নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অনুসূর্যকে লেখা রূপকথা

নির্ঝর নৈঃশব্দ্য

অনুসূর্যকে লেখা রূপকথা

নির্ঝর নৈঃশব্দ্য › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প : সন্ধ্যানাদ

২৪ শে মার্চ, ২০১৭ রাত ৮:০৪

ইরাবান অর্জুনের পুত্র। না, তার জন্ম দৌপদী কিংবা সুভদ্রার গর্ভে নয়। তার জন্ম চিত্রাঙ্গদার গর্ভেও নয়। চিত্রাঙ্গদার গর্ভে যে পুত্রের জন্ম তার নাম বভ্রুবাহন। ইরাবানের জন্ম নাগরাজার কন্যা উলূপীর গর্ভে। আর উলুপীকে এক প্রকার বাধ্য হয়েই অর্জুন বিবাহ করেছিলো কেনো তা বলা বাহুল্য।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ অনিবার্য দেখে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো শ্রীকৃষ্ণ। শঙ্কিত হলো যুদ্ধের ভয়াবহ ফলের কথা ভেবে। কিন্তু যেভাবেই হোক ধর্মের জয় দেখার জন্য সে চাইলো যুদ্ধে জয়ী হোক পা-বরাই।

ভবিষ্যৎ গণনা করতে পারতো পা-বদের কনিষ্ঠভাই মাদ্রিপুত্র সহদেব। কৃষ্ণ তাকে ডেকে বললো, ‘উপায় বলো, মাদ্রেয়।’
বহু অংক কষলো সহদেব। তারপর মলিন মুখে কৃষ্ণকে বললো, ‘এ বড় কঠিন উপায়, বাসুদেব।’
‘উপায় বলো, মাদ্রেয়।’ কৃষ্ণের চোখে মুখে অস্থিরতা।
‘কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে জয়ী হতে হলে মা কালীর কাছে বলি দিতে হবে।’
‘কী প্রকারের বলি?’ কৃষ্ণ জানতে চায়।
‘যে পক্ষ আগে তাদের শ্রেষ্ঠ বীর যোদ্ধাকে বলি দেবে—সে পক্ষই জিতবে, বাসুদেব।’

কৃষ্ণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো আরো। অনেক ভেবেও অর্জুন ছাড়া আর কাউকে বলির জন্য উপযুক্ত মনে হলো না তার। না, কোনোভাবেই অর্জুনকে বলি দেয়া যাবে না। কিন্তু কী ভেবে সহসা কৃষ্ণের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠলো।

এমন সময় কৃষ্ণের আনন্দের কারণ হয়ে যেনো তার কাছে স্বেচ্ছায় আত্মোৎসর্গ করতে এগিয়ে এলো কিশোর বীর ইরাবান। সে ছিলো অর্জুনের মতোই দক্ষ বীর যোদ্ধা। তাকে পেয়ে হাতে যেনো হাতে যেনো সূর্য পেয়ে গেলো শ্রীকৃষ্ণ।

ধনুর্ধারী বীর ইরাবান কৃষ্ণ এবং পা-বগণের সমুখে বুক টান টান করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শ্রীকৃষ্ণ তাকে বললো, ‘তোমার শেষ ইচ্ছা কী, অর্জুনপুত্র বীরশ্রেষ্ঠ ইরাবান?’

শ্রী কৃষ্ণের প্রশ্ন শুনে ইরাবান যেনো অকূল পাথারে পড়ে গেলো। কী উত্তর দেবে সে? জানে যে তার জন্য জন্মদাতা অর্জুনের মনে তেমন কোনো স্নেহ-মমতা বা টান নেই। তাই সে অনেক ভেবে চিন্তে যা বললো তার সারমর্ম হলো, এই নশ্বর পৃথিবীতে তার জন্য শোক-বিলাপ করার তো কেউ নেই। তাই সে এক রাতের জন্য হলেও বিয়ে করতে চায়, শৃঙ্গার-সুখ ভোগ করতে চায়। যেনো তার মৃত্যুর পর বউ তার জন্য বিলাপ করে কাঁদে।
‘তাই-ই হবে।’ শ্রীকৃষ্ণ বললো।

কিন্তু কোনো পিতা তার কন্যাকে ইরাবানের কাছে দান করতে রাজি হলো না। কোনো নারী তাকে বরণ করতে এগিয়ে এলো না। বলিপ্রদত্ত যুবককে কে বিয়ে করবে? আর কোনো উপায় না দেখে শ্রীকৃষ্ণ একটা পথ বের করলো। সে নিজেই এক অনন্য অনিন্দ্যসুন্দর স্ত্রীর রূপ ধারণ করলো। তারপর বিবাহ করলো ইরাবানকে। কৃষ্ণের সেই স্ত্রীরূপের নাম মোহিনী।

মোহিনী ও ইরাবান পরস্পর এক রাত্রির জন্য কাটালো প্রেমে-শৃঙ্গারে দাম্পত্যের প্রগাঢ় মধুময় রাত্রি। এই এক রাত্রিই যেনো হাজারটা রাত্রির সমান।

পরের দিন সূর্যোদয় থেকে শুরু হলো কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ। ইরাবানের ইচ্ছে ছিলো সে নশ্বর শরীরেই পুরো যুদ্ধ দেখবে। এবং নিজেও যুদ্ধ করবে। তাই মা কালীর কাছে যুদ্ধের আঠারো দিন ধরে তাকে কেটে কেটে একটু একটু করে বলি দেয়া হলো।

যুদ্ধের শেষ দিন কয়েক মুহূর্ত যুদ্ধ করার সুযোগও তাকে দেয় কৃষ্ণ। তখন ইরাবানের দেহে অবশিষ্ট ছিলো শুধু কঙ্কাল আর মাথা। যুদ্ধশেষে ইরাবানের ইচ্ছাতেই তার মাথা কেটে ফেলা হয়। সেই মাথা গড়িয়ে যায় বিধ্বস্ত কৌরব সেনাবাহিনির ওপর দিয়ে।

মৃত্যুর আগমুহূর্তে ইরাবান শুনতে পায় তার জন্য বিলাপ করে কাঁদছে তার প্রিয়তম স্ত্রী মোহিনী। আর মোহিনীর সেই বিলাপে পৃথিবীর সকল বনে নেমে আসে অন্তহীন শীতকাল, আর ঝরে যায় পৃথিবীর সকল গাছের পাতা।


ত্রয়োদশজন্মে ইরাবান আবার মানুষ রূপেই জন্ম নেয়। এবং পৃথিবীর উত্তরের একটি পাতাবনে বেড়ে উঠে। তারও আগে পৃথিবীর সবচে’ ব্যর্থ একজন কবি ইরাবানকে নিয়ে একটি কবিতা লিখে রাখে চালতার পাতায়। এই কারণেই চালতার পাতার শিরা-উপশিরা অন্য সব পাতার চেয়ে ভিন্ন। একটু গভীর চোখে তাকালেই সেই কবিতা পড়া যায়,
ইরাবান, তোর জন্য কে কাঁদে, কে রাখে শূন্যবুকে দীর্ঘ হাত? কার বিলাপে বাতাস ভারি হয়ে ওঠে? মোহিনী চোখের সোনায় ধরা আছে উত্তরের আকাশ। শিরার ভিতর ছল করে রক্ত। তাকে তুই জন্ম থেকে রেখেছিস এমনই লাল। এই লাল এখন নীল হয়ে ফুরিয়ে যায় বাতাসের পাশে। বিগ্রহ কথা বলে। বিগ্রহের নামও কি মোহিনী নয়? মোহিনীও এক ছলেরই নাম। তার শৃঙ্গারে ক্ষয় হলে পরমায়ু তুই অমরতাকে উপহাস করে ফুরিয়ে যাবি। তোর নামে একটা পাহাড় হবে কি নদী হবে—তা ভেবে তোর কোনো কাজ নেই। তোর যা আছে অহম—তাইই তোর অর্জন।

একদিন পাতাবনে হাওয়া উড়ছিলো। ইরাবান ভাবে, এইসব হাওয়া উত্তরের কোনো পাহাড় থেকে আসে নিশ্চয়ই। সে খালিপায়ে হাঁটছিলো ঝরাপাতা মাড়িয়ে। এমন পাতা ঝরছে! এমন ছায়া ছায়া দুপুরে আজ মনে হয় সকল পাতা ঝরে যাবে। সে হাঁটতে হাঁটতে জারুলতলায় এসে দাঁড়ালো।
‘তুমিও খালি পা?’
ইরাবান ঘুরে দাঁড়ালো। দেখলো, শ্রীমতি দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে হাসি। ইরাবান ভাবে, এই হাসি একটা কাচের কৌটোয় ভরে তার বিছানায় মাথার কাছে রেখে দিবে। সে প্রতিদিন একবার ভাবে, কীভাবে এই হাসি চুরি করা যায়। সে ভাবে, ভালোবাসার মানুষের সবকিছু বুঝি প্রতিদিনই সুন্দর হতে থাকে।

শ্রীমতি আবার তাকে শুধায়, ‘খালি পা কেনো, ইরাবান?’
‘মর্মর বাজাতে ইচ্ছে হলো মনে।’
‘আসো তবে, মর্মর বাজাই।’
ইরাবান শ্রীমতির কথা শুনে কেঁপে ওঠলো মনে মনে। সে তার পায়ের দিকে তাকালো। দেখলো,
শ্রীমতির বাম পায়ের তৃতীয় আঙুলে একটা কালো সুতো বাঁধা।
‘কে বেঁধে দিলো, সুতো?’
‘সে।’
‘কেনো?’
‘আমার এই আঙুলটা তো অ›ধ হয়ে গেছে, তাই।’
‘এখন দেখতে পায়?’
‘হ্যাঁ তো, সুতোটাই তো এখন আঙুলের চোখ।’

ইরাবানের খুব অসহায় লাগলো। সে অনেকদিনের জমানো কথাটা বলবে ভাবছিলো আজকে। কিন্তু বলতে পারছে না। অথচ এই হাওয়া আর পাতাঝরার দিনেই বলে দেয়া যেতো সেই কথাটা। তার সেই কথাটা। তার গলা কাঁপছে।
‘তুমি কি আমাকে কিছু বলতে চাও, আজকে?’ শ্রীমতি শুধায়। ইরাবান চুপিচাপ শ্রীমতির পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। ‘বলো। আজকে না বললে আর কোনোদিন শুনবো না।’ শ্রীমতি বলে।
‘আমি তোমার পায়ের পাতায় চুম্বন করতে চাই।’
‘ছি! এইভাবে ভালোবাসে না।’
‘কেনো?’
‘আমি তো প্রতিদান দিতে পারবো না।’
‘আমি তো কোনো প্রতিদান চাইনি।’
‘তারপরও না।’

শ্রীমতি ঝরাপাতা মাড়িয়ে চলে যায়। ইরাবান নিজেকে ঝরাপাতা ভাবতে ভাবতে দাঁড়িয়ে থাকে। তার জাতিস্মর কানে ভেসে আসে যেনো কুরুক্ষেত্রের শেষ সন্ধ্যার বিলাপ।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৫ শে মার্চ, ২০১৭ সকাল ১০:৫৮

অপ্‌সরা বলেছেন: অনেক অনেক ভালো লাগা ভাইয়া!

অনেক দিন পর তোমাকে দেখলাম ভাইয়ামনি!

৩০ শে মার্চ, ২০১৭ দুপুর ১২:১১

নির্ঝর নৈঃশব্দ্য বলেছেন: :) তোমাকেও অনেকদিন পর

২| ২৮ শে মার্চ, ২০১৭ বিকাল ৫:৪৭

হাসান মাহবুব বলেছেন: অনৈসলামিক লেখা :-<

৩০ শে মার্চ, ২০১৭ দুপুর ১২:১১

নির্ঝর নৈঃশব্দ্য বলেছেন: হ :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.