নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ছোট থাকতে পছনদো করি

নাঈম ফয়সাল নয়ন

সত্য কে সত্য আর মিথ্যা কে মিথ্যা বলার চেষ্টা করি

নাঈম ফয়সাল নয়ন › বিস্তারিত পোস্টঃ

আলাদীনের নূপুর

১১ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:২২



“কাকা, নুপুর জোড়া আছে?”
দোকানদার কে জিজ্ঞাসা করলো আলাদীন। আলাদীনের বয়স ২৮ থেকে ৩০ এর ভিতরেই হবে। গোলগাল শান্তশিষ্ট সহজ সরল চেহারা। মানুষের চেহারার সাথে চরিত্রের মিল খুব বেশি দেখা না গেলেও আলাদীনের চেহারা ও চরিত্র একদম এক সুতোয় গাথা। আবার গল্পের নায়কের সাথে নিজের নাম মিলিয়ে বা হুবহু রাখলেই যে নায়ক হওয়া যায়না তারও জ্বলন্ত প্রমাণ বহন করে চলেছে সে। নাম ‘আলাদীন’ হওয়া সত্বেও প্রদীপের জিনের বদৌলতে বিলাসী জীবন যাপনের পরিবর্তে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে চলেছে দারিদ্রতার সাথে। তবে মৃত্যুর আগে একটা পিতলের প্রদীপ উপহার পেয়েছিল সে তার বাবার কাছ থেকে। বাবা বলেছিল -
“বরই সাধ কইরা তর নাম রাখছিলাম ‘আলাদীন’। ভাবছিলাম তুই জন্মানির পর আমগো সব দুক্কু দূর হইয়া যাইবো।”
দুঃখ তো দূর হয়নি বরং তিনি মরে যাবার পর থেকে আরও বেহাল দশা তার সংসারের।
দোকানদার আলাদীনের দিকে নিদারুন বিরক্তি নিয়ে তাকালেন, তারপর ঠান্ডা মাথায় কাছে ডেকে বললেন -
“আচ্ছা বাপু, তোমার কি সমস্যা বলো তো?”
“না… ইয়ে .. মানে..”
“কি না মানে? আমি তো তোমাকে কথা দিয়েছি যে, ওই নূপুর জোড়া আমি কারো কাছে বিক্রি করবো না!! তার পরেও রোজ এভাবে কেন বিরক্ত করতে আসো বলো তো?”
“জী আচ্ছা ঠিক আছে। আমি ভীষণ দুঃখিত!!”
বলে খুশি মনে কসমেটিকের দোকান থেকে বের হয়ে যেতে চাইলো আলাদীন, কিন্তু দোকানদার পিছন থেকে ডাকতেই আবার ফিরে এলো সে। দোকানি বললেন -
“বলি নূপুর জোড়া নিয়ে যাও। যেদিন মাইনে পাও সেদিন এসে টাকা দিয়ে যেও। দাম তো বেশি না, মাত্র আড়াইশো টাকা!! আচ্ছা .. আচ্ছা ঠিক আছে তুমি নাহয় দুশোই দিও।”
আলাদীন খুব করুন কন্ঠে বলল -
“না কাকা। ওই বাকী বর্গা আমার সয়না। মাইনে পেলেই এসে নিয়ে যাবক্ষণ। আপনি শুধু ওটা বিক্রি করবেন না। নূপুর জোড়া আমার খুব মনে ধরেছে। এরকম নূপুর আরো থাকলে কোন চিন্তায় করতাম না আমি। এক জোড়ায় আছে কিনা তাই…”
“আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো। আমি বেচেঁ থাকতে তোমার এই নূপুর অন্য কারো হাতে যাবেনা।”
বললেন দোকানদার কাকা। আলাদীন খুশি মনে বের হয়ে গেল দোকান থেকে। আজ মাসের ২৩ তারিখ। আর তো মাত্র এক সপ্তাহ! তার পরেই মাইনে পেয়ে নূপুর জোড়ার মালিকানা অর্জন করবে সে। এরপর সেই মালিকানা পরিবর্তন করে রজিনার হাতে তুলে দেবে ভালবাসার উপহার স্বরূপ। তার পিছনেও অবশ্য বিশেষ কারণ রয়েছে।
সদ্য কেনা নতুন এক জোড়া রূপোর নূপুর পায়ে দিয়ে বান্ধবীদের সাথে পুকুরে গোসল করতে নেমে হারিয়ে ফেলেছিল রজিনা। তারপর আম বাগানের কোনায় গোপনে আলাদীনের সাথে দেখা করতে এসে নূপুর জোড়ার শোকে তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই ফেলেছিল সে!! এই বাগানের সব থেকে বড় গাছটার গোড়ালিতে বসে রোজ দেখা করে তারা। আলাদীন তখন হোহো করে হেসে মুছে দিয়েছিল রজিনার চোখের পানি… আর বলেছিল-
“এ মাসের বেতন পেয়ে সবথেকে ভালো নূপুর কিনে দেব তোমাকে।”
এরপর অবশ্য আলাদীন গোপনে গভীর রাতে ওই পুকুরে ঘন্টার পর ঘন্টা ডুব দিয়ে হাতরে অনেক খুঁজেও মেলাতে পারেনি রজিনার নূপুর জোড়া। তাও একদিন নয়!! কনকনে এই শীতের রাত্রেও টানা ৩ দিন ধরে খুঁজে ব্যর্থ হয়েছে সে।
রজিনার সাথে আলাদীনের আজ ২ বছরের প্রেম। অনেক সাধের প্রেম। সহজ সরল কিন্তু চঞ্চল এই মেয়েটিকে দেখলেই যে কেউ প্রেমে পরে যেতে পারে, তাই কাউকে আর সে সুযোগ না দিয়ে নিজেই সবার আগে প্রস্তাব করে বসলো আলাদীন, এবং সফলও হল। কিন্তু এই সফলতার সুখ এতটাই মধুর আর তীব্র ছিল যে, এর পরিনতি সম্পর্কে ভাবনা টা ভুলেই গিয়েছিল সে। কেননা রজিনা তো আর তার মত কোন হতদরিদ্র পরিবারের কন্যা নয়!! বরং গ্রামের ৫ জন ধনী ব্যক্তির এক জনের একমাত্র কন্যা রজিনা। ফলেই এ সম্পর্কের বাস্তবায়ন প্রশ্নের মুখেই রয়ে যায়।
অনার্স কম্প্লিট করার পরপরই বাবার অকাল মৃত্যুর দরুন লেখাপড়াটা আর শেষ করা হয়নি আলাদীনের। মা, আর ক্লাস ফাইভ পড়ুয়া ছোট বোনটার সমস্ত দ্বায়িত্ব এসে পরলো তার কাধেঁ। ফলে গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে তিন হাজার টাকা বেতনের চাকরি করতে বাধ্য হয় সে। তবুও শিক্ষকতাকে সে কখনোই ছোট চোখে দেখেনি। কিন্তু স্বল্প বেতনের অভাবী আলাদীনকে ছোট চোখে দেখতো গ্রামের অনেকেই।
যাইহোক, বেতনের দুইদিন আগে মনের ভিতরে কেমন খচখচ করায় নিশ্চিন্ত হবার জন্য দোকানটার দিকে আবারো রওনা দিল আলাদীন। কিন্তু এবার আর দোকানের ভিতরে ঢুকলো না সে। দূর থেকে চোরের মত দেখলো কাচের দেয়ালে ঝুলছে তার নূপুর জোড়া। দেখেই এক বুক আনন্দ ও প্রফুল্লতা নিয়ে টান দিয়ে চলে গেল সাইকেলে করে।
আজ বেতনের দিন। সকাল থেকেই একটা চাপা আনন্দ ও উত্তেজনা কাজ করে চলেছে আলাদীনের ভিতরে। সামান্য দুশো টাকার এক জোড়া নূপুর সে তার প্রেমিকা কে দেবে এটা তার আনন্দের বিষয় বস্তু নয়। বরং গত দুই বছরে রজিনার কাছ থেকে অনেক উপহার পেলেও এই প্রথম বারের মত সে রজিনা কে কিছু একটা দিতে চলেছে। যে আনন্দ লেপ্টে রয়েছে তার চোখেমুখে। আজ তার মন অনেক ভালো। কোন ছাত্রের উপর তার কোন রাগ নেই, পড়া না পারলেও আজ সে কাউকেই শাসাতে পারছে না। হৃদয়ের কোনে কি ভিষণ আনন্দ … আচ্ছা এ ধরনের কোন আনন্দকে কেন্দ্র করেই কি কবি বলেছিলেন -
“আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে …”
বেতনের টাকা হাতে পাওয়া মাত্রই হেড স্যারের কাছ থেকে বিশেষ ছুটি নিল আলাদীন। গত দুই বছরে এটাই তার প্রথম ছুটি, তাই হেড স্যার হাসি মুখেই গ্রহণ করলেন। তারপর সাইকেলটা নিয়ে রওনা দিল কসমেটিকসের দোকান উদ্যেশ্য করে। কিন্তু আজ যেন সাইকেল টা কিছুতেই এগোতে চাইছে না!! এত জোরে প্যাডেল মারছে তবুও …
শেষমেষ যখন দোকানে পৌছল তখন একটা অসম্ভব ধাক্কা খেল আলাদীন… সাইকেলের দুইদিকে দুই পা মাটিতে চেপে ধরে কোনরকমে ব্রেক করে দাড়িয়ে অথর্বের মত নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো বন্ধ দোকানটার তালার দিকে!! আশ্চর্য!! এ দোকান তো আজ অবধি বন্ধ হতে দেখেনি সে!! এমনকি শুক্রবারেও না!! কেননা এটাই যে বাজারের একমাত্র কসমেটিকসের দোকান!! যা বন্ধ হলে এই গাঁয়ের মানুষ অচল!! দিক বেদিক না ভেবে সে ছুটে চলল দোকানদারদের বাড়ির দিকে। দরকার হয় তাকে ধরে এনে দোকান খোলাবে । দোকানদার সাহেব বিশেষ পরিচিত ব্যক্তি হওয়ায় বাড়িটা খুজে বের করতেও খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি, কিন্তু সেখানে যাবার পর যে দ্বিতীয় ধাক্কাটা অপেক্ষা করছিল তার জন্য সেটা কাটাতে বেশ বেগ পেতে হল তাকে।
মারা গেছেন দোকানদার সাহেব!! দুইদিন আগে অর্থাৎ শেষ যেদিন আলাদীন চুরি করে দোকানে গেছিল সেদিন রাত্রে মারা যান তিনি!!
মৃত্যু খবর মাথায় নিয়ে দুঃখ ভরাক্রান্ত চোখে আলাদীন যখন ফিরে আসছিল তখন -
“আচ্ছা! আপনার নাম আলাদীন নয়তো?”
পিছন থেকে বলে উঠলেন মৃত দোকানদারের বড় ছেলে। আলাদীন মূহুর্থেই যেন চমকিয়ে উঠে পিছন ফিরে তাকালো। তারপর উত্তেজিত হয়ে বলল -
“জীজ জী … আমি … আমিই আলাদীন”
দোকানির ছেলে “একটু দাড়ান আমি আসছি” বলে বাসার ভিতরে প্রবেশ করলেন। তারপর কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এসে ওই নুপুর জোড়া আলাদীনের হাতে দিয়ে বললেন -
“মৃত্যুর আগে বাবা আমাকে বলে গেছেন - কোন এক আলাদীন এসে এই নুপুর জোড়া দাবি করবে। তখন তাকে অবশ্যই এটা দিয়ে দিতে। আমিতো প্রথমে ভেবেছিলাম মৃত্যু যন্ত্রণায় তিনি ভুল বলছেন, কিসের আলাদীন, কোথাকার আলাদীন...। যাইহোক, আপনি এসেছেন যখন তখন এটা নিয়ে বাবার শেষ ইচ্ছা পূরন করুন।”
দোকানদার সাহেব ঠিক তার কথা রেখেছেন… কিন্তু জরিনা? সে কি রাখবে তার কথা...
আলাদীন কি বলবে বুঝতে পারলোনা। শুধু তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা অদ্ভুত শিহরণ খেলা করে গেল। কিছুক্ষণ বাদে সম্বিত ফিরে এলে নূপুর জোড়া হাতে নিয়ে আলাদীন ছোট্ট করে ধন্যবাদ দিল। তারপর একটু ইতস্তত করে পকেট থেকে দুইশো টাকা বের করে দোকানির ছেলের হাতের মধ্যে গুঁজে দিয়ে বলল -
“এটা রাখুন”
সাথে সাথে তিনি বললেন -
“উুহু ও ভুলটি করবেন না!! টাকা তো আমি নিব না”
সাথে সাথে আলাদীন তার হাত দুটি চেপে ধরে বলল -
“টাকা টা না নিলে আমার ভালোবাসার অমর্যাদা হবে ভাই … দয়া করুন”
আলাদীনের চোখের দিকে তাকিয়ে উনি আর না করতে পারলেন না। তবে আলাদীন চলে যাবার সময় পিছন থেকে ফিসফিস করে বললেন -
“বাবার মুখে ঠিকই শুনেছি… গল্পের আলাদীনকে চোখে দেখিনি কিন্তু বাস্তব আলাদীনের দেখা পেলাম...”
৩০ বছর পর…
আলাদীনের বয়স এখন ৬০ বছর। চুল দাড়ি প্রায় সবই সাদা হয়ে গেছে। মা গত হবার পর বোনটাকে ভালো দেখে পাত্রস্থ করেছেন। শুধু নিজেই আজো কারো পাত্র হতে পারেননি। এরপর শিক্ষকতার পাশাপাশি নিজের বাদবাকি পড়াশুনাও শেষ করেছেন এবং আজ সে নিজেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। মাসে এখন তার যে পরিমান আয় হয় তাতে ৩ টা সংসার দিব্যি আরামে চলে যায়। আজ তিনি অভাব মুক্ত। সবার জীবনে থেকেই একদিন অভাব বিদায় নেয়... যখন আর তার অভাব মুক্তির প্রয়োজন হয়না।
তবে রজিনার স্বামীর মত হয়তো এমিরাটস এর ফার্স্ট ক্লাস টিকেট নিয়ে এদেশ সেদেশ ঘোরা হয়না !! কিন্তু প্রতি মাসে দেশের প্রত্যেকটা জেলায় ৩ দিনের জন্য ভ্রমন তো করতে পারেন। দেশের ৬৫ জেলায় ১ বার করে ঘুরতে পারলেই তো বিশ্বভ্রমন হয়ে যায়!! তো আর দুঃখ কিসের? খাচ্ছেন দাচ্ছেন, ছাত্র-ছাত্রি মানুষ করছেন, পায়ের উপরে পা তুলে বেশ ভালোই আছেন… ভালোই…! ভালো+“ই” = ভালোই !!!
তবে আজো প্রায় প্রায় একটা অদ্ভুত কাজ করেন তিনি। হঠাৎ করেই মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে চিৎকার করে ওঠেন… হৃদয়ের সবটুকু যন্ত্রণা বীভৎস আর্তনাদ করে বলে ওঠে- “WHY?”
এবং সাথে সাথেই লাঠিতে ভর দিয়ে ঘরের বাইরে বের হয়ে সেই নূপুর জোড়া ছুড়ে ফেলেন সামনের পুকুরটাতে!! তারপর ভোরের আলো ফোটার আগেই আবার পানিতে ডুব দিয়ে হাতরে হাতরে নূপুর জোড়া উদ্ধার করে আনেন… দীর্ঘ ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা কিনা… তাই আর এখন খুজে পেতে অসুবিধা হয়না…

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:৩৩

আটলান্টিক বলেছেন: প্রথম হইলাম

১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:২২

নাঈম ফয়সাল নয়ন বলেছেন: শুকরিয়া।

২| ১১ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১১:২৫

মনিরা সুলতানা বলেছেন: আহারে সময় !
খুব খুব ভালো লেগেছে লেখা ।

১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:২১

নাঈম ফয়সাল নয়ন বলেছেন: শুকরিয়া।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.