নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
'ওকি গাড়িয়াল ভাই
কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে
ওকি গাড়িয়াল ভাই…
হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারির বন্দরে' ।
আব্বাস উদ্দিনের সেই চিলমারীর বন্দর আজও আছে ।কেবল সময়ের স্রোতে বিলীনের পথে আমাদের লোকসংগীত।একটা সময় ছিল যখন উত্তরবঙ্গের গ্রাম গঞ্জের এক মাত্র মাধ্যম ছিল গরুর গাড়ি কিংবা মহিষের গাড়ি । দূর দুরান্তের বালুকাময় পথে চলতো গরুর গাড়ি । আর উদাস গাড়িয়ালের কণ্ঠে ধ্বনিত ভাওয়াইয়া গান। আধুনিক জীবন প্রণালী ও নাগরিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত গ্রামীণ এই মানুষগুলোর দৈনন্দিন জীবন প্রবাহের পাওয়া না পাওয়া ,আনন্দ বেদনাগুলো বির্মূত্ত হয়ে ফুটে উঠতো সেই সকল গানের সুরে ও ভাষায়।
এই বছর পাঁচেক আগেও গ্রামের হাট বাজার গুলোতে বসতো গানের আসর ।একতারা হাতে উদাস বাউল গান গাইতো।গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষের আনন্দ, দু:খ, বেদনা, সহমর্মিতা, জীবনবোধ এবং সর্বপরি মানুষের উদ্দিপিত অসীম প্রাণশক্তি জাগ্রত করার অসীম এক ক্ষমতা ছিল এসব গানের ।
ভাওয়াইয়া গানের বিষয় বিশ্লেষণ :
ভাওয়াইয়ার গানের আবেদন ও কাঠামো আর সব লোক সঙ্গীত থেকে বেশ খানিকটা আলাদা ধাঁচের । এ গানের সকল উপাদান আশপাশের জগত্ থেকে নেওয়া।নর-নারীর প্রেম, গণ মানুষের পদাবলি, আর শ্রমজীবী মানুষের হাহাকারই সেখানে প্রাধান্য পায়, বিমূর্ততার কোনো সুযোগ সেখানে নেই।উত্তরের প্রকৃতি রুক্ষ ।এখানকার মানুষের জীবন যাপনও খরস্রোতা তিস্তা মতই। মৈষাল কিংবা চ্যাংড়া বন্ধুর কন্ঠেও তাই চড়া সুর বাজে।মহাজনের হাজার বছরের শোষনে পিষ্ঠ কৃষানের কন্ঠে তাই ধ্বনিত হয়,
“ হামার ফসল হামার খাটনির
দাম বুঝিয়া নেমো
না হলে হালুয়া পেন্টির ডাঙ্গোত
এবার ঠিক করিয়া দেমো।'
কিংবা নিথুয়া পাথারে একটি নারী হৃদয়ের কাছে জর্জরিত গ্রামীণ বংশীবাদক যুবকের আহাজারি......
“আমেনা কম তোরে ডাকি
মোর জেবনের কি থুছিস বাকি। “
গাড়িয়ালের গরুর গলার ঘণ্টি শুনে আকুল হয়ে বাড়ির বাহির হয় অভিমানি কিশোরী ।সারাদিনের কাজ শেষে তার তরুন বন্ধু সন্ধ্যার আবছা আলোয় ঘরে ফেরে। কিশোরীর মনে তখন অভিমান আর অভিযোগের পাহাড়।
‘মইষ চড়ান মোর মইষাল বন্ধু রে/ বন্ধু কোন বা চরের মাঝে/এলা কেনে ঘণ্টির বাজন/না শোনম মুই কানে মইষাল রে।’
আবহমান বাংলার পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থায় নারী মানস চিরকালই অবরুদ্ধ।দূর পরদেশে তার প্রেমিক পুরুষ হয়তো আটকা পড়ে যায় চাকরির ফাঁদে।দুটি নরনারী তখন হয়তো এভাবেই আশায় থাকে ডাহুক কিংবা চকোয়া পাখির।যে তার কাংখিত জনের কাছে পৌছে দেবে তার মনের খবর। আব্বাস উদ্দিনের দরাজ গলায় ভেসে আসে সেই সুর
'ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে।
উড়িয়া যায়রে চকোয়া পঙ্খি
বগীক বলে ঠারে
তোমার বগা বন্দী হইছে ধরলা নদীর পারে। ‘
আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য এই ভাওয়াইয়া সম্পদ এখন বিলুপ্তির পথে।কিন্তু কেন?উত্তরটা পেতে বড় ধরনের কোন গবেষণার প্রয়োজন হয় না।আমাদের শহুরে মানসিকতা আর নাগরিক সংস্কৃতির আধিপত্য কারনেই আজকের এই দৈন্যদশা।আমাদের লোকভান্ডারের আর্শ্চায সব সৃষ্টি সংরক্ষনের নেই যথাযথ কোন উদ্যোগ।গবেষকদের আন্তরিক পদক্ষেপও একেবারেই নগন্য।চরম অবহেলা আর অর্থনৈতিক দৈন্যদশার মধ্যে বসবাস করছেন ভাওয়াইয়া শিল্পীবৃন্দ।বর্তমান রাজধানী কেন্দ্রিক গণমাধ্যমগুলোর ভাওয়াইয়া গানের প্রতি নিদারুন অবহেলা প্রকট আকার ধারন করেছে।এ অবস্থা থেকে উত্তরন একেবারে অনিবার্য হয়ে দাড়িয়েছে।আমাদের বর্তমান প্রজন্মই হতে পারে এ গর্বিত ঐতিহ্যের ধারক।কেননা নতুনরাই চিরদিন যে কোন উত্তরাধিকারকে যুগযুগ ধরে বহন করে যায়।
©somewhere in net ltd.