নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

যা মনে আসে তাই লিখি।

স্বর্ণবন্ধন

একজন শখের লেখক। তাই সাহিত্যগত কোন ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

স্বর্ণবন্ধন › বিস্তারিত পোস্টঃ

অজগর০১

২৭ শে জুন, ২০১৯ দুপুর ১২:৫৬

(১)
অজগরটিকে আজ ছাড়া হবে আলতাদিঘীর অভয়ারণ্যে। বনবিভাগের বড় অফিসার থেকে শুরু করে এলাকার সাংসদ সবাই হাজির হয়েছে এই উপলক্ষ্যে। আলতাদিঘীতে আজ মেলা বসেছে গণ্যমান্য মানুষের। শতাব্দীর পুরানো গাছগুলো তাকিয়ে আছে ফ্যালফ্যাল করে। এমন হোমড়া চোমরার ভিড় শেষ কবে দেখেছে এই আদিম অরণ্য, তা এই গাছ গুলো মনে করতে পারছেনা। সম্ভবত সাতশ আটশ বছর হবে, এমন ঘটনা ঘটেনা। শেষ ঘটেছিলো পাল রাজাদের আমলে। রাণী বিভাবতীর অনুরোধে মহান রাজা ধর্মপাল বনের বুক চিড়ে খুড়েছিলেন এই মাইল দুয়েক লম্বা দিঘী। রানী বিভাবতী স্বপ্নে দেখেছিলেন একটা তৃষ্ণার্ত ছোট বাচ্চা তার কাছে জল খেতে চাইছে, আর তিনি তাকে গ্লাসে করে লাল আলতা গোলানো জল খেতে দিয়েছেন। বাচ্চাটা খেতে গিয়ে বমি করে ফেলেছে! বিভাবতীর ঘুম অন্ধকার থাকতেই ভেংগে গিয়েছিলো। পৃথিবীর সব মন খারাপ তাকে পেয়ে বসেছিলো। একি অলুক্ষণে স্বপ্ন! কেন এমন স্বপ্ন তার কাছে এলো! সব শুনে রাজাও চিন্তিত হয়ে পড়লেন। যথারীতি রাজজ্যোতিষীর ডাক পড়লো। কথিত আছে জ্যোতিষী নাকি ভবিষ্যদ্রষ্টা ছিলেন। তিনি স্বপ্ন ব্যখ্যা দিলেন- রাণীর উপর দৈব আদেশ এসেছে, তৃষ্ণার্তদের জন্য দিঘী খুড়তে হবে! আলতা পায়ে মেখে রাণী হাঁটবেন, যতদূর তার পায়ের আলতা মাটিতে দাগ ফেলবে, ততদূর লম্বা দিঘী খুড়তে হবে। তারপর একদিন শুভ সকালে এখানে এসেছিলেন রাজা রাণী, আর রাজ সমাবেশ! রানী বিভাবতী লাল আলতায় পা চুবিয়ে নতুন সূর্য্যের আলোয় সেদিন হেঁটেছিলেন এইখানটাতে। আহা! সে কি রূপ তার! দুধে আলতা শরীরের রঙ,কাজলে টানা চোখে মায়ার আসর, মাথার চুল মাটি ছুঁয়ে দিচ্ছিলো প্রায়! সেতো বহুদিন আগের কথা। ছিড়ে যাওয়া পুথির পাতার মতো অস্পষ্ট সেই স্মৃতি!
আজকের এই সমাবেশ সেইদিনের মতো নয়। অনেক গুলো গাড়ি বনের গাছের ফাকে ফাকে অনেক কষ্টে দাড় করানো হয়েছে। ড্রাইভারদের মুখে রাজ্যের বিরক্তি, এমন কাদা ভরা রাস্তায় গাড়ি চালানো সত্যিই কঠিন কাজ। কিন্তু কি আর করা! নেতা আর বড় কর্তাদের ইচ্ছাই সব! তাই আসা ছাড়া তো কোন উপায় ছিলোনা! বিরক্ত হয়ে সবগুলো ড্রাইভার জটলা পেকে বিড়ি ফুঁকছে ঘন একটা ঝোপের আড়ালে। আর সবার মধ্যমণি হয়ে দাড়িয়ে আছেন মধ্যবয়সী, ভুঁড়িওয়ালা কিছু মানুষ। উনারাই এই এলাকার হর্তাকর্তা! বনবিভাগের অফিসার এগিয়ে যাচ্ছেন, তার সাথে দপ্তরের দুই প্রহরী। তারা দুইজন মিলে একটা বস্তা টেনে আনছে। ওখানেই আছে অজগরটা। কয়েকজন সাংবাদিক এসেছেন হাতে ক্যামেরা নিয়ে। সাংসদের অনুরোধ তার আর অজগরের ছবিটা যেন একই ফ্রেমে আসে! ছোটকালে তিনি একটা গল্পের বইয়ে দেখেছিলেন একজন সাহসী বীর সিংহের কেশর ধরে দাড়িয়ে আছেন; ছবিটা এখনো তার চোখে ভাসে। সাপের গায়ে হাত রাখা একটা ছবি পত্রিকায় আসলে ব্যাপারটা মন্দ হয় না! সবই তো ইমেজের ব্যাপার! তিনি চোখ দিয়ে একজন সাংবাদিককে ইশারা করলেন। সাংবাদিক সাহেব এগিয়ে গেলেন সুবিধামতো জায়গায়।
সাপটাকে ছাড়া গেলো অনেক কসরতের পর। বনবিভাগের প্রহরীরা এই কাজে পারদর্শী নয় মোটেও, আসলে জীবনে তারা এরকম আস্ত অজগর হাত দিয়ে ধরে নাই! তার উপর চোখের সামনে এমপি সাহেব! সব মিলিয়ে একটা ভজঘট পেকেই গেলো। বস্তার মুখটা খোলার কথা ছিলো যেদিকে, খোলা হলো তার উলটো দিকে! যেমন কাজ তেমন ফল! অজগরটা মুক্তি পেয়েই রওনা হলো গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দিকে। এতোক্ষণের হাততালি হঠাত হাউমাউ শব্দে পরিণত হলো! সবাই যে যার মতো ছুট লাগালো। এমপি সাহেবের ছবি তোলা আর হলো না! বনবিভাগের বড়কর্তা একাই দাঁড়িয়ে থাকলেন শেষ পর্যন্ত। একটা লাঠির মাথা দিয়ে খোঁচা দিয়ে সাপের মাথাটা ঘুরিয়ে দিলেন অন্যদিকে। ঘুরে গেলো তার গতিপথ। বড়কর্তা মনে মনে হাসলেন, হায়রে বোকা প্রাণী! তোর চেয়েও বোকা প্রাণী আছে, তারা হচ্ছে মানুষ। তবে তারা তোর চেয়েও ভয়ংকর!

সবাই এখন ফিরতে শুরু করলো। শুধু এমপি সাহেব সাংবাদিককে ডেকে কানে কানে বলে দিলেন, খবরটা ছাপিয়ো, কিন্তু ছবি গুলো যেন না আসে! মৃদু হেসে সম্মতি জানিয়ে মোটরসাইকেলে স্টার্ট দিলেন সাংবাদিক। ধীরে ধীরে হালকা হয়ে এলো গণ্যমান্যের ভিড়।
এইসব মানুষ ছাড়াও আরো কিছু সাধারণ মানুষ জড়ো হয়েছে এখানে। তারা স্থানীয় বাসিন্দা, বনটার আশেপাশেই বসবাস। তারা এতো তাড়াতাড়ি ফিরবে না। সাপটা কোনদিকে গেলো জানাটা তাদের নিরাপত্তার জন্য খুব জরুরী। তারা শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করবে! এদেরই একজন শামীমা। সাপ মুক্তকরণের কার্যকলাপে এতক্ষণ তার হাসি পাচ্ছিল খুব। কিন্তু এখন দুশ্চিন্তা হচ্ছে খুব বেশি! তার চার ছেলে মেয়েই এখনো ছোট! সারাদিন এইসব বনে বাদাড়ে খেলাধূলা করে। যদি কোন ক্ষতি হয়!
(২)
সাপটা ধীরে ধীরে আগাচ্ছে। উঁচু নীচু মাটির উপর দিয়ে তার পিচ্ছিল শরীর রেলগাড়ির মতো গড়িয়ে যাচ্ছে। ঘোলা চোখে সবুজ আলো জ্বলছে অদ্ভুত ম্রিয়মাণতায়। শীতল রক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে দ্রুত; তাড়াতাড়ি ঠান্ডা হওয়া দরকার! আগে তার আবাস ছিলো পাহাড়ি এলাকায়। লুকানোর জায়গার অভাব ছিলোনা; অফুরন্ত খাবার ছিলো। কিন্তু এখানে কিছুই তার ঘোলা চোখে ধরা পড়ছেনা। চামড়া ছিলে যাচ্ছে অমসৃণ ঘাসের ঘষায়। সে খুব বিরক্ত হচ্ছে। তার ইচ্ছা হচ্ছে সব কিছু গিলে ফেলতে! ক্ষুধা ও রাগের মিশ্র অনুভূতি ভেসে বেড়াচ্ছে চারিপাশে।
কিছুদূরে দোপেয়ে কিছু জন্তুর উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে! ওর শরীরে এখন বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট নাই। আপাতত শরীরকে ঠান্ডা করা দরকার। আলতা দিঘীর পাশের অযত্নে জন্মানো কলমি লতার ফাঁকে নিজের শরীরকে গলিয়ে দেয় সে! উৎসুক জনতা হইহই করে উঠে দূর থেকে! আনন্দ নাকি ভয়ে তা অবশ্য এতোদূর থেকে বোঝা মুশকিল! ভীড় থেকে খানিকটা দূরে কড়া চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে দীপেন হেমব্রং! এ এলাকার বাসিন্দা সাঁওতাল জাতির মানুষ। সে জানে সাপটা পানিতে আজীবন থাকার জন্য নামে নাই। আজ সন্ধ্যার আগের ক্ষুধা মেটাতে ওটা ডাঙ্গায় উঠবে। এই বনে শিকারের উপযুক্ত পশু নেই বললেই চলে। স্থলচর প্রাণি বলতে বনের ফাঁকে ফাঁকে ঘর বেঁধে থাকা সাঁওতাল জাতির লোকরাই! সাপটার সাথে তাদের খুব তাড়তাড়ি দেখা হবে! সতর্ক থাকতে হবে সবাইকে, খুব সতর্ক থাকতে হবে!
(৩)
“যতন করিয়া করিয়া কন্যা বান্ধিল এ ঘর,
চান্দের আলো নামে ভাঙ্গা ছাদের উপর
দিনের বাতাস কয় আসিলে দখিণ দুয়ারে,
ভ্রমরা তুমি ডাকিয়া দিও রূপন্তী কন্যারে”
আলতাদিঘীর আশেপাশে মাইল পাঁচেক গভীর বন। একটা মাত্র সরু রাস্তা চলে গিয়েছে সেই বনের বুক চিরে। নিকটবর্তী থানা থেকে এই একমাত্র রাস্তা ধরে পৌছানো যায় আলতাদিঘী অভ্যারণ্যের বুকে পরগাছার মতো বেড়ে উঠা জনবসতি গুলোতে। খুব বেশি বড় নয় সেগুলো। গভীর বনের ছায়ার মধ্যে মাঝে মধ্যে উঁকি দেয়া দুই চারটে বাড়ি-ঘর মাত্র! দেখলে মনে হয় সভ্যতা এখানে এখনো সংগ্রাম করছে প্রকৃতিকে হটিয়ে দেবার জন্য; কিন্তু পারছে না ! এখানেই পাড়ার শেষ মাথায় শামীমা দের বাড়ি। শামীমা আর তার আরো দুই বোন পাশাপাশি বসতি গড়েছে এই আদিম ভূখন্ডের শেষ মাথায়। তাদের বাসা গুলো ঘন গাছের ছায়ায় খানিকটা গড়ের মতো উঁচু জায়গায়। টিন শেডের পাকা বাড়িগুলো দিনের বেলার আলোতে গাছের ফাঁকে ঝলমল করে চোখ ধাধিয়ে দেয়। মাইল চারেক দূরেই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত।
শামীমার স্বামী আজাদ স্বচ্ছল মানুষ। থানা শহরে ব্যাবসা করেন, তুলার ব্যাবসা। উপজেলার বাজারে তার বড় দোকান। সারাদিন ব্যাবসার ব্যস্ততায় পার হয়ে যায়। প্রায়ই বাড়ী ফিরতে রাত দশটা বাজে। নাহ, এসব নিয়ে শামীমার কোন অভিযোগ নাই। স্বামী বাসায় আগে ফিরলে ভালো হত হয়তো, খানিকক্ষণ গল্পস্বল্প করা যেতো! কিন্তু বেচারি ব্যস্ত মানুষ। সারাদিন খাটছেন তো তার আর তার ছেলেমেয়ের জন্যই! এটুকু সে বোঝে। আর সারাদিন কেটে যায় দুই বাচ্চাকে সামলাতে; গল্পের জন্য তো বোনেরা আছেই। এসব ভাবলে বলা যায় শামীমা ভালোই আছে, সুখেই আছে। তবুও কখনো সখনো অলক্ষুণে পূর্ণিমায় তার খুব মন খারাপ হয়ে যায়। কেন হয় কে জানে! মনের খব কি আর সব জানা যায়!
তো এই আপাত শান্তির মধ্যে তার মনে নতুন অশান্তি নিয়ে এসেছে সেদিনের সেই অজগর। না কোন ক্ষতি সাপটা এখনো করে নাই, কিন্তু করতে কতক্ষণ। তার দুই মাসুম বাচ্চা; একজনের বয়স পাঁচ বছর আরেক জনের তিন। সারাদিন তাদের দেখে রাখতে হয়। একটু চোখের আড়াল করলেই ছুট লাগায় পাশের ঘন গাছগুলোর মধ্যে। এই গাছের আড়াল আর বুনো কলমির ঝোপঝাড় তাদের খেলার জায়গা। সাপটা এই পর্যন্ত চলেই আসতে পারে। খুব স্বাভাবিক সেটা! সকাল থেকেই তাই শামীমা আজ তাদের পাহারা দিচ্ছে। বাচ্চা দুইটাও আজকে বেশি ঝোপঝাড়ে যাওয়ার বায়নাক্কা করছে। এটা নিয়ে সকাল থেকে দুইবার দুইটাকে মার ও লাগিয়েছে। কিছুক্ষণ কান্নাকাটির পর তারা একই কাজই করছে!
এভাবেই সারাদিন পার হলো তার। সন্ধ্যাবেলা রান্না বসিয়ে দিতে গিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলো সে। ব্যস! বাচ্চা দুইটার আর দেখা নেই! শামীমার আত্মা বের হয়ে যাওয়ার যোগাড়! সে এক দৌড়ে হাজির হলো উঠোনের মাথায়। না বাচ্চারা ঝোপঝাড়ে এখনো ঢোকে নাই, বরং তার দিকে ভয়ে নীল হয়ে দৌড়ে আসছে। এতো ভয় পেয়েছে ওরা যে কাঁদতেও ভুলে গিয়েছে সম্ভবত। কোন মতে মায়ের কাছে দৌড়ে এসে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো তারা দুইজন-“মা! ভুত! ভুত!”
(৪)
নাহ এই সামান্য আলোছায়ায় ভূতে ভয় পাওয়ার মানুষ নয় শামীমা। তারপরও এই মুহূর্তে সাহস দেখানোটা বুদ্ধিমানের কাজ মনে করলো না সে। তার মা বলতো- “ মাইয়া লোকের সাহস থাকলেও সবসময় দেখাতে নাই!” অন্তত এই আধা জঙ্গলের রাজ্যে এ কথাটা ঠিক। তাই সে জোরে একটা হাঁক দিলো তার দুই বোনকে। নাম ধরে চিৎকার করে জানালো-“ শরীফা, শিল্পী! বাড়ির লোকজন নিয়ে এদিকে একটু আয় দেখি। জঙ্গলে বাচ্চা গুলান কি না কি দেখে ভয় পাইছে।“
শরীফা, শিল্পীদের বাসায় আজ ঘর ভর্তি লোক ছিলো। বেশিক্ষণ দেরী হলোনা এক পাল লোক জড়ো হতে। ভুতের কথা শুনে তারা সবাই যদিও আঁতকে উঠলো, কিন্তু দমলো না। কয়েকটা মশাল জ্বালিয়ে সবাই গেলো ঝোপ খুঁজতে। একজন আবার হাতে একটা ভাঙ্গা বালতি নিয়ে তা পেটাতে পেটাতে তাদের পিছন পিছন গেলো; যাতে ভুত হোক আর জন্তু জানোয়ার হোক, যেন ভয় পায়! তাদের এই এলাহি কান্ডে ঘরে ফেরা পাখিরাও কিচির মিচির করে শোরগোল তুললো। সোজা কথা সেখানে যেরকম হট্টগোল শুরু হলো তাতে আর যাই হোক ভুতের বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব নয়! ভুতকে পাওয়াও গেলোনা। শরীফার স্বামী সাহস দেখানোর জন্য আরো খানিকটা ভিতরে এগিয়ে গেলো। হাতে তার জ্বলন্ত মশাল। পিছনে বিশাল সেনা বহর রেখে অধিনায়ক যেভাবে বুক ফুলিয়ে কয়েক কদম সামনে এগিয়ে যায়, ঠিক তেমন আরকি! তবে বেশিক্ষণ তার বুক ফুলিয়ে হাঁটার সৌভাগ্য হলোনা। হঠাত আর্তচিৎকার দিয়ে সে বললো-“লাশ! লাশ! লাশ!” এই বলে সে সম্মোহিতের মতো দাঁড়িয়ে পড়লো ভয়ে। তার হাত পা কিছুই নড়ছিলো না, চোখের সামনে শধু ভয়, পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহতম ময়!

জড়ো হওয়া লোকজনের উত্তেজনা সত্যিকার আতঙ্কে রূপ নিলো। কিন্তু তা তাদের উৎসাহকে দমাতে পারলোনা। তারা এগিয়ে গেলো সেইদিকে। শামীমার দুঃসম্পর্কের চাচা অভিজ্ঞ লোক কলিম আলী পড়ে থাকা শরীরটার সামনে গিয়ে, সন্তর্পণে নাকের উপর হাত রেখে বোঝার চেষ্টা করলেন লোকটা শ্বাস নিচ্ছে কিনা। তারপর বললেন-“ তাড়াতাড়ি তোল! মরে নাই! অজ্ঞান হয়ে আছে!"
নাহ, ভদ্রলোক মরেন নাই। তাড়াতাড়ি দৌড়াতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে মাথায় আঘাত পেয়েছিলেন। এখন এই আলতাদিঘীর অরণ্যের প্রান্তসীমায় ঝোপের ধারে পড়ে আছেন। নীল শার্ট, গ্যাভার্ডিন এর ঢিলে ঢোলা প্যান্ট আর পায়ে কাঁটাওয়ালা কেডস এ ছোপ ছোপ কাঁদা মেখে গিয়েছে। গলায় ঝোলানো বাইনোকুলার, মাথার কাউবয় হ্যাটটা বেশ কিছু দূরে মানকচুর ঝোপে আটকে রয়েছে। মানুষের একটা অদ্ভুত স্বভাব হচ্ছে প্রথম দেখায়ই কারো সম্পর্কে মোটের উপর একটা আন্দাজ করে ফেলা। সমবেত মানুষ ও তার সম্পর্কে ভাবতে থাকে হয়তো। সবার মনেই রহস্য জাগে, এই সন্ধ্যায় লোকটা বনের দিকে কি করছে! এমনিতেও জায়গাটা পর্যটকদের কাছে খুব বেশি পরিচিত নয়, তারউপর এলাকাটা সীমান্তের কাছাকাছি। এখানে অপরিচিত মানুষ রহস্যের চেয়েও ভয় জাগায় বেশি। যদিও লোকটার বয়স বেশি নয়, কিন্তু ঠোঁটের উপর বাঁকানো গোঁফ দেখে মোটেও সাধারণ মানুষ মনে হচ্ছেনা। একেক জন একেক মত দিতে থাকে। কলিম চাচার বুদ্ধিটাই সবচেয়ে বেশি মনে ধরে শামীমার। পুলিশে খবর দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু কাছের থানা এখান থেকে মাইল সাতেক! গভীর অরণ্যের মাঝখানে দিয়ে চলা একফালি রাস্তা দিয়ে যেতে হয়। সন্ধ্যাবেলা এই রাস্তায় এতোদূর যাওয়ায় সাহস দেখায় না কেউই! শরীফার স্বামীকে ডাকতেই সে বলে তার জ্বর আসছে, গাঁ কাঁপছে, অন্য কেউ যাক। কাউকেই পাওয়া যায়না রাতে লোকটাকে গঞ্জে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কারো একজনের কাছে থানার নম্বর ছিলো। ফোন দিয়ে কানেক্ট হলেও কথা শোনা গেলোনা কোন। আসলে এই ঘন গাছপালার এলাকায় নেটওয়ার্ক থাকেনা অধিকাংশ সময়। এসব দেখে বিরক্ত হয়ে কলিম চাচা বললেন-“ভালো না খারাপ তা পরে বিচার করো! আগে তো মানুষটাকে বাঁচাও! আমাদের কালে তোমাদের মতো এতো স্বার্থপর ছিলাম না!”

সবাই ধরাধরি করে মানুষটাকে তুলে আনে শামীমাদের বাইরের চালি ঘরের বারান্দায়। বেঞ্চের উপর শুইয়ে দেয় শরীরটাকে। মাথায় পানি ঢালতে শুরু করে দুইজন। ভদ্রলোক যার নাম আমরা জানিনা, এমনকি তিনি নিজেও আসলটা বলেননা, বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় কাজ করেন। তিনি চোরাকারবারিও হতে পারেন, আবার নিরাপত্তা বিভাগের মানুষ ও হতে পারেন! কাউকে কখনোই তার পরিচয় বলেন না। যখন সবাই মিলে তাকে কোলাপাঁজা করে উঠাচ্ছিলো, তখনই তার জ্ঞান ফিরে এসেছিলো, কিন্তু তিনি তখন থেকেই মটকা মেরে আছেন। অনেক দিনের অভিজ্ঞতা থেকে এটা তিনি ভালোই জানেন যে এতো লোকের সামনে জ্ঞান ফিরে আসাটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। হাজার মানুষের জেরার মুখে পড়া বিপদজনক। যেকোন সময় ভুল বোঝাবুঝি হতে পারে। তবে জ্ঞান ফেরার লক্ষণ দেখানো যেতে পারে! খানিকটা সময় পর মৃদু গোঙ্গানি আর কাতরানোর শব্দ করলেন, তবে চোখ পুরোটা মেললেন না। কিছুক্ষণ পর দুই তিনজনকে পাহাড়ায় রেখে যে যার ঘরের দিকে ফিরে গেলো। সিদ্ধান্ত হলো কাল সকালেই লোকটাকে গঞ্জের থানায় নিয়ে যাওয়া হবে। খানিক দূরে দাঁড়িয়ে থাকলো শামীমা। সে বুঝতে পারছিলো সবাই মিলে তার ঘাড়ে একটা ঝামেলা চাপিয়ে ভেগে যাচ্ছে। হাজার হোক তার বাড়ীতেই তো তোলা হয়েছে! তার স্বামী আজাদ বাসায় থাকলে এরকম ভেজালে ফেলার সাহস হতোনা কারো!

আজাদ ফিরলেন রাত আটটায়। দুই তিনজন লোক তখনো ঢুলু ঢুলু চোখে পাহারা দিচ্ছিলো চালিঘর। এমনিতেই গত মাস দুয়েক আজাদের ব্যবসা ভালো যাচ্ছেনা। এই বন জঙ্গলের দেশে কোন ব্যবসাই বেশি দিন জমানো যায়না। ব্যবসা চালানোর জন্য যেমন মূলধন দরকার তেমনি মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও থাকা দরকার। এখানে মানুষের সেই ক্ষমতা খুব কম! বাড়ি ফিরে সব দেখে আজাদের মাথার রক্ত পায়ে ঊঠে যায়। কিন্তু সে বুদ্ধিমান লোক, জানে এখন চেঁচিয়ে লাভ নাই। বরং অন্যরা সাহায্য করবেনা। বলবে তার জমিতেই তো পাওয়া গিয়েছে! তার চেয়ে কোনভাবে আপদ বিদায় করতে হবে। মানুষ হিসেব কেউ তাকে কখনোই বোকা সোকা বলবেনা। আসলে সে বোকা নয়ও। মানুষটার পড়ে থাকা জিনিসপত্র দেখে সে আন্দাজ করে নিলো আর যাই হোক এ সাধারণ মানুষ নয়। তাড়াতাড়ি করে শোয়া লোকটার ঝোলার মতো ব্যাগটা বের করলো। হাত ঢুকাতেই পাওয়া গেলো কিছু কাগজ আর একটা পরিচয় পত্র, সেখানে নাম লিখা সাইফ ব্যাপারী, বাড়ি বনানী ১০, এমডি ব্যাপারী এন্ড কোং। সর্বনাশ এতো মনে হয় নামীদামী লোক, এখানে কিভাবে আসলো! নাড়িতে হাত রাখে আজাদ। না নাড়ির গতি সচল, বুক উঠা নামা করছে। মরে নাই তাহলে! যাক বাঁচা গেলো। এরকম একটা লোক এখানে মরে গেলে চৌদ্দগোষ্টীর নাম পেপারে আসতো আর পুলিশের টানা হেঁচড়া শুরু হতো। সে জোরে ডাক দিলো-“অই সাইফ ভাই চোখ মেলেন! ব্যাপারী সাহেব চোখ মেলেন!” ভদ্রলোকের জ্ঞান অনেক আগেই ফিরেছিলো। তিনি ভির কমার অপেক্ষায় ছিলেন। এবার চোখ মেললেন ধীরে ধীরে। তাই দেখে আজাদ পাশের দুজনকে ধমক দিয়ে বললো তাড়াতাড়ি মানুষে খবর দে। আসলে আজাদ চাচ্ছিলোনা প্রথম পরিচয়ের সময় উটকো ঝামেলা গুলো থাকুক এখানে। ব্যাপারী চোখ মেলে তাকালে, আজাদ এক গাল হেসে বলল- “আমি আজাদ, মরে যেতে লাগছিলেন তো আমিই বাঁচাইলাম। এখানে আসলেন কিভাবে? কেন আসছেন?“ এতোগুলো প্রশ্নের ঝড়ে ব্যাপারীর মাথা কিছুক্ষণ থম মেরে থাকলো। তারপর তার বহু যত্নে শেখা অভ্যস্ততার অভিনয়ে হেসে বললেন- “আমি সাইফ, সাইফুদ্দিন ব্যাপারী, আসলে আমার ব্যবসা ঢাকায় থাকিও ঢাকায়। তবে শখ হচ্ছে বনে বাদাড়ে ঘুরে দুর্লভ গাছ খোঁজা!”
“তো এই আকাইম্মা মার্কা জঙ্গলে কি খুঁজতে আসছিলেন ভাই?”
ততোক্ষণে আশেপাশের আরো দুই চার জন ভিড় জমিয়েছে। এক কোণায় শামীমা আর তার দুই বোন উঁকি দিচ্ছে। তাদের সবার চোখে একগাদা বিস্ময়! একনজরে আশেপাশের ভিড়ের দিকে তাকিয়ে ব্যাপারী বলে-
“নীলপদ্ম খুঁজতে!”
নীলপদ্ম! সমবেত লোকজনের মধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়। এরকম পদ্ম তো এ এলাকায় পাওয়া যায়না। আসলে পদ্ম ফুলের দেখাই মেলেনা এখন! সবাই কলিম চাচার দিকে তাকায়। কলিম চাচা এই এলাকার জাননেওয়ালা মানুষ। তিনি জানতেও পারেন। কলিম চাচা মাথা নাড়িয়ে বলেন-“ পরদাদা দের আমলেও নাকি পাওয়া যেতো! আলতাদিঘীতে রাজা নাকি চাষ করাতেন। কিন্তু সাহেবদের শাসনের পর তো কেউ কখনোই দেখে নাই! কি জানি থাকতেও পারে!”
নীলপদ্মের খোঁজে লোকটা এতোদূর এসেছে। এতো বড়ো আর ধনী মানুষের কাছে এটা দামী জিনিস, মানে আসলেই মূল্যবান! আজাদ প্রসঙ্গ পালটাতে চায়, এই কথা সবার কানে পৌছানো উচিত হবেনা। সে জিজ্ঞাসা করে-“ তো আপনাকে মারলো কে এইভাবে?”
-“জংগলে খুঁজতে খুঁজতে খানিকটা দেরী হয়ে গিয়েছিলো। আলোও কমে আসছিলো! ভুল করে পা পড়ে গিয়েছিলো একটা বিরাট সাপের কুন্ডলীর ভিতর! কোনভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে প্রাণপণে দৌড়াতে গিয়ে আপনাদের বাগানের গাছের সাথে বাড়ি খেয়েছিলাম! তারপর তো আর কিছুই মনে নাই!”
ঘটনার সূত্র জানতে পারলে মানুষের আগ্রহ কমে যায়। এখানেও সবার ব্যাপারীর ব্যাপারে আগ্রহ কমে যায়। নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে তারা। তার মানে সাপটা গভীর জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়ে উঠে এসেছে! আশেপাশেই হয়তো ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটা শীতল ভয় তাদের কে ছুঁয়ে যায়। শরীফার স্বামী কিছুক্ষণ বনবিভাগ আর সরকারের পিন্ডি চটকায়। বলে আজ তারা প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ বলেই সবাই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নাহলে কেউ কখনো শুনেছে সরকারের লোকেরা এসে বাড়ির উঠোনের পাশে সাপ ছেড়ে দিয়ে যায়। তাও এরকমের দানব সাইজের সাপ! কেউই বেশিক্ষণ অপেক্ষা করেনা। দ্রুত নিজ নিজ বাড়ির দিকে রওয়ানা হয় সবাই। ভিড় ফাঁকা হয়ে গেলে ব্যাপারী আজাদের দিকে তাকিয়ে বলে-“ অনেক কষ্ট করলেন ভাই! অনেক ধন্যবাদ! আজ রাতটা থাকতে পারলে, কাল সকালেই আমি চলে যাব!”

আজাদের এখনো অনেক কিছুই জানার বাকী। লোকটাকে তার হাতছাড়া করার ইচ্ছা ছিলোনা। তাই সে বাড়াবাড়ি রকমের অনুরোধ শুরূ করলো তার এখানে দুই চার দিন থাকার। এমনকি তার এই অনুরোধের ছিরি দেখে শামীমার ও লজ্জায় মাথা নীচু হয়ে গেলো খানিকটা! যেতে চাচ্ছে যখন যেতে দাও! আজাদকে পাশে ডেকে চোখ রাঙ্গায় শামীমা। উত্তেজিত আজাদ তাকে বলে- “ আরে এ যে সে লোক নয়! ঢাকার ব্যবসাদার লোক! এর সাথে ভালো সম্পর্ক করতে পারলে অনেক লাভ! আর, নীলপদ্মের বিষয়টা কি জেনে নেই না আগে! তারপর দেখো কি করি!” চোখেমুখে নিশ্চিত লটারী পাওয়ার মতো ঝলক খেলা করে আজাদের। কিন্তু ব্যাপারী রাজি হয়না। মনে মনে ঠিক করে সূর্য্য উঠার আগেই এলাকা ছাড়তে হবে। কিন্তু এখন এসব বলে এই লোভী মানুষটার খপ্পরে পরার কোন মানে হয়না। মাথা নীচু করে বসে থাকে নিজের মতো!
(৫)
অজগরটা অনেক খুঁজেও খাবারের খোঁজ পায়না এই এলাকায়। বনটা নামেই বন। প্রাণীদের কোন হদিস এখানে পাওয়া যায়না! সাপটা এমাথা থেকে ওমাথা ঘুরেছে আজ! সীমান্তের কাঁটাতারে গায়ের চামড়া ছড়ে গিয়েছে। সেখানে বাঁধা পেয়ে আবার সাঁওতালপল্লির ধার ঘেঁষে সে চলে এসেছিলো এদিকটায়। সাঁওতালরা অবশ্য টের পেয়ে তারা করেছিলো তাকে! এরমধ্যেই ব্যাপারীকে হাতের নাগালে পেয়েই গিয়েছিলো। কিন্তু সাপটার পোড়া কপাল! শিকার ফসকে দৌড় দিয়েছিলো। এখন গরু ছাগলের গায়ের গন্ধ শুকে তাদের খুজছে সে। খুব সন্তর্পণে বিশাল দানবটা চলে এসেছে শরীফার গোয়াল ঘরের পাশে। ইট দিয়ে গাঁথা দেয়ালে কয়েকবার মাথা দিয়ে গুতো দেয় সে। কাজ হয়না। চারিপাশে ঘুরে ছিদ্র খুঁজে বেড়ায়, খুঁজে পায়না। শুধু তার ক্ষুধার মাত্রা দানবের মতো বাড়তে থাকে আর বাড়তে থাকে রাগ! সে চুপ করে গড়াতে গড়াতে শামীমা দের উঠোনের কোণে চলে আসে! আকাশে কালো ছায়ায় জ্বলজ্বল করছে অগণ্য তারা। নীচের উঠোনে হ্যাজাক বাতির পাশে তিনটে চেয়ারে বসে গল্প জমানোর চেষ্টা করছে তিনটা মানুষ। কথা অবশ্য আজাদই বেশি বলছে। ব্যাপারি শুধুই হু হা করছে। তা করুক! বড়লোক মানুষেরা একটু কম কথাই বলে। তার তো আর আজাদকে দরকার নেই, বরং আজাদেরই তাকে দরকার! শামীমা এই প্রথম খেয়াল করে মানুষটাকে। বয়স বেশি নয়, বিশ থেকে ত্রিশের মাঝেই হবে। চুল ব্যাকব্রাশ আর বাকানো গোঁফ, লোকটাকে বেশ দেখাচ্ছে! মানুষটাকে নিয়ে তার মনের মধ্যে কৌতূহল জাগে খুব, গল্প পাতানোর শখ হয়। কিন্তু সাহস হয়না! আজাদ ব্যাপারগুলো পছন্দ করেনা!
সাপটা হ্যাজাকের আলো দেখে আর সেইদিকে আগায়না। পাগলের মতো ছটফট করে ক্ষুধায়! কিছু না পেয়ে শরীফার মুরগির ঘরের দরোজায় জোরে গুতা দেয়। পলকা টিনে বানানো দরোজা খসে পড়ে। মুরগি গুলো নারকীয় চিৎকার শুরূ করে। সাপটা সু্যোগ পায়না খাওয়ার। দূর থেকে দুমদাম পায়ের ছুটে আসার শব্দে আসতে করে পাশের ঝোপে ঢুকে পড়ে।
(৬)
নাহ, তার আর যাওয়া হলোনা। সকালে ঊঠে একবার সে ভেবেছিলো চলে যাবে। কেউ ঘুম থেকে উঠার অথবা টের পাওয়ার আগেই চলে যাবে। মানুষের বেশি কাছাকাছি যাওয়া তার মানা। ঢাকার উপর মহলে তার নাম সীমান্তের ব্যাপারী। সবাই এই নামেই তাকে চেনে। সীমান্তের কাটাতার পার করে জিনিস আনা নেওয়া করাই তার কাজ; বিশেষত যেসব সীমানায় ভিড় কম, সেখান এই কাজ করা বেশি সহজ। গতরাতেই নীলপদ্মের ব্যাপারে একটা সমাধান পাওয়া যেতো। কিন্তু অন্ধকারে ভয়ংকর দানবের মতো ওই অজগরটাই সব তালগোল পাকিয়ে দিলো! ঢাকা থেকে বের হওয়ার সময় সে খোজ খবর নিয়েই বের হয়েছিলো, এই জংগলে কোন বিপদজনক জন্তু জানোয়ার থাকার কথা না! কোথায় কোন বিপদ তার খোজ না নিয়ে সে পথে নামেনা। কিন্তু এটা কোথায় থেকে এলো কে জানে! আরেকটু হলেই জড়িয়ে ফেলেছিল! যাক বাচা গিয়েছে এবারের মতো। সমস্যা হচ্ছে নীলপদ্মটা যার দরকার সে খুব জেদি মানুষ! অনেক টাকা তাকে দিয়ে দিয়েছে এরমধ্যেই, সেগুলো খরচ ও শেষ! নাহ টাকাও বড় বিষয় নয়, কথার বরখেলাপ উনি বরদাস্ত করেন না। উনার বদ নজরে পড়লে তার মতো কত শত সীমান্তের ব্যাপারী এক রাতেই পৃথিবীর মানচিত্র থেকে হাওয়া হয়ে যায়। প্রাণের মায়া তো সবারই থাকে! কে আর চায় জীবনটা বেঘোরে যাক! আর কয়টা দিন এখানে থাকতেই হবে। আর আজাদ এখানের গঞ্জের ছোটখাটো ব্যবসায়ী। সে এরমধ্যেই তার মধ্যে লাভের গন্ধ খুজে পেয়েছে। মানুষ যখন লোভের নেশায় পড়ে তখন তাকে দিয়ে অনেক কিছুই করানো সম্ভব। সে ঠিল করে আর কয়টা দিন এখানেই কাটাবে।
সকালে যখন বাতাসে সামান্য শীত ভাব আলতো ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে যায়, সেই সময়টায়, হালকা আলোয় সে ঘর থেকে বের হয়ে সামনের পুকুরের পাড়ে এসে বসে। পাশের কোন একটা গাছ থেকে ভেসে আসছে বকুল ফুলের বাসি গন্ধ। হালকা বাতাসে তার সামান্য লম্বা চুল ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। বাসি গন্ধটার কেমন একটা মাদকতা আছে। তার মনটা কেমন কেমন করে উঠে। একটা চাপা কষ্ট কোথাও থেকে চলে আসে মাথার ভিতরে। কি নিয়ে, সে বুঝে ঊঠতে পারেনা। নিঃসংগতা নাকি পরিচয়হীনতা তা সে নিজেও জানেনা। বুড়ো উইপোকায় খাওয়া একটা গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে পুকুরের পানির দিকে নিবিষ্ট হয়ে বসে থাকে সে। মিনিটের পাল উড়িয়ে ঘন্টা পার হয়। লাল সূর্যের ছায়া পানিতে ধীরে ধীরে আগুন ধরায়। সে বসেই থাকে!
আচমকা একটা নারীকন্ঠের আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে তার। শামীমা সকালে উঠে হাসের বাচ্চাগুলো ছাড়তে এসেছিলো পুকুরের জলে। প্রথমে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে থাকা মানুষটাকে দেখে চমকে উঠেছিলো; আসলে চিনতেই পারে নাই; পরে বুঝতে পেরে ডাক দিয়েছে- “ কি করেন? এতো সকালে উঠে একা একা কি ভাবছেন?” হতচকিত হয়ে তার দিকে তাকায় সীমান্তের ব্যাপারী। কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে থাকে সে! মেয়েটাকে অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে নতুন সকালের আলোয়। চুলগুলো কিছুটা এলিয়ে আছে ঘাড়ের উপর, চোখের গভীরে মেঘের ছায়া! সে কখনো এভাবে কোন মেয়েকে বহুদিন দেখে নাই। তার মনে পড়ে অনেক কিছু, অনেকটা সিনেমার পুরানো রিলের মতো কিছু ছবি মনে খেলে যায়। মায়ের মুখ মনে পড়ে আবছা, ছোট বোনের মুখ, আর ভার্সিটি জীবনের স্বপ্নের মুখটার কথা। নাবিলা অনেকদিন অপেক্ষা করেছিলো তার জন্য, কিন্তু সেই কথা রাখে নাই! সবার কথা মনে পড়ে গেলো। এরকম কি হয়? হতেও পারে! মানুষের মন বলে কথা! তাকে এরকম ভ্যাবাচ্যাকা অবস্থায় দেখে খুব হাসি পেলো শামীমার! সে হাসি আটকাতে পারলোনা। খিল খিল করে হেসে ঊঠলো সে। সেই হাসি নারিকেল গাছের ঝিরিঝিরি পাতার মধ্যে দিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়লো আশেপাশের বাতাসে। লোকটা মনে হয় ততোটা খারাপ নয়! আজাদের মুখে সে কাল রাতে শুনেছে লোকটা অনেক জ্ঞানী! লোকটা নিশ্চয় অনেক মজার গল্প জানে! কথা বলার মানুষ এই বন জংগলের দেশে খুব কম! গল্প করার শখ জাগে তার মনে। সীমান্তের ব্যাপারী ও গল্প করতে চায়। বহুদিন সে গল্প করেনা। মেয়েদের সাথে বসে গল্প করা তো অনেক দূরের ব্যাপার। আজ তারো গল্প করতে মন চায়৷ সীমান্তের ব্যাপারীর একটা মজার গুণ আছে, সে চাইলেই মুখে মুখে ছড়া বানাতে পারে। এরকম লাইন বানিয়ে সে ঢাকার অনেক মোটা বুদ্ধির ধনীলোকের মুগ্ধতা অর্জন করেছে। আজ তার মনে হলো শামীমাকে নিয়ে একটা ছড়া বানায়। একটু ভেবে সে হেসে বললো-
আইলো কন্যা গৌরবর্ণ মনে সাদা আলো,
লতাপাতা পাখি নিয়ে গল্পে আলো জ্বালো!
এইবারো কাজ হলো। শামীমার মনে হলো মানুষটা আসলেই মজার লোক। খানিকটা রহস্য মানব হতে পারে! রহস্য কে নিয়ে কৌতূহলী না হয়ে পারা যায়না। তার আগ্রহ বেড়ে গেলো আরো। আসলেই মানুষটাকে জানতে হবে।
আজ আজাদের ঘুম ভাংগতে দেরি হলো বেশ খানিক ক্ষণ। গত রাতে অনাকংখিত অতিথির সাথে কথা বলতে গিয়ে ঘুমাতে দেরি হয়ে গিয়েছিলো অনেক। সকালে উঠেই সে প্রথমে বাইরের ঘরে উঁকি দিলো, না লোকটা নেই! অবাক হলো সে। কান পাততেই পুকুরের পাশ থেকে শামীমার গল্পের আওয়াজ পেলো। আজাদ কিছুটা খুঁতখুঁতে স্বভাবের মানুষ। সবকিছু আড়াল থেকে যাচাই করতে ভালোবাসেন। আজো তিনি যাচাই করার জন্য পুকুর পাড়ে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে শোনার চেষ্টা করলেন। সীমান্তের ব্যাপারী তখন শামীমাকে ঢাকায় তার বাসা আর পরিবারের কল্পিত বর্ণনাশোনাচ্ছিল। গুলশানের কল্পিত ফ্ল্যাট, তার পা পিছলানো টাইলস, ঝকঝকে কিচেন, তার কল্পিত স্ত্রীর কথা, ব্যবসার কথা। সে উপমা দিয়ে বোঝাচ্ছিলো কতো বড় সে গুলো। তার কল্পিত গল্প গুলো হা করে গিলছে শামীমা। জীবন এতো ঝলমলে হয়?সত্যি হয়! মানুষের কতো অর্থ! আজাদ ও স্থির থাকতে পারেনা। এই লোকটাকে ম্যানেজ করতে পারলে তার ব্যবসাটা দাঁড়িয়ে যাবে। হাজার হোক তাকে তো তারাই বাচিয়েছে। এটুকু কৃতজ্ঞতা সে আশা করতেই পারে। আড়াল থেকে বের হয়ে এক গাল লম্বা হাসি নিয়ে তাদের সাথে গল্পে যোগ দেয় আজাদ। কিছুক্ষণ গল্প করার পর সে আবার আগের রাত্রির পুনুরাবৃত্তি করে- “তো তারপর কয়দিন থাকছেন তো ব্যাপারী সাহেব গরীবের বাড়িতে!” সীমান্তের ব্যাপারীর ব্যবসার নিয়ম হচ্ছে মানুষের থেকে দূরে থাকা। কিন্তু যা নিষেধ, মানুষ তো সবসময় তা মেনে চলতে পারেনা। তবে সে জানে প্রথম অনুরোধে রাজী হয়ে গেলে তা সবসময় সুন্দর ভাবে দেখা হয়না। আর এখনো কাজটা হয় নাই! এদের বাসায় না থেকে বনে ঘোরাঘুরি করলে সন্দেহ জাগতে পারে সবার মনে। নীলপদ্ম পেয়ে গেলেই সে এখান থেকে হাওয়া হয়ে যাবে! আজ পেলে আজই! তাই কয়েকবার থাকার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ার পর আজাদের অত্যধিক পীড়াপীড়িতে রাজী হয় সে। ব্যাপারটা এমন যে তার ইচ্ছা নয়, বরং আজাদের ইচ্ছাকে সন্মান দেখাতেই সে এখানে দুই একদিন থাকতে রাজী হলো! আগেই বলেছি আজাদ খুব খুতখুতে। থাকতে বললেও একদিনের অচেনা মানুষকে একা স্তীর সাথে রেখে যাওয়ার মতো বোকা নয়। তাই ব্যাপারীকে বারবার তার দোকান দেখার জন্য গঞ্জে যেতে অনুরোধ করে। সব বুঝতে পারে ব্যাপারী। গঞ্জে যেতে রাজী না হলেও, সে জানায় যে আবার বনে খুজতে যাবে সে! সারাদিন নীলপদ্ম খুজতে হবে সারাদিন। আসতে আসতে রাত হবে বেশ। এই বলে তার বাইনোকুলার আর ঝোলা নিয়ে রেডি হয়ে পড়ে তারাতারি। এটাকে অন্তত গ্রহণ্যোগ্য মনে হয় আজাদের কাছে। সেও তার দোকানে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে। আজ এমনিতেই দেরী হয়েছে বেশ!
(৭)
আঁকা বাকা রাস্তাটা শামীমাদের বাড়ি থেকে বনের বুক চিরে চলে গিয়েছে আলতাদিঘীর তীরে। একজন স্থানীয় ভ্যানয়ালা কে ঠিক করে তাতে চড়ে বসে ব্যাপারী। আলতাদিঘীর পাড়ে গতকাল সন্ধ্যায় তার দেখা করার কথা ছিলো মুসা ফকিরের সাথে। মুসা ফকির এই এলাকায় বিখ্যাত না হলেও সবার চেনা। না সে কোন অতিন্দ্রীয় ক্ষমতার অধিকারী কেউ নয়। কারো কোন অলৌকিক উপকার তাকে করেতে দেখেনি কেউ। তবুও সবাই তাকে ভয় পায়। রহস্যে ভরা একজন মানুষ, আলতাদিঘীর গভীর বনে দিন রাত তার আসা যাওয়া! মানুষ বলে ফকির নাকি বনে ধ্যান করেন! সবই শোনা কথা। কারো কারো চোখে সে এক নিখাদ পাগল। তার সাথেই দেখা করার কথা ছিলো গতকাল। মাঝখানে অজগরটাই যতো অনর্থ পাকালো। আরেকবার আজ দেখা পেলে ওটার মাথাটাই থেতলে দেবে ভাবে সে! কপাল ভালো হলে হয়তো ফকিরটার দেখা পেতে পারে। তাই যেন হয়, নাহলে অসীম দুর্গতি হবে!

রাস্তায় ছুটে চলে ভ্যানটা। দুইপাশে ঘন বন দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে। মাথার উপর ঘন ছায়া হয়ে ছড়িয়ে আছে বয়সী গাছেদের মাথা। আলো নীচের রাস্তা অবধি পৌছায়না সবখানে! মাঝে মাঝে বৃষ্টির মতো ব্যাপারীর মাথার উপর ঝরে পড়ছে রাতের জমানো শিশির! সে অভিভূত হয়। রাস্তার পাশে সাদা আলোর মতো জ্বলছে বুনো ভাটের সাদা ফুল। কিছুটা আনমনা হয়েই আবার বাস্তবে ফিরে আসে সে! তার জানা নেই ফকির কই থাকে। সম্ভবত সারা এলাকা আবার খুজতে হবে। আলতাদিঘীর পাড়ের সামান্য আগেই খোয়া বিছানো রাস্তাটা শেষ হয়ে গিয়েছে, সেখানেই নেমে পড়ে ব্যাপারী। আশেপাশের বহুদূরে গাছ ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ছেনা। মাঝখানে পাখির কালো চোখের মতো টলমল জল নিয়ে বয়ে যাচ্ছে আলতাদিঘী। মন উতলা হয় তার, কেন হচ্ছে এমন সে বোঝেনা। হয়তো প্রথম সকালের রেশ এখনো কাটছেনা। শামীমা মেয়েটা বড় সুন্দর! কেমন মায়ার একটা প্রলেপ ফেলে দিয়েছে তার কর্কশ মনের উপর! নিজের মনেই মাথা নাড়ায় সে। নাহ! এসব ঝামেলায় জড়ানো যাবেনা কোনমতেই। একবার হইচই পাকলে সাড়ে সর্বনাশ হবে তার! ভুয়া পরিচয়টা দিয়ে দুই একদিন কাটানো যেতে পারে তার বেশি নয়। আর সীমান্ত এলাকা এটা, কতো রকমের গুপ্তচর আছে তার তো ঠিক ঠিকানা নাই। চোখে দেখা যাচ্ছেনা বলে যে তারা নেই, এমন নয়! সে দিঘীটার এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত টহল দিয়ে আসে, কিন্তু ফকিরের দেখা পায়না! একজন সাঁওতাল মেয়ে পানিতে কাপড় ধুচ্ছিল একপাশে। তাকেই জিজ্ঞাসা করে ফকিরের কথা। মেয়েটি হেসে বলে-“ ফকির তো একটু আগে অইদিকে চলে গেলো, বর্ডারের দিকে!” তাড়াতাড়ি সেইদিকেই পা বাড়ায় সে। পিছন থেকে মেয়েটি বলে সাবধানে যাবেন! ওইখানে কিন্তু গোলাগুলি হয়। পাত্তা দেয়না ব্যাপারী, খুব জোরে হাঁটা দেয়। আজ কাজ সারতেই হবে।

সামনে বনটা হঠাৎ বেখাপ্পা ভাবে শেষ হয়ে গিয়েছে। মাইল দুয়েক লম্বা ফসলের মাঠটার পরেই রাক্ষসের মতো কাঁটাতারের বেড়া দাঁড়িয়ে আছে। এটা নোম্যান্সল্যান্ডের জমি। এতো খেয়াল রাখার মতো মনের অবস্থা তার নেই। সে শুধু মুসা ফকিরের দেখা চায়। হনহন করে সে হাটা দেয় সীমানার দিকে। এখানের সীমান্তরক্ষীরা এমনিতেই মানুষের আনাগোনায় অভ্যস্ত। সবসময় কিছু বলেনা। তবে ব্যাপারীকে এভাবে হাটতে দেখে সম্ভবত তাদের সন্দেহ হয়। গুলি চালায় আচমকাই! ব্যাপারী যেখানে ছিলো সেখানেই স্থির হয়ে যায় পাথরের মতো। আশেপাশের মাটিতে ইতিমধ্যে গুলি গেঁথে গিয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে তার গায়ে লাগে নাই এই যা! খোলা মাঠের মধ্যে কোনদিকে যাবে বুঝে উঠতে পারে না সে। সম্ভবত পরের গুলিটা তাকে ভেদ করবে ভেবে ফায়ারিং স্কোয়াডের বন্দীর মতো দাঁড়িয়ে যায় সে। হঠাৎ তার হাত ধরে হেচকা টান মারে একটা লোক। ময়লা লুংগী আর চাদর থেকে ভকভক করে দুর্গন্ধ বেড়োচ্ছে। মাথায় ময়লা চুল আর মুখে ছন্নছাড়া দাড়ি। বয়স বেশি নয়, চল্লিশ ছুই ছুই। সম্ভবত তার গায়ের বোটকানো গন্ধেই সম্বিত আসে ব্যাপারীর! এবার আর ভুল করে না! ভদ্রলোকের মতো তার সাথে সাথে ফিরে চলে আসে বাংলাদেশের সীমানার ভিতর। সম্ভবত তাকে থেমে যেতে দেখে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলো সীমান্তের টহলদাররা। পর্যটক ভেবে থেমে গিয়েছে, অথবা নিতান্তই মায়াবশত ছেড়ে দিয়েছে।
আলতাদিঘীর পাড়ে এসে দাড়িওয়ালা মানুষটি জানতে চায়-“ বাপ, তুমি কোন মদনা রে? বেয়াকুবের মতো মরতে লাগছিলা!” মুখ খুলতেই গাজার ঝাঁজ টের পায় ব্যাপারী। সে তার কৌশলে আগায়। জিজ্ঞাসা করে-“ আপনার নাম?”
“তুমিতো দেখি জব্বর বেয়াদব! আমারে জেরা করতে লাগছো! আমি মুসা ফকির! এই এলাকার কোন লোক এর হিম্মত নাই আমারে জেরা করে। এক্কেরে....
“ আমি সীমান্তের ব্যাপারী। নীলপদ্ম নিতে আসছি। ঢাকা থেকে আপনার সাথে কথা হয়েছে নিশ্চয়? আপনার কোড?”
দুইজন দুইজনের সাংকেতিক কোড জেনে নেয় ফিসফিস করে। তারপর ফকির বলে মুখ বন্ধ রেখে তাকে অনুসরণ করতে। জংলা পথে খানিক হেটে একটা সাওতাল বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায় তারা! তারপর ফকিরের ইশারায় সামনের টিনের ঘরে ঢুকে পড়ে! এটা দীপেন হেমব্রং এর ঘর! তাড়াতাড়ি একটা টুল এনে মাচাং এর উপর থেকে কয়েকটা জিনিস নিয়ে আসে সে! ব্যপারী দেখতে পায়, আতরের ছোট শিশির আকারের কয়েকটা বুদ্ধ মূর্তি, পদ্মাসনে বসা আকৃতি। রঙ দেখেই বোঝা যাচ্ছে খাঁটি সোনার! ফকির একটা নিয়ে ব্যাপারীর হাতে দিয়ে বলে-“ মাল বুঝায় দিলাম। এখন যতো তাড়াতাড়ি পারেন এলাকা ছাড়েন! পুলিশে টের পাইলে কিন্তু দুইজনেই শেষ! খুব পুরাতন জিনিস! সম্রাট অশোক নাকি তিব্বতে উপহার পাঠাইছিলেন এগুলা! ওইখান থেকে আসাম হয়ে এদিকে আসছে! এখন যান তাড়াতাড়ি! বিদায় হোন।“
স্বাভাবিক মানুষের মতো শিস দিয়ে গান গাইতে গাইতে আলতাদিঘীর পাড়ে রাখা ভ্যানে এসে বসে ব্যাপারী। এইবারে ফিরতে হবে। বেশি দেরী হলে জয়পুরহাটের বাস মিস হয়ে যাবে। এইরকম জিনিস পকেটে রেখে ঘোরা আর ক্রসফায়ারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একই জিনিস! ভ্যানওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করে ব্যাপারী একেবারে ধামুরহাটে যাবে কিনা। সেখান থেকেই জয়পুরের বাস পাওয়া যায়। ব্যাটা ত্যাঁদড়, রাজী হয়না। তার নাকি ক্লান্তি লাগছে। ব্যাপারী তাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে ধামুরহাটের ভাড়া সে নেয় দুইশ টাকা। কিভাবে বাঙ্গালিকে রাজী করাতে হয়, তা ব্যাপারির ভালোই জানা আছে। সে তাকে বলে- “ তোমাকে পাঁচশ টাকা দিব! তাও যাবেনা?” উত্তরে বাতাস হঠাত দিক বদলে ফেলে। আর ভ্যানওয়ালার ও মন বদলে যায়। দাঁত কেলিয়ে যেতে রাজী হয় সে।
(৮)
সকাল থেকেই ঝড়ো বাতাস বইছে এই জনপদে। বাঁশের ঝাড়ের সবগুলো বাঁশ বাতাসের তালে তালে নাচানাচি করছে। নারিকেলের পাতাগুলোর ফাঁক দিয়ে শো শো শব্দে বাতাস উড়ে বেড়াচ্ছে। আর উড়ে বেড়াচ্ছে শামীমার মন। শান্ত মনটা অকারণেই উতলা হয়ে আছে সকাল থেকে। গল্প করার কোন মানুষ নাই তার। সকাল থেকে সন্ধ্যা কাটে একঘেয়ে ঘুঘুদের ডাক শুনে। বোনগুলোও নিজেদের সংসার নিয়ে এতো ব্যস্ত! আর আজাদ তো সেই রাতে আসে আর ভোরে চলে যায়! সে খুব একা! ভেবেছিলো লোকটার সাথে গল্প করবে অনেক। বলা তো যায়না বন্ধুত্ব ও হয়ে যেতে পারে এভাবে। হয়তো খুব ব্যস্ত লোক! অনেক নামীদামী লোক! তবুও অবসরে যদি তার কথা ভুলে মনে পড়ে। গল্প তো করতেই পারে! তার মন বলছিলো ব্যাপারী তাড়াতাড়ি ফিরবে। কিন্তু কেন বলছিলো সে নিজেও জানেনা। মন কি আর সবসময় যুক্তি মানে! সে কিছুক্ষণ পর পর সামনের রাস্তায় এসে উঁকি দিচ্ছিলো। যাওয়ার তো মোটে একটাই রাস্তা, আসলে এ পথেই আসতে হবে। কোন কাজ আজ হচ্ছিলো না তার ভালো মত।
আকাশে মেঘ জমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি নামবে! লোকটা আবার বনের পথে কোন বিপদে পড়বে কে জানে! একটু পর পর সামনের রাস্তায় এসে উঁকি দেয় সে। দুপুর ২টার দিকে দূরে বনের এক পাশের রাস্তার মাথায় একটা ভ্যান দেখা যায়। আনন্দে ছলকে উঠে তার মন। যাক এতোক্ষণে লোকটার দেখা মিললো!
তাড়াতাড়ি এলাকাটা পার হতে হবে। সীমান্তের ব্যাপারী চায়না এখানে থামতে। শামীমার কাছে থেকে একবার বিদায় নিতে পারলে ভালোই হতো! মেয়েটা সুন্দর গল্প করতে পারে! হাতে কাজ না থাকলে কারণে অকারণে গল্প করা যেতো। কিন্তু পকেটে নীলপদ্ম নিয়ে এখানে থামা ভয়ংকর ঝুকির কাজ হবে! পথের মধ্যে এমন অনেক মানুষের সাথেই তার দেখা হয়! সবার জন্য মন কাঁদলে তো ব্যবসা লাটে উঠবে। ভ্যানওয়ালা কে তাড়া দেয় সে, তাড়াতাড়ি জায়গাটা পার করতে। মাথা নীচু করে থাকে, দৃষ্টি রাখে ভ্যানের পাটাতনের উপর। এ এক মানুষের আজব স্বভাব! কাউকে বা কোন কিছুকে এড়াতে চাইলে তারা মাথা নীচু করে থাকে, ভাবে কেউ তাকে দেখছে না! সম্ভবত এটাও মানুষের এক আদিম প্রবৃত্তি। কালো মেঘ ঘন হয়ে আসে তার মাথার উপর! ভ্যানওয়ালা জোরে টান দেয় সাধ্যমতো। ভাটফুলের ঝোপের আড়ালে বুনো শ্যাওড়া গাছের কোণায় দাঁড়িয়ে ছিলো শামীমা। অপেক্ষা করছিলো, কখন ভ্যানটা এসে পৌছায় তার অপেক্ষায়। কিন্তু তার বাসার সামনে এসে যখন সেটা থামলো না, ঝড়ের গতিতে ছুটতে লাগলো, তখন সে ভাবলো নিশ্চয়ই ব্যাপারী মনে করতে পারছে না তার বাসার সঠিক অবস্থান। শামীমা পিছন থেকে জোরসে চিৎকার করলো- “ওই ভ্যান দাঁড়াও! দাঁড়াও!” চালক ব্রেকে কষে চাপ দিতেই থেমে গেলো চাকা!
মানুষের ভাবনা মতো যদি সব হতো, তাহলে তো গতকাল ব্যাপারী অজগরের খপ্পরে পড়তোনা। আজ সে ঢাকায় থাকতো এতোক্ষণ! কিন্তু ওই যে হয়না সব! আজকে আবার সে আটকা পড়বে হয়তো। শামীমা দৌড়ে সামনে এসে জানতে চায় সে পথ ভুলে গিয়েছিলো কিনা! বন জংগলের রাস্তা, খেই রাখা মুশকিল! ব্যাপারী হেসে বললো- “নারে ভাই ঢাকা থেকে জরূরী ফোন এসেছে! এক্ষুণি যেতে হবে! দেরি করার উপায় নাই।” এভাবে আশাহত হতেহবে ভাবে নাই শামীমা! সম্ভবত তার আশাকে বাঁচানোর জন্যই ঝড় এর আভাস আসে বাতাসে। বনের গাছগুলোর উলটানো পাল্টানোর কড়া শব্দ আসতে থেকে পিছন থেকে, অনেকটা পটকা ফুটার মতো! মেঘের কালো ছায়া চলে আসে রাস্তার উপর। ঝড় আসছে! বড় ঝড়! শামীমা বলে-“ এখন যাওয়ার চিন্তা বাদ দেন। এখন এই রাস্তা দিয়ে গেলে হয় বাজ পড়ে মরবেন নয়তো গাছ পড়ে! কোনটাই খুব সুখের জিনিস না। ঝড় থামুক, তারপর যান!” ব্যাপারী তখনকার মতো থামে। ভাবে পরে বিকাল বেলা না হয় বের হবে। এই ঝড়ে আসলেই যাওয়া সম্ভব নয়!
ঝড় বেড়ে গিয়েছে অনেক। দূরের বনের সবগুলো গাছ মনে হচ্ছে উড়ে উঠবে উতলা বাতাসে। আশেপাশের দুই একটা কলাগাছ ভেংগে পড়ছে দুমদাম। দূরে একটা তালগাছের মাথা অদ্ভুত ভাবে নুয়ে পড়ছে। শামীমার ঘরের বারান্দায় বসে থাকতে থাকতে একটু ভয়ই পায় ব্যাপারী। যদি ঝড় এই ঘরের টিনের ছাদটাও উড়িয়ে নেয় এখন! উড়াতেই পারে! খানিকটা আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকে সে। সামনেই বসে আছে শামীমা, কিছুটা দূরে একটা ছোট টুলের উপর। তার মন ভালো নাই। সে বুঝতে পেরেছে লোকটা পালাতে চেয়েছিলো সম্ভবত। সেই গায়ে পড়ে আটকিয়েছে। নিজেকে আত্মসন্মানহীন মনে হয় খুব। কেন সে আটকাতে গেলো? আসলে একাকিত্ব তাকে খুব দুর্বল করে ফেলেছে। সম্ভবত মন কোন কথা বলার মানুষ খুঁজছিল। আর আজাদ ও চায় লোকটা থাকুক। সেতো বড় ভুলের কিছু করে নাই; নিজেকে প্রবোধ দেয় শামীমা! ঝড় সব উলট পালট করে; জঙ্গলাকীর্ণ এ গ্রামের সব গাছেদের নাড়িয়ে দেয়, আর উলট পালট করে দেয় ব্যাপারীর মন! তার হঠাত সামনের মানুষটার সাথে কথা বলার ইচ্ছা জাগে। বহুদিন সে কোন মেয়ের সাথে মন খুলে কথা বলেনা। পকেটে টাকা থাকলে ঢাকার এক হোটেলে গোপনে তার যাতায়াত আছে। টাকা খরচ করলে মেয়েদের ও পাওয়া যায়; সে ডাকেও তাদের মাঝে মাঝে! উগ্র প্রসাধনী আর শরীরে উৎকট বডি স্প্রে ছড়িয়ে, আশেপাশের বাতাসে এক ধরনের অস্বস্তি ছড়াতে ছড়াতে তারা আসে। শরীরের প্রয়োজন মেটে বটে কিন্তু মন? নাহ, মনের কেনা বেচা তারা করেনা! গল্প শুনতে বা শুনাতে তারা আসেনা। কাজ সেরে চোখ মুখ শক্ত করে, চোখে মুখে একগাদা ঘৃণা নিয়ে চলে যায় তারা! মনটা তার একাকী বেঁচে আছে বহুদিন হলো। আজ এই ঝড়ের উন্মাদনায় তারো মন একটু পাখা মেলতে চায়। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর অস্বস্তি কাটাতে ব্যাপারীই মুখ খুলে। সে শামীমাকে স্বগোতক্তির মতো বলে- “ঝড় কি এখানে প্রায়ই হয় এরকম? আপনাদের ভয় লাগেনা এরকম জায়গায় থাকতে? একেতো জঙ্গল চারিদিকে! তার উপর এইরকম আবহাওয়া!”
“ভয় লাগবে কেন? আমাদের জন্মস্থান এটা! এর মাটি, গাছ পালা, পানি সবই আমরা চিনি। আপনাদের শহরের মানুষের চেয়ে এখানের মানুষ অনেক ভালো; অত মিথ্যাবাদী না!”

মিথ্যাবাদী শব্দটা ঠাস করে বাজে ব্যপারীর কানের পর্দায়। ছদ্ম পরিচয়ে থাকার এই এক সমস্যা। সব কথাতেই সন্দেহ হয়। মনে হয় এইতো সবাই জেনে যাবে সব! অস্বস্তি গলায় নিয়ে সে জানতে চায় শামীমা মিথ্যাবাদী কেন বলছে শহরের লোককে!
শামীমা বাঁকা হাসি দিয়ে বলে- “এই যে আপনি!! সকালে গল্প করতে গিয়ে একবার বললেন আপনার বউ গুলশানে একটা বুটিক না কিসের জানি দোকানের মালিক! আবার তার পরক্ষণেই বললেন ঢাকা ভার্সিটিতে চাকুরী করে! আবার শেষে বললেন বাসাতেই থাকে, একটু অসুস্থ মানুষ! কিছুই করেনা! এক বউ তিন রকম হয় কিভাবে? নাকি তিন বউ! নাকি বিয়েই করেন নাই? যাই হোক, মিথ্যা বলার কি দরকার!”

কথাটা বলেই অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে থাকে শামীমা। মেয়েদের এই পুরূষ মানুষ গুলো যতোই বোকা ভাবুক, আসলে তা তারা কখনোই নয়। হয়তো মায়ার চোখে সব তারা দেখে। তাই পুরুষের কথা আর কাজের সব অসঙ্গতিই তাদের চোখে ধরা পড়ে যায়, কিন্তু মেয়েরা সবসময় বুঝতে দেয় না যে তারা সব বুঝে গিয়েছে। সম্ভবত মায়ার জালটাকে তারা সবসময় ছিড়তে চায়না। এরকম ভুল সাধারণত ব্যাপারী করেনা। তুখোড় অভিনেতার মতো সব সামলে নিয়েছে সবসময়। আজ এই অজগ্রামের একটা মেয়ের সামনে ধরা পড়ায় ভিতরে ভিতরে বেশ অপ্রসতুত হলো সে। কিন্তু বহুদিনের অনবরত চর্চার অভ্যাসবশত অভিনয় চালিয়ে গেলো। ঠোঁটের কোণে খানিকটা অনুশোচনার হাসি এনে বললো- “আসলে আপন বলতে সেভাবে কেউই নাইতো। দেশের নানান জায়গাই যাই গাছপালা খুঁজতে। সবসময় অবিবাহিত বললে অনেক ঝামেলায় পড়ার সম্ভাবনা থাকে। বোঝেনই তো!”
হুম! এতোক্ষণে বুঝতে পারে শামীমা। স্বাভাবিক হয় সে। গল্প শুরু করে প্রাণ খুলে। কতো কিছু নিয়ে গল্প করে তারা; আলতাদিঘীর দৈত্য-দানো থেকে শুরূ করে বোন শরীফার বজ্জাত জামাই, সবাইকে নিয়ে তার জমানো গল্প শোনাতে শুরূ করে সে। বহু বছরের জমানো গল্পের প্রসবণ আজ শ্রোতা পেয়ে নেমে আসে মনোলোক থেকে বস্তুলোকে। পাশের জমিটাতে একা একাই ঝরে পড়ে অনেকগুলো বকফুল। তাদের শক্ত পাপড়ি মাটিতে পরে মানুষের পায়ের মতো থপ থপ শব্দ হয়। শামীমার গল্প থামেনা। ব্যাপারী শোনে, এজন্য নয় যে গল্পের কাহিনী গুলো খুব অনন্য! কিন্তু তার শুনতে ভালো লাগে। মেয়েটার ফর্সা মুখে কালো চুল এলিয়ে পড়ে যতোবার, ততোবারই মুগ্ধ হয় ব্যাপারী। হয়তো আজ রাতেই বা কাল সকালেই তাকে ছাড়তেই হবে এই এলাকা, কিন্তু এই গল্পের সম্মোহন উপেক্ষা করতে পারেনা সে! অথবা মেয়েটার আকর্ষণ! শামীমা তার কাছে জানতে চায় সে নীলপদ্ম খুজে পেয়েছে কিনা। মাথা নাড়ায় আজাদ, পায়নি এখনো। অবাক হয়ে শামীমা বলে-“ তাহলে চলে যাচ্ছেন যে? সব জায়গা দেখেছেন ভালো করে?”
-“দেখেছি! পেলাম নাতো! হয়তো গুজব ছিলো!”
-“আপনি নতুন মানুষ সব জায়গা চিনেন নাতো! আমাকে সাথে নিয়ে যাবেন কাল? আমি আলতাদিঘীর সব এলাকা চিনি। আর ওখানে আমার এক বান্ধবী থাকে লক্ষী টুডু। ওকে নিয়ে আমরা আবার সব খুজবো! যাবেন আমাদের সাথে?”
কথাটা বলে এক আকাশ আশা নিয়ে ব্যাপারীর দিকে তাকিয়ে থাকে মেয়েটা। সে কিছুক্ষণ মেয়েটার চোখে চোখ রাখে, সেখানে মায়ার জল টলমল করছে। এরকম চোখের দিকে তাকিয়ে কখনো না বলা যায় না! মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে সে। আনন্দে একহাত লাফিয়ে উঠে শামীমা! আজাদ তার বনে বাদাড়ে যাওয়া একদম ভালোবাসে না। কিন্তু যে মানুষ সারাদিন থাকেইনা তার পছন্দ অপছন্দে জীবন সাজানো চলে না! জীবন তার নিজের পছন্দেই চলে। আজাদ বাসায় না থাকলে বোনদের নিয়ে কিংবা লক্ষীকে ডেকে এনে তার সাথেই প্রায়ই বেড়িয়ে যায় সে। বোন শরীফার বাসা পাশে হওয়ায় সুবিধাই হয়েছে তার, বাচ্চাগুলোকে কিছুক্ষণের জন্য তার কাছেই রাখতে পারে। এসব ভাবতে গিয়ে হঠাত তার মনে হলো ব্যাপারীকে সে দুপুরের খাবার দেয় নাই এখনো! জিহবায় কামড় দিয়ে সে দৌড় লাগালো রান্নাঘরের দিকে। আর ব্যাপারীর মনে অকারণে ঝড় উঠেছে। যে ঝড়কে সে সবসময় ভুলে থাকতে চায়। আচ্ছা শামীমার চোখ গুলো কি অনেকটা নাবিলার চোখের মতো। ওর মতোই কথা বেশি বলে সে! অনেকদিন অপেক্ষা করেছিলো মেয়েটা, আজো কি অপেক্ষা করে? যৌবনের বহু বিকাল তার সাথে স্মৃতি হয়ে জমে আছে বুকের কোণাটায়, যেমন জমে থাকে ঝড়ের মেঘ। নাবিলার মোবাইল নাম্বারটা কি এখনো আগেরটাই আছে? নাকি বদলে ফেলেছে! নাবিলার মোবাইল নাম্বারটা সবসময় মুখস্থ থাকতো তার, আজো আছে! কিছুটা ঘোরের বশে মোবাইল ফোন বের করে কাঁপা হাতে সেই নাম্বারে বার্তা লিখলো ব্যাপারী- “ভালো আছো নাবিলা?”

আজাদ আজ আগেভাগেই ফিরতে চেয়েছিল। কিন্তু ঝড় বৃষ্টির তোড়ে আসতে আসতে বেলা পড়ে এলো। সে যখন পৌছালো সূর্য তখন প্রায় অস্ত গিয়েছে। দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে পুকুরের পাড়ে বসে গল্প করছিলো শামীমা আর ব্যাপারী। এর মধ্যেই শামীমা এক মজার খেলা আবিষ্কার করে ফেলেছে। সে একেকটা গাছ দেখিয়ে ব্যাপারীকে জিজ্ঞাসা করে তার নাম। প্রথম প্রথম সে ভড়কে যাচ্ছিলো! না পারলেই শামীমা বলছিল –“ আরে ভাই আপনি নাকি গাছপালা খুঁজে বেড়ান? এই গাছের নাম জানেননা!” পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন উঠলেই ব্যাপারীর নিরাপত্তা নিয়ে ভয় জাগে। সে ঘাবড়ে গেলেও এবারেও সামলে নিল। শামীমাকে হেসে বলল-“সব গাছের আঞ্চলিক নামতো বলতে পারবোনা। তবে ইংরাজী নাম জানি। ইংরাজীতে পড়েছি তো!” তারা যখন এভাবেই গাছপালা নিয়ে গল্প চালাচ্ছিলো সেই সময় পৌছালো আজাদ। দূর থেকে তাদের এই গল্প করা দেখে অসম্ভব বিরক্ত হলো আজাদ। এইজন্যেই লোকে বলে মেয়ে মানুষের বুদ্ধির অভাব আর মাথায় শয়তান ঘোরে! আচ্ছা এটার হিসাব পরে করবে সে। আগে আজকের মধ্যেই নীলপদ্মের খোঁজ বাগাতেই হবে; সোজা রাস্তায় না বললে বাঁকা রাস্তা আছে। নীলপদ্মের হদিস না দিয়ে আজাদের এলাকা সে ছাড়তে পারবেনা। সে নিশ্চয়ই জানে, ভান করছে না জানার! যুগপৎ রাগ ও ক্ষোভ মনে নিয়েও মুখে হাসি মেখে নিয়ে পুকুর পাড়ে এগিয়ে যায় আজাদ। তাকে দেখে ভীষণ অপ্রস্তুত হয় শামীমা। কি নেশায় সে এতোক্ষণ মজে ছিলো নিজেও বুঝতে পারেনা। কিন্তু এই ভর সন্ধ্যা অবধি অচেনা মানুষের সাথে পুকুর পাড়ে গল্প করা যে তার স্বামী ভালোভাবে নেয় নাই তা সে বুঝতে পারে ভালোমতোই। কথা না বাড়িয়ে বাড়ির ভিতর চলে যায় সে। আজাদ সোজা সাপটা কথা শুরু করে-“ব্যাপারী সাহেব, নীলপদ্ম পাইলেন?”
-“না। পাই নাই ভাই। অনেক খুঁজলাম!পেলাম না। ভাবছি চলে যাবো আজ রাতেই ঢাকা!”

-“কিন্তু রাতে তো এই রাস্তা নিরাপদ না! অজগরে মারে নাই বলে মানুষ যে মারবে না, তার কোন গ্যারান্টি আছে বলেন। আজ রাত থেকে যান, কাল না হয় দুইজনে মিলে আরো লোকজন নিয়ে খুঁজব! ঢাকা থেকে যখন এতোদূর আসছেন, এমনি এমনি তো আসেন নাই!”

আজাদের কথার প্রচ্ছন্ন হুমকি টের পায় ব্যাপারী। তবুও মাথা ঠাণ্ডা রাখে সে। জানে এই ধরনের লোক খুব সহজে ছাড়েনা। শুধু তাকিয়ে থাকে আজাদের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করে সে। এখান থেকে এখন বের হওয়ার উপায় হচ্ছে এর কথা মেনে নেয়া। অন্তত সারা রাত আর সকাল পাওয়া যাবে উপায় বের করার জন্য! সে ভয়ের কোন লক্ষণ দেখায় না চোখে মুখে। সন্তুষ্টির ভঙ্গিতে বলে-“ তাহলে ত খুব ভালো হয় ভাই! যদি নীলপদ্ম পেয়ে যাই আপনার ব্যাপারটাও আমি দেখব।“
আজাদ হাসে। সে ব্যবসায়ী মানুষ, তাই ব্যবসার চুক্তি ভালোই বোঝে। বাঙ্গালী কে সোজা রাস্তা দিলে সেখান দিয়ে যায়না, সে জানে! আর জিনিস হাতে না আসা পর্যন্ত একে চোখে চোখে রাখা দরকার। শরীফার স্বামী যে তার ভায়রা ভাই, দুলু একটু দূরে এসে দাঁড়িয়েছিল। খোদার খাসীটা সম্ভবত তাদের কথা শোনার মতলবে আছে। ওকে কাজে লাগালে কেমন হয়! ইশারায় তাকে ডাক দেয় এদিকে। চোখ ইশারা করে বলে-“ব্যাপারী ভাই আমাদের অতিথি। উনি বড় ব্যবসায়ী মানুষ, এখন থেকে দেখে দেখে রাখেন! জংগলের দেশ! আপনি একটু উনার বডিগার্ড হিসেবে থাকেন। আজ রাত উনার সাথেই থাকবেন।“
চোখের ইশারা বুঝে মাথা নাড়ে দুলু। সমস্যাটা অনেক বেশি প্রকট হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারে ব্যাপারী। রাতেই বের হতে হবে যে করেই হোক। যদি আসলেই এই লোক তার সাথে থাকে তো সমস্যা! দরকার হলে এটাকে ঘুমের মধ্যে দম বন্ধ করে দিয়ে তাকে বের হতে হবে। নিজের উপর খুব রাগ হয় তার। তার ব্যবসার নীতি ই এই, কারো প্রতি দুর্বল হওয়া যাবেনা। আর সে একটা অচেনা মেয়ের অনুরোধ রাখতে গিয়ে এ কোন ঝামেলায় পড়লো। তারপরও স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে স্বাভাবিক থাকলো সে। শুধু প্যান্টের পকেটে রাখা নীলপদ্মটা অস্বাভাবিক অস্বস্তি তৈরী করছে। মনে হচ্ছে মূর্তিটা অনবরত খোঁচা দিচ্ছে তার উরূতে। মানুষ যখন কিছু লুকিয়ে রাখতে যায় তার সমস্ত মন ওই দিকেই যায় বারবার। তবুও সে স্বাভাবিক হাসি হেসে আজাদ আর দুলুকে অনুসরণ করে। একফাকে মোবাইলে একটা কোড চেপে পাঠিয়ে দেয় ঢাকায়! ওরা খবর পেয়ে যাবে যে ও সমস্যায়। জিপিএস ট্র্যাকার কাজ করলে ওরাই খুঁজে বের করার ব্যবস্থা করবে তাকে। আজাদ ব্যাপারীকে দুলুর হেফাজতে রেখে পাশের ঘরে চলে গেলো।
শামীমা রান্না ঘরেই কাজ করছিলো। সে শামীমাকে ডাক দিলো জোরে। আজাদের বৃদ্ধ দাদু প্রায়ই একটা কথা বলতেন, মাইয়া মানুষকে ছাড় দিবানা, যখনের হিসাব তখনই সারবা। আজাদ কথাটা খুব ভালো মতো মানে। শামীমা আসলে সে তাকে পাশে বসায়। হাতে আলতো করে হাত রেখে বলে-“ বঊ নীলপদ্মের কথা কিছু জানতে পারলা?”
হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সে। হেসে বলে-“না গো! খুঁজে পায় নায় নাকি। তবে রাজী হইছে কাল আমারে আর লক্ষীরে নিয়ে খুঁজতে যাবে! তুমি অনুমতি দিলে যাবো।”
আজাদ খুশি হয়, বউটা তার কাজের আছে। স্বামীর জন্য দরকারী জিনিসের পিছনেই তবে লেগে ছিলো এতোক্ষণ। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় সে শামীমার। যখনকার সোহাগ তখনোই করতে হয়, তাতে সোহাগের মূল্য থাকে। শামীমা হেসে হাত সরিয়ে দিয়ে বলে আহ্লাদ পরে করো, অনেক কাজ বাকী! বলে রান্নাঘরের দিকে যাওয়ায় জন্য উঠে দাঁড়ায় সে। আজাদ বলে-“দাঁড়াও!”
তারপর শামীমার সামনে দাঁড়িয়ে তার গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দেয়। মুহূর্তে আঙ্গুলের লাল দাগ বসে যায় তার সাদা গালে। গুঙ্গিয়ে ঊঠে সে। আজাদ বলে- “এইবার কাজে যাও! নীলপদ্মের খোঁজ নিছ তাই সোহাগ পাইছিলা! আর সন্ধ্যাকালে অচেনা পর পুরুষের সাথে রংগতামাশা করছিলা তাই এই চড়!” সময়ের হিসাব সময়ে মিটিয়ে মাথাটা ঠাণ্ডা হলো আজাদের। গোসলে চলে গেলো সে। পাশের ঘর থেকে সব কানে আসলো ব্যাপারীর। চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো তার!
(৯)
অজগরটা কাঁদা ছেড়ে উপরে উঠছে। লাল কাদার ছোপে তার কালো শরীরটার নতুন আকৃতি নিয়েছে এরমধ্যেই। সাঁওতাল পাড়ার পাশের একটা ড্রেন দিয়ে সাবধানে আগাচ্ছে সে! একটা ছাগল চাপা ড্রেনটার কাঁদায় আটকে পড়েছে। এমন সৌভাগ্য অজগরটার এলো বহুদিন পর। এটাকে হারালে চলবে না। কালো ছাগলটা আটকা পড়ে আছে বেকায়দা কাঁদায়। তাকে জড়িয়ে ধরতে তেমন আয়াসই হয়না অজগরটার। অর্ধমৃত ছাগলটাকে জড়িয়ে ধরে গিলতে থাকে সে! সময় লাগবে তার! এটাই তার সবথেকে দূর্বল সময়। একেবারে গিলে ফেলতে পারলে আর পর্যাপ্ত বিশ্রামের সময় পেলেই হবে। তারপর সে এইসব দোপেয়ে দের দৌরাত্ম্য কত দেখবে না হয়! গিলতে থাকে সে! ওইদিকে দীপেন হেম্ব্রং এর মার শখের দুই ছাগলের একটি ঘরে ফিরে নাই। যেখানে বাঁধা ছিলো সেখানের দড়ি ছিঁড়ে পালিয়েছে। বেচারা সারা বন তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তার হদিস পায় নাই। বিকাল বেলা দীপেন ফিরে সব শুনে প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে পড়লো। তার বদ্ধমূল ধারণা এটা ওই অজগরের কীর্তি! হয়তো অসহায় ছাগলটা পালাচ্ছিল কোন দিকে। বনের গভীরে ওটাকে পেয়ে সাবাড় করে দিয়েছে অজগরটা। সাঁওতাল পাড়ার সবাইকে ডাকে সে। বলে তবে কি এর কোনই বিহিত হবে না! এই ভূখন্ডের প্রাচীন বংশ তারা! তারা বীরের জাত। যখন এই বনে বাঘ, ভাল্লুক থাকতো, তারাও সাঁওতালদের সমীহ করে চলতো। আজো এ বনের বাতাসে কান পাতলে তাদের পূর্বপুরূষদের তীরে আর বর্শার শব্দ শোনা যায়। আজ এইভাবে এক পরদেশি অজগর তাদের হারিয়ে দিবে। প্রবীণ বুড়ো যোগেন হেমব্রং মাথা নাড়ায়- “না! না! এ হবে না, হবার নয়!”
বহুদিন পর যুদ্ধের সাজ নেয় সবাই। পুরাতন ধনুক আর তীরের ফলা গুলো ঘষে নেয় যতন করে। পাথরে ঘষে ধারালো করে বর্শার ফলা! কমবয়সী ছেলেগুলো পুরাতন লোহার ভাঙ্গা বালতি হাতে নিয়ে তাতে জোরে জোরে শব্দ করতে থাকে একটানা। বহুদিন পর শিকারে যাচ্ছে তারা। আলতাদিঘীর পানিতে তাদের মশালের আলোর প্রতিচ্ছায়া এই মাথা থেকে ওই মাথায় চলে যায়। পুরোটা এলাকা খুঁজে বেড়ায় তারা। পায়না খুঁজে কোন কিছুই। তাদের টিনের ক্যানেস্তারার শব্দ আলতাদিঘীর পাড় থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে পৌছায় বহুদূর! পালিয়ে যায় শেয়ালগুলো। কুকুরেরা সমবেত চিৎকার শুরূ করে। পাশের ভারত-বাংলা সীমান্তে সচকিত হয়ে উঠে প্রহরীরা। রাতের আঁধারে তারা ঘটনাটি আন্দাজ করতে ব্যর্থ হয় তারা। ওইপার থেকে কয়েক রাউণ্ড গুলি ছোড়া হয়! পরিস্থিতি বুঝতে পারে সাঁওতালরা। থেমে যায় তারা। গুটি গুটি পায়ে পাড়ার দিকে চলে যায় অধিকাংশই। শুধু দীপেনের সাথে কয়েকজন পাড়ায় ফিরে না। তারা তীর ধনুক আর বর্শা নিয়ে রওয়ানা দেয় পাশের পাড়ার দিকে। দীপেনের মা সারারাত মরা কান্না কাঁদে। বনের বাতাসে ভেসে আসা কান্নার শব্দ খুব ভৌতিক আবহ নিয়ে বাজতে থাকে! আর সাপটা সাঁওতাল পাড়ার কোলেই ড্রেনের ভিতর আরামের ঘুম দেয় অনেকদিন পর।


চলবে...

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে জুন, ২০১৯ দুপুর ১:৪৫

রাজীব নুর বলেছেন: আন্তর্জাতিক গল্প।
বেশ চলুক--- রহস্য রোমাঞ্চ সবই আছে।

২| ২৭ শে জুন, ২০১৯ বিকাল ৪:৪৫

মাহমুদুর রহমান বলেছেন: খুব সুন্দর।

৩| ২৮ শে জুন, ২০১৯ দুপুর ১২:২০

আর্কিওপটেরিক্স বলেছেন: চমৎকার !!

চলুক

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.