নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

খোন্দকার মেহেদী আকরাম এর ব্লগ

নাটশেল

লিখতে ভালো লাগে তাই লিখি। যতদিন ভালো লাগে ততদিন লিখে যাবো।

নাটশেল › বিস্তারিত পোস্টঃ

যুদ্ধাপরাধের বিচার কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ অথবা ত্রুটিপূর্ণ: আন্তর্জাতিক পটভূমিতে বাংলাদেশের প্রেখ্যাপট বিশ্লেষণ

১০ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১১:০৯





আমার জন্ম হয়েছে স্বাধীনতার পাঁচ বছর পর। জ্ঞান হওয়ার পর যতবারই মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনেছি ততবারই শুনেছি ‘রাজাকার’ শব্দটি। আমার চারপাশের সবাইকে দেখেছি 'রাজাকার' শব্দটিকে ঘৃণাভরে উচ্চারণ করতে। সবার কাছে শুনেছি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজাকারদের কু-কৃত্তির কথা। কলেজ জীবনে দেখেছি রাজাকারেরা রয়েছে আমাদের চারপাশেই। রাজাকারদের বিশেষ ক্ষমতাধর মনে হয়েছে তখন। প্রশ্ন করেছি 'রাজাকাররা তো যুদ্ধাপরাধী, তবে ওদের বিচার হচ্ছে না কেন?'- উত্তরটি ছিল হৃদয় বিদারক! লোকে বলত এ দেশে রাজাকারদের বিচার হবে না কোনো দিনও! রাজাকারদের বিচার করতে গেলে দেশে গৃহযুদ্ধ লেগে যাবে! - এটা নব্বই দশকের গোড়ার দিকের ঘটনা। চিন্হিত যুদ্ধাপরাধী রাজাকাররা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াত তখন, নিজেদেরকে 'রাজাকার' বলে গর্ব করত! আজ ২০১৪, আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। আজ কেও বলছে না যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা যাবে না। তবে কেও কেও বলছে সরকার এখন ট্রাইবুনালের মাধ্যমে যে বিচার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে তা সুষ্ঠু হচ্ছে না! কেও কেও বলছে সরকার ন্যায় বিচার না করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করছে; সরকার নিরপরাধ জামাতে ইসলামের লীডারদের কে যুদ্ধাপরাধের অপরাধে সাজা দিচ্ছে! বহির্বিশ্ব থেকেও উঠছে সমালোচনার ঝর!



একজন 'অরাজনৈতিক সাধারণ' মানুষ হিসেবে আমার মনে খটকা লাগলো! আমি জানতে চাইলাম যুগে যুগে দেশে দেশে যে যুদ্ধাপরাধ সংঘঠিত হয়েছিল, তার বিচার কি হয়েছিল? হলে তা কিভাবে হয়েছিল? ওই যুদ্ধাপরাধের বিচারগুলো কি সমালোচনার উর্ধে ছিল? বিচার প্রক্রিয়াই বা কেমন ছিল? আমি দেখতে চাইলাম বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া পূর্ববর্তী আন্তর্জাতিক বিচার প্রক্রিয়া গুলোর সাথে কতটুকু 'অসামজস্যপূর্ণ'। দৃষ্টিপাত করলাম হাগেনবাখের বিচার থেকে কাদের মোল্লার বিচারের দিকে।



হাগেনবাখের বিচার:

১৪৭৪ সালে স্যার পিটার ফন হাগেনবাখ (Sir Peter von Hagenbach) কে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে দোষী স্বাব্যস্ত করে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয় জার্মানির ব্রাইজাখে। ২৮ জন জজ নিয়ে বিশেষ ভাবে গঠিত ট্রাইবুনাল এই রায় ঘোষণা করে। ইতিহাসে এই রায়টিই সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধের বিচারের রায় (International War Crime Trial) হিসেবে বিবেচিত। ১৪৬৯ থেকে ১৪৭৪ পর্যন্ত সময়টিতে হাগেনবাখ ডিউক অফ বার্গান্ডির আলসেসিয়ান অঞ্চলের গভর্নর থাকা অবস্থায় প্রজাদের উপর হত্যা এবং ধর্ষণসহ চালায় নানা ধরনের নির্মম অত্যাচার। বিচারে যখন তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয় তখন আত্মপক্ষ সমর্থন করে সে বলেছিল যে সে যা করেছে তা করেছে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের হুকুম তামিল করার জন্যই। কিন্তু ট্রাইবুনাল হাগেনবাখের এই আত্মপক্ষ সমর্থনের অজুহাত আমলে নেয়নি এই বিধায় যে হুকুম তামিল করার জন্য কোনো অপরাধ মূলক কাজ করলেও তা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। হাগেনবাখের বিচার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে মাইল ফলক স্থাপন করেছিল তারই ধারাবাহিকতায় ৫০০ বছর পরে শুরু হয় নুরেমবার্গ ট্রায়াল (Nuremberg trials) নামে আরেক যুদ্ধাপরাধের বিচার।



নুরেমবার্গ ট্রায়াল (Nuremberg trials):

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের কুখ্যাত নাত্সী বাহিনী যে হত্যা, ধর্ষণ, লুন্ঠন সহ বর্বরোচিত অত্যাচার চালায় তার বিচারের জন্য এক বিশেষ বিচার বিভাগীয় ট্রাইবুনাল গঠন করা হয় জার্মানির নুরেমবার্গে। যুধাপরাধিদের এই বিচার বহুল আলোচিত ‘নুরেমবার্গ ট্রায়াল’ হিসেবে পরিচিত। আন্তর্জাতিক মিলিটারী ট্রাইবুনাল (International Military Tribunal) নামের এক বিশেষ ট্রাইবুনাল ১৯৪৫ সালের ২০ শে নভেম্বর থেকে বিচার কাজ শুরু করে যা শেষ হয় পরের বছর অক্টোবরে। বিচারে মারাত্নক মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয় নাত্সী বাহিনীর ২৪ জন ‘হাই প্রোফাইল’ অফিসারের বিরুদ্ধে। তাদের মধ্যে ফাঁসি দেয়া হয় ১২ জনকে ১৬ অক্টোবর ১৯৪৬ সালে, যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয় ৩ জনকে, ৪ জনকে দেয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদের ১০ থেকে ২০ বছরের কারাদন্ড এবং অভিযোগ প্রমানিত না হওয়ায় বাকিদেরকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়। হিটলারের অধীনস্ত যে সমস্ত চিকত্সক যুদ্ধকালীন সময় বিভিন্ন অন্যায় কাজের সাথে জড়িত ছিল তাদেরকেও রেহাই দেয়া হয়নি বিচার থেকে। জার্মানির নুরেমবার্গেই ইউ.এস মিলিটারি ট্রাইবুনাল-১ (US military courts) মোট ২০ জন চিকিত্সকের বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাদের অভিযোগ আনে এবং এদের মধ্যে ৭ জনকে দেয়া হয় মৃত্যুদন্ড, ৭ জনকে বেকসুর খালাস, এবং বাকিদেরকে যাবজ্জীবন সহ বিভিন্ন মেয়াদের কারাদন্ড। নাত্সী বাহিনীর চিকিত্সকদের জন্য এই বিচার কাজ 'ডক্টর'স ট্রায়াল' হিসেবে পরিচিত।



ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইবুনাল:

১৯৯১ সালে যুগোস্লাভিয়া যুদ্ধে বসনিয়ান-সার্ব বাহিনী যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায় তার বিচারে ১৯৯৩ সালে নেদারল্যান্ড এর হেইগ এ জাতিসংঘ যে বিশেষ (Ad hoc) আদালত গঠন করে তা 'ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইবুনাল-যুগোস্লাভিয়া' নামে পরিচিত। এ বিচার কাজ এখনো চলছে, যা ২০১৫ তে শেষ হওয়ার কথা। গণহত্যা এবং মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে তত্কালীন স্রেপ্স্কা রিপাবলিক (Republika Srpska) এর প্রেসিডেন্ট এবং সার্বিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টির লিডার রাদোভান কারাদজিক এর বিরুদ্ধে, যে বর্তমানে বন্দী আছে। অভিযোগ প্রমানিত হলে নিঃসন্দেহে তার যাবজ্জীবন কারাদন্ড হবে। ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘ একই ধরনের আরেকটি ট্রাইবুনাল গঠন করে রুয়ান্ডাতে সংঘটিত আরেকটি যুদ্ধাপরাধের বিচার উপলক্ষে। ১৯৯৪ সালের এপ্রিলে সংঘটিত হওয়া ১০০ দিনের সংঘর্ষে সরকার সমর্থিত উগ্রপন্থী হুটু মিলিশিয়া প্রায় ৫,০০,০০০ সংখ্যালঘু টুটসি লোক হত্যা করে। এ সংঘর্ষে অবশ্য হতাহতের সংখ্যা ছিল ৭,০০,০০০ এর উপরে। ১৯৯৮ সালে বিচারে ট্রাইবুনাল আটক প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট অকায়েসুকে গণহত্যার অপরাধে দোষী সাবস্ত করে এবং তাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়। অন্যদিকে টেলিভশন এবং পত্রিকার মাধ্যমে টুটসি গণহত্যায় প্ররোচনা দেয়ায় আরো তিন জনকে বিভিন্ন মেয়াদে ৩০ থেকে ৩৫ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয় ২০০৭ এ।



কেন যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইবুনাল গুরুত্বপূর্ণ?

ইতিহাস থেকে জানা যায় যে যেখানেই যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা বা মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেখানেই একটা বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করে সেই অপরাধের বিচার করা হয়েছে। যুদ্ধে হতাহত হবে এটাই স্বাভাবিক; তবে হতাহতের সংখ্যা যখন অস্বাভাবিক হয়ে যায় অথবা সঘটিত অপরাধ যখন গণ হত্যা, ধর্ষণ বা মানবতা বিরোধী অপরাধে রূপ নেই তখন তা অবশ্যই বিচারযোগ্য অপরাধে পরিগণিত হয়। যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইবুনালের কাজ হলো সমাজের সামনে এই অপরাধকে চিন্হিত করা এবং তার যথাযথ বিচার করা। যুদ্ধাপরাধ বিচার ট্রাইবুনাল অপরাধীদের কোনো ক্ষমা বা মুক্তির সুযোগ দেয় না। বরং এ ট্রাইবুনাল অপরাধের যথাপোযুক্ত বিচারের মধ্য দিয়ে যুদ্ধে নিহত এবং শহীদের প্রতি শ্রদ্ধ্যা প্রদর্শন করে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠন করা হয়েছে ' আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল'।



বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল:

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন ৯ মাসে প্রায় ৩০,০০,০০০ (ত্রিশ লক্ষ) মানুষ হত্যা করে পাকিস্থানি মিলেটারী, এবং তাদের দোসর আল-বদর, আল-সমস এবং রাজাকার গোষ্টি। তারা ধর্ষণ করে ২ লক্ষ মা-বোনকে আর ভিটে ছাড়া করে হিন্দু সংখ্যালঘু সহ লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষকে। সংঘটিত এই যুদ্ধাপরাধের বিচারের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭৩ সালে সর্বপ্রথম আইন হিসেবে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আইন ১৯৭৩’ প্রণয়ন করা হয়। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের উথ্যান পতনে অবশ্য ট্রাইবুনালের বিচার কাজ স্তব্ধ হয়ে ছিল প্রায় পয়ত্রিশ বছর। পরবর্তিতে ২০১০ সালে আওয়ামিলিগ সরকার ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল’ গঠন করে। এই ট্রাইবুনাল ২০১২ সালে বাংলাদেশ জামায়তে ইসলামীর ৯ জন এবং বিএনপি'র ২ জনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনে। এদের মধ্যে ২০১৩ সালে আবুল কালাম আজাদকে অভিযুক্ত করা হয় গণহত্যা, ধর্ষণ এবং অপহরণ অপরাধে এবং তার উনুপস্থিতিতেই তাকে মৃত্যু দন্ড দেয়া হয়। আরেক জামাত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লাকে প্রাথমিক ভাবে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হলেও আপিলের মাধ্যমে তার রায় মৃত্যু দন্ডে উন্নীত করা হয় এবং ২০১৩ এর ডিসেম্বরে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। জামায়েতে ইসলামের নায়েবে আমির দেলওয়ার হোসেন সায়ীদীকে ট্রাইবুনালের রায়ে মৃত্যুদন্ড দেয়া হলেও আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট তাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয় ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী অপরাধের জন্য। বর্তমানে সে কারা ভোগ করছে। অন্যদিকে, বয়স বিবেচনায় এনে নাটের গুরু গোলাম আজমকে ৯০ বছর কারাদন্ড দেয়া হয়ে এবং সাজা ভোগরত অবস্থায় ২৩ এ অক্টোবর সে মৃত্যু বরণ করে। কামরুজ্জামানের ফাঁসির রায় বাস্তবায়ন সময়ের ব্যাপার মাত্র। এছাড়াও মুইন উদ্দিন, মুজাহিদ, নিজামী, মীর কাসেম আলী এবং সাকা চৌধুরি গং দেরও ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে। মোট কথা প্রধান যুদ্ধাপরাধীদের সবারই বিচার হয়েছে। জনগণ এবং হাজার হাজার শহীদ পরিবারের দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হয়েছে। শহীদদের আত্মত্যাগের ঋণ কিছুটা হলেও শোধ হয়েছে। তবে প্রশ্ন উঠেছে 'বিচার কার্যের স্বচ্ছতা' নিয়ে। একটা করে রায় দেয়া হচ্ছে আর কিছু মানুষ হইচই করছে যে বিচার সুষ্ঠু হয়নি, 'ধৃত রাজাকারেরা' সব নির্দোষ! আসলেই কি তাই?



পূর্বে সম্পন্ন আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধের কোনো বিচারই কখনো সমালোচনার উর্ধে ছিল না:

হাগেনবাখের বিচার ও সমালোচিত হয়েছে। সমালোচকদের দৃষ্টিতে হাগেনবাখের জন্য গঠিত ট্রাইবুনাল 'আন্তর্জাতিক' ছিলনা, কেননা ওই ট্রাইবুনাল গঠিত হয়েছিল রোমান এম্পায়ার এর আশির্বাদ পুষ্ট বিচারক মন্ডলী দিয়ে। কাজে বিচারের রায়ও ছিল রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবিত। নুরেমবার্গ ট্রায়ালও সমালোচনার উর্ধে নয়! সমালোচকের দৃষ্টিতে যে 'অপরাধের' জন্য দোষীদের সাজা দেয়া হয়েছে ঐ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ওই 'অপরাধগুলো' আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ (ক্রাইম)- ই ছিল না। তত্কালীন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হারলান ফিস্কে স্টোন (Harlan Fiske Stone) নুরেমবার্গ ট্রায়ালকে বলেছিলেন 'ফ্রড' (Fraud) ট্রায়াল। যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের সহযোগী বিচারপতি উইললিয়াম ডগলাস (William O. Douglas) নুরেমবার্গ ট্রায়াল সম্পর্কে সমালোচনা করে বলেছিলেন, "I thought at the time and still think that the Nuremberg trials were unprincipled. Law was created ex-post facto to suit the passion and clamor of the time.” দুর্বল বিচারপতি নিয়ে ট্রায়াল গঠনের প্রতিবাদে তো যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি চিফ কাউন্সেল আব্রাহাম পমেরান্তজ (Abraham Pomerantz) তার চাকরিই ছেড়ে দিলেন! প্রসঙ্গত: বলে রাখা ভালো যে আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, পোল্যান্ড এবং রাশিয়া থেকে বিচারপতিদের নিয়ে নুরেমবার্গ ট্রায়াল গঠন করা হয়েছিল।



নুরেমবার্গ ট্রায়াল এর বিচারকগণ কি 'নিরপেক্ষ' ছিল? উত্তর: 'না'। এ প্রসঙ্গে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং আইনজ্ঞ আর্থার লেহমান গুধার্ট (Arthur Lehman Goodhart) বলেছিলেন, “The judges were appointed by the victors, the Tribunal was not impartial and could not be regarded as a court in the true sense.” এ রকম আরও অনেক সমলোচনা হয়েছে নুরেমবার্গ ট্রায়ালকে ঘিরে। কিন্তু তারপরও নুরেমবার্গ ট্রায়ালই ইতিহাসের পাতায় টিকে আছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে। সমালোচকরা যাই বলুক অথবা আইনের সূক্ষ মারপ্যাচ যাই থাকুক, এটা তো সত্য যে হিটলারের নাত্সী বাহিনী কি তান্ডব চালিয়েছে ইহুদিদের উপর। কিভাবে পদদলিত করেছে মানবতা। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশেও পদদলিত হয়েছে মানবতা। হয়েছে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ; মারাত্মক ভাবে ভঙ্গ করা হয়েছে 'জেনেভা কনভেনশন'। এ অপরাধের বিচার আজ হচ্ছে। আর একই ধারাবাহিকতায় বিচার কার্যও সমালোচিত হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার সমালোচিত হবে এটাই স্বাভাবিক। সমালোচনার কারণে যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ থাকা সমীচীন নয়। কেননা ত্রুটি হীন ভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্ভব নয়; অতীতে কখনো সম্ভব হয়নি; ভবিষ্যতেও হবে না।



শেষ কথা:

ব্রিটেনে নভেম্বর মাস আসলেই দেখা যায় চারদিকে পপি ফুল আর পপি ফুল। না এটা কোনো প্রকৃতিক ব্যাপার না। প্রতিটি মানুষ ছোটো ছোটো কৃত্রিম লাল রঙের পপি ফুলের ব্যাজ পরিধান করে, গাড়ির ফ্রন্ট প্যানেলেও দেখা যায় পপি ফুল! টিভি খুললেই দেখাযায় সবাই পপি ফুল এর ব্যাজ পরে বসে আছে! হাজার হাজার সিরামিকের পপি ফুল দিয়ে ঘিরে রাখা হয় 'টাওয়ার অফ লন্ডন'। একই ঘটনার পুনরাবৃতি ঘটে প্রতি বছর ঠিক নভেম্বরের ১ থেকে ১১ তারখ পর্যন্ত। পপি ফুল পরিধান করে গোটা ব্রিটিশ জাতি স্বরণ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত হওয়া লক্ষ লক্ষ প্রানের আত্মত্যাগ। আমাদের দেশের স্বাধীনতার পেছনেও তো রয়েছে লক্ষ প্রানের আত্মত্যাগ। আমরা কিভাবে তাদের স্বরণ করি? আমরা কি আসলে তাদের স্বরণ করি? তাদের ঋণ কি আমরা পরিশোধ করেছি? ধিক্কার ওই সমস্ত জ্ঞান পাপীদের যারা যুদ্ধাপরাধীদের সাফাই গাইতে গিয়ে ভুলে যায় স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর শহীদদের কথা। ত্রিশ লক্ষ শহীদের ঋণ কোনো 'বার্গেন প্রাইস' নয়। লক্ষ শহীদের ঋণ পরিশোধ এক 'ন্যায্য' দাবি এবং তা পরিশোধ করতে হবে 'ন্যায্য মূল্যেই'।



ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম

শেফিল্ড,

১০ নভেম্বর ২০১৪



[তথ্য সুত্র: (1) The Trial of Peter Von Hagenbach: Reconciling History, Historiography, and International Criminal Law. Gregory S. Gordon. February 16, 2012; (2) The Diplomat 12 Oct 2014, Article by Abed Khan; (3) Huffington Post, 12 Feb 2013, (4) Wikipedia, (5) World Without Genocide, (6) Beyondintractability.org, (7) এবং বিভিন্ন বাংলা পত্রিকা]

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১১:৪৮

নিয়ামুল ইসলাম বলেছেন: ভাই আমরা পৃথিবীর অন্যতম কুলাঙ্গার জাতি, কারন আমদের দেশে জন্ম নেয়া (স্বাধীনতার পর) কিছু লোক কথায় কথায় আন্তর্জাতিক মান নিয়া প্রশ্ন তুলে। তাই মাঝে মাঝে তাদের বলি বিয়েটাও আন্তর্জাতিক মান ঠিক রেখে করিস। বাংলাদেশের বিরুধীদের কোন ঠাই নাই এ দেশে, শাস্তিই এদের প্রাপ্য।

২| ১১ ই নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৫:৪৯

পার্সিয়াস রিবর্ণ বলেছেন: অসাধারণ পোস্ট । নতুন করে কিছু তথ্য জানলাম ।

পোস্টে ++

ভালোলাগা .......

১১ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:১৩

নাটশেল বলেছেন: লেখাটি আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম। ভালো থাবেন।

৩| ১২ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ২:০৮

চা-ওয়ালা বলেছেন: ধিক্কার ওই সমস্ত জ্ঞান পাপীদের যারা যুদ্ধাপরাধীদের সাফাই গাইতে গিয়ে ভুলে যায় স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর শহীদদের কথা।
প্লাস প্লাস প্লাস।।

১২ ই নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:৪১

নাটশেল বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে, ধৈর্য ধরে লেখাটি পড়ার জন্য।

৪| ১২ ই নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:২৯

জেরিফ বলেছেন: চমৎকার বিশ্লেষণ ।

ধিক্কার ওই সমস্ত জ্ঞান পাপীদের যারা যুদ্ধাপরাধীদের সাফাই গাইতে গিয়ে ভুলে যায় স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর শহীদদের কথা।



++++++++

১২ ই নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:৪২

নাটশেল বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে, ধৈর্য ধরে লেখাটি পড়ার জন্য।

৫| ১২ ই নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৪:০৫

হাসান নাঈম বলেছেন:

এই ব্যাপারে আমার একটা প্রশ্ন ছিল - আচ্ছা আমরা এত বছর ধরে শুনে আসলাম এইসব লোক নাকি যুদ্ধাপরাধী, তাহলে ট্রাইবুনালে বিচার করার সময় এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা গেল না কেন? কেন '৭৩ এর আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইন পরিবর্তন করে সেখানে 'মানবতা বিরোধী অপরাধ' সংযুক্ত করতে হল? বিচার প্রকৃয়া, স্বাস্তির বিধান সবই যুদ্ধাপরাধের জন্য তৈরী অথচ বিচার করা হচ্ছে 'মানবতা বিরোধী' অপরাধের - কারণ কি?

আর একটা কথা - যুদ্ধ যেহেতু একাধিক দেশের মধ্যে হয়, তাই যুদ্ধাপরাধ মাত্রই আন্তর্জাতিক অপরাধ। তাহলে আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার স্থানীয় ট্রাইবুনালে কেন করা হল? সত্যিকারের আন্তর্জাতিক মানের ট্রাইবুনাল করলে কী সমস্যা ছিল?

অপরাধীর স্বাস্তি হওয়া এক বিষয় আর একের অপরাধে অন্যকে বা মিথ্যা অভিযোগে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ফাঁসিয়ে দেয়া বা আন্দোলনের জোরে আইন পরিবর্তন ও আদালতে প্রভাবিত করে কোন ব্যাক্তির ফাঁসি নিশ্চিত করা সম্পুর্ণ ভিন্ন বিষয়। এই বিচার করতে গিয়ে আমরা দেশের আইন আদালতকে যেভাবে কলঙ্কিত করেছি, রাস্তার আন্দোলনের মাধ্যমে যেভাবে আইন বদলিয়ে আদালতকে মৃত্যুদন্ড দানে বাধ্য করেছি সেটা খুব একটা ভাল কাজ হয় নাই। ভবিষ্যতেই দেখা যাবে এর পরিনতি কেমন হয়।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.