নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রায়আন৫৬৩

আবু রায়আন

ছাত্র

আবু রায়আন › বিস্তারিত পোস্টঃ

হৈমন্তী

১৯ শে আগস্ট, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:২৪



কন্যার বাপ সবুর কুরিতে পারিতেন, কিন্তু বরের বাপ সবুর করিতে চাহিলেন না। তিনি দেখিলেন, মেয়েটির বিবাহের বয়স পার হইয়া গেছে, কিন্তু আর কিছু দিন গেলে সেটাকে ভদ্র বা অভদ্র কোনো রকম চাপা দিবার সময় পার হইয়া যাইবে। মেয়ের বসয় অবৈধর রকম বাড়িয়া গেছে বটে, কিন্তু পণের টাকার আপেক্ষিক গুরুত্ব এখনও তাহার চেয়ে কিঞ্চিৎ উপরে আছে, সেজন্যই তাড়া।

আমি ছিলাম বর। সুতরাং বিবাহ সম্পর্কে আমার মত যাচাই করা অনাবশ্যক ছিল। আমার কাজ আমি করিয়াছি, এফ.এ. পাশ করিয়া বৃত্তি পাইয়াছি। তাই প্রজাপতির দুই পক্ষ, কন্যাপক্ষ ও বরপক্ষ, ঘন ঘন বিচলিত হইয়া উঠিল।

আমাদের দেশে যে মানুষ একবার বিবাহ করিয়াছে বিবাহ সম্বান্ধে তাহার আর কোনো উদবেগ থাকে না। নরমাংসের স্বাদ পাইলে মানুষের সম্পের্কে বাঘের যে দশা হয়, স্ত্রী সম্পর্কে তাহার ভাবটা সেইরূপ হইয়া ওঠে। অবস্থা যেমনি ও বয়স যতই হউক, স্ত্রীর অভাব ঘটিবামাত্র তাহা পূরণ করিয়া লইতে তাহার কোনো দ্বিধা থাকে না। যত দ্বিধা ও দুশ্চিন্তা সে দেখি আমাতের নবীন ছাত্রদের। বিবাহের পৌঃনপুনিক প্রস্তাবে তাহাদের পিতৃপক্ষের পাঁকা চুল কলপের আর্শীবাদে পুনঃ পুনঃ কাঁচা হইয়া ওঠে, আর প্রথম ঘটকালির আঁচেই ইহাদের কাঁচা চুল ভাবনায় একরাত্রে পাকিবার উপক্রম হয়।

সত্য বলিতেছি, আমার মনে এমন বিষম উদবেগ জন্মায় নাই। বরঞ্চ বিবাহের কথায় আমার মনে মধ্যে যেন দক্ষিণা হাওয়া দিতে লাগিল। কৌতূহলী কল্পনায় কিশলায়গুরি মধ্যে একটা যেন কানাকানি পড়িয়া গেল। যাহাকে বার্কের ফ্রেঞ্চ রেভোল্যুশনের মোট পাঁচ-সাতটা খাতা মুখস্ত করিতে হইবে, তাহার পক্ষে এ ভাবনা ভাবা দোষের। আমার এ লেখা যদি টেকস্টবুক-কমিটির অনুমোদিত হইবার কোন অশংকা থাকিত তবে সাবধান হইতাম।

কিন্তু, এ কি করিতেছি! এ কি একটা গল্প যে উপন্যাস লিখিতে বসিলাম। এমন সুরে আমার লেখা শুরু হইবে এ কি আমি জানিতাম। মনে ছিল, কয় বৎসরের বেদনার যে মেঘ কালো হইয়া জমিয়া উঠিয়াছে, তাহাকে বৈশাখ সন্ধ্যার ঝোড় বৃষ্টির মত প্রবল বর্ষণে নিঃশেস করিয়া দিব। কিন্তু, না পড়িরাল বাংলায় শিশুপাঠ্য বই লিখিতে, কারণ সংস্কৃতি মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ আমার পড়া নাই; আর না পাড়িলাম কব্য রচনা করিতে, কারণ মাতৃভাষা আমার জীবনের মধ্যে এমন পুষ্পিত হইয়া উঠে নাই যাদাহে নিজের অন্তুরকে বাহিরে টানিয়া আনিতে পারি। সেজন্যই দেখিতেছি, আমার ভিতরকার শ্মশানচারী সন্ন্যাসীটা অট্রহাস্যে আপনাকে আপনি পরিহাস করিতে বাসিয়াছে। না করিয়া করিবে কি। তাহার যে অশ্রু শুকাইয়া গেছে। জৈষ্ঠ্যের খররৌদ্রই তো জৈষ্ঠ্যের অশ্রুশূন্য রোদন।

আমার সঙ্গে যাহার বিবাহ হইয়াছিল তাহার সত্য নামটা দিব না। কারণ পৃথিবীর ইতিহাসে তাহার নামটি লইয়া প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে বিবাদের কোনো আশঙ্কা নাই। যে তম্রশাসনে তাহার নাম কোদাই কার আছে সেটা আমারা হৃদয়পট। কোনকালে যে পট এবং সে নাম বিলুপ্ত হইবে, এমন কথা আমি মনে করিতে পারি না। কিন্তু, যে অমৃতলোকে তাহা অক্ষয় হইয় রহিল সেখানে ঐতিহাসিকের আনাগোনা নাই।

আমার এ লেখায় তাহার যেমন হউক একটা নাম চাই। আচ্ছা, তাহার নাম দিলাম শিশির। কেননা, শিশিরে কান্নাহাসি একেবারে এক হইয়া আছে, আর শিশিরে ভোরবেলাটুকুর কথা সকালবেয়া আসিয়া ফরাইয়া যায়।

শিশির আমার চেয়ে কেবল দু বছারের ছোট ছিল। অথচ, আমার পিতা যে গৌরীদানের পক্ষপাতী ছিলেন না তাহা নহে। তাঁহার পিতা ছিলেন উগ্রভাবে সমাজবিদ্রোহী; দেশেরপ্রচলিত ধর্মকর্মের কিছুতেই তাঁহার আস্থা ছিল না; তিনি কষিয়া ইংরেজি পড়িছিলেন। আমার পিতা উগ্রভাবে সমাজের অনুগামী; মানিতে তাঁহার বাধে এমন জিনিস আমাদের সমাজে, সদরে অন্দরে, দেউড়ি বা খিড়কির পথে খুঁজিয়া পাওয়া দায়, কারণ ইনিও কষিয়া ইংরেজি পড়িয়াছিলেন। পিতামহ ও পিতা উভয়েই মতামত বিদ্রোহের দুই বিভিন্ন মূর্তি। কোনটাই সরল স্বাভাবিক নহে। তবুও বুড়ো বয়েসের মেয়ের সঙ্গে বাবা যে আমার বিবাহ দিলেন তাহার কারণ. মেয়ের বয়স বড় বলিয়া পণের টাকাও বড়। শিশির আমার শ্বশুড়ের একমাত্র মেয়ে। বারা বিশ্বাস ছিল, কন্যার পিতার সম্ত টাকা ভাবী জামাতার ভবিষ্যের গর্ভ পূরণ করিয়া তুলিতেছে।

আমার শ্বশুড়ের বিশেষ কোনো একাটা মতেই বালাই ছিল না। তিনি পশ্চিমের এক পাহাড়েরর কোন রাজার অদীনে বড় কাজ করিতেন। শিশির যখন কোলে তাখন তার মার মৃতু্্য হয়। মেয়ে বৎসর অন্তে এক-এক বছর করিয়া বড় হইয়ছে, তাহার আমার শ্বশুড়ের চোখেই পড়ে নাই। সেকানে তাঁহার সমাজের লোক এমন কেহই ছিল না যে তাঁহাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাইয়া দিবে।

শিশিষের বয়স যথা সময়ে ষোল হইল; কিন্তু সেটা স্বভারে ষোল, সমাজের ষোল নহে। কেহ তাহাকে আপন বয়সের জন্য সর্তক হইতে পরামর্শ দেয় নাই, সেও আপন বয়সটার দিকে ফিরিয়াও তাকাইত না।

কলেজের তৃতীয় বৎসরে পা দিয়াছি, আমার বয়স উনিশ, এমন সময় আমার বিবাহ হইল। বয়সটা সমাজের মতে বা সমাজ সংস্কারকের মতে উপযুক্ত ছিল কি না তাহা লাইয়া তাহার দুই পক্ষ লড়াই করিয়া রক্তারক্তি করিয়া মরুক, কিন্তু আমি বলিতেছি, কিন্তু আমি বলিতেছি, সে বয়সটা পরীক্ষা পাশ করিবার পক্ষে যত ভাল হউক, বিবাহের সম্বন্ধ আসিবার পক্ষে কিছুমাত্র কম ভাল নয়।

বিবাহের অরুণোদয় হইল একখানি ফটোগ্রাফের আভাসে। পড়া মুখস্ত করিতেছিলাম। একজন ঠাট্টার সম্পর্কের আত্নীয়া আমার টেবিলের ওপর শিশিরে ছবখানা রাখিয়া বলিনে,"এইবার সত্যিকার পড়া পড়ো-একেবারে ঘাড়মোড় ভাঙয়া।"

কোনো একজন আনাড়ি কারিগরের তোলা ছবি। মা ছিল না, সুতরাং কেহ তাহার চুল টানিয়া বাঁধিয়া খোঁপায় জরি জরাইয়া, সাহা মল্লিক কোম্পনির জবড়জঙ জ্যাকেট পড়াইয় বর পক্ষের চোখ ভুলাইবার জন্য জালিয়াতির চেষ্টা করে নাই। ভারি একখানি সাদাসিধা মুখ, সাদাসিধা দুটি চোখ এবং সাদাসিধা একটি শাড়ি। কিন্তু, সমস্তটি লইয়া কি যে মহিমা সে আমি বলিতে পারি না। যেমন তেমন একখানি চৌকিতে বসিয়া, পিছনে একখানা ডোড়া দাগ-কাটা শতরঞ্জ ঝোলানো, পাশে একটা টিপাইয়ের উপরে ফুলদানিতে ফুলের তোড়া। আর, গালিচার উপরে শাড়ির বাঁকা পাড়টির নিচে দুখানি খালি পা।

পটের ছবির উপর আমার মনের সোনার কাঠি লাগাইতেই সে আমার জীবনের মধ্যে জাগিয়া ওঠিল। সেই কালো দুটি চোখ আমার সমস্ত ভাবনার মাঝখানে কেমন করিয়া চাহিয়া রহিল। আর, বাঁকা পাড়ের নিচেরকার দুখানি খালি পা আমার হৃদয়কে আপন পদ্মাসন করিয়া লইল।

পঞ্জিকার পাতা উল্টাতে থাকিল; দুটা-তিনটা বিবাহের লগ্ন পিছিইয়া যায়, শ্বশুড়ের ছুটি আর মেলে না। ওুদকে সামনে একটা অকাল চার-পাঁচ মাস জুড়িয়া আমার আইবড় বয়সের সীমানে উনিশ বছর হইতে অনর্থক বিশ বছরের দিকে ঠেলিয়া দিবার চক্রান্ত করিতেছে। শ্বশুড়ের এবং তাঁহার মুনিবের উপর রাগ হইতে লাগিল।

যা হউক, অকালের ঠিক পূর্ব লগ্নে আসিয়া বিবাহের দিন ঠেকিল। সেদিনকার সানাইয়ের প্রত্যেক তানটি যে আমার মনে পড়িতেছে। সেদিনকার প্রত্যেক মুহূর্তটিকে আমি আমার সমস্ত চৈতন্য দিয়া স্পর্শ করিয়াছি। আমার সেই উনিশ বছরের বয়সটি আমার জীবনে অক্ষয় হইয়া থাক।

বিবাহ সভায় চারদিকে হট্টোগোল; তাহারই মাঝখানে কন্যার কোমল হাতখানি আমার হাতেে উপর পড়িল। এমন আশ্চার্য আর কি আছে। আমর মন বার বার করিয়া বলিতে লাগিল,'আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম।' কাহাকে পাইলাম। এ যে দুর্লভ, এ যে মানবী, ইহার রহস্যের কি অন্ত আছে!

আমার শ্বশুড়েরর নাম গৌরীশংকর। যে হিমালয়ে বাস করিতেন, সেই হিমালয়েল তিনি যেন মিতা। তাঁহার গাম্ভীর্যের শিখরদেশে একটি স্থির হাস্য শুভ্র হইয়াছিল। আর, তাঁহার হৃদয়ের ভিতরটিতে স্নেহের যে একটি প্রাস্রবণ ছিল তাহার সন্ধান যাহার জানিত তাহারা তাঁহাকে ছাড়িতে চাইত না।

কর্মক্ষেত্রে ফিরিবার পূর্বে আমার শ্বশুড় আমাকে ডাকিয়া বলিলেন,"বাবা, আমার মেয়েটি আমি সতেরো বছর ধরিয়া আমি জানি, আর তোমাকে এই কটি দিন মাত্র জানিলাম, তবু তোমার হাতেই ও রহিল। যে ধন দিলাম তাহার মূল্য যেন তুমি বুঝিতে পার, ইহার বেশি আর্শীবাদ আর নাই।"

তাঁহার বেহাই বেহান সকলেই তাঁহাকে বার বার করিয়া আশ্বাস দিয়া বলিলেন,"বেহাই মনে কোন চিন্তা রাখিবেন না। তোমার মেয়েটি যেমন বাপকে ছাড়িয়া আসিয়াছে, এখানে তেমনি বাপ মা উভয়কেই পাইল।"

তাহার পরে শ্বশুড়মশায় মেয়ের কাছে বিদায় লাইবার বেলা হাসিলেন; বলিলেন,"বুড়ি চলিলাম। তোর একখানি মাত্র এই বাপ, আজ হইতে ইহার যদি কিছু খোয়া যায় বা চুরি যায় বা নষ্ট হয় আমি তাহার জন্য দায়ী নই।"

মেয়ে বলিল,"তাই বই-কি। কোথাও একটু ডদি লোকসান হঢ তোমাকে তার ক্ষতিপূরণ করিতে হইবে।"

আবশেষে নিত্য তাহার যেসব বিষয়ে বিভ্রাট ঘটে বাপকে সে সম্পন্ধে সে বারবার সর্তক করিয়া দিল। তাহার সম্বন্ধে আমার শ্বশুরের যথেষ্ট সংযম ছিল না; গুটিকয়েক অপথ্য ছিল, তাহার প্রতি তাঁহার বিশেষ আসক্তি-- বাপকে সেই সমস্ত প্রলোভন হইতে যথাসম্ভব ঠেকাইয়া রাখা মেয়ের এক কাজ ছিল। তাই সে আজ বাপের হাত ধরিয়া উদবেগের সহিত বলিল,''বাবা, তুমি আমার কথা রোখো-রাখবে?"

বাবা হাসিয়া কহিলেন,"মানুষ পণ করে পণ ভাঙিয়া ফেলিঢা হাঁফ ছাড়িবার জন্য। আতএব কথা না দেওয়াই সবচেয়ে নিরপাদ।"

তাহার পরে বাপ চলিয়া আসিলে ঘরে কপাট পড়িল। তাহার পরে কি হইল কেহ জানে না।

বাপ ও মেয়ের অশ্রুহীন বিদায় ব্যাপার পাশের ঘর হইতে কৌতূহলী অন্তঃপুরিকার দল দেখিল এবং শুনিল। অবাক কান্ড! খোট্টার দেশে থাকিয় খোট্টা হইয়া গিয়াছে। মায়া মমতা একেবারে নাই!

আমার শ্বশুড়ের বন্ধু বনমালীবাবুই আমাদের বিবাহের ঘটকালি করিয়াছিলেন। তিনি আমাদের পরিবারেরও পরিচিত। তিনি আমার শ্বশুড়কে বলিয়াছিলেন,"সংসারে তোমার তো ঐ একটি মেয়ে। এখন ইহাদের পাশে বাড়ি লইয়া এখানেই জীবনটা কাটাও।"

তিনি বলিলেন,"যাহা দিলাম তাহা উজাড় করিয়া দিরাম। এখন ফিরিয়া তাকাইতে গেলে দুঃখ পাইতে হইবে। অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রাখিতে যাইবার মতো এমন বিড়ম্বনা আর নাই।"

সব শেষে আমাকে নিভৃতে লইয়া গিয়া অপরাধীর মতো সসংকোচে বলিলেন, "আমার মেয়েটির বই পড়িবার শখ, এবং লোকজনে খাওয়াইতে ও বড় ভালোবাসে। এজন্য বেহাইকে বিরক্ত করিতে ইচ্ছা করি না। আমি মাঝে মাঝে তোমাকে টাকা পাঠাইব। তোমার বাবা জানিতে পারিলে কি রাগ করিবেন?"

প্রশ্ন শুনিয়া কিছু আশ্চর্য হইলাম। সংসারের কোন একটা দিক হইতে অর্থসমাগম হইলে বাবা রাগ করিবেন, তাঁহার মেজাজ এত খারাপ তো দেখি নাই।

যেন ঘুষ দিতেছেন এমনিভাবে আমার হাত একখানা একশো টাকার নোট গুঁজিয়া আমার শ্বশুড় দ্রুত প্রস্তান করিলেন; আমার প্রনাম লাইবার জন্য সবুর কলিনে না। পিছন হইতে দিখিতে পাইলাম পকেট হইতে রুমাল বাহির হইল।

আমি স্তব্ধ হইয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম। মনে বুঝিলাম, ইহারা অন্য জাতের মানুষ।

বন্ধুৃদের অনেকেই তো বিবাহ করিতে দেখিলাম। মন্ত্র পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্ত্রীটিকে একেবারে এক গ্রাসে গলধঃকারণ করা হয়। পাকযন্ত্রে পৌছিবার কিছুক্ষণ বাদে এই পদার্থটির নানা গুণগাণ প্রকাশ হইতে পারে এবং ক্ষণে ক্ষণে অাভ্যান্তরিক উদবেগ হইয়াও থাকে, কিন্তু রাস্তাটুকুতে কোথাও কিছুমাত্র বাধে না। আমি কিন্তু বিবাহ সভাতেই বুঝিয়াছিলাম, দানের মন্ত্রে স্ত্রীকে যতুটুকু পাওয়া যায় তাহাতে সসার চলে, কিন্তু পনেরো-আনা বাকি থাকিয়া যায়। আমার সন্দেহ হয়, অধিকাংশ লোকে স্ত্রীকে বিবাহমাত্র করে, পায় না এবং সে জানেও না যে সে পায় নাই; তাহাদের স্ত্রীর কাছে ও আমৃতু্্যকাল এ খবর ধরা পড়ে না। কিন্তু সে যে আমার সাধনার ধন ছিল; সে আমার সম্পত্তি নয় সম্পদ।

শিশর-না, এ নামটা আর ব্যাবহার করা চলিল না। একে তো এটা তাহার নাম নয়, তাহাতে এটা তাহার পরিচয়ও নহে। সে সূর্যের মত দ্রুব; সে ক্ষণজীবনী উষার বিদায়ের অশ্রুবিন্দুটি নয়। কি হইবে গোপন রাখিয়া, তাহার আসল নাম হৈমন্তী।

দেখিলাম, এই সতোরে বছরের মেয়েটির উপরে যৌবনের আলো আসিয়া পড়িয়াছে,কিন্তু এখনও কৈশোরের কোল হইতে জাগিয়া ওঠে নাই। ঠিক যেন শৈলচূড়ার বরফের উপর সকালের আলো ঠিকরিয়া পড়িতেঠে, কিন্তু বরফ এখন গলিল না। আমি জানি, কী অকলঙ্ক শুভ্র সে, কী নিবিড় পবিত্র!

আমার মনে একটা ভাবনা ছিল যে, লেখাপড়া জান বড় মেয়, কী জানি কেমন করিয়া তাহার মন পাইতে হইবে। কিন্তু অতি অল্প দিনেই দেখিলাম. মনের রাস্তার সঙ্গে বইয়ের দোকানের রাস্তার কোন জায়গায় কাটাকাটি নাই। কবে যে তাহার সাদা মনটির উপরে একটু রং ধরিল, চোখে একটু ঘোডর লাগিল, কবে তাহার সমস্ত শরীর মন যেন উৎসুক হইয়া ওঠিল, তাহা ঠিক করিয়া বলিতে পারিব না।

এ তো গেল একদিকের কথা। আবার অন্য দিকও আছে, সেটা বিস্তারিত বলিবার সময় আসিয়াছে।

রাজসংসারে আমার শ্বশুড়ের চাকরি। ব্যাঙ্কে যে তাঁহার কত টাকা জমিল সে সম্বন্ধে জনশ্রুতি নানাপ্রকার অঙ্কপাত করিয়াছে, কিন্ত কোন অঙ্কই লাখের নিচে নামে নাই। ইহার ফল হইয়াছিল এই যে, তাহার পিতার দর যেমন-যেমন বাড়িল, হৈমর আদরও তেমনি বাড়িতে লাগিল। আমাদের ঘরের কাজকর্ম রীতিপদ্ধিতি শিখিয়া লইবার জন্য সে ব্যাগ্র, কিন্তু মা তাহাকে অত্যন্ত স্নেহে কিছুতেই হাত দিতে দিলেন না। এমন কি, হৈমর সঙ্গে পাহাড় হইতে যে দাসী আসিয়াছিল যদিও তাহাকে নিজেদের ঘরে ঢুকিতে দিতেন না, তবু তাহার জাত সম্বন্ধে প্রশ্নমাত্র করিলেন না, পাছে বিশ্রী একটা উত্তর শুনিতে হয়।

এমনিভাবেই দিন চলিয়া যাইতে পারিত, কিন্তু হঠাৎ একদিন বাবার মুখ ঘোর অন্ধকার দেখা গেল। ব্যাপারখানা এই- আমার বিবাহে আমার শ্বশুড় পনেরো হাজার টাকা নগদ আর পাঁচ হাজার টাকার গহনা দিয়াছিলেন। বাবার তাঁহার এক দালাল বন্ধুর কাছে খবর পাইয়াছেন, ইহার মধ্যে পনেরো হাজার টাকাই ধার করিয়া সংগ্রহ করিতে হইয়াছে, তাহার সুদও নিত্যান্ত সামান্য নহে। লাখ টাকার গুজব তো একেবারেই ফাঁকি।

যদিও আমার শ্বশুড়েরর সম্পত্তির পরিমাণ সম্বন্ধে আমারা বাবার সঙ্গে তাঁহারা কোনদিন কোনো আলোচনাই হয় নাই, তবু বাবা জানি না কোন যুক্তিতে ঠিক করিলেন, তাঁহার বেহাই তাঁহাকে ইচ্ছাপূর্বক প্রবঞ্চনা করিয়াছেন।

তার পরে, বাবার একটা ধারণা ছিল, আমার শ্বশুড় রাজার প্রধানমন্ত্রী গোছের কিছু একটা। খবর লইয়া জানিলেন, তিনি সেখানকার শিক্ষাবিভাগের অধ্যক্ষ। বাবা বলিলেন, অর্থাৎ ইস্কুলের হেডমাস্টার-সংসারে ভদ্র পদ যতগুলো আছে তাহার মধ্যে সবচেয়ে ওঁচা। বাবার বড় আশা ছিল, শ্বশুড় আজ বাদে কাল কাজে অবসর লইবেন তাখনই আমিই রাজমন্ত্রী হইব।

এমন সময় রাস উপলক্ষে দেশের কুটুম্বরা আমাদের কলিকাতার বাড়িতে আসিয়া জমা হইলেন। কন্যাকে দেখিয়া তাঁহাদের মধ্যে একটা কানাকানি পড়িয়া গেল। কানাকানি ক্রমে অস্ফুট হইতে স্ফুট হইয়া উঠিল। দূর সম্পর্কের কোনো এক দিদিমা বলিয়া উঠিলেন, "পোড়া কপাল আমার! নাত বউ যে বয়সে আমাকেও হার মানাইল।"

আর-এক দিদিমাশ্রেণীয়া বলিলেন- "আমাদেরই যদি হার না মানাইবে তবে অপু বাহির হইতে বউ আনিতে যাইবে কেন?"

আমার মা খুব জোড়ের সঙ্গে বলিয়া উঠিলেন, "ওমা, সে কী কথা। বউমার বয়স সবে এগারো বই তো নয়, এই আসছে ফাল্গুনে বারোয় পা দিবে। খোট্টার দেশে ডালরুটি খাইয়া মানুষ, তাই অমন বড়ন্ত হইয়া উঠিয়াছে।"

দিদিমা বলিলেন, "বাছা, এখনও চোখে এত কম দেখি না। কন্যাপক্ষ নিশ্চই তোমাদের কাছে বয়স ভাঁড়াইয়াছে।

মা বলিনলন, "আমরা যে কাষ্ঠি দেখিলাম।"
কথাটা সত্য। কিন্তু কোষ্ঠিতেই প্রমাণ আছে, মেয়ের বয়ষ সতেরো।
প্রবঅণারা বলিলেন, "কোষ্ঠিতে কি আর ফাাঁকি চলে ন?"
এই লইয়া ঘোর তর্ক, এমনিকি, বিবাদ হইয়া গেল।
এমন সময় সেখানে হৈম আসিয়া উপস্থিত। কোনো একা দিদিমা জিজ্ঞাসা করিলেন, "নাতবউ, তোমার বয়স কত বলো তো?"
মা তাহাকে চোখ টিপিয়া ইশার করিলেন। হৈম তাহার অর্থ বুঝিলনা। বলিল,"সতেরো।"
মা ব্যাস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, "তুমি জান না।"
হৈম কহিল, "আমি জানি, আমার বয়স সতেরো।"
দিদিমা পরস্পরের গা-টেপাটেপি করিলেন।
বধূর নির্বূদ্ধিতায় রাগিয়া মা বলিলেন, "তুমি তো সব জান! তোমার বাবা যে বলিলেন, তোমার বয়স এগারো।" হৈম চমকিয়া কহিল, "বাবা বলিয়াছেন? কখনো না।"

মা কহিলেন, "অবাক করিল। বেহাই আমার সামনে নিজের মুখে বলিলেন, আর মেয়ে বলে 'কখনও না'।" এই বলিয়া আরো একবার চোখ টিপিলেন।
এবার হৈম ইশারার মানে বুঝিল। স্বর আরো দৃঢ় করিয়া বলিল, "বাবা এমন কথা কখনোই বলিতে পারেন না।"
মা গলা চড়াইয়া বলিলেন, "তুই আমাকে মিথ্যাবাদী বলিতে চাস?"
হৈম বলিল, "আমার বাব তো কখনোই মিথ্যা বলেন না।"

ইহার পরে মা যতই গালি দিতে লাগিলেন, কতাটার কালি ততই গড়াইয়া ছড়াইয়া চারিদেকে লেপিয়া গেল।

মার রাগ করিয়া বাবার কাছে তাঁহার বধূর মূঢ়তা এবং ততোথিক একগঁয়েমির কথা বলিয়া দিলেন। বাবা হৈমকে ডাকিয়া বলিলেন, "আইবড় মেয়ের বয়স সতেরো, এটা কি খুব একটা গৌরবের কথা, তাই ঢাক পিটাইয়া বেড়াইডতে হইবে? আমাদের এখানে এসব চলিবে না, বলিয়া রাখিতেছি।"

হায় রে, তাঁহার বৌমার প্রতি বাবার সেই মধুমাখা পঞ্চম স্বর আজ একেবারে এমন বাঝখাঁই খাদে নাবিল কেমন করিয়া।

হৈম ব্যাথিত হইয়া প্রশ্ন করিল, "কেহ যদি বয়ষ জিজ্ঞাস করে, কী বলিব?"

বাবা বলিলেন, "মিথ্যা বলিবার দরকার নাই, তুমি বলিও আমি জানি না, আমার শ্বশুড় জানেন।"

কেমন করিয়া মিথ্যা বলিতে না হয় সেই উপদেশ শুনিয়া হৈম এমন ভাবে চুপ করিয়া রহিল যে বাবা বুঝিলেন, তাঁহার সাদুপদেশটা একেবারে বাজে খরচ হইল।

হৈমর দুর্গতিতে দুঃখ প্রকাশ করিব কী, তাহার কাছে আমার মাথা হেঁট হইয়া গেল। সেদিন দেখিলাম, শরৎপ্রভাতের আকাশের মতো তাহার চোখের সেই সরল উদাস দৃষ্টিচ একটা কি সংশয়ে ম্লান হইয়া গেছে। বঅত হরিণীর মতো সে আমার মুখের দিকে চাহিল। ভাবিল, 'আমি ইহাদিগকে চিনি না।'

সেদিন একখান শৌখিন বাঁধাই করা ইংরেজি কবিতার বই তাহার জন্য কিনিয়া আনিছিলাম। বইখানি সে হাতে করিয়া রইল এবং আস্তে আস্তে কোলের উপর রাখিয়া দিল, একবার খুলিয়াও দেখিল না।

আমি তাহার হাতকানি তুলিয়া ধরিয়া বলিলাম, "হৈম, আমার উপর রাগ করিও না। আমি তোমার সত্যে কখনো আঘত করিব না, আমি যে তোমার সত্যের বাঁধনে বাঁধা।"

হৈম কিছু না বলিয়া একটু খানি হাসিল। সে হাসি বিধাতা যাহাকে দিয়াছেন তাহার কোনো কথা বলিবার দরকার নাই।

পিতার আর্থিক উন্নতির পর হইতে দেবতার অনুগ্রহকে স্থায়ী করিবার জন্য নূতন উৎসাহে আমাদের বাড়িতে পুর্জাচনা চলিতেছে। এ পর্যন্ত যে সমস্ত ক্রিয়াকর্মে বাড়ির বধূর ডাক পড়ে নাই। নূতন বধূে প্রতি একদিন পূজা সাজাইবার আদেশ হইল; সে বলিল, "মা, বলিয়া দাও কি করিতে হইবে?"

ইহাতে কাহারও মাথায় আকাশ ভাঙিয়া পড়িবার কথা নয়, কারণ সকলেরই জানা ছিল, মাতুহীন কন্যা প্রবাসে মানুষ। কিন্তু কেবলমাত্র হৈমকে লজ্জিত করাই এই আদেশের হেতু। সকলেই গালে হাত দিয়া বলিল, "ওমা, এ কি কান্ড! এ কোন নাস্তিকের ঘরের মেয়ে। এবার এ সংসার হইতে লক্ষি ছাড়িল, আর দেরি নাই।"

এই উপলক্ষে হৈমর বাপের উদ্দেশ্যে যাহা-না বলিবার তাহা বলা হইল। যখন হইতে কটু কথা হাওয়া দিয়াছে, হৈম একেবারে চুপ করিয়া সমস্ত সহ্য করিয়াছে। একদিনের জন্যও কাহারও সামনে সে চোখের জল ফেলে নাই। আজ তাহার বড় বড় দুই চোখ ভাসাইয়া দিয়া জল পড়িলে লাগিল। সে উঠিয়া দাড়াইয়া বলিল, "আপনারা জানেন- সে দেশে আমার বাবাকে সবাই ঋষি বলে?" ঋষি বলে! ভারি একটা হাসি পড়িয়া গেল। ইহার পর তাহার পিতার উল্লেখ করিতে প্রায়ই বলা হইত, তোমার ঋষিবাবা! এই মেয়েটির সকলের চেয়ে দরদের জায়গাটি যে কোথায় তাহা আমাদের সংসার বুঝিয়া লইয়াছিল।

বস্তুত, আমার শ্বশুড় ব্রাহ্মও নন, খ্রিষ্টানও নন, হয়তো বা নাস্তিকও না হইবেন। দের্বাচনার কথা কোনদিন তিনি চিন্তাও করেন নাই। মেয়েকে তিনি অনেক পড়াইয়াছেন-শুনাইয়াছেন, কিন্তু কোনো দিনের জন্য দেবতা সম্বন্ধে তিনি তাহাকে কোনো উপদেশ দেন নাই। বনমালীবাবু এ লইয়া তাঁহাকে একবার প্রশ্ন করিয়াছিলেন। তিনি বলিয়াছিলেন, "আমি যাহা বুঝি না, তাহা শিখাইতে গেলে কপটতা শিখানো হইবে।"

অন্তঃপুরে হৈমর একটি প্রকৃত ভক্ত ছিল, সে আমার ছোটবোন নারানী। বউদিদিকে ভালোবাসে বলিয়া তাহাকে অনেক গঞ্জনা সহিতে হইয়াছিল। সংসারযাত্রার হৈমর সমস্ত আপমানের পালা আমি তাহার কাছেই শুনিতে পাইতাম। একদিনের জন্যও আমি হৈমর কাছে শুনি নাই। এসব কথা সংকোচে মুখে আনিতে পারিতাম না। সে সংকোচ নিজের জন্য নহে।

হৈম তাহার বাপের কাছ হইতে যত চিঠি পাইত সমস্ত আমাতকে পড়িতে দিত। চিঠিগুলো ছোট কিন্তু রসে ভরা। সেও বাপকে যত চিঠি লিখিত সমস্ত আমাতে দেখাইত। বাপের সঙ্গে তাহার সম্বন্ধটি আমার সঙ্গে ভাগ করিয়া না লইলে তাহার দাম্পত্য যে পূর্ণ হইতে পারিত না। তাহার চিঠিতে শ্বশুড়বাড়ি সম্বন্ধে কোনো নালিশের ইশারাটুকুও ুছল না। থাকিলে বিপদ ঘটিতে পারিত। রারানীর কাছে শুনিয়াছি, শ্বশুরবাড়ির কী লেখে জানিবার জন্য মাঝে মাঝে তাহার চিঠি খোলা হইত।

চিঠির মধ্যে অপরাধের কোনো প্রমাণ না পাইয়া উপরওয়াদের মন সে শান্ত হইয়াছিল তাহা নহে। বোধ করি তাহাতে তাঁহারা আশাংঙ্গের দুঃখই পাইয়াছিলেন। বিষম বিরক্ত হইয়া তাঁহারা বলিতে লাগিলেন, "এত ঘন ঘন চিঠিই বা কিসের জন্য? বাপই যেন মব, আমরা কি কেহ নই?"

এই লইয়া অনেক অপ্রিয় কথা চলিতে লাগিল। আমি ক্ষুদ্ধ হইয় হৈমকে বলিলাম, "তোমার বাবার চিঠি আর-কাহাকেও না দিয়া আমাকেই দিয়ো। কলেজে যাইবার সময় আমি পোষ্ট করিয়া দিব।"

হৈম বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাস করিল, "কেন?"
আমি লজ্জায় তাহার উত্তর দিলাম না।

বাড়িতে এখন সকলে বলিতে আরম্ভ করিল, "এই বার অপুর মাথা খাওয়া হইল। বি.এ, ডিগ্রি শিকায় তোলা রহিল। ছেলেরই বা দোষ কি?"

সে তো বটেই। দোষ সমম্ত হৈমের। তাহার দোষ তাহার বয়স সতেরো; তাহার দোষ যে আমি তাহাকে ভালোবাসি; তাহার দোষ যে বিধাতার এই বিধি, তাই আমার হৃদয়েল রন্ধ্রে রন্ধ্রে সমসাত আকাশ আজ বাঁমি বাজাইতেছে।

বি.এ ডিগ্রি অকাতরচিত্রে আমি চুলায় দিতে পারিতাম কিন্তু গৈমর কল্যানে পন করিলাম, পাশ করিব এবং ভালো করিয়াই পাশ করিব। এ পণ রক্ষা করা আমার সে অবস্থায় যে সম্বাপর বোধ হইয়ছির তাহার দুইটি কারণ ছিল- এক তো হৈমর ভালোবাসর মধ্যে এমন একটি আকাশের বিস্তার ছিল যে, সংকীর্ণ আসক্তির মধ্যে সে মনকে জড়াইয়া রাখিত না, সেই ভালোবাসার চারদিকে বারি একটি স্বাস্থকর হাওয়া বহিত।দ্বিতীয় পরীক্ষার জন্য যে বইগুলি পড়ার প্রয়োজন ছিল হৈমর সঙ্গে মিলিয়া পড়া অসম্ভব ছিল না।

পরীক্ষায় পাশের উদযোগে কোমর বাঁধিয়া লাগিলাম। একদিন রবিবার মদ্যাহ্নে বাহিরের ঘরে বসিয়া মার্টিনোর চরিত্রতত্ত্ব বইখানির বিশষ লাইনের মধ্যপথগুলা ফাড়িয়া ফেলিয়া নীল পেন্সিলের লাঙল চালাইতেছিলাম, এমন সময় বাহিরের দিকে হঠাৎ আমার চোখ পড়িল।

আমার ঘরেরর সম্মুখে আঙিনার উত্তর দিকে অন্তুঃপুরে উঠিবার একটি সিঁড়ি। তাহারই গায়ে গায়ে মাঝে মাঝে গরাদে-দেওয়া একটা জানলা। দেখি তাহারাই একটি জানলায় হৈম চুপ করিয়া বসিয়া পশ্চিমের দিকে চাহিয়া। সেদিকে মল্লিকদের বাগানে কাঞ্চনগাছ গোলাপি ফুলে আচ্ছন্ন।

আমার বুকে ধক করিয়া একটি ধ্বাকা দিল; মনের মধ্যে একটা অনাবধানতার আবরণ ছিঁড়িয়া পড়িয়া গেল। এই নিঃশব্দ বেদনার রূপটি আমি এতদিন এমন স্পষ্ট করিয়া দেখি নাই!

কিন্তু না, আমি কেবল তাহার বসিবার ভঙ্গিটুকু দেখিতে পাইতেছিলাম। কোলের উপরে একটি হাতের উপর আর একটি হাত স্থির পড়িয়া আছে, মাথাটি দেয়ালের উপরে হেলানো, খোলা চুল বাম কাঁধের উপর দিয়া বুকের ওপর ঝুলিয়া পড়িতেছে। আমার বুকের ভিতরটা হু হু করিয়া উঠিল।

আমাার নিজের জীবনটা এমনি কানায় কানায় ভরিয়াছে যে, আমি কোথাও কোন শূন্যতা লক্ণ করিতে পারি নাই। আজ হাঠাৎ আমার অত্যন্ত নিকটে অতি বৃহৎ একটা নৈরাশ্যের গহ্বর দেখিতে পাইলাম। কেমন করিয়া কি দিয়া আমি তাহা পূরণ করিব? আমাকে তো কিছু্ই ছাড়িতে হয় নাই। না আত্মীয়, না অভ্যাস, না কিছু। হৈম যে স মস্ত ফেলিয়া আমার কাছে আসিয়াছে। সেটা কতখানি তাহা আমি ভালো করিয়া ভাবি নাই। আমার সংসারে অপমানের কণ্টকশয়নে সে বসিয়া; সে শয়ন আমিও তাহার সঙে ভাগ করিয়া লইয়াছি। সেই দুঃখে হৈমর সঙ্গে আমার যোগ ছিল, তাহাতে আমাদিগে পৃথক করে নাই। কিন্তু, এই গিরিনন্দীনি সতেরো বৎসর-কাল অন্তরে বাহিরে কত বড় একটা মুক্তির মধ্যে মানুষ হইয়াছে। কী নির্মল সত্যে এবং উদার আলোকে তাহার প্রকৃতি এমন ঋজু শুভ্র ও সবল হইয়া উঠিয়াছে। তাহা হইতে হৈম যে কী রূপ নিরতিশয় ও নিষ্ঠুরূপে বিচ্ছিন্ন হইয়াছে এত দিন তাহা আমি সম্পূর্ণ অনুভব করিতে পারি নাই, কেননা সেখানে তাহার সঙ্গে আমার সমসান আসন চিল না।

হৈম যে অন্তরে মুহূর্তে মুহূর্তে মরিতেছিল। তাহাকে আমি সব দিতে পারি কিন্তু মুক্তি দিতে পারি না- তাহা আমার নিজের মধ্যে কোথায়? সেই জন্যই কলিকাতার গলিতে ঐ গারদের ফাঁক দিয়া নির্বাক আকাশের সঙ্গে তাহার নির্বাক মনের কথা হয়; এবং এক এক দিন রাত্রে হঠাৎ জাগিয়া ওঠিয়া দেখি, সে বিছানায় নাই। হাতের ওপর মাথা রাখিয়া আকাশ ভরা তারার দিকে মুখ তুলিয়া ছাদে শুইয়া আছে।

মার্টিনো পড়িয়া রহিল। ভাবতি লাগিলাম, কী করি! শিশুকাল হইতে বাবার কাছে আমার সংকোচের অন্ত ছিল না, কখনও মুখামুখি তাঁহার কাছে দরবার করিবার সাহস বা অভ্যাস আমার ছিল না। সেদিন থাকিতে পারিলাম না। লজ্জার মাথা খাইয়া তাঁহাকে বলিয়া বসিলাম, "বউয়েল শরীর ভালো নয়, তাহকে একবার বাপের কাছে পাঠাইলে হয়।"

বাবা তো একেবারে হতবুদ্ধি। মনে লেশমাত্র সন্দেহ রহিল না যে, হৈমই এইরূপ অভূতপূর্ব স্পর্ধায় আমাকে প্রবর্তিত করিয়াছে। তাখনই তিনি উঠিয়া অন্তঃপুরে গিয়া হৈমকে জিজ্ঞাস করিলেন, "বলি, বউমা,তোমার অসুখটা কিসের?" গৈম বলিল, "অসুখ তো নাই।"

বাবা ভাবিলেন, এ উত্তরটা তেজ দেখাইবার জন্য।

কিন্তু, হৈমর শরীর যে দিনে দিনে শুকাইয়া যাইতেছিল তাহা আমার প্রতিদিনের অভ্যাসবশতই বুঝি নাই। একদিন বনমালীবাবু তাহাকে দেখিয়া চমকিয়া উঠিলেন, "অ্যাঁ, এ কী! হৈম, এ কেমন চেহারা তোর! অসুখ করে নাই তো?"

হৈম কহিল, "না। "

এই ঘটনার দিনদশেক পরেই বলা না, কহা নাই, হঠাৎ আমার শ্বশুড় আসিয়া উপস্থিত। হৈমর শরীরের কথাটা নিশ্চই বনমালীবাবুই তাঁহাকে লিখিয়াছেন।

বিবাহের পর বাবার কাছে বিদায় লাইবার আপনার অশ্রু চাপিয়া নিয়াছিল। এবার মিলনের দিন বাপ যেমনি তাহার চিবুক ধরিয়া মুখটি তুলিয়া ধরিলেন অমনি হৈমর চোখের জল আর মানা মানিল না। বাপ একটি কথা বলিতে পারিলন না; জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করিলেন না, 'কেমন আছিস।' আমার শ্বশুড় তাঁহার মেয়ের মুখে এমন একটি কিছু দেখিয়াছিলেন যাহাতে তাঁহার বুক ফাটিয়া গেল।

হৈম বাবার হাত ধরিয়া শোবার ঘরে লইয়া গেল। অনেক কতা জিজ্ঞাসা করিবার আছে। তাহার বাবারও যে শরীটা ভালো দেখিতেছে না।

বাবা জিজ্ঞাস করিলেন, "বুড়ি, আমার সঙ্গ যাবি?"
হৈম কাঙালের মতো বলিয়া উঠিল, "যাব।"
বাপ বলিনে, "আচ্ছা, সব ঠিক করিতেছি।"

শ্বশুড় যদি অত্যন্ত উদবিগ্ন হইয়া না থাকিতেন তাহা হইলে এই বাড়িতে ঢুকিয়া বুঝিতে পারিতেন, এখানে তাঁহার আর সেদিন নাই। হঠাৎ তাঁহার অবির্ভাবকে উপদ্রব মনে করিয়া বাবা তো ভালো করিয়া কথাই কহিলেন না। আমার শ্বশুড়ের মনে ছিল তাঁহার বেহাই একটা তাঁহাকে আশ্বাস দিয়াছিলেন যে, য়খন তাঁহার খুশি মেয়ে বাড়ি লইয়া যাইতে পারিবেন। এ সত্যের অন্যতা হইতে পারেসে কথা তিনি মনেও আনিতে পারে নাই।

বাবা তামাক টানিতে টানিতে বলিলেন, "বেহাই, আামি তো কছিু বলিতে পারি না। একবার তাহলে বাড়ির মধ্যে-"

বাড়ির-মধ্যের উপর বরাত দেওয়ার অর্থ কী আমার জানা ছিল। বুঝিলাম, কিছু হইবে না। কিছু হইলও না। বউমার শরীর ভালো নাই! এক বড় অন্যায় অপবাদ।

শ্বশুড়মশায় স্বয়ং একজন ভালা ডাক্তার আনিয়া পরীক্ষা করাইলেন। ডাক্তার বলিলেন, "বায়ু পরিবর্তন অবশ্যক, নহিলে হঠাৎ একটা শক্ত ব্যাসো তো সকলেরই হইতে পারে।"

বাবা হসিয়া কহিলেন, "হঠাৎ একটা শক্ত ব্যামো তো সকলেই হইতে পারে। এটা কি আবার একটা কথা।"
আমার শ্বশুড় কহিলেন, "জানেন তো উনি একজন প্রসিদ্ধ ডাক্তার, উহার কথাটা কি-"
বাবা কহিলেন, "অমন ঢের ডাক্তার দেখিয়াছি। দক্ষিণার জোরে সকল পন্ডিতেরই কাছে সব বিধান মেলে এবং সকল ডাক্তারের কাছেই সব রোগের সার্টিফিকেট পাওয়া যায়।"

এই কথাটা শুনিয়া শ্বশুড় একেবারে স্বব্ধ হইয়া গেলেন। হৈম বুঝিল, তাহার বাবার প্রস্তাব অপমানের সহিত অগ্রাহ্য হইয়াছে। তাহার মন একেবারে কাঠ হইয়া গেল।

আমি আর সহিতে পারিলাম না। বাবার কাছে গিয়া বলিলাম, "হৈমকে আমি লইয়া যাইব।"
বাব গর্জিয়া উঠিলেন, "বটে রে-" ইত্যাদি ইত্যাদি।

বন্ধুরা কেহ কেহ আমাকে জিজ্ঞাস করিয়াছেন, যাহা বলিলাম তাহা করিলাম না কেন। স্ত্রঅকে লইয়া জোর করিয়া বাহির হইয়া গেলেইতো হইত। গেলাম না কেন?কেন! যদি লোক ধর্মের কাছে সত্য ধর্মকে না ঠেলিব, যদি ঘরের কাছে ঘরের মানুষকে বলি দিতে না পরিব, তবে আমার রক্তের মধ্যে বহু যোগের যে শিক্ষা তাহা কি করিতে আছে। জান তোমরা? যে দিন অযোধ্যার লোকেরা শীতাকে বিসর্জন দিবার দাবি করিয়াছিল তাহার মধ্যে আমিও যে ছিলাম। আর সে বির্সজনেসর গৌরবের কথা যুগে যুগে যাহারা গান করিয়া আসিয়াছে আমিও যে তাহাদের মধ্যে একজন। আর, আমিও সেদিন লোকরঞ্জনের জন্য স্ত্রী পরিত্যাগের গুণ বর্ণনা করিয়া মাসিক পত্রে প্রবন্ধ লিখিয়াছি। বুকের রক্ত দিয়া আমাকে যে একদিন দ্বিতীয় সীতা বির্সজনের কাহিনী লিখিতে সে কথা কে জানিত।

পিতায় কন্যায় আর একবার বিদায়ের ক্ষণ উপস্তিত হইল। এইবারেও দুজনেরই মুখে হাসি। কন্যার হাসিতে হাসিতেই র্ভৎসানা করিয়া বলিল, "বাবা, আর যদি তুমি কখনও আমাকে দেখবার জন্য এমন ছুটাছুটি করিয়া এ বাড়িতে আস তবে আম ঘরে কপাট দিব।"

বাপ হাসিতে হাসিত বলিলেন, "ফের যদি আসি, তবে সিঁধকাটি সঙ্গে করিয়া আসিব।"

ইহার পরে হৈমর মুখে তাহার চিরদিনের সেই স্নিগ্ধ হাসিটুকু আর একদিনের জন্যও দেখি নাই। তাহারও পরে কি হইল সেকথা আর বলিতে পারিব না।

শুনিতেছি মা পাত্রী সন্ধান করিতেছিন। হয়তো এক দিন অনরোধ অগ্রাহ্য করিতে পরিব না, ইহাও সম্ভব হইতে পারে। কারণ- থাক্ আর কাজ কী!

----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------


লেখক পরিচিতি:
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অতুলনীয় ও সর্বতোমুখী প্রতিভার অধিকারী। কবিতা ছাড়াও ছেটাগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, সমালোচনা, পত্রসাহিত্য, রম্যরচনা, ভ্রমণকাহিনী, সংগীত-প্রতিটি বিভাগেই রয়েছে অসামন্য প্রতিভার বিরলদৃষ্ট পরিচয়। এছাড়াও তিনি ছিলেন অনন্য চিত্রশিল্পী; সাহিত্য-পত্রিকার সম্পাদক ও দক্ষ দিক্ষা সংঘটক। 'শান্তি নিকেতন' ও 'বিশ্বভারতী' তাঁরই অবদান। মাত্র পনর বছর বয়েসে তাঁর প্রথম কাব্য 'বনফুল' প্রকাশিত হয়। আর ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বের শ্রেষ্ঠকবির মর্যদা নিয়ে তিনি এশীয়দের মধ্যে সর্বপ্রথম সাহিত্যে 'নোবেল পুরস্কার' পান। বাংলা ছোটডগল্পের পথিকৃৎ তিনি। তাঁর অসাধারণ ছোটগল্পগুলো প্রধাণত সংকলিত হয়েছে 'গল্পগুচ্ছ' গ্রন্থের চারটি খন্ডে ও 'গল্পস্বর' গ্রন্থে। 'সোনার তরী', 'চিত্র', 'বলাকা', 'মানসী', 'কল্পনা' ইত্যাদি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ সহ তাঁর অসহ্য গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে 'নৌকাডুবি', 'গোরা', 'ঘরে বাইরে', 'চার অধ্যায়', 'শেষের কবিতা', ইত্যাদি উপন্যাস; 'রক্ত করবী', 'রাজা', 'চিত্রাঙ্গদা', 'ডাকঘর', 'চিরকুমার সভা', 'বির্সজন' ইত্যাদি নাটক ও প্রহসন; 'বিচিত্র প্রবন্ধ', 'কালান্তর', 'পঞ্চভূত', 'সভ্যতার সংকট', ইত্যাদি প্রবন্ধ; 'বাংলা ভাষা পরিচয়', 'লোকসাহিত্য', 'সাহিত্য', 'ভাষা', সহিত্য ও শিক্ষা ইত্যাদি সম্পর্কিত আলোচনা প্রবন্ধ।

রবীন্দ্রনাথের জন্ম কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে। ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ ই মে, বাংলা ২৫শে বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দে এবং মৃতু্্য ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই আগস্ট বাংলা ২২শে শ্রাবণ, ১৩৮৬ বঙ্গাব্দে।

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ১৯ শে আগস্ট, ২০১৭ রাত ৮:৩৩

মৃত্তিকামানব বলেছেন: বানান ভুল লেখাটিকে দৃষ্টিকটু দেখাচ্ছে....

২২ শে আগস্ট, ২০১৭ রাত ১০:০৮

আবু রায়আন বলেছেন: বানান ভুলের জন্য আমি দু:খিত। সময়ের ব্যাবধানে বানানগুলো ঠিক করে দেওয়া হবে।

২| ১৯ শে আগস্ট, ২০১৭ রাত ১১:৫৭

মেঘের সাথী বলেছেন: অনেক বছর আবার পড়লাম। প্রিয় একটি গল্প :)

৩| ২০ শে আগস্ট, ২০১৭ রাত ১২:৪৩

কাউয়ার জাত বলেছেন: খুব ভালো একটা আকাম করেছেন। স্ক্যান করে দিলে আরো কষ্ট কম হত।

২২ শে আগস্ট, ২০১৭ রাত ১০:০৫

আবু রায়আন বলেছেন: স্কেন করে দিলে হয়তো গল্পটা আরেকবার পড়া হতো না।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.