নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শিল্প ও সাহিত্য জগতের এক তৃষ্ণার্ত পথিক।

অনন্ত নিগার

বিজ্ঞানের সঠিক তথ্য বদলে দেবে আপনার জীবন!

অনন্ত নিগার › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প : শুধুই স্পর্শ

২৫ শে নভেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৩:০২


অনেকদিন পরে সেতুপাড়ায় আসল তমাল। ঠিক কতদিন, কতবছর পর তা নির্ভুল হিসেব করে বলতে পারবে না। তবে নূন্যতম বছর তিনেক তো হবেই। সাধারণত এদিকটায় আসেনা সে। আসেনা বলতে আসার প্রয়োজন পরে না। আজ এসেছে এখানে, তবে কি আসার দরকার ছিল? না, মোটেই না। আজ দুপুরের পর থেকেই মনটা তিক্ত হয়ে আছে জগত সংসারের কাজ আর নোংরা মানুষদের যন্ত্রণায়। প্রতিদিনই তার মনে হয় এ সমাজের প্রত্যেকটা, প্রায় প্রত্যেকটা মানুষই নিপাট ভদ্রলোক হয়ে সেজে থাকা একেকটা নিরাবেগ যন্ত্র, সংসারে পুরোপুরি আসক্ত একেকটা অনুভূতিহীন শরীর। নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। কলেজে চাকরি নিয়েছে দুই বছর হল, দুপুরের পরে প্রতিদিনই বাসায় এসে একটা না একটা ছোটখাটো অনুল্লেখ্য বিষয় নিয়ে বড় ভাই বা ভাবির সাথে তার ঝগড়া লেগে যায়। বুড়ো বাপ আর মা শুধু বেকুবের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। পরিবারটা অনেক আগেই ছেড়ে দিত, কিন্তু একা কুলিয়ে উঠতে পারবে না সে। মা আর বাবাকে নিয়ে আলাদা একটা পরিবার গড়ে তুলতে গেলে শহরে সম্ভব নয়, তার মাসিক আয়ে হবে না, মফস্বলে চলে যেতে হবে। কারণ আধা সরকারি কলেজে তার পোস্টে এখনো তার এমপিও ভুক্তি হয় নি, হতে আরো কতদিন, মাস বা বছর যাবে বলা যাচ্ছে না। শুধু কলেজের বেতনেই আপাতত চলছে সে। বড় ভাই তার সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। সুতরাং সংসারে বড়ভাইয়ের কর্তৃত্বই বেশী, তারচাইতেও বেশী ঝাঁজালো কর্তৃত্ব হচ্ছে ব্যাটার বৌয়ের। আজ দিনটা সরকারি ছুটি ছিল। কোনো ঝগড়াঝাঁটি হয় নি কারো সাথে। তবুও কেনো জানি এক অজানা নিঃসঙ্গতা আর মিথ্যা অভিমান কোথা থেকে তাকে এসে ঘিরে ধরল দুপুর থেকেই। সকালে নাস্তা খেয়ে কোথাও বেরোয় নি। শুধু খবরের কাগজ পরে সকাল কাটিয়ে দিয়েছে। তারপরে আবারো ঘুম অসময়ে। মায়ের ডাকে দুপুরে ওঠে ভাত খেয়ে বিছানায় কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করল, বই নিয়েও কিছুক্ষণ আনমনা হয়ে পাতা ঊল্টালো। লাভ হলনা, কি এক বিষণ্ণতার ছায়া নর্তকীর মতো নূপুর পরে তাকে ঘিরে নাচতে থাকলো। বিকেলে বেরল ঘর থেকে, কিছুক্ষণ ফুটপাত ধরে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটল। তারপর কি ভেবে হঠাত বাসস্টপে এসে থামা হেল্পারের অনবরত বিরক্তিকর চেঁচিয়ে বলা,’’সেতুপারা! সেতুপারা!” শুনেই সে হুট করে যাত্রীবোঝাই বাসে চেপে বসল। ঠিক কেনো, জানে না। সেতুপারা অনেকদিন যায়নি সে। বেকার থাকতে প্রায়শই ওখানে বন্ধুরা মিলে যেত। সেতুপারা ফেলে সামান্য এগিয়েই পাহাড়ি এলাকা। মূল রাস্তা থেকে বাম দিকে ঢুকে হাটা শুরু করলেই শুরু হবে দুপাশে পত্র পল্লবে সুশোভিত কাচা রাস্তা। তারপর পাহাড়ি বাঁক, তারপর শুধুই পাহাড় আর পাহাড়, কিছুটা বনাঞ্চল। প্রত্যেকদিন বিকেলেই অবসর কাটাতে একটু সময় পেলেই হাফিয়ে উঠা মানুষ দম ফেলতে এখানে আসে। তবে পরিবার নিয়ে সদলে এখানে আসার চেয়ে বেশি আসে প্রেমিক প্রেমিকার যুগল। চাকরি হবারও অনেক আগ থেকে এদিকে আসা ছেড়ে দিয়েছিলো তমাল। বিশেষত এদিকে এক বন্ধুর বাসা থাকায় আসা পড়ত। কিন্তু পুলিশে চাকরি হবার পর পোস্টিং হয়ে গিয়েছিলো তার দিনাজপুরে। হয়তো বদলি হয়ে এখন অন্য জায়গায়। যোগাযোগ নেই তার সাথে এখন আর। একে একে সব বন্ধু চাকরি নিয়ে, বিয়ে থা করে সবাই সংসার জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে নিজেদের জড়িয়ে থিতু হয়ে গেলো। আর তাই তমালের এদিকটায় আসাও একসময় ধীরে ধীরে কমতে লাগলো। শেষবার যখন এসেছিলো খুব সম্ভব বছর তিন বা সাড়ে তিন বছর আগে। কিভাবে যে সময়ের ঘোড়া দৌড়ায়, টেরই পাওয়া যায়না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তমাল হাঁটতে হাঁটতে সেতুপাড়া ফেলে এসে হাইওয়ে সড়ক থেকে বাম পাশে মোড় নিলো। কাচা রাস্তা ধরে সোজা হাটা শুরু করল। প্রায় শুকনা পাতায় ছেয়ে যাওয়া রাস্তাটায় পাতার স্তূপ জমে আছে। হাঁটলেই ঝরে যাওয়া পাতার মর্মর আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। পাতাগুলো কি জানান দিচ্ছে যে তারাও একদিন দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলোর শাখা-প্রশাখার ডগায় সজীব হয়ে বেছে ছিল ক্ষণিকের স্মৃতি হয়ে?
পাহাড়ে বাঁক নিয়ে বেশ কিছুদূর এগুতেই বিষণ্ণ তমাল হঠাত থমকে দাঁড়ালো। এখানে হঠাত করে আসার একটা নিঃশব্দ আবেগী কারণ সে খুঁজে পেলো। পাহাড় আর বনাঞ্চলের এক বন্য গন্ধে হৃদয়ের তলানি থেকে কি এক স্নিগ্ধ অনুভূতি হঠাত পাক খেয়ে খেয়ে ঘূর্ণি হয়ে উঠতে লাগলো। মাদকের মতো কি এক মাতাল করা অনুভূতি তাকে যেন মুহূর্তে আবেশিত করে তুলল। নামটা হঠাত করে আলোর ঝলকানির মতো হৃদয়ের আকাশে আচমকা ভেসে উঠল তার- ‘মনিকা’! মনিকা কোথায় আছে এখন? কেমন আছে? দেশে নাকি বিদেশে চলে গেছে? বিয়ে হয়ে গেছে? এখনো কি ওর আগের মতোই সুশ্রী, মোহিনী রূপের লাবণ্য রয়ে গেছে? ঝাঁক বেঁধে আসা প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর জানা নেই তমালের। তবু এক স্নিগ্ধ অথচ দগ্ধ অনুভূতি, এক সম্মোহনী শক্তি দূর অতীতে নিয়ে অমনোযোগী করে তুলল তাকে। সে দাঁড়িয়ে ছিল এক পাহাড়ের পাশে, কাঁচা রাস্তার মাঝখানে। কি ভেবে একটু দূরে গিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে বসে পড়ল। তার চারিদিকে পাহাড়, আর একটু আধটু বনাঞ্চল। নিবিড়, শান্ত আর বড্ড রোম্যান্টিক। অদূরে দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে আঁকাবাঁকা হয়ে সরু এক স্বচ্ছ পানির নালা। পানির টলমলে শব্দ, পাতা মাড়িয়ে যাওয়ার মর্মরে শব্দ, বন্য পোকা আর গাছের আড়ালে আবডালে বসে থাকা চেনা অচেনা কতগুলো পাখির কিচির মিচির ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই, নেই শহুরে কোনো রেশ। নিস্তব্ধ এই প্রকৃতিতে যেন নিজেকে মিশিয়ে দিলো সে এক ভাববিলাসীতায়। সাথে একটা সিগ্রেট থাকলে ভালো ছিল।
তমাল যখন রসায়ন নিয়ে চতুর্থ বর্ষে পড়াশুনা করছে, তখন হাত খরচ যোগাতে একটা কোচিং সেন্টারে পড়াতো সে। কলেজ পড়ুয়া ছেলে মেয়েদের শুধু রসায়নের ক্লাস নিতো সপ্তাহে তিনদিন। তিনদিনে দুটো করে ক্লাস ছিল তার। বিকেল থেকে প্রায় সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত থাকতে হত তাকে। মাস শেষে বেতন পেত ক্লাস নেওয়ার সংখ্যা হিসেবে। মনিকা ছিল প্রথম ব্যাচের অর্থাৎ বিকেলের শুরুতেই মনিকাদের ব্যাচের ক্লাস নিতে হত তমালকে। মনিকা ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিল। সবসময় পেছন দিকে এসে বসত আর অপলক দৃষ্টিতে তমালকে বিদ্ধ করত সবসময়ই। তমাল খুব আকর্ষণীয় পুরুষ কিনা তা ঠিক সে বুঝে উঠতে পারত না। তার চুল বরাবরই একটু লম্বা থাকত, চিরুনি করত খুব কম। শ্যাম বর্ণ শরীর তার, মুখে সারা বছরই হালকা দাঁড়ি গোঁফ থাকত। চ্যাপ্টা শরীর আর মাঝারী উচ্চতা তার। জিন্স, টি-শার্ট তার সারা বছরের পোশাক ছিল, ভুলেও শার্ট গায়ে দিত না সে। আর মনিকা? কাহিনী যেহেতু নব যৌবনা মনিকাকে নিয়ে, তো একটু আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে নেওয়া ভালো। মনিকা খাটো, মেয়েদের স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে একটু কম, তাই হাই হিল জুতো তাকে নিয়মিত পরতে হত। ফর্সা, লাবণ্যময় চামড়া তার, কিন্তু ছিপছিপে শরীর দেখলেই বুঝা যেতো এই মেয়ের খাবারে খুব অনীহা আছে। আবার পোশাক আশাক যা পরত তা খুব দামি। মসৃণ চুড়া করে বেঁধে রাখা খোঁপার সাথে লম্বাটে মুখ আর পোশাকের সাথে দারুণ মানাত। খুব শান্ত মনে হত মেয়েটাকে। ক্লাসে কারো সাথে কথা বলত না, সদা নীরব। কিন্তু ওর চাহনির মধ্যে কি এক বেপরোয়া ভাব ছিল, তমাল সেটা ঠিকই টের পেত। তার বারবার মনে হত মেয়েটাকে দেখে যা মনে হয় সে আসলে মোটেও তা না। কথা বলত কম ঠিকই কিন্তু ওর নিয়মিত কাজল দেওয়া চোখ দুটো কথা বলত এমন ভাষায় যে ভাষা তমাল ঠিকই বুঝতে পারত। কি এক রহস্যে আচ্ছাদিত আহবান তার দৃষ্টিতে সারাক্ষণ লেগে থাকত আর সেটা তমাল যতক্ষণ ক্লাসে থাকত ততক্ষণ ঠিক তারই দিকে নিবদ্ধ থাকত। একদিন ক্লাস শেষে বেরিয়ে আসার সময় মেয়েটা তার পিছু পিছু এলো করিডর পর্যন্ত এবং পেছন থেকে “স্যার!” সম্বোধন করে থাকে থামাল। তমাল অবাক হলেও কেনো জানি তার মনে হল এই ঘটনাটাই সে এতদিন অবচেতনভাবে আশা করছিল। মনিকা জানালো রসায়নে তার মার্কস বরাবরই কম উঠে আর সবচেয়ে কাঁচা সে ঐ বিষয়েই। তমাল বাড়িতে গিয়ে পড়ায় কিনা জানতে চাইলে তমাল হেসে না করে দিল। মেয়েটা একটু হতাশ হয়ে কয়েক মুহূর্তনীরবদাঁড়িয়ে রইল। তারপর হুট করে তার নাম্বার চাইল। বলল যদি পড়তে গিয়ে কোনোকিছু দুর্বোধ্য ঠেকে, তাহলে ফোনে সে তমালের কাছ থেকে সহায়তা যেননিতে পারে। মনিকা নাম্বার নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে চলে গেল। এবং তমালকে অবাক করে দিয়ে ঠিক ঐদিন রাতেই দশটার দিকে ফোন দিল। কিছুক্ষণ কথা বলল এমনিতেই। নাম, পরিচয় ইত্যাদি টুকটাক বিষয় নিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে মনিকা জানালো ওটা তারই ব্যক্তিগত নাম্বার, সেভ করে রাখার জন্য। তমাল মনিকাকে সেদিন ঠাঁই দিল তার ফোনবুকে। জানত না এই মেয়েটা কোনো একদিন তার শূন্য বুকে ঠাঁই নিয়ে নেবে প্রগাঢ় আবেগ হয়ে।
মনিকা প্রতিদিন, প্রায় প্রত্যেকদিন সকাল সন্ধ্যা কিংবা রাতে তাকে ফোন করতে শুরু করল। এবং বিনা কারণে সে ফোন করত। প্রথম প্রথম যাও দুয়েকদিন পড়াশুনার কিছু সমস্যাদি বা টিপস নিয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু ফোন আসার হার বৃদ্ধির সাথে সাথে আলোচনা আর গল্পগুজবের সীমানা বিস্তৃত হতে হতে সব সীমানাই অতিক্রম করতে শুরু করল। এমনকি মাঝে মাঝে অনেকটা বাচ্চামী শাসনের ভঙ্গিতে নির্দেশ দিয়ে রাখত আজ অমুক রঙের টিশার্ট বা প্যান্ট পরে আসার জন্য। তমাল পরিষ্কার বুজতে পারছিল যে তার ভঙ্গুর হৃদয়ের প্রতিরোধ ক্ষমতা দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল। মাস দেড়েকের ভেতরেই মনিকা কোনো এক গভীর রাতে যেন স্বপ্নাবিষ্টের মত তমালকে গাঢ় গলায় বলল,”ভালোবাসি!”। তমালজানত এই মায়াবী আহবানের ডাকের সাড়া তাকে দিতেই হবে, তবু নিজের ব্যক্তিত্ব ধরে রাখার কৃত্রিম প্রয়াসে তাকে বাস্তবতার রূপরেখা টেনেবুঝনোর চেষ্টা করতে লাগল। মনিকা আসলে একরকম নিশ্চিতই ছিল, তমাল অনেক আগে থেকেই গলতে শুরু করেছে। তমাল এখন যা করছে তা হচ্ছে ফরমালিটি। কারণ মুখে মানুষ যাই বলুক, কিন্তু চোখের ভাষা, ইঙ্গিত কিন্তু আড়াল করা যায় না। মনিকার আত্মবিশ্বাস দিন দিন বাড়ছিল তমালের মুখের শ্রবণেন্দ্রিয় ভাষার চেয়ে চোখের অদেখা ভাষা বুঝতে পেরে। কে রাজি হবে, আর কে হবেনা, সেটা কিন্তু ঐ মানুষটার সাথে কিছু দিন কথাবার্তা আর ভাব বিনিময়ের পরেই অনুমান করে নেওয়া যায় তার চোখের মাঝে হঠাত নেচে ওঠা প্রশ্রয় তরঙ্গ দেখে। মনিকাও জানত তমালের ফরমাল ব্যক্তিত্বের মোকাবেলা কিভাবে করতে হয়, কারণ মনিকা দেখতে যেরকম ছিল, ভেতরটা ছিল অনেক অভিজ্ঞ আর জেদি। সে শুরু করল অবোধ আচরণ, যেমন ক্লাসে না আসা, ফোনে কান্নাকাটি করা, মাঝে মাঝে না খেয়ে থাকা, সারারাত না ঘুমিয়ে তমালকে আবেগী ডিজিটাল মেসেজ দিয়ে সেটা জানান দেওয়া। অবশেষে তমাল হার মেনে নীল আবেগের কাছে, বাস্তবতা থেকে সরে এসে। অথচ তমাল পরিষ্কার জানত, মনিকার আরেকটু বয়স হলেই তার মোহ কেটে যাবে, সে তাকে ত্যাগ করবে একদিন না একদিন। এটাও সে বুঝতে পারত মনিকা ঝোঁকের বসে এসব করছে, তার লেগে থাকা আর মেসেজের অভিজ্ঞ ভাষা পড়েই অনুমান করে নিয়েছিল এই মেয়ে এতো অল্পতেই প্রেমে অভিজ্ঞ হয়ে গেছে। তমাল সব জানত, জানত তার বর্তমান কি, কি তার আসন্ন ভবিষ্যৎ। তবু মাদকের মতো কি এক নেশা তাকে সর্বক্ষণ তাড়া করে বেড়িয়েছিল। প্রতিরোধ ক্ষমতা তার দুর্বল ছিল, আবেগ ছিল বেশি, আর তাই জেনে শুনেই মনিকা নামের মাদকের দিকে সে হাত বাড়িয়েছিল।
তমাল সম্মতি দিয়ে দিল। ফোনে আলাপ দিনের পর দিন চলল। ক্লাসে চলল নীরব আর ইঙ্গিতপূর্ণ চাহনির নিরন্তর বিনিময়। যখন মনিকার ফাইনাল পরীক্ষা শেষে সে কলেজের পরিধি থেকে বেরিয়ে এলো, তখন থেকেই ধীরে ধীরে তমালের সাথে তার ফোনালাপ কমতে শুরু হল। তমাল নিজ থেকে কখনই ফোন দিত না, মনিকার নিষেধ ছিল। তাই মনিকাই কল দিয়ে বলত ব্যাক করার জন্য। মনিকার কল আসার হার হ্রাস পেতে লাগল। তমাল বুঝতে পারছিল মনিকাকে সে হারাতে শুরু করেছে। আসলে হারাবে কি, সে জানত মনিকা আসলে তার কোনোদিন ছিলই না। দুজনেই এক সাময়িক প্রহসনে লিপ্ত হয়েছিলো, যার অনিবার্য সমাপ্তি শুধু অপেক্ষা করছিল শুধু সময়ের উপর। সময় ঘনিয়ে আসছিল। মনিকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগেই তার ফোন আসা প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। তমাল ঝুঁকি নিয়ে একসময় নিজেই ফোন দিতে শুরু করল, কিন্তু বেশীরভাগ সময়ই তার ফোন সুইচড অফ থাকত। তমালের শক্তি ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছিলো। সময় প্রায় শেষ, নাটকের শেষ দৃশ্য নিকটাসন্ন। অনেক কষ্টে দুএকবার যোগাযোগ করে মিনতি করল একবার দেখা করার জন্য। মনিকা রাজি হল। তমাল বলল এই সেতুপাড়ার পাহাড়ি এলাকায় আসার জন্য। মনিকা খুব স্বাভাবিকভাবেই সেজে গুজে আসল। কথা বলতে বলতে এই পাহাড়ি বাঁক অতিক্রম করে এই নির্জন পত্র পল্লবে আচ্ছাদিত নরম মাটির আঁকাবাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে দুজনে থামল। তমাল মনিকার হাতদুটো নিজের হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল একরাশ আবেগ নিয়ে,” সত্যি কি ভালোবাসো আমায়?” মনিকা মুচকি হেসে বলল, “ বাড়িতে অনেকে সন্দেহ করছেন হয়ত আমি কারো সাথে প্রেম করছি আমার নিয়মিত ফোনালাপ দেখে। তাই ফোন-টোন কম দেই, সুইচড অফ করে রাখি। ভালোবাসি তো অবশ্যই।“বলে তমালের গালে আলতো করে চুমু খেল মনিকা।পাহাড় আর বনাঞ্চলের এক বন্য গন্ধ এসে সেই অনুভূতিকে আরো মাদকীয় করে তুলল। মনিকার ঠোঁটের স্পর্শের সেই রেশ আজো রয়ে গেছে তার গালে, হৃদয়ে।
মনিকার সাথে তমালের এই শেষ দেখা। চাইলে সে তার বাড়ির আশেপাশে গিয়ে ঘুরঘুর করতে পারত, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে সেটা জেনে ওখানে গিয়ে খোঁজ করতে পারত। তমাল ওসব কিছুই করেনি। এতো জুনিয়র একটা মেয়েকে খোঁজে বেড়ানোর অর্থ এই সমাজের সবাই বুঝবে। আর তাছাড়া তমাল ওরকম গোছের ছেলেও নয়। তাই একচেটিয়া নাটকের সমাপ্তি হয়েছিল এখানেই, এই পাহাড়ের বাঁকে।
তমাল বসে আছে। বসে আছে স্বপ্নাবিষ্টের মতো। সেই বন্য গন্ধটা এখন সে পাচ্ছে। আর বুঝতে পারছে কোথায়, কোন সুদূর অতীতে যেন ক্রমাগত সে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। মনিকার স্পর্শ তো আর সে পাবেনা, তাই অনুভূতিতেই সে নিজেকে একাত্ম করে দিচ্ছে ধীরে ধীরে। এই পরম ভাবনা তমালের নিজেরই মনে সৃষ্ট হওয়া নিজেরই এক স্বতন্ত্র অনুভূতি। মনিকা কিছুই দেয়নি তাকে। দিয়েছিল তাকে অনুভূতিহীন কিছু স্পর্শ। শুধুই স্পর্শ!

মন্তব্য ১ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে জানুয়ারি, ২০২০ রাত ৩:২২

সামু পাগলা০০৭ বলেছেন: কি অদ্ভুত! এত সুন্দর লেখায় কোন মন্তব্য নেই.........

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.