নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ছোট থাকতে পছনদো করি

নাঈম ফয়সাল নয়ন

সত্য কে সত্য আর মিথ্যা কে মিথ্যা বলার চেষ্টা করি

নাঈম ফয়সাল নয়ন › বিস্তারিত পোস্টঃ

ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় (Season-2) - পর্ব- ১০

২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:২৯



যেভাবে জেলায় জেলায় শহরে বন্দরে ঘুরে বেড়াচ্ছি তাতে আমি দেখতে খুব সুদর্শন কেউ হলে অবশ্যই প্রতি শহরে একটা করে গানের কলি গেয়ে শোনাতাম - “আমি রূপ নগরের রাজ কুমার রূপের যাদু এনেছি। ইরান তুরান পার হয়ে আজ তোমার দেশে এসেছি।”
নাহ!! ইরান তুরান হবেনা। “খুলনা, যশোর পার হয়ে আজ রায়েরমহল এসেছি!!”

খুলনার বয়রা বাজার থেকে এক কিলোমিটার ভিতরে রায়েরমহল গ্রাম। এই গ্রামের বিশাল বড় মাতব্বর মোজাম্মেল হোসেনের মায়ের ৩য় মৃত্যু বার্ষিকী আজ। সে উপলক্ষে গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগল যা যা আছে দুনিয়ায় সব কিছু দিয়ে বিশাল মৌত খানার আয়োজন করেছেন তিনি। অনেকটা খাবারের গন্ধে গন্ধে সেদিকেই হেটে চলেছি আমি আর বৃদ্ধা মা।
মাতব্বর সাহেব যে বিরাট “মা” ভক্ত ছিলেন তা টের পেলাম তার বাড়ির কাছাকাছি ঘেষতেই। রাজা বাদশাদের বাড়ির মত বিশাল বাড়ির সামনে রয়েছে এক দাগে প্রায় ৪ একর খোলা জায়গা। সেই জায়গার পুরোটা জুড়েই তিনি অনুষ্ঠানের জাঁকজমক আয়োজন করেছেন। চারিদিকে শতশত মানুষের বিস্তর ব্যস্ত পদচারনা। হই হুল্লোড় চেচামেচিতে সে এক বিচ্ছিরি অবস্থা।
দুরেই রান্নাবান্না চলছে এবং বিরানীর সুগন্ধ এসে মস্তিষ্কে এক বিশেষ বিক্রিয়া ঘটিয়ে জীভ দিয়ে পানি ঝড়িয়ে ছাড়ছে। বৃদ্ধা মা এদিক সেদিক নাক দিয়ে কয়েকবার ঘোঁতঘোঁত করে ঘ্রাণ নিয়ে বলল -
“আমারে কই নিয়াইলি বাজান?”
ট্রেনে ভালো ঘুম হয়নি তাই হাই তুলতে তুলতে বললাম -
“তোমার বাড়িতে নিয়া আসলাম মা”
“তুই কি মশকরা করতাছোস? আমার বাড়ি কিয়ের এত শোরগোল? এত খাওন দাওনের ঘেরান আইতাছে কইত্থিকা?”
“কি কও? তোমার মনে নাই, আজ তোমার বিবাহ বার্ষিকী!!! সে জন্যেই এই আয়োজন!!”
লজ্জায় মুখে কাপড় চেপে মা বললেন -
“ধুর ছ্যামরা!! কি কস এগুলান? তর বাপের লগে কবে বিয়া বইছিলাম হেইডা তো আমারই মনে নাই। তুই এই গুলা কি উল্টা পাল্টা বকতাছোস?”
এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। কেননা মরা বাড়ির অনুষ্ঠান আর বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠানের খুব বেশি তারতম্য চোখে পরেনা আজকাল। মাতব্বর সাহেবের প্রয়াত মা যদি কবর থেকে উঠে আসতে পারতেন তবে তার এই মৌত খানায় এসে সবার সামনেই খিলখিলিয়ে হাসতেন আর কঙ্কাল শরীরটা দিয়ে খুব নাচতে আরম্ভ করতেন।
“মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ … তাতা থৈথৈ …”

আমি মা কে নিয়ে হাটতে হাটতে চারিদিকে ঘুরতে থাকলাম আর সমস্ত আয়োজন ঘিরে দ্বায়িত্ব প্রাপ্ত ছোট মাতব্বরদের মজার মজার কীর্তিকলাপ দেখতে থাকলাম। দেখলাম একটা প্যন্ডেলের ভিতর থেকে উচ্চস্বরে বাচ্চা কন্ঠে কোরআন তেলাওয়াতের ধ্বনি ভেসে আসছে। সেখানে একজন হুজুর তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। তার পাশেই বিশাল রান্নাবান্নার আয়োজন চলছে। সেখানেও চলছে সাজসাজ রব। চারিদিকে পুরো গ্রামের হাজার হাজার মানুষের উপচে পরা ভীড়। কিন্তু কোথাও মাতব্বর সাহেবকে দেখতে পেলাম না। দেখার আগ্রহও প্রকাশ করলাম না। কেননা আমি জানি তিনি নিজে থেকেই দেখা দিবেন!!

অবশেষে মাতব্বর সাহেবের দেখা পেলাম ঘন্টা দুয়েক পরে। দুটো ছোট ছোট ফুটফুটে বাচ্চার লাশ বাড়ির উঠোনে থুয়ে গম্ভীর মুখে বসে আছেন তিনি। লাশ কে ঘিরে তার আপনজনদের আহাজারি ক্রমেই ভারী করে তুলেছে রায়েরমহল গ্রামের আকাশ বাতাসকে।

ঘটনাটি কিছুক্ষন আগের। খাওয়া দাওয়ার কার্যক্রম শুরু হওয়ার সাথে সাথেই ঝাকে ঝাকে মানুষের ভীড় ঠেলে “আগে গেলে আগে পাবো”র মত করে পাল্লা দিতে থাকে সবাই। ফলে এত মানুষের নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় কর্তৃপক্ষ এবং ফলাফল স্বরুপ পায়ের তলে পিষ্ট হয়ে মরতে হয়েছে এই দুই বাচ্চাকে। নাক মুখ থেবড়ে রক্ত ঝড়ে একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পরার সাথে সাথেই সবার মরন খাওয়া থেমে যাওয়ার কথা, অথচ এখনো অনেকে খাবার স্থানে বসে গোগ্রাসে গিলেই চলেছে!! পরে অবশ্য মাতব্বরের নির্দেশ অনুযায়ী খাবার সরবরাহ স্থগিত করা হয়।

কিছুক্ষন পর মাতব্বর সাহের উঠে দাঁড়ালেন এবং রক্ত চক্ষু নিয়ে হুংকার দিয়ে গ্রামবাসীকে বললেন-

“আজ থেকে এই গ্রামে কোন অনুষ্ঠান হবেনা!! লোক দেখানো এসব ভণ্ডামি বন্ধ করতে হবে !!!”

যাক, দুটি তাজা প্রাণের বিনিময়ে হলেও তার বোধদয় হল মনে হচ্ছে। একজন মৃত ব্যক্তির মৃত্যু উপলক্ষে শোক পালনের নামে ভণ্ডামি করতে গিয়ে নতুন জীবনের মৃত্যু ঘটানোর কোন মানেই হয়না।
তবে একটা বিষয় আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। কোন এক মাতব্বরকে শুধুমাত্র শিক্ষা দিতে গিয়ে সৃষ্টিকর্তা যদি দুটো করে নতুন জীবন কেড়ে নেন তবে দুনিয়াতে যে এরকম লাখো মাতব্বর আছেন তাদের ক্ষেত্রে কি করবেন? তা কি জানি !! সবার ক্ষেত্রেই যে তিনি একই পদ্ধতি অবলম্বন করবেন তারও তো কোন মানে নেই। তবে এটা ঠিক যে প্রত্যেক মানুষকে তিনি একবার হলেও শিক্ষা দিয়ে থাকেন। কেউ সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়, আবার কেউ অশিক্ষিতই থেকে যায়। তাই শিক্ষিত বলতে শুধুমাত্র স্কুল, কলেজ বা ভার্সিটি থেকে ধুমা তুলে আসলেই তাকে শিক্ষিত বলা উচিত নয়। কেননা এমন অনেক উচ্চ শিক্ষিত জ্ঞানী মানুষ আছেন যারা - কিছু মানুষের ধাক্কায় ২০ তলা বিল্ডিং ভেঙ্গে পরে বলে মনে করেন। সবাই তাদেরকে শিক্ষিত বললেও আমি তাদেরকে মূর্খ বলতেও রাজী নই!! কেননা মূর্খরও একটা লেবেল থাকে!! তারা হলেন প্রতিবন্ধী!! আবার যে রিকশাওয়ালা সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে মাস শেষে তার স্ত্রীর নামে কিছু টাকা সঞ্চয় করেন ভবিষ্যতের জন্য, আমি তাকে শিক্ষিত বলতে এতটুকুও কুণ্ঠিত বোধ করবো না। মানুষ যে যে বিষয়ে চিন্তাশীল সে সে বিষয়েই সে শিক্ষিত।

একটা পুলিশ ভ্যান এসে লাশ দুটো নিয়ে গেল ময়না তদন্তের জন্য। পিছু পিছু ছুটলো লাশের আপনজন এবং গ্রামবাসী। আস্তে আস্তে ফাঁকা হতে থাকলো ময়দান। বড়বড় ডেকে পরে আছে এতএত খাবার।

আকাশে মেঘ করেছে, মাঝে মাঝেই বিজলি চমকাচ্ছে। মাতব্বর সাহেব এখনো সেখানেই ঠাই দাড়িয়ে আছেন। একে একে সবাই বিদায় নিলে তার দৃষ্টি এসে পড়লো আমাদের দিকে। আমি আর বৃদ্ধা দাড়িয়ে আছি তার দিকে ফিরে। কিন্তু ঠিক তখনই যেন বিদ্যুৎ চমকানোর মত চমকে উঠলেন তিনি!! যদিও আকাশে কোন বজ্রপাতের শব্দ হয়নি, তবে কালো মেঘে কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেছে চারিপাশ। তিনি ছুটে আসলেন আমাদের দিকে, এবং হতম্ভব হয়ে বড়বড় চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকলেন আমার পাশে দাড়িয়ে থাকা বৃদ্ধা মায়ের দিকে!!! তারপর কিছুক্ষন পর তার কি যেন হল !! তিনি দুই হাত কাকুতির মত করে “মা” বলে একটা চিৎকার দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হাঁটু গেড়ে মাটিতে লুটিয়ে পরলেন !! তারপর বৃদ্ধার পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন- “মাগো… মা তুমি এসেছ !!! সত্যিই এসেছ !!!”
বৃদ্ধা তার হাতের লাঠিটা ফেলে দিয়ে নিচু হয়ে মাতব্বরের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল-
“কে ? কে কাঁদে খোকা?”
বলে পাশে দাড়িয়ে থাকা আমাকে ধাক্কা দিতে যায় … কিন্তু… আমি সট করে সটকে পরলাম সেখান থেকে !!!


আগেই বলেছি, মাতব্বর মোজাম্মেল সাহেব তার মা কে অসম্ভব ভালবাসতেন এবং তার মা মৃত্যুর আগে তাকে বলেছিলেন- “খোকা কাঁদিস না, দেখিস আমি ঠিক আবার ফিরে আসবো তোর কাছে”!! বলেই তিনি অক্কা পেলেন। এবং কোন এক কাকতালীয় জনিত কারনে আমার সাথে থাকা বৃদ্ধার চেহারার সাথে মোজাম্মেল সাহেবের মায়ের চেহারার হুবহু মিল থাকায় সাময়িক ভাবে তিনি ধরেই নিয়েছেন তার মা আবার ফিরে এসেছে !!!

হোক সেটা কাকতালীয়, হোক পুরো ব্যাপারটি ভুল। তবুও কেউ একজন তো আর তার মায়ের পথ চেয়ে বসে থাকবেনা, বা কেউ একজন তো আর তার গলায় ঝোলানো ছেলের ছবি দেখিয়ে
বলবেনা যে - “তোমরা কেউ আমার খোকা কে দেখেছো?”

আমি একটা আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে হারিয়ে গেলাম তাদের অলক্ষ্যে তাদের কাছ থেকে অনেক দূর...। আমার দায়িত্ব... শেষ !! মা তার সন্তান এবং সন্তান তার মাকে খুজে পেয়েছে… সেখানে আর হাড্ডি হওয়ার কোন কারন দেখছি না।

আকাশ থেকে এতক্ষন মাঝে মাঝে সার্চলাইট মারলেও এবার শো শো শব্দে ঝর উঠতে শুরু করেছে… আমি উত্তাল ঢেউ এর মত ঝড়ের বিপরীতে ছুটে চলেছি গ্রামের মেঠো পথ ধরে অজানার উদ্দেশ্যে… ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পরতে শুরু করেছে… চোখ বন্ধ না করে বৃষ্টির ফোটা গুলোকে ভিতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছি আর একটা দারুন শীতল অনুভুতি নিয়ে চলেছি… এর ভিতরেই দেখলাম শান বাধানো একটা পুকুর ঘাটে হাঁটু পর্যন্ত পা ডুবিয়ে খোলা চুলে বসে আছে একটা মেয়ে… কোন কিছু না ভেবে আমি হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে বসে পরলাম তার পাশে… এবং আমিও পানিতে হাঁটু পর্যন্ত পা ডুবালাম... কিন্তু তার কোন ভাবান্তর নেই… তার মুখ দেখা যাচ্ছেনা... মনে হচ্ছে সে যুগ যুগ ধরে বসে আছে আমার প্রতীক্ষায়… আমি দেরী করাতে সে রাগ করে বসে আছে অন্যদিকে মুখ করে… যুগ যুগ ধরে অপেক্ষা করছে, কবে আমি তার রাগ ভাঙ্গাবো… প্রচণ্ড একটা বজ্রপাতের শব্দ তুলে আকাশ ফেটে বৃষ্টি নামলো… মেয়েটা প্রচণ্ড ভয়ে কেঁপে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরলো… এই প্রথম তার মুখ দেখতে পেলাম… পিঙ্গলবর্ণ (ব্রাউন) চোখের মনি… আমি তাকাতেই বন্ধ করে ফেলল সে।

(সমাপ্ত)

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১০:৩২

সোহানী বলেছেন: খুব মন খারাপ হয়ে গেল। মেয়র মহীউদ্দিন এর কুলখানিতে এভাবে ১০টা তাজা প্রান ঝড়ে গেল, হায়রে দেশ!! শোক দিবস নাকি সুখ দিবস তা আয়োজন দেখে বোঝার উপায় নেই।

শেষের প্যারাটাতে ও ভালোলাগা যদিও পুরো লিখা থেকে ভিন্ন।

অনেক ভালো লাগলো...

৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:৪০

নাঈম ফয়সাল নয়ন বলেছেন: ধন্যবাদ।

২| ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১০:৪৫

আবু তালেব শেখ বলেছেন: একজন মৃত ব্যক্তির মৃত্যু উপলক্ষে শোক পালনের নামে ভণ্ডামি

এটা ধর্মীয় রীতিনীতির অংশ বিশেষ।
এটাকে ভন্ডামি বলা কিন্তু ধর্মিয় অনুভুতিতে আঘাত দেওয়ার শামিল।
এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর জন্য আয়োজক দায়ি ধর্ম নয়।

৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ৯:৪১

নাঈম ফয়সাল নয়ন বলেছেন: সেটাই।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.