নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অমিয় উজ্জ্বল

অমিয় উজ্‌জ্‌বল

অর্থ নয় কীর্তি নয় সফলতা নয় আরো এক বিপন্ন বিস্ময় অন্তর্গত রক্তের ভেতর খেলা করে।

অমিয় উজ্‌জ্‌বল › বিস্তারিত পোস্টঃ

মন্ত্রী

১৫ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১১:২১

-হ্যালো…..ডাক্তার উজ্জ্বল?
-জ্বি …কে বলছেন?
-আমি মন্ত্রী বলছি।
-মন্ত্রী ? আমার চৌদ্দ গুষ্টিতে কোন মন্ত্রী নেই। হওয়ার কোন সুদুর সম্ভাবনাও নেই।
-বন্ধু, আমি মন্ত্রী বলছি।
একে তো মন্ত্রী তার উপর আবার বন্ধু ….. আমি যে ঐ লেভেল এর লোকনা তা আমার ফেসবুক বন্ধুরা বিলক্ষণ জানেন। দুপুরের ভাতঘুম নষ্ট করে এই জাতীয় রসিকতা হজম করতে বিষের মত লাগে। বিরক্তি নিয়েই জিজ্ঞেস করলাম ……
-কোন মন্ত্রী?
-কওয়া পারো বস্ত্র মন্ত্রী। হে হে হে।
চরম ঝাড়ি দিতে যাব এরকম সময় ফোনের আগন্তুক আমাকে বলল ,
-দোস্ত আমি মন্ত্রী মন্ডল, শান্তিনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়……।
আমার বিরক্তি মহুর্তেই মিলিয়ে গেল। স্মৃতি এক অদভূত অনুভুতির জগত।
-মন্ত্রী …..???? কেমন আছিস? কি খবর তোর?
.... ..... ....
শান্তি নগর প্রাথমিক বিদ্যালয়। আমার জীবনের প্রথম স্কুল।
আমার তখন সাড়ে পাঁচ বছর বয়স।
এক বিকেলে আব্বা আমাদের ভাই বোনদের নিয়ে হাঁটতে বের হলেন। আমাদের সরকারি বাসার পেছনে একটা ছোট্ট বন। সেটা পেরুলেই একটা গ্রাম। ছিম ছাম, ছোট্ট। গ্রামের নাম শান্তিনগর। সেখানে পাশাপাশি তিনটি ছোট্ট মাটির ঘর। ঘরগুলিতে ছোট ছোট জানালা। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বানানো জানালার গ্রিল। ভেতরে বেঞ্চি, বাঁশের তৈরী। গ্রামের চায়ের দোকানগুলির সামনে যেমন থাকে সেরকম। সামনে একটি সাইন বোর্ড “ শান্তিনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্থাপিত – ১৯৮৩” । সামনে বিরাট একটি মাঠ। এক পাশে দীঘি।
আব্বা বললেন “সুন্দর তো স্কুলটা!”
এই রহস্যের ভেদ আমরা ভাইবোনরা আজো করতে পারিনি, আব্বা এর মধ্যে কি সুন্দর দেখেছিলেন।
আমাকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো সেই ‘সুন্দর’ স্কুলে। আমার অপর দুই ভাইবোন উপজেলা সদরের একটি স্কুলে পড়ালেখা করছিল। তাদেরও সেখান থেকে ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করা হলো।
শান্তিনগর নামটিই কি আব্বাকে আকৃষ্ট করেছিল?
এই স্কুলে আমার যারা সহপাঠি হলো তারা আমার থেকে বয়সে কমপক্ষে ৪/৫ বছরের বড়। ওদের অধিকাংশই লুংগি পড়ে আসত। স্কুল ব্যাগ কারো ছিলনা, প্রশ্নই আসেনা। আমার কেন ছিল সেটা ছিল তাদের কাছে বিরাট প্রশ্ন। উপর ক্লাশের ছেলেরা বই গুলো রুমালে বেধে নিয়ে আসতো একটা বিশেষষ কায়দায়।
আমি ছিলাম ওদের কাছে রীতিমত এলিয়েন, হাসির জিনিস। আমি ইংলিশ প্যান্ট পড়ি, জুতা পড়ি। হাসাহসি চলতেই থাকলো একের পর এক নানা ইস্যুতে। এঅবস্থায় টানা একবছর আমি স্কুলেই যায়নি। ২য় শ্রেনী থেকে আমি নিয়মিত হই। ততদিনে একটু করে ধাতস্থ হতে শুরু করি।
স্কুলে ছেলেরা ক্লাশ না থাকলে ফুটবল খেলত। এটা যতটা না ছিল ফুটবল খেলা তার চেয়ে বেশী ছিল হুড়াহুড়ি। আমি দুর থেকেই খেলা দেখতাম। কখনো ফুটবল না পেলে ওরা গাছে ঝুলাঝুলি খেলত। সেটাও আমার পক্ষে কঠিন। আমি গাছে চড়া তখনো শিখিনি ।
আমার ভরসা ছিল আমার বান্ধবীরা। ওদের বউ তোলা, বরফ পানি, গোল্লা ছুট অপেক্ষাকৃত সহজ খেলা আমার জন্য। আমার সেই বান্ধবীদেরও অধিকাংশের বিয়ে হয়ে গেল ক্লাশ থ্রি ফোরে উঠতে না উঠতেই্ ।
এরকম কঠিন দু:সময়ে আমার বন্ধু হয়েছিল যথাক্রমে মোকসেদুল ও মন্ত্রী মন্ডল।
মোকসেদুলের সাথে পরে আমার কুমিল্লায় দেখা হয়েছিল একদিন। বড় করুন ছিল সে দেখা হওয়া। আজ সেই গল্প থাক।
অন্যদের গল্প বলি।
মন্ত্রী নামটা এই সময়ে একটু অন্যরকম শোনালেও এরকম নামের আমার আরো কিছু সহপাঠী ছিল।
এদের একজনের নাম ছিল ‘বালিস্টার” । মানে ব্যারিস্টার আর কি। ওখানের স্থানীয় ভাষায় ব্যারিস্টারকে বালিস্টারই বলতো। একজন ছিল জজ মিয়া।
বুলেট হোসেন, এসডু(এসডিও)ও ছিল।
এরা কেউই নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেনি। বাল্স্টিার পরবর্তী জীবনে একজন চোরাকারবরিী হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ে। বিরামপুর সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে চিনি,চাল, শাড়ী প্রভৃতি পাচার করে হাত মকশ করে।এভাবে একদিন তার ফেনসিডিলে উত্তরণ হয়। শেষ পর্যন্ত যতদুর জেনেছি ফেনসিডিল পাচার করতে গিয়ে সে ধরা পড়ে ।
নিজের জন্য একজন ব্যারিস্টার তো দুরে থাকুক এডভোকেটও যোগাড় করতে পারেনি।
বালিস্টার এখন জেলে।
আমরা যখন হাই স্কুলে পড়ি জজ মিয়া তখন থেকেই সিনেমা হলের টিকেট ব্ল্যাক করে। বর্তমান পেশা জানিনা।
বুলেট হোসেন বলতো সে বড় হলে পুলিশ হবে। বুলেট এখন রেল স্টেশনে চা এর দোকান চালায়। ওর চায়ের অনেক সুনাম। অনেক পুলিশ –কনস্টেবল তার দোকানে চা খায়। ছুটিতে দিনাজপুর গেলে আমরাও যাই বুলেটের চা খেতে। বুলেট বন্ধুদের পেয়ে দ্বিগুন শক্তিতে চায়ে দুধ গুলাতে থাকে টিং টিং আওয়াজ তুলে।
মন্ত্রীতে ফিরে আসি। প্রাইমারীতে থাকা অবস্থায় মন্ত্রী আমাকে ভাল সংগ দিয়েছে। ও ঝুলাঝুলি খেলতনা। বল খেলার নামে হুড়াহুড়িও করতোনা। আমার সাথে সহজ সহজ খেলা খেলার চেষ্টা করতো। পড়াশুনায় আগ্রহ ছিল। আমরা আংগুলে আংগুল কেটে দোস্ত হয়েছিলাম।
মন্ত্রী হাইস্কুল পর্যন্ত আমাদের সাথে ছিল। তারপর একদিন দেখি সে আর নেই। মানে আসেনা। ততদিনে আমি উপজেলা সদরের অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত পরিবারের ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব জমিয়ে ফেলেছি। মন্ত্রীর হারিয়ে যাওয়া ছিল স্রেফ একটা ড্রপ আউট।
সেই মন্ত্রী আমাকে ফোন দিয়েছে।
....................
-দোস্ত, অনেকদিন পর তোমার সাথে কথা বলিচ্ছি। খুব আনন্দ লাগিচ্ছে।
- হুম। খবর কি তোর? কি করিস? কোথায় আছিস?
- ঐ যে কোলাম (বললাম) বস্ত্র মন্ত্রী।
- মানে কি? হেয়ালি ছাড়।
- টেইলারি করি দোস্ত। ঢাকাতেই থাকি, মোহাম্মদ পুর।
- ভাল তো।
- কোটা বানাবা পারি। তবে এখনো কাটিং মাস্টার হওয়া পারিনি। আসো একদিন।
- আসব। তুই আয়। আমি মহাখালিতে থাকি।
- আসব দোস্ত। যে কারণে ফোন দিছি সেটা আগে বলি। আম্মা অসুস্থ। দিনাজপুরের ডাক্তাররা বললো ক্যান্সার। শুনে তো আমার মাথাটা চক্কর খাইছে। বুলেট কো’ল তুমি ক্যান্সার হাসপাতালের ডাক্তার। অর কাছ থেকেই নাম্বারটা নিছঁ।
- কোথায় ক্যান্সার?
- জরায়ু ‘ত বলে। অপারেশন করার কথা ছিল । ফির ডাক্তাররা কো’ল অপারেশন করা যাবেনা। থেরাপী লাগবে। তুমি এনা হামাক হেলপ করো দোস্ত।
- অবশ্যই। তুই যত তাড়াতাড়ি পারিস খালাম্মাকে নিয়ে আয়। আমি সব ব্যবস্থা করবো।
আমার সেদিনের দুপুর অন্যরকম ভাল লাগায় কেটেছিল। ছোটবেলার অসংখ্য স্মৃতি মাথায় নিয়ে আমি পার করেছি একরকম ঘোরের ভেতর দিয়ে। আমি মন্ত্রী ও তার মায়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
মন্ত্রী আর আসেনি। আমি ফোন করেছিলাম । মন্ত্রী বলেছিল “দোস্ত , আম্মাক দিনাজপুরে হোমিওপ্যাথী দেখাচ্ছি। এখন এট্টু ভাল। ঢাকাত আনে চিকিৎসা করা ….. বুঝই তো। মানষে কো’ল থেরাপী দিতে ম্যোলা খরচ। বাচারও গেরান্টি নাই…..”
আমি আর কথা বাড়ালাম না। শুধু বললাম “তুই আসিস একদিন।”
মন্ত্রী আর আসেনি। একই শহরে আমরা থাকি। আমাদের আর দেখা করা হয়না। আমার আর কোট বানানোর প্রয়োজন হয়নি। হয়ত মন্ত্রীরও আর ডাক্তারের প্রয়োজন হয়নি।
এতদিনে ঢাকায় থেকে হয়ত মন্ত্রীও জেনে গেছে এই ঢাকা শহরে প্রয়োজন ছাড়া কেউ কারো সাথে দেখা করেনা।

মন্তব্য ১১ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (১১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:৫০

আজমান আন্দালিব বলেছেন: মন্ত্রী আর আসেনি। একই শহরে আমরা থাকি। আমাদের আর দেখা করা হয়না। আমার আর কোট বানানোর প্রয়োজন হয়নি। হয়ত মন্ত্রীরও আর ডাক্তারের প্রয়োজন হয়নি।
এতদিনে ঢাকায় থেকে হয়ত মন্ত্রীও জেনে গেছে এই ঢাকা শহরে প্রয়োজন ছাড়া কেউ কারো সাথে দেখা করেনা।
সুন্দর!

২| ১৬ ই নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:৫৭

ভরকেন্দ্র বলেছেন: মন্ত্রীরা কখনই আসবেনা... দ্বীধা অথবা লজ্জা....অথবা...।

৩| ১৬ ই নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৪:১২

সোহানী বলেছেন: অনেক ভালো লাগলো লিখাটা.........

৪| ১৬ ই নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৫:২৪

এটিএম নাফিজ বলেছেন: লেখাটা ভালো লাগলো। :)

৫| ১৭ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:৩৪

হাসান মাহবুব বলেছেন: নচিকেতার অনির্বাণ গানটার কথা মনে পড়ে গেলো।

দেখে যা, যা অনির্বাণ
কী সুখে রয়েছে প্রাণ!

৬| ১৮ ই নভেম্বর, ২০১৪ ভোর ৪:১৪

ব্ল্যাক পাইরেট বলেছেন: ফিরে না ফেরার শহর ঢাকা শহর.......।

৭| ১৮ ই নভেম্বর, ২০১৪ সকাল ৮:৫৬

সপ্নময় তপু বলেছেন: শেষ কথাটা নাড়া দিয়ে গেল। আমি খুব বড় কিছু হই নি। কিন্তু আমাকেও কে জীবন মাঝে মাঝে এই অপরাধবোধে ভোগায়

২০ শে নভেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:২৮

অমিয় উজ্‌জ্‌বল বলেছেন: এই তো জীবন

৮| ১৮ ই নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৪:৩৮

জেরিফ বলেছেন: শেষ লাইন গুলো দেহ টাকে নাড়িয়ে দিলো ।

২০ শে নভেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:২২

অমিয় উজ্‌জ্‌বল বলেছেন: মনটাকে নাড়া দেয় নাই? নাকি খালি দেহ?

৯| ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৪ ভোর ৬:১৭

জেরিফ বলেছেন: দেহ টাকে নাড়াতে হলে আগে মন টাকে ছুঁতে হবে । লিখাটা যথার্থ ভাবে তার দায়িত্ব পালন করেছে ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.