নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পাঠকের মুগ্ধতাই আমার লেখার প্রেরণা, সত্য প্রচার আমার লেখার উদ্দেশ্য আর মিথ্যাকে বিনাশ করে দিকেদিগন্তে সত্যের আলোকচ্ছটার বিচ্ছুরণই আমার লেখার চূড়ান্ত লক্ষ্য।

বিদ্রহীসূত

রাকীব আল হাসান, সহকারী সাহিত্য সম্পাদক, দৈনিক বজ্রশক্তি।

বিদ্রহীসূত › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলা ভাষা ও একুশে ফেব্রুয়ারি

২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ১০:১৮



পৃথিবীতে এমন অনেক জাতি আছে যারা বৈদেশিক আগ্রাসনের ফলে নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি সব হারিয়ে অন্যের ভাষা, সংস্কৃতির উপর ভর করে খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে। ঔপনিবেশিক যুগে যখন ইউরোপিয়ানরা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে শাসন, শোষণ আর আগ্রাসন চালিয়েছিল তখন অনেক জাতি নিজেদের ভাষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য সব ভুলে পুরোদস্তুর দাসে পরিণত হয়েছিল। সামরিক আগ্রাসনের ফলে জাতি বিলুপ্তির ঘটনাও আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই। কিন্তু যারা একবার জীবন দেওয়া শিখেছে তাদেরকে আর পদানত করে রাখা যায়নি। আমরা সেই গর্বিত জাতি যারা ভাষার জন্য, মাতৃভূমির জন্য, সংস্কৃতির জন্য জীবন দেওয়া শিখেছিলাম। এ কারণেই আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের স্বাধীনতা কেউ চিরতরে কেড়ে নিতে পারেনি। পৃথিবীতে ভাষার জন্য জীবন দেওয়ার গৌরবোজ্জল ইতিহাস একমাত্র বাঙালি জাতিরই রয়েছে। এদেশের সূর্যসন্তানেরা সেদিন যদি ভাষার জন্য জীবন না দিতেন তবে আমরাও হয়ত আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলতাম। কিন্তু প্রশ্ন হলো আমরা কি আমাদের মাতৃভাষার সেই গৌরবকে পূর্ণরূপে ধরে রাখতে পেরেছি নাকি কেবল দিবসের মধ্যে ভাষাশহীদদের সম্মানকে, বাংলা ভাষার গৌরবকে আবদ্ধ করে রেখেছি?

বাংলা ভাষা নিয়ে কিছু কথা:
বাংলাদেশ ও ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, অসম রাজ্যের বরাক উপত্যকা এবং আন্দামান দ্বীপপুঞ্জেও বাংলা ভাষাতে কথা বলা হয়। এই ভাষার লিপি হল বাংলা লিপি। এই অঞ্চলের প্রায় বাইশ কোটি স্থানীয় মানুষের ও পৃথিবীর মোট ৩০ কোটি মানুষের ভাষা হওয়ায়, এই ভাষা বিশ্বের সর্বাধিক প্রচলিত ভাষাগুলির মধ্যে চতুর্থ স্থান অধিকার করেছে। এছাড়াও ২০০২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওনের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আহমাদ তেজন কাব্বাহ ঐ রাষ্ট্রে উপস্থিত জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীর ৫,৩০০ বাংলাদেশী সৈনিকদের সেবার স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলা ভাষাকে সরকারী ভাষার মর্যাদা প্রদান করেন।

বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীত, এবং ভারতের জাতীয় স্তোত্র এই ভাষাতেই রচিত এবং তা থেকেই দক্ষিণ এশিয়ায় এই ভাষার গুরুত্ব বোঝা যায়। এটি বাংলাদেশের প্রধান ভাষা এবং ভারতে দ্বিতীয় সর্বাধিক প্রচলিত ভাষা। এই ভাষা বাংলার নবজাগরণের ফলে সৃষ্ট বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য নির্মাণ ও বাংলার সাংস্কৃতিক বিবিধতাকে এক সূত্রে গ্রথিত করেছে, শুধু তাই নয়, এই ভাষা বাঙালি জাতীয়তাবাদ গঠনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

১৯৫১-৫২ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব পাকিস্তানে সংগঠিত বাংলা ভাষা আন্দোলন এই ভাষার সাথে বাঙালি অস্তিত্বের যোগসূত্র স্থাপন করেছিল। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১শে ফেব্রুয়ারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদী ছাত্র ও আন্দোলনকারীরা মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলা ও লেখাপড়ার অধিকারের দাবীতে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন। মাতৃভাষার জন্য তাঁদের বলিদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

আরও একটু জেনে নেই রাষ্ট্রভাষা বাংলা সম্পর্কে:
১৭৭৮ সালে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে প্রথম মত পোষণ করেন একজন ব্রিটিশ লেখক ন্যাথিনিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড। ১৯১৮ সালে ভারতের ঐতিহ্যবাহী শান্তিনিকেতনে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ভারতের সাধারণ ভাষা কী হওয়া উচিত তা নিয়ে একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ভারতের সাধারণ ভাষা হিসেবে হিন্দিকে প্রস্তাব করা হলে সরাসরি বিরোধিতা করেন ওই সভায় অংশগ্রহণকারী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি তার বক্তব্যে বাংলাকে ভারতের সাধারণ ভাষা করার প্রস্তাব পেশ করেন। ওই সময়ে হিন্দি- প্রেমিকরা হিন্দিভাষাকে সমর্থন করে গান্ধীজীর বরাবরে একটি পত্রে লেখেন -“The only possible national language for intercourse is Hindi in India.”

এরপর ১৯২১ সালে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী লিখিত আকারে ব্রিটিশ সরকারের কাছে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার প্রস্তাব পেশ করেন। ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সম্পাদক আবুল হাশিম প্রাদেশিক কাউন্সিলের কাছে পেশকৃত খসড়া ম্যানিফেস্টোতে বাংলাকে পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। ১৯৪৭ সালের ৩০ জুন দৈনিক আজাদ পত্রিকায় পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা প্রবন্ধে আব্দুল হক বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করেন। ১৯৪৮ সালে নবগঠিত পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম বৈঠক বসে করাচিতে। বৈঠকের শুরুতেই উর্দু ও ইংরেজিকে গণপরিষদের সরকারি ভাষা বলে ঘোষণা করা হয়। গণপরিষদ সদস্য বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (কুমিল্লা) সভায় একটি মুলতবি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তাতে তিনি উর্দু-ইংরেজির সাথে বাংলাকেও গণপরিষদের সরকারি ভাষা ঘোষণার দাবি জানান। কিন্তু তখন এ প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়া হয়। পূর্ববাংলায় এর বিরুপ প্রতিক্রিয়া হয়।‘‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’’ দাবিতে ছাত্রসমাজের বৈপ্লবিক পদক্ষেপে ঢাকার রাজপথ সরগরম হয়ে ওঠে।

বঙ্গীয় সমাজে বাংলাভাষার অবস্থান নিয়ে বাঙালি মুসলমানদের আত্ম-অন্বেষায় যে ভাষা চেতনার উন্মেষ ঘটে, তারই সূত্র ধরে বিভাগোত্তর পূর্ববঙ্গের রাজধানী ঢাকায় ১৯৪৭ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে ভাষা-বিক্ষোভ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ঢাকায় এক ভাষণে ঘোষণা করেন “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা”। জিন্নাহ্’র এ বিরূপ মন্তব্যে তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে উপস্থিত ছাত্র-জনতার একাংশ। উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা - এ ধরনের একপেশে উক্তিতে আন্দোলনকারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। আন্দোলন জোরদার হতে থাকে, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যার চরম প্রকাশ ঘটে। এইদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে বেরিয়ে এলে পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়। এতে বরকত, জব্বার, আবদুস সালাম, রফিক সহ ছয়জন ছাত্র-যুবক হতাহত হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলে সমবেত হন। নানা-নির্যাতন সত্ত্বেও ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ জমাতে পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি পুনরায় রাজপথে নেমে আসে। এদিন নবাবপুর, রণখোলা ও ভিক্টোরিয়া পার্ক এলাকায় পুলিশ মিছিলে গুলিবর্ষণ করে। এ দিনে শহীদ হন শফিউর রহমান, আব্দুল আউয়াল ও অহিদুল্লাহসহ সরকারি হিসাব মতে চারজন ব্যক্তি।

১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মুসলিমলীগ হক-ভাসানী- সোহরাওয়ার্দীর মিলিত যুক্তফ্রন্টের নিকট শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয় বিপুল ভোটে। এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২৩৭ টি আসনের মাঝে ২২৩ টি আসন পায়। মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৯ টি আসন। বাংলাদেশিদের দাঁতভাঙ্গা জবাবে পূর্ব পাকিস্তানে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে মুসলিম লীগ। অনেক প্রতিবন্ধকতা পার করে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে সরকার বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি:
২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্বীকৃতি পাওয়ার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ সাধনা, সংগ্রামের ইতিহাস। কানাডা প্রবাসী বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালামের প্রতিষ্ঠিত “The mother language lover of the world” সংগঠন ১৯৮৮ সালের ২৯ মার্চ জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণার প্রস্তাব করে একটি চিঠি পাঠান। এ চিঠিতে সাত জাতি ও সাত ভাষার দশজন স্বাক্ষর করেন। এর এক বছর পর, ইউনেস্কো সদর দফতরের ভাষা বিভাগের আন্না মারিয়া রফিকুল ইসলামকে ১৯৯৯ সালের ৩ মার্চ সম্মতিসূচক চিঠি লেখেন, Regarding your request to declare the 21 February as International Mother Language day. The idea is indeed very interesting. অবশেষে Bangladesh National Commission-এর পক্ষে সচিব কফিল উদ্দিন আহমদ প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশ ইউনেস্কো জাতীয় কমিশন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অনুমতিক্রমে প্রস্তাবটি ইউনেস্কো সদর দফতরে পেশ করেন। ইউনেস্কোর ২৮ টি সদস্যরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রস্তাব লিখিতভাবে সমর্থন করে। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আর বাংলাভাষাভাষী মানুষের কাছে শোকার্ত দিন নয়। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন গোটাবিশ্বের মাতৃভাষা দিবস। রক্তের আলপনা এঁকে যে ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে আমাদের বাঙালি সন্তানরা, রাজকীয় ভাষা হিসেবে। তাঁদের আন্দোলনের সূত্র ধরেই ২১ ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তারাই আমাদের গর্বিত ধন, তারাই আমাদের মাতৃভাষার প্রতিষ্ঠাতা।

আমাদের মাতৃভাষা ও বর্তমান প্রজন্ম:
ভাষার ধর্মই হচ্ছে বদলে যাওয়া। তাই বলে শুদ্ধ বাংলা না শিখে সেই অজ্ঞতাকে আধুনিকতা বলে চালিয়ে দেওয়া একটি অপরাধ, ভাষার বিরুদ্ধে শত্রুতার নামান্তর। আশা করি ভাষাবিদেরা অতটা বিবর্তন প্রশ্রয় দিবেন না, যাতে করে পাঁচশ’ বছর পরে কোনো শিক্ষার্থী বর্তমানের কোনো সাহিত্য/রচনার অর্থ বোঝার জন্য অভিধানের সাহায্য নিয়েও কোনো দিশা খুঁজে পাবে না। যেমন চর্যাপদ পড়তে গেলে বর্তমানের কোনো অভিধানেই কুলোয় না। আধুনিক প্রজন্মের একটি বড় অংশ ‘জটিল, অস্থির, পাঙ্খা’ শব্দগুলিকে ‘চমৎকার, অপূর্ব’ অর্থে ব্যবহার করছে, যার অর্থ অভিধান থেকে আবিষ্কার করা সম্ভব নয়। এমন স্বেচ্ছাচারিতার অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যায়। ভাষা বদলাবেই কিন্তু এ বদলে যাওয়া হবে প্রকৃতির মত স্বাভাবিক।

আমাদের পূর্বপুরুষরা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছেন কিন্তু আমরা সেই ভাষার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য কোনো চেষ্টা করি না। স্কুল কলেজের গতানুগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও আমরা শুদ্ধ বাংলা বলা ও লেখার যোগ্যতা লাভ করতে পারছি না। ফলে বাংলা ভাষা শুধু একটু আন্তরিকতার অভাবে ক্রমেই চরম বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ বিপর্যয়ের দায় আমরা এড়াতে পারব না। ভুল বানানে লেখা সাইনবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন দেখে এখন আর কেউ অবাক হন বলে মনে হয় না। ইদানীং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্লগ, ফেসবুক, অনলাইন নিউজ পোর্টালসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইট। অবস্থা দেখে মনে হয়, এসব স্থানে যা খুশি তা লেখাটাই যেন রীতি! কিংবা এ ক্ষেত্রে বানান নিয়ে ভাবার কোনো দরকার নেই। শুধু তাদের কথাই-বা বলি কেন, প্রতিদিন যত পত্রিকা প্রকাশ হচ্ছে তার ক’টার মধ্যে শুদ্ধ বাংলা বানান প্রয়োগের চেষ্টা থাকে?

অনেকেই বলে থাকেন, অর্থ বুঝতে পারলেই তো হলো, শুদ্ধি-অশুদ্ধি নিয়ে অত মাথা ঘামানোর কী প্রয়োজন? অবস্থা এতদূর সঙ্গিন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে আমরা ভুল বাংলা লিখতে লজ্জিত তো হই-ই না, এমনকি কৈফিয়ৎ দিই- বাংলা খুব শক্ত ভাষা। যথাযথ বিনয়ের সঙ্গেই বলতে হচ্ছে, নিজের মাতৃভাষা সম্পর্কে অন্য কোনো জনগোষ্ঠী এত মূঢ়, নির্লজ্জ উক্তি করে বলে আমি জানি না।

এখানে বলা প্রয়োজন, পৃথিবীতে উন্নত আধুনিক ভাষাগুলোর মধ্যে নিয়মকানুনের দিক থেকে বাংলা অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিধিবদ্ধ একটি ভাষা; এর বানানবিধি, উচ্চারণের নিয়ম ইংরেজি বা ফরাসির চেয়ে উন্নত। পৃথিবীর প্রত্যেক ভাষায় কিছু না কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সে বিবেচনায় বাংলা ভাষার সীমাবদ্ধতা বলা যায় অতি নগণ্য। ইংরেজির রীতিবিহীন উচ্চারণ-রীতি সংস্কার করে ধ্বনিমূলক পদ্ধতিতে ইংরেজি লেখার পদ্ধতি প্রচলনের জন্য জর্জ বার্নড শ মোটা অঙ্কের অর্থ উইল করে গিয়েছিলেন, অথচ আজও পর্যন্ত ইংরেজ ভাষাবিজ্ঞানীরা এটা করে উঠতে পারেন নি। কিন্তু বাংলা ভাষায় লেখ্য ও কথ্য উভয় ক্ষেত্রেই প্রমিত রীতি নির্ধারণ করা বাংলা একাডেমির পক্ষে সম্ভব হয়েছে।

বাংলা শেখার প্রতি আমরা এতটাই উদাসীন যে, যেখানে ইংরেজি, অংক, বিজ্ঞানের জন্য ছোট ক্লাস থেকেই বাসায় শিক্ষক রাখি কিন্তু বাংলা শেখার জন্য কখনোই কোনো শিক্ষকের দ্বারস্থ হই না। কথায় কথাই ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করাকে আমরা আধুনিকতা হিসাবে গ্রহণ করেছি। অনেকে আবার এটা বলে খুব গর্ব অনুভব করেন যে, আমি তো আসলে বাংলা গুছিয়ে বলতে পারি না, ইংলিশ টার্ম ব্যবহার করলে আমার বুঝতে সুবিধা হবে। এভাবে আমাদের রক্ত দিয়ে কেনা মাতৃভাষা আমাদের কাছে উপেক্ষিত হচ্ছে প্রতিদিন। নিজ বাসভূমে সে এখন পরবাসী, তার অঙ্গে এখন বহুবিধ লজ্জার স্পর্শ। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তি একথা বলার চেষ্টা করেছিল যে বাংলা সাহিত্যের ভাষা, কিন্তু কাজের ভাষা নয়, উচ্চশিক্ষার বাহন নয়-সে কথাই আজ স্বাধীন দেশে যেন কার্যত সত্যে প্রমাণিত হচ্ছে। এর চেয়ে লজ্জার আর কী থাকতে পারে? ফেব্রুয়ারি এলে বাংলা ভাষার জন্য করুণ কান্না অঝোরে ঝরতে থাকে, কিন্তু এই দিবসেই কেবল আমরা ভাষার কথা স্মরণ করি, সারা বছর পড়ি ইংরেজি মাধ্যমে। উচ্চশিক্ষা, অফিস-আদালত, ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারি এক কথায় উচ্চপর্যায়ের প্রায় সব অঙ্গনেই এখন রাজত্ব করছে বিদেশি ভাষা।

কেবল বৃথা গৌরববোধে স্ফীত হয়ে কোনো লাভ হবে না, প্রয়োজন মাতৃভাষার যথাযথ গৌরব বৃদ্ধিতে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ। পুঁজিবাদী শোষণ আর উন্নত প্রযুক্তির নামে ভাষা-সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বায়ন নীতির বিরুদ্ধে এভাবে ভাষা-আন্দোলন তথা একুশে ফেব্রুয়ারি কিংবা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমাদের সামনে নতুন পথনির্দেশক হয়ে উঠতে পারে। দেশে দেশে বঞ্চিত মানুষ তাদের সার্বিক মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে কাজে লাগাতে পারবে কি না, তারই ওপর নির্ভর করছে এই দিবসের প্রকৃত তাৎপর্য।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১০:০৯

রাজীব নুর বলেছেন: ভাষা শহীদদের নিয়ে কিছু লিখেন।

২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ১:০৩

বিদ্রহীসূত বলেছেন: ভাষা শহীদদের প্রতি আমার অসীম শ্রদ্ধা রয়েছে, সময়-সুযোগ করে ভবিষ্যতে লেখার ইচ্ছা রইল। ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.