নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

যে কোনো ভূমিকায় সমানে লড়ে যাই, আপনি যেমন চান আমি ঠিক তাই।

নান্দনিক নন্দিনী

লেখালেখি হচ্ছে প্রেমে পড়ার মতন একটা ব্যাপার, কোনো ধরনের কর্তৃত্ব জাহির করা নয়।

নান্দনিক নন্দিনী › বিস্তারিত পোস্টঃ

‘একটা তোড়া লন, আফা’

১৮ ই এপ্রিল, ২০১৫ দুপুর ২:১৯

বিজয় সরণি হয়ে ফার্মগেট আসার এই রাস্তাটাতে কিছু মুখ আমার পরিচিত হয়ে গেছে। প্রতিদিনই তারা আসে, ‘আফা, ফুল লন’। সকালে অফিসে যাওয়ার তাড়া আর বিকেলে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফেরা। না, ফুল কেনা হয় না আমার। সচেতন বা অসচেতনভাবে বলে দেয়, না, লাগবে না। ফুল যে ভালোবাসি না তেমন নয়, তবে চার দেয়ালের ঘরটাতে ওদের একাকী রাখতে ইচ্ছে করে না আমার।

যথারীতি অফিস থেকে রিকশায় বাড়ি ফেরার পথে বিজয় সরণির দীর্ঘ যানজট। ‘আফা একটা তোড়া লন’,—শুনে চিন্তা ভঙ্গ হলো।

প্রশ্ন করি, কী নাম তোমার?

হাসি মুখে উত্তর—আলী হাসান।

একটা তোড়া কত করে বিক্রি করো?

‘আফা, গোলাপ তোড়া ১০ ট্যাকা।’

বলি, তুমি আমার সঙ্গে একটু কথা বলবে, যদি তোমার ফুল বিক্রিতে সমস্যা না হয়।

আলী হাসান হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।

আলী হাসানের বয়স আট বছরের মতো। বাবা বেলাল হোসেন মারা গেছেন। মা দেলোয়ারা বেগম বেঁচে আছেন। তিন ভাইবোনের মধ্যে আলী হাসান বড়।

ওর একটা বোন আছে। বোনের বয়স কত জিজ্ঞেস করতেই হাতের উচ্চতায় যা দেখাল তাতে ওর বোনটার বয়স ছয় বছর হবে বলে মনে হলো। ছোট ভাইটার বয়স তিন বছরের মতো।

আলী হাসানেরা এখানে গাবতলীতে থাকে। ঢাকায় এসেছে দুবছর আগে। ওদের বাড়ি দিনাজপুরের কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রামে। বাবা মারা যাওয়ার পর জীবিকার সন্ধানে ওর মা তিন সন্তান নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। আলী হাসানের মা রঙের কারখানায় কাজ করেন। আলী হাসান আগে একটা দোকানে কাজ করত। ছয় মাস হয় ও ফুল বিক্রি করছে।

দিনে কতগুলো তোড়া বিক্রি করো?—জানতে চাই ওর কাছে



‘জানি না, তয় হইবো ৫০-৬০টা। আফা, আমরা তো তোড়া বানাই না, মালিকে বানায়, আমরা বেচি। প্রত্যেক তোড়ায় দুই টাকা কইরা পাই। তয়, ১০ ট্যাকার বেশি বেচবার পারলে বেশিও পাই।’

আলী হাসানের দিন শুরু হয় ভোরে। ৮-৯টায় লোকাল বাসে চড়ে চলে আসে বিজয় সরণিতে। অপেক্ষা ফুলের গাড়ি আসার। গাড়ি আসলে শুরু হয় তোড়া বানানোর কাজ। কাজটা ওদের না হলেও আলী হাসানের মতো আরও যেসব বাচ্চারা ফুল বিক্রি করে, তারা হাত লাগায় কাজে। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে ওরা ফুলের তোড়া নিয়ে বিক্রি শুরু করে।

আলী হাসান লেখাপড়া জানে না। স্কুলে যাওয়ার সময় ও সুযোগ কোনোটাই হয়নি তার। প্রশ্ন তাহলে টাকা চেনে কী করে। দুষ্টুমির হাসি ওর চোখে-মুখে। ‘মামুর ব্যাটারা শিখাইছে।’

দিনে কত টাকা আয় হয়?

আলী হাসান বলল, ‘আফা, একাক দিন একাক রহম। কোনো দিন ১০০, কোনো দিন ১৫০-২০০। ঠিক নাই। কোনো কোনো দিন গাড়ি কইরা যাওনের সময় স্যার-আফারা ৫০০-১০০০ ট্যাকা দেন।’

এমন কয়বার পাইছ?

‘আমি একবার পাইছি। তয়, অন্যরা আরও বেশিবার পাইছে। আফা, ঈদের আগে গাড়ি কইরা আইয়া স্যার-আফারা নতুন জামাকাপড়ও দিয়া যায়।’

আলী হাসানের মা রঙের কারখানায় কাজ করেন এবং ওভারটাইম করে মাসে তিন-সাড়ে তিন হাজার টাকা আয় করেন। গাবতলীর ছোট ঘরটার ভাড়া মাসে এক হাজার ২০০ টাকা।

‘মায়ের একার আয়ে সংসার চলে না বইলাই তো ফুল বেচি আমি। সহালে বাসারতন খাইয়া আই আর দুপরের জন্য বাটিতে ভইরা লইয়া আসি। বাসায় ফিরি রাতের ১০টা বাজে।’

আলী হাসানের ছোট্ট একটা স্বপ্ন আছে। সেটা পূরণ করার জন্য মাটির ব্যাংকে টাকা জমা করছে। কত টাকা জমেছে তা সে জানে না। একবারে ভাঙলে জানতে পারবে পরিমাণটা আসলে কত।

জমানো টাকা দিয়ে সে তার বাড়িতে গিয়ে জমি কিনে ওখানেই থাকবে। স্কুলে ভর্তি হবে। এখানে স্কুলে গেলে ‘মালিকে’ রাগ হয়। সে সময় আর কেউ রাগ করবে না।

এটা বড় কোনো স্বপ্ন না হলেও আলী হাসানদের জন্য বড়। জানি না, স্বপ্নটা এই ছোট্ট আলী হাসানকে বাঁচিয়ে রাখবে, না আলী হাসান স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রাখবে। তবে চাইব, ‘ওর ছোট্ট দুচোখে দেখা এই স্বপ্নটা পূরণ হোক।’

আমি আলী হাসানের কাছ থেকে একটা ফুলের তোড়া কিনলাম। ও আমাকে প্রশ্ন করল, ‘আফা, এত কিছু জানলেন। আপনি কি পত্রিকায় লেখবেন?’

হেসে বলি, তুমি পত্রিকা চেনো?

‘হ, চিনি। আমাগো লগের অনেকে পত্রিকা ব্যাচে। তাগোর কাছের পত্রিকাতন ছবি দেখি। পড়তে তো আর পারি না।’

সিগন্যাল সবুজ সংকেতে জানিয়ে দিল এবার আমরা যেতে পারি। আলী হাসান রাস্তা ছেড়ে ফুটপাতে উঠে দাঁড়াল। আমি বললাম, ভালো থেকো আলী হাসান। আলী হাসান উত্তর দিল, ‘আবার দেহা হইবো, আফা।’

মন্তব্য ১০ টি রেটিং +৭/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ১৮ ই এপ্রিল, ২০১৫ বিকাল ৩:২৮

তাহসিনুল ইসলাম বলেছেন: ভালো লাগলো।
ফুল বিক্রি করে এমন একটা পথ শিশুকে নিয়ে আমিও একটা গল্প লিখেছিলাম। গল্পটার নাম, অরণি।
গল্পের পথশিশুটার কোন নাম ছিলো না। অরণি তার নাম দিয়েছিলো, শিশির ।
অরণিও ঠিক আপনারই মতোই ছিলো :)

১৮ ই এপ্রিল, ২০১৫ বিকাল ৫:৩১

নান্দনিক নন্দিনী বলেছেন: অরণি'র কে হুম ? ধন্যবাদ জনাব, তাহসিনুল ইসলাম :)

২| ১৯ শে এপ্রিল, ২০১৫ সকাল ১০:০১

কাল্পনিক_ভালোবাসা বলেছেন: জমানো টাকা দিয়ে শিশুটার স্কুলে ভর্তি হবার স্বপ্নটা খুব মর্মস্পর্শী। বাচ্চাটা জানে না, সেও সময়ের সাথে পাল্লা দিচ্ছে। জীবনের কঠিন বাস্তবতায় স্বপ্নটা হয়ত থেকে যাবে, কিন্তু সময়টা আর থাকবে না।


২৯ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ২:০৭

নান্দনিক নন্দিনী বলেছেন: কিছু মানুষ জন্ম থেকেই বড় হয়ে যায়। বাস্তবতা তাদের কে বড় করে দেয়। তাদের স্বপ্নঘোর আছে বলে উঁচু তলার মানুষ গুলো উঁচুতলা তেই থাকতে পারে।

৩| ২৪ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ৯:৪৮

দিশেহারা রাজপুত্র বলেছেন: প্রতিটি পথশিশুই স্বপ্ন বোনে। স্বপ্নগুলো ঝরে যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। তবুও স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নই বাঁচিয়ে রাখে তাদের। স্বপ্ন ছোঁয়ার আশায় নিরন্তর করে চলে জীবন সংগ্রাম।

২৯ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ২:১০

নান্দনিক নন্দিনী বলেছেন: স্বপ্নঘোরে ঠিক যেন, পৌছতে চায় নিজের কাছে

৪| ১১ ই মে, ২০১৬ দুপুর ১:৪৯

রুদ্র জাহেদ বলেছেন: স্বপ্নরা হয়তো বাঁচিয়ে রাখে।হাজার দুঃখের মাঝেও একটু সুখের অনুভব।একদিন স্বপ্ন পূরণ হবে।রাস্তায় এসব দৃশ্য দেখলে অসহায় জীবনের ছাপটা বেশি ধরা দেয়

১৭ ই মে, ২০১৬ রাত ১০:২৩

নান্দনিক নন্দিনী বলেছেন: :( :(

৫| ২১ শে জুন, ২০২০ রাত ৯:২৮

খায়রুল আহসান বলেছেন: 'আবার দেহা হইবো, আফা!' - দেখা হয়েছিল কি?
স্বপ্নের জ্বাল বোনা আলী হাসানের জন্য মায়া হচ্ছে।

২১ শে জুন, ২০২০ রাত ৯:৩৬

নান্দনিক নন্দিনী বলেছেন: দেখা হয়েছিল বেশ কয়েকবার।
প্রথমবার আমি ওকে খুঁজে বের করেছিলাম নিউজপেপারটা দেয়ার জন্য। ওর ছবিও এসেছিল।

তারপর সিগন্যালে মাঝে মধ্যে, আমাকে দেখলে খুব লাজুক লাজুক হাসি হাসতো। কখনো ফুল কিনেছি, কখনো এমনিই গল্প করেছি।

ঈদের পোশাক কেনার জন্য কিছু টাকা দিয়েছিলাম। এতটা খুশি এই জীবনে আমি খুব কম মানুষকে করতে পেরেছি!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.