নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে ঘুরে বেড়াই।

মোঃ রাফিদ

বই পড়তে আর গান শুনতে ভালোবাসি

মোঃ রাফিদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ফেলে আসা ছেলেবেলা

১১ ই জুন, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:৫২


আচ্ছা, সময়টা এত স্বার্থপর কেন? সুন্দর শৈশব-কৈশর জীবনটাকে পিছে ফেলে সে একাই যৌবন, প্রৌঢত্ব এবং বার্ধক্যের স্টেশনগুলাকে অতিক্রম করে জীবনের রহস্যময় শেষ গন্তব্যে চলে যেতে চায়, এ যেন এক বিরতিহীন রেলগাড়ি। কেন এরকম?
.
যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাই, এই এতটুকু এতটুকু বাচ্চাগুলোকে দেখে ভাবি, ইশ! আমিও না এরকম ছিলাম একসময়। বাবা-মা’র সাথে মার্কেটে গেলে যদি হঠাৎ করে খেলনার দোকানের বাহারি মডেলের ছোট ছোট গাড়িগুলো দেখেছি কিংবা বন্দুকগুলো, ওমনি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে দিতাম কিনে দেয়ার জন্য। হয়তো বাবা-মা’র এ মুহূর্তে সামর্থ্য নেই। মাসের শেষ; কত ধার-দেনা বাকি আছে, বাসায় বাজার নেই, দু’দিন পর্যন্ত চলবে, কিন্তু তারপর? তাই কত কি অজুহাত দিয়ে আমাদের ভুলিয়ে রাখতে হতো। বলতেন, পরীক্ষায় ফার্স্ট হ, তারপর কিনে দেব। তখন বুঝতাম না, কিন্তু আজ বুঝি। এ যে কঠিন বাস্তবতা! আর যখন পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে বলতাম, কই, এখন তো কিনে দাও। তখন, বাবা-মা’কে বাধ্য হয়ে কিনে দিতেই হতো। সেই মুহূর্তে তাঁদের মুখে একটা মিষ্টি হাসি উঁকি দিতো আর মনে দেখা দিতো এক ঝলক আশার আলো, এই ভেবে যে, নাহ! আমার ছেলেটা মস্ত বড় মানুষ হবে একদিন ঠিকই, ইনশাল্লাহ।
.
ঈদের সময় হলে নতুন কাপড় কেনার ধুম পরে যেত। বাবা আমার ওই চাই, মা আমার সেটা চাই; কত না বাহানা। না কিনে দিলে কেঁদে ভাসাতাম। তাই ঈদের বোনাসটা পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বাবা-মা শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবী আরও কত কি কিনে দিতেন। আমাদের কিনে দিতে গিয়ে নিজেরাই যে আর কিছু কিনতে পারতেন না, সে বিষয়টা কি আর আমরা তখন বুঝতাম? আমাদের কেনা-কাটা শেষে বাসায় ফিরে আমরা যখন নিজেদের নতুন ড্রেসগুলো মনের আনন্দে পরে পরে আয়নায় নিজেদের দেখতাম আর ভাবতাম, এগুলা এখন স্বযত্নে তুলে রাখতে হবে, কাওকে দেখতে দেওয়া যাবে না। দেখতে দিলেই আমার কাপড়টা আর নতুন থাকবে না। তখন মা হয়তো নিম্নস্বরে বাবাকে বলতো, তুমি নিজের জন্য কিছুই তো কিনলে না। সব তো ছেলে-মেয়েদেরই কিনে দিলে। আর বাবা তখন মুচকি হেসে বলতো, আমি আর কি কিনবো? এখনও কি সে বয়স আছে যে নতুন কাপড়-চোপড় পরে ঘুরবো? আর আমার শার্ট-প্যান্ট আছেই তো, সেগুলাই একটু ভাল করে ধুয়েটুয়ে পরিষ্কার করে নতুনের মত চকচকে করে দিও, তাতেই হয়ে যাবে আমার। একদম ফকফকা নতুন কাপড়। তারপর ঈদের দিন! মাঠে নামাজ পরতে যাওয়ার এ এক অনাবিল আনন্দ ছিল। বাবা’র, মামার কিংবা চাচার হাতটা ধরে ঈদের নামাজ পরতে যাওয়া গুটিগুটি পায়ে, নতুন পাঞ্জাবীটা গায়ে দিয়ে, সেই অনুভূতিগুলো বলবার নয়। আগের রাত থেকেই উত্তেজনায় ঘুম আসতো না চোখে। নামাজ শেষে বাবা,মামা, চাচার কাছে বেলুন, টমটম গাড়ি কিনতে চাওয়ার বায়না ধরা; দিনগুলোর কথা চিন্তা করলেই মনটা নাড়া দিয়ে ওঠে এক বিষন্নতায়। কারন, আজ অনেক বড় হয়ে গিয়েছি। সেসব বায়না আর করা সম্ভব হয়ে ওঠে না এখন। ঈদের নামাজের পর বাসায় এসে একে একে সব আত্মীয়-স্বজনকে সালাম করা আর তাঁদের খুশি হয়ে দেয়া সেই ১০/২০-৫০টাকা, ১০০ টাকার নোটগুলো পেলে নিজেকে বেশ বড় মানুষ বড় মানুষ মনে হতো। মনে হতো, যা ইচ্ছা তাই কিনে ফেলতে পারবো এখন, আমার খেলনাগুলা কিনতে আর কেও বাধা দিতে পারবে না, কারন এগুলা আমার টাকা। কিন্তু দিন শেষে সেগুলা মা’র হাতেই তুলে দিতাম, কারন জানতাম, মা’ই আমাদের একমাত্র নিরাপদ ব্যাংক।
.
একটা সময় শৈশব থেকে কৈশরে পা দিলাম। জীবনের কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সান্নিধ্য পেলাম যারা আমাকে জীবনটাকে নতুনভাবে দেখতে শিখিয়েছে। সেই কোচিং শেষে ডিসি’র মাঠে ক্রিকেট খেলা, জিলা স্কুলের পেছনে বালুর মাঠে ক্রিকেট, জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলা। একদিন তুমুল ঝড়ের মধ্যে জিলা স্কুল মাঠে ফুটবল খেলা শেষে ভিজে চপচপে শরীর নিয়ে বাসায় এসে বাসায় ঢুকতে না দেওয়ায় বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা, মায়ের বকুনি, সব কিছুই আজ কেমন যেন হারিয়ে গিয়েছে কাল-গহ্বরে। কোচিং শেষে হাসপাতাল রোডে সাইকেল স্টান্ট প্র্যাক্টিস করার ঘটনাগুলোও ভুলবার নয়।
.
কৈশর জীবনটায় রঙিন একটা সময় অতিবাহিত হয় প্রতিটা মানুষেরই। সেই রঙিন আভা প্রত্যেকের চোখে এসে ঝলকানি দেয়। প্রতিদিন ভোর ৬টার প্রাইভেট শেষ করে সকাল ৭টায় গার্লস স্কুলের কাছে দুরুদুরু বুক নিয়ে তার জন্য দাঁড়িয়ে থাকা, রিকশায় করে যাবে সে, একটা বার দেখবার আশা মাত্র। কখনও বা দেখতে পেতাম, আবার কখনও বা না। আবার সেই বিকেলে তার প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার রাস্তায় বন্ধুদের নিয়ে অপেক্ষা করা, আহ! আরেকবার তাকে দেখবো-এই আশায় সেই প্রতীক্ষার ক্ষণগুলো কতই না মধুর ছিল। আজ সব হারিয়ে গিয়েছে, সব। কে কোথায়, কারও কোন খোঁজ নেই।
.
আজ বন্ধুরা একেক জন দেশের একেক প্রান্তে, একেক ইউনিভার্সিটিতে। কেও আছে সিলেটে, কেও রাজশাহী, কেও খুলনা, কেও ময়মনসিংহ আর কেও বা আমার মত ঢাকায়। কিভাবে যে স্কুলের গন্ডিটা পেরিয়ে কলেজের উঠোনটুকুও পেরিয়ে গেল, টেরই পেলাম না। সময় এত দ্রুত চলে যায়! হায়! এখন এতটাই ব্যস্ততা আমাদের ঘিরে ধরেছে যে, মাত্র বছরে দু-তিনবার ছুটিতে এসে যখন দেখা হয় নিজেদের মধ্যে, তখন তাদের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত যেন অমূল্য সোনালী-ক্ষণ বলে মনে হয়। নিজেকে আবার যেন সেই কৈশরত্বে ফিরে পাই।
.
মাঝে মধ্যে ভাবি এটা কেমন বাস্তবতা? চলছে, চলছে তো চলছেই। পেছনে ফিরে তাকানোর নেই। কেবল স্বার্থপরের মত একা একাই এগিয়ে যায় বয়স-ক্ষণ-কাল ভেদ করে। বাবাদের চুল পেকে যাচ্ছে, মায়েদের চুলের অধিকাংশ কোণায় পাক ধরে গিয়েছে ইতোমধ্যে, আমাদের বয়স একবিংশের কোঠা ছাড়িয়ে গিয়েছে কবেই। মনে হয়, এই তো সেদিন বাচ্চাটি ছিলাম, আর আজ বয়স বাড়ার সাথে সাথে দায়িত্ববোধ সামনে এসে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে সারিবদ্ধভাবে, একের পর এক। নিজের জন্য নয়, এখন ভাবতে হয় পরিবারের জন্য, বাবা-মা’র জন্য, ঘনিষ্ঠ কিছু আত্মীয় স্বজনদের জন্য।
.
ছোট থাকতে চিন্তা করতাম, বড় হই না কেন? ইশ! বড়রা কত স্বাধীন। কি সুন্দর ইচ্ছে মত ঘুরে বেড়ায়। আর আজ বড় হয়ে ভাবি, আহ! সেই মধুর ছেলেবেলার সময়গুলো, আবার যদি ফিরে পেতাম!

বড় হয়ে স্বাধীনতা পেয়েছি ঠিকই, কিন্তু বিধি-নিষেধের, বাস্তবতার নির্মম কষাঘাতের আর দায়িত্ববোধের শেকল আমাদের পায়ে পরে গিয়েছে। এর থেকে কি সেই ছেলেবেলার পরাধীনতাই মধুর ছিল না? যা ইচ্ছা তাই করতে পারতাম, কেও কিচ্ছু মনে করতো না। দুষ্টামি করলেও সবাই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতো। আর আজ, প্রতিটা পদক্ষেপ ফেলতে হয় প্ল্যান করে যদি কোথাও ফাঁদ থেকে থাকে, প্রতিটা কথা বলতে হয় ভেবে-চিন্তে, কতই না ছল-চাতুরী করে সত্য-মিথ্যে অভিনয় চালাতে হয়, পাছে কেও যেন অসন্তুষ্ট না হয়ে যায়। এ অভিনয় নাটক-সিনেমার অভিনয়গুলোকেও যেন হার মানিয়ে দেয়। আজ কোন একটা কাজ করতে গেলে এতই ভেবে-চিন্তে করতে হয় যে, কাঁধের দুই ফেরেশতা কেরামান-কাতেবীনের চেয়ে আশপাশের মানুষকে বেশি জবাব-দিহিতা করতে হয়। ভার্সিটিতে কেন চান্স পেলে না, ইঞ্জিনিয়ারিং পরেও এখনও বেকার কেন, পিওর সাব্জেক্ট পরে তো কিছুই করতে পারছো না, জব না পেলে কি চলবে—নানান প্রশ্নের বুলেটে জর্জরিত হতে হয়। আর সব কিছু মুখ বুজে সয়ে যেতে হয় কেবল কালের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে আর মহান আল্লাহ’র উপর বিশ্বাস রেখে। মাত্র কয়েকবছর পরেই বাবা রিটায়ার্ড করলে কিভাবে ফ্যামিলি চলবে, এখনও নিজের পড়াশুনাটা শেষ করে উঠতে পারছি না, এম.এস.সি টা আর মনে হয় করা হবে না, পরিবারের হাল ধরতে হবে তো, এসব দুশ্চিন্তাতে আর চাকরীর খোঁজে হন্নে হয়ে ঢাকার রাস্তায় দৌঁড়োতে দৌঁড়োতেই আমাদের মত মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেদের যৌবনকালটাও যে কিভাবে সমাপ্তির কোঠায় এসে দাঁড়িয়ে যায়, সে খেয়াল আর থাকে না।
.
প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ার ইচ্ছা না থাকলেও বাধ্য হয়ে আমাদের মত অনেক মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেদের পড়তে হয়, একটু নিশ্চিন্ত ক্যারিয়ারের আশায়; কি আর করার, দেশটাই যে অন্যরকম। আর এ নিয়েও কত জনে কত মিষ্টি কথার তীব্র বিষাক্ত বিধিয়ে দিয়ে যায়। ইচ্ছে করে কি কেও মরুভূমির পথ বেছে নেয়? এটা তো আর কেও বোঝে না। কত্ত কিছু মুখ বুজে সয়ে যেতে শিখে গিয়েছি আমরা, কতোই না বড় হয়ে গিয়েছি। কত বন্ধু কত জায়গায় ঘুরাঘুরি করে বেড়ায় ইচ্ছে মত, কত্ত কিছু করে বেড়াচ্ছে। আমাদের মনটাও তো চায় সেসব করতে। কিন্তু চাইলেই তা করতে পারি না, নিজেদের দমিয়ে রাখতে হয়। কি দরকার বাবা-মা’র টাকা নষ্ট করে? এমনিতেই ভার্সিটির কত খরচ। নিজের টাকায় না হয় একসময় করাই যাবে, এই সান্ত্বনাই আমাদের একমাত্র ভরসা।
.
জানি না, প্রিয় বন্ধুগুলোর সাথে আজীবন এক সাথে থাকতে পারবো কিনা। এখনই নিজদের জীবন আমাদের একেকজনকে একেক প্রান্তে নিয়ে গিয়েছে, আগামী ১০ বছরে যে কাকে কোথায় নিয়ে যাবে, আদৌ যোগাযোগ থাকবে কি থাকবে না, তার কোন গ্যারেন্টি নেই। হয়তো দেখা হবে ৫/৭ বছর পর পর, তারপর নিজেরা নিজেদের বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে আলাপ করবো, কিরে, কেমন চলছে দিন কাল তোর? কত বছর পর দেখা! বাচ্চা কয়টা হলো রে? এসব নানান প্রশ্নের পেছনে বৃদ্ধ-দৃষ্টিতে কৌতুহলী মন হাতড়ে বেড়াবে সেই ছেলেবেলাকার একসাথে কাটানো মুহূর্তগুলোর স্মৃতি। কত দুষ্টামি, মারামারি, রাগ-অভিমান, আরও কত কি? কোথায় যে সেসব হারিয়ে গেল, কেও জানে না।
.
.
এভাবেই কেটে যায় প্রতিটা মানুষের জীবন। এটাই বাস্তবতা। আর এ বাস্তবতাকে সঙ্গে নিয়েই আমাদের জীবনের অবিরাম অনন্তের দিকে পথ চলা।

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই জুন, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:৩৬

রাজীব নুর বলেছেন: ভালো ছিলো আপনার শৈশব।
আমার শৈশব তেমন ভালো ছিল না।

২| ১১ ই জুন, ২০১৯ রাত ৯:৪৫

আহমেদ জী এস বলেছেন: মোঃ রাফিদ,



নষ্টালজিক লেখা। সুন্দর ও অকপট।
মানুষের জীবনের শতসহস্র জটিলতার মাঝেও মানুষ কখনও কখনও ফিরে যায় শৈশবের কাছে। তেমন করে আপনার মতোই ফিরে যাওয়ার কথা আছে এখানে - মাঝে মাঝে ........

৩| ১২ ই জুন, ২০১৯ সকাল ১০:১৬

আর্কিওপটেরিক্স বলেছেন: সুন্দর সাবলীল লেখা....

শৈশবটা বারে বারে উঁকি দিচ্ছিল......

৪| ১২ ই জুন, ২০১৯ দুপুর ১:১০

কাজী ফাতেমা ছবি বলেছেন: সুন্দর লেখা

৫| ১২ ই জুন, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:৪৮

মেঘ প্রিয় বালক বলেছেন: শৈশবে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে যখন স্মৃতিচারণ করি। সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.