নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শিল্প ও সাহিত্য জগতের এক তৃষ্ণার্ত পথিক।

অনন্ত নিগার

বিজ্ঞানের সঠিক তথ্য বদলে দেবে আপনার জীবন!

অনন্ত নিগার › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ প্রেমের বিপদ

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সকাল ৯:১৯

সকাল থেকে আবিরের ঘন ঘন ফোনের যন্ত্রণায় আমার সকালি ঘুমটা হারাম হয়ে গেল। সকালি ঘুম বলার কারণ সকালেই আমার মূল ঘুম হয়। রাতের বেলায় বই পড়া, মিথিলার সাথে আবেগি, অবান্তর কিংবা অবাস্তব সব সপ্নের কথাবার্তা বলে ফোনালাপ চালিয়ে যাওয়া, কিংবা গানশুনা - মোদ্দাকথা কাজের কাজ কিছু নয়, অকাজে সময় কাটিয়ে দেই আর ঘড়ির কাঁটা প্রায় দুইটা অতিক্রম করলে শুয়ে পড়ি। সুতরাং সারারাতে জেগে থেকে যে ক্লান্তি আর অবসন্নতা তৈরি হয়, তা কাটাতে হয় সকালে লম্বা ঘুম দিয়ে বেলা করে বিছানা ছেড়ে। তাই এই সকালি ঘুমটাই আমার মূল ঘুম। তবে আজ আর হল না আবিরের এই অহেতুক বারবার ফোন করাটার জন্য। বারবার আমাকে জাগিয়ে জাগিয়ে ঘুমের পুরো আমেজটাই নষ্ট করে দিল। কি আর করা! তড়িঘড়ি করে ওঠে বাথরুম আর বিছানা সেরে রওয়ানা দিলাম ওর বাসাতে, ঝর্ণা পাড়ায়। আমার বাসা থেকে ওর বাসা খুব একটা দূরে নয়, সিকি মাইলের মতো হবে কিনা সন্দেহ, তবু তো আমার জমিদারি পা দুটো রিকশা না নিলে রাস্তায় প্রতিটা পদক্ষেপে আমার শরীরের মাত্র পঞ্চান্ন কেজি ভার বইতে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। কি আর করা। বাপের পকেট থেকে আমার পকেটে মাগনা আসে, আর তাই আমিও খরচ করতে কার্পণ্য করি না।
সব মিলিয়ে দশ মিনিটে পৌঁছে গেলাম আবিরের একতলা বাসায়। গিয়ে দেখি ড্রয়িংরুমে সে অস্থিরভাবে পায়চারি করছে। আমাকে দেখে যেন তার খরতাপে অতিষ্ঠ হৃদয়ে কিছুটা শীতল ছায়া মিলল। সোফায় আমাকে বসিয়ে বলল, ‘’দোস্ত তুই বস। আগে কিছু একটা খেয়ে নে, তারপর প্ল্যান প্রোগ্রাম করে রওয়ানা দিব। আমি বললাম, কিসের প্ল্যান প্রোগ্রাম? তোদের তো ফোনেই সব ঠিকঠাক হয়েই আছে, সুতরাং প্ল্যান প্রোগ্রাম করার আর কি বাকি রইল?” আবির একটু গলা নামিয়ে বলল, “তবু তো দোস্ত অচেনা মেয়ে, ফোনে পরিচয়, ফোনেই প্রেম। কিন্তু সরাসরি তো আর দেখিনি, মেয়ে তো আর স্মার্টফোন ব্যবহার করেনা। বুজতেই পারছিস, ও ইন্টারনেট ব্যবহার করে না বিধায় ও সোশ্যাল নেটওয়ার্কের বাইরে থাকে, তাই একটা ছবি বিনিময়েরও সুযোগ হয়নি। এখন কথা হল, দেখা হবার আগে আমার পোশাক আশাক, গেট-আপ, তারপর ওখানে গিয়ে সিচ্যুওয়েশন যদি অন্যরকম থাকে বা মেয়েকে আমার যদি পছন্দ না হয় বা আমাকে যদি ওর পছন্দ না হয়, তো পরিস্থিতি তো সামাল দিতে হবে, আর সেজন্যই তো তোকে ডাকা। শত হলেও তুইই তো আমার একমাত্র বাল্যবন্ধু। তোকে ছাড়া কি হবে?” আমি একটু মুরব্বীয়ানা দেখিয়ে বললাম, “ঠিক আছে তৈরি হয়ে নে, আমি অপেক্ষা করছি। কিছু খেতে দিতে হবে না, নাস্তা খেয়ে এসেছি এইমাত্র। তুই রেডি হো, আমি বসা আছি।“ আবির সাথে সাথে বলল, “ সামান্য চা নাহয় খা...আমি এর ভেতরে...” আমি হাত তুলে বললাম,” তুই ঝটপট রেডি হো। আগে অভিযান শেষ করে আসি, তারপর খাওয়া দাওয়া।’’
মাত্র আধাঘন্টা ব্যবধানে আমরা পৌঁছে গেলাম খান বাজারে। পূর্বদিকে লাগাতার শপিংমল আর রেস্তোরাঁ, ক্যাফেটরি ইত্যাদি। নির্দিষ্ট শপিংমলে ঢুকে পাঁচ তলায় উঠে গিয়ে ঢুকলাম ‘ওয়েস্টার্ন ফুড’ নামক অভিজাত রেস্তোরাঁয়। নিরিবিলি এক কর্নারে গিয়ে পালিশ করা ঝকঝকে মুখোমুখি দুটো চেয়ারে গিয়ে বসলাম। আমাদের পাশে আরো দুটো চেয়ার খালি, আমরা যার জন্য অপেক্ষা করছি, তিনি একা আসলে বা সঙ্গে কাউকে নিয়ে আসলেও বসতে পারবেন। এই রেস্তোরাঁটাই আগে থেকে ঠিক করে রেখেছেন আমার বন্ধু আবির সাহেব। “এতদিন আমাকে বলিস নি কেনো?” বসার সাথে সাথেই জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলাম আমি। “আরে বলার মতো তো তেমন কিছুই হয়নি। একবছর আগে আমার বান্ধবী শীলাকে ফোন করেছিলাম ওর নাম্বারে, দেখি ধরল অচেনা কণ্ঠের আরেক মেয়ে। বলল শীলার দুঃসম্পর্কের খালাতো বোন সে, শীলা তাকে সিমকার্ডটা দিয়ে দিয়েছে, ও এখন নতুন নাম্বার ইউজ করে। আমাকে শীলার নতুন নাম্বার দিল, আর ফর্মালি শুধু কয়েক মিনিট আলাপ করলাম। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম ও থাকে মফস্বলে, আড়িয়ালগড়ে। শীলাদের বাসায় এসে দুয়েকদিন থেকেছিল। এর ভেতরেই নাকি সিমটা ও নিয়েছিল।“ আমি বুকের উপর হাত গুঁটিয়ে বসে মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকলাম ইতিবৃত্ত। এই সময় বয় আসল অর্ডার নিতে। আবির আমার দিকে তাকিয়ে বলল,” এখনই হালকা পাতলা কিছু খাবি, নাকি ও আসলে...” আমি সাথে সাথে বললাম” ও আসতে কতক্ষণ লাগবে জানি না। এগারোটায় আসার কথা বলেছিলি’’ আমি হাতঘড়ি দেখে বললাম,’’এখনও পনেরো মিনিট বাকি। তাছাড়া মেয়েদের সাজগোজ সাড়তেই এক্সট্রা এক ঘন্টা সময় লাগে। সুতরাং ভাই হালকা পাতলা কিছু মেরে দেই!’’ বয়কে আমিই অর্ডার দিলাম,” ভাই দুটো স্ট্রোবেরী মিল্কশেক দিয়ে দিন।’’ বয় চলে যেতেই আবির বাকিটা বলতে শুরু করল, “তো মেয়েটার গলার স্বর দারুন লাগল! চিকন আর টেনে টেনে কথা বলে। ঐদিন গলার স্বরটা শোনার পর থেকেই মেয়েটাকে দেখতে ইচ্ছে করেছিল। কয়েকদিন পর ইচ্ছে করে বাহানা বানিয়ে আবার ওকে ফোন করলাম। বললাম যে শীলা কয়েকদিন ধরে ভার্সিটিতে আসছে না, ওর ফোনও সুইচড অফ পাচ্ছি। সে এ ব্যাপারে কিছু জানে কিনা। ও বলল যে না। আমি তখন সাথে সাথে কথার মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে আলাপচারিতা শুরু করলাম। ওর নাম, কিসে পড়ে ইত্যাদি ইত্যাদি কয়েকটা কথা জেনে রেখে দিলাম। তবে রাখার আগে মেয়েটাকে বলেই ফেললাম, আপনার গলার স্বর দারুণ। মাঝে মাঝে ফোন দিলে সে রাগ করবে কিনা, একথা জিজ্ঞেস করাতে মেয়েটা খুব অবাক হল, তারপর একটু প্রশ্রয়ের স্বরে বলল, সমস্যা নেই, যেহেতু আপনি শীলার বন্ধু। ব্যাস, এই থেকে শুরু। প্রায় একবছর কথা টথা বলে এই আজ এসে দেখা পর্যন্ত গড়ালো। ওর নাম শিউলি। এখন দেখা যাক, বাকিটা আমার ভাগ্যের উপর। তবে ভাই কথা হল অলরেডি আমাদের প্রেম বেশ গভীরে চলে এসেছে। আসলে জানিস কি, আমি তো খুব থ্রিল ফীল করছি! এই যে না দেখে ফিল্মি কায়দায় প্রেম করাটা। দারুণ জিনিস! মনের মিল তো একরকম হয়েই আছে, এখন ভাই একটু দুয়া কর, দেখতে একটু সুশ্রী হলেই হল। ব্যাস, আর কে আটকাবে আমাকে? বিয়ে করেই ফেলব।’’ টেবিল চাপড়ে চেয়ারে আয়েশ করে হেলান দিতে দিতে ঘোষণা দিল আবির।
আমরা দুজনে যখন মিল্কশেক দুটো শেষ করে আরো প্রায় মিনিট দশেক গল্প করে পার করে দিলাম, ঠিক তার পরপরই দরজা ঠেলে একটা মেয়ে ঢুকল। ঢুকে কোথাও না বসে রেস্টুরেন্টের ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে ইতিউতি করে চারিদিকে তাকিয়ে কাউকে খুঁজতে লাগল। দৃশ্যটা ছিল দেখার মত। কারণ মেয়েকে কয়েক নজর দেখে নিয়েই আমি ঝট করে চোখ ঘোরালাম আবিরের দিকে, বন্ধু আমার একেবারে মুখ হাঁ করে মেয়েটাকে দেখছিল আর যত ক্রীম, পাউডার মেখে এসেছিল সব ঘেমে একেবারে গলে গলে পড়ছিল। আবির শক্ত করে তার ডান হাত দিয়ে টেবিলের উপর রাখা আমার বাঁ হাতটা চেপে ধরে বলল, ‘’দোস্ত, দোয়া কর, ওই মেয়েটা যেন না হয়, প্লীজ দোস্ত!” আমি দ্রুত হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে চাপা ধমক দিয়ে বললাম,” শালা তুমি মাল জুটিয়ে বলছ আমি দোয়া করব! আমার তো খেয়ে দেয়ে কাজ নেই! চুপচাপ বসে থাক! দেখি কি হয়।’’ যে মেয়েটাকে দেখে আমাদের ভিড়মি খাওয়ার যোগাড় তাকে দেখলে যে কোন ছেলেরই পালানো ছাড়া উপায় নেই। লিকলিকে কালো শরীর, ত্যাবড়া- তোবড়া নাক মুখ আর মাছের মত বড় বড় চোখ, আর কোঁকড়ানো খোলা চুল। একেতো কালো, তার ওপর পড়ে এসেছে গাঢ় নীল বর্ণের সেলোয়াড় কামিজ। এই শুটকি মার্কা শরীর আর দুই নাম্বারি ডিজাইনের চেহারা দেখে আমার বন্ধু আবিরের প্রবল উৎসাহ একেবারে ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল। মেয়েটা এতক্ষণে আমাদেরকে দেখতে মেয়ে খুব সাবাভবিকভাবে যেন আমরা তার অনেকদিনের পরিচিত এমনভাবে সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,” হ্যালো! আমি শিঊলি। আপনাদের মধ্যে আবির কে?” আবির অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইল। বিপদে পড়লাম আমি। কোন কিছু না করে এখন আমি পড়লাম মাঝখানে। আমি খানিকটা ঢোক গিলে নিয়ে একটু সাহস সঞ্চয় করে বললাম,’’ আপনি বসুন না। আগে একটু কথা বলে নেই আপনার সাথে।“ মেয়েটাও নাছোড়বান্দার মতো হেসে বলল,” আমি শিওর না হয়ে কি করে বসি। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত যে আপনাদের দুজনের মধ্যে কেউ একজন। আপনার গলার স্বরটা তো আমার অচেনা লাগছে। নিশ্চয়ই আপনি আবির নন। ওর গলা আমার চেনা হয়ে গেছে।“ বলতে বলতে এবার ব্ল্যাক-ডায়মন্ড আবিরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,” এই যে মিস্টার, আপনি নিশ্চয়ই আবির?” আবির এবার হতভম্ব হয়ে একবার মেয়ের দিকে আর একবার আমার দিকে তাকাতে লাগলো যেন এই ঘটনার সাথে তার কোনো লেনদেনই নেই। এবার আমার মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে উঠল। ব্যাটা নিজের ফাঁদে নিজে পা দিয়ে এখন আমার দিকে এমনভাবে বোকার মত তাকাচ্ছে যেন আমার সব মাথাব্যথা! ওকে উদ্ধার করার সব দায়দায়িত্ব আমার নাকি? আমি এবার বেশ গলা চড়িয়েই মেয়েটাকে শুনিয়ে বললাম, “কি রে, কথা বলছিস না কেন? বল, তুইই তো আবির।’’ এবার আমি মুখ ঘুরিয়ে মেয়েটাকে বললাম, “আপনি বসুন।’’ মেয়েটা এবার নির্দ্বিধায় আমার পাশের চেয়ারটায় ঠিক আবিরের মুখোমুখি বসে পড়ল। বসেই সরাসরি ওর দিকে তাকিয়ে রইল কয়েকমুহূর্ত। আবির মাথা নীচু করে বসে আছে, ফাঁকে ফাঁকে মেয়েটার দিকে অপরাধীর মতো তাকাচ্ছে, যেন ‘ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি অবস্থা’! মেয়েটাকেই মুখ খুলতে হল,’’ব্যাপার কি বলুন তো? ফোনে তো খুব ভালো কথা বলতে পারেন আপনি। আপনার কথা যেমন রোম্যান্টিক, তেমনি আপনি দেখতেও তো দেখি হ্যান্ডসাম। আমার তো সব দিক দিয়েই হয়ে গেল। কি এতো ভাবছেন আপনি?...আমাকে কি পছন্দ হয়নি আপনার?’’ আবির হাঁ করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল, যেন তার পেটে কিংবা মুখে কোন কথাই আসছে না। আমি এবার অনেকটা কড়া গলায় বললাম,’’কি রে, তোর সমস্যাটা কি বলতো? কথা বলতে তো কোনো দোষ নেই। তুই আমাকে এতো তাড়া দিয়ে এখানে নিয়ে এলি, উনিও উনার কথামতো এসে হাজির হয়েছেন। সবই তো হল, এখন তুই ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে মুখে কুলুপ এঁটে এমনভাবে বসে আছিস যেন তোর এখানে কোনো ভূমিকাই নেই। নে নে, শুরু কর! কি বলবি বল।‘’ এরপরেও আবির কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে রইল। তবে বুঝা যাচ্ছে যে সে একটা কিছু বলে শুরু করতে চাইছে, কিন্তু কি বলে শুরু করবে ভেবে পাচ্ছে না। শিউলিই এবার তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল,’’দেখুন, এটা কোনো ভ্রাম্যমাণ আদালত নয়, আমি কোনো ম্যাজিস্ট্রেট নই যে আপনাকে কোন দন্ড দেবো, আর আপনি কোন আসামী নন। দীর্ঘদিন আপনি ফোনে আমার সাথে কথা বলেছেন, আপনি যেচে আমাকে ভালবেসেছেন, আমাকেও ভালবাসিয়েছেন। আমি কিন্তু বার বার আপনাকে বলেছিলাম আমার কন্ঠ যেরকমই হোক, তবে আমার কণ্ঠের সাথে আমার চেহারার আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই। আমি কিন্তু সুশ্রী নই, দেখতে কালো। আপনি হেসে উড়িয়ে দিতেন আর বলতেন মনটাই হল ভালোবাসার স্বরূপ। মনের সাথে মনের মিল হলে যে নকশা তৈরি হয়, তাই হচ্ছে ভালোবাসা। কি? বলেন নি? আরো বলেছিলেন ঘন, আবেগি মূহুর্তে যে, শিউলি তুমি দেখতে যেমনই হও, আমি তোমাকে মেনে নিয়েছি, তোমাকে শুধু তোমাকেই আমি মন থেকে ভালোবেসেছি, ফিরে যাবার আর কোনো পথ নেই। আর এখন তো দেখছি মুখে রা আসছে না। কে বলেছিল আপনাকে নিজে যেচে একটা মেয়ের জীবনে এসে মেয়েটাকে ইমোশনাল করে তাকে ডেকে এনে এই নাটক করার? এই যদি হয় আপনার ভালোবাসার স্বরূপ, তাহলে আমাকে ফোনে হাজারবার ‘ভালোবাসি’ কথাটা বলার আগে কি একবারও ভেবে দেখেননি মিষ্টি গলার আমি আর সশরীরের আমি এক নাও হতে পারি?‘’ বলে জিজ্ঞাসু মেয়েটা কিছুক্ষণ তিক্ত আর অবজ্ঞা নিয়ে আমার গর্দভ বন্ধুটার দিকে তাকিয়ে আবার বলল,’’ দেখুন আমি আপনাকে বেঁধে রাখিনি, আর আপনার মতো ছেলেকে বেঁধে রাখার কোনো ইচ্ছেও আমার নেই। আপনার যা বলার প্লীজ আপনি সরাসরি বলে দিন, আমি মাইন্ড করব না। কারণ ছোটবেলা থেকেই আমি নিজেকে একজন কালো, কুৎসিত মানবী হিসেবে মেনে নিয়েছি। সুতরাং নির্ভয়ে বলুন কি বলবেন।’’ শিউলি নামের মেয়েটার সততায় আমি একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলাম! কত অনায়াসে মেয়েটা বাস্তবতা আর সত্যিটার বিবরণ অবলীলায় বলে দিল, মেনে নিল। আর আবির? আমার নিজের মাথা লজ্জায় নত হয়ে গেল আমি ওর সাথে বন্ধু হিসেবে এসেছি বলে! তবে ভেতর থেকে যেমন রাগ অনুভব করছিলাম, পাশাপাশি মেয়েটার প্রতি আমি মনে মনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়লাম। মেয়েটার কথা অযৌক্তিক নয়। নিতান্ত গবেট শ্রেণীর মানুষ না হলে কি এমন একটা কান্ড কেউ করে! আমি বসে রইলাম। আর এবার গলাটা একটু খাঁকারি দিয়ে ফাটা গলায় অবশেষে কথা যেন খুঁজে পেল আবির,”দেখুন আসলে কি বলব, আমি অনেকটা অপ্রস্তুত হয়েই এসেছি। মানে...আমি মনে মনে কল্পনায় আপনার একটা অবয়ব তৈরি করে রেখেছিলাম, সেটা যেমনই হোক। তবে...ইয়ে...’’ ‘’থাক থাক!’’ মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠল শিউলি,’’ আর বলতে হবে না! কি আর বলবেন? বলবেন আপনার কল্পনার শিউলির সাথে বাস্তবের শিউলির কোনো মিলই নেই, এইতো? এই ব্যাপারটা কি আপনার মোটা মাথায় আগে ঢুকে নি? আমি বাস্তবে দেখতে আপনার মনের মতো হতে নাও পারি এই সোজা কথাটা আপনার মতো শিক্ষিত গবেটও বুজতে পারলনা? এটাই হল আপনাদের পুরুষ জাতির মহাসমস্যা। হুট করে আপনারা আবেগে জান দিয়ে দিতে পারেন, আবার খানিক পরে আবেগ কেটে গেলে হুট করে একেবারে জান নিয়েও নিতে পারেন। আপনাদের এই আবেগী সমস্যাটাই আপনাদের ভাবমূর্তি সবসময় নষ্ট করে ফেলে।‘’ আবির এবার কিছুটা দমে গিয়ে অনেকটা আত্মসপর্মপণের ভঙ্গিতে বলল,’’ দেখুন, আসলে আমার ভূল হয়েছে আমি স্বীকার করি। তবে যেহেতু কথা ছিল আমাদের সম্পর্কটা বিয়ে পর্যন্ত গড়াবে, সুতরাং পরিবারের তো পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার রয়েছে, তাই না?’’ ‘’হয়েছে, হয়েছে!’’ হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে শিউলি বলল,’’এখন পরিবারের উপর দায়ভার চাপিয়ে দিয়ে পালাতে চাইছেন, এই তো? খুব তো বড়াই করে আগে বলেছিলেন, যে আপনার সিদ্ধান্তই আপনার পরিবারের সিদ্ধান্ত, সেখানে কেউ এসে নাক গলাতে পারবেনা। এখন কেনো পরিবারকে টেনে আনছেন? থাক! যা বুঝার তা তো আমি বুঝে নিয়েছি। এরপরেও আপনার বন্ধুকে সাক্ষী রেখে আমি ফরমালি সরাসরি জিজ্ঞেস করছি, আপনার সিদ্ধান্তটা কি বলে ফেলুন। হ্যাঁ অথবা না?’’ আমি নীরবে ঢুক গিললাম। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এই বদ্ধ রেস্টুরেন্টেও ইতিমধ্যে আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। আর ফাঁদে আটকা পড়া ইঁদুরের মত অসহায় আবির আশ্রয় চেয়ে আমার দিকে বারবার তাকাতে লাগল। আমরা তিনজনই জানি উত্তরটা কি। কিন্তু এখন এই আনুষ্ঠানিকতাটা কি করে শেষ করব সেটাই আমাদের দুজনের মাথায় ঢুকছে না। শেষ পর্যন্ত ভাবলাম নাটকের শেষ সংলাপ আমিই দেই অর্থাৎ নাটকের উপসংহারে আমারও একটু ভূমিকা থাকা উচিত। আমি কেশে একটু গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললাম,’’দেখুন মিস শিউলি, আপনি তো ইতিমধ্যে বুঝে গেছেন এই গর্দভের সিদ্ধান্তটা কি। সুতরাং আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তবে হ্যাঁ, আবিরের উচিত আপনার কাছে ক্ষমা চাওয়া। আবির সাহেব! আর নাটক না করে ক্ষমা চেয়ে নিন আর ক্ষমা চেয়ে উঠে পড়ুন। আর হ্যাঁ মিস শিউলি, যে লজ্জা আজ আমি পেয়েছি ওর বন্ধু হয়ে ওর সাথে এসে, তাতে অন্তত: এইটুকু গ্যারান্টি আমি দিয়ে যাচ্ছি পরবর্তীতে আমি আর কোনোদিন ওর মত হাঁদারামের সাথে এইসমস্ত ব্যাপারে সাহায্য করা তো দূরের কথা, আর কোনোদিনও এইসমস্ত ব্যাপারে কথা উঠলে আমি একশ হাত দূরে থাকব। নে আবির, ক্ষমা চেয়ে নে ঝটপট! আমি উঠে পড়ব, আমার বিরক্ত লাগছে!’’ আমার কথা শেষ হবার পর শিউলি ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর আবিরকে আর কোনো সুযোগ না দিয়ে বলল,’’ থাক! ক্ষমা চেয়ে আর আমাকে কৃতার্থ করতে হবে না। আপনার উত্তরটা হলো- না, এই তো?’’ আবির মাথা নিচু করে বসে রইল। শিউলি একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইল। “তারমানে ভালোবাসার ক্ষেত্রে মানুষ যতই বলুক না কেনো মনটাই মুখ্য আর শরীর গৌণ, কিন্তু বাস্তবে বেশীরভাগ পুরুষদের কাছে কিন্তু শরীরটাই মুখ্য, কথাটা কি অস্বীকার করতে পারবেন?’’ শিউলির এই কথাটায়ও আবির স্রেফ নীরব শ্রোতার ভূমিকা পালন করল। “ও কে।“ শিউলি ফোঁস করে আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতের মোবাইলটা টিপতে টিপতে বলল,’’কি আর করা! যাক, তবু শান্তি, একটা প্রহসনের অবসান হল অবশেষে। তবে হ্যাঁ, আমার বান্ধবীটার জন্য খারাপ লাগছে!” কথাটার মানে বুঝতে না পেরে আমি আর আবির একে অপরের দিকে মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম,”বান্ধবী মানে? বুঝলাম না।’’ শিউলি কার নাম্বারে যেনো ডায়াল করে কানে দিতে দিতে বলল,”বান্ধবী মানে আমি শিউলির কথা বলছি। আমি শিউলি নই, শিউলির বান্ধবী রেখা। শিউলির আর আমার গলার স্বর হুবুহু একইরকম। বিশেষ করে ফোনে কথা বললে আমাদের গলার স্বর কেউ আলাদাভবে তফাৎ ধরতে পারে না, আর সামনা সামনি তো পারবেনই না। তাছাড়া পরীক্ষা করার জন্য আমি প্রায় সময়ই মিস্টার আবিরের সাথে কয়েকমিনিট করে কথা বলে দেখতাম যে উনি ধরতে পারেন কিনা। আমাদের পরীক্ষা সফল হতেই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে প্রথমে আমি এসে হাজির হব মিস্টার আবিরের সামনে উনার ভালোবাসার বিশুদ্ধতা পরীক্ষা করতে। যাক...হ্যাঁ শিউলি..” বুঝতে পারলাম শিউলি ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করেছে। “ আয়, চলে আয়...হ্যাঁ, হ্যাঁ...পরীক্ষা শেষ! তোর খাঁটি প্রেমিক পরীক্ষায় ফেল করেছে। একেবারে জিরো পেয়েছে পরীক্ষার খাতায়। আয়, আমি ভেতরে আছি।“ বলে লাইন কেটে দিল রেখা। এবার সে ঠোঁটে বাঁকা হাসি হেসে হাতে মোবাইল দোলাতে দোলাতে আবিরের দিকে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টিতে। আর আমরা দুই গবেট স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। কয়েকমিনিটের ব্যবধানে আরেকটি মেয়ে এসে দরজা ঠেলে ঢুকল। পড়নে আধুনিক ডিজাইনের মেরুন রঙের সালোয়ার-কামিজ আর চুল চূড়া করে খোপা বাঁধা, উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ। আর মুখের গঠন? দেখার মতো! মাঝারী উচ্চতার শিউলি সামনে এসে কাজল কালো টানা টানা মায়াবী চোখ দিয়ে আমাদের দুজনের দিকে বিষ দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল। রেখা ইশারা করে আবিরকে দেখিয়ে দিল। দীর্ঘক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে অগ্নিঝরা কন্ঠে রেখাকে শুধু বলল,” চল রেখা!” বলে একটা কথাও আমাদের সাথে আর না বলে ঘুরে সোজা দুজনে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমরা হতভম্ব হয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখার পরেও ঠেলে যাওয়া দরজার দিকে তাকিয়ে রইলাম। পরপর দুইবারের ধাক্কায় আবির একেবারে পাথরের মত জমে গিয়ে নীরব হয়ে বসে রইল। দ্বিতীয় ধাক্কাটা ছিল সবচাইতে বড় ধাক্কা। কারণ, শিউলি মেয়েটা সত্যিকার অর্থে অসাধারণ সুন্দরী! কিন্তু এখন সব শেষ। আবিরের নিশ্চিত হতে যাওয়া বৌ চোখের সামনে দিয়ে চিরদিনের জন্য অবলীলায় বেরিয়ে গেল তারই অসততার জন্য।
আমরা দুই জন্তু বসে রইলাম স্তব্ধ হয়ে, নির্বাক হয়ে। বসে রইলাম...স্রেফ বসে রইলাম।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.