নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অামি অতি সাধারণ, সাধারণ থাকতে চাই ।

পার্থ তালুকদার

আমি ভাই সাধারণ, সাধারণ থাকতে চাই।

পার্থ তালুকদার › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ এ্যালবাম

২৩ শে জুন, ২০১৬ রাত ৮:৩১




হলভর্তি দর্শক। বিকেল পাঁচটা থেকে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে এখন রাত ন’টা ছুঁই ছুঁই। চলবে রাত দশটা পর্যন্ত। স্টেজে আলোর ঝলকানি থাকলেও পুরো হলরুম অন্ধকারে আচ্ছন্ন। হাত বাড়ালে দেখা গেলেও সেটা কার হাত চেনা যায় না। প্রতিদিন পাঁচ ঘন্টা করে এই অনুষ্ঠানে মোট চারজন বক্তা তাদের বক্তব্য রাখবেন। অনুষ্ঠান চলবে পুরো এক সপ্তাহ। বক্তব্য বললে ভূল হবে, আসলে তাদের অনুভুতি শেয়ার করবেন দর্শকদের কাছে। শহরের একটা চ্যারিটি সংগঠন এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে তাদের স্বজনরা এখানে উপস্থিত হয়ে তাদের স্মৃতিটুকু দর্শকদের কাছে তুলে ধরবেন। কেউ রক্তমাখা শার্ট, কেউ প্যান্ট আবার কেউবা তাদের প্রিয়জনদের ছবি নিয়ে এসেছেন। সংগঠনটি মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচিহ্ন পরম মমতায় সংগ্রহ করে শহরে একটা যাদুঘর প্রতিষ্ঠা করবে, এই তাদের উদ্দেশ্য।

একজন পিতা তাঁর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পুত্রের রক্তমাখা শার্ট নিয়ে আসছেন। পুত্রের শহীদ হওয়ার বর্ণনা শুনে হলরুমে পিনপতন নিরবতা নেমে আসে। সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছেন তাঁর পুত্রের করুণ কাহিনী। এ তো কোন মিথ্যে কাল্পনিক ইতিহাস নয়। এতো কোন অলৌকিক মহাকাব্য নয়, যা কোন এক কবি বছরের পর বছর সাধনায় তিলে তিলে নিঁখুতভাবে রচনা করেছেন। এটা বাস্তব। চন্দ্র সূর্যের মতো জ্বলজ্বল করা চিরবাস্তব। পিতা কখনো পুত্রের মৃত্যু নিয়ে মিথ্যে কাব্য রচনা করে না। মা কখনো মানুষরূপী পশুদের কাছে ধর্ষিত মেয়েকে নিয়ে মেকি কাব্য রচনা করে না। এখানের দর্শক কারো বক্তব্য শুনে মুহুর্মূহু করতালি দেয় না। এখানে তাদের গায়ের লোমে কাঁপন ধরে, কারো চোখ বেয়ে অজান্তেই পড়ে যায় ক’ফোঁটা নোনা জল।

মাইকে ঘোষণা এল। এবার নজরুল সাহেব তাঁর সহপাঠির গল্প নিয়ে আসছেন। ‘সহপাঠি’ বলায় দর্শকদের মনযোগে একটু ছন্দপতন ঘটলো। কয়েকটা চেয়ার নড়ার শব্দও পাওয়া গেল তখন। কয়েকজন দর্শক উঁকি দিয়ে নজরুল সাহেবের চেহারাটা দেখার চেষ্টা করলেন। হয়তো কোন একজন বললেন, সহপাঠির গল্প! কী আর হবে ! এ কেমন গল্প !

নিজের নাম শুনে উসখুসভাবে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন নজরুল সাহেব। একজন ভলান্টেয়ার তাকে সাহায্য করার জন্য অতি দ্রুত তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াল। একটা হাত এগিয়ে দিতেই নজরুল সাহেব মাথা নাড়িয়ে বাঁধা দিলেন। অর্থাৎ তিনি একাই দাঁড়াতে পারবেন। গুটিগুটি পায়ে তিনি ডায়াসের কাছে চলে গেলেন। হাতে একটা সোনালী রংয়ের বাক্স। খুব মমতায় নিজ সন্তানের মতো বুকের সাথে জড়িয়ে ধরেছেন। মাইক্রোফোনের কাছে গিয়ে কন্ঠ ঠিক আছে কিনা তা পরখ করার চেষ্টাটুকুও করেন নি। একপলক হলভর্তি দর্শকের দিকে তাঁকালেন। এবার বলতে শুরু করেন তিনি।

১৯৭১ সাল। আজকের যে মুরারীচাঁদ কলেজ অর্থাৎ এমসি কলেজ, সেই কলেজের ছাত্র ছিলাম আমি। অনার্স ফাইনাল ইয়ারে পড়ি। দেশ তখন উত্তাল সমুদ্র। এখানে মিটিং তো ঐখানে পিকেটিং। আমরা থাকতাম কলেজ হোস্টেলে। দেশের এই অবস্থায় পড়ার টেবিলে মন বসে না। বাড়ীতে মা-বাবার জন্য সবসময় মন কাঁদে। সেদিন রুমে দরজা বন্ধ করে কি যেন ভাবছি। হঠাৎ দরজায় টকটক শব্দ। চেয়ার থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না আমার। বললাম, কে ?
: আরে আমি। তাড়াতাড়ি দরজা খোল।
আমি চেয়ার থেকে উঠে দরজাটা খুললাম। রাত তেমন একটা হয়নি। দশটার এদিক সেদিক হবে। বাইরের ঠান্ডা বাতাস আমার মুখে একটা ঝাপটা দিলো। ফেব্রুয়ারী মাস। তবে শীতটা এখনও কমেনি। তাছাড়া কলেজ হোস্টেলটা পাহাড়ের পাদদেশে হওয়ায় শীতটা একটু বেশীই মনে হচ্ছে। দরজা খোলা মাত্র শীতের ঝাপটার মতই আমাকে জড়িয়ে ধরল হিরণ।
: কিরে, কি হইছে তোর ?
: বন্ধু, আমার প্রেম হয়েগেছে !
: প্রেম ! কখন ? কার সাথে ?
: হুম বন্ধু, প্রেম হয়ে গেছে। আজ বিকেল পাঁচটা কুড়ি মিনিটে। আর কার সাথে ? সেটা তো তুই অনুমান করতে পারছিস।
: পারছি বন্ধু, পারছি।

হিরণ আমাদের ক্লাসের সবচাইতে শান্ত ছেলে। সিলেট শহরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান সে। শহরের সুবিদবাজার থেকে বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার পথে ডানদিকের গলিটায় ঢুকে দুইটা বাসা ফেলে পরের বাসাটাই তাদের। দু’তলা বাসার পুরোটাই হিরণদের। পাঠ্য বইয়ের সাথে সবসময়ই তার ঝুলানো ব্যাগে জায়গা করে নিত রবিঠাকুর, নজরুল, জীবনানন্দ। কলেজ, বাসা আর আমার রুমেই তার সময় কাটতো বেশী। দেখা গেল কলেজের পিছন গেইট দিয়ে বেরিয়ে দু’জন হাটতে হাটতে হোস্টেল গেইট পর্যন্ত এসে আবার দু’জন গল্প করছি। আমি রুমে যাওয়ার জন্য মোড় নিতে গেলে হিরণও আমার পিছু নেয়।
: কিরে, এখন বাসায় যাবি না ?
: না বন্ধু, এখন বাসায় যেতে ভাল লাগছে না। বিকেলে যাব।
: ঠিক আছে আয়।

এই হলো হিরণ। এমন শান্ত ছেলে হুট করে প্রেমে পড়েছে শুনে আমি মোটেই অবাক হইনি। হুট করে বললে ভূল হবে। আমার ধারণা ছিল প্রেমটা ওর হবেই। এমন সুন্দরী একটা মেয়ে কারো পিছু নিলে, যে যাই বলুক, প্রেম হবেই। তাই সকল নিয়ম মেনে অথবা না মেনে হিরণের সাথে অলি সেন গুপ্তা’র প্রেমটা হয়েই যায়। অলি ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্রী। চঞ্চল, চটপটে। হিরণের ঠিক বিপরীত। তবে দু’জনই ছিল বইয়ের পোকা। কলেজে বামধারার রাজনীতির সাথে কিছুটা যুক্ত ছিল অলি। ক্যাম্পাসের মিটিং মিছিলে প্রায়শই দেখা যেত তাকে। সে সিলেট শহরেরই মেয়ে।

অলি প্রথম যেদিন হিরণকে প্রপোজ করে সেদিন হিরণ আমাকে বিষয়টা বলেনি। বলল একদিন পর। প্রপোজ পাওয়ার পরের কয়েক ঘন্টা নাকি সে এতটাই ভয় পেয়েছিল, বাসায় গিয়ে দরজা বন্ধ করে ঐ রাতে ভাত না খেয়ে, না ঘুমিয়ে কাটিয়েছিল পুরো রাত। পরের দিন খুব সকাল বেলা আমার হোস্টেলে এসে বলে-
: দেখলি বন্ধু, ঐ মেয়ে, ঐ মেয়ে কিনা আমাকে প্রপোজ করে !
: কোন মেয়ে ?
: ঐ যে অলি। সারাদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়। মিছিল করে, মিটিং করে। সে নাকি আমার সাথে প্রেম করবে! আমি শেষ বন্ধু।

তাহলে অলির সাথে তোর প্রেমটা হয়েই গেল বন্ধু। যাক্ ভালই হয়েছে। একটা প্রেম অন্তত করতে পারলি। মা-বাবার কাছে কলেজে ভর্তির একটা রেজাল্ট দিতে হবে না ! সেটাই দিবি। আমার দ্বারা তো আর হলো না। শোন, পরীক্ষার পরপরই কিন্তু বিয়েটা করে ফেলবি। তোর বিয়েতে অনেক মজা হবে, কি বলিস। আহ ! ভাবতেই বেশ লাগছে। হিরণ অনেকটা উৎফুল্ল মনে আমার রুম থেকে বিদায় নেয়।

দু’মাস পরই পরীক্ষা। ক্লাস বন্ধ, তাই কলেজে যাওয়া হয় না। হিরণের সাথে তেমন আর দেখাও হয় না। শুনলাম হিরণ নাকি এখনো কলেজে যায়। তবে যা শুনে খুবই আশ্চর্য হয়েছি তা হলো, সে নাকি ইদানিং মিছিল-মিটিং করে। কোন কোন পথসভায় ভাষণও রাখে। মনেমনে ভাবলাম, তাঁর উপর হয়তো অলির প্রভাব পড়েছে। প্রেমে পড়লে একের উপর অন্যের প্রভাব পড়বে এটাই স্বাভাবিক।

হঠা্ৎ একদিন হিরণ আমার রুমে এসে হাজির। আমি খোঁচা দিয়ে বললাম, কিরে, প্রেমে পড়ে কি হোস্টেলের কথা ভূলে গেলি। মুচকি হাঁসে হিরণ। আমার চেয়ারে বসে টেবিলে কনুই দিয়ে হাত দুটি থুতনির মধ্যে চেপে ধরে। তাঁর মাথায় কোন দুশ্চিন্তা ঘোরপাক খাচ্ছে, তা দেখেই বুঝা যায়।
: কিরে, তুই নাকি নেতা হয়ে যাচ্ছিস ? মিছিল-মিটিং করিস শুনলাম।
: হ্যাঁ বন্ধু, ঠিকই শুনেছিস। দেশের যা অবস্থা তাতে তো মনে হয় ওরা আমাদের বাঁচতে দিবেনা। ঢাকাতে ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে। ঘর থেকে বের হলেই গুলি। যেকোন সময় যুদ্ধ শুরু হতে পারে। এ অবস্থায় মনকে ধরে রাখতে পারলাম না বন্ধু। দেশের জন্য কিছু একটা করতে হবে।

কথাগুলো শেষ করে শান্ত হয়ে বসে থাকে হিরণ। আমি তাঁর পাশে গিয়ে বসি। নিজেকে কেমন জানি অপরাধী লাগছে। আমি পরীক্ষার জন্য বসে আছি আর এদিকে বন্ধুরা দেশ নিয়ে চিন্তা করছে।

বুঝলে নজরুল, দেশটা স্বাধীন হলেই আমি বিয়ে করবো। অলিও তা মেনে নিয়েছে। দেশের এই অবস্থায় বিয়ে করা কি ঠিক হবে, বল ? একটা স্বাধীন দেশে আমরা দু’জন বিয়ে করবো; উহু, ভাবতেই কেমন শিহরণ লাগছে। অলি কি বলে জানিস ? বলে, পরাধীন দেশে প্রেম আর স্বাধীন দেশে বিয়ে। দু’দেশেরই একটা স্বাদ পাওয়া যাবে তখন। জানিস নজরুল, অলি না এখন অনেক শান্ত হয়ে গেছে। কী জানি ভাবে সারাদিন। সারাক্ষণ আমার সাথে থাকতে চায়। আমার জন্য নাকি ওর খুব টেনশন হয়। আমি বলি, সব ঠিক হয়ে যাবে বন্ধু, বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে।

তার কিছুদিন পরেই দেশে যুদ্ধ শুরু হয়। আমি গ্রামে পালিয়ে যাই। যাওয়ার আগে আমার জরুরী কাগজপত্র হিরণের বাসায় রেখে যাই। বিদায় বেলায় হিরণের হাত ধরে বলি, আমায় ক্ষমা করিস বন্ধু। তোদের মতো আমি দেশের জন্য কিছু করতে পারছি না। আমার মায়ের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাকে বাড়ি যেতে হবে। হিরণ আমার পিছু পিছু দু’তলা থেকে গেইট পর্যন্ত নেমে আসে। আমাকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে বুকে টানে। কষ্টে বুক ফেঁটে চুরমার হয়ে যাচ্ছিল। সে আরো চেপে ধরে আমাকে। দু’জোড়া চোখ ছলছল করছে। আমার কেন জানি মনেহচ্ছে, এ জীবনে আর আমাদের দেখা হবে না। এ যেন সাময়িক বিদায় নয়, চিরবিদায়।

এবার একটু থামলেন নজরুল সাহেব। সামনের দিকে বিড়বিড় করে থাকালেন। যেন হিরণকেই খুঁজছেন তিনি। দর্শকরা শান্ত হয়ে বসে আছেন। পুরো হলরুম নীরব, নিস্তব্ধ, নিস্প্রাণ। একটু আগে যেন ঝড়োবাতাস বয়ে গেছে এখানে। ছোটবেলায় দাদু যখন কেচ্ছাকাহিনী বলতেন, তখন একটু পরপর বলতাম, তারপর কী হইছে দাদু? কিন্তু এখানে এমন হচ্ছে না। সবাই একাগ্রচিত্তে, ধৈর্য্য নিয়ে শুনছেন এই কাহিনী।
আবার শুরু করেন নজরুল সাহেব।

একটা সময় দেশ স্বাধীন হয়। এই নয় মাস কারো সাথে যোগাযোগ নেই আমার। সিলেটে এসে নতুন এক মেসে উঠি। পরদিনই হিরণের বাসায় যাই। বাসায় তালা ঝুলছে। বন্ধুদের কাছে যোগাযোগের চেষ্টা করি। এ-বাসা ও-বাসায় খোঁজ নেই। কেউ হিরণদের খোঁজ দিতে পারে না। আমার পা চলেনা। হৃদয় খাঁ খাঁ করে। রাতে ঘুম হয়না। হিরণের মুখ ভেসে উঠে স্বপ্নে। অনেক বন্ধুর সাথে দেখা হয়, কিন্তু কেউ হিরণের খবর দিতে পারে না। এভাবেই চলছিল দিন।

জানালার পাশের আমড়া গাছটায় প্রচুর মুকুল এসেছে এবার। এতদিন চোখে পড়েনি। সকালের এক পশলা বৃষ্টিতে সবুজ পাতাগুলো আরো যেন চিকচিক করছে। বাইরে শিশুদের কোলাহল কানে আসায় সেই ছোটবেলায় ফিরে যাচ্ছিলাম যেন। কি এক ভাবনা নিয়ে শুয়ে আছি বিছানায়। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিব, ইচ্ছে করছে না। আবার কড়া নাড়ার শব্দ। রাগে গিয়ে দরজাটা খুললাম। শাড়ি পড়া এক মহিলা। মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিলাম এবার। একি ! অলি! আমার পা জোড়া কাঁপছে। হৃদয়টা পুড়ে যাচ্ছে কেন ? এ কি আমার বন্ধু হিরণের প্রিয় অলি। যাকে সে দুষ্টুমি করে বলত, রাঙ্গাঅলি। আজ এমন দেখাচ্ছে কেন ? ঝরে পড়া শুকনো পাতার মতো ধূসর, প্রাণহীন। আমি কাঁপাকাঁপা সুরে বলি, অলি, তুমি !
: হ্যাঁ নজরুল ভাই, আমি।
: আমি সাতপাঁচ না ভেবেই বলি, হিরণ কোথায় ?
চেয়ারে চুপমেরে বসে পড়ে সে। কোন কথা নেই। দৃষ্টি যেন জানালার পাশের আমড়ামুকুল ছাড়িয়ে দিগন্তের শেষ সীমানা প্রাচীর স্পর্শ করেছে। খেয়াল করলাম চোখ জোড়ায় টলটল করছে বেদনার জল। অলি শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছার চেষ্ট করলো কয়েকবার। এবার বলতে লাগলো..

যুদ্ধ শুরু হলে হিরণদের বাসা রেইড দেয় আর্মিরা। হিরণ তখন বাসার উপর তলায় ছিল। আর্মিরা দরজা ভেঙ্গে ওদের বাসার ভিতর ঢুকে পড়ে। হিরণের মা-বাবা-বোনকে টেনে হিচড়ে এক সাথে জড়ো করে নিচ তলায়। হিরণের খোঁজে দু’জন আর্মি উপরে উঠতে থাকে। বন্দুকের বাট দিয়ে পেটাতে পেটাতে হিরণকে নিচে নিয়ে আসে ঘাতকরা। হিরণের চোখের সামনে তাঁর মা-বাবা-বোনকে গুলি করে হিরণকে সাথে করে নিয়ে নেয় তারা। তখন বাড়ীর কাজের বুয়া আড়ালে থেকে সবকিছুর সাক্ষী হয়।

: হিরণ, হিরণের কি হলো। আমি ওর কথার পিঠে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেই।
: হিরণকে আর পাওয়া যায়নি নজরুল ভাই। আমরা অনেক খুঁজেছি। যেখানেই লাশের খবর পেয়েছি সেখানেই ছুটে গিয়েছি আমি। উন্মাদের মতো হেঁটেছি শহরের অলিতেগলিতে। কিন্তু তাকে পাইনি আমরা। আমি আমার ভালবাসার মানুষটিকে হারিয়ে ফেলেছি নজরুল ভাই। হারিয়ে ফেলেছি।
ঢুঁকরে কেঁদে উঠে অলি। আমি শূন্য দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে থাকি। কী শুনছি এসব!

নজরুল ভাই, একটা কথা রাখবেন। এই খামে আমার আর হিরণের কিছু ভালবাসার স্মৃতি আছে। স্মৃতিগুলো আমাকে কাঁদায়, সারাক্ষণ কাঁদায়। এইগুলো আপনার কাছে রাখবেন প্লীজ। আমি জানি, এগুলো আমার কাছে যে যত্নে,ভালবাসায়, মমতায় থাকার কথা, আপনার কাছে সে রকমই থাকবে। আমার বাসা থেকে আমাকে বিয়ের প্রেসার দেয়া হচ্ছে। হয়তো আমার অমতেই একদিন বিয়ে হয়ে যাবে। কার কাছে যাবো, কোথায় থাকবো তাও ঠিক নেই। তাই এই স্মৃতিগুলো আপনার কাছেই রেখে যাচ্ছি।

কেমন জানি একটা ঘোরের মধ্যে আমাকে রেখে অলি চলে যায়। আমি ওর পিছুপিছু দরজা পর্যন্ত এগিয়ে আসি। আমার পা আর চলছে না। দরজা বন্ধ করে তাড়াতাড়ি খামটা হাতে নেই। তাড়াহুড়ো করে খুলতে গিয়ে খাম থেকে কয়েকটা ছবি ফ্লোরে পড়ে যায়। এগুলো তুলতে গিয়ে খাম থেকে সবগুলো ছবি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ফ্লোরে। আমি একটা একটা করে ছবিগুলো দেখি। আমার বন্ধু হিরণের ছবি। এই হিরণ আর নেই! আমার বন্ধু হিরণ আর নেই! বিশ্বাস হচ্ছে না। কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। অহ গড, কি করেছো তুমি। আমি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলি। মনে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে একাকী ফ্লোরের মাঝে শুয়ে থাকি অনেক্ষণ। অনন্তকাল এভাবেই শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে আমার। হায় খোদা, মানুষের রঙ্গিন স্বপ্নগুলো কেন এভাবে ধূসর হয় ?

হলরুমে নিরবতা নেমে আসে। নজরুল সাহেব পকেট থেকে রুমালটা বের করে চোখ মুছেন। একটু সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন তিনি। কথা বলতে বলতে কখন যে একটু কাঁত হয়ে গেছেন খেয়াল করেন নি। একজন এক গ্লাস পানি নিয়ে তাঁর দিকে এগুতেই মাথা নাড়িয়ে বাঁধা দিলেন। এবার মাইক্রোফোনে মুখ এগিয়ে বললেন- সুধী দর্শক, আমার গল্পটা শেষ হয়নি এখনো।

আমার পাশের রুমে যে ছেলেটা থাকতো, তাঁর নাম নিহার। শহরে এ-বাসা ও-বাসায় টিউশন করে। প্রায়সময়ই এসে গল্প করতো একটা বাসায় নাকি এক মহিলা আছেন যিনি সারাক্ষণ বাসার করিডোরে উদাসী মনে হেঁটে বেড়ান। জানালার কাছে অপলক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকেন। চেহারাতে স্পষ্ট কষ্টের ছাপ।
তারপর দিন যায়,আসে নতুন সূর্য্য। আমরা ব্যস্ততার অজুহাতে আপনের স্মৃতি, বিস্মৃতির এ্যালবামে জড়ো করি। কিন্তু নিহার আমাকে ভূলতে দেয় না। সে ঐ বাড়ির নাম না জানা মহিলার সংবাদ নিয়ে আসে। মন খারাপের সুরে একদিন আমাকে বলে- ভাই, আমি যে মহিলার কথা আপনাকে বলেছি তিনি আজ আত্মহত্যা করেছেন। আমি চমকে উঠে বলি- তাই নাকি! কেন রে, কি জন্য মারা গেল ? নাম কি তাঁর ?
: উনার নাম তো জানি না ভাই।

পরের দিন স্নিগ্ধ সকালে সোনালী সূর্য্য উঠার ক্ষানিক পরে দু’টাকার পত্রিকায় শ’খানেক খবরের ভীড়ে যা আমাকে বিধ্বস্ত করে, স্মৃতির অতলে ডুবিয়ে দেয়, তা অলি সেনগুপ্তা’র মৃত্যু সংবাদ।

তাদের স্মৃতিগুলো আমি পরম মমতায়, ভালবাসায়, দায়িত্ববোধ থেকে যত্নসহকারে রেখে দিয়েছি। এই স্মৃতিটুকু আমার কাছে মহামূল্যবান। এই যে আমার এত এত সম্পত্তি, টাকা পয়সা, সবকিছুই এগুলোর কাছে অতি নগন্য। মানুষ তার অর্জিত সম্পদ সারাজীবন আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে পারে না, কিন্তু স্মৃতিচিহ্ন বুকে ধারণ করে অনন্তকাল কাটিয়ে দিতে পারে। স্মৃতি শাশ্বত, অমর। আমি এই স্মৃতিগুলোর জন্য আমার কলেজ জীবনে ফিরে যেতে পারি। এগুলো শুধু ছবিই নয়, এগুলো আমার বেঁচে থাকার প্রেরণা। এই স্মৃতিগুলো হাতড়ে নিয়ে আমি একবার হাসি তো একবার কাঁদি। আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম, সবকিছুর বিনিময়ে আগলে রাখবো। জানিনা কতটুকু পেরেছি। আমার সম্পদ আমাকে জাগতিক ভোগবিলাসে মত্ত রাখে কিন্তু এই ছবিগুলো আমাকে আত্মশুদ্ধিতে সাহায্য করে। ওদের দু’জনের জীবন থেকেই আমি অনুভব করি, জীবন আসলেই কী !

যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মা হারনোর, বাবা হারানোর, ভাই-বোন হারানোর গল্প শুনেছি আমরা। কিন্তু কারো প্রেমিক, কারো প্রেমিকা, কারো বন্ধু-বান্ধবী হারানোর গল্প কখনো শুনিনি। অলি-হিরণের মতো কতশত যুবক-যুবতীর স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হয়ে গেছে, তাদের খবর কে রাখে বলেন। আমি এই এ্যালবামে অলি-হিরণের সবগুলো ছবি যত্নকরে রেখে দিয়েছি। এটা আপনাদের দিয়ে দেয়ার কথা থাকলেও আপাতত দিচ্ছি না। আমি যখন এই মায়ার পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবো, তখন আপনাদের কাছে রেখে দিবেন। তবে আপনারা আমাকে কথা দেন, এ্যালবামটা পরম মমতায়, শ্রদ্ধায়, আপনাদের কাছে রাখবেন।

নজরুল সাহেব কথা শেষ করে মঞ্চ থেকে নেমে সবার কাছ থেকে বিদায় নেন। বাইরে তাঁর গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টির জন্য গাড়িতে উঠতে পারছেন না। ড্রাইভার দৌড়ে একটা ছাতা নিয়ে আসলো। গাড়িটা চলে গেল বৃষ্টিকে মাড়িয়ে। পেছনে শতশত দর্শক বৃষ্টির দিকে অপলক তাঁকিয়ে বুকের গোমটবাঁধা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একটু হালকা হলো সবাই।






মন্তব্য ১৪ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (১৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে জুন, ২০১৬ রাত ৯:২১

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: হুসসসসসসস।
মন খারাপ হয়ে যায় ভাবলে এসব, পড়লে এসব।
গল্পে নতুনত্ব নেই তবে কেন জানি ভাল লেগে গেল, ইদানিং আনকোড়া কিছুই শুধু ভাল লাগে। হয়ো একাত্তরের কথা বলেছেন বলেই কাজ করেছে এই ভাললাগাটা

২৫ শে জুন, ২০১৬ সকাল ১১:২১

পার্থ তালুকদার বলেছেন: প্রাণখোলা মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ রাখালরাজা ভাই। :)

২| ২৪ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৩:০৯

সুমন কর বলেছেন: গল্পে ভালো লাগা রইলো।

২৫ শে জুন, ২০১৬ সকাল ১১:২২

পার্থ তালুকদার বলেছেন: ধন্যবাদ দাদা।

৩| ২৪ শে জুন, ২০১৬ বিকাল ৫:৫৪

অশ্রুকারিগর বলেছেন: পুরো গল্পটা মনযোগ দিয়ে পড়লে সবারই বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসবে। মন খারাপ করা গল্পে ভালো লাগা।

২৫ শে জুন, ২০১৬ সকাল ১১:২৩

পার্থ তালুকদার বলেছেন: সময় নিয়ে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ প্রিয় ব্লগার।

৪| ২৫ শে জুন, ২০১৬ সকাল ৯:১৯

হাসান মাহবুব বলেছেন: ভীষণ ট্রাজিক ঘটনা।

২৫ শে জুন, ২০১৬ সকাল ১১:২৫

পার্থ তালুকদার বলেছেন: আমার পরিচিত একজনের জীবনে ঘটে যাওয়া করুণ গল্প।
ধন্যবাদ হাসান ভাই।

৫| ২৫ শে জুন, ২০১৬ সকাল ১১:৩৮

সায়ান তানভি বলেছেন: ভালো লিখেছেন :)

২৫ শে জুন, ২০১৬ রাত ৯:৪৬

পার্থ তালুকদার বলেছেন: ধন্যবাদ প্রিয় ব্লগার।

৬| ২৫ শে জুন, ২০১৬ রাত ৮:০০

মাহমুদ০০৭ বলেছেন: ভালো লাগল পার্থ ভাই । মন খারাপ করা গল্প

২৫ শে জুন, ২০১৬ রাত ৯:৪৯

পার্থ তালুকদার বলেছেন: মন খারাপ করা সত্য কাহিনী ।

৭| ২৬ শে জুন, ২০১৬ সকাল ৯:৪৪

আবুহেনা মোঃ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন: কষ্ট পেলাম। লেখার গুনে গল্পটি পাঠক আকর্ষণের ক্ষমতা রাখে।

ধন্যবাদ ভাই পার্থ তালুকদার।

২৬ শে জুন, ২০১৬ দুপুর ২:৩৪

পার্থ তালুকদার বলেছেন: ধন্যবাদ আবুহেনা ভাই।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.