নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শিল্প ও সাহিত্য জগতের এক তৃষ্ণার্ত পথিক।

অনন্ত নিগার

বিজ্ঞানের সঠিক তথ্য বদলে দেবে আপনার জীবন!

অনন্ত নিগার › বিস্তারিত পোস্টঃ

ঘূর্ণিঝড় কি এবং কেন হয়

২৬ শে নভেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:২৫


প্রাচীনকালে আদিম, অজ্ঞ মানুষেরা প্রাকৃতিক দুর্যোগকে ভয় পেয়ে সৃষ্টি করত নানা জল্পনা-কল্পনা কিংবা কল্পকাহিনি। ওইসব উদ্ভট কল্পকাহিনি তৈরির কারণ ছিল তাদের অজ্ঞতা। তারা মনে করত অদৃশ্য কোনো মহাক্ষমতাধর ব্যক্তি বা দেবদেবী তাদের ওপর কোনো কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে এহেন আক্রমণ চালিয়ে তিনি তার আক্রোশের প্রকাশ ঘটাচ্ছেন। হয়তো তিনি মানুষকে এসব দুর্যোগ দ্বারা মানবকুলের অনিষ্ট সাধন করে তাদেরকে কোনো সতর্ক বার্তা দিচ্ছেন কিংবা বুঝাতে চাইছেন যে তিনি কোনো কারণে মানুষের ওপর অসন্তুষ্ট। অথবা তিনি যে কতটুকু শক্তি রাখেন এই রহস্যময় পৃথিবীতে, তারই জানান দিচ্ছেন এসব তাণ্ডবলীলা ঘটিয়ে। কারণ মানুষের জ্ঞানের পরিসীমা তখন খুবই ক্ষুদ্র ছিল। ইতিহাস পড়লে জানতে পারি আমরা স্থান বিশেষে এমনও হত যে, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগকে দেবতাদের অসন্তুষ্টি হিসেবে ধরে নিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করে প্রাণ বাঁচানোর জন্য, কিংবা নিজেদের আহার্য শস্যাদি, ফসল রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন কুমারী মেয়েদের উৎসর্গ করা হত দেবতাদের উদ্দেশ্যে। মানুষের ধারণা ছিল, মানুষের যেমন ক্ষুধা আছে, কামনা-বাসনা আছে, ক্রোধ আছে, নারী সৌন্দর্যের প্রতি আদিম টান আছে, তেমনি তা তাদের রক্ষক, তাদের পালনকর্তা দেবতাদেরও আছে। আর সেই জন্যই তারা তাদের লোকালয়ের সবচেয়ে সুন্দরী, কুমারী তনয়াকে দেবতাদের নামে অদৃশ্যের হাতে সঁপে দিত, যদি এতে দেবতা সন্তুষ্ট হয়ে তাদের ওপর দিয়ে ক্রোধ নিবারণ থেকে নিজেকে ক্ষান্ত করেন! মানুষ যখনই প্রকৃতির কোনো জটিল কিংবা সরল ঘটনার ব্যাখ্যা খুঁজে পেতনা, তখুনই তারা তাদের অজ্ঞতা থেকে সৃষ্টি করত এসব গাঁজাখুরি চিন্তাভাবনা। কারণ, মানুষ এমন একটি প্রজাতির প্রাণী, যার কৌতূহল অসীম এবং সে জীবিত থাকাকালীন অবস্থায়ই পেতে চায় সমস্ত প্রশ্নের উত্তর। আর তাই তো প্রাচীনকালে আদিম মানুষেরা ঝড়-তুফান, ভূমিকম্প, বন্যা, খরা, তুষারপাত, দাবানল কিংবা উল্কাপাত- এইসব প্রাকৃতিক ঘটনার কোনো সুরাহা না করতে পেরে কখনও সূর্যকে, কখনও বাতাসকে, কখনও আগুনকে, আবার কখনও বা কোনো পশুকেও পর্যন্ত তারা নিজেদের উপাস্যে পরিণত করেছিল। এখনও অনেক উপজাতি আছে পৃথিবীর গহীন জঙ্গলে (যেমন- আফ্রিকার জঙ্গলে) যারা আজো বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি বা অনেক পশুর উপাসনা করে। আবার আদিম মানুষদের কেউ কেউ এমনও চিন্তা ভাবনা করেছিল যে, যদি এইসব প্রাকৃতিক শক্তিকে (যেমন- বায়ু, আগুন, পানি ইত্যাদি) কোনোভাবে নিজের বশে আনা যায়, তাহলে সে এইসব শক্তিকে ইচ্ছেমতো নিজের স্বার্থে কাজে লাগাতে পারবে, হয়ে উঠতে পারবে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। মূলতঃ যাদুচর্চার চিন্তা ভাবনার সুত্রপাত এভাবেই ঘটেছিল বলে ধারণা করা যায়, যার রেশ, প্রভাব এবং বিশ্বাস আজো পৃথিবীতে ব্যাপ্ত এবং বিদ্যমান। পৃথিবীর যেখানেই যত বেশী অজ্ঞতা, অশিক্ষা শক্ত হয়ে শেখর গেড়ে বসে আছে, সেখানেই তত বেশী মানুষ নানা সমস্যায় জর্জরিত, আর অপবিশ্বাস, কুসংস্কার দ্বারা আক্রান্ত।
বিজ্ঞানের কাজ হল- প্রতিটি প্রাকৃতিক ঘটনার (হোক সেটা যতই দুর্বোধ্য) একটি যুক্তিসঙ্গত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দান করা যার পেছনে থাকবে গাণিতিক কিংবা পরীক্ষিত প্রমাণ। এর আগে আমি বিজ্ঞান সিরিজের প্রথম পর্বে ভূমিকম্পের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। আর আজ আমি আমার আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছি প্রকৃতির আরেক আঘাত- ঘূর্ণিঝড় নিয়ে। ভূমিকম্প আর ঘূর্ণিঝড়- প্রকৃতির এই দুই ‘ক্রোধ’-এর মধ্যে একটা চোখে পড়ার মত তফাৎ হচ্ছে, প্রথমজন কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই হামলা করেন। আর পরেরজন একটু আগাম বার্তা, যেমন- নয় নম্বর, দশ নম্বর ইত্যাদি বিপদ সংকেত বিভিন্ন লক্ষণের মাধ্যমে দেখিয়ে প্রেরণ করে আমাদেরকে কিছুটা বলে-কয়ে আসেন। কারণ, তার জন্য প্রস্তুতি থাকা চাই। কেননা, তিনি ভূমিকম্পের মত হঠাৎ এসে কয়েক মিনিটের মধ্যে আবার হঠাৎ উধাও হয়ে যাননা। তিনি যখন আসেন, বেশ আঁটসাঁট হয়ে প্রস্তুতি নিয়ে, দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে সময় নিয়েই আসেন। পুরো দিন, পুরো রাত, একেবারে ৭-১০ দিন পর্যন্ত তিনি এক লোকালয় থেকে আরেক লোকালয়ে তাণ্ডবলীলা চালাতে চালাতে অগ্রসর হতে থাকেন, যতক্ষণ না তার শক্তি বা ফুয়েল ফুরাতে ফুরাতে একেবারে দুর্বল হয়ে সাধারণ বৃষ্টিপাতে পরিণত হয়ে বিলুপ্ত না হয়ে যান।
এখন আসা যাক মূল প্রসঙ্গে। ঘূর্ণিঝড় আসলে কি? আর এটি কেনই বা ঘটে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমরা পেয়ে যাব পুরো আলোচনা শেষে। তবে প্রশ্নগুলোর উত্তর পাবার আগে আমাদেরকে কয়েকটা ব্যাপার জেনে নিতে হবে। অন্যথায়, আলোচনা চালিয়ে নিতে বা লেখাটি পড়ে পুরোপুরি বুঝতে একটু অসুবিধে হবে।
প্রথমে যেটা বুঝতে হবে সেটা হল, বায়ুচাপ কি? সহজ ব্যাপার। আমরা জানি, আমরা চারদিক থেকে নানারকমের গ্যাস দ্বারা পরিবেষ্টিত। যেমন- অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি। এর মধ্যে অক্সিজেন আর কার্বন-ডাই-অক্সাইড নামক দুটি গ্যাসের কথা আমরা খুব ভালো করেই জানি। এখন এই মিশ্রিত গ্যাসগুলো কিন্তু এক জায়গায় স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকেনা। কারণ, সূর্যের আলো পৃথিবীর সব জায়গায় সমানভাবে তাপ দিতে পারেনা বলে বায়ুর তাপমাত্রাও সব জায়গায় সমান হয়না। তখন যা হয়, তাহল- উষ্ণ তাপমাত্রার বায়ু হালকা হয়ে উপরে ওঠে যায়। আর সাথে সাথে সেই শূন্যস্থান দখল করার জন্য অন্য এলাকার অপেক্ষাকৃত শীতল বায়ু এসে দখল করে নেয়। তাপমাত্রার কারণে গ্যাসের এই অবিরাম প্রবাহকে আমরা বায়ুপ্রবাহ বা বাতাস বলি। যে এলাকার বায়ু উষ্ণ হয়ে উপরে ওঠে গেল, আর শীতল বায়ু এসে জায়গা দখল শুরু করে দিল, বলতে হবে সেখানে বায়ুর নিম্নচাপ শুরু হয়েছে। উল্টোভাবে, শীতল এলাকায় যেখানে বায়ু ঘন আর ভারী, সেখানে বায়ুর উচ্চচাপ বিদ্যমান রয়েছে। অর্থ্যাৎ বায়ুর তাপমাত্রার কারণে উচ্চচাপ ও নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। সুতরাং এককথায় বলতে গেলে, বাতাসের প্রতি বর্গমিটারে বায়ু তার তাপমাত্রার কারণে কতটুকু চাপের সৃষ্টি করে, কতটুকু ভারী বা কতটুকু হালকা, তাই হচ্ছে বায়ুর চাপ। বায়ু হালকা হয়ে উপরে উঠলে নিম্নচাপ আর ভারী হয়ে থাকলে উচ্চচাপ বিরাজমান- এটাই হল মনে রাখার ও বুঝার কৌশল।
এবার দেখি আমরা বায়ুর আর্দ্রতা কি? বায়ুর আর্দ্রতা হল বায়ুতে জলের উপস্থিতি। আমরা জানি যে, সূর্যের তাপে জলের বিভিন্ন উৎস থেকে পানি বাষ্প হয়ে বাতাসে মিশে যায়। বাতাসে এই জলের উপস্থিতিই বাতাসের আর্দ্রতা নির্দেশ করে। বাতাসের আর্দ্রতা যখন অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা জায়গায় এসে তাপ হারাতে শুরু করে, তখন সেই বাষ্প আবার জলে রূপান্তরিত হয়। অর্থ্যাৎ তাপে যেমন জল বাষ্পে পরিণত হয়ে বাতাসে মিশে যায়, উল্টোভাবে তাপ হারালে বাতাসের বাষ্প পুনরায় জলে রূপান্তরিত হতে পারে। আর এর নজির আমরা দেখতে পাই ঠান্ডা বোতল বা গ্লাসের গায়ে। ঠান্ডা বোতলের গায়ে যে ফোঁটা ফোঁটা পানি জমে, তার ব্যাখ্যা হল- বাতাসে ভাসমান বাষ্প ঠান্ডা বোতলের স্পর্শে এসে তাপ হারিয়ে পানিতে রূপান্তরিত হয় এবং বোতলের গায়ে ফোঁটা ফোঁটা হয়ে লেগে থাকে। এটা বাতাসের আর্দ্রতার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
এবার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যা আলোচনা না করলে ঘূর্ণিঝড়ের আলোচনাটা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। সেটা হল- নিরক্ষরেখা। শব্দটা একটু কঠিন বা বিদঘুটে শোনালেও এর সংজ্ঞাটা শুনলে কাঠিন্যের শঙ্কাটা একেবারেই কেটে যাবে। প্রায় কমলালেবুর মত গোল পৃথিবীটার গোলক হাতে নিয়ে এর ঠিক পেট বরাবর মানে মাঝ বরাবর একটা দাগ যদি কল্পনা করি যেটা পৃথিবী নামক গোলকটাকে ঠিক সমান দুইভাগে ভাগ করবে, তাহলে সেই রেখাটাকেই বলা হবে নিরক্ষরেখা বা বিষুবরেখা। নিরক্ষরেখা থেকে যত উপরে উঠবেন, বলা হবে আপনি উত্তরে যাচ্ছেন, কারণ ওদিকে উত্তরমেরু। আর নিরক্ষরেখার নীচ বরাবর নামতে থাকলে বলা হবে উল্টোটা, অর্থ্যাৎ দক্ষিণমেরুর দিকে যাচ্ছেন দক্ষিণ বরাবর। তারমানে আমরা নিরক্ষরেখাকে শূন্য ধরে উপরে পাচ্ছি উত্তর গোলার্ধ আর নীচে পাচ্ছি দক্ষিণ গোলার্ধ। আর নিরক্ষরেখার সমান্তরাল আরো কিছু রেখা কল্পনা করা হয়, যেগুলোকে বলা হয় অক্ষরেখা বা অক্ষাংশ। নিরক্ষরেখাকে শূন্য ডিগ্রী ধরে এর উপরে আটটা বড় বড় সমান্তরাল দাগ কল্পনা করি। শূন্য থেকে একেক দাগের ব্যবধান ধরি দশ ডিগ্রী। তাহলে আমরা ক্রমানুসারে উপরে উত্তরদিকে উঠতে থাকলে পাই- শূন্য, দশ, বিশ, ত্রিশ, চল্লিশ...আশি অর্থ্যাৎ আশি ডিগ্রীতে এসে থামবে। একইভাবে, নীচে দক্ষিণেও শূন্য থেকে আশি ডিগ্রী পর্যন্ত পাব। এখন প্রশ্ন হল- আমাদের বাংলাদেশ উত্তর গোলার্ধের কত ডিগ্রীর মধ্যে রয়েছে? পৃথিবীর ম্যাপ হাতে নিলে দেখবেন, বাংলাদেশের অবস্থান দশ থেকে ত্রিশ ডিগ্রীর ভেতরে রয়েছে। আর যত সমস্যা এখানেই। কারণ, শূন্য ডিগ্রীতে বায়ুর ঘূর্ণন সম্ভব হবেনা। এমনকি শূন্য থেকে পাঁচ ডিগ্রীর ভেতরে মোটামুটি সমুদ্রে সৃষ্ট বায়ু প্রবাহের কোনো ঘূর্ণির সৃষ্টি হবে না। ঘূর্ণন সৃষ্টি হয় পাঁচ ডিগ্রীর বাইরের অঞ্চলে। তাহলে প্রশ্ন হল- বায়ুপ্রবাহে ঘূর্ণির সৃষ্টি হলে ঘূর্ণনের দিক কোন দিকে হবে? আমরা জানি, পৃথিবীটা ঘড়ির কাটার দিক বরাবর ঘুরছে। তারমানে এটা স্পষ্ট যে, উত্তর গোলার্ধে অতিকায় কোনো বস্তু বা বায়ুর ঘূর্ণন সৃষ্টি হলে সেটা পৃথিবীর ঘূর্ণনের বিপরীত দিকে ঘুরতে বাধ্য হবে অর্থ্যাৎ ঘড়ির কাটার বিপরীত দিকে ঘুরবে। কেন? কল্পনা না করে ছোটোখাটো একটা সহজ পরীক্ষা করলেই তো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়। একটা গোলাকার পাত্র নিন যার নীচে ঠিক মাঝখানে কেন্দ্রের মধ্যে একটা স্ট্যান্ড যুক্ত রয়েছে। পাত্রটাতে কিছু পানি নিন। পানি কোন দিকে ঘুরবে সেটা জানার জন্যে পাতলা, ছোট কোনো বস্তু, যেমন বোতলের ছিপি বা প্লাস্টিকের কোনো টুকরা রেখে দিন। ব্যাস হয়ে গেল। এবার গোলাকার পাত্রটাকে স্ট্যান্ডকে কেন্দ্র করে লাটিমের মত সজোরে ঘুরাতে থাকুন। দেখবেন, যেদিকে গোলাকার পাত্র তার অক্ষ বরাবর ঘুরছে, পানি ঠিক বিপরীত দিকে ঘুরছে। যদি পানির ঘূর্ণনের দিক স্পষ্ট না বুঝতে পারেন, তাহলে পানিতে রাখা সেই প্লাস্টিকের টুকরা বা ছিপির দিকে তাকান। এবার পানির ঘূর্ণনের দিক স্পষ্ট হয়ে যাবে। তবে একটা ব্যাপার খেয়াল করলে দেখবেন, পানিতে ভাসমান ছিপিটা যদি পানিতে ঘূর্ণনের একেবারে কেন্দ্রে চলে আসে, তাহলে কিন্তু সেটি আর স্রোতের সাথে তাল মিলিয়ে ঘুরবেনা। এটি কেন্দ্রের মধ্যে আপেক্ষিকভাবে স্থির হয়ে থাকবে। তারমানে আমরা যা রেজাল্ট পেলাম, তা হল- পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে যদি কোনো ঘূর্ণির সৃষ্টি হয়, তবে তার দিক হবে পৃথিবীর ঘূর্ণনের বিপরীত দিকে। ব্যাস, হয়ে গেল! আসল কটকটে জিনিসগুলোই আলোচনা করা হয়ে গেছে। এবার ঘূর্ণিঝড় কি সেটা বুঝা আর কোনো ব্যাপারই নয়।
গ্রীষ্মকালে উত্তর গোলার্ধে পাঁচ ডিগ্রী অক্ষাংশের বাইরে একটি অঞ্চলের কোনো সমুদ্র পৃষ্ঠের কথা বিবেচনা করা যাক। যখন সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রী সেলসিয়াসের উপরে চলে আসবে, তখন সমুদ্রের পৃষ্ঠের বায়ু হালকা হয়ে উপরে ওঠতে শুরু করবে। সাথে সাথে অন্য এলাকার অপেক্ষাকৃত শীতল বায়ু এসে সেই স্থান দখল করতে শুরু করবে। অর্থ্যাৎ আপনারা নিশ্চয় বুঝে গেছেন যে, সমুদ্র পৃষ্ঠে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়েছে। আস্তে আস্তে এই প্রক্রিয়া চলতে থাকবে কারণ, সমুদ্রের পানির উপরের বায়ু ক্রমাগত তাপ হারিয়ে হালকা হয়ে উপরে উঠতে উঠতে ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু সেই নির্দিষ্ট অঞ্চলের শূন্য স্থান পূরণের জন্য ক্রমাগত শীতল বাতাস আসতেই থাকবে। যত বেশী নিম্নচাপের এই প্রক্রিয়া চলতে থাকবে, ততই কেন্দ্রের দিকে শীতল বায়ুর ধেয়ে আসাটা আরো ত্বরান্বিত হবে। কারণ, নীচে যতই শীতল বায়ু এসে চাপ দিতে শুরু করবে ততই বেড়ে যাবে এখানকার তাপমাত্রা। উপরে ছড়িয়ে পড়া গরম বায়ু আর নীচে সংকুচিত শীতল বায়ু- এই দুই তাপমাত্রার বায়ুর মিলনে আস্তে আস্তে মিলনস্থলে আর্দ্র বায়ু তাপ হারিয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানির সৃষ্টি করতে থাকবে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, এবার বায়ুর সাথে সাথে আস্তে আস্তে উপরের দিকে বৃষ্টিপাতেরও সূচনা হচ্ছে। যেহেতু পৃথিবীটা ঘূর্ণায়মান, তাই সমুদ্রপৃষ্ঠে সৃষ্ট হওয়া বায়ুর এই সমাবেশেও ঘূর্ণনের সৃষ্টি হবে। কোনদিকে ঘুরবে? আগেই বলেছি পৃথিবী যেদিকে ঘুরবে, তার বিপরীত দিকে হবে বায়ুর সেই ঘূর্ণন অর্থ্যাৎ ঘড়ির কাঁটার ঠিক বিপরীত দিকে। ক্রমশ দ্রুত ঘুরতে থাকা বায়ুর কুন্ডুলী আস্তে আস্তে বিরাট আকার ধারণ করতে থাকবে এবং সেই সাথে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে জলোচ্ছ্বাসেরও পরিমাণ। এভাবে বায়ুর ঘূর্ণন, বায়ুতে জলোচ্ছ্বাসের উপস্থিতি এবং ক্রমবর্ধমান বেগ মিলে সৃষ্টি করবে যে ঝড়, তার নামই হল- ঘূর্ণিঝড়, যাকে ইংরেজিতে বলে সাইক্লোন। এই সাইক্লোনকেই চীন বা জাপানে বলা হয় টাইফুন। আবার বঙ্গোপসাগর, ভারত মহাসাগর এবং আরব সাগরে একে সাইক্লোনই বলা হয়। পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে আমেরিকার কাছাকাছি আটলান্টিক মহাসাগর এলাকায় একে বলা হয় হারিকেন। আবার এই সাইক্লোনই যখন প্রবল ঘূর্ণি নিয়ে অল্পস্থান জুড়ে ঘটে, তখন সেটাকে বলা হবে টর্নেডো। তারমানে দেখা যাচ্ছে, সবগুলো আসলে একই জিনিস। এই ঘূর্ণিঝড়কেই একেক এলাকায় একেক নামে ভূষিত করা হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় যে কেবল উত্তর অক্ষাংশে ঘটে তা না। উত্তর অক্ষাংশের বিপরীতে দক্ষিণ অক্ষাংশেও ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়। তবে সেখানে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের ঘূর্ণনের দিক থাকে ঘড়ির কাঁটার দিকেই। তারমানে আমরা বুঝতে পারছি যে, শূন্য থেকে পাঁচ ডিগ্রী অক্ষাংশের ভেতরে ঘূর্ণিঝড় হয়না। ঘূর্ণিঝড় হতে হলে পাঁচ ডিগ্রী অক্ষাংশের বাইরে যেতে হবে। কারণ, পৃথিবীর ৩০ ডিগ্রী উত্তর অক্ষাংশ থেকে ৩০ ডিগ্রী দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে যে অঞ্চল, সেই অঞ্চলকে বলা হয় গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চল। আর ঘূর্ণিঝড় সংঘটিত হয় গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে। বাংলাদেশ যেহেতু ৩০ ডিগ্রী উত্তর অক্ষাংশের ভেতরে, তাই বাংলাদেশকে গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশ বলা হয়। সেজন্যই বাংলাদেশ প্রায় সময় ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে।
এবারে কিছু তথ্য দেওয়া যাক ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষমতা সম্পর্কে। আমরা জানি, প্রতিটি কাজের জন্যই চাই তার প্রয়োজনীয় শক্তি। কোনো ইঞ্জিনই তেল, গ্যাস অর্থ্যাৎ ফুয়েল ছাড়া চলতে পারে না। তেমনি ঘূর্ণিঝড় এগিয়ে যেতে হলে তারও থাকা চাই শক্তি উৎপাদনকারী ফুয়েল। আর ঘূর্ণিঝড়ের ফুয়েল হল- সমুদ্রের পানি থেকে নেয়া তাপশক্তি। তারমানে এটা পরিষ্কার যে, যখন ঘূর্ণিঝড় কোনো উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে, তখন সেটা ক্ষতি সাধন করে ঠিকই, কিন্তু যেহেতু সেটা ভূমি অঞ্চলে প্রবেশ করে ফেলেছে, সুতরাং পানির অভাবে সেটা আস্তে আস্তে দুর্বল হতে শুরু করবে এবং একসময় ঝড় বৃষ্টিতে রূপান্তরিত হয়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়। অর্থ্যাৎ সমুদ্রের পানির তাপশক্তিই হচ্ছে ঘূর্ণিঝড়ের চালিকাশক্তি। আর ঘুর্ণিঝড় অব্যাহত থাকতে হলে, তার নীচে অবশ্যই সমুদ্রের পানি থাকতে হবে।
ঘূর্ণিঝড়ের আকৃতি কিরূপ? ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে সমুদ্রের নিম্নচাপের কারণে সৃষ্ট বায়ুর প্রচণ্ড ঘূর্ণন। আর এই ঘূর্ণন সৃষ্টি হয় পৃথিবীর বৃত্তাকার ঘূর্ণনের কারণে। লাটিম যখন একটি কেন্দ্র বরাবর ঘুরে, তেমনি ঘূর্ণিঝড়েরও একটি কেন্দ্র থাকে, যাকে বলা হয় eye বা চোখ। এই চোখের মধ্যেই চাপ থাকে সবচেয়ে নিম্নমাত্রার। আর এর বাইরের দেয়ালে অর্থ্যাৎ ঘূর্ণনশীল বায়ুতে চাপ থাকে চোখের চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেশী। চোখ বা কেন্দ্রের ব্যাস থাকে সাধারণত ৩০-৬৫ কিলোমিটার। এই কেন্দ্র কিন্তু বাইরের ঘূর্ণনশীল বায়ুর মত ভয়ংকর থাকেনা। কারণ, কেন্দ্রের মধ্যে কিন্তু ঘূর্ণনের প্রভাব থাকে খুবই সামান্য। যার কারণে কেন্দ্রের উপরে পরিষ্কার, মেঘমুক্ত আকাশও দেখা যায়। তাই ঘূর্ণিঝড় যখন দক্ষিণমুখী হয়ে ঘুরতে ঘুরতে কোনো উপকূলের উত্তর দিকে এগুতে থাকে, তখন প্রথম ধাপের বাতাস পেরিয়ে যাবার পর সেখানে কেন্দ্র এসে হাজির হয়। কেন্দ্রের অপেক্ষাকৃত কম বায়ু প্রবাহ ও পরিষ্কার আকাশ দেখে তখন মানুষ ভাবে আপদ কেটে গেছে। কিন্তু এরপরেই আসে দ্বিতীয় ধাপের বাতাসের ধাক্কা। আর সেই ধাক্কাটা থাকে আগেরটার চাইতেও আরো অনেক শক্তিশালী। একটা ব্যাপার জেনে রাখা উচিত যে, সমুদ্রে বায়ুপ্রবাহের সৃষ্টি হলেই যে ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হবে, তা কিন্তু না। সমুদ্রের নিম্নচাপবর্তী অঞ্চলে যে বায়ু প্রবাহের সৃষ্টি হয়, সেটা কিন্তু উচ্চচাপের এলাকা থেকে নিম্নচাপের এলাকায় শীতল বাতাস ক্রমাগত ধেয়ে আসার কারণে হয়। বাতাসের এই ধেয়ে আসার গতি এবং পৃথিবীর ঘূর্ণনের ফলে সৃষ্ট বায়ুর ঘূর্ণন গতি- এই দুই গতির মধ্যে যখন মোটামুটি একটা ব্যালেন্স তৈরি হয়, তখনই ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়। অন্যথায়, ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হবার আগেই সেটা মুখ থুবড়ে পড়বে। ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের বেগ থাকে সাধারণত ঘন্টায় ৯০-১১৭ কিলোমিটার। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, এরকম বেগের একটি ঘূর্ণিঝড়ের আক্রমণ কতোটা তীব্র হয়ে ওঠতে পারে।
তবে এটা সত্যি, প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগ মূলত পৃথিবীর ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার জন্য সংঘটিত হয়। বরং প্রাচীনকালে এই সমস্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটনের মাত্রা আরো বেশী ছিল। সাড়ে চারশত কোটি বছরের এই পৃথিবীটা এরকম প্রকান্ড দুর্যোগের চড়াই উতরাই পেরিয়েই বরং আজকের স্থিতিশীল পৃথিবীতে পরিণত হয়েছে। যদি সত্যিই প্রাকৃতিক দুর্যোগ কোনো দেবতার ‘ক্রোধ’ হত, তাহলে সহজেই প্রশ্ন আসবে যে, পৃথিবীতে যখন মানব প্রজাতির অস্তিত্বই ছিলনা, বরং শুধু অন্যান্য প্রাণির অস্তিত্ব ছিল, তখন যে সমস্ত বড় বড় দুর্যোগ হত (যেমন- আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ, তীব্র ভূ-কম্পন, উল্কাপাত, আগ্নেয়বৃষ্টি, বন্যা, তুষারপাত, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি), সেই দুর্যোগের ঝালগুলো দেবতারা তখন কাদের ওপর মেটাতেন? কিংবা কাদের পাপে তখন সেই সমস্ত দুর্যোগ সংঘটিত হত?

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.