নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

যা মনে আসে তাই লিখি।

স্বর্ণবন্ধন

একজন শখের লেখক। তাই সাহিত্যগত কোন ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

স্বর্ণবন্ধন › বিস্তারিত পোস্টঃ

অজগর০২

২৮ শে জুন, ২০১৯ দুপুর ২:৪৩

(৮)....
আকাশে মেঘ জমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি নামবে! লোকটা আবার বনের পথে কোন বিপদে পড়বে কে জানে! একটু পর পর সামনের রাস্তায় এসে উঁকি দেয় সে। দুপুর ২টার দিকে দূরে বনের এক পাশের রাস্তার মাথায় একটা ভ্যান দেখা যায়। আনন্দে ছলকে উঠে তার মন। যাক এতোক্ষণে লোকটার দেখা মিললো!
তাড়াতাড়ি এলাকাটা পার হতে হবে। সীমান্তের ব্যাপারী চায়না এখানে থামতে। শামীমার কাছে থেকে একবার বিদায় নিতে পারলে ভালোই হতো! মেয়েটা সুন্দর গল্প করতে পারে! হাতে কাজ না থাকলে কারণে অকারণে গল্প করা যেতো। কিন্তু পকেটে নীলপদ্ম নিয়ে এখানে থামা ভয়ংকর ঝুকির কাজ হবে! পথের মধ্যে এমন অনেক মানুষের সাথেই তার দেখা হয়! সবার জন্য মন কাঁদলে তো ব্যবসা লাটে উঠবে। ভ্যানওয়ালা কে তাড়া দেয় সে, তাড়াতাড়ি জায়গাটা পার করতে। মাথা নীচু করে থাকে, দৃষ্টি রাখে ভ্যানের পাটাতনের উপর। এ এক মানুষের আজব স্বভাব! কাউকে বা কোন কিছুকে এড়াতে চাইলে তারা মাথা নীচু করে থাকে, ভাবে কেউ তাকে দেখছে না! সম্ভবত এটাও মানুষের এক আদিম প্রবৃত্তি। কালো মেঘ ঘন হয়ে আসে তার মাথার উপর! ভ্যানওয়ালা জোরে টান দেয় সাধ্যমতো। ভাটফুলের ঝোপের আড়ালে বুনো শ্যাওড়া গাছের কোণায় দাঁড়িয়ে ছিলো শামীমা। অপেক্ষা করছিলো, কখন ভ্যানটা এসে পৌছায় তার অপেক্ষায়। কিন্তু তার বাসার সামনে এসে যখন সেটা থামলো না, ঝড়ের গতিতে ছুটতে লাগলো, তখন সে ভাবলো নিশ্চয়ই ব্যাপারী মনে করতে পারছে না তার বাসার সঠিক অবস্থান। শামীমা পিছন থেকে জোরসে চিৎকার করলো- “ওই ভ্যান দাঁড়াও! দাঁড়াও!” চালক ব্রেকে কষে চাপ দিতেই থেমে গেলো চাকা!
মানুষের ভাবনা মতো যদি সব হতো, তাহলে তো গতকাল ব্যাপারী অজগরের খপ্পরে পড়তোনা। আজ সে ঢাকায় থাকতো এতোক্ষণ! কিন্তু ওই যে হয়না সব! আজকে আবার সে আটকা পড়বে হয়তো। শামীমা দৌড়ে সামনে এসে জানতে চায় সে পথ ভুলে গিয়েছিলো কিনা! বন জংগলের রাস্তা, খেই রাখা মুশকিল! ব্যাপারী হেসে বললো- “নারে ভাই ঢাকা থেকে জরূরী ফোন এসেছে! এক্ষুণি যেতে হবে! দেরি করার উপায় নাই।” এভাবে আশাহত হতেহবে ভাবে নাই শামীমা! সম্ভবত তার আশাকে বাঁচানোর জন্যই ঝড় এর আভাস আসে বাতাসে। বনের গাছগুলোর উলটানো পাল্টানোর কড়া শব্দ আসতে থেকে পিছন থেকে, অনেকটা পটকা ফুটার মতো! মেঘের কালো ছায়া চলে আসে রাস্তার উপর। ঝড় আসছে! বড় ঝড়! শামীমা বলে-“ এখন যাওয়ার চিন্তা বাদ দেন। এখন এই রাস্তা দিয়ে গেলে হয় বাজ পড়ে মরবেন নয়তো গাছ পড়ে! কোনটাই খুব সুখের জিনিস না। ঝড় থামুক, তারপর যান!” ব্যাপারী তখনকার মতো থামে। ভাবে পরে বিকাল বেলা না হয় বের হবে। এই ঝড়ে আসলেই যাওয়া সম্ভব নয়!
ঝড় বেড়ে গিয়েছে অনেক। দূরের বনের সবগুলো গাছ মনে হচ্ছে উড়ে উঠবে উতলা বাতাসে। আশেপাশের দুই একটা কলাগাছ ভেংগে পড়ছে দুমদাম। দূরে একটা তালগাছের মাথা অদ্ভুত ভাবে নুয়ে পড়ছে। শামীমার ঘরের বারান্দায় বসে থাকতে থাকতে একটু ভয়ই পায় ব্যাপারী। যদি ঝড় এই ঘরের টিনের ছাদটাও উড়িয়ে নেয় এখন! উড়াতেই পারে! খানিকটা আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকে সে। সামনেই বসে আছে শামীমা, কিছুটা দূরে একটা ছোট টুলের উপর। তার মন ভালো নাই। সে বুঝতে পেরেছে লোকটা পালাতে চেয়েছিলো সম্ভবত। সেই গায়ে পড়ে আটকিয়েছে। নিজেকে আত্মসন্মানহীন মনে হয় খুব। কেন সে আটকাতে গেলো? আসলে একাকিত্ব তাকে খুব দুর্বল করে ফেলেছে। সম্ভবত মন কোন কথা বলার মানুষ খুঁজছিল। আর আজাদ ও চায় লোকটা থাকুক। সেতো বড় ভুলের কিছু করে নাই; নিজেকে প্রবোধ দেয় শামীমা! ঝড় সব উলট পালট করে; জঙ্গলাকীর্ণ এ গ্রামের সব গাছেদের নাড়িয়ে দেয়, আর উলট পালট করে দেয় ব্যাপারীর মন! তার হঠাত সামনের মানুষটার সাথে কথা বলার ইচ্ছা জাগে। বহুদিন সে কোন মেয়ের সাথে মন খুলে কথা বলেনা। পকেটে টাকা থাকলে ঢাকার এক হোটেলে গোপনে তার যাতায়াত আছে। টাকা খরচ করলে মেয়েদের ও পাওয়া যায়; সে ডাকেও তাদের মাঝে মাঝে! উগ্র প্রসাধনী আর শরীরে উৎকট বডি স্প্রে ছড়িয়ে, আশেপাশের বাতাসে এক ধরনের অস্বস্তি ছড়াতে ছড়াতে তারা আসে। শরীরের প্রয়োজন মেটে বটে কিন্তু মন? নাহ, মনের কেনা বেচা তারা করেনা! গল্প শুনতে বা শুনাতে তারা আসেনা। কাজ সেরে চোখ মুখ শক্ত করে, চোখে মুখে একগাদা ঘৃণা নিয়ে চলে যায় তারা! মনটা তার একাকী বেঁচে আছে বহুদিন হলো। আজ এই ঝড়ের উন্মাদনায় তারো মন একটু পাখা মেলতে চায়। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর অস্বস্তি কাটাতে ব্যাপারীই মুখ খুলে। সে শামীমাকে স্বগোতক্তির মতো বলে- “ঝড় কি এখানে প্রায়ই হয় এরকম? আপনাদের ভয় লাগেনা এরকম জায়গায় থাকতে? একেতো জঙ্গল চারিদিকে! তার উপর এইরকম আবহাওয়া!”
“ভয় লাগবে কেন? আমাদের জন্মস্থান এটা! এর মাটি, গাছ পালা, পানি সবই আমরা চিনি। আপনাদের শহরের মানুষের চেয়ে এখানের মানুষ অনেক ভালো; অত মিথ্যাবাদী না!”

মিথ্যাবাদী শব্দটা ঠাস করে বাজে ব্যপারীর কানের পর্দায়। ছদ্ম পরিচয়ে থাকার এই এক সমস্যা। সব কথাতেই সন্দেহ হয়। মনে হয় এইতো সবাই জেনে যাবে সব! অস্বস্তি গলায় নিয়ে সে জানতে চায় শামীমা মিথ্যাবাদী কেন বলছে শহরের লোককে!
শামীমা বাঁকা হাসি দিয়ে বলে- “এই যে আপনি!! সকালে গল্প করতে গিয়ে একবার বললেন আপনার বউ গুলশানে একটা বুটিক না কিসের জানি দোকানের মালিক! আবার তার পরক্ষণেই বললেন ঢাকা ভার্সিটিতে চাকুরী করে! আবার শেষে বললেন বাসাতেই থাকে, একটু অসুস্থ মানুষ! কিছুই করেনা! এক বউ তিন রকম হয় কিভাবে? নাকি তিন বউ! নাকি বিয়েই করেন নাই? যাই হোক, মিথ্যা বলার কি দরকার!”

কথাটা বলেই অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে থাকে শামীমা। মেয়েদের এই পুরূষ মানুষ গুলো যতোই বোকা ভাবুক, আসলে তা তারা কখনোই নয়। হয়তো মায়ার চোখে সব তারা দেখে। তাই পুরুষের কথা আর কাজের সব অসঙ্গতিই তাদের চোখে ধরা পড়ে যায়, কিন্তু মেয়েরা সবসময় বুঝতে দেয় না যে তারা সব বুঝে গিয়েছে। সম্ভবত মায়ার জালটাকে তারা সবসময় ছিড়তে চায়না। এরকম ভুল সাধারণত ব্যাপারী করেনা। তুখোড় অভিনেতার মতো সব সামলে নিয়েছে সবসময়। আজ এই অজগ্রামের একটা মেয়ের সামনে ধরা পড়ায় ভিতরে ভিতরে বেশ অপ্রসতুত হলো সে। কিন্তু বহুদিনের অনবরত চর্চার অভ্যাসবশত অভিনয় চালিয়ে গেলো। ঠোঁটের কোণে খানিকটা অনুশোচনার হাসি এনে বললো- “আসলে আপন বলতে সেভাবে কেউই নাইতো। দেশের নানান জায়গাই যাই গাছপালা খুঁজতে। সবসময় অবিবাহিত বললে অনেক ঝামেলায় পড়ার সম্ভাবনা থাকে। বোঝেনই তো!”
হুম! এতোক্ষণে বুঝতে পারে শামীমা। স্বাভাবিক হয় সে। গল্প শুরু করে প্রাণ খুলে। কতো কিছু নিয়ে গল্প করে তারা; আলতাদিঘীর দৈত্য-দানো থেকে শুরূ করে বোন শরীফার বজ্জাত জামাই, সবাইকে নিয়ে তার জমানো গল্প শোনাতে শুরূ করে সে। বহু বছরের জমানো গল্পের প্রসবণ আজ শ্রোতা পেয়ে নেমে আসে মনোলোক থেকে বস্তুলোকে। পাশের জমিটাতে একা একাই ঝরে পড়ে অনেকগুলো বকফুল। তাদের শক্ত পাপড়ি মাটিতে পরে মানুষের পায়ের মতো থপ থপ শব্দ হয়। শামীমার গল্প থামেনা। ব্যাপারী শোনে, এজন্য নয় যে গল্পের কাহিনী গুলো খুব অনন্য! কিন্তু তার শুনতে ভালো লাগে। মেয়েটার ফর্সা মুখে কালো চুল এলিয়ে পড়ে যতোবার, ততোবারই মুগ্ধ হয় ব্যাপারী। হয়তো আজ রাতেই বা কাল সকালেই তাকে ছাড়তেই হবে এই এলাকা, কিন্তু এই গল্পের সম্মোহন উপেক্ষা করতে পারেনা সে! অথবা মেয়েটার আকর্ষণ! শামীমা তার কাছে জানতে চায় সে নীলপদ্ম খুজে পেয়েছে কিনা। মাথা নাড়ায় আজাদ, পায়নি এখনো। অবাক হয়ে শামীমা বলে-“ তাহলে চলে যাচ্ছেন যে? সব জায়গা দেখেছেন ভালো করে?”
-“দেখেছি! পেলাম নাতো! হয়তো গুজব ছিলো!”
-“আপনি নতুন মানুষ সব জায়গা চিনেন নাতো! আমাকে সাথে নিয়ে যাবেন কাল? আমি আলতাদিঘীর সব এলাকা চিনি। আর ওখানে আমার এক বান্ধবী থাকে লক্ষী টুডু। ওকে নিয়ে আমরা আবার সব খুজবো! যাবেন আমাদের সাথে?”
কথাটা বলে এক আকাশ আশা নিয়ে ব্যাপারীর দিকে তাকিয়ে থাকে মেয়েটা। সে কিছুক্ষণ মেয়েটার চোখে চোখ রাখে, সেখানে মায়ার জল টলমল করছে। এরকম চোখের দিকে তাকিয়ে কখনো না বলা যায় না! মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে সে। আনন্দে একহাত লাফিয়ে উঠে শামীমা! আজাদ তার বনে বাদাড়ে যাওয়া একদম ভালোবাসে না। কিন্তু যে মানুষ সারাদিন থাকেইনা তার পছন্দ অপছন্দে জীবন সাজানো চলে না! জীবন তার নিজের পছন্দেই চলে। আজাদ বাসায় না থাকলে বোনদের নিয়ে কিংবা লক্ষীকে ডেকে এনে তার সাথেই প্রায়ই বেড়িয়ে যায় সে। বোন শরীফার বাসা পাশে হওয়ায় সুবিধাই হয়েছে তার, বাচ্চাগুলোকে কিছুক্ষণের জন্য তার কাছেই রাখতে পারে। এসব ভাবতে গিয়ে হঠাত তার মনে হলো ব্যাপারীকে সে দুপুরের খাবার দেয় নাই এখনো! জিহবায় কামড় দিয়ে সে দৌড় লাগালো রান্নাঘরের দিকে। আর ব্যাপারীর মনে অকারণে ঝড় উঠেছে। যে ঝড়কে সে সবসময় ভুলে থাকতে চায়। আচ্ছা শামীমার চোখ গুলো কি অনেকটা নাবিলার চোখের মতো। ওর মতোই কথা বেশি বলে সে! অনেকদিন অপেক্ষা করেছিলো মেয়েটা, আজো কি অপেক্ষা করে? যৌবনের বহু বিকাল তার সাথে স্মৃতি হয়ে জমে আছে বুকের কোণাটায়, যেমন জমে থাকে ঝড়ের মেঘ। নাবিলার মোবাইল নাম্বারটা কি এখনো আগেরটাই আছে? নাকি বদলে ফেলেছে! নাবিলার মোবাইল নাম্বারটা সবসময় মুখস্থ থাকতো তার, আজো আছে! কিছুটা ঘোরের বশে মোবাইল ফোন বের করে কাঁপা হাতে সেই নাম্বারে বার্তা লিখলো ব্যাপারী- “ভালো আছো নাবিলা?”

আজাদ আজ আগেভাগেই ফিরতে চেয়েছিল। কিন্তু ঝড় বৃষ্টির তোড়ে আসতে আসতে বেলা পড়ে এলো। সে যখন পৌছালো সূর্য তখন প্রায় অস্ত গিয়েছে। দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে পুকুরের পাড়ে বসে গল্প করছিলো শামীমা আর ব্যাপারী। এর মধ্যেই শামীমা এক মজার খেলা আবিষ্কার করে ফেলেছে। সে একেকটা গাছ দেখিয়ে ব্যাপারীকে জিজ্ঞাসা করে তার নাম। প্রথম প্রথম সে ভড়কে যাচ্ছিলো! না পারলেই শামীমা বলছিল –“ আরে ভাই আপনি নাকি গাছপালা খুঁজে বেড়ান? এই গাছের নাম জানেননা!” পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন উঠলেই ব্যাপারীর নিরাপত্তা নিয়ে ভয় জাগে। সে ঘাবড়ে গেলেও এবারেও সামলে নিল। শামীমাকে হেসে বলল-“সব গাছের আঞ্চলিক নামতো বলতে পারবোনা। তবে ইংরাজী নাম জানি। ইংরাজীতে পড়েছি তো!” তারা যখন এভাবেই গাছপালা নিয়ে গল্প চালাচ্ছিলো সেই সময় পৌছালো আজাদ। দূর থেকে তাদের এই গল্প করা দেখে অসম্ভব বিরক্ত হলো আজাদ। এইজন্যেই লোকে বলে মেয়ে মানুষের বুদ্ধির অভাব আর মাথায় শয়তান ঘোরে! আচ্ছা এটার হিসাব পরে করবে সে। আগে আজকের মধ্যেই নীলপদ্মের খোঁজ বাগাতেই হবে; সোজা রাস্তায় না বললে বাঁকা রাস্তা আছে। নীলপদ্মের হদিস না দিয়ে আজাদের এলাকা সে ছাড়তে পারবেনা। সে নিশ্চয়ই জানে, ভান করছে না জানার! যুগপৎ রাগ ও ক্ষোভ মনে নিয়েও মুখে হাসি মেখে নিয়ে পুকুর পাড়ে এগিয়ে যায় আজাদ। তাকে দেখে ভীষণ অপ্রস্তুত হয় শামীমা। কি নেশায় সে এতোক্ষণ মজে ছিলো নিজেও বুঝতে পারেনা। কিন্তু এই ভর সন্ধ্যা অবধি অচেনা মানুষের সাথে পুকুর পাড়ে গল্প করা যে তার স্বামী ভালোভাবে নেয় নাই তা সে বুঝতে পারে ভালোমতোই। কথা না বাড়িয়ে বাড়ির ভিতর চলে যায় সে। আজাদ সোজা সাপটা কথা শুরু করে-“ব্যাপারী সাহেব, নীলপদ্ম পাইলেন?”
-“না। পাই নাই ভাই। অনেক খুঁজলাম!পেলাম না। ভাবছি চলে যাবো আজ রাতেই ঢাকা!”

-“কিন্তু রাতে তো এই রাস্তা নিরাপদ না! অজগরে মারে নাই বলে মানুষ যে মারবে না, তার কোন গ্যারান্টি আছে বলেন। আজ রাত থেকে যান, কাল না হয় দুইজনে মিলে আরো লোকজন নিয়ে খুঁজব! ঢাকা থেকে যখন এতোদূর আসছেন, এমনি এমনি তো আসেন নাই!”

আজাদের কথার প্রচ্ছন্ন হুমকি টের পায় ব্যাপারী। তবুও মাথা ঠাণ্ডা রাখে সে। জানে এই ধরনের লোক খুব সহজে ছাড়েনা। শুধু তাকিয়ে থাকে আজাদের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করে সে। এখান থেকে এখন বের হওয়ার উপায় হচ্ছে এর কথা মেনে নেয়া। অন্তত সারা রাত আর সকাল পাওয়া যাবে উপায় বের করার জন্য! সে ভয়ের কোন লক্ষণ দেখায় না চোখে মুখে। সন্তুষ্টির ভঙ্গিতে বলে-“ তাহলে ত খুব ভালো হয় ভাই! যদি নীলপদ্ম পেয়ে যাই আপনার ব্যাপারটাও আমি দেখব।“
আজাদ হাসে। সে ব্যবসায়ী মানুষ, তাই ব্যবসার চুক্তি ভালোই বোঝে। বাঙ্গালী কে সোজা রাস্তা দিলে সেখান দিয়ে যায়না, সে জানে! আর জিনিস হাতে না আসা পর্যন্ত একে চোখে চোখে রাখা দরকার। শরীফার স্বামী যে তার ভায়রা ভাই, দুলু একটু দূরে এসে দাঁড়িয়েছিল। খোদার খাসীটা সম্ভবত তাদের কথা শোনার মতলবে আছে। ওকে কাজে লাগালে কেমন হয়! ইশারায় তাকে ডাক দেয় এদিকে। চোখ ইশারা করে বলে-“ব্যাপারী ভাই আমাদের অতিথি। উনি বড় ব্যবসায়ী মানুষ, এখন থেকে দেখে দেখে রাখেন! জংগলের দেশ! আপনি একটু উনার বডিগার্ড হিসেবে থাকেন। আজ রাত উনার সাথেই থাকবেন।“
চোখের ইশারা বুঝে মাথা নাড়ে দুলু। সমস্যাটা অনেক বেশি প্রকট হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারে ব্যাপারী। রাতেই বের হতে হবে যে করেই হোক। যদি আসলেই এই লোক তার সাথে থাকে তো সমস্যা! দরকার হলে এটাকে ঘুমের মধ্যে দম বন্ধ করে দিয়ে তাকে বের হতে হবে। নিজের উপর খুব রাগ হয় তার। তার ব্যবসার নীতি ই এই, কারো প্রতি দুর্বল হওয়া যাবেনা। আর সে একটা অচেনা মেয়ের অনুরোধ রাখতে গিয়ে এ কোন ঝামেলায় পড়লো। তারপরও স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে স্বাভাবিক থাকলো সে। শুধু প্যান্টের পকেটে রাখা নীলপদ্মটা অস্বাভাবিক অস্বস্তি তৈরী করছে। মনে হচ্ছে মূর্তিটা অনবরত খোঁচা দিচ্ছে তার উরূতে। মানুষ যখন কিছু লুকিয়ে রাখতে যায় তার সমস্ত মন ওই দিকেই যায় বারবার। তবুও সে স্বাভাবিক হাসি হেসে আজাদ আর দুলুকে অনুসরণ করে। একফাকে মোবাইলে একটা কোড চেপে পাঠিয়ে দেয় ঢাকায়! ওরা খবর পেয়ে যাবে যে ও সমস্যায়। জিপিএস ট্র্যাকার কাজ করলে ওরাই খুঁজে বের করার ব্যবস্থা করবে তাকে। আজাদ ব্যাপারীকে দুলুর হেফাজতে রেখে পাশের ঘরে চলে গেলো।
শামীমা রান্না ঘরেই কাজ করছিলো। সে শামীমাকে ডাক দিলো জোরে। আজাদের বৃদ্ধ দাদু প্রায়ই একটা কথা বলতেন, মাইয়া মানুষকে ছাড় দিবানা, যখনের হিসাব তখনই সারবা। আজাদ কথাটা খুব ভালো মতো মানে। শামীমা আসলে সে তাকে পাশে বসায়। হাতে আলতো করে হাত রেখে বলে-“ বঊ নীলপদ্মের কথা কিছু জানতে পারলা?”
হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সে। হেসে বলে-“না গো! খুঁজে পায় নায় নাকি। তবে রাজী হইছে কাল আমারে আর লক্ষীরে নিয়ে খুঁজতে যাবে! তুমি অনুমতি দিলে যাবো।”
আজাদ খুশি হয়, বউটা তার কাজের আছে। স্বামীর জন্য দরকারী জিনিসের পিছনেই তবে লেগে ছিলো এতোক্ষণ। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় সে শামীমার। যখনকার সোহাগ তখনোই করতে হয়, তাতে সোহাগের মূল্য থাকে। শামীমা হেসে হাত সরিয়ে দিয়ে বলে আহ্লাদ পরে করো, অনেক কাজ বাকী! বলে রান্নাঘরের দিকে যাওয়ায় জন্য উঠে দাঁড়ায় সে। আজাদ বলে-“দাঁড়াও!”
তারপর শামীমার সামনে দাঁড়িয়ে তার গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দেয়। মুহূর্তে আঙ্গুলের লাল দাগ বসে যায় তার সাদা গালে। গুঙ্গিয়ে ঊঠে সে। আজাদ বলে- “এইবার কাজে যাও! নীলপদ্মের খোঁজ নিছ তাই সোহাগ পাইছিলা! আর সন্ধ্যাকালে অচেনা পর পুরুষের সাথে রংগতামাশা করছিলা তাই এই চড়!” সময়ের হিসাব সময়ে মিটিয়ে মাথাটা ঠাণ্ডা হলো আজাদের। গোসলে চলে গেলো সে। পাশের ঘর থেকে সব কানে আসলো ব্যাপারীর। চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো তার!
(৯)
অজগরটা কাঁদা ছেড়ে উপরে উঠছে। লাল কাদার ছোপে তার কালো শরীরটার নতুন আকৃতি নিয়েছে এরমধ্যেই। সাঁওতাল পাড়ার পাশের একটা ড্রেন দিয়ে সাবধানে আগাচ্ছে সে! একটা ছাগল চাপা ড্রেনটার কাঁদায় আটকে পড়েছে। এমন সৌভাগ্য অজগরটার এলো বহুদিন পর। এটাকে হারালে চলবে না। কালো ছাগলটা আটকা পড়ে আছে বেকায়দা কাঁদায়। তাকে জড়িয়ে ধরতে তেমন আয়াসই হয়না অজগরটার। অর্ধমৃত ছাগলটাকে জড়িয়ে ধরে গিলতে থাকে সে! সময় লাগবে তার! এটাই তার সবথেকে দূর্বল সময়। একেবারে গিলে ফেলতে পারলে আর পর্যাপ্ত বিশ্রামের সময় পেলেই হবে। তারপর সে এইসব দোপেয়ে দের দৌরাত্ম্য কত দেখবে না হয়! গিলতে থাকে সে! ওইদিকে দীপেন হেম্ব্রং এর মার শখের দুই ছাগলের একটি ঘরে ফিরে নাই। যেখানে বাঁধা ছিলো সেখানের দড়ি ছিঁড়ে পালিয়েছে। বেচারা সারা বন তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তার হদিস পায় নাই। বিকাল বেলা দীপেন ফিরে সব শুনে প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে পড়লো। তার বদ্ধমূল ধারণা এটা ওই অজগরের কীর্তি! হয়তো অসহায় ছাগলটা পালাচ্ছিল কোন দিকে। বনের গভীরে ওটাকে পেয়ে সাবাড় করে দিয়েছে অজগরটা। সাঁওতাল পাড়ার সবাইকে ডাকে সে। বলে তবে কি এর কোনই বিহিত হবে না! এই ভূখন্ডের প্রাচীন বংশ তারা! তারা বীরের জাত। যখন এই বনে বাঘ, ভাল্লুক থাকতো, তারাও সাঁওতালদের সমীহ করে চলতো। আজো এ বনের বাতাসে কান পাতলে তাদের পূর্বপুরূষদের তীরে আর বর্শার শব্দ শোনা যায়। আজ এইভাবে এক পরদেশি অজগর তাদের হারিয়ে দিবে। প্রবীণ বুড়ো যোগেন হেমব্রং মাথা নাড়ায়- “না! না! এ হবে না, হবার নয়!”
বহুদিন পর যুদ্ধের সাজ নেয় সবাই। পুরাতন ধনুক আর তীরের ফলা গুলো ঘষে নেয় যতন করে। পাথরে ঘষে ধারালো করে বর্শার ফলা! কমবয়সী ছেলেগুলো পুরাতন লোহার ভাঙ্গা বালতি হাতে নিয়ে তাতে জোরে জোরে শব্দ করতে থাকে একটানা। বহুদিন পর শিকারে যাচ্ছে তারা। আলতাদিঘীর পানিতে তাদের মশালের আলোর প্রতিচ্ছায়া এই মাথা থেকে ওই মাথায় চলে যায়। পুরোটা এলাকা খুঁজে বেড়ায় তারা। পায়না খুঁজে কোন কিছুই। তাদের টিনের ক্যানেস্তারার শব্দ আলতাদিঘীর পাড় থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে পৌছায় বহুদূর! পালিয়ে যায় শেয়ালগুলো। কুকুরেরা সমবেত চিৎকার শুরূ করে। পাশের ভারত-বাংলা সীমান্তে সচকিত হয়ে উঠে প্রহরীরা। রাতের আঁধারে তারা ঘটনাটি আন্দাজ করতে ব্যর্থ হয় তারা। ওইপার থেকে কয়েক রাউণ্ড গুলি ছোড়া হয়! পরিস্থিতি বুঝতে পারে সাঁওতালরা। থেমে যায় তারা। গুটি গুটি পায়ে পাড়ার দিকে চলে যায় অধিকাংশই। শুধু দীপেনের সাথে কয়েকজন পাড়ায় ফিরে না। তারা তীর ধনুক আর বর্শা নিয়ে রওয়ানা দেয় পাশের পাড়ার দিকে। দীপেনের মা সারারাত মরা কান্না কাঁদে। বনের বাতাসে ভেসে আসা কান্নার শব্দ খুব ভৌতিক আবহ নিয়ে বাজতে থাকে! আর সাপটা সাঁওতাল পাড়ার কোলেই ড্রেনের ভিতর আরামের ঘুম দেয় অনেকদিন পর।
https://www.somewhereinblog.net/blog/roso15/30277314

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে জুন, ২০১৯ বিকাল ৩:০১

আর্কিওপটেরিক্স বলেছেন: তারপর?

২| ২৮ শে জুন, ২০১৯ বিকাল ৪:৩৩

রাজীব নুর বলেছেন: এটাই কি শেষ পর্ব?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.