নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

.

ইতিহাসের পাতিহাঁস

ইতিহাসের পাতিহাঁস › বিস্তারিত পোস্টঃ

ডেস্টিনি ডিসরাপ্টেড- মুসলিম দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্ব ইতিহাস (০০৯)

২০ শে মে, ২০১৮ ভোর ৫:০৬

খিলাফত এর জন্ম (১)
১১-২৪ হিঃ (৬৩২-৬৪৪ খৃস্টাব্দ)

মুসলমানরা মোহাম্মদ (সঃ) এর সম্পূর্ণ জীবনকাল থেকেই ধর্মীয় শিক্ষা নিয়ে থাকেন। তবে মহানবীর মৃত্যুর সাথে সাথেই ধর্মীয় তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাবলী শেষ হয়ে যায়নি। তাঁর প্রথম চার উত্তরাধিকারীদের জীবনকালেও এটা বহমান থাকে। আবু বকর, ওমর, উসমান, আলী (র)- এই চারজন ‘রাশিদুন’ (সঠিক পথে চালিত ব্যাক্তিবর্গ) হিসাবে পরিচিত। পর্বত গুহায় প্রথম ওহী অবতীর্ণ হওয়ার সময় থেকে শুরু করে চল্লিশ বছর পরে চতুর্থ খলিফার মৃত্যু পর্যন্ত এই পুরো সময়ের ঘটনাবলীই ইসলামের মূল ধর্মীয় কাহিনীর অন্তর্ভুক্ত।

ইসলামের যখন আবির্ভাব হয় মানব সভ্যতা ততদিনে খুব ভালভাবেই লেখালেখির যুগে প্রবেশ করেছিল। মানুষ তখন ডায়েরি, চিঠি, প্রশাসনিক কাগজপত্র এবং অন্যান্য লেখাজোখা করত। এই সময়ের একটি সমৃদ্ধ দালিলিক রেকর্ড বিদ্যমান। অতএব এটা মনে হতে পারেই যে ইসলামের উদ্ভবের সময়টি কিংবদন্তি না হয়ে সম্পূর্ণ ভাবে সাংবাদিকতার এখতিয়ারে থাকা উচিত। অথচ আমরা এই প্রথম চার খলিফার জীবন ও শাসনকাল সম্পর্কে যা জানি তার অধিকাংশই এসেছে তাঁদের মৃত্যুর কয়েক দশক পরে ইবনে ইসহাক-এর লেখা ইতিহাস থেকে, যিনি ১৫১ হিজরিতে (৭৬৮ খ্রিস্টাব্দ) মারা যান।

ইবনে ইসহাক মৌখিক ইতিহাসবিদদের এক দীর্ঘ পরম্পরা থেকে এসেছেন। এঁরা ছিলেন সেইসব নারী ও পুরুষ যাদের কাজই ছিল ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য ঘটনা জোগাড় করা, মনে রাখা এবং অন্যদেরকে তা বলা। এঁদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই পুরো ইতিহাসটাকে লিখিত রূপ দেন। কিন্তু তাঁর মূল বইটির অধিকাংশই একসময় হারিয়ে যায়। তবে হারিয়ে যাওয়ার আগেই অন্যান্য লেখকেরা তাঁর বইটি থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন, এর রেফারেন্স দিয়েছেন, এর উপর আলোচনা করেছেন এবং এর সারমর্ম লিখেছেন বা নিজের মতো করে পুনর্লিখন ও করেছেন।

ইবনে জারীর আল-তাবারি ছিলেন এমন একজন ইতিহাসবেত্তা যিনি তাঁর তথ্যের প্রধান উৎস হিসেবে নিয়েছিলেন ইবনে ইসহাক-এর কাজকে। আল-তাবারি প্রায় তিন শত হিজরীতে মারা যান। তিনি ৩৯ খণ্ডের ‘নবী-রসূল ও সম্রাটদের কাহিনী’ (তারিখ আল রসুল ওয়াল মুলুক) নামে একটি বই লিখেন যার কাহিনী শুরু করেন আদম (আঃ) থেকে আর শেষ করেন ২৯২ হিজরিতে (৯১৫ খ্রিস্টাব্দ)। তাঁর এই লিখনি আজকের দিন পর্যন্ত টিকে আছে। যে সকল ছোটখাটো ডিটেইল আমরা মোহাম্মদ (সঃ) এবং তাঁর উত্তরাধিকারীদের সম্পর্কে আজকে পড়ি সেসব এই আল-তাবারি’র লেখার মাধ্যমেই আমাদের সময় পর্যন্ত পৌঁছেছে। তিনিই আমাদেরকে জানিয়েছেন সেই ঐতিহাসিক চরিত্রদের কি রঙের চুল ছিল, কি তাদের প্রিয় খাদ্য ছিল, তারা কয়টি উটের মালিক ছিলেন- এরকম নানান খুঁটিনাটি ব্যাপার। তিনি তাদের গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা ও কথোপকথনগুলোকে সরাসরি উদ্ধৃতির মতো করে তুলে ধরেছেন। তার লিখা ইতিহাসটি অবশ্য খুব একটা সুপাঠ্য কিছু না। কারণ প্রতিটি কাহিনির শুরুতে তিনি বিশাল লম্বা তালিকা দিয়ে দিয়েছিলেন, কে কার কাছ থেকে সেই কাহিনী শুনেছিল, যেমন- ‘ক’ ‘খ’-এর কাছ থেকে শুনেছেন যে ‘গ’ ‘ঘ’ এর কাছ থেকে শুনেছেন... এভাবে একদম মূল ঘটনা পর্যন্ত। এই পুরো তালিকা দেয়ার পর একদম শেষে কাহিনীটা লিখেছেন। এভাবে দেয়া ঘটনার রেফারেন্সকে বলা হয় ‘ইসনাদ’। তিনি একটি ঘটনার শুধু একটি করে ইসনাদ দিয়েই ক্ষান্ত হননি। একই কাহিনির ভিন্ন ভিন্ন ইসনাদ এবং ভিন্ন ভিন্ন সংস্করন একটির পর একটি লিখেছেন। বিভিন্ন ভার্শন এর মধ্যে কোনটি সত্য বা অধিকতর গ্রহণযোগ্য সে ব্যাপারে তিনি অবশ্য কোন মতামত লিখেন নি, সেই দায়িত্ব তিনি পাঠকের উপরই ছেড়ে দিয়েছেন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অন্যান্য লেখকেরাও নিজেদের মতো করে এই কাহিনীগুলো লিখেছেন। এর মধ্যে কিছু কিছু কাহিনী মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়, যেগুলো বাচ্চাকালে আমরা শুনতে পেতাম বাড়িতে গুরুজনদের কাছে বা স্কুলে ধর্ম শিক্ষকদের মুখে।

{অনুবাদকের নোটঃ তাবারি নিজেই তাঁর বইয়ের ভুমিকায় লিখেছেন, যে তিনি যা যা শুনেছেন তাই লিখেছেন, এর মধ্যে কিছু বর্ণনা অসত্য হওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং তিনি যাচাই বাছাই করেন নি। এখানে আলোচনা দেখতে পারেন । এ কারনে তাবারি এবং ইসহাকের রচিত সিরাতে কিছু আপত্তিকর জিনিস পাওয়া যায়। বিশেষত ইহুদী ও মোনাফেকরা নবীজি সম্পর্কে অনেক অসত্য এবং সত্যের সাথে মিথ্যা মিশিয়ে অর্ধসত্য কাহিনী প্রচার করেছিল, এখনও চেষ্টা করে। তাই সিরাত যেই লিখুক না কেন তা যদি কোরানের এবং সহি হাদিসের সাথে খাপ না খায় তবে তাতে সমস্যা আছে। কেউ কেউ বলছেন মুহাদ্দিস রা হাদিস যাচাই বাছাইয়ে যেই কঠোর মান নিয়ন্ত্রনের চেষ্টা করেছেন, অনেক সিরাত রচয়িতা ততটা করেন নি।}

ইসলামের ইতিহাসের এই কাহিনীগুলো নবীজির মৃত্যুর পরের ২৯ বছরের এক উথাল পাথাল মানবীয় নাটকীয়তাবহুল সময়কে ফুটিয়ে তোলে। এই কাহিনিতে আমরা পাই অতিমানবীয় চরিত্রদেরকে, এপিক সব ঘটনার মাঝে। এই গল্পের পরতে পরতে বিষ্ময় যেমন আছে তেমনি আছে হৃদয়ভাঙ্গা বেদনা । এই গল্প বলতে গিয়ে পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে যাওয়া খুবই সম্ভব, কারণ নেয়ার মতো অনেকগুলো পক্ষই এতে আছে। এই কাহিনির বিভিন্ন চরিত্রের উদ্দেশ্য নিয়ে জল্পনা কল্পনা করা এবং তাঁদের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলাটাও খুবই সম্ভব।

অন্যদিকে, এই কাহিনীগুলো মেটাফরিক স্ট্যাটাস অর্জন করেছে। পরবর্তীকালে ইসলামের মধ্যে বিভিন্ন মতবাদ (doctrine) এবং ধর্মীয় অবস্থানকে (theological position) সাপোর্ট করার জন্য ঐ সময়কার বিভিন্ন সিদ্ধান্ত এবং ইন্টারপ্রিটেশনকে রেফারেন্স হিসাবে অবলম্বন করা হয়েছে। এইসব কাহিনীগুলোর ঠিক কোন ভার্সনটা যে সঠিক তা আমরা একেবারে নিশ্চিত করে বলতে পারব না, কারন আমাদের কাছে যা আছে তা একটা কাহিনীর কাহিনীর কাহিনী। এটা একটা ছাকুনির মতো যা কিনা বিস্তারিত ঘটনাটা থেকে পৌরাণিক উপাদানটাকে তুলে এনেছে আমাদের সামনে। তো এই হলো সেই উত্তরাধিকারের গল্প।

প্রথম খলিফা (১২-১৪ হিঃ)

যেই মুহূর্তে মোহাম্মদ (সঃ) মারা যান, মুসলিম সম্প্রদায় এক কঠিন সমস্যায় পড়ল। সেই মুহূর্তের প্রশ্নটা শুধু এই ছিল না যে ‘কে’ আমাদের পরবর্তী নেতা? প্রশ্ন ছিল- আমাদের পরবর্তী নেতা আসলে ‘কি’। তিনি কি শুধুই একজন ধর্মীয় নেতা নাকি শুধুই একজন শাসক বা রাজনৈতিক নেতা? যখন একজন সেইন্ট (ঋষি/সাধু/সন্ত) মারা যান তাঁর জায়গায় ভক্তরা সাথে সাথে অন্য আরেকজন সেইন্টকে বসিয়ে দিতে পারে না। কারণ এরকম ব্যাক্তিত্ব তো ভোট দিয়ে বা সিলেকশন করে তৈরি করা যায় না। তাঁদের আবির্ভাব হয়, যখন হওয়ার তখন। যতক্ষণ আরেকজন সেইন্ট এর আবির্ভাব না হয়, ভক্তরা হয়তো নিরাশায় ভোগে, কিন্তু তাদের জীবন এর জন্য থেমে থাকে না। কিন্তু একজন সম্রাট যখন মারা যান তখন সেই শূন্যস্থান সাথে সাথেই পূরণ করতে হয়।

যখন নবী মোহাম্মদ (সঃ) মারা যান, এটা শুধু মাত্র একজন ধর্মীয় নেতার প্রস্থানই ছিল না, একই সাথে এটা একজন শাসকের মৃত্যুও ছিল বটে। তাঁর শূন্যস্থান অপূরণীয় ছিল, কিন্তু রাজনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করলে কাউকে না কাউকে তার জায়গা নিতে হতো। কারণ একজন নেতা ছাড়া উম্মাহ টিকে থাকতে পারত না।

নতুন সেই নেতাকে একজন রাজার চেয়ে অনেক বেশী কিছু হতে হত। কারণ এটা অন্য আর দশটা সম্প্রদায়ের মত ছিল না। এই সম্প্রদায়টির সদস্যরা বিশ্বাস করতেন যে তাঁরা ছিলেন কিতাবের বিমূর্ত ধারক এবং প্রতীক, তাঁদের অস্তিত্ব ছিল আল্লাহর ইচ্ছায় আর তাঁদের কাজ ছিল পৃথিবীকে আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী বদলে দেয়া। এই বিশেষ সম্প্রদায়টির নেতার শুধু বীরত্ব, বুদ্ধি, সাহস ইত্যাদি গুণাবলী থাকাটাই যথেষ্ট ছিল না, তাঁর কিছু বিশেষ ধর্মীয় অনুগ্রহ বা ক্ষমতাও থাকতে হতো। কিন্তু মোহাম্মদ (সঃ) এর উত্তরাধিকারী তো আল্লাহর দ্বারা পথ প্রদর্শিত কোনও নবী হবেন না, কারণ মোহাম্মদ (সঃ) নিজেই বলে গেছেন তাঁর পর আর কোন নবী আসবেন না। তো সেই নেতা রাজাও হবেন না, নবীও হবেন না- হবেন টা ঠিক কি রকম?

মুসলিম সম্প্রদায় এই প্রশ্নটি নিয়ে মোহাম্মদ (সঃ) এর জীবনকালেও চিন্তা করেনি আর তার মৃত্যুর ঠিক পরের সময়টাও এইরকম গভীর দার্শনিক আলোচনার জন্য সঠিক সময় ছিল না। মহানবীর দাফন তখনও হয়নি এরকম সময় আবু বকর (র) আশঙ্কাজনক খবর শুনতে পেলেন: মদীনার কিছু লোকাল মুসলমান (আনসার) নিজেদের একজন নেতা নির্বাচিত করতে মিটিং ডেকেছেন। ব্যাপারটা যেন এমন যে তাঁরা এবং মক্কা থেকে হিজরত করে আসা মুসলিমরা (মুহাজির) ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ। এটা যদি ঘটতো তাহলে এখানেই হতে পারত উম্মাহর পতনের সূচনা!

আবু বকর (র) মোহাম্মদ এর ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সাহাবীকে নিয়ে সেই সভায় উপস্থিত হলেন। তিনি তাদেরকে মিনতি করে বল্লেন যে মুসলিমদের সমগ্র সম্প্রদায়ের জন্য একজনই নেতা নির্বাচন করা উচিত, শাসক হিসাবে নয়, ধর্মীয় গুরু হিসাবেও নয়- শুধুমাত্র মিটিং ডাকা ও পরিচালনা করা, বিভিন্ন বিষয়ে মধ্যস্ততা করা এবং মোটের উপর উম্মাহ-কে এক সাথে ধরে রাখার জন্য। তিনি ওমর (র) এবং মহানবীর আরেকজন ঘনিষ্ট সাহাবীকে দেখিয়ে সমবেত লোকদেরকে বললেন 'এই দুইজনের একজনকে বেছে নাও'।

ওমর নিজে অবশ্য আবু বকরের উপরে নিজের অবস্থান চিন্তাও করতে পারেন নি । তিনি আবু বকর এর হাত জড়িয়ে ধরলেন এবং সমবেত সাহাবীদেরকে বললেন যে মহানবীর অবর্তমানে নেতৃত্ব দেয়া শুধু আবু বকরকেই মানায়। অশ্রুসিক্ত নয়নে তিনি মোহাম্মদ (সঃ) এর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু আবু বকর এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেন। এই আবেগপূর্ণ দৃশ্য দেখে সবার কাছে হঠাৎ করেই যেন মনে হতে লাগলো যে আসলেই তো, আবু বকর-ই তো সুস্পষ্ট এবং একমাত্র যোগ্য ব্যাক্তি- এরকম বিচক্ষণ, প্রীতিজনক এক মানুষ যিনি তার সারাটা জীবনই প্রজ্ঞা,সাহস এবং সহমর্মিতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে ছিলেন। সেই মিটিং এ সবাই সর্বসম্মতিক্রমে আবু বকরকে খলিফা উপাধিতে ভূষিত করলেন। খলিফা শব্দটির ইংরেজি অর্থ হল ‘ডেপুটি’।

আবু বকর গ্রহণ করার আগে এই খলিফা উপাধিটির কোনও অস্তিত্ব ছিল না। অন্য কোনও উপজাতি বা জাতির খলিফা পদধারি কোন নেতা তখন ছিল না। খলিফার দায়িত্ব, কর্তব্য বা ক্ষমতা কি সেটা কেউই তাই জানত না। প্রথম পদাধিকারী হিসাবে আবু বকর-কে ই এই ডিটেইলস গুলো ঠিক করে নিতে হলো।

শুরুর পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আগের পর্ব এখানে

[তামিম আনসারী’র Destiny Disrupted: A History of the World Through Islamic Eyes বইয়ের অনুবাদ।
https://www.goodreads.com/book/show/6240926-destiny-disrupted
https://www.amazon.com এ প্রিভিউ এবং রিভিউ দেখতে।]

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.