নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রাফিব্লগ

রথো রাফি

রথো রাফি লেখালেখি গাণ্ডীব, অনিন্দ্য, শিড়দাঁড়া এবং দ্রষ্টব্যেই । মূলত কবিতা অন্তঃপ্রাণ তবে গদ্যও লিখেছি কিছু। অনুবাদেও আগ্রহ আছে। বই এখনো নাই। জন্ম: দক্ষিণ তারুয়া, আশুগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। বসবাস ঢাকায়। প্রকাশনা সংস্থায় কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে, বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে ফ্রিল্যান্স কাজ করছি। [email protected]

রথো রাফি › বিস্তারিত পোস্টঃ

‘নিয়তি’

২৫ শে আগস্ট, ২০১৩ রাত ৩:৩২





কে জানি একবার বলেছিলো, সজাগ হবেতো বন্দী হয়ে যাবে তুমি, কথাটা তখন বিশ্বাস করি নি। আমার বিশ্বাস ছিলো, যে মুহূর্তে কেউ সচেতন নয়, শুধু সে-মুহূর্তগুলিই হলো তার আবিষ্ট দশা, চূড়ান্ত বন্দী দশা। কিন্তু এখন মনে হলো ওই লোকটি হয়তো ঠিকই বলেছিলো। কেন? সে-কথাই বলছি এখন।

মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারাতে হারাতে, এতো একা, এতো একা, হয়েছি যে, কারো সাথে বহুদিন, আর কথা হয় না আমার, একদমই না। মানুষের উপর বিশ্বাস হারাতে হারাতে তবু সেলুনে এসে, দুই আয়নার ভেতরে, আমাকে দেখেছিলাম আমি, একা নই, একা নই, বরং কী অসীম। তবু আমার মনে হলো, আমার অসীম নিঃসঙ্গতা কাটেনি কখনোই, এমনকি এক কণাও।



একজন বললো, সজাগ থাকার নামই আসলে নিঃসঙ্গতা।

অন্যজন মৃদু হাসলো, শুনে, কথার পিঠে বললো, ঘুমই একমাত্র খাদ যেখানে তুমি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ো।



আমরা চা খেয়ে, রাতের আড্ডা সেরে বেরিয়ে পড়েছিলাম, বাড়ির পথে, আলাদা আলাদা হয়ে। আর কথাকটির মারপ্যাচ, সরলতা আর যে অন্তহীন জটিলতা সেসব ভাবতে ভাবতে হাঁটছিলাম আমি, একা একা, তখনই গালে নিজের হাত উঠে আসে একবার, অনুভব করলাম দাঁড়িগুলো এরইমধ্যে বেশ বড়ো হয়ে গেছে, ভাবলাম আগামিকাল সেলুনে যেতে হবে আবার, বহুদিন আগের কথা এসব।



তো এই যে সেলুনে আমি, তবু আমি, আগের মতোই অভ্যাসবশত, ওই তাগড়া শরীরের, ঝাকড়া চুলের, ঈগলের ডানার মতো মেলা গোঁফারো শীলের পেশল হাতের চকচকে খুরের নিচে, কী অবলীলায় গলা পেতে দিয়ে, কেমন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি, একসময়। খুরের আশ্চর্য যাদু আমাকে পাকড়ে ফেলে, আমার সজাগ অনুভূতির বন্দীদশা থেকে টেনে বের করে আনে আমাকে, আমারই অজ্ঞাতে, যার নিবিড় নাম ‘নির্ভরতা’, এক অত্যাশ্চর্য তৃষ্ণার মতো, খুরের ধার যদিও একবিন্দু কম নয়, আর মানুষের প্রতি তবু, ‘বিশ্বাস’ ফিরে পাইনি আমি। তাহলে আমিও কি বিশ্বাস করতাম, নির্ভরতা ছাড়া স্বাধীনতার কোন অর্থই হয় না!

আর ‘ভাই, ও ভাই’ বলে লোকটি আমাকে ডেকে তুলে ফের, ডেকে আনে আমাকে আমারই বাহির থেকে ভেতরের দিকে, আমারই ভাবনার অগ্নিপরিধিতে, এনে ফেলে বন্দী দশায়, এইখানে, ঘুমের বাইরে, আর মানুষের প্রতি তবু, বিশ্বাস ফিরে না পেয়ে, আগের মতোই ফিরলাম, একাকিত্বে নিজেকে মুড়ে নিয়ে, সেলুন থেকে, আমার অসীমতা, আমার অসতর্ক ‘নির্ভরতা’ পেছনে ফেলে রেখে... অবিশ্বাসের একটা জামা গায়ে, জামাটাকে যদি আর কোথাও আমি খুলে রাখতে পারতাম, আমার অজ্ঞাতে, কিংবা হায়, চিরতরে, যদি খুলে রাখতে পারতাম!



অনুভব করলাম আমার অসীম প্রতিচ্ছবির মুখগুলো আমারই মুখের দিকে, চোখের দিকে তখন কেমন নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করছিলো, আশ্চর্য হয়েছিলাম, আমি যখন খুরের নিচে ঘুমিয়ে পরেছিলাম, কী ভয়ংকর একটা খাদের ভেতরে তলিয়ে গিয়েছিলাম, ভাবতেই শিউরে উঠলাম আমি। অথচ ‘নির্ভরতা’র দেখা পেয়ে তাদের অসংখ্যচোখ, যেগুলো আমার দিকে চেয়েছিলো, মনে হলো কেমন নিভে গিয়েছিলো। নিভে গিয়েছিলো, না কি আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলে লক্ষ্যই করতে পারি নি। আশা করি, নিভে গিয়েছিলো। কিন্তু সেলুন-অলা কখনোই সেখানে বেশিক্ষণ থাকতে দেবে না আর, আপনাকে এ ব্যাপারটাকে আরো ভালভাবে লক্ষ্য করার জন্য, ফলে, ফিরে আসতেই হবে এই সেলুনে, আর যেকোন মীমাংসাই রহস্যময় এমন ভেবেও নিয়তিবাদী হয়ে ওঠা আপনার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে, কেননা আপনি আসলে ভাবনার ছলে মুক্তি সন্ধান করছেন, আর এই সমস্যা-পরিধির বাইরেই কোথাও না কোথাও ছুটে যেতে চান, এই চাওয়াটাই যদি না আপনার নিয়তি হয়!



রাতে একা একা বাড়ি ফিরতে ফিরতে ভাবতাম এসব কথা, বহুবছর আগে, আবিষ্ট হয়ে। আজ আবিস্কার করলাম, তীব্র চিন্তুাও ছিলো এক নিবিড় আবিষ্টতা, বন্দিদশা, আর নিজেকে কেমন বোকা মনে হলো, এখন।



যাকে আমি এতোক্ষণ গল্পটা বলছিলাম, আমার পাশে পাশে সে হাঁটছিলো বললো, আসলে তুমি হলে গিয়ে এমন এক পাখি যে কিনা খাঁচা ছাড়া বাঁচতে পারে না, অথচ খাঁচাটাকেই কিনা ঘৃণা করে, এবং এক খাঁচা থেকে আরেক খাঁচায় গিয়ে ঢুকে, আর খাঁচা ত্যাগ করার আগে আগে পরবর্তী খাঁচাটি কেন বেশি সুন্দর তা-ই আবিস্কার করে বসে, সমস্ত চিন্তা, সমস্ত যুক্তি, সমস্ত অযুক্তি নিজের ভাললাগার পেছনে ষোলআনা খাটিয়ে নেয়, আগেও যেমন করেছিলো সে।



রাতে বাড়ি ফেরার এতোটা পথ পাড়ি দেয়ার পর এখন সে বিদায় জানালো আমাকে, সে রাস্তার ডান দিকে বাঁক নিতেই এই নীরব মাঝরাতের রাস্তায় একটু দূরের লাইটপোস্টের আলোতে তার ছায়াটি আমার গায়ের উপর দিয়ে ঘুরে গেলো। আমি আরো এগাবো, কারণ আরো খানিকটা পথ আমাকে একাই যেতে হবে, তবেইতো বাড়িটার দেখা মিলবে, লোকে বলে, আমি নাকি ওখানেই থাকি। বাড়ি! এ শব্দটা এ মুহূর্তে আমাকে কেমন চমকে দিলো।



একা হাঁটতে হাঁটতে আমি ভাবলাম, খাঁচাগুলোই একে অপরের সাথে ঝগড়াঝাটি করে কিনা, আর একে অপরের কাছ থেকে আমাকে লুটে নেয় কিনা, আর এই রদবদলই এনে দেয় কিনা স্বাধীনতার স্বাদ। কিংবা এমনওতো ভাবতে পারি, খাঁচাটি যখন আমাকে নিয়ে আর আনন্দ পায় না, তখনই আমি অসুখী হয়ে পড়ি। অসংখ্য খাঁচার হা-মুখের সামনে মনে হয় যেনো আমিই তাদের নির্বাচন করছি, আসলে কি তাই? তাদের প্রবল নিঃশ্বাসসমূহ একে-অপরের গায়ে ধাক্কা লেগে বাঁকিয়ে চুড়িয়ে ঘূর্ণী সৃষ্টি করে, আর আমি ঘূর্ণীর সাথে সাথে ঘুরি, যে খাঁচার নিঃশ্বাস যতো শক্তিশালী সে ততই সেই নিঃশ্বাসরেখা বরাবর অবস্থানকারী কোন খাঁচার হা-মুখের দিকে আমাকে ঠেলে দেয়। কারণ তারা কেউই হয়তো আমাকে পছন্দ করে না। আর অন্যের খাঁচায় ছুঁড়ে দিতে চায়। আমি অনিচ্ছায় কোন খাঁচার ভেতরে সেঁধিয়ে গিয়ে ভাবি, এমন খাঁচাটি আমি চাইনি। যেমন খাঁচার কল্পনা করেছিলাম, এটা তার চেয়ে অনেক নিকৃষ্ট, খাঁচায় প্রবেশের আগে আমার পক্ষে বুঝে ওঠা ছিলো খুব মুশকিল। মুশকিল! আবার সেই নিয়তিবাদী শব্দ, নাকি নিয়তিবিরোধীতার শব্দই এটি?



কারণ আমি ভাবতে ভাবতে আমার সব প্রশ্ন নিয়ে হাজির হতাম একসময় তাদের কাছেই, যাদেরকে আমি ভালবাসতাম একদিন, ভাবতাম, নিরাপোসী, আর তারা থাকতো নিরোত্তর, আর আমি ক্রমেই আমার ভাবনার শিকার হয়ে পড়ি, আবিস্কার করি, আরো এক নিঃসঙ্গতা আছে, আর চিন্তাই তা নির্মাণ করে দেয়, অথচ যার একটা প্রতিশ্রুতি হলো সম্পর্কের সেতুটিকেই গড়ে তোলা আবার, আর আমি আবিস্কার করেছিলাম তাদের ভান, তাদের অবিচল ভণ্ডামী, আর আমার চিন্তাগুলো উড়ুক্কু হতে হতে কখনো কখনো জলের স্পর্শ হারিয়ে ফেলতো, যদিও মাছের মতোই জল-জন্ম তাদের, লাফ মারতো হাওয়ায়, তীব্রতায়, আর হাসফাঁস করতো। আর অনুভব করতাম এই নিঃসঙ্গ উড়াল হাজারো মাছের ভীড়ে, যারা একে অপরের প্রতিধ্বনি মাত্র, বা প্রতিচ্ছবি, আর একে অপরকে ভাবছে: ভুল চিন্তার ভেতরে দেখো কিভাবে উড়ছে তারা। কখনো একেঅপরের গায়ে ধাক্কা লাগলে টের পেতো: শালারতো দেখি কোন হুশই নেই!

আর বহুদিন পরে জেনে ছিলাম, তারা নিরাপোষী কারণ, চিন্তা সময় রেখা বরাবর পাল্টায় বলে, তারা কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারতো না। কোন সিদ্ধান্তে পা রাখবে তা কাউকে জানাতো না। সব সিদ্ধান্তই নাকি সমান মনে হতো তাদের কাছে, যদিও তারা ছিলো দ্রোহী, আর নিজের গোপন পদচারিতাকে ঠিকই ষোলআনাযুক্তিসিদ্ধ ভাবতো, আর অপরের কাছে তা প্রকাশে থাকতো অনীহ ও নীরব। কেননা আজকের সিদ্ধান্ত কালকেতো পাল্টে যেতেই পারে। তাদের নিরাপোষিতা ছিলো নিরবতার, কোন সিদ্ধান্তহীন গোপন পদচারিতার, আর অন্যের কাছে নিজেদের কোন শব্দ ব্যবহার কোন ধ্বনিব্যবহার ছাড়াই সবচেয়ে জ্ঞানী প্রমানের। তাদের কাছ থেকে নিজেরই অজ্ঞাতে সরতে সরতে ভাবলাম, তুমি শব্দ করো, আর না করো নিজের কাছে পাল্টে যাচ্ছো দিনদিন, আর এই যে পাল্টে না যাওয়ার একটা ভান তাই হচ্ছে আসলে নিরাপোষিতা, যাকে সময়ের স্রোত ক্রমশ হাস্যকর তুলছে। আর সবচেয়ে করুণ বিষয়টা হলো, তুমি হাসতে পারছো না, প্রতিচ্ছবিগুলোর ভুলগুলো কি তোমারও ভুল নয়?



আর আমি আবিস্কার করেছিলাম তাদের ভান, তাদের অবিচল ভণ্ডামী, আর আমার চিন্তাগুলো উড়ুক্কু হতে হতে কখনো কখনো জলের স্পর্শ হারিয়ে ফেলতো, যদিও মাছের মতোই জল-জন্ম তাদের, লাফ মারতো হাওয়ায়, তীব্রতায়, আর হাসফাঁস করতো। আর অনুভব করতাম এই নিঃসঙ্গ উড়াল হাজারো মাছের ভীড়ে, যারা একে অপরের প্রতিধ্বনি মাত্র, বা প্রতিচ্ছবি, আর একে অপরকে ভাবছে: ভুল চিন্তার ভেতরে দেখো কিভাবে উড়ছে তারা। কখনো একেঅপরের গায়ে ধাক্কা লাগলে টের পেতো: শালারতো দেখি কোন হুশই নেই!



চিন্তা কখনো কখনো কিভাবে হুশ কেড়ে নেয়, আর আত্মকেন্দ্রিক করে ফেলে, আমি যাদেরকে ভালবাসতাম, একদিন সুনির্ভর কিছু ভাবতাম (আমারই ভুল-ভাবনা নয় কি? তার মানে আমি নিজের ভাবনাকে নির্ভুল করার চেষ্টায় নিমগ্ন রয়েছি, নাহলে ভাবছি কেন, এই নিরোত্তর পরিস্থিতি নিয়ে), তাদের মুখের উপর ওই ভঙ্গি দিনের পর দিন ফুটে থাকতে দেখে আমি ক্ষিপ্ত উল্কার মতো ঝরে ঝরে পড়তাম, বেদনার নীল এক আকাশ থেকে অসীম এক নিস্ফলা প্রান্তরে, নিজেই ফের নিজের বীজ হয়ে উঠি, উঠতেই হয়, আর নিজের কাছেই প্রার্থনা করি, নতুন শেকড়, কারণ প্রান্তরের নাগালতো পেতো শুধু আমার ওই ভস্মসারটুকুই।



তো একা হতে হতে, কোন একদিন আপনিও হয়তো, আপনার অসীম প্রতিচ্ছবির মাঝখানে দাঁড়িয়ে, কোন এক সেলুনের ভেতরে, আমার মতো খুরের নিচে ঘুমিয়ে পড়ার কথা ভাববেন, আর আশ্চর্য হবেন: লোকটা ওখানে ‘সুনির্ভরতা’ পেয়েছিলো! আর অট্টহাসিও দিতে পারেন, তবে কোন-একদিন আবারও ভাববেন, ওই হাসি আসলেই কার প্রতি ছিলো, নিজের প্রতিও কি নয় অনেকটা?



কিংবা, নিঃসঙ্গতা আসলে আমাদের ক্ষমা করে না, করতেই জানে না, বরং আমাদের কল্পনার পাখাটিকে বারোহাত লম্বা করে তোলে শুধু, কিন্তু তখন আর কোথাও উড়ে যেতে পারি না আমরা, পারি না, তাই না? তাহলে আপনিও কি ভাবতেন, আপনি নিরাপোষী চিন্তার ভেতর দিয়ে ক্রমে স্বাধীন হয়ে উঠছেন, আর একদিন আবিস্কার করেছেন, স্বাধীন হওয়ার বদলে আশ্চর্য নিঃসঙ্গতাই নির্মাণ করেছেন!



কিন্তু এসব কথা বলার পর কী দেখলাম? কেউ নয়, শুধু আমার দীর্ঘ ছায়া আমার সামনে ক্রমে আরো দীর্ঘ হয়ে উঠছে, রাতের নগ্ন কালো ও ফাঁকা রাস্তার নীরবতায় দূর অবধি ছড়িয়ে পড়েছে, আর ল্যাম্পোস্টটি পেছনে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। কারণ প্রতিপদক্ষেপেই আমি ভাবছি, আমার ছায়ার ভেতরে প্রবেশ করবো, কিন্তু না, ছায়াটি তার পায়ের আঙুলের সাথে আমার পায়ের পাতার স্পর্শটুকুই অনুমোদন করে কেবল, ভেতরে প্রবেশের অনুমোদন দেয় না কিছুতেই, বড়ো হয়, বড়ো হতেই থাকে, আর সামনে এগিয়ে যায়, যেতেই থাকে, আমার প্রতিটি পদক্ষেপেই। আমি কি আমার ছায়ার ভেতরে কোনদিনই প্রবেশ করতে পারবো না। আর এরপরতো, এই নগ্ন রাস্তা, আর, কী অন্ধকার!



কিন্তু আপনি যেহেতু গল্পটি পড়ছেন, সেলুনে ঢুকে, কিংবা রাত্রির রাস্তায় একা একা হাঁটতে গিয়ে, মহাবিশ্বে আপনি কেমন একা ও হাস্যকর, ভাবছেন, আর, তবু, নিজেকে, কিছুতেই, তুচ্ছ করে তুলতে পারছেন না, বরং নিজেকেই শুধু প্রাধান্য দিচ্ছেন, আর আপনার চিন্তা আপনার পিছু ছাড়ছে না কিছুতেই, আপনি কেমন আপনার নিজেরই চিন্তার শিকার... এসব ভাবতে ভাবতে আশ্চর্য হবেন হয়তো। কিন্তু আপনি জেনেই গেছেন যে, পৃথিবীতে মানুষ সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয়গুলো নিয়ে সবচেয়ে কম আশ্চর্য হয়!



যদিও ভাবতেন, অন্যকেউ দায়ী আপনার এই অসীম নিঃসঙ্গতার জন্য, ভাবছেন, যাদের ভালবাসতেন, যারা ভণ্ড-প্রতারক, আসলে তারা তা নয়, বরং আপনার চিন্তাই, তাদের সাথে আপনার দূরত্বই, তাদের এমন একটি চেহারা বানিয়েছে, আপনার নিজের চিন্তা দিয়ে এমন বিকৃত করে ফেলেছেন তাদের! যেমন তারাও আপনাকে করেছে, কারণ তারাও আপনার মতোই ভাবে ও ভাবতে থাকে, আর ভাবে তারা ঠিকটি ভাবছে। ভাবছে, তাদের ভুবনটার ভেতরে বুঝি কোথাও একটা ভুল রয়ে গেছে, তবে তা নিতান্তই অনিচ্ছুক, আর যতো তুচ্ছই হোক, তা আর তুচ্ছ নয় কিছুতেই। আনিচ্ছুক!



কিন্তু তখন আর কী করে আশা করেন, তারা আপনাকে সঙ্গ দেবে, আপনার জিভ যখন তাদের ইতোমধ্যেই চাবকে ফেলেছে, অথচ আপনি একদিন আবিস্কার করবেন, তাদের মাঝখানে আপনাকে, আর তাদের জিভের বিষ দেখবেন কিভাবে আপনার গায়ে ছিটকে পড়ছে, আর আপনি ভাববেন, আপনি তো আসলে প্রতারক নন, বরং তারাই, কিন্তু ইতোমধ্যে সবাই জেনেগেছে, আপনি আসলেই প্রতারক, এরা সবাই আপনারই মতো নিজনিজ চিন্তার পথে কবেই হারিয়ে গেছে, আর আপনার মতোই বিস্মৃতি আর স্মৃতিতে আশ্চর্য মাখামাখি, আর বহুদিন পরপর দেখা হলে, একে অপরকে ঘিরে নানান অনুমানই তাদের চিন্তার মানচিত্রটিকে নির্ধারণ করে দেবে, যেমন দেয়, আর আপনি ভাবছেন, তারা প্রতারক, অথচ তা নয়! নয়? না-হলে আপনি নিঃসঙ্গ কেন এতো, আর আপনি কেবল সৎ, তা হলেন কিভাবে! কারণ বিস্মৃতি প্রতিটি মানুষেই আছে, আর সময় বারবারই একই ঘটনার তাৎপর্য পাল্টে দেয়, দিতে থাকে! প্রেম ও সততার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার আসলেই নিঃসঙ্গতা।

নিঃসঙ্গতা! না হেসে পারবেন না, মাঝরাতে, রাস্তার উপরে, একাকি অবস্থায়, কারণ তখন কিছুই জানানোর নেই, আর নেই আত্ম-উন্মোচনের নামে শরীর থেকে শেষ বস্ত্রটিও খুলে ফেলার মতো কোন বৈধতা, কারণ কোন চোখ নেই যে এই নগ্নতার কোন অর্থ তৈরি হবে! নিজের কাছে আপনিতো নগ্নই, নন কি, না হলে কিভাবে দাবী করছেন, সততা আর প্রেমের সেরা পুরস্কার জিতে নিয়েছেন, আপনারই অসংখ্যচোখের পাহারার নিচে এমন উদ্ধত্য আর কোনভাবে অর্জন করতে পারবেন আপনি!



কিন্তু ততক্ষণে আপনিতো কোন না কোন এক সেলুনে, আগের মতোই অভ্যাসবশত, ওই তাগড়া শরীরের, ঝাঁকড়া চুলের, ঈগলের ডানার মতো মেলা গোঁফারো শীলের পেশল হাতের চকচকে খুরের নিচে কী অবলীলায় গলা পেতে দিয়ে, ঘুমের ভেতরে, হয়তো, ঢলে পড়েছেন, আর অসংখ্য ঢুলুঢুলো চোখ, আপনাকেই লক্ষ্য করছে... আপনি লক্ষ্য করছেন না!



কারণ, একজন বললো, সজাগ থাকার নামই আসলে নিঃসঙ্গতা।

কারণ, অন্যজন মৃদু হাসলো, শুনে, কথার পিঠে বললো, ঘুমই একমাত্র খাদ যেখানে তুমি পুরোপুরি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ো।



ভাবছি, এখন আপনি কি স্বপ্ন দেখছেন যে, আপনার বুকের বা পাশ থেকে একটা রক্তের চিকন ধারা সাদা কাপড়ের ওপর দিয়ে বেয়ে নামছে ক্রমে নিচে আরো নিচে, আর পায়ের পাশের ফ্লোরে গিয়ে নামছে, একটা লাল সাপের মতো, আর সমস্ত আয়নার ভেতরে দেখতে পাচ্ছেন কত লক্ষ খুন একসাথে ঘটছে!



কারণ, নিঃসঙ্গতা নাকি আরকিছুই নয়, আত্মহত্যা ছাড়া!

কারণ, তা বিশুদ্ধ অস্বীকার



তারা এমন কথাও বলেছিলো বেশ জোরের সাথে, রাতের নীরব রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে সেসব ভাবছিলাম আমি, বহুদিন আগে, হয়তোবা আপনার স্বপ্নেরই ভেতরে...



অথচ, চিন্তার সবচেয়ে বড়ো দুর্বলতা হলো, নিজের অসীমসংখ্যক প্রতিচ্ছবিই কেবল চাই, তারাই তাকে কেবল নির্ভুল প্রমাণ করতে পারে!



আর ও সব প্রতিচ্ছবির দেখা মিলতে পারে সেলুনে সমান্তরাল দুই আয়নার মাঝখানে, যখন নাপিত তার চকচকে খুরটা নামিয়ে আনছে, আপনার গলা বরাবর, আর আপনার ঝিমুনি এসে গেছে ততক্ষণে। আপনাকে কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে দেয়া হবে না ওইখানে। চিন্তার সচ্ছতা আসার আগেই আপনাকে পথে নেমে আসতে হবে আবার।

২৫.০৫.২০১৩



মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.