নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রবাহূত

রবাহূত › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছায়াময়

১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:০০



লোকটা আমার দিকে আরেকটু চেপে আসে, আমি কিছু মনে করি না। বেচারা! কি যেন বলে, “বিগত যৌবন”, থাক একটু আমার উষ্ণতায়! ওতে আমার কমবে না, ঐযে ডানদিকের কোনার লোকটা একহাতের আড়ালে আমায় খুব মাপছে, এর বেশি কিছুতো নয়? দ্যাখ ভাল করে দ্যাখ!তবে চোখের বিশেষ আরাম হয়ত হবে না। আমার ভাইটাল স্ট্যাটেস্টিকস ওমন আরামদায়ক মোটেও নয়। বেচারা! আমিও দেখি রংচটা চেকশার্ট, তেল চিটে কলার, তুলে রাখা হাতের পোড়া দাগ। এইতো ব্যস এর বেশি কি আর! লোকটা বুঝে আমিও উনাকে দেখছি, ঘাড় ঘুরিয়ে নেয়, গাদাগাদি বসা টেম্পুতে প্রতিটি মানুষ বুঝি মানুষের নিঃশ্বাস গুনতে পারে, প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হত, অযথা উড়না ধরে টানাটানি করতাম, টেম্পুর গ্রিলের সাথে সেঁটে বসতাম। এখন সব অভ্যাস হয়ে গেছে। ঐ তো একটু চোখের দেখা, অযথা ঝাঁকি একটু বেশি খাওয়া, এর বেশি কিছু তো আর নয়। ওসব অভ্যাস হয়ে গেছে। ঐ যে “বিগত যৌবনটা” ঠিক সরে বসেছে, হয়ত আচমকা ব্রেক কষার কারনে কিংবা হয়ত হঠাৎ করে উনার মনে পরে গেছে, আমার বয়সী বোন কিংবা কন্যার কথা। বেচারা! আমিই একটু উনার দিকে চেপে বসি- থাক একটু আমার উষ্ণতায়!
এই ব্রেক, বিগত যৌবনের সরে বসা এই ঘটনার বিরতিতে ছেলেটি উঠে বসে সিটে, আর আমার কি যেন একটা হয়, ধক্‌ করে উঠে, বুকে একটা তির তির অনুভূতি হয়, অযথা বাঁ হাতের মধ্যমাটা কেঁপে কেঁপে উঠে!
বাইরে পিচগলা রোদ্দুর, দূরে উঁচু রেইল রাস্তা তারওপরে ঝিল, ঝিলের পরে ইট, ইটের পরে ইট, সারি সারি বাড়ি ঘর দালান কোঠা, সব সব ঝাপসা হয়ে যায়! না স্থান না কাল – কিছুই আমার বোধে আসে না সহসা। অসময়ে অফিস-ফেরতা নিজেকে খুব কেমন যেন মনে হয়। মুহুর্ত কাল! তারপর সামলে উঠি। বেচারা! যুবক হয়ত আমাকে ল লক্ষ্যই করেনি, ব্বলিন উঠা আটপৌরে উড়না জামা নিয়ে আমি যতটা সংকুচিত হচ্ছি এর কোনই হয়ত কারন নেই, আমায় কী দেখার আছে? নিজের জন্য খানিক মায়া হয়। একটু ভাল দেখতে হলে কি হত! রূপটান যদি একটু করতাম! আমার সব কিছুতেই ক্যামন যেন! আমি না কাল, না ফর্সা, না সুন্দরী না কুৎসিত, না ঘারকা না ঘাটকা! একদম যা-তা! আফসোস খুব আফসোস!
আচ্ছা একবারও কি চোখ তুলেনি! দেখেনি! আমি তো সোজা নাক বরাবর, আমার কষ্ট হয়, জানি অযথা কিন্তু হয় এক অদ্ভুত কষ্ট! এমন হয়নি আর কখন, আঠার উনিশ হলে মানতাম, তাও নয় চব্বিস পঁচিশটি বসন্ত গেছে পেরিয়ে, মেঘে মেঘে না হোক অনেক বেলা, কম তো আর নয়। এমন আচরনের কোন কারন না পেয়ে নিজেরই লজ্জা হয়। নাটক নভেলে যেমন থাকে, “তবে এই কি ভালবাসা!” – এমন উদ্ভট অনুভুতিটা বড় জ্বালায়, আর এই লাইনটা মনে পড়তেই হাসি পায়। আমি মুখ ঘুরিয়ে রাস্তা দেখি সরে সরে যাওয়া দৃশ্যাবলী, আমার ভাল লাগে। আমি রোদ দেখি, জল দেখি, হাওয়া দেখি, দেখি মেঘ, “চলিষ্ণু মেঘ... ঐ উঁচুতে ... ঐ উঁচুতে... আমি ভালবাসি আশ্চর্য মেঘদল”! হঠাৎ বোদলেয়ারের মেঘদল আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। যুবক কি পার বুঝতে? এই এখুনি কবিতা টবিতা ভাবতে পারি আমি? শ্রীহীন ভ্যানিটি ব্যাগ, ধুলোয় ঝাপাসা জুত, সরু হাতে সস্তা ঘড়ির সময় দেখা আমায় মনেই হয়না ওসব বুঝি। ফুলপাতা, কবিতা, আঁকা!
যুবক! তোমার না-হক জুলুম আমার উপর। একটু অকিঞ্চিত এই আমাকে দেখলে কি হয় ! তোমার না চোখ, না চুল, না হাসি, শুধু অবয়বটাই আমায় আচ্ছন্ন করে ফেলেছে, বিবস মথের মত পরে থাকি, নিসচুপ নিয়তি কীট অমোঘ আসে এগিয়ে! এই তুমি আমার কেউ নও! একদমই না! কিছু হওয়ার কিংবা ঘটবার নেই কোন অলীক সম্ভাবনা! কেবল ঘটমান বর্তমান, খানিক পরে অতীত, তারপর বিস্মৃতি। এই নিয়তি! এই শেষ!! গেল ফুরাইল মামলা হইল ডিসমিস। সহসা হাঁটুতে হেল্পারের খোঁচা, চলিষ্ণু মেঘ, বিবস মথ, অদৃশ্য সব, হুট হাট! ব্যাগ খুলি, ডান কোনায় গুনে রাখা ভাড়াটা দিতে যেয়েও থামি, ভিতরের চেইন পকেট থেকে খুচরো খাচরা কাগজের ফাঁক থেকে ভাজ করা পঞ্চাশ টাকার নোটটা বের করি, যদি ওর ভাংতি না থাকে। আল্লাহ তাই যেন হয়। পাংশু মুখে ভাংতি চাইলাম, ভাই ভাংতি হবে? একটু হাসি এ পকেট ও পকেট হাতড়ে শেষতক না পাওয়া, এই আমার অনেক হোত পাওয়া। একটু চোখাচোখি, হাসি চূর্ণ বিচূর্ণ! জমিয়ে রাখতাম। কে জানে কত দিন। বুঝি অনেক দিন। হয়ত কোনদিন ঝড় জল হলে খুব, জানালা দিয়ে মেঘ দেখতাম, উঁচুতে ঐ উঁচুতে চলিষ্ণু মেঘ, ছায়াময় যুবককে হয়ত আলগোছে ভাবতাম, বই এর ভাঁজে শুকিয়ে যাওয়া বিদ্যা পাতার মত, দেখতাম মুখে ঈষৎ প্রশ্রয় এর হাসি নিয়ে কিংবা যদি সেই পাশে এসে দাঁড়াত সমুখে সুদীর্ঘ ছায়া ফেলে!
কিন্তু হায়! হতচ্ছারাটার আজ ঠিকই ভাংতি আছে, হাতে গুজে দেয় গুনে গুনে টাকা। বেচারা! আমার ছায়াময় যুবক ঐ দুরেই থাকল। ছায়ারা সব দুরেই থাকে সবসময়। স্টাফ রোড, স্টাফ রোড পেরিয়ে কাকলী, কাকলীতে নেমে যায় সেই “বিগত যৌবন”। এই কড়কড়ে তিনটে সাড়ে তিনটের রোদে কেউ উঠে না। অপুষ্ট কণ্ঠে ছেলেটা চেঁচায় “ফ্রাঙ্গে” “ফ্রাঙ্গে”। চারিধারে কি নৈশব্দ, চরাচর কি নিঃসঙ্গ তখন, আমার!
হঠাৎ ঝাঁকি মেরে চলতে থাকে টেম্পু। তারপর মহাখালী। মহাখালীতে টেম্পু থামতেই হঠাৎ একদমই হঠাৎ টুক করে ছোট্ট একটি লাফ দিয়ে নেমে যায় ছায়াময়। ঐ যে যাচ্ছে রেল রাস্তা ধরে, সমকৌণিক দূরত্ব ক্রমশ বারে, আমি নির্নিমেষ দেখি। সব্জে ক্যানভাসের শার্ট, খাকি টুইলের প্যান্ট, এক মাথা ঝাঁকড়া চুল। খানিক আগে দেখা, ঝুলে থাকা বুক পকেটে ভাঁজ করা কাগজ টাকা, এক চিলতে একটা লাল ফিতে, বোতাম, বোতাম ঘর সব দেখি।
হঠাৎ খুব কষ্ট হয়। খুব খুব খুবই! হে যুবক এ তোমার না হক জুলুম আমার উপর। না দেখলে আমায়, না বললে কথা। “তবে কি এই ভালবাসা”! নাহ! আর হাসি পায় না। নিজের জন্য বড্ড মায়া হয়, বেচারা!
১৭/০৫/১৯৯৯


মন্তব্য ৩ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:০৫

ফরিদ আহমদ চৌধুরী বলেছেন:

২| ১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ৯:৩৭

অতৃপ্তচোখ বলেছেন: গল্পটা পড়ে মায়া হল আপনার প্রতি। ভালোবাসা বুঝি এরকমই! স্মৃতি হয়ে রয়!

১৩ ই জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১০:৪২

রবাহূত বলেছেন: আমার প্রতি মায়া হবে কেন ভাই, এ নিছক গল্প। আমি সামান্য লেখক মাত্র!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.