নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অনুসূর্যকে লেখা রূপকথা

নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

অনুসূর্যকে লেখা রূপকথা

নির্ঝর নৈঃশব্দ্য › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প : মা এবং একটি হলুদ পরী

০৯ ই মার্চ, ২০১৭ রাত ১০:২৭

আমাদের একটি মা আছে, বাবাও আছে একটি। বাবার পোস্টিং হয়েছে অনেকদূরে, দুইদিনের পথ; বছরে দুইবার বাড়ি আসেন, দুইদিন পর চলে যান। তারপর ডাকপিয়ন প্রতিমাসে মানিঅর্ডারের সঙ্গে একটা চিঠি নিয়ে আসে। কখনো শুধুই চিঠি, হলুদখামের ডানদিকে ওপরের কোণায় জাতীয় পাখির ছবি। আর খোকন পিয়নের হাত থেকে সেই চিঠি নিয়ে মায়ের কাছে ছুটে যায়, মা পাটক্ষেতে নারিশ-শাক তুলতে তুলতে তখন অজানিত কারণে আনমনা হয়ে থাকে।

একদিন আসে, আমরা মাকে দেখি, সারাক্ষণ কাজের ফাঁকে একটা পাখির দিকে তাকিয়ে থাকে। পাখির নাম দোয়েল। আমাদের জাতীয় পাখি রূপে ইহাই লেবুগাছের ডালে কিংবা চিঠির খামের কোণায় লেজ তুলে দাঁড়িয়ে থাকে। আর শিস দিয়ে গান করে ভাঙা দুপুরের রোদে, লেবুপাতার ছায়ায়।

এই পাখির নামে আমার একটা বোন ছিলো। তারও ছিলো পাখির স্বভাব। সেই স্বভাবেই একদিন উড়ে হারিয়ে গেলো আকাশ পার হয়ে, অন্য কোনো আকাশে।

মাকে দেখি, বাঁশের কাঠিতে বানানো একটা মোড়ার ওপর পা টেনে চেয়ারে বসে থাকে। মায়ের পেট দিনের পর দিন ফুলে ওঠে। মায়ের পা ফুলে ওঠে। একদিন মায়ের পেট থেকে দোয়েল বের হয়ে আসে। লাল একটা পুতুলের মতো ছোটো। একটা পাখির বুকের মতো নরোম। তাকে আমরা একটা গামলা এবং একটা লাল রঙের ঝুড়ির মধ্যে রেখে দিই। সে একটু একটু করে বড় হতে থাকে।


একদিন ঝড় এলো সন্ধ্যাবেলা। ঝড়ের চুল কালো। ঝড়ের শক্তি অপরূপ। ঝড় বাড়তে থাকে। ঝড় বাড়তে থাকে। আমাদের টিনের চালা ঘর। ঝড়োহাওয়ার ফড় ফড় করে টিন কাঁপে। মা ওপর দিকে তাকিয়ে আয়াতুল কুরসি পড়ে টিনের চালায় ফুঁ দিতে থাকে; তার বুকের মধ্যে ভয়Ñযদি কোনো পেরেক আলগা হয়ে যায়, একটা টিনের কোণা খুলে যায় তাহলে সর্বনাশ, বাতাস ঢুকে সমস্ত চালা উড়ে যাবে। দোয়া ইউনুস পড়তে থাকে মা, ‘লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবাহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ জোয়ালেমিন... লা ইলাহা...’

টিনের চালে ফড় ফড় শব্দ হয়। যেনো আমরা গভীর সমুদ্রে মাছের পেটের ভিতর আছি। মা যন্ত্রের মতো কুরানের মন্ত্র আওড়াতে থাকে। ঠাং করে ধাতব শব্দ হয়। একটা পেরেক ছুটে যায় আমাদের গোল ঘরের কোণার টিনের। ফড় ফড় করে হাওয়া ঢুকে ঘরের ভিতর, ঝড় ঢুকে শোঁ শোঁ করে পাক খায়।

মা ‘ও আল্লারে’ বলে চিৎকার দেয়, আর অন্ধকারে হাতড়ে-পাতরে ঘরের দক্ষিণ কোণা থেকে খুঁজে বের করে আনে একগোছা দড়ি। আমাদের বুক ভয়ে টিপ টিপ করে কাঁপতে থাকে।

আমার মায়ের মাথায় বুদ্ধির শেষ নাই। দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ফেলে টিনের কোণা। তারপর মোড়ায় বসে দড়ি ধরে বসে থাকে। ঝড়ের টানে মায়ের হাত কাঁপতে থাকে। মা আরো শক্ত করে টেনে ধরে দড়ি যেনো ঝড়কেই টেনে ধরে করবে বশ।

কিন্তু মানুষ আর কতোক্ষণ পারে? বোকার মতো ভয়ে কাঁপতে থাকা আমরা আটভাইবোন মায়ের বাহুবল হয়ে দড়ি ধরে দাঁড়াই মায়ের পাশে। আমাদের ছোটোপাখি দোয়েলও এসে ধরে দড়ি।

বাহিরে ঝড় গাছেদের সঙ্গে হৈ হৈ করে নাচে। রাত বাড়ে। আমাদের ঘুম পায়। তন্দ্রাচ্ছন্ন আমরা দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। কিন্তু মানুষ আর কতোক্ষণ এইভাবে থাকে। আমরা মায়ের পাশে বসে পড়ি দড়ি ধরে। মায়ের গায়ে হেলান দিই। আমাদের গায়ের গরমে মায়েরও ঘুম পায়। আমরা ঘুম যাই, মুঠো আলগা হয় আমাদের। কিন্তু দোয়েলের মুঠো আরো শক্ত হয়; সে ঘুমায় না। কিন্তু অতোটুকু পাখির মতো মেয়ে আর কতো শক্তি রাখে। আমাদের টিনের চালা উড়ে যায়। উড়ে যায় টিনে বাঁধা দড়ি। পাখির মতো উড়ে যায় দড়ি ধরা আমাদের ছোট্ট দোয়েল।

আমাদের ঘুম ছুটে গেলো প্রচ- ঝড়, তার শব্দ, বিজলি চমক আর বজ্রপাতের শব্দে। আমরা মাথার ওপর টিনের চালার বদলে দেখলাম বিধ্বস্ত আকাশের তলে বাতাসে, বিদ্যুতে, বজ্রে আর গাছে ভয়ানক ধস্তাধস্তি, মারামারি, কাটাকাটি খেলা। মা বলতে থাকে, ‘ঠাড়াল ঠাড়াল...’

বজ্রপাতকে মা বলতো ঠাড়াল। মায়ের চোখই প্রথম দেখে দোয়েল নেই। মা ‘অ পাখি, অ পাখি...’ বলে পাগলের মতো হয়ে যায়। তারপর মুর্ছা যায়।

ঝড় আমাদের ঘরের সবকিছু লন্ডভন্ড করতে থাকে। আমরা মাকে শক্ত করে আকড়ে ধরে ভাইয়ে-বোনে লোহার শিকলের মতো হাঁটুগেড়ে বসে থাকি; ভোরের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। অনেকদূর থেকে বাতাসের ধাক্কায় সমুদ্র আমাদের উঠানে ভেসে আসে। রাত ভেঙে ভোর নেমে আসে আমাদের ঘরে।

ঝড়ের গতি কমে আসে কিন্তু থামে না; আর ঢিমেতালে বৃষ্টি নামে। আমরা দোয়েলকে খুঁজতে বের হই। এক একজন এক দিকে যাই, উঠানে তখনো হাঁটু পানি।

খোকন বড় রাস্তার দিকে যায়, রাস্তায় ওঠতে গিয়ে বাতাসের ধাক্কায় পাক খেয়ে পড়ে। ক্লাস ফোরে পড়ে সে। আবার ওঠে দাঁড়ায় বুড়ো আঙুলের নখ পিচ্ছিল রাস্তার কাদার মধ্যে গেঁথে আবার ওঠে দাঁড়ায়। তারপর অনেকটা হামাগুড়ি দিয়ে বড়রাস্তায় ওঠে, ভাঙারাস্তার পিচের পাড় আকড়ে ধরে বসে পড়ে। তার সামনে বিদ্যুতের পিলার। তার ঝুলছে, ছেঁড়া তার। ওটা ধরে সে কতোক্ষণ বাতাসে দোল খায় জানে না। ঝড় থেমে যায়। বৃষ্টি নামে, ঝুম ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির ভিতর সে দৌড়ায়। অনেকটা পথ ঘুরেও দোয়েলের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না।

সকালবেলাতেই আমার ছোটোখালা যেনো ঘুরতে ঘুরতে আমাদের বাড়িতে চলে এলো। এর মধ্যে মায়ের জ্ঞান ফিরে। কিন্তু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বিলাপ করে। ছোটোখালার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিলো, অন্ধকার ঘরে জায়নামাজে বসে জ্বিন হাজির করতে পারতো। সামনে একটা কুলার মধ্যে ঢেঁকিছাটা চাউলের ওপর তেরোটা জ্বলন্ত মোমবাতি, মাঝখানে একটা গ্লাসে তিনটা রক্তজবার ফুল, লোবান, আর একটা আয়না বসানো থাকতো। আর খালা পুঁথির মতো সুর করে মন্ত্রজাতীয় কিছু বলতো যেমন,
উত্তরে জঙ্গলে ওড়ে খোদার কালাম,
দখিনে সাইগরে ঘুরে বদর মোকাম...
একসময় আয়নার মধ্যে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত সব দেখা যেতো।

আমাদের চালাহীন ঘরের এককোণায় অন্ধকার করে ছোটোখালা জায়নামাজ পেতে বসে। আর পাশে আমাদের মা। আসনে বসার দশমিনিটের মধ্যে ছোটোখালার হাত কাঁপতে থাকে। পুঁথির সুরেই বলতে থাকে,
দখিনে সাইগর কূলে খাড়া তালগাছ,
তালগাছে বইয়া রইছে হইলদা এক মাছ।
মাছ নয়রে, মাছ নয়রে, মাইনষের ছাও—
চউখ আছে, মুখ আছে—ছোডো ছোডো পাও...

ছোটোখালা একসময় তার আসন ভেঙে দেয় তারপর তার কথাগুলিই তর্জমা করে মাকে শোনায়। বলে যে এখান থেকে কুড়িমাইল দূরে একটা তালগাছের মাথায় দোয়েল আটকে আছে। তারপরনে একটা হলুদ রঙের ফ্রক। তালগাছের পাশে একটা পুরনো মসজিদ আছে, মসজিদের সঙ্গে গোরস্তান। গোরস্তানের প্রথম সারির তিনটা কবর পাকা করা। কবরের নতুন চুনকাম।

আমার মা সাধারণত ছোটোখালার কথা বিশ্বাস করে না। কিন্তু আজকে করলো। হয়তো দোয়েলের গায়ের হলুদ রঙের জামার কথা শুনে; যেটা ছোটোখালার জানার কথা না।

ছোটোখালাকে সঙ্গে করে মা দোয়েলের খোঁজে বের হলো। আমরাও মায়ের সঙ্গে যাই। মা একটা গাটরির মধ্যে ওয়ারড্রোব আর আলমিরা ঘেঁটে লাল-হলুদ রঙের শাড়ি, বিছানার চাদর এইসব বেঁধে নেয়। কেনো নেয় আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। আমরা মায়ের সঙ্গে যাই।


ছোটোখালার যে জায়গাটার কথাটা বলেছে সেটা আমাদের বাড়ি থেকে কুড়ি মাইল দক্ষিণে সমুদ্র উপকূলে। আমরা সকলে মিলে একটা চান্দের গাড়িতে উঠে পড়ি। স্থানীয় ওয়ার্কশপে বানানো জিপকে আমরা বলি চান্দের গাড়ি।

ঘণ্টাখানেক পর চান্দের গাড়ি সেই পুরনো মসজিদের পাশে আমাদের নামিয়ে দেয়। আমরা মসজিদ পার হয়ে তিনটা পাকা কবরের পাশ ঘেঁষে তালগাছের দিকে যেতে যেতে ওপরে তাকাই। আর যেনো দোয়েলকে দেখা যায়। তার গায়ে হলুদ জামা তালপাতার ফাঁক গলে আসা রোদে ঝলমল করে। মনে হয়, একটা হলুদ পরী তালপাতার ভাঁজে শুয়ে কাঁদছে। অবশ্য এর মধ্যে তার কান্না শুনে লোকজন তালগাছের নিচে জড়ো হয়েছে।

এ যাত্রায় শুধু দোয়েল নয়, আরো অনেক নারী, শিশু পেয়ারাগাছ, কদমগাছ, রেইন্ট্রিগাছ নারিকেলগাছে হয় আশ্রয় নিয়েছে কিংবা দোয়েলের মতো উড়ে গিয়ে আটকে গেছে। এদিকে ঝড়ের টানে ভালোই জলোচ্ছ্বাস হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিলো তিরিশ ফিটেরও বেশি। সেইবার ঘূর্ণিঝড়ে আর জলোচ্ছ্বাসে দুইলাখের ওপর মানুষ মরে গেলো উপকূলীয় এবং দ্বীপাঞ্চলে। অজস্র মানুষ বিকলাঙ্গ হয়ে গেলো। আমরা একবছর মাছ খাওয়া বাদ দিলাম। তখন নদী, সমুদ্র আর জলাশয়ে লাশের ছড়াছড়ি। মাছ সমানে খেয়ে যাচ্ছিলো মানুষের মাংস।

আমার ভিড় ঠেলে তালগাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়াই। মা গাটরি খুলে লাল-হলুদ শাড়ি আর বিছানার চাদর বের করে। আমরা সবাই, গাছের নিচে জমা হওয়া লোকজন মিলে শাড়ি আর চাদর মেলে শক্ত করে কোণা ধরে দাঁড়িয়ে তালগাছটাকে সেনাবাহিনির মতো ঘিরে ফেলি। মা দোয়েলকে ডাকতে থাকে, ‘অ পাখি, অ পাখি, আয় আয়, আয় আয়...।’

মায়ের ডাক শুনে দোয়েলের কান্না থেমে যায়। সে হাসে; আর দুহাত মেলে তালগাছের পাতার আড়াল থেকে ঝাঁপ দেয় নিচে। মনে হয়, একটা ধনেশপাখি তার দীঘল হলুদ চঞ্চু উজিয়ে ডানা মেলে নামছে। তাকে আমরা একটা লালশাড়ির মধ্যে ধরে ফেলি। মা কেঁদে কেটে ওকে বুকে চেপে ধরে।

আমরা আটভাইবোন মিলে বুঝি মায়ের বুকের বুকে ভাঁজে সে দোয়েল নয়, অন্য কেউ; কেবল মা বুঝতে পারে না।

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ০৯ ই মার্চ, ২০১৭ রাত ১০:৫২

পুলহ বলেছেন: পুরো গল্পটাকে কি একটা কাব্যিক শিলালিপি বলা যায় ? বহুদূর, চোখের আড়াল কোন নগরের এক সাধারণ পরিবারের কাহিনী? ইতিহাস? যে কাহিনীগুলো কখনো কোন সভ্যতার নজরে আসে না! রয়ে যায় মাটির আরো, আরো গভীরে !
স্থানীয় উপাদান, লোকজ ঐতিহ্য, সংস্কৃতির সাবলীল সম্মিলন ঘটেছে লেখায়। বর্ণনার সরলতা এবং মাধুর্য পাঠক আটকে রাখার মত। আমাকে অন্তত রেখেছিলো।
খুব ভাল একটা লেখা পড়লাম। এমন লেখাগুলো চোখ এড়িয়ে গেলে আপসোস হয় !
শুভকামনা জানবেন।

০৯ ই মার্চ, ২০১৭ রাত ১১:০৭

নির্ঝর নৈঃশব্দ্য বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ। এই গল্পের অনেকখানিই সত্যি। এইটা আমাদের বাড়ির গল্প।

২| ১০ ই মার্চ, ২০১৭ রাত ২:২০

ওমেরা বলেছেন: খুব সুন্দর করে লিখেছেন ধন্যবাদ ।

১১ ই মার্চ, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৩২

নির্ঝর নৈঃশব্দ্য বলেছেন: ধন্যবাদ

৩| ১১ ই মার্চ, ২০১৭ সকাল ১১:৪৬

টুশকি বলেছেন: দোয়েল আমার দুই মাসের বড় বয়সে। মনে আছে ওর কথা। ওখানে বর্ষাকালে বৃষ্টি হয়। আপনার মা কেমন আছে?
আমাদের মা পাখিটা উড়ে গেছে কয়েক বছর আগে, ছানাটা ডানার অপেক্ষায়, ডানা পেলেই উড়ে যাবে
আমরা সবাই চলে যাব, কেউ আগে কেউ পরে..একদিন সমস্ত শাদা আর শাদা হয়ে যাবে

১১ ই মার্চ, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৩১

নির্ঝর নৈঃশব্দ্য বলেছেন: জানি, আমারও মনে আছে। আর মায়ের ডানাও প্রায় পূর্ণ হয়ে গেছে কয়েকদিনের মধ্যেই হয়তো উড়ে যাবে।

৪| ১৭ ই মার্চ, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৩১

সুমন কর বলেছেন: চমৎকার বর্ণনা। মুগ্ধ হলাম। +।

২৪ শে মার্চ, ২০১৭ রাত ৮:৩৮

নির্ঝর নৈঃশব্দ্য বলেছেন: ধন্যবাদ, সুমন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.