নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার প্রিয় কিছু পাপের কাছে আমি বন্দি হয়ে আছি

নাভিদ কায়সার রায়ান

তৃতীয় ধরণের পাগল হল সেয়ানা পাগল। এটা সবচেয়ে কঠিন ধরণের পাগলামি। এই পাগল কি সুস্থ না অসুস্থ সেটা বোঝা খুব কঠিন। যখন সে পাগলামি করছে তখন তার কাজকারবার হবে সুস্থ মানুষের মতো। জটিল সব যুক্তি দিয়ে সে তার পাগলামি প্রতিষ্ঠিত করবে। আবার যখন সে সুস্থ থাকবে তখন তার চিন্তা ভাবনা হবে পাগলের মতো। অফিসে এবং বাসায় নিয়মিত ভাবে আমি এই পাগলের ভূমিকায় অভিনয় করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমার কাছে ভালোই লাগে। শুধু মাঝে মধ্যে আমার মাথার মধ্যে জ্যোৎস্না ঢুকে পড়ে। তখন খুব অস্থির লাগে। কেন লাগে জানি না। আপনারা কেউ কি জানেন?

নাভিদ কায়সার রায়ান › বিস্তারিত পোস্টঃ

আবার তোরা মানুষ হ

০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১১:৪৪

(১)



অফিসের ক্যান্টিনে ঢুকতে গিয়ে কোনার দিকে একটা টেবিলকে ঘিরে থাকা সাত আট জনের জটালাটা জামালের চোখে পড়ে। একটু থমকে চেহারায় স্বভাব সুলভ গাম্ভীর্য নিয়ে ভীড়টাকে এড়িয়ে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যায় সে। দুপুরে সবসময় সে একটু দেরি করে ক্যান্টিনে আসে যেন নির্ভেজালে লাঞ্চটা সারা যায়। কিন্তু গত কয়দিন ধরে লাঞ্চ টাইমে হইহল্লা করে এই ছাগলগুলো তাকে জ্বালিয়ে মারছে। বিরক্তিকর ব্যাপার। কোথাও গিয়ে যদি একটু শান্তি পাওয়া যেতো!

গত কয়দিনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সারা দেশ উত্তাল হয়ে আছে। প্রথাগত রাজনীতির বিরুদ্ধে দেশের জনমানুষ যেন হঠাৎই ক্ষেপে উঠেছে। এমুহূর্তে সবচেয়ে উত্তেজিত হয়ে আছে সম্ভবত ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা। পুলিশের লাথি গুঁতো খেয়েও ওরা দমে যায়নি। ফাঁক পেলেই এখানে ওখানে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। হতাশার ব্যাপার হলো দু’একটা স্লোগান দেবার আগেই সেখানে র্যা ব-পুলিশ এসে হাজির হচ্ছে। সাময়িক উত্তেজনার এখানেই সমাপ্তি ঘটছে। থেকে থেকে আগুনের ফুলকি জ্বলে ওঠে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। জোরালো নেতৃত্বের অভাব ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

এর মধ্যে দেশের রাজনৈতিক নেতারা এই আন্দোলনকে বিভিন্ন ভাবে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। আর দেশের বেআক্কেল জনগণ হাঁ করে দেখছে কিভাবে তাদের সাধের আন্দোলন বেহাত হয়ে যাচ্ছে। কারো যেন কিছু করার নেই। জামালের খুব বিরক্ত লাগে এই সব।

যথারীতি সেই উত্তেজনার হাওয়া মাঠ ঘাট, নদী নালা, চায়ের দোকান পেরিয়ে এখন এই কর্পোরেট অফিসের ক্যান্টিন পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। অফিসে সেই উত্তেজনার আগুন উস্কে দিচ্ছে আসাদ নামের এক গাধা। এমনিতে আসাদ ভাল ছেলে। সারাক্ষণ ভ্যাব্দার মতো হাসে। অল্প কিছুদিন হলো চাকরী করছে। ছেলেমানুষী কথাবার্তায় বোঝা যায় এখনো দুধ দাঁত পড়েনি। শুধু আসাদ বাদে অফিসের কাউকেই সে সহ্য করতে পারে না। দুঃখের বিষয়, গাধাগুলো তার বিরক্তির ব্যাপারটা ধরতে পারে না। কেন পারে না সেটাও একটা রহস্য।

জামাল “একলা চলোরে” নীতিতে বিশ্বাসী। বিভিন্নভাবে সেজন্য সে চেষ্টা করেছে এই ছেলেটা যেন তার আশেপাশে ভিড়তে না পারে। কিন্তু তার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে আসাদ তার পিছে আঠার মতো লেগে আছে। কারণ, তরুণদের একাংশের আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা লেলিন আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধু। আসাদ লেলিন বলতে অজ্ঞান। লেলিনের ব্যাপারে আরো জানার জন্যই আমার উপর এতো অত্যাচার। এমন ভাবে এসে জিজ্ঞেস করে “না”-ও বলা যায় না সব সময়। আসলে সে কাউকেই “না” করতে পারে না। মুখে বিরক্তির ছাপ নিয়েও সে অনুরোধে আস্ত ট্যাংক পর্যন্ত গিলে ফেলেছে এমন ইতিহাসও আছে।

ওদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় আড় চোখে দেখল অফিসের যত সব নিষ্কর্মা আর অকর্মের ধাড়ীরা আজকের পেপারটার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। বিরক্তিতে নাকটা কুঁচকে আসে জামালের। “গাধার বাচ্চা একেকটা”।

দ্রুত খাবারের বাটি আর প্লেটটা নিয়ে জামাল ওদিক থেকে সরে আসে। ওদের দিকে পিঠ দিয়ে একটা খালি টেবিল দেখে বসে পড়ে। এক হাতে খেতে খেতে আরেক হাতে মোবাইলের স্পর্শকাতর পর্দায় আঙ্গুল বুলিয়ে ইন্টারনেটের গভীরে হারিয়ে যেতে থাকে।

“আরে জামাল ভাই! আপনি এখানে? কখন এলেন?”

আচমকা আক্রমণে মুখ তুলে দেখে একাউন্টসের রফিক তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। খুব উৎফুল্ল ভঙ্গিতে তার সামনে পেতে রাখা চেয়ারে বসে পড়ে রফিক। ওর সাথে আরো দু’তিন জন জামালকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল। রফিককে বসতে দেখে ওরা আর দাঁড়ালো না। গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করতে করতে চলে গেল। জামাল বুঝতে পারে এরাই এতক্ষণ জটলা পাকিয়ে ওখানে বসে ছিল।

খাওয়া বাদ দিয়ে রফিকের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে জামাল। বিষয়টা কি? এটা আবার কোন উৎপাত? রফিকের দিকে তাকিয়ে জামাল জিজ্ঞেস করে,

“কোন সমস্যা?”

“সমস্যা?! হা! হা! হা!! কি যে বলেন!” রফিকের মুখের হাসি বিস্তৃত হয়। “আপনি আছেন আপনার সমস্যা নিয়ে। আরে মিয়া, আন্দোলনের যে চৌদ্দটা বেজেছে সেই খবর রাখেন? সব শেষ!”

“কেন, কি হয়েছে? ”

“কি আর হবে, এই দেশে ভালো কিছু কখনো টিকতে পারবে না, বুঝলেন? আমরা ভেবেছিলাম এবার বোধহয় দেশে একটা পরিবর্তন আসবে। আফটার অল এতো দিনে দেশের ছাত্ররা খেপেছে। এটা কি কম কথা? কত আশা করেছিলাম এই আন্দোলনের ফলে হয়ত দেশটা থেকে ঘুস, দুর্নীতি, রাজনীতির ব্যাবসা হয়ত এবার বন্ধ হবে। কিসের কি? সব গেল।”

“কেন, আন্দোলন তো চলছে।”

“ধুর মিয়া। একে কি আন্দোলন বলে? গ্রুপিং দিয়ে আন্দোলনের জগা খিচুড়ি পাকিয়ে গেছে। আর আপনার ওই ফ্রেন্ড লেলিন তো নিশ্চিত যে কোন দিন মার্ডার হয়ে যাবে।”

কথাটা শুনে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। মাথা তুলে রফিকের দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকালাম।

আমার চেহারা দেখে রফিক আমতা আমতা করে বলল, “আরে ভাই, আপনি তো দেখি সিরিয়াস হয়ে গেলেন। আপনার সাথে একটু মজা করছিলাম আরকি। হা হা হা।”

হাসি থামিয়ে মাথা নিচু করে ষড়যন্ত্রকারীদের গলায় বলল, “ এদিকে অফিসে কি চলছে জানেন নাকি?”

“নারে ভাই জানি না। ভাই রে, আপনি তো মহা বিরক্ত করছেন। শান্তিতে একটু খেতে দেন।”

জামালের অজ্ঞানতায় অবাক হয়ে রফিক জিজ্ঞেস করে, “আপনি কিছুই জানেন না?”

জামাল অমায়িক হেসে বলে, “না ভাই। আমি কিছুই জানি না। জানার ইচ্ছাও নাই।”

“আপনি জানেন না, আসাদের চাকরী চলে গেছে?”

“হোয়াট?”

“হ্যাঁ। ”

“কিন্তু কেন?”

“আপনি তাহলে আসলেই কিছু জানেন না?”

গাধাটা বলে কি? আসাদের সাথে না সেদিনও কথা হল। এর মধ্যে আবার কি থেকে কি হয়ে গেল। জামালের চোখের তারায় কৌতূহল দেখে রফিক মাথাটা নিচু করে একটু এগিয়ে নিয়ে এসে বলে,

“গোপন সূত্রে খবর পেয়েছি। আসাদের সাথেই আর একটা মেয়ে কাজ করে না, তামান্না না কি যেন নাম?”

“হ্যাঁ চিনি তো। ভালো মেয়ে।”

“আরে রাখেন আপনার ভালো মেয়ে।“ টেবিলে একটা চাপড় মেরে হেলান দিয়ে বসে রফিক।

“আপনার সেই ভালো মেয়ে আর ওই নতুন ছেলে আসাদ, দু’জনে মিলে নাকি জমিয়ে প্রেম প্রেম খেলছিল। প্রেম করবি ভালো কথা। তাই বলে অফিসের কাজে ফাঁকি দিয়ে যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াবি তা কি হয়? এসব দেখে কে যেন অ্যাডমিনে লাগিয়েছিল। পরে অ্যাডমিন গোপনে তদন্ত করে দেখেছে ঘটনা সঠিক। সাথে সাথে আসাদের চাকরী নট। তামান্নারটাও যেত, কিন্তু কোন এক মহলের সুপারিশে এ যাত্রা বেঁচে গেছে।”

আশ্চর্য ব্যাপার। এতো কিছু হয়ে গেল আর আমি জানতেই পারলাম না? তামান্না আর আসাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ যে সম্পুর্ন মিথ্যা সেটা আমি ভালো করেই জানে। তামান্না আর আসাদ একই টিমে কাজ করে। তামান্না দেখতে বেশ সুন্দরী। একটু ঢং করে কথা বলে কিন্তু এমনিতে মেয়েটা ভালো। একবার দেখলেই ওকে যে কারো ভালো লেগে যাবে। আসাদ যে কপাল গুনে ওর সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়ে গেছে তাতে অফিসের অনেকেই ঈর্ষান্বিত ছিল। ওদের মধ্যেই যে কেউ গিয়ে আসাদের নামে মিথ্যা অপবাদ লাগিয়েছে সে ব্যাপারে জামাল শতভাগ নিশ্চিত।

“আরে, কি হল জামাল ভাই? আপনি এতো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন কেন?”

রফিকের কথায় সম্বিদ ফেরে জামালের। মাথা নেড়ে বলে,

“নাহ। এমনিতেই। হঠাৎ করে এমন একটা খবর শুনলাম তো তাই একটু চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম।”

“হা হা হা। হ্যাঁ হ্যাঁ, তাতো হবেই। আসাদ তো আবার আপনার খুব ক্লোজ ছিল। আচ্ছা থাকেন তাহলে। আমি যাই।” বলে চেয়ার ছেড়ে কিছুদুর গিয়ে আবার ফিরে এসে নিচু গলায় বলল, “ জামাল ভাই, এই সপ্তাহে আপনার টাকাটা দিতে পারছি না। আগামী সপ্তাহে দিয়ে দিব ইনশাআল্লাহ্‌। আর, যা যা বললাম সেটা একটু গোপন রাখবেন। বোঝেনই তো কলি যুগ। কোন কথা কোথায় গিয়ে লাগায় তার ঠিক আছে? কাউকেই বিশ্বাস করার উপায় নাই।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, তাতো বটেই।“

কথা শেষ করে রফিক চলে যায়। জামাল বিমর্ষ মুখে রফিকের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কলি যুগ, না? এটা শুধু কলি যুগ না, এটা কৃষ্ণ কলি যুগ। কলি যুগের বাপ।

খাওয়া শেষ করে প্লেট রেখে বেসিনে হাত ধোবার সময় ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার সালাম তার পাশে এসে দাঁড়ায়। আয়নাতে চোখাচোখি হওয়াতে মাথা নেড়ে কুশল বিনিময় করে দু’জন। হাত ধোয়া শেষ করে সালাম তার দিকে ফিরে বলে,

“জামাল ভাই, রফিক সাহেবের কাছ থেকে একটু দূরে থাকবেন।”

“কেন?”

“রফিক সাহেব আপনাকে কি বলে গেল সেটা আমি সবই শুনেছি। এই রফিক সাহেবের কমপ্লেনের কারনেই কিন্তু আসাদের চাকরীটা গেল।”

“কি সর্বনাশ! বলেন কি?”

“হ্যাঁ। অ্যাডমিনের শাহরিয়ার আমাকে বললো। রফিক সাহেব নাকি সরাসরি উপর লেভেলে কথাটা লাগিয়েছে। তবে ঘটনায় কিছুটা হলেও সত্যতা আছে। আসাদ নাকি মেয়েটাকে প্রপোজ করেছিল।”

কথাগুলো শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।

সালাম সাহেব স্বল্পভাষী লোক। কথা আর না বাড়িয়ে কাজে চলে গেল। আমিও ডেস্কে চলে এলাম। বিকেলের দিকে তামান্নার খোঁজ নিয়ে জানলাম, তামান্না তিন দিনের ছুটিতে আছে।



(২



অফিস শেষ করে ফিরতি পথে শাহবাগ নেমে গেলাম। অনেক দিন টি.এস.সি তে যাই না। আমার বন্ধুরা নাকি আজকাল প্রায়ই এখানে আড্ডা দিচ্ছে। দেশের চলমান পরিস্থিতিতে রাজা-উজির মারার জন্য টি.এস.সির তুলনা হয় না। আগে রাইফেলস স্কোয়ার, জিয়া উদ্যান, রবীন্দ্র সরোবর মুক্তমঞ্চ কিংবা চুন্নু মিয়ার চায়ের দোকানে সবাই জড়ো হলেও এখন আড্ডার ভেন্যু চেঞ্জ হয়েছে।

শাহবাগ নেমে আমি কি মনে করে আসাদকেই প্রথমে ফোন দিলাম। বেশ কয়বার রিং হবার পর আসাদ ফোন ধরল,

“আরি! জামাল ভাই! হঠাৎ কি মনে করে? কেমন আছেন?”

“আছি ভালোই। তুমি কোথায়?”

“আমি আছি জিগাতলা। আপনি কি এদিকেই নাকি?”

“আমি শাহবাগ আছি। তুমি এদিক আসলে একবার ফোন দিয়ো। আমি আটটা নয়টা পর্যন্ত আছি।”

“আপনি শাহবাগে? ওকে বস, আমি আধা ঘন্টার মধ্যে আসছি।”

কথা শেষ করে আমি একটা রিকসা নিয়ে টি.এস.সি চলে এলাম। ওখানেই রাস্তার উল্টো দিকে আইল্যান্ডে দোস্তদের আড্ডা মারতে দেখলাম। আমাকে দেখে সবুজ এগিয়ে এসে হাত ধরে আড্ডার মাঝখানে নিয়ে যায়। নিশ্চয়ই কোন বদ মতলব আছে। সবুজের সব কিছুতেই ফাইজলামী করা চাই। আমাকে মাঝখানে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“হ্যাঁ এইবার তুই বল, তুই আস্তিক না নাস্তিক?”

“মানে?”

“মানে, তুই তো নামায রোজা কিছুই করিস না। কিন্তু তারপরও কি তুই সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করিস?”

“হ্যাঁ করি।”

সবুজ এক হাতের তালুতে অন্য হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে আঘাত করে চটাস করে একটা শব্দ করে একটু লাফিয়ে উঠে বলে,

“এইতো দ্যাখ। এরি নাম বিশ্বাস। এর জন্য অত ক্রিয়াকর্মের দরকার হয় না। অতো প্রমাণেরও দরকার হয় না।”

আমি কিছু বুঝতে না পেরে একটা ফাঁক দেখে বসে পড়লাম। লেলিনও আছে দেখলাম। ভুশ ভুশ করে সিগারেট টানছে। আমাকে দেখে সিগারেটের প্যাকেটটা এগিয়ে দিল। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে সবুজকে বললাম,

“কিরে, আমি তো কিছুই বুঝতে পারলাম না। কিসের আস্তিক, নাস্তিক। একটু খুলে বল।”

আমার কথায় সবুজ উৎসাহ পেয়ে বলে চলল,

“সম্মানিত শ্রোতাবৃন্দ এবং আড্ডাবাজ বন্ধুরা। আমাদের এসে উপস্থিত হয়েছেন হার্ডকোর জামাল। লেট করে আসার জন্য তিনি আড্ডার মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছেন না। এজন্য উনাকে একটু ডেমো দিতে হবে। ডেমো দেয়ার জন্য জামালের পক্ষ থেকে সবার জন্য এক কাপ চা!!!”

বাহ সকাল সকাল সিল খাওয়া শুরু হয়ে গেল। পিচ্চি ছেলেটাকে দেখে চায়ের অর্ডার দিয়ে বললাম,

“হ্যাঁ, এইবার বল। তোর চা আসছে।”

সবুজ হাত পা নেড়ে বলতে থাকে,

“আমাদের মানবতাবাদী ফারজানা ম্যাডাম আজকে একটি অত্যান্ত জটিল প্রশ্ন করেছেন, আমাদের ধর্ম নাকি নারীদের অবমাননা করেছে। ধর্ম ব্যাপারটাই নাকি সেকেলে আর পুরুষতান্ত্রিক। উনার বক্তব্য অনুসারে আধুনিক যুগের নারীদের জন্য কোন ধর্মই প্রযোজ্য না। আমাদের মহান নারী জাতি আজ পাখা মেলে আকাশে উড়তে চায়, আর আমরা নাকি ধর্মের দোহাই দিয়ে তাদের ঘরে বন্দী করে রেখেছি।”

আমি মাঝখান থেকে বলে উঠলাম,

“তো, তুই বন্দী করে রেখেছিস কেন? ছেড়ে দে। ছেড়ে দিলেই তো সুবিধা। মেয়েদের আমও যাবে ছালাও যাবে। আর আমরা সেই আম, ছালাতে ভরে বাসায় নিয়ে এসে বউকে খাওয়াব। আমাদের আমও থাকল ছালাও থাকল। বাইরেও মজা নিলাম আবার বাসাও ঠাণ্ডা রাখলাম।”

আমার মন্তব্যে সবাই আবার হই হইকরে ওঠে। আবার তর্ক বিতর্ক শুরু হয়।

আমি একটু সরে লেলিনের দিকে চলে আসি। এর মধ্যে চা চলে আসে। চায়ের সাথে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করি,

“কিরে তোদের আন্দোলনের কি অবস্থা? দেশটাকে বদলাতে পারবি তোরা শেষ পর্যন্ত?”

“আরে ধুর! বাদ দে তো ওই সব কথা। আর ভাল্লাগেনা।“

“কেন কি হয়েছে?”

“অনেক পলিটিক্যাল প্রেসারের মধ্যে আছি। তুই তো জানিস, ক্যাম্পাসে থাকতে এক দলের হয়ে রাজনীতি করেছিলাম। সেটাই আমার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যতই নিরপেক্ষ হয়ে কাজ করি না কেন, শেষ পর্যন্ত আমাকে শুনতে হয় আমি অমুক দলের দালাল। আমার অনেক ঘরের লোকই এসব কথা বলে সবার কান ভারী করে বেড়াচ্ছে। বাইরের কথা আর কি বলবো।”

হতাশায় মাথাটা এদিক ওদিক নাড়তে থাকে লেলিন। আমি ওর ঘাড়ে হাত দিয়ে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করি।

“আরে, এসব আন্দোলনে গেলে ঝামেলা একটু আসবেই। তাতে কি আর থেমে থাকলে হবে? তুই লড়াই চালিয়ে যা। আমরা আছি তোর সাথে।”

মাথাটা তুলে সেই চির চেনা ছেলেমানুষি হাসি হাসে লেলিন।

“দোস্ত তোরা তো মাঠে নামিস না। তাই ব্যাপারটা বুঝিস না। আমার সাথে একটা গ্রুপ কাজ করে, এরা পুরোপুরি ফ্রীক। কিন্তু কি করবো, ভালো ছেলে তো হাতে পাইনা। যে কয়টা পাই সব ওই ক্যাটাগরির। পোলাপান না থাকলে আন্দোলন হবে কি দিয়ে?”



পেপার পত্রিকার মাধ্যমে বিষয়টা আমিও জানতে পেরেছি। লেলিন একটু চুপ করে বলল,

“দেশটা মরে যাচ্ছেরে দোস্ত। দুঃখের বিষয় সেদিকে কারো খেয়াল নেই। দেশ নিয়ে কারো চিন্তা ভাবনা নেই। সবাই আছে যার যার ধান্দায়। আমি আর দিদার মিলে একসময় কত কি চিন্তা করতাম দেশটাকে নিয়ে। কিছুই করতে পারলাম না।” লেলিনের বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

আমি বসে বসে ভাবি, লেলিনের এই দীর্ঘশ্বাস কি শুধু ওর একার? নাকি এই বাংলার প্রতিটি মানুষের?

লেলিন বলতে থাকে,

“দিদার ও নাকি আজকাল আমার নামে উল্টা পাল্টা বলে বেড়ায়। মাঝে মাঝে বুঝে উঠতে পারি না। কি লাভ হল এসব করে? দিদারটাকে যদি এই সময়টায় পাশে পেতাম! হারামজাদা বেঈমানটা আজকাল খুব রাজনীতি শিখেছে। দেশটা না থাকলে কি করবি রাজনীতি দিয়ে? ধুয়ে পানি খাবি?”

আমি খুব মন দিয়ে লেলিনের কথাগুলো শুনছিলাম। দিদার আমাদের আরেক বন্ধু। একসময় খুব ক্লোজ একটা গ্রুপ ছিলাম আমরা। রাজনীতিতে নামার পর লেলিনের সাথে কি একটা বিষয় নিয়ে দিদারের ঝগড়া হয়। আর সেখান থেকেই বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। সেই ফাটল আজো জোড়া লাগেনি। অবস্থা এখন এমন যে, লেলিন আছে যেখানে দিদার নাই সেখানে।

এমন সময় আসাদের ফোন আসে,

“হ্যালো, বস। আপনি কোথায়? আমি তো শাহবাগ চলে এসেছি।”

“তুমি এক কাজ কর, টি.এস.সি.র কাছা কাছি এসে ফোন দাও।”

“ওকে” বলে আসাদ ফোন কেটে দিল। কিছুক্ষণ পর বাইকে করে আসাদ আসলো। হাত দিয়ে ইশারা করে এদিক আসতে বললাম। আমি কথা বলার জন্য আড্ডা থেকে উঠে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম।

“তো, কেমন চলছে দিনকাল তোমার?” জিজ্ঞেস করলাম আসাদকে

আসাদ হাসি মুখে জবাব দেয়, “এই তো ভালো আছি ভাইয়া। শুনেছেন তো বোধ হয়...”

“হ্যাঁ, সেই জন্যই তো তোমাকে এখানে ডাকলাম। কি হয়েছিল বলতো?”

“কিছু না ভাইয়া।”

“আরে বল। সমস্যা নেই।”

“আরে, সেদিন আমার কি যেন হয়েছিল। তামান্নাকে দেখে সেদিন এতো ভালো লাগছিল যে নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারিনি। সকালে দশটার দিকে কফি শপে ওকে নিয়ে গিয়েছিলাম কফি খাবার জন্য। সেখানেই ওকে প্রপোজ করে বসেছি।”

“কি সর্বনাশ! কিন্তু তামান্না তো ম্যারেড।”

“হ্যাঁ জানি।”

“তারপর?”

“তারপর আর কি? এই ব্যাপারটা নিয়ে তামান্না আমার উপর খুব আপসেট হয়। কান্না কাটি শুরু করে। আমি সরি টরি বলে ওকে বোঝানর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। রীতিমতো নাটক। অফিসের দুই এক জন বোধ হয় ব্যাপারটা দেখেছে। দেখে কি থেকে কি বুঝেছে আল্লাহ্‌ই জানে। অফিসে আমার নামে উল্টা পাল্টা কি কি যেন বলেছে। তারপরের কাহিনী তো আপনি জানেনই...”



আসাদের কথা বার্তা শুনেতো আমার চক্ষু চড়ক গাছ। বলে কি এই ছেলে? দেখে তো বোঝা যায় না তলে তলে এই ছেলে এতদুর যেতে পারে। তাই বলে একটা ম্যারেড মেয়েকে তুই প্রপোজ করবি? এতো দেখি বাঘের বাচ্চা!



মনের কথা মুখে বলতে পারলাম না। বরং করুনার দৃষ্টি নিয়ে ওকে কিছু সান্ত্বনার বানী শোনাতে যাচ্ছিলাম। তখন দেখি আসাদ স্থির দৃষ্টিতে লেলিনের দিকে তাকিয়ে আছে।

“ওইটা লেলিন ভাই না?”

“হ্যাঁ। কেন?”

“লেলিন ভাইয়ের জন্য আমার একটা ম্যাসেজ আছে।”

“লেলিনের জন্য ম্যাসেজ? কে পাঠিয়েছে?”

“দিদার ভাই।”

আমি চমকে উঠে জিজ্ঞেস করি, “কে?”

“দিদার ভাই।”

বিস্ফোরিত নেত্রে আমি জিজ্ঞেস করি, “তুমি দিদারকে চেন কিভাবে?”

“আরে, দিদার ভাইকে কে না চেনে। উনি তো আমাদের গুরু।”

“কি ম্যাসেজ? বল তো!”

মানি ব্যাগের ভেতর থেকে একটা কাগজ বের করে আসাদ।

“দিদার ভাই বলেছে এটা শুধু মাত্র লেলিন ভাইকে দেয়ার জন্য। অন্য কাউকে না।”

আমি হাত ধরে আসাদকে লেলিনের সামনে নিয়ে আসি। উত্তেজনায় আমার তখন বুক কাঁপছে। এতদিন পর আমাদের হারিয়ে যাওয়া বন্ধু আমাদের খোঁজ করছে। কি লিখেছে ওই কাগজে জানার জন্য বুকটা আইঢাই করতে থাকে।

“অ্যাই লেলিন, একটু শুনে যা।” আমি লেলিনকে ডেকে এক পাশে নিয়ে এলাম।

প্যান্টের ময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে আসে লেলিন।

“কিরে, কি ব্যাপার?”

“এই ছেলেটা তোর জন্য একটা ম্যাসেজ নিয়ে এসেছে।” কথাগুলো বলার সময় উত্তেজনায় নিজের হার্টবিট শুনতে পাচ্ছিলাম আমি।

“কিসের ম্যাসেজ?” লেলিন ভ্রু কুঁচকে তাকায় আসাদের দিকে। “এই ছেলেটা কে?”

“আসাদ। আমার অফিসের কলিগ। খুব ভালো ছেলে। একটা ম্যারেড মেয়েকে প্রপোজ করে কদিন আগেই চাকরী হারিয়েছে।” ইমোশনাল হয়ে কি বলতে কি বলছি কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।

আমার কথার মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে ও অবাক হয়ে একবার আমার দিকে আর একবার আসাদের দিকে তাকাল।

“দিদার তোকে একটা ম্যাসেজ পাঠিয়েছে।”

“দিদার?”

লেলিনের চোখের অবিশ্বাসের দৃষ্টিটা দেখে খুশীতে আমার চোখে পানি চলে আসে। আসাদ হতভম্ব লেলিনের দিকে কাগজটা বাড়িয়ে দেয়।

কাগজটায় কি যেন একটা লেখা, অন্ধকারে বোঝা যায় না। মোবাইলের আলো পড়তেই দিদারের হাতের লেখা স্পষ্ট হয়ে আসে। একটা কবিতা লেখা –



কীসের শোক করিস ভাই –

আবার তোরা মানুষ হ’।

গিয়াছে দেশ দুঃখ নাই, —

আবার তোরা মানুষ হ’।।

পরের পরে কেন এ রোষ,

নিজেরাই যদি শত্রু হস্?

তোদের এ যে নিজেরই দোষ –

আবার তোরা মানুষ হ’।

ঘুচাতে চাস যদি রে এই

হতাশাময় বর্তমান;

বিশ্বময় জাগায়ে তোল্

ভায়ের প্রতি ভায়ের টান;

ভুলিয়ে যা রে আত্মপর,

পরকে নিয়ে আপন কর্;

বিশ্ব তোর নিজের ঘর –

আবার তোরা মানুষ হ’।

শত্রু হয় হোক না, যদি

সেথায় পাস মহৎ প্রাণ,

তাহারে ভালো বাসিতে শেখ্,

তাহারে কর্ হৃদয় দান।

মিত্র হোক – ভণ্ড যে –

তাহারে দূর করিয়া দে;

সবার বাড়া শত্রু সে, —

আবার তোরা মানুষ হ’।

জগৎ জুড়ে দুইটি সেনা

পরস্পরে রাঙায় চোখ;

পুণ্য সেনা নিজের কর্,

পাপের সেনা শত্রুর হোক;

ধর্ম যথা সেদিকে থাক্,—

ঈশ্বরেরে মাথায় রাখ্;

স্বজন দেশ ডুবিয়া যাক –

আবার তোরা মানুষ হ’।।

বন্ধু,

দেশটার জন্য তো কিছুই করতে পারলি না। নিজেও পারবি না আবার আমার হেল্পও নিবি না। খুব দেমাগ হয়েছে তোর বুঝতেই পারছি। কবিতাটা পরার পর থেকেই তোর দেমাগ দেখতে খুব ইচ্ছা করছে। দেখা হচ্ছে তাহলে শীঘ্রই।

তোর দোস্ত,

দিদার





============================================



"কীসের শোক করিস ভাই"

কবিতাটা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সকাল ৮:২২

মামুন রশিদ বলেছেন: সমসাময়িক ব্যাপার নিয়ে সুন্দর গল্প । শেষের কবিতাটাও ভাল হয়েছে ।

+

২| ০২ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:৪৪

নাভিদ কায়সার রায়ান বলেছেন: ধন্যবাদ মামুন ভাই!

"কীসের শোক করিস ভাই"
কবিতাটা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.