নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রাফিব্লগ

রথো রাফি

রথো রাফি লেখালেখি গাণ্ডীব, অনিন্দ্য, শিড়দাঁড়া এবং দ্রষ্টব্যেই । মূলত কবিতা অন্তঃপ্রাণ তবে গদ্যও লিখেছি কিছু। অনুবাদেও আগ্রহ আছে। বই এখনো নাই। জন্ম: দক্ষিণ তারুয়া, আশুগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। বসবাস ঢাকায়। প্রকাশনা সংস্থায় কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে, বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে ফ্রিল্যান্স কাজ করছি। [email protected]

রথো রাফি › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমরা যারা হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতাম

২৫ শে নভেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:৪৯

আর প্রত্যেকদিন আমাদের নামগুলো থেকে ঝরে পড়ে যায় হরফের পর হরফ, যে-নামগুলো এখনো আমাদের একের চেয়ে অন্যকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়।

----চেশোয়াভ মিউশ





“non fui, non sum, non desidero.” আমরা যে-রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতাম সে-রাস্তার দুপাশে দুটো পার্ক ছিলো, একটা প্রকৌশল ভবন ছিলো, সড়ক দ্বীপ ছিলো, ট্রাফিক পুলিশ ছিলো, মত্স্যভবন ছিলো, শিল্পকলা একাডেমী ছিলো, বস্তিও ছিলো। আমরা যে-রাস্তাটি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতাম সে-রাস্তাটিতে দিনে সারাক্ষণ জ্যাম লেগে থাকতো। লোকাল বাস, সিটিং সার্ভিস, স্পেশাল সার্ভিস, প্রাইভেট কারের ভীড় লেগে থাকতো। আর ফুটপাতের ওপর দিয়ে লোকজন হাঁটার বদলে ছুটতো মটর সাইকেলগুলো। আমি তাদের দিকে তাকালে, তারা চোখ পাকিয়ে তাকাতো। তাদের বলা যেতো না, ভাই ফুটপাত ছেড়ে রাস্তায় নামেন। আর লোকাল বাসে চড়লে, সবসময় দশপনের মিনিটের রাস্তা পেরোতে বাসের ভেতর দাঁড়িয়ে থেকে একদেড় ঘন্টা পার করে দিতে হতো। বাসের ভেতর শীতকালে বেশ আরাম লাগতো। আর গরমে ঘামতে ঘামতে আমাদের প্যান্টশার্ট ভিজে যেতো, আন্ডারওয়্যার ভিজতো কিন্তু আমরা তা নিয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করতাম না। কেউ বলতো ট্রাফিক পুলিশ দক্ষ না, কেউ বলতো সরকার রাস্তায় এতো গাড়ি ছেড়েছে অথচ সে তুলনায় রাস্তা তৈরি করেনি, বা রাস্তা প্রশস্থ করেনি। বা কেউ বলতো রাস্তার প্রসারিত করার জায়গা কই। কেউ বলতো রিক্শা উঠিয়ে দেয়া হচ্ছে না কেন। কেউ বলতো রিকশা তুলে দিলে লাখ লাখ লোক খাবে কী, কেউ বা বলতো শিল্পকারখানা আর আবাসিক এলকাগুলো ক্রমে দূরে সরিয়ে নেয়া উচিত। আমরা জানতাম, কথায় তার বেশি কেউ আগাবে না। এসবেরই কোন একটাকে সঠিক মনে করে, বা সঠিক-বেঠিক কিছুই মনে না করেই, নিজেকে পরিস্থিতির সাথে ঠিকই তারা মানিয়ে নেবে, আর দিনদুপরে সারা গ্রীস্মেই ঘামতে থাকবে। সারা বর্ষায় ভিজতে থাকবে। আর এসব কথা তবু বছরের পর বছর চালিয়ে যাবে। আমরা যে-রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতাম সে-রাস্তায় দুপরের পর তিনটা কি চারটায় তেমন ভীড় থাকতো না। তাই সেসময় বাসা থেকে বেরিয়ে পড়া সুবিধাজনক মনে করতাম, আর বাসে চড়তাম। দ্রুত পৌছে যেতাম আমাদের আড্ডার জায়গায়। আর দেখতাম, তখনো রোদ। আর এ বয়েসে সন্ধ্যার আগে আড্ডা দিতে আসাও লজ্জাজনক। তাতে বোঝা যায়, বাদাইম্যা আমরা, কিছুই করি না। আড্ডা দিয়ে বেড়াই। আমরা যে কিছু করতে চাই না, তা নয়। আমরাও কাজ করতে চাই। কিন্তু কাজে যদিবা এক কি দুবার ঢুকেছি আমরা, আমাদের সাফল্যের অবস্থা খুবই খারাপ। আর সবার ভেতর এতো ঈর্ষা আবিস্কার করতাম আমরা, আর এসবের ভেতরে এতো বেশি একে অপরকে অপমানের রসদ পেতাম যে, একসময় হতাশ হয়ে পড়তাম। আর মনে হতো, কেরানিগীরি কৃতদাসবৃত্তির চেয়েও খারাপ। কারণ কৃতদাসবৃত্তিতে অভিমত প্রকাশেরই সুযোগ নেই, অভিমত প্রকাশের ছলাকলা থাকা দূরের কথা। আর কেরানিগিরির সবটাই কর্তার ইচ্ছে অনুসারে স্ট^াধীন অভিমতের ছলাকলা রপ্ত করা। যদিও এই কৃতদাসবৃত্তির বিকল্প, আমাদের কারোরই জানা ছিলো না। আমরা তবু ছিটকে পড়তাম কাজ থেকে, অফিস থেকে। আর আমাদের যোগ্যতাও তেমন ছিলো না যে ভালকাজ পাবো, জুটিয়ে নেবো। যা পেলে, আমাদের পেটের পিঠের চেটের ছাদের সমাধান ঘটতে পারতো। যা পেলে, সুখে দুএকটা গানও আমরা গেয়ে ফেলতে পারতাম হয়তো।

আমরা যে-রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতাম, সে-রাস্তা এগারোটার পর নীরব থাকতো। তবে ট্রাকের ধাবমানতায়, নীরবতা ফাঁটার শব্দে রাস্তাটা কঁকিয়ে উঠতো একটু পরপরই। সে-রাস্তার ওপর, বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত, পুলিশের ভ্যান, একটা, আসতো আর যেতো। কখনো থামতো না। তবে শেষরাতের দিকে মানে, সবসময়ে, ওটা থাকতো কিনা জানতাম না। তখনতো আর আমরা ওই রাস্তয় থাকতাম না। তবে যেদিন আমাদের বাসায় ফেরার আগ্রহ বা ফেরার উপায় থাকতো না, সেরাতে দেখতাম পুলিশ ভ্যানটা দাঁড়িয়ে আছে।

আমরা যে-রাস্তাটি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতাম, ছিনতাইকারীর ককটেল ফাঁটানোর কারণে মাঝে মাঝে তার নীরবতা কুঁকড়ে যেতো। আর কোন এক রিকশার সামনে, দেখতে পেতাম আমরা, এসে আচমকা দাঁড়িয়ে পড়তো অটোরিকশা, রিকশার চারপাশে দাঁড়িয়ে পড়তো কয়েকটা যুবক। রিকশার মহিলা যাত্রী ভয় পেয়ে দিয়ে দিতো তার কানের গহনা, হাতের সোনার চুড়ি, মোবাইল, গলার চেইন, দিতে দেরী হয়ে পড়তো যদি, ওই যুবকরা রেগে যেতো। হুঁশ থকাতো না। খুরের পোচ দিতো মহিলার হাতে, পাশের পুরুষটির কিছু করার থাকতো না। আমরা যে-রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতাম সে-রাস্তার পুলিশের একটা ভ্যান চলতো, কখনো থামতো না। যদি থামতো কখনো, তা ওই কোন না কোন পথচারীর চেঁচামেচি শুনেই। আর ভ্যান ঘটনাস্থলে এসে জিগ্যেস করতো কী হয়েছে? তারা উত্তর দিতো আমাদের সবকিছু নিয়ে গেছে ছিনতাইকারীরা। ওহ, খুবই দুঃখজনক। আপনারা আমাদের সাহায্য করুন। আপনারা দিনদুপুরে এসব দামী জিনিস গায়ে পড়ে আসেন কেন, আপনাদের কা-জ্ঞান নেই! জানেন যখন দুর্ঘটনা ঘটবেই! এসব পড়ে পড়ে খোলা রাস্তায় কখনোই চলা-ফেরা করবেন না। এতে আমাদের সুনাম নষ্ট হয়। দুর্ঘটনা ঘটলে, পুলিশের দোষ। পত্রিকায় এতো লেখালেখি হয়, এতো জানার পরও লোকজন কেন যে সোনার গহনা পড়ে রাস্তয় বের হয়, শিা হয় না। ভাই, লোকগুলো এদিক দিয়েই গেছে, একটু এগোলেই দেখতে পাবেন। এসব বলে তারা অনুনয় বিনয় করতো। তো এখন পিছু নিয়ে কি এদের নাগাল পাওয়া যাবে? আপনারা-যে কী ভুল করেন। চলেন থানায় গিয়ে একটা ডায়েরী করে রাখেন। পুলিশেরা তাদের পরামর্শ দিতো। ভাই আপনারা এদিক দিয়ে আমাদেরকে ভ্যানে নিয়ে দ্রুত চলুন না প্লিজ, ওরা বেশি দূর যেতে পারে নি। নিশ্চয় ধরতে পারবেন। তাদের অনুনয়-বিনয়ে পুলিশেরা অবাক হয়ে যেতো। আমরা যে-রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতাম সে-রাস্তার ওপর একটা পলিথিনের মশারির মতো টাঙানো একটা ঘুপচিঘর ছিলো। ঘরটা রাতে গজিয়ে ওঠতো, বুদ্বুদের মতোই। আর দিনে ঠিক মিলিয়ে মিলিয়ে যেতো। আষাঢ়ে ব্যাকুল ব্যাঙের গলার উপর স্বরথলিটি যেমন একবার ফুলে উঠে আবার মিলিয়ে যায়, তেমনি অনেকটা। দিনে চলাফেরা করতো যেসব লোকেরা কখনোই, তাই, ফুটপাতের ওপর ওই ঘরটাকে দেখতে পেতো না। তাদের জিগ্যেস করলে, কখনোই এ বিষয়ে কিছু বলতে পারতো না। রাতে যারা হাঁটে তাদেরকে যদি বলেন, এখানে কোন ঘর নেই, তারাও অবাক হতো, লোকজনের তেমন কথা শুনে।

আমি যে রাস্তা দিয়ে হাঁটতাম, সে রাস্তায় পলিথিনের ঘরটা বাতাসে ফুলে ওঠতো, আবার চুপসে যেতো। তার পেট একবার উপরে উঠতো, আবার নামতো। দূরে থেকে পুলিশের ভ্যান তা দেখতে পেতো। ভানটা ছুটে আসতো, আর ঘরটার ভেতরে ঢুকে ফের বেরিয়ে এলে, আমরা দেখতে পেতাম, পুলিশের হাতে একজনের কলার মুচড়ে ধরা। লোকটা কাঁপছে, ঘামছে, আর কাঁদছে: ভাই আমার ছেলেমেয়ে আছে ঘরে, মান সম্মান থাকবো না। আমার কাছে তেমন টাকা নেই। ভাই, আমারে থানায় নিয়েন না। ঘাড়ে ধাক্কাা দিয়ে লোকটাকে তখন ভ্যানের ভেতর ছুঁড়ে ফেলতো তারা। আমরা হাসতাম, রাস্তায় মানসম্মান গেলে কি লোকটার আপত্তি নেই, ভেবে হাসতাম। নির্জন রাস্তায় আসলেই মানসম্মান বলে কিছু থাকার কথা নয় ভাবতাম, আর হাসতাম আমরা।

আমরা যে-রাস্তা দিয়ে হাঁটতাম সে-রাস্তায় পুলিশের ভ্যানটা ধরা-খাওয়া লোকটাকে নিয়ে চলে যেতো। আমরা দেখতাম, পলিথিনের ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েটা হাসছে। আর তার পায়জামার ফিতা বাঁধছে। ব্লাউজের বোতাম লাগাচ্ছে। বা একটা স্তন ব্লাউজ থেকে বেরিয়ে আছে, তার খেয়াল নেই বা সময় নেই। ওই ফাকে আমরা এক পলক দেখে নেয়ার চেষ্টা করতাম। বা আর তার হাতদুটা পায়জামাটা টেনে কোমরের উপর তুলতেই তখন বেশি ব্যস্ত। দূর থেকে আসা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় যদিও তার স্তন ঠিকঠাক দেখা যেতো না, তার স্তনের দিকে তার মুখের দিকে ঠিকই তাকিয়ে থাকতাম। আমরা চাইতাম পায়জামাটা কোমরে আসতে একটু দেরি হোক, তার স্তনটা আরো কয়েকপলক দেখতে না চেয়ে পারতাম না আমরা। আমরা তার সাথে দুয়েকটা কথা না বলে পলিথিন ঘরটা পেরিয়ে যেতে পারতাম না কখনোই।

আমরা যে-রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতাম সে-রাস্তা দিয়ে একটা পুলিশের ভ্যান চলতো। আর ছিনতাই হলে, তারা এসে বলতো কী করেন-না আপনারা, সোনাদানা গায়ে দিয়ে আজকাল কেউ রাস্তা দিয়ে চলে? লোকজন এ কথা শুনে কাঁদবে না হাসবে, বুঝতে পারতো না। কখনো কখনো হেসে ফেলতো। আর ছিনতাই হওয়া লোকজন নিজেদের নাকি পুলিশদের বোকা ভেবে হাহুতাশ করে চলে যেতো ঠিক বোঝা যেতো না।

আমরা যে রাস্তা দিয়ে হাঁটতাম, সে-রাস্তাটা রাত এগারোটা বাজলেই যেনো ঘুমিয়ে পড়তো। তাই এসব কেউ দেখতে পেতো না। আমরা ঘুমাতাম না বলে দেখতে পেতাম। তাই পুলিশ আমাদের বলতো, এত্তো রাতে কোত্থেকে আসিস তোরা? আমরা বলতাম, আড্ডা দিয়ে এলাম। কী করস তোরা? আমরা চুপ করে থাকতাম। একজন বলতো, কেন রাতে হাঁটার ওপর কোন নিষেধাজ্ঞা আছে নাকি সংবিধানের কোথাও! আমাদেরই এককজন বলতো, তারা লেখালেখি করে, তাদেরকে ছেড়ে দেন, সে লেখালেখি করতো না যেনো। পুলিশরা বলতো, সকাল সকাল বাসায় ফিরে যাবেন। তোরা থেকে আপনারা সম্বোধন কারো না কারো সাহস বাড়িয়ে দিতো। আর বলে উঠতো, কেন তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে, আমাদের কাজ শেষ হলে-না আমরা ফিরবো। পুলিশ হাসতো, আড্ডা দেয়া কি কাজ, মশকরা হচ্ছে, না! তারপর খুব রেগে যেতো। বলছি-না, রাতে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি নিষেধ, কথা কানে ঢুকানোর ব্যবস্থা করছি তাহলে? আমরা আমাদের সাহসের সীমা আবিস্কার করে লজ্জায় মরে যেতাম, একে অপরের দিকে আর তাকাতে পারতাম না। এখন কী হবে? আমরা যে-রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতাম সে-রাস্তায় একটা প্রকৌশল ভবন ছিলো, একটা মসজিদ ছিলো, তার দুপাশে দুটা পার্কও ছিলো। আমরা যে-রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতাম, সে রাস্তায় যা ঘটতে দেখতাম, তা লেখার মতো কোন বিষয় বলে আমরা কখনোই ভাবতাম না। আমরা ভাবতাম, এসব সাংবাদিকের কাজ, আমাদের কাজ-না। ভাবতাম, এসবতো প্রতিদিনের বিষয়, এসব আবার লেখার বিষয হয় কিভাবে!

আমরা যে-রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতাম সে-রাস্তায় কোন আবাসিক ঘরবাড়ি ছিলো না, তাই স্থির কোন মানুষ সে-রাস্তার কোথাও ছিলো না। যারা ছিলো, তারা শুধু হাঁটতো আর হাঁটতো। হয় ঘরে ফেরার তাড়া, আর না হয় অফিসে ছুটার তাড়া। আর তাদের যেহেতু এসব দেখার সময় নেই, তাই আমরা ছাড়া এসব ঘটনা কেউ দেখতে পেতো না, বা দেখতো না, কিংবা কখনোই দেখার মতো মনে হতো না তাদের কাছে। কিংবা তাদের পথের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ালে, তারা এসব ঘটনার প্রতি চোখ কুচকে তাকাতো। আর ভাবতো, এসব অসভ্য ঘটনা। এর বেশি কিছু নয়। আর না দেখার ভান করে চলে যেতো। আমরা যে-রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতাম, তারা কখনো এসব বিষয় লেখার বিষয় বলে মনে করতাম না। ফলে এ রাস্তায় কখনোই কিছু ঘটতো না।

আমার যে-রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতাম, সে-রাস্তার উভয় পাশে কোন আবাসিক এলাকা ছিলো না, তাই কোন মানুষ ছিলো না, তাই তারা অপরাধ করতো না কেউ। আর আমরা জানতাম এই রাস্তায় কোন অপরাধই ঘটে না। কিংবা সে-কারণেই অপরাধ ঘটার সম্ভাবনা বেশি। ভাবতাম পুলিশ অনেক দরদী, যাদের ছিনতাই হয়ে যায়, দুর্গত লোকদের তারা রাস্তায় ফেলে চলে যায় না, তাদের কাছে এসে কোমল স্বরে অন্তত দু একটা কথা জিগ্যেস করে, অন্তত্ব কী হয়েছে জানতে চায়, দুএকটা উপদেশ দেয়, যাতে ভবিষ্যতে তারা আর এ ধরনের বিপদে না-পড়ে। আর গরীব মেয়েটাকেও অন্তত বাঁচতে দিচ্ছে। আর পলিথিন ঘরের ভেতর থেকে যে-লোককেই তারা ধরুক না কেন, তাকে ছেড়ে দেবে ঘন্টা দেড়েক পর, তাদের ভ্যান থেকে নামিয়ে দেয়া হবে রাস্তার ওপর, কোন ল্যাম্পপোস্টের নিচে। তার পকেটে যা থাকবে তা না হয় নিয়ে নিলো, কিন্তু তার সম্মানটাতো বাচিয়ে দিলো, তার পরিবারটাতো ভাঙার হাত থেকে রেহাই পেলো। কী জানি পুলিশেরও হয়তো ওই লোকটার মতো একটা ফুটফুটে মেয়ে আছে। হয়তো সেও পুলিশকে বলেছে, স্যার, আমার ছোট্ট একটা মেয়ে স্কুলে যায়, রোজ সকালেই তার আমাকে চাই, আমাকে ছাড়া ও স্ট‹ুলে যেতে পারবে না, স্যার। স্যার, বউ চলে গেলে আমার মেয়েটা কী বাঁচবে স্যার? পুুলিশ নিজের মেয়ের মুখের কথা ভেবে আইনের কথা ভুলে যেতো। আইনের কথা ভুলার জন্য লোকটার পকেটের টাকাটা যদি নিয়ে নেয়, তাতেতো কিছু বলার থাকে না। কারণ তার হৃদয় আরো অনেকে বড়ো মনের পরিচয় দিচ্ছে। পুলিশ হয়তো আবিস্কার করে লোকটার বউটার আসলে গোপন রোগ আছে, লোকটা কী অসহায়? হয়তো ভাবতো, ওই পলিথিন ঘরের মেয়েটার চেয়েও অসহায়। কিংবা এসব কিছুই ভাবতো না। ভাবতো দেশে কত অরাজকতা চলে। এটা আর এমনকি। এটাতো প্রতিদিনই ঘটে। মাঝখান থেকে ওই পলিথিন ঘরের মেয়োটার প্রাণটা আর ওর ছোট মেয়োটর জানটা বেঁচে যায়। ফলে ছেড়ে দেয়।

আমরা যে-রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতাম সে-রাস্তায় পলিথিন ঘরের মেয়েটাকে জিগ্যেস করলে এসবই বলতো। তোমাকে ধরে না কেন? সে বলতো, তাহলেতো বেঁচে যেতাম, কিছুদিন-যে তিনবেলা হাজতের ভেতর কিছু খেতে পাবো, অন্তত সে নিশ্চয়তা মিলতো, এ কাজ থেকেও কয়েকদিনের ছুটি পাওয়া যেতো। কয়েকটা দিন খেয়েদেয়ে থাকি, তারা আমাদের সে-সুযোগ দেবে না। আমরা সে-রাস্তায় তার কথা শুনে অবাক হতাম না, হাসতাম। একজন বলতো, রোজগার-তো ভালই করতাসস, হা হুতাশ করতাসস ক্যান, হাজতের ভাত কী বেশি মজা? সে হাসতো। আমরা তারে বলতাম, পাঁচটা টেকা দে না, চা খামু পথে। সে মাঝে মাঝে দিতো, আর মাঝে মাঝে হেসে ফিরিয়ে দিতো। আর লোকটার আসলে কী হলো তা না জেনেই হাঁটতে হাঁটতে আমরা বাড়ি ফিরতাম। লোকটার কী হলো তা জানা সহজ নয়, কারণ তাকে তো আর এখানে দ্বিতীয়বার দেখতে পেতাম না। বা আমরা যেসময় এ পথ দিযে যেতাম সে সেসময় যেতো না, যেতো হয়তো অন্য সময়ে। তাই তার কী হলো আমরা না জেনেই নিবির্ঘেœই এ পথ ধরে হেটে যেতাম।

হাঁটতে হাঁটতে আমাদের পা ব্যাথা করতো। খালি পেটে হাঁটলে কান্তিতো লাগবেই, বলে উঠতো কেউ। তাই চা খেতে চাইতাম বারবার। আর সিগারেট টানতে চাইতাম। আমাদের কারো পকেটে টাকা থাকতো না। ভাগ করে চা সিগারেট খেতাম। টাকাও ভাগ করে নিতাম। আমরা কিছুদিন বলতে থাকতাম, দেখো কাপে দিনদিন চায়ের পরিমাণ কমে যাচ্ছে, তারপর ফের কিছুদিন বলতে থাকতাম, কাপটা দিনদিন ছোট হয়ে যাচ্ছে, খেয়াল করতাসস। সিগারেটের দাম বেড়ে গেলে কিছুদিন বলতে থাকতাম, আর সিগারেট খাবো না। বলতাম, খালি পেটে চা খাওয়া একদম ঠিক না। কেউ একজন বলতো, গ্যাস্ট্রিকে চা সিগারেট একদম নিষেধ। অন্যজন বলতো চা-সিগারেট ছাড়া আর খাওয়ার মতো কিছু আছে নাকি দুনিয়ায়। সবইতো ভেজাল। অন্যকেউ বলতো, আমার পিঠের উপরের ডানপাশ সারাণ চিনচিন করে। বা বলতো মেরুদন্ডের উপর থেকে শুরু হয় আর শেষ হয় কোমরের শেষ কশেরুকায় গিয়ে। টানা পাঁচসাত ঘন্টার ব্যাপার। আমরা হাসতাম, বলতাম তিনটা চা-কে পাঁচটা কাপে দাও। দোকানদার বলতো, তিনটাকে পাঁচটা বানালেতো আবারো বলবেন চা কম দিছি। একজন বলতো, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করাই বড়ো চিকিত্সা। সময়মতো খেতে হবে। আরেকজন উত্তর দিতো, আজকে সকালে খাইনি। কিংবা আজকে দুপুরে খাই খাই করেও শেষপর্যšø খাওয়া আর হলো না, একটা লেখা নিয়ে ভাবছিলাম, কিন্তু দিনদিন শব্দের গোদাম এতা খালি হইছে, যে কোন বিষয়কেই আর ঠিকঠাক ভাষায় ধরতে পারছি না। দোকানদার চা দিলে বলতাম, আরো একটু লিকার দাও, চিনি বেশি হয়েছে। তো অন্যজন বলতো দুধ কম হয়েছে। দোকানদার বিরক্ত হয়ে বলতো, সেইতো চারকাপই আদায় করে নিলেন। কিন্তু দামতো তিনটারই দিবেন। আমরা বিরক্ত হয়ে বলতাম, আমরা প্রতিদিনের কাস্টমার, আমাদের কথা আলাদা। কেউ হাসতে হাসতে বলতো, ভালো দোকানদারের লণ কি জানিস, বেশি চা দিবি, দাম কম রাখবি। দোকানদার বলতো, আপনারা দোকানটা কিনে নেন, আপনাদের দোকান থেকে সবসময় আমি চা খামু। আমরা বলতাম, এতো চা খাই, টাকা থাকলে দোকান কি আমরা দিতাম না, কত আর চায়ের কাপে বঞ্চনা সহ্য করা যায়। চায়ের কাপে বঞ্চনা বুঝছস, বলে আমরা হাসতাম। আমরা চা খেয়ে আবার হাঁটতাম।

আর আমরা যারা হাঁটতাম, হাঁটতেই থাকতাম, বেশিরভাগদিনই পকেটে বাসভাড়া কম পড়তো বলে, আর মাঝে মাঝে বাসই থাকতো না বলে, এতো রাতে, আমরা স্বপ্ন দেখতাম একদিন লেখক হয়ে যাবো, এসব তুচ্ছ ঘটনার দিকে চোখ বন্ধ করে রেখে। আর আমরা যারা এ রাস্তা দিয়ে হাটতাম আমরা কেউ কারো লেখাই পছন্দ করতাম না। কেউ হয়তো অপরের লেখার একটা বা দুইটা লাইন পছন্দ করতাম, বা কোন একটা শব্দ, তা বেশির ভাগ সময়েই আন্তরিক থাকতো, কিন্তু কখনো অন্তত এই শব্দটা না লেখার খুবই ভাল লেগেছে বলে লেখকের মান-সম্মান বাঁচানোর চেষ্টা করতাম। আমরা বলতাম, ঐ যে লেখকটার নাম যেনো কী, ঐ যে লেখকটা! কোথায় যেনো তার একটা লেখা পড়েছিলাম: “ধূলোর রাজ্যে একটুখানি চারাটির বীজভেঙে বেরিয়ে আসার কী সাহস, দেখে ঈর্ষা করে সারারাত তারাগুলো, আর তার সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে অসম্ভব মুগ্ধ চাঁদ-- জোছনা নয়, বৃষ্টি এসে ধুয়ে গেছে তার গায়ের ধুলো, এই একটু আগে, বৃষ্টি-স্নানের পর এবার সে ততোধিক ভালোবাসে জোছনা-স্নান...” একে অপরের মুখের দিকে তাকাই আমরা, যে লিখেছে তার নাম মনে করার চেষ্টা করি, পারি না কিছুতেই মনে করতে। কেউ একজন ভাবে, সে এখন বানিয়েছে এ লাইনকটা, কারণ আমরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেটা ছিলো ফুটপাত, পাশেই একটা চারাগাছ ধূলোর পোশাক পড়ে দাঁড়ানো, দেখতে আমাদের গায়ের ময়রা বিবর্ণ জামার মতোই। ল্যাম্পোস্টের কারণে সৌন্দর্যনিঃস্ব একটা চাঁদ ঝুলছিলো তখন আকাশে। সে তাকিয়েছিলো চারাটির দিকে আমরা খেয়াল করলাম, তারপর আকাশের চাঁদটার দিকে, হয়তো এ দৃশ্য-দৃকপাত থেকেই হয়তো লাইনকটা জন্মেছে। আর চারাগাছটার দিকে তাকিয়ে আমাদের মনে হলো সেটা বেশ ময়লা, আর আমাদের পরস্পরের জামার দিকে তাকালাম। মনে হলো, আমাদের জামাকাপড় আরো অনেক ময়লা, ধোয়া হয় না অনেকদিন। আমরা আবার গাছটার দিকে তাকাই। একজন বলে ফুটপাতের কংক্রিটের ফাঁকে জন্মানোর বড়ো সুবিধা কী জানো, তাকে কখনো বড়ো হতে হবে না। কেউ একটা লাইন বলে, আমরা লেখকের নাম মনে করতে পারি না। সে বলে, তোরাও কি তাকে পড়িসনি, আমি তো ভাবতাম তার পুরো রচনাবলি কবেই পড়ে ফেলেছিস তোরা। কিন্তু আমরা চুপ থাকতাম, কারণ আমরা একটা বই কেনার জন্য বছর কাটিয়ে দেই। কেনা আর হয়ে উঠে না, কারণ আমাদের পকেট বেশিরভাগসময়েই আমাদের হেল্প করে না। আমরা পছন্দের বইটার ফø্যাপটা বারবার চেখে আসি, দোকানে ঢুকে প্রায় সন্ধ্যায়। প্রায় ভাবি, টাকাটা পেলেই কিনে ফেলবো। কিন্তু টাকা কোত্থেকে আসবে তা আমরা জানতাম না কখনোই। কিন্তু তাতো আমাদের চাই চাই, কিন্তু কিভাবে তা আমরা জানতাম না, কিন্তু আমাদের মুখেও হঠাত্ থাপ্পড় কষাতো ঐ প্রশ্ন: 'Ars longa, vita brevis?' কিন্তু উত্তর আমাদের সবসময়েই বিভ্রান্ত করতো, কিংবা কোন উত্তরই আমাদের তুষ্ট করতো না। কিংবা তৃতীয় কোন উত্তর আমাদের হাতে ছিলো না। ফ্যাপওয়াইজ আমাদের বিকাশ ঘটতো, আর কেউ কেউ আমাদের ফ্যাপ-ওয়াইজ বলেও ডাকতে চাইতো। আমাদের পড়ার টেবিল ছিলো না, আলাদা রুম ছিলো না। তাই আমাদের প্রতিভা ছিলো দুর্দান্ত লেখার জায়গা আবিস্কারে, ছেঁড়া কাগজ, সিগারাটের প্যাকেটের উল্টো পিঠ, বা কারো দেয়া ওষুধ কোম্পানির ছোট প্যাড। আর এসবে জায়গা খুবই কম বলে আমরা ছোট ছোট টুকরো টুকরো করে লেখার অভ্যাস করে ফেলেছিলাম, আমরা হাইকো আবিস্কার করে ফেলছিলাম, হাইকো সম্পর্কিত আমাদের স্মৃতি গিলে খেয়ে। মহত্ সংপক্ষপন গুন। স্পষ্টতার অতুলনীয় দাম। আর ব্যাপ্তির বিশালতা। আবিস্কার করতাম আমরা। ছোট লেখাগুলোর ভেতর। আর অকৃতজ্ঞ হয়ে পড়তাম ঐ ছেঁড়া ছোট কাগজটুকরোগুলোর প্রতি, যারা আমাদের কোন লেখাকে বড়ো হতে দিতো না। আমরা কাউকে শোনানো মাত্র বলতাম, বুঝলেন। পাঠক বলতো, হা বুঝলাম। “মাটির পৃথিবীর নদীতে নত্রগুলো সাঁতার কাটছে, কোন আকাশের-যে সন্তান তারা, তাদের গা-জুড়ে পা-জুড়ে আলো মুখজুড়েও দেখো তা-ই, এমনকি পায়ের তলাতেও দেখো কী অদ্ভুত কোন ধূলো নাই!” সংক্ষেপের তাত্পর্য যদি এতই ভীষণ হতো, তাহলে জগত সংক্ষেপেই কেন সৃষ্টি হলো না! আমাদের কেউ বলতো, জগত অবশ্যই খুবই সংক্ষিপ্ত, তাই এর বিকাশ আজও থামছে না। আমাদের কেউ ফুরণ কাটে- কিন্তু আমাদেরই কোন বিকাশ তো হচ্ছে না, এমনকি ঐ চারগাছটিরও দেখো বিকাশ হচ্ছে, দেখো। তখন চারাগাছটির দিকে তাকিয়ে আমরা ভাবতাম, গাছটির বড়ো হওয়ার যন্ত্রণা সইতে হবে না। হাইকু গাছ। আমরা যারা এ রাস্তা দিয়ে হাটতাম, গাছটির মুখোমুখি হলেই বলে উঠতাম, হাইকু-গাছটা কেন বাড়ছে না!

কেউ না কেউ বলে উঠতো, ও হাইকু গাছ, আমরা কেন বাড়ছি না? একজন বলতো, আমার এতো বিকশিত হয়েছি, এতো বিকশিত হয়েছি, এতো বিকশিত হয়েছি যে.. আরেকজন বলতো, বিকাশই আর সম্ভব নয়। আমরা বলতাম, জ্ঞানীরা কম বলে, ছোট করে, সহজ করে বলে। আমরা বলতাম, মানুষের ব্যস্ততা দিনদিন বাড়ছে, বড়ো লেখা পড়ার সময় কই। তাই কবিতা এখন থেকে খুব ছোট হতে হবে। যেনো আগে কোনো কালে ছোট ছিলো না। টু সি দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন এ গ্রেইন। কিন্তু তবু কেউ একবার যেনো বলে উঠেছিলো, তাহলে মানুষ সিনেমা নাটক দেখে কেন, মানুষ উপন্যাস পড়ে কেন। কিন্তু আমরা এ কথা ভুলে গিয়েছিলাম। আমাদের সুবিধা একআধটুকরো লাইনেই। আমরা কি এর বেশি চাইলেই লিখতে পারতাম! সবচেয়ে বড়ো কথা হলো-- আমরা বড়ো করে কিছুই লিখতে চাইনি, এই অতি ব্যস্ত ও অতিগতিশীল দুনিয়ায়। এটাই আমাদের নন্দন তত্ত্ব।

আমরা যে-রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতাম অন্যান্য রাস্তার মতো সে-রাস্তা দিয়েও সময় হাঁটতো, তবে আমরা উল্টোটা অনুভব করতাম, একে অপরকে বলতাম সময় আমাদের সাথে কখনোই হাঁটছে না, কেবল অন্য পথ দিয়েই হাঁটছে। আর নিজেদের অজান্তে কেউ কখনো দীর্ঘশ্বাস ফেলতো। আর তা ল্য করে অন্যকেউ ঠিক হেসে ফেলতো। ল্যম্পপোস্টের আলোয় তার চিবুকে ঠোঁটের কোনায় হাসির টুকরোটাকে দোল খেতে দেখতাম আমরা। ঠিক শিশিরের মতো। আর যেদিন যে আমাদের সাথে থাকতো না, ভাবতাম তার পকেটে নিশ্চয় টাকা আছে। তাই আমাদের এড়িয়ে চলছে। কিংবা আমরা তার লেখালেখি নিয়ে সমালোচনায় মেতে উঠতাম। বলতাম, ও শালা এক রবীন্দ্রনাথের বিশ-ত্রিশটা কবিতার বেশি পড়েনি, জীবনান্দের আটদশটা, মাইকেল ছুঁয়েও দেখিনি, আটদশটা উদ্ধৃতি ছাড়া। দেখবি সে যখন কারো লেখার মাঝে প্রভাব আবিস্কার করে, তখন সেইসব প্রভাব ঐ কটি লেখার ভেতরই ঘুরা ফেরা করে, খেয়াল্গ করছস, আর-কারো নাম, বা এর বাইরের কোন কবিতাটবিতার নাম সে বলতে পারে না। আমরা যারা এই রাস্তায় হাটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতাম, অথচ এভাবেই তাদের বছরগুলো আত্ম-পরিক্রমায় বারবারই শেষ করে ফেলতো। কেউ বলতো, ভাত খাইতে পায় না, বই খাওয়ার পয়সা পাবে কই। কেউ বলতো, লিখতে এসে এভাবে দারিদ্রে ভোগার জন্যতো আমরাই দায়ী, তাই না? আমাদের শেষপর্যন্ত নিজেদের দায়ী করা ছাড়া কোন পথ খোলা থাকতো না। কেউ বলতো, এ দীর্ঘ পথ পার হওয়াটার একটা বড়ো তাত্পর্য আছে না, কী কস তোরা! এটা জীবন, এ জীবনটাইতো আমরা পাড়ি দিচ্ছি, এর ভেতর দিয়ে সময় একদিন কথা বলবে দেখিস। আমরা হাসতাম। আর বলতাম, সময়ের জিভ নেই। আর দেখ, তোর জিভটাওতো ধার পাচ্ছে না। তা না-হলে, চারপাশে কি তোর মতো সময় নিজের অস্তিতের জানান দিতো না, আমাদের কানফাটা চেঁচানিতে। সে হাসতো। আমরা হাসতাম। যদিও আমরা কখনোই চেঁচামেচি করতাম না। আমরা একে অপরের ভেতরে কেমন মিলে মিশে যেতাম। আমাদের আলাদা করতে পারতাম না। আমরা ভীষণভাবে আলাদা হতে চাইতাম, পারতাম না। কারণ স্বতন্ত্রের অনেক দাম। ওকেই অনন্যতা বলে, ওকেই মৌলিকতা বলে। এরই আকাশছোঁয়া দাম চারপাশে, আমাদের তা জানতেই হয়েছিলো। আর আমাদের পকেট তার সমর্থন জুগিয়েছে, সবসময়েই। আর তা এড়িয়ে আমরা অণ্যভাবে ভাবতেও পারতাম না। এসব আমরা কিভাবে যেনো শিখে ফেলেছিলাম।

আমাদের মাঝে মাঝে ভ্যানে করে পুলিশেরা বাড়ির কাছের রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে আসতো। নামিয়ে দিলে, তাদেরকে আমরা ধন্যবাদ জানাতাম। আর ভাবতাম, এই পুলিশ অফিসারটা কী ভাল, কী অমায়িক। আমরা পরের দিন সে কথা অপরকে বলতে ভুলতাম না। আর একে অপরকে বলতাম, সকলেই খারাপ না, বুঝলে। আমরা এক অপরে দিকে তাকিয়ে হাসতাম। আর কেউ বলতো, তাদের সাথে খাতির রাখা ভাল। কারো বাড়ির সামনে কাউকে পুলিশ ভ্যান থেকে নামিয়ে দিচ্ছে, এটা অসম্মানের বলে জানতাম, কিন্তু আমাদেরতো এ ছাড়া উপায় থাকতো না।

আমরা যে-রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতাম, সে-রাস্তার বাইরে আমাদের সম্পর্কে বাড়ি অবধি টেনে নিতাম না। তার আগেই আমাদের পথ আলাদা করে নিতাম। তবু কেউ কেউ থাকার জায়গা হারাতো বলে অপর কারো সাথে নাছোড়বান্দার মতো যেতে চায়তো। আর যার সাথে যেতে চায়তো সে বলতো, আজকে অনেক মানুষ বাসায়, থাকার জায়গা নেই, তা ছাড়া খাওয়াদাওয়া কী আছে কে জানে। আরেকদিন যাস। তবু চলে যেতে হতো। আর বাসায় পৌছে বল্পব্দুকে কাপড় বদলাতে দিয়ে, আবিস্ট‹ার করতাম অতিরিক্ত তেমন পোশাক নেই যা বল্পব্দুকে দেওয়া যায়। পোশাক বদলের সময় একে অপরের দিকে তাকিয়ে আবিস্কার করতাম, একজনের গায়ের গেঞ্জী কতকালের ময়লা, কালচে হয়ে আছে। অন্য জনের গায়ে আবিস্কার করতাম, হায় তার পাঁজরের একপাশ বেশ দুমড়ানো। আবিস্কার করতাম, সে কেন কখনোই খালি গা হতে চাইতো না। কথা বলতে বলতে মাঝরাতে ভাঙা ট্রাংক থেকে খুলে দেখাতো কতকাল আগের পুরেনো একটিদুটি চিঠি, যাতে একে অপরের প্রতি দুর্বলতার অক্ষরগুলো লেখা, যা তখনো গভীর প্রণয়রূপ করেনি ধারণ, ওহে সখা। তো আর যোগাযোগ নেই। কিংবা আবিস্কার করতাম, হারানো মানুষকে নিয়ে কারো অনেকগুলো অদ্ভুত স্বপ্ন যেগুলো কখনোই মাটি পাবে না, এমনকি সম্ভাবনা নেই টবের গাছ হয়ে ওঠারও। আমরা একে অপরের বাড়িতে না যেতে চাইলেও, না গিয়ে উপায় থাকতো না প্রায়ই। আর বাড়ি গিয়ে আবিস্কার করতাম, ঘরের চালে অনেক ফুটো, সেগুলো আমরা লুকুতে পারতাম না। কারণ বৃষ্টি তো আর মেহমান চিনতো না, যদিও আমরা কখনোই কারো বাড়িতে মেহমান বলে গন্য হতাম না। বিব্রতের কারণ বলেই গণ্য হতাম। যদিও একে অপরকে কখনোই তা বলতাম না। আকস্মিকের মেহমানদের আরো না। চালের ফুটো বেয়ে পড়া ফোঁটাগুলো কেমন লজ্জিত করে তুলতো আমাদের। ফলে বালতি, বাসন বাটি একেকটা ছিদ্রের নিচে দিতাম। আর বলতাম, বাসার মালিক ঠিক করে দিচ্ছে না। কত করে বলছি। বর্ষায় যদি বিছানা গুটিয়ে রাখতে হয়, যদি মেঝেয় ভিজে যায়, তাহলে বলো কী করে ঘুমাই। বর্ষায় তাই আমরা প্রায় ঘুমাই না, রাত জেগে থাকি। আর টিভিতে বাংলা সিনেমা দেখি, হিন্দি সিনেমা দেখি। গল্কপ্প করি আর বলি, দুএকটা রাত না ঘুমোলে কী হয়!

আমরা যে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতাম, তারা কখনো ওই রাস্তার বাইরে আমাদের সম্পর্ককে গড়াতে দিতাম না। আর তবু বাধ্য হয়ে সম্পর্ক রাস্তা থেকে বাইরে গড়িয়ে পড়তো। গড়াতে গড়াতে কারো না কারো বাড়ির দিকে চলে যেতো। আর দরজায় কড়া নাড়তো মাঝরাতে। বলতে হতো, আজকে রাতটা কি থাকা যাবে। বাধ্য হয়ে আমরা দরজা খুলতাম। আর বলতাম, ভেতরে আয়। আর কাচুমাচু হয়ে বাসার বা মেসের অন্যদের বলতাম, ও আমার বন্ধু, আজকে রাতটা থাকবে। বলতাম, কত করে বলি, আমার বাসায় আসিস না। এখন বালিশ পাবো কই। বিছানা পাবো কই। তো কী আর করা, চল জেগে জেগে গল্প করি, বারান্দায় বসে। আর হাতমুখ ধুয়ে নে, বলেই বলতাম, পানি থাকে না। ঢাকা শহরটা একেবারে ধ্বংস হযে গেছে। বালতির অল্প পানি দিয়ে হাতমুখটা ধুয়ে নে। আর খাবার কিছু আছে কিনা রান্নাঘরে গিয়ে দেখে আসতাম। আর বল্পব্দুকে বলতাম, যা পড়ে আছে তাই একটা ডিম ভেজে কোনরকম খেয়ে নে। এতো রাতে তো কোন দোকান খোলা নেই। তাছাড়া আমার কাছে টাকাও নেই। তো বেরিয়ে পড়তাম দুজনে মিলে, আর ডিম কিনে ফিরে, ভেজে, খেয়ে, নিজেদের ক্লান্ত চেহারার দিকে চেয়ে, একে অপরের জন্য একটু মায়া অনুভব করতাম। খাওয়া শেষে সে বলতো, তোর বইয়ের কালেকশনটা দেখা না। বলতাম, খাওন পায় না, বইয়ের কালেকশন। আর জানতে পারতাম, তার টেবিল নেই, বই কয়েকটা মাত্র। তারও কয়েকটা আবার বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে আনা। বাকি কয়টার বেশিরভাগগুলোরই কোন মূল্য নেই সাহিত্যগতভাবে বা সমকালীনতার অর্থে। আর দুএকটা বিশ্বখ্যাত বইয়েরর পুরোনো ময়লা কপি। এই তো। কেউ তখন মার্ক টোয়েনের মতো বলবে, এই বইটা-না, ওইযে লোকটা-না, তাকে চিনো না(?!), তার বাসায় গিয়েছিলাম, তখন, পড়ার জন্য এনেছিলাম। আর ফেরত দেইনি। আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে বলতে পারতাম না, এই ভাবেই যে আমরা চালিয়ে দিচ্ছি, এভাবে কী কিছু হবে, হবে না। হতে পারে যদি প্রতিভা আকাশ থেকে নামে। তখন তো, ঘোরাফেরা বা বইপত্রে বা লোকজনের সাথে কথাবার্তারও কোন দরকার নেই। আকাশ থেকে মাথার ভেতর সরাসরি লেখা নাজেল হবে। আর আমাদের শুধু এই সম্ভাবনাটুকুই আছে। একজন একবার চেচিয়ে বলছিলো, জগতকে তীব্রভাবে পর্যবেণ না করলে লেখক হওয়া যায় না। আরেকজন বলছিলো, আমিতো লেখকই হতে চাইনি। আবার আরেকজন বলেছিলো , সারদিনই এতো হতাশ লাগে, এতো বিষাদ নিজের ভেতরে গিয়ে ঢুকে থাকে, চোখ দুটো নিজের চিšøায় ম¹ু থাকতে থাকতে কাšø। বিষাদে ডুবে নিজেকে যেমন পর্যব্ষেণ করা যায় না তেমনি শতজনকে তো দূরের দ্বিতীয়কাউকেই, এমনকি প্রতিদিনের সঙ্গী একজন বন্ধুকেও পর্যবেণ করা যায় না। জীবন তা এলাও করে না। অন্যজন হাসতে হাসতে বলে, ঠিক বলছিস। কিন্তু আমাদেরতো লেখা ছাড়া উপায় নেই। আমাদের আর কোনো পরিচয় নেই, পেশা নেই, নেশা নেই, শখ নেই, বিদ্যা নেই, দতা নেই, চাকরি নেই, প্রেমিকা নেই, আমাদের লেখকই পরিচয়টাই শুধহৃ আছে। আরেকজন আসতে হাসতে কয়, তোর লেখক পরিচয় আছে কে কয়ছে? আরেকজন হাসতে হাসতে বলে ডানে বামে হেলে পড়ে, তোর লেখাইতো কোথাও প্রকাশ হয় না। আরকজন বলে, তবু আমাদের লেখক সেজেই থাকতে হবে।

আমরা যারা এই রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতাম, তারা কখনোই একে অপরকে ঘরে নিয়ে আসতে চাইতাম না। তবু কেউ বাধ্য হয়ে অপরের ঘরে চলে যেতাম। আর আবিস্কার করতাম, একে অপরের মাবাবার চোখের অশ্রু। বাবা, আমার ছেলেটার কত বয়স হলো। একটা কিছু তো তার করা উচিত। এভাবে লেখেটেখে সে তো তার নিজের একবেলা ভাতও যোগাতে পারছে না। কতবার বলেছি, গরীবের জন্য লেখালেখি না। কিন্তু ও শোনে না। ওর নেশা লেখালেখি করবে। কিন্তু কই কেউতো ওকে ডাকে না। তোমরা বন্ধুবান্দবরা মিলে ওকে কোথাও ঢুকিয়ে দাও না। আর আমরা আবিস্কার করতাম, আমরা আমাদের মা বাবাকে ধমকে দিচ্ছি, লেখালেখি কি টাকাপয়সার জন্য করে কেউ! বন্ধুর মুখের দিকে তাকিযে বলতাম, এরা মুখর্, এদের কথায় কান দিও না। তো মায়ের কান্না থামতো না। তখন আমরা ঘুমোতে বিছানায় এসে অনেকণ চুপচাপ সিগারেট খেয়ে, শুয়ে থেকে, গড়িয়ে, রাত পার করে দিতাম। আর আমাদের জীবনের গল্পের ভেতর কখনোই মনে পড়তো না যে, আমাদেরও কোথাও না কোথাও দুয়েকটা আনন্দের ঘটনা নিশ্চয় আছে। আর ভোরের দিকে কখন যে চোখ বুঝতাম, দিনের বারোটার আগে চোখ মেলতে পারতাম না। আর বিদায় নেওয়ার সময় বলতাম, চল দোস্ত, আমার বইটা থেকে দুটো লেখা পড়ি। একজন পড়তে থাকলে, আরেকজন শুনতাম, আর মুখ কুচকাতাম। কী আজেবাজে লিখে যে বই বাইর করছে, আল্লা মালুম। একে অপরকে বলতাম, মানুষ এতো মুর্খ, আর চকচকে যে, তার মুখের আলো লেগে বই ঝাপসা হয়ে যায়, অরগুলো আর দৃশ্যমান থাকে না। বলতাম, কত আর বই গিফট করবো, বন্ধুদের বই গিফট করার জন্যতো বই বের করি নি। কিন্তু গিফট করা ছাড়াতো কোথাও এক কপি বিক্রি হয় না, এমন মুর্খের দেশে জন্ম নিলাম, কোন শালার কোন চেতনা বা অনুভ’তি বলে কিছু নাই। বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম। তখন আরেকজন বন্ধু বলতো, একটা বই বের করতে গিয়ে এতোটাকা ধারকরলাম যে, এখনও শোধ করতে পারছি না।



আমরা যারা এই রাস্তা দিযে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতাম তারা একদিন আবিস্কার করলাম, আমাদের তেমন কোনো যোগ্যতা নেই, তেমন কিছুই হয়ে ওঠিনি আমরা, বরং সবচেয়ে বেশি পরনির্ভর হয়ে উঠেছি। কিন্তু তা আমরা মেনে নিতে পারছি না। আর আবিস্কার করি, আমাদের যারা পরিচিত ছিলো তারা কেউ আর আমাদের আড্ডায় আসে না। আমরা চা খেয়ে টাকা দিতে না পারলে, ভাবি, পুরোনো কেউ এলে, বিলটা দিতো নিশ্চয়। আর দেখি, কেউ আসে না, সেদিন। আমরা যারা হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতাম তাদেরও শখ ছিলো গেয়ে ওঠার। কিন্তু কোনদিনও গান শিখতে যাওয়া হয়নি আমাদের। আর এখন সারাদিন কারো সাথে আমাদের কারো কথা হয় না। সন্ধ্যায় দেখা হলে বলি, আজকে তোমাকে একটা গান শোনাবো। আর আমরা জানি, তার গাওয়া খুব জঘন্য হবে। কিন্তু এর ভেতর দিয়ে সে অনেক হালকা হবে, এটা নিশ্চিত। তাই আমরাও কষ্ট সহ্য করবে। একে কি ক্যাথারসিস বলে? ক্যথারসিস কি গায়কের, না শ্রোতার? দুটোই মনে হয়। কিন্তু নিশ্চিত নই আমরা। কারণ নিশ্চিত হওয়ার জন্য যতোটা জ্ঞান আমাদের অর্জন করা দরকার ছিল, ততটা করার সময়, বোঝার মতা, ততটা ব্যয় বহনের সামর্থ্য আমাদের কারোই ছিলো না। আমরা, তাই, তাকে গাইতে দেই। শ্রোতা হিসেবে, আমরা কষ্ট সহ্য করি। একসময় তার সাথে আমরাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথা ঝাকাই। সেও আরো বেশি ঝাঁকায়। আর গান শেষে আরেকটা গাইতে চায়। আমরা বলি, আজকে থাক। সে বলে, আমি জানি, তোমাদের ভাল লাগেনি। কিন্তু কী করা এর চেয়ে ভাল যে আমি গাইতে পারি না। আমরা বলতাম, না না, আজকে তোমার গলাটা ঠিক খুলছে না। তাই আর গাওয়া ঠিক নয, এ-ই বলছিলাম আরকি।

আমরা যারা হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতাম। তাদেরকে কতজনই না হ্যালো বলতো। আমরা ভাবতাম, সম্মান করছে। তারপর আবিস্কার করতাম, আমাদের আর হ্যালো বলছে না। অন্যদের সাথে মিশে গিয়ে আমাদের দিব্যি ভুলে গেছে। আর তারা তখন আমাদের আড্ডার এলাকায় নতুন ছিলো বলে আমাদের হ্যালো বলে সঙ্গ জুটাতে চাইতো। এটাইতো স্বভাবিক। আমরাও তাকে সাথে ভিড়িয়ে নিতাম। কয়েকদিন অন্তত চায়ের বিল দেবে। তারপর তারা আবিস্কার করতো, আমরা শুধু বড়ো বড়ো কথা বলি, কাজের নামে ঠনঠন। তারা স্বীকার করতো যে, আমরা ভাল বুঝি। আমাদের অনেক মেধা। বলতো, আমাদের কষ্ট লাগে যে, আপনারা কিছুই করছেন না। এভাবে সময়টা অপচয় করছেন। আমরা বলতাম না কিছুই। আমরা ভাবতাম, দেখো, স্বীকার করছে আমাদের প্রতিভার কথা। আমাদের বোঝাবুঝির কথা। আরো কিছুদিন পেরিযে গেলে বলতো, আমাদের জন্য সুযোগের অভাব তাদেরকে ব্যাথিত করে খুব। কিন্তু আরো কিছু দিন কেটে যাওয়ার পর আবিস্কার করতাম, সে আর আমাদের কাছেই ভীড়ছে না। আর একেবারে মুখোমুখি হয়ে পড়লে, হ্যালো বলেই কেটে পড়ছে। আমরা ভাবতাম, থাক, যাক। চলে যাক। আর একজন আরেকজনকে কখনো একটু রেগে গিযে বলতাম, চোখ ফুটেছে বেশ। তাই আমাদের আর চোখে পড়ছে না। আমরা আবিস্কার করতাম যে, আমাদেরও ঈর্ষা আছে। আর বলতাম, ছেলেটার কিছু হবে ভাবছিলাম, কিন্তু সেই লাউ সেই কদু। ওর আর কিচ্ছু হবে না। চাকরিবাকরি সংসার এসবের ভেতরেই ও একদিন হারিয়ে যাবে। দেখবে তার আর লেখালেখি হবে না। এখন আবোল তাবোল কয়েকদিন লিখবে, তারপর আর খুঁজেও পাওয়া যাবে না।

আমরা যারা এই রাস্তা দিয়ে হাটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতাম তারা আজও এই রাস্তা দিইে বাড়ি ফিরছি, আজও, তারা ভাড়া নেওয়া একটা রুমকেই বাড়ি বলতাম। আর বাড়ির ঠিকানা না পাল্টালেও তাদের বাসার ঠিকানা কেবলই পাল্টে পাল্টে যেতো। আর আমরা প্রত্যেকেই জানতাম, এর পেছনের কারণ। কিন্তু আমরা একে অপরের এই কারণটিকে কখনোই উত্পাটন করতে পারতাম না। আমরা যারা হাটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরতাম, তারা আসলে কখনোই হ্যা কখনোই বাড়ি ফিরতাম না।









মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.