নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কথা বলি..... বর্তমানের- কথা বলি ভবিষ্যতের.......

মাই নেম ইজ রেজাউল ইসলাম। এন্ড আই অ্যাম নট এ রাজাকার !!!

মোঃ রেজাউল ইসলাম

আমি নতুন সর্বদা----

মোঃ রেজাউল ইসলাম › বিস্তারিত পোস্টঃ

সায়ীদ স্যারের সঙ্গে জয়নাল ভাইয়ের ক্লিনিকে .... //আনিসুল হক//

০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:০১





ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল সাহেব ফোন করে বললেন, ‘আমরা জয়নাল আবেদিনের ক্লিনিক দেখতে ময়মনসিংহ যাচ্ছি। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ যাবেন। আপনিও চলেন।’

না বলার প্রশ্নই আসে না। স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আউয়াল সাহেব একজন জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কর্মসূচির একজন নিয়মিত সহযোগী। সেই সূত্রেই তাঁর সঙ্গে আলাপ। একবার-দুবার এর-ওর জন্য চিকিৎসা সহায়তা নেওয়ার জন্য তাঁর ওপরে জুলুমও করেছি। অমায়িক ভদ্রলোক। একজন সৎ ও পরিশ্রমী প্রকৌশলীও যে সফল হতে পারেন, তিনি তাঁর উদাহরণ। আমি রসিকতা করে বলি, ডাব না কাটলে কী হয়? সঠিক উত্তর: নারকেল। ইঞ্জিনিয়ার সফল হলে কী হয়? আউয়াল সাহেবের মতো সফল উদ্যোক্তা হন। আর ব্যর্থ হলে কী হয়? আমার মতো লেখক-সাংবাদিক হন।

আর সঙ্গে যাবেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার। একটা দিন আমরা তাঁর সান্নিধ্য লাভ করতে পারব।

তাঁদের দুজনের চেয়েও বড় আকর্ষণ কিন্তু জয়নাল আবেদিন। তিনি ছিলেন একজন রিকশাচালক। ময়মনসিংহের গ্রামে অভাবের সংসার ছিল তাঁর। বাবার অসুখ হলো। কাছাকাছি কোনো চিকিৎসালয় নেই। অসুস্থ বাবাকে নিয়ে ছুটছেন যুবক জয়নাল। চিকিৎসা শুরুর আগেই মারা গেলেন তাঁর বাবা। জয়নাল আবেদিন ঢাকা চলে এলেন। রিকশা চালান। রোজ রিকশা চালিয়ে কিছু টাকা জমান। দিনে দিনে কিছু টাকা সঞ্চয় হলো। ফিরে এলেন ময়মনসিংহের দুর্গম প্রত্যন্ত গ্রামটিতে। সদর উপজেলার টানহাসাদিয়া গ্রামে। গড়ে তুললেন একটা চিকিৎসাকেন্দ্র। মমতাজ হাসপাতাল।

শুধু কি চিকিৎসালয়? সঙ্গে আছে একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়। একটা নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণকেন্দ্র।

জয়নাল আবেদিনের সঙ্গে গত বছর থেকে পরিচয়। প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একটা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ উপলক্ষে। সাদা দাড়ি। মাথায় টাক। গালটা ভাঙা। শরীরটাও ধনুকের মতো গেছে বেঁকে। কিন্তু তাঁর হাসিটা মনে হয় কোটি টাকা দামের। চোখের কোণে কোথাও একটুখানি বেদনা। দেখা হলেই তিনি হাত দুটো নিজের করতলে পুরে নেন। বলেন, ‘আপনি আমার ক্লিনিক দেখতে যাবেন না?’

আমি বলি, ‘যাব যাব, জয়নাল ভাই। যেতে তো হবেই।’

এটা কিন্তু কথার কথা। যাব বলে কত জায়গায় কোনো দিনও যাওয়া হলো না। কাজেই এটা সুবর্ণ সুযোগ জয়নাল আবেদিনের গ্রামে যাওয়ার। কিছুতেই এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না।

বেশ সকাল সকাল আমরা রওনা দিলাম একটা ঝা চকচকে মাইক্রোবাসে। আজ থেকে দিন পঁচিশেক আগের কথা। আমাদের সঙ্গে আরও আছেন স্থপতি আকিল আখতার চৌধুরী। ঝিকির ঝিকির ময়মনসিং, আইতে যাইতে কত দিন। আমার ধারণা ছিল দুই থেকে তিন ঘণ্টা লাগবে। ১৩০ কিলোমিটারের বেশি পথ তো নয়। কিন্তু রাস্তার অবস্থা নাকি ভয়াবহ। তাই আমরা সিলেটের পথ ধরলাম। কিশোরগঞ্জ হয়ে যাব ময়মনসিংহ। কিন্তু পথ আর ফুরোয় না। সাড়ে সাতটায় উঠেছি গাড়িতে। সাড়ে ১২টায় পৌঁছাব আশা করি।

আবদুল আউয়াল সাহেব তাঁর মোবাইল ফোনে সিঙ্গাপুর শহরের ছবি দেখাতে লাগলেন। তিনি প্রায়ই সেখানে যান। সেখানের ইতিহাস বিষয়ে তাঁর আগ্রহ আছে। দেখালেন, মাত্র কয়েক দশক আগেও সিঙ্গাপুর ছিল একটা জেলেপল্লি। ভাঙা ঘরদোরের সামনে সিঙ্গাপুরের জেলে নাগরিকেরা বসে আছেন। বন্যা হয়েছে। সব ডুবে গেছে। সেই সিঙ্গাপুর আজ কত উন্নত। আউয়াল সাহেব বললেন, আজ থেকে পাঁচ দশক আগে সিঙ্গাপুরের কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিল, তারা নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করবে। সবাই যেন খেতে পায়, পরতে পায়, বাসস্থান পায়। এ জন্য কী করতে হবে? প্রতিটি পরিবারকে দিতে হবে কর্মসংস্থান আর বাসস্থান। এ জন্য তারা গড়ে তুলল এমপ্লয়মেন্ট ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (ইবিডি) আর হাউজিং ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (এইচডিবি)। সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইওয়ের লেখা ফ্রম থার্ড ওয়ার্ল্ড টু দ্য ফার্স্ট বইয়ে একেবারে নিঃস্ব একটা দেশ থেকে উন্নত সিঙ্গাপুরে পরিণত হওয়ার যাত্রাপথের বর্ণনা আছে।

প্রায় ছয় ঘণ্টা পরে আমরা পৌঁছালাম জয়নাল আবেদিনের ক্লিনিক থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে। এরপর আর পাকা রাস্তা নেই। আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। লুঙ্গি পরিহিত জয়নাল ভাই দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর শুভ্রতাভরা হাসিমাখা মুখখানি নিয়ে। আমি হাঁটতে শুরু করলাম। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার আর আউয়াল সাহেব উঠলেন রিকশাভ্যানে। কাদাভরা পথ। হাঁটা বেশ বিপজ্জনক। বহুদিন পরে দেখলাম মহিষের গাড়ি। বিপরীত দিক থেকে আসছে।

জয়নাল আবেদিনের ক্লিনিকে পৌঁছাতে প্রায় আধা ঘণ্টা লেগে গেল। ওপরে টিন। চারপাশে সাধ্যমতো ইটের দেয়াল। সেখানে একটা ছোট্ট ঘরে ওষুধের ডিসপেনসারি। একটা ঘরে কয়েকটা বেড। আরেক পাশে একটা পাঠশালা। অনেক বাচ্চাকাচ্চা এসেছে স্কুলে। শিক্ষকেরা পড়াচ্ছেন। তার পাশে স্কুল ও ক্লিনিকের খরচ নির্বাহ করার জন্য গরুর খামার। সামনে বেশ খানিকটা জায়গা। একটা পুকুরের মতো। সেখানে হাঁস ভাসছে। মাছের চাষ হচ্ছে। রোজ অনেক রোগী আসে এখানে চিকিৎসা নিতে। পাস করা চিকিৎসক আসেন সপ্তাহে দুই দিন। বাকি দিন পল্লি চিকিৎসকই রোগী দেখে ওষুধ দেন। ওষুধ দেওয়া হয় বিনা মূল্যে।

জয়নাল আবেদিন জানালেন, জরুরি রোগী এলে তাকে কোনো চিকিৎসকের কাছে পাঠানো হয়। কোনো চিকিৎসক নিজেও খবর পেলে চলে আসেন।

প্রতি মাসেই টাকা গুনতে হয়। প্রথম আলোয় তাঁর স্কুলের খবর প্রকাশিত হলে তিনি যে সাহায্য পান, সেই টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করা হয়েছিল। সেটা তিনি তুলে নিয়ে গেছেন। গরু কিনেছেন। সামনের ও পাশের জমি কিনেছেন। স্কুলঘরটা আরেকটু শক্তপোক্ত করা দরকার। আউয়াল সাহেব একটা ঘর তুলে দিচ্ছেন স্কুলের জমিতে।

আমি বলি, ‘জয়নাল ভাই, জমি কিনেছেন কি নিজের নামে?’

তিনি বলেন, ‘না না, সব ক্লিনিকের নামে। স্কুলের নামে। নিজের নামে কিছুই করি নাই। প্রতি মাসে কত খরচ। ১৫ লাখ টাকা থেকে মাসে কয়েক হাজার টাকা আসত। পোষাত না। এখন গরুর দুধ বিক্রি করি। জমির সবজি বিক্রি করি। ডিম বিক্রি করি। তবুও তো চলে না। স্কুলের শিক্ষকদের বেতন। কর্মচারীদের বেতন। তার ওপর রোজ দুই-তিন হাজার টাকার ওষুধ ফ্রি দিতে হয়।’

তিনি কিছু সাহায্য এদিক-ওদিক থেকে পান। প্যাসিফিক ফার্মাসিউটিক্যাল কিছু ওষুধ দেয়। জয়নাল আবেদিন চোখেমুখে অন্ধকার দেখেন।

প্রথম আলোর ময়মনসিংহ প্রতিনিধি কামরান পারভেজও এসেছেন। তিনি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের কাছে জানতে চান, কী রকম দেখলেন।

স্যারের মুখের দিকে তাকাই। স্যার কী বলবেন?

তিনি বলেন, ‘বিন্দু থেকে সিন্ধুর দিকে মানুষের অগ্রযাত্রাকেই দেখতে এসেছিলাম। জয়নাল আবেদিনের সঙ্গে ২০০৭ সাল থেকেই আমার পরিচয়। বিরামহীনভাবে তাঁর কাজ আমি দেখেছি। সামান্য সম্বল নিয়ে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন। মানুষের ইছাশক্তি যত গভীর হয়, ততই মানুষ সফলতার দিকে এগিয়ে যায়।’

কিন্তু জয়নাল আবেদিনকে কী বলব? আমার সামনে যে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ওল্ডম্যান অ্যান্ড সির দৃশ্যকল্প। বিশাল সমুদ্র। একজন বৃদ্ধ মানুষ একা একটা বিশাল মাছের সঙ্গে লড়ছেন। কিন্তু আমার কোনো বাস্তব কথা মনে পড়ছে না, যা আমি জয়নাল আবেদিনকে বলতে পারি। মাসে এক-দেড় লাখ টাকা কীভাবে আয় করতে পারবেন তিনি? এই দুর্গম গ্রামে এ তো অসম্ভব একটা কাজ।

জয়নাল আবেদিনকে সায়ীদ স্যার বলেন, ‘জয়নাল সাহেব, লেগে থাকবেন। ছাড়বেন না।’

আমি সব সময়েই স্যারের কাছে দিকনির্দেশনা পাই। এবারও বোধ হয় পেলাম। এ ম্যান ক্যান বি ডেস্ট্রয়েড বাট নট ডিফিটেড। মানুষকে ধ্বংস করা যেতে পারে, কিন্তু পরাজিত করা যাবে না।

চলে আসি আমরা পড়ন্ত বিকেলে। একই পথ ধরে। সেই হাঁটাপথ। দুধারে বর্ষাস্নাত পল্লিবাংলার বিস্তৃত শ্যামশ্রী। সাধ্যমতো মানুষের ঘরবাড়ি। সবুজ খেত। সরকারি বিদ্যালয়। খানিকটা হেঁটে এসে সেই মাইক্রোবাস।

গাড়িতে পুরোনো দিনের গান বাজে। গান শুনতে শুনতে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ জিজ্ঞেস করেন, ‘আচ্ছা বলো তো, কোন শিল্প কালোত্তীর্ণ হয়?’ স্যারের কাছেই উত্তরটা জানতে চাই আমরা। তিনি বলেন, ‘যা আমাদের স্মৃতিকে উসকে দেয়। যেমন ধরো, এই যে এই গানটা... আচ্ছা দেখো, কত গান এল-গেল, শচীন দেববর্মনের গান কেন এখনকার ছেলেমেয়েরাও শোনে?’

গাড়ি শহরের দিকে চলে আসছে। ঢাকার দিকে। মনের ভেতরে নানা রসায়ন ক্রিয়া করছে। একটা জীবন নিয়ে আমরা কী করলাম? কিছুই না। একজন রিকশা চালিয়ে তার সব সঞ্চয় দিয়ে একটা ক্লিনিক, একটা স্কুল, একটা প্রশিক্ষণকেন্দ্র চালানোর চেষ্টা করছেন। আমরা কী করলাম?

‘ও মা, অনেক তোমার খেয়েছি গো, অনেক নিয়েছি মা/ তবু জানি নে-যে কী বা তোমায় দিয়েছি মা!/ আমার জনম গেল বৃথা কাজে/ আমি কাটানু দিন ঘরের মাঝে/ তুমি বৃথা আমায় শক্তি দিলে শক্তিদাতা।’

কী রকম আত্মপর হয়ে পড়েছি আমরা! দেশে এত বড় বন্যা চলছে, এত এত মানুষ পানিবন্দী! কিন্তু নাগরিক সমাজে কি কোনো বিকার দেখতে পাচ্ছেন?

আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

সুত্রঃ প্রথম আলো

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:২৭

নুর ইসলাম রফিক বলেছেন: আমরা জীবন থেকে শিক্ষা নেইনা বলে আমাদের শিক্ষা পরিপূর্ণ হয়না।donnobad anisur rohman sir ke abong aponakeo.

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.