নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শিল্প ও সাহিত্য জগতের এক তৃষ্ণার্ত পথিক।

অনন্ত নিগার

বিজ্ঞানের সঠিক তথ্য বদলে দেবে আপনার জীবন!

অনন্ত নিগার › বিস্তারিত পোস্টঃ

সরল ভাবনাঃ শিক্ষক, শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের নিয়ে কিছু কথা- ঝাঁকের কৈ কি ঝাঁকের সাথেই মিশে যাবে?

২২ শে আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ১:০৩

অনন্ত নিগার
--------------
কিছুদিন আগে আমার এক পরিচিত আপা আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা আর শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলাপকালে এমন এক ঘটনা উল্লেখ করলেন যে স্তব্ধ হয়ে আমি কিছুক্ষণ জায়গায় জমে বসে রইলাম। শিক্ষা-বাণিজ্য আর আমাদের দেশের অতি সচেতন অভিভাবকদের অদূরদর্শিতা নিয়ে আমি এতোটাই হতাশ যে আমি বুজতে পারছি পুরো ব্যাপারটাই আমাদের সবার প্রায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। পত্রপত্রিকায় অসংখ্য কলাম আর সংবাদ লেখা হয় এ নিয়ে, তাই ভেবেছিলাম নতুন করে আর আমার মতো নগণ্য লেখকের কিইবা লেখার আছে? কিন্তু আপার দেওয়া একটা ঘটনা বৃত্তান্ত শুনে আমি এতোটাই অবাক হয়েছিলাম যে শেষ পর্যন্ত ভাবলাম সামান্য বিবেকও যদি আমার থেকে থাকে তাহলেও অন্তত দুটো লাইন লেখা উচিত। ঘটনা সংক্ষিপ্তভাবে বলতে গেলে এরকম- আমাদের শহরের একটি নামকরা স্কুলে এক মহিলা তার ছোট কচি মেয়ে যার বয়স সম্ভবত চার পাঁচের বেশী হবেনা, তাকে ক্লাস ওয়ানের কোন গ্রুপে যেন ভর্তি করাতে নিয়ে এসেছিলেন (কি গ্রুপ তা আমি বলতে পারবনা, কেজি নাকি নার্সারি, এসব আমি বুঝিনা কারণ আমি যখন স্কুলে পড়তাম, আমাদের সময় তখন এসব ছিল না)। মেয়েটার অতিসচেতন বাবার কড়া নির্দেশ ছিল এই ভালো স্কুলে তাকে চান্স পেতেই হবে, অন্যথায় তার মুখ ছোট হয়ে যাবে। ভদ্রলোকের স্ত্রী, মানে শিশুটির মাও সেরকম অতিসচেতন এবং স্বামীর প্রতি নিবেদিত প্রাণ। পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবার কিছুক্ষণ পরে নোটিশ বোর্ডে যখন রেজাল্ট শীট টাঙানো হল দেখা গেলো সেই অবুঝ কচি মেয়েটি মেধা তালিকায় নেই। মেয়েটির সাথে শুধু ওর মাই ছিল, বাবা নয়। মেয়ে চান্স না পাওয়াতে তার মা কচি সেই বাচ্চাটিকে অনেক গালিগালাজ করে বাবার শাস্তির ভয় দেখিয়ে, শাসিয়ে টাসিয়ে রাস্তায় ওকে একা ফেলে সোজা বাড়ির পথে হাঁটা ধরলেন! ছোট্র অবুঝ মেয়েটি কেঁদে কেঁদে ভয়ে পেছন থেকে ‘মা! মা!’ বলে ডাকতে শুরু করল। বাকীটা আমি আর শুনতে চাই নি কারণ শোনার মতো সহ্যক্ষমতা আমার আর ছিল না। তবে আপনারা নিশ্চয়ই বাকীটা ইতিমধ্যে অনুমান করে নিয়েছেন। মা হয়তো কৃত্রিম ভয় দেখিয়ে চলে যাচ্ছিলেন, একটু পরে ঠিকই এসে বাড়িতে নিয়ে যাবেন নিজের মেয়েকে। সে যাই হোক। এবার আমি আসি মূল প্রসঙ্গে, মানে এখানে আমার বিবেক কেনো এই ঘটনায় নড়ে উঠল? এরকম ঘটনা আরো অসংখ্য হয়তো বা ঘটছে, সবগুলো তো আর আমাদের দেখার আর শোনার সৌভাগ্য হয় না।
পদার্থ বিজ্ঞানে আমি যখন কয়েক বছর আগে সদ্য স্নাতক ডিগ্রী নিয়ে বের হয়েছিলাম, তখন থেকে সব মিলিয়ে আমি দুটো হাই স্কুলে বিজ্ঞানের খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে প্রায় দুই বছর চাকরি করেছিলাম, এবং পরবর্তীতে আমি সবইচ্ছায় ছেড়েও দিয়েছিলাম। আমার ছাত্রজীবন আর স্বল্পকালীন শিক্ষকজীবনের অভিজ্ঞতার আলোকেই আমি কিছু কথা বলতে চাই।
আজকাল আমাদের দেশে শিক্ষা বলতে আমি যা বুঝি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান দিয়ে তা হলো, শিক্ষা হচ্ছে বাণিজ্যের আরেক নতুন, ভদ্র ও গ্রহণযোগ্য একটি শাখা। কিভাবে? শুরু থেকে শুরু করা যাক। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে সমস্ত মেধাবী শিক্ষার্থীরা ডিগ্রী নিয়ে বের হয়, এদের প্রায় সবাই অর্থনৈতিক কারণে চলে যায় এমন কোনো সরকারী বা বেসরকারি চাকুরীতে যেখানে প্রচুর বেতন আর সম্মান আদায় করা যায়, কিন্তু আদৌ তার মেধা বা সৃজনশীলতা সেখানে এসে কোন কাজে লাগেনা। অথবা এদের কিছু অংশ বিদেশে চলে যায় উচ্চতর ডিগ্রী নেবার জন্য, যাদের বেশীরভাগই পরে আর ফিরে আসেনা। এই ছাঁকন প্রক্রিয়া শেষে দেখা যায় কম মেধাবীরাই শেষ পর্যন্ত অপর্যাপ্ত জ্ঞান নিয়ে ধীরে ধীরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে ঝুঁকে পড়েন। বিদ্যালয়, কিংবা কলেজ পর্যায়ে এসে দেখা যায় যারা পড়াচ্ছেন তাদের কোনো উদ্দীপনা, উৎসাহ নেই পড়ানোর ব্যাপারে, নেই সঠিক কোন প্রশিক্ষণ। বস্তুকেন্দ্রিক এই সংসার জীবনে তারা একটু ভালোমানের জীবন যাপনের জন্য বেছে নেন পার্ট টাইম কোচিং বা টিউশন। কারণ মাস শেষে তারা যা বেতন পান, তা মানসম্মত একটি জীবন কাটানোর জন্য পর্যাপ্ত নয়। একদিকে এ সমস্ত শিক্ষকদের জ্ঞানের অপর্যাপ্ততা, প্রশিক্ষণের ঘাটতি, অপরদিকে আর্থিক টানাপড়েন, সব মিলিয়ে তাদের মানসিক প্রবণতা ধীরে ধীরে পুরোপুরি বাণিজ্যিক হয়ে ওঠে। এই গেলো শিক্ষকদের কথা। এবার আলোকপাত করা যাক শিক্ষাব্যবস্থার দিকে।
আমাদের দেশের হ-য-ব-র-ল মার্কা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ভাবতে গেলে যে কোনো বিদ্বানের মাথাই সহজে ঘর্মাক্ত হয়ে যাবে। বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম আর মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা- এই তিন নিয়ে আমাদের শিক্ষার তিনটি মান ও আলাদা আলাদা তিন রূপ। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় যেমন একদিকে দেওয়া হচ্ছে ধর্মীয় জ্ঞান মধ্যযুগীয় ব্যবস্থায় (যা বাংলা ভাষায়ও দেওয়া সম্ভব), অন্যদিকে ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থায় গড়ে তোলা হচ্ছে একেবারে বিপরীত আরেক শ্রেণী, যারা পশ্চিমা সংস্কৃতির ধ্যান-ধারণায় গড়ে উঠছে। আর মাঝামাঝি অবস্থানে রয়েছেন বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা, এবং সেখানেও আছে আবার একই সিলেবাসের বাংলা ও ইংরেজী দুটো সমান্তরাল রেখা। কথায় আছে, মধ্যম চলে তফাতে। তবে বাংলা মাধ্যমের ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে আমার যেহেতু দুটোর অভিজ্ঞতাই আছে, তাই শুধু বাংলা মাধ্যমের ভেতরেই আমার আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকবে।
প্রথমত, আমি এক কথায় বলে দিতে চাই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা হচ্ছে পাঠ্যপুস্তকের সমাধান নির্ভর, সমস্যা নির্ভর নয়। ক্লাসে গেলে শিক্ষার্থীরা শুধু তাদের পাঠ্যবইয়ের অনুশীলনের সমাধান আশা করে শিক্ষকদের কাছ থেকে আর পরীক্ষার আগে আশা করে সাজেশন্স। অভিভাবক আর শিক্ষার্থী, দুপক্ষেরই দাবি হল শিক্ষকের কাজ হচ্ছে সমস্যার সমাধান করে দেওয়া আর সেই শিক্ষার্থীর কাজ হচ্ছে হুবহু তা অনুকরণ করে স্মরণ রাখা এবং নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষার হলে তা হুবহু বসিয়ে দেওয়া। তার উপর যদি হু হু করে মার্কস দেওয়ার নিয়ম থাকে, তাহলে তো কেল্লা ফতে! সবাই খুশিতে গদগদ! অভিভাবকেরা গর্বে বুক তিন হাত ফুলিয়ে, গলা চড়িয়ে বলেন, আমার মেয়ে গোল্ডেন প্লাস পেয়েছে কিংবা ওপর পক্ষ সামান্য মাথা নিচু করে বলেন আমার ছেলে সিলভার প্লাস পেয়েছে। এই গোল্ডেন আর সিলভারের চাকচিক্য ধরে রাখতে অলিতে গলিতে (হয়তো কিছুদিন পরে বনে-জঙ্গলে, এমনকি গুহার ভেতরেও) গজিয়ে উঠছে কোচিং সেন্টার আর প্রাইভেট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, কলেজ (যেখানে ইন্টারন্যাশনাল তো দুরের কথা, ন্যাশনালের ‘ন’ পর্যন্তও নেই)। অথচ শিক্ষকদের কাজ হচ্ছে শিক্ষার্থীদের হাতে সমাধানের গাইড তুলে দেওয়া নয়, বরং কিভাবে সমস্যার সমাধান সে নিজে নিজে করতে পারবে তার প্রশিক্ষণ দেওয়া, তাকে দিয়ে তার ভেতরের সুপ্ত প্রতিভা বের করে আনা, পরীক্ষা পাশে তাকে সবনির্ভর করে গড়ে তোলা। মুখস্থ নির্ভর পড়াশুনা হচ্ছে শুধুমাত্র স্মরণশক্তির তীক্ষ্ণতা বৃদ্ধি করা, আদৌ তা মেধার পরীক্ষা নয়। মেধা যাচাই করতে হলে নিজ বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে নিয়ত নতুন নতুন যে কোনো সমস্যারই সমাধান ছাত্র যেন নিজে করতে সক্ষম হতে পারে তা নিশ্চিত করা। অর্থাৎ ছাত্রকে আত্মনির্ভরশীল হতে হবে, পরজীবীর মত শিক্ষক কিংবা কোচিং নির্ভর হলে চলবেনা। আর সোনালী রেজাল্ট কিংবা রূপালী রেজাল্ট দিয়ে আসলে আজকাল যে প্রতিযোগিতা হচ্ছে তা আদৌ সোনার মানুষ গড়তে যে পুরোপুরি কাজে লাগছে কিনা, তার সত্যতা স্বচক্ষে দেখা যায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্টের ওপর নিরীক্ষণ করলে। অথচ এই সোনালী রেজাল্ট ধরে রাখতে গিয়ে আমাদের দেশের অতি সচেতন অভিভাবকদের মধ্যে আর স্কুল, কলেজগুলোর মধ্যে যে অবাধ প্রতিযোগিতা আর রমরমা ব্যবসা চলছে, তারই ভিত্তিতে ছোট বড় সব শিক্ষার্থীদের উপর নেমে আসছে চরম দুর্ভোগ, কেড়ে নেওয়া হচ্ছে তাদের খেলার সামান্য সময়টুকু, নিজের স্বপ্ন নিয়ে ভাবার সময়টুকু; এমনকি এক সময় বাবা মার চাপিয়ে দেওয়া স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে সন্তানেরা নিজের স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে বিলীন করে দিচ্ছে নিজের অস্তিত্বকে। ছোট ছোট বাচ্চারাও নির্মম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। সোনার মানুষ গড়ে তুলার দুর্বার প্রেরণা নিয়ে বাবা মারা তাদের ভর্তি করে দেন এমন সব স্কুলে যেখানে থাকে অপরিকল্পিত সিলেবাস আর অহেতুক কঠোর সব নিয়মাবলী। অভিভাবকদের ধারণা যতবেশী বই আর যত বেশী নিয়ম, ততই সন্তানের জন্য তা মঙ্গলজনক। আর তাই রোজ সকালবেলা হাঁটতে বেরোলে আমি দেখি ছোট ছোট ঘুমকাতুরে বাচ্চারা তাদের মা বাবার সাথে স্কুলে যাচ্ছে ইউনিফর্ম পড়ে আর তাদের বইয়ে বোঝাই ব্যাগ তাদের অভিভাবকের হাতে, কারণ বাচ্চার চেয়ে ব্যাগের ওজন মনে হয় বেশী।
এই সমস্ত কিছুর প্রতিফলনই দেখা যায় উপরোল্লিখিত আপার বলা সেই নির্মম ঘটনায়। কি আর করা? সবাই ব্যস্ত সোনালী রেজাল্ট নিয়ে। কারণ ,সোনালী রেজাল্ট মানে সোনালী ভবিষ্যৎ, সোনালী ভবিষ্যৎ মানে একদিন টাকা উৎপাদনের সোনালী মেশিনে রূপান্তরিত হওয়া, সোনালী মানুষ হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এভাবে আমাদের দেশে সোনালী রেজাল্টধারী মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, অথচ আনুপাতিকভাবে বাড়ছে না সোনার মানুষরা! কি আর হবে শেষ পর্যন্ত? এভাবে যদি চলতেই থাকে তাহলে হয়তো ‘ঝাঁকের কৈ একদিন ঝাঁকের সাথেই মিশে যাবে।‘
অভিভাবক টাইপ যারা এই লেখা পড়ছেন, তারা হয়তো তাচ্ছিল্য করে মনে মনে আমাকে বলছেন, ‘সবজান্তা সাহেব, আপনি যখন বাবা হবেন, আপনিও তাই করবেন!’ ঠিক আছে। আমি সানন্দে আপনাদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম। কারণ, স্কুলের প্রধান শিক্ষককে দেওয়া প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের সেই বিখ্যাত চিঠির কথাগুলো আমার হৃদয়ের কাগজে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছে। পরিশেষে সবার জন্য শুভ কামনা জানিয়ে বিদায় নিচ্ছি।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.