নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জীবনের রং

আসাদ ইসলাম নয়ন

লেখক ও পরিচালক ।

আসাদ ইসলাম নয়ন › বিস্তারিত পোস্টঃ

তরুণ শেখ মুজিবের বর্ণনায় ১৯৪৬ এর ১৬ আগস্ট শুরু হওয়া হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা(৫ম কিস্তি)

২৫ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১:৩০

শেখ মুজিবুর রহমানঃ
...................................

শ্রীরামপুরে কোনো গোলমাল হয় নাই শুনলাম, কিন্তু নাসের কোথায়? লোক পাঠালাম শ্রীরামপুরের খবর আনতে। দাঙ্গা ও লুটতরাজ একটু বন্ধ হয়েছে। নাসের কলকাতায় এসেছিল ১৬ই আগস্ট। হ্যারিসন রোডে এসে বিপদে পড়ে। তারপর একটা এ্যাম্বুলেন্স গাড়িতে উঠে জীবনটা বাঁচায়। নাসেরের একটা ছোটকালে টাইফয়েড হয়ে খোঁড়া গয়ে গিয়েছিল। পা টেনে টেনে হাঁটতে হয়। সেই পা দেখিয়ে এ্যাম্বুলেন্সে উঠে পড়ে। দিনভর এ্যাম্বুলেন্সে থাকে, সন্ধ্যায় হাওড়া থেকে ট্রেনে উঠে শ্রীরামপুর যায়। ট্রেনে তিন ঘণ্টা লাগে। কয়েকবার ট্রেনে আক্রমণ হয়েছে। কোনোমতে বেঁচে গিয়েছে। একটা কথা সত্য, অনেক হিন্দু মুসলমানদের রক্ষা করতে যেয়ে বিপদে পড়েছে। জীবনও হারিয়েছে। আমি নিজেই এর প্রমাণ পেয়েছি। মুসলিম লীগ অফিসে যেসব টেলিফোন আসত, তার মধ্যে বহু টেলিফোন হিন্দুরাই করেছে। তাদের বাড়িতে মুসলমানদের আশ্রয় দিয়েছে, শীঘ্রই এদের নিয়ে যেতে বলেছে, নতুবা এরাও মরবে, আশ্রিত মুসলমানরাও মরবে।

একদল লোককে দেখেছি দাঙ্গাহাঙ্গামার ধার ধারে না। দোকান ভাঙছে, লুট করছে, আর কোনো কাজ নাই। একজনকে বাধা দিতে যেয়ে বিপদে পড়েছিলাম। আমাকে আক্রমণ করে বসেছিল। কারফিউ জারি হয়েছে, রাতে কোথাও যাবার উপায় নাই। সন্ধ্যার পর কোন লোক রাস্তায় বের হলে রক্ষা নাই। কোন কথা নাই, দেখামাত্র গুলি। মিলিটারি গুলি করে মেরে ফেলে দেয়। এমনকি জানালা খোলা থাকলেও গুলি করে। ভোরবেলা দেখা যেত অনেক লোক রাস্তায় গুলি খেয়ে মরে পড়ে আছে। কোনো কথা নেই শুধু গুলি।

একবার আমার ও সিলেটের মোয়াজ্জেম চৌধুরীর (এখন কনভেনশন মুসলিম লীগের এমএনএ) উপর ভার পড়েছে রাতে পার্ক সার্কাস ও বালিগঞ্জের মাঝে একটা মুসলমান বস্তি আছে- প্রত্যেক রাতেই হিন্দুরা সেখানে আক্রমণ করে- তাদের পাহারা দেওয়ার জন্য। কারণ, বন্দুক চালানোর লোকের নাকি অভাব। আমরা গুলি ছুঁড়তে জানতাম।

সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময় খবর এল মিল্লাত অফিস থেকে ঐ এলাকায় যাবার জন্য। আমরা রওয়ানা করে তাড়াতাড়ি ছুটতে লাগলাম, কোন গাড়ি নাই। আমাদের পায়ে হেঁটেই পৌঁছাতে হবে। কেবলমাত্র লোয়ার সার্কুলার রোড পার হয়ে আমরা ছোট রাস্তা ঢুকেছি, অমনিই কারফিউর সময় হয়ে গেছে। কবরস্থানের পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। গাড়ির শব্দ পেলেই আমরা লুকাই, আবার হাঁটি। অনেক কষ্টে পার্ক সার্কাস ময়দানের পিছনে এলাম। ময়দান পাই হই কি করে? অনেক্ষণ ধরে চেষ্টার পর ময়দানের পিছন দিয়ে ‘সওগাত’ প্রেসের মালিক ও সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সাহেবের বাড়ির কাছে পৌঁছলাম। সেখান থেকে আর একটা রাস্তা পার হয়ে এক বন্ধুর বাড়িতে ঢুকলাম। কিন্তু এখন কি করি? বন্ধুর বাবা ও মা আমাদের কিছুতেই বার হতে দিতে রাজি হলেন না। কারণ, রাস্তার মোড়েই মিলিটারি পাহারা দিচ্ছে। তারা ছায়া দেখলেও গুলি করে। উপায় নাই। রাতে আমাদের সেখানেই কাটাতে হল। আমরা জায়গামত পৌঁছাতে পারলাম না। যদিও সে রাতে কোনো গোলমাল হয় নাই। প্রায় মাইল দেড়েক পথ অতিক্রম করেছিলাম। যে কোনো সময় গুলি খেয়ে মরতে পারতাম।

পার্ক সার্কাস এরিয়ায় বিচারপতি সিদ্দিকী, জনাব আবদুর রশিদ, জনাব তোফাজ্জল আলী (ভূতপূর্ব মন্ত্রী), আরও অনেকে ডিফেন্স পার্টির নেতৃত্ব দিতেন। আমরা ছিলাম স্বেচ্ছাসেবক। শিয়ালদহ ও হাওড়া স্টেশনে হিন্দু ও মুসলমানদের ক্যাম্প করা হয়েছিল যাতে বাইরে থেকে কেউ এসেই হিন্দু বা মুসলমান মহল্লায় না যায়। কারণ মুসলমানরা হিন্দুদের মহল্লায় এবং হিন্দুরা মুসলমান মহল্লায় গেলে আর রক্ষা নাই। কলকাতায় মহিলাদের মধ্যে জনাব সোহরাওয়ার্দীর মেয়ে মিসেস সোলায়মান, নবাবজাদা নসরুল্লাহর মেয়ে ইফফাত নসরুল্লাহ, বেগম আক্তার আতাহার আলী, সাপ্তাহিক 'বেগম' পত্রিকার সম্পাদিকা নূরজাহান বেগম, বেগম রশিদ, রোকেয়া কবীর এবং মন্নুজান হোস্টেলের ও ব্র্যাবোর্ন কলেজের মেয়েরা খুবই পরিশ্রম করেছেন। রাতদিন রিফিউজি সেন্টারে এরা কাজ করতেন মেয়েদের ভিতর, আমাদের করতে হতো পুরুষদের মধ্যে। রাতে অসুবিধা হতো, তবুও হাজেরা মাহমুদ আলী, হালিমা নুরুদ্দিন, আরও কয়েকজনকে সারারাত পরিশ্রম করতে দেখেছি।

কলকাতার অবস্থা খুবই ভয়াবহ হয়ে গেছে। মুসলমানরা মুসলমান মহল্লায় চলে এসেছে। হিন্দুরা হিন্দু মহল্লায় চলে গিয়েছে। বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা করার জায়গা ছিল একমাত্র অ্যাসপ্লানেডে, যাকে আমরা চৌরঙ্গী বলতাম। এখন অবস্থা হয়েছে আরও খারাপ। বেশ কিছুদিন কোনো গোলমাল নাই। হঠাৎ এক জায়গায় সামান্য গোলমাল আর ছোরা মারামারি শুরু হয়ে গেল। শহীদ সাহেব সমস্ত রাতদিন পরিশ্রম করছেন শান্তি রক্ষা করার জন্য। কলকাতায় চৌদ্দ-পনের শত পুলিশ বাহিনীর মধ্যে মাত্র পঞ্চাশ-ষাটজন মুসলমান, অফিসারদের অবস্থাও প্রায় সেই রকম। শহীদ সাহেব লীগ সরকার চালাবেন কী করে? তিনি আরও এক হাজার মুসলমানকে পুলিশ বাহিনীতে ভর্তি করতে চাইলে তদানীন্তন ইংরেজ গভর্নর আপত্তি তুলেছিলেন। শহীদ সাহেব পদত্যাগের হুমকি দিলে তিনি রাজি হন। পাঞ্জাব থেকে যুদ্ধফেরত মিলিটারি লোকদের এনে ভর্তি করলেন। এতে ভীষণ হৈচৈ পড়ে গেল। কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার কাগজগুলি হৈচৈ বেশি করল।(চলবে)
সূত্র: শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী ।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.