নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অমরত্বের প্রত্যাশাহীন এই শহরে থেকে যাক কিছু খুচরো কথা...

পদ্মপুকুর

একজন শভেনিস্ট ও স্মৃতিকাতর মানুষ

পদ্মপুকুর › বিস্তারিত পোস্টঃ

ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ দুপুর বেলার অক্ত...

২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১০:২৪

ইউটিউব প্রতিষ্ঠার সাথে বাংলাদেশি বংশদ্ভূত জার্মান-আমেরিকান জাওয়াদ করিম জড়িত ছিলেন। ইউটিউবে আপলোড করা প্রথম ভিডিওটাও জাওয়াদেরই। অন্যদিকে ফেইসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মহাত্মাদের মধ্যে কোন বাংলাদেশি ছিলেননা, ছিলেন এক নিরেট আমেরিকান মার্ক জুকারবার্গ আর তার চার স্যাঙাৎ। তবুও যেন মনে হচ্ছে, আমেরিকান এই পঞ্চপাণ্ডব ফেইসবুক নির্মাণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো বুঝতে পেরেছিলেন বাংলাদেশীদেরকে। আর তাই শুরু হওয়ার মাত্র ১৪ বছর পর ঢাকা এখন ফেইসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে দ্বিতীয়। প্রথম হওয়ার সম্ভাবনাও নাকচ করা যাচ্ছে না। অতিমাত্রায় প্রদর্শনপ্রিয় বাংলাদেশিরা ফেইসবুককে আপন করবে সবচেয়ে বেশি, এটাই হওয়ার ছিল। জাতি হিসেবে আমাদের এই ‘দেখানো’ স্বভাব আমাদের জাতীয় বোধগুলোকেই নষ্ট করে ফেলেছে সম্পূর্ণভাবে।

যে মাসে আমাদের কোনো চেতনার দিন থাকে, সে মাসগুলোতে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব হতাশ হয়ে যাই। এই যেমন একুশে ফেব্রুয়ারি। যদিও আবেগের আতিশয্যে আমরা বলি যে বিশ্বে একমাত্র আমরাই ভাষার দাবিতে আন্দোলন সংগ্রাম করেছি, জীবন দিয়েছি, বাস্তবতা হলো, আমাদের পার্শ্ববর্তী আসামের মত আরো অনেল জাতিই একই সংগ্রাম করেছে। সেটা অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু রক্তাক্ত আন্দোলনের মাধ্যমে ভাষার অধিকার ছিনিয়ে আনার পর আমাদের ভাষাপ্রেম হওয়ার কথা ছিল হিমালয়ের মত উঁচু আর দৃঢ়। কিন্তু আজ কি হচ্ছে! একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আমাদের জীবনে স্রেফ শো-অফের একটা উপলক্ষ হয়ে দাড়িয়েছে। এই চান্সে আমাদের আদিখ্যেতাকে উস্কে দিয়ে অতি লোভি ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ব্যবসা করে যাচ্ছে। সবকিছুর পেছনেই এখন ব্যবসা। এখানে কোন চেতনা নেই, নেই কোন আবেগ।

ক্যাম্পাসে থাকাকালীন সময়ে রোভারিং করার সূত্রে কয়েকবার একুশে ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রীয় শহীদমিনারে দায়িত্বপালনের সুযোগ হয়েছিল। সেই সময়েও দেখেছি, শহীদমিনারে আসার পেছনে যে ‘চেতনা’ তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি সার্থকতা ছিলো টিভি ক্যামেরায় মুখ দেখানোতে। ভাষাপ্রেম, সে সময়ের আত্মৎসর্গকারীদের প্রতি ভালোবাসা, কোনকিছুই ছিলনা সেখানে। লাভের মধ্যে লাভ ছিল- সারারাত একসাথে ঘনিষ্ঠভাবে ডিউটি করার পর প্রায় প্রতি একুশে ফেব্রুয়ারির পরই নতুন নতুন প্রেমিক-প্রেমিকার জুটি তৈরী হতো।

গেল সপ্তাহে যশোর থেকে চিত্রা এক্সপ্রেসযোগে ঢাকা আসছিলাম। ৮ সিটের কেবিনে দুই বাচ্চাসহ এক ফ্যামিলিও ছিল। ছোট মেয়েটি কোন এক ইংরেজি স্কুলে স্ট্যান্ডার্ড টুতে পড়ে। খুব দ্রুতই ওর সাথে সখ্যতা হয়ে গেল। যারা ট্রেনে যশোর- ঢাকা জার্নি করেছেন, তারা জানেন, এই রুটের ট্রেনে এত বেশি সময় লাগে যে এক পর্যায়ে এসে বিরক্তিকর লাগতে বাধ্য, সে আপনি সিটে বসে আসেন বা কেবিনে শুয়েই আসেন না কেন।

এই বাচ্চাটাও একসময় বিরক্তির চরম সীমায় এসে গেল এবং অদ্ভূত বিষয় হল এই, তখন সে এতক্ষণের বাংলা বাদ দিয়ে একেবারে চোস্ত হিন্দিতে বাতচিত করা শুরু করলো। আমি খুব একটা অবাক হইনি। সাধারণত মানুষ মাতাল হলে তার মনের গহীনে থাকা কথাগুলো বেরিয়ে আসে। একইভাবে মানুষ যখন রেগে যায়, তখনও তার চেপে রাখা কথাগুলো বেরিয়ে আসে। এই মেয়েটির ক্ষেত্রে শেষেরটিই ঘটেছে। সে রেগে গেছে এবং তার মনের ভেতরের ভাব বেরিয়ে এসেছে।

এই চিত্র এখন এমন পর্যায়ে গেছে যে, এটাকে উদাহরণ হিসেবে আনাই বোকামী। ফেইসবুকে বাংলাদেশীদের স্ট্যাটাসগুলো ফলো করুন, দেখবেন একটা বড় অংশ হিন্দিতে স্ট্যাটাস দিচ্ছে। উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের আড্ডায় হিন্দি ঢুকে পড়েছে। আর ইংরেজিতে বলতে পারাটাতো আত্মশ্লাঘার বিষয়। লোকাল বাসের মধ্যে বা চলতি পথে দেখবেন ঝগড়াঝাটির একপর্যায়ে কেউ একজন বলে বসছে- হু আর ইউ, ডু ইউ নো মি? এই কথার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত থাকে, আমি বাপু ইংরেজি বলিয়ে, তোমার থেকে উঁচুতলার, আমার সাথে তর্ক করার তুই কে হে ইডিয়ট.. ..

বিদেশি ভাষা বলতে পেরে জাতে ওঠার এই ধারা অবশ্য নতুন নয়। সেই সতেরো শতকেই কবি আব্দুল হাকিম লিখেছিলেন-
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।

এই অবস্থা তখনও ছিল, কিন্তু তা ছিল জাতে ওঠার প্রচেষ্টা, আর এখন এই বাচ্চার মত কমবয়েসীরা হিন্দি বলছে মন থেকে, অবলীলায়।

বলা হয়, কবি লেখকরা ত্রিকালদর্শী। ছিয়াশি বা সাতাশি সালের দিকে জাতীয় যাদুঘরে এক অনুষ্ঠানে এই লেখার শিরোনামটি যাঁর কবিতা থেকে নেওয়া, সেই প্রিয় কবি আল মাহমুদ বলেছিলেন ‘নিকট ভবিষ্যতে ঢাকা হবে বাংলাভাষার রাজধানী”.. .. এই মহান কবির সৌভাগ্য (!) এই যে উনি এখন বেঁচে থাকলেও যদ্দুর জানি দৃষ্টিশক্তিহীন হয়ে পড়েছেন, বয়সজনিত কারণে শ্রবণশক্তিও খুবই ক্ষীণ, যে কারণে বাংলাভাষার ভবিষ্যৎ রাজধানী ও দেশের অধীবাসীদের বাংলা ভাষাপ্রেম দেখতে বা শুনতে পান না। না হলে নির্ঘাৎ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরাপারে পাড়ি জমাতেন বহু আগেই।

যদ্দুর জানি, পঞ্চাশের দশকে এক সময় আরবী হরফে বাংলা লেখার প্রচলনেরও একটা দুরভিসন্ধি চলেছিল, যেটা ড. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহসহ ভাষাবিদদের তুমুল বিরোধিতার মুখে বাতিল হয়ে যায়। অথচ আজ আমরা সেই চেতনাটুকুও বিসর্জন দিয়ে কি সুন্দর ইংরেজি অক্ষরে বাংলা লিখছি।

সুতপা বন্দ্যোপধ্যায়ের কন্ঠে ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের একটা আবৃত্তি শুনেছিলাম। আজকের লেখার সাথে খুব যায়। উনারা দু’জনই ওপার বাংলার মানুষ। বিশাল ভারতবর্ষে দাপুটে হিন্দির চাপে ওখানে বাংলার দশা চিড়ে চ্যাপ্টা হওয়া সম্ভব। কলকাতায় গিয়ে দেখেছিও, শহর কলকাতায় মানুষ হিন্দিতেই সড়গড় বেশি। সে ওরা যা ইচ্ছে হোক গিয়ে। কিন্তু আমরা কেন? আমরা না ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি?

সরকারি এক অফিস পিয়ন আব্দুস সালাম, সদ্য পিতা হওয়া আব্দুল জব্বার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবুল বরকত, কোর্টের কেরাণি শফিউর এবং জগন্নাথ কলেজের মেধাবী ছাত্র রফিকউদ্দিন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি থেকে এসেছিলেন, নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন-বাঙালি কখনোই বেনিয়া ভাষা মেনে নেবে না। অথচ আজ সেই তাঁদেরই উত্তরসূরীরা এখন বিনা প্রশ্নে নিজের স্বকীয়তা বিলিয়ে দিয়ে জাতে উঠছে।

একদা আমাদের শিল্পীরা গেয়েছিলেন রক্ত উত্তাল করা গান, কবিরা লিখেছিলেন সংগ্রামী কবিতা। তেমনি, কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ লিখেছিলেন এক অনবদ্য কবিতা-
কুমড়ো ফুলে ফুলে
নুয়ে পরেছে লতাটা, সজনে ডাঁটায় ভরে গেছে গাছটা,
আর আমি ডালের বড়ি শুকিয়ে রেখেছি।
খোকা তুই কবে আসবি ?
কবে ছুটি?”
চিঠিটা তার পকেটে ছিল ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা।
“মাগো, ওরা বলে সবার কথা কেড়ে নেবে।
তোমার কোলে শুয়ে গল্প শুনতে দেবে না।
বলো, মা, তাই কি হয়?
তাইতো আমার দেরি হচ্ছে।
তোমার জন্যে কথার ঝুরি নিয়ে তবেই না বাড়ি ফিরবো।
লক্ষী মা, রাগ করো না, মাত্রতো আর ক’টা দিন।”
“পাগল ছেলে,” মা পড়ে আর হাসে,
“তোর ওপরে রাগ করতে পারি !”
নারিকেলের চিড়ে কোটে,
উরকি ধানের মুড়কি ভাজে,
এটা-সেটা আর কত কী
তার খোকা বাড়ি ফিরবে ক্লান্ত খোকা।
কুমড়ো ফুল শুকিয়ে গেছে,
ঝরে পরেছে ডাঁটা,
পুঁই লতাটা নেতানো
“খোকা এলি ?”
ঝাপসা চোখে মা তাকায়
উঠানে উঠানে
যেখানে খোকার শব শকুনীরা ব্যবচ্ছেদ করে।
এখন মা’র চোখে চৈত্রের রোদ পুড়িয়ে দেয় শকুনীদের।
তারপর দাওয়ায় বসে মা আবার ধান ভানে,
বিন্নি ধানের খই ভাজে,
খোকা তার কখন আসে কখন আসে!
এখন মা’র চোখে শিশির-
ভোর স্নেহের রোদে ভিটে ভ’রেছে।


আমরা এ সবই ভুলে গেছি। আমাদের ভাষা আমাদের কাছে ব্যাকডেটেড। তাঁকে আপডেটেড করার কোন সামাজিক উদ্যোগ নেই, নেই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ। পাড়ায় পাড়ায়, স্কুলে স্কুলে তাই বাড়ছে শহীদ মিনার, অথচ ছেলে মেয়েরা মনের ভাব প্রকাশে বেছে নিচ্ছে হিন্দি আর ইংরেজিকে।

আগামীকালও এক একুশ ফেব্রুয়ারি। মনচোখে দেখতে পাচ্ছি, আজিজ মার্কেট আর শাহবাগ মোড়ের ফুলের দোকানগুলোতে এতক্ষণে হুলুস্থুল বিকিকিনি শুরু হয়ে গেছে। তারপর দলে দলে, জোড়ায় জোড়ায় সাদা-কালো পোশাকে, বাংলাকে ভালোবাসি লেখা টি শার্ট পরে ফুল নিয়ে যাবে শহীদমিনারে দিতে। তারপর একগোছা সেলফি তুলে ফেইসবুকে আপলোড দিয়ে লিখবে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভূলিতে পারি..’ নিচে কেউ একজন কমেন্ট দিবে, ‘আমিন না বলে যাবেন না...’ অগত্যা বাংলা প্রেম এখানেই সমাপ্ত হবে।

কিন্তু কোন এক অদ্ভুত কারণে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ওই মায়ের মত আমারও চোখে শিশির এসে ভরে দেয়। আর তাই চেতনার দিনগুলোতে আমি খুব বিষণ্নতায় ভুগি।

ছবিসূত্র: ইন্টানেট

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১০:৫৫

রাজীব নুর বলেছেন: আমি আজ একুশে ফেব্রুয়ারী নিয়ে আজ একটি কবিতা লিখব।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.