নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রাফিব্লগ

রথো রাফি

রথো রাফি লেখালেখি গাণ্ডীব, অনিন্দ্য, শিড়দাঁড়া এবং দ্রষ্টব্যেই । মূলত কবিতা অন্তঃপ্রাণ তবে গদ্যও লিখেছি কিছু। অনুবাদেও আগ্রহ আছে। বই এখনো নাই। জন্ম: দক্ষিণ তারুয়া, আশুগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। বসবাস ঢাকায়। প্রকাশনা সংস্থায় কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে, বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে ফ্রিল্যান্স কাজ করছি। [email protected]

রথো রাফি › বিস্তারিত পোস্টঃ

সংবেদ ও মননের দ্বন্দ্ব: শুদ্ধ ও অশুদ্ধ কবিতা

৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:৪২

সংবেদন ও মননের দ্বন্দ্ব: শুদ্ধ ও অশুদ্ধ কবিতা


অর্থ উদ্ধার আর স্বীকারোক্তি আদায়ের লক্ষ্যে যারা কবিতাকে চেয়ারের পায়ার সাথে বেঁধে থার্ড ডিগ্রি নির্যাতন চালায়, তাদের কথা ভাবছি না। যারা কবিতা থেকে অর্থগোপনের তীব্র জেহাদ করে থাকে, ভাবছি না তাদের কথাও। বরং তাদের কথাই এ মুহূর্তে ভাবছি, যারা প্রায়-অর্থস্বচ্ছতাকেই নক্ষত্রমাত্রায় উত্তীর্ণ করেছেন, আবহমানের এই অন্ধকারে। করেছেন সময়ের ঘটনাধারার সাথে সম্পর্কিত থেকেই। তাদের কথা ভাবতে গিয়ে কতজনের ভীড়ে কাব্বানিও আমার চোখে চট করে অন্তত এক কণা আলো ছড়ালেন। তাই আমার ভাষাবাধা সত্বেও, বাংলায় একে দৃশ্যমানতা দানের একটু তাড়াহুড়ো দেখা দিয়েছিল আমার মাঝে। তবে নিজের সীমাবদ্ধতার কারণে স্বীকার করতেই হয়, উত্সভাষা আরবি থেকে নয়, ইংরেজি থেকেই আমার বঙ্গীয় তত্পরতা চলছিল। এ কাজ তাই অনেকটা দুধের স্বাদ ঘুলে মেটানোর মতোই। তবে এখানে আমার বলার বিষয়, শুধু কাব্বানি নন। বরং তার নামের ছুতোয় আরো অনেক কিছু বলার চেষ্টা করা।
কাব্বানির কবিতা পড়তে গিয়ে আমার দেশের যে দুজনের নাম চট করে মনে এলো, তারা হলেন, আল মাহমুদ, আর শামসুর রাহমান। আর অবশ্যই ল্যাটিন আমেরিকার কবিতার পাঠকমাত্রেই পাবলো নেরুদার কথাতো মনে আনবেনই। কে না জানে তাদের সবারই রয়েছে এক প্রেমটলমল মন। আর আছে নিজ সংস্কৃতি আর সমকাল নিয়ে তীব্র সচেতনতা। এ তিন বিশিষ্টতার ত্রিবণীসঙ্গম ঘটেছে নিজার কাব্বানির কবিতাতেও। এ যেমন নির্বাসনের তিক্ত স্বাদ এনে দিয়েছে তাকে, তেমনি নিজ দেশেই শুধু নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যেই তাকে সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিদেরও একজনে পরিণত করেছে। তার কবিতাও সেই প্রমাণই বহন করে এনেছে আমাদের জন্য যে, সমকাল, ন্যায়বোধ আর শিল্পকর্ম এক দেহে লীন হলে কবিতা অধিক প্রাণোষ্ণ হয়ে ওঠে। এই দেহাত্মবোধই নিরাপোসী কবিতাকে শক্তি, ঋদ্ধি ও জনপ্রিয়তা যোগায়। এসব চাওয়া শুধু কবির নয়, পাঠকেরও। কবিতাগুলো কবির চাওয়াকে প্রমাণ করে। আর কবিতার জনপ্রিয়তা পাঠকের চাওয়াকে প্রমাণ করে।
তার তীব্র ও আন্তরিক উচ্চারণগুলো ব্যক্তির সুউচ্চ মানবিকচূঁড়াটি থেকে গড়িয়ে পড়ে অভিমানী অশ্রুর মতো পাঠক সমতলে। আর পুরো আরব বিশ্বের ইতিহাস-ধারার সমান্তরালে বেজে উঠে এই কবিতা-মনন। কল্পনা করি, আরবি ভাষায় নিশ্চয় তার কবিতার অক্ষররাজি মুক্তোর মতোই ঝলমল করে। তবে কোন সুরে, কোন স্পন্দনে, ও কোন ছন্দে তারা হিল্লোলিত-- আরবি জানি না বলে অজ্ঞাতই থেকে গেলো আমার। ইংরেজিতে পড়লেও তার কবিতার অতুল হীরকস্বচ্ছতা আর অপূর্ব উদ্বেলতা ঠিকই টের পাই যেনো। তাই আফসোস আরও বেড়ে যায় ।
কাব্বানির কবিতা পড়তে গেলে মধ্যপ্রাচ্যে তার পরবর্তী প্রজন্মের কবি নিজের দেশের এডোনিস, প্রতিবেশীদেশের মাহমুদ দারবিশ, কিংবা খানিকটা দুনিয়া মিখাইলের কথাও স্বাভাবিকভাবেই মনে আসবে। এসব কবির মতো তার উপরেও এয়াহুদা আমিচাই, আমিরী বারাকা, এলেন গিন্সবার্গ, আঁর্তোর র‌্যাবোর প্রভাব রয়েছে। আর কয়েক শতাব্দি দূরের ম্যাটাফিজিক্যাল কবি জন ডানের কাব্য কৌশল, শক এফেক্ট বা দূরবর্তী-বা-প্রায়-বিপরীত-উপাদান-বা-বিষয়ের প্রগাঢ় ইঙ্গিত উত্সারী আকস্মিক-বিজলি-সম্মিলন তার কবিতাকেও দিয়েছে আন্তরিক দীপ্তি। আর এই কৌশল ওপাড় বাংলার সাম্প্রতিক কবি রনজিত্ দাশেরও সবচেয়ে বড়ো অবলম্বন-- এ যেনো অনেকটা ভাবুক লোকের মন, আর নাগরিক মননের দীপ্তি অর্জনের প্রকৌশল।
সুফলা অনেক কবির পাশাপাশি তার কবিতা পড়তে গিয়েও মনে হলো, রাজনৈতিক কবিতা-যে প্রায়শই কবিরা লিখে উঠতে পারেন না, তা বিষয়ের দোষে নয়। বরং বিষয়টি ঘিরে কবির অভিজ্ঞতা, কল্পনা ও কারুদক্ষতার সীমাবদ্ধতাই এর কারণ।
ভাবলাম আমার এই আনন্দটুক, আমার এই তিক্ত অনুভবটুকু, পাঠকের সাথেও ভাগ করে নিই, আর যারা রাজনৈতিক কবিতার বিরোধী, বিশেষত বিতৃষ্ণাবশত, তাদের সাথেও। সে কারণেও এই অনুবাদে হাত দেয়া। তবে আর সব বিষয়কে একেবারেই প্রান্তে ঠেলে দিয়ে শুধু রাজনৈতিক কবিতা যারা অনবরত লিখে গেছেন, এই বিতৃষ্ণার পেছনে কিছুটা দায় তাদেরও রয়েছে বৈকি।
যোগাযোগ-অনিবার্যতার পূজারী হয়ে স্বচ্ছতা আর অতিসরলতাকে গুলিয়ে ফেলার ভেতর দিয়েই আমরা ঊন-কবিরা কাব্যিশূন্য-বিবৃতির জমি প্রসারিত করতে থাকি। অস্কীকার করার সুযোগ নেই যে, অনেকসময় রসহীন প্রপাগান্ডায় পর্যবসিত হয় কবিতা। এর মানে এই নয় যে, আমি প্রপাগান্ডায (ইতিবাচক অর্থে) প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করছি। বলতে চাইছি, স্বচ্ছতা, দৃঢ়তা, আত্মবিশ্বাস, ও কোনো নির্দিষ্ট মতাদর্শকে ফলিয়ে তুলতে গিয়ে সরলতার শিকার হলে চলে না কোনভাবেই। এমন কর্ম বিপুলভাবেই ঘটে রাজনৈতিক কবিতায়। রাজনৈতিক কবিতার ক্ষেত্রে এ অভিযোগ শুদ্ধসহি কবিদের পক্ষ থেকে জোরেসোরে ধ্বনিত হয়ে থাকে। কিন্তু এ কথা রাজনীতিবিরাগ কবিতার ক্ষেত্রেও ঠিক সমভাবেই প্রযোজ্য। এ সত্য সবারই স্বীকার করতে হবে।
তবে বিবৃতি-যে সবসময়ই ক্ষতিকর, তা কিন্তু নয়। প্রতিভাধরের হাতে দুটি দূরবর্তী বিবৃতি পাশাপাশি বসে মন্তাজ-মর্যাদায় উত্তীর্ণ হয়ে এক তৃতীয়মাত্রা, মানে সুস্বাদ কাব্যিক রূপও পরিগ্রহ করতে পারে। সেক্ষেত্রে এর কাব্যিকতার ভরবিন্দুটি দুটো বিবৃতির সাদা ও শূন্য ফাঁকটিতেই সজীবতা পায়।
শুদ্ধ সাহিত্যের-যে অমরতা-বোধী বা শ্বাশতকালীনতার প্রতি যে-অগাধ-টান তার সাথে হাজার বছরের ধর্মীয় বিশ্বাসেরও একটা পরোক্ষ সম্পর্ক রয়েছে মনে হয়। পার্থিব ক্ষণস্থাযী জীবনের দুঃখ-কষ্ট শ্রমঘামের বিনিময়ে স্বাচ্ছন্দ্য না জুটলেও, মৃত্যুর পরে তা অমরতাসহ জুটবে-- কবির এমন একটা বিশ্বাসের মৃদু নিঃশ্বাস কি লেগে নেই এইসব শুদ্ধ কবিতার গায়ে! কিন্তু কোন আধুনিক মানুষই এমন বিশ্বাসে আর স্থিত নয়। শরীরের অমরত্ব ফুরোনোর পর আত্মার অমরত্বের আকাঙ্খার মতোই এই বাচিক-অমরতা-- এই হলো ট্রাজেডি। বিপরীতে, অবিশুদ্ধ সাহিত্য তাত্ক্ষণিক প্রয়োজনে সাড়া দিলেও তারও আছে প্রয়োজন ফুরোনোর পরও আয়ুর অধিক টিকে থাকার ইচ্ছে (অনেক সময়ে ইতিবাচক ভূমিকার স্মারক হিসেবে), আছে লোভক্ষোভও, যদিও তা আর অমরতা নয় কিছুতেই। ‘তবু তিন’শ বছর/ কোন্ কবি বেঁচে থাকে?’ -- এমন একটা প্রশ্নার্তি বা দীর্ঘশ্বাস শুদ্ধ কবিতার লেখকের মতো তাই অবিশুদ্ধ কবিতার কবির গায়েও এসে লাগে।
তবু কত কবিইতো হাজার বছরের পার হয়ে আমাদের হাতে উঠে আসে, কেউ কেউ তার কাব্যের ভাষার মৃত্যুর পরেও আমাদের উপভোগের তালিকায় নিজেকে নৈবেদ্য হিসেবে উপহার দেয়। নিজের ভাষায় অনুবাদ করে তাকে জীবন দান করতে বাধ্য হই। ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়ায়, ভাষা বেঁচে নেই, কিন্তু কবি বেঁচে আছে! তো বলতেই হয়, তবু অনেক কবি তিনশো বছরের বেশিও বাঁচে!

কোন একটি সংকট ঘিরে লেখার পর (রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যাওয়ার ফল হিসেবে নয়) সংকটটি কেটে গেলে অশুদ্ধ কবির রাজনৈতিক কবিতা সার্থক হয়ে উঠে ঠিকই, একইসাথে এর সার্থকমৃত্যুও নিশ্চিত হয়। এদিক দিয়ে ভাবলে, রাজনৈতিক কবিতা যেনো ওষুধি গাছ, একবার ফল দিয়েই মরে যায়। কিন্তু বিশ্বপরিস্থিতি এতোই হতাশার যে, অনেক সংকট বেঁচে থাকে এমনকি শত-কিংবা-হাজার-বছর (আর এমনসব দীর্ঘস্থায়ী সংকটে বেশি সাড়া দেয় শুদ্ধ কবিরা, দীর্ঘজীবী সংকটে দীর্ঘজীবন নিশ্চিত হয় বলে কি না কে জানে!), পরিণতিতে অশুদ্ধ কবিরও দুর্ভাগ্য আর দুঃখের আয়ু হাজার-বা-শত বছর দীর্ঘ হয়ে যায় (আর শুদ্ধ কবিদের অভিযোগকে প্রায় সত্যে পরিণত করে: সমাজ পরিবর্তনে কবিতা কোন কাজে আসে না)। যদিও এসব অশুদ্ধ কবিতা কোনভাবেই অমরতার স্বপ্ন দেখতে চায় না! চায় না, কারণ, এর মানে এক চিরঅসুখ, এক চিরসমাধানহীনতা, এক নিয়তি নির্ভরতা, যার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে আছ আশ্বাসের মতো রাজনৈতিক কবিতাগুলো। না হলে প্রতিবাদ আদৌ জমে উঠবে না যে! আর অশুদ্ধ কবিদের জন্য বস্তুত এ খুব অশালীন, মানে এই অমরতা, এই ক্ষত-না-শোকানোর শর্তে। তাই অশুদ্ধ কবির কোন কবিতা হাজার বছর টিকে থাকার মানে মানব সভ্যতার হাজার বছরের গ্লানী হয়ে উঠা, কবির জন্য আত্মগ্লানির। কিন্তু এই অনাকাঙ্খিত অমরতাও কোনো অবিশুদ্ধ কবিরা ঘাড়ে দুর্বহ বোঝার মতো চেপে বসতে পারে।

কবিতা সমাজের কোন কাজে লাগে না এই বিশ্বাসের ভেতর দিয়ে যদি বলা হয়, রাজনৈতিক কবিতা লেখার চেয়ে রাস্তায় নামাই ভাল-- তেমন কথা অনেকে বলেও থাকেন- তাহলে বলতে হয়, কবিতা সমাজের কোন কাজে না আসলে, রাজনৈতিক কবিতার সমান্তরালে শুদ্ধ কবিদের কবিতা লেখারওতো কোন যুক্তি অবশিষ্ট থাকে না-- বিশেষত তাদের অসুখী সত্তাকে নিয়ে তো নয়ই, তা কেবল নিয়তিবাদী উচ্চারণের বেশি কিছু হয়ে উঠবে না আর, কিংবা নিজেকে বা অপরের ঘাড়ে দোষ চাপানোর অযৌক্তিতা ছাড়া বেশি কিছু হয়ে উঠারও সম্ভাবনা থাকবে না আর শুদ্ধ কবিতার। তবু আশ্চর্যের, ‘কবিতা দিয়ে কী হবে’ বলেও শুদ্ধ কবিরা কিন্তু কবিতা থেকে পালিয়ে যাননি কখনো। অন্যকে অনর্থক কাজে বাধা দিতে চাইলেও, অনর্থকতার পুঁজারি ভেবে নিজেকে জড়িয়ে-পেচিয়ে-ডুবিয়ে রেখেছেন কবিতার আঁচলেই-- এ আমাদের জন্যও কিন্তু দুঃখের নয়, আনন্দেরই। কারণ তা পরোক্ষে একটা দুরাশাকেই লালন করে চলেছে, নিজ বিশ্বাসের বিপরীতে। তাছাড়া, কবিতার ভেতর যদি তারা আনন্দ-বা-বেদনা-সংবেদী সৌন্দর্যের দেখা পান, তা কি কবিতার বাইরে পান না! তা হলে কবিতার উপযোগিতা আরো একধাপ ক্ষয়ে যায়। আর যদি ওই সৌন্দর্য-মুগ্ধতাই মুখ্য ও মোক্ষ হয়ে থাকে, বলতে হবে তাও এক রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে, কবিতা হয়ে ওঠে সৌন্দর্যকে প্রমোট করার একটা মাধ্যম-- যে সৌন্দর্য আসলে ব্যক্তির নিজের বিস্ময়কে অনূদিত করামাত্র, অপরকে স্বীকার করতে পারে না। আর সৌন্দর্য-- তা সমাজে অদৃশ্যপ্রায়, আর তা সর্বজনীনও নয় আর, কবিতায় কেবল তার মুখের দেখা মেলে মাঝে মাঝে-- কিন্তু এ ভাবনার সীমা সবারই জানা। কি জীবনান্দ কি রবীন্দ্রনাথ উভয়েই, প্রত্যেক্ষ না হোক, পরোক্ষে কবিতার ভেতর উপযোগিতা আর মূল্যের সন্ধান করেছেন। এক্সট্রিম মূল্যসন্ধানী ডিলান থমাসের কথাটি মনে পড়ছে, একটা নতুন কবিতা লেখার পর পৃথিবী আর আগের অবস্থায় থাকে না। কিংবা জীবনান্দ দাশের এই কথাকটি কি ভুলে যাবো আমরা?-

‌'কিন্তু তবুও কবিতার সঙ্গে ব্যক্তি ও সমাজের সম্বন্ধ অন্তত দুই রকম। প্রথমত শ্রেষ্ঠ কবিতার ভেতর একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায় এই যে মানুষের তথাকথিত সমাজকে বা সভ্যতাকেই শুধু নয় এমনকি সমস্ত অমানবীয় সৃষ্টিকেও যেনো তা ভাঙছে- এবং নতুন করে গড়তে চাচ্ছে; এবং এই সৃজন যেন সমস্ত অসঙ্গতির জট খসিয়ে কোনো একটা সুসীম আনন্দের দিকে। এই ইঙ্গিত এত মেঘধবলিমা গভীর ও বিরাট অথচ এত সূক্ষ্ম, যে ব্যক্তি সমাজ ও সভ্যতা তাকে উপেক্ষা করলেও (সবসময় উপেক্ষা করে না যদিও) এই ইঙ্গিতের প্রভাবে তারা অতীতে উপকৃত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো ব্যাপকভাবে উদ্ধার লাভ করতে পারে। '

সৌন্দর্যের সর্বজনীনতা নিয়ে চলমান বিশ্বাস বিলুপ্ত হয়েছে ইতোমধ্যেই বোদ্ধা-মহলে। তদুপরি, সত্য আর সর্বজনীনতা বা সৌন্দর্য বা সত্যের সর্বজনীন চেহারাটিও অবলুপ্ত হওয়ার পর সম্ভবত রাজনীতিই হয়ে উঠে দাঁড়ানোর জায়গা। আর এই বিষয়টি উত্তরাধুনিকদেরও আরাধ্য। সৌন্দর্য বা সত্য আর ক্ষমতা-যে যমজ, আর তাদের ডাবলহেলিক্স-যে জীবনকে পেঁচিয়ে রেখেছে সবখানেই, সাপের মতো, সে কথা ভুলতে চাইছে না কেউ আর। কিন্তু তখনো সাপের বিষ যে সাপের আত্মরক্ষার জন্যই, অন্যকে নির্যাতনের জন্য নয়, মানে নির্যাতনবিরোধীগরল, সে কথাও ভুলতে চাচ্ছে না কেউ আর। আমরা তো জানি, সাপের বিষে ওষুধ হয়, আর মেডিসিন গ্রহণে এমনকি নিরাজ নন ‘মিশেল ফুকো’ও! আর সত্যের দোহাই পেড়ে ক্ষমতা-যে পীড়নপ্রকট হয়ে উঠে, সে কথা মনে রাখলেতো সেই প্যারাডক্সটিও সামনে আসে, শত্রুকেও বিশল্যকরণে ডাকা! তবে, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আর প্রতিকারতো বঞ্চনা, উপেক্ষা আর অসুস্থতার বিরুদ্ধে মাত্র, প্রয়োজনের বিরুদ্ধেতো কখনো নয়।
বিপরীতে, অশুদ্ধ সাহিত্যের মাঝে রয়েছে যোগাযোগের তীব্রতা, নিজের সঙ্গে অপরকে বোঝার আর্তি। প্রয়োজনের ডাকে সাড়াপ্রদানের সাহস ও সততা। অর্থাত্ ব্যক্তির সামাজিকমাত্রাটির উপর ভর রেখে শ্রেয়োবোধই এর চালিকা শক্তি যেনো। কিন্তু এসমস্ত গুণের চাপে এ প্রায়ই হারিয়ে বসে ব্যঞ্জনার সমৃদ্ধি বা জাদুগুণটি। আবার শুদ্ধ সাহিত্যের রয়েছে উদ্বোধনের তীব্রতা, ব্যঞ্জনার ঋদ্ধি, কিন্তু এসব গুণের চাপে এর অর্জন হয়ে দাঁড়ায় সমকাল-নিঃস্বতা, আর যোগাযোগ-দারিদ্য, অর্থাত্ সমাজের ব্যক্তিকমাত্রাটির উপর ভর রেখে ব্যাক্তির সৌন্দর্য়বোধই এর চালিকাশক্তি যেনো। অশুদ্ধ সাহিত্যের রয়েছে প্রতিরোধী অনুভূতির এক জরুরি পরম্পরা, অন্যদিকে শুদ্ধ সাহিত্যের রয়েছে এক আনন্দ অনুভূতির পরম্পরা। একটিতে রয়েছে মনন-সহনীয় হয়ে উঠার প্রবণতা, অপরটিতে রয়েছে সংবেদন-সহনীয় হয়ে উঠার চাপ। একটিতে রয়েছে পাঠককে একটা বোদ্ধিক অবস্থান গ্রহণে প্ররোচনা দান, অপরটিতে রয়েছে পাঠকের সংবেদগত সামর্থ্যরে স্বাধীন ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করার প্রবণতা।
শুদ্ধ আর অশুদ্ধ কবিতা একে অপরের পরিপূরক হওয়ার বদলে, কেন তারা এক বিপরীত মূল্যে দাঁড়িয়ে গেলো? একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ হওয়ার বদলে কেন বিচ্ছিন্ন ও বিপরীতমুদ্রা অর্জন করলো এই জরুরত ও আনন্দ? আমাদের তো কোনটা ছাড়াই চলে না।

এর পেছনে আসলে অনেকটা বিংশশতকও দায়ী। মার্কসীয় রাজনীতির বিপুল উত্থান, বিপরীতে শিল্পবিপ্লবের ভেতর মনন ও ধনে ধনাঢ্য ব্যক্তির বিকাশের অসম্ভব সুযোগ, দাবী করলো ব্যক্তির উত্থান, ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে উদযাপন করত চাইলো এই পক্ষ। এর বিপরীতে, বর্ধমান মাত্রায় সাধারণ মানুষের তীব্র উচ্ছেদ হওয়া, মানসিক বিচ্ছিন্নতা, দাবী করলো সামষ্টিক উত্থান। এসবের তীব্রতায় সৃষ্ট দ্বি-ভাজিত বিশ্বের চলমান ঠান্ডা ও গরম যুদ্ধটাও চাড়িয়ে গেছে সাহিত্যবিশ্বে, বেশ গভীরভাবেই। ইতিবাচক গ্রহিষ্ণুতার রাজনীতির বদলে মাথা চারা দিল নেতিবাচক বর্জনের প্রবণতা। আর সাহিত্য রসের চেয়ে, নানান রাষ্ট্র, পার্টি ও পার্টিজানলোকের কাছে সাহিত্যের মূল্যায়নে নিজের ও নিজ রাজনৈতিক দলের লাভালাভের রাজনীতিই হয়ে উঠেছে একমাত্র দিকনিদের্শী উপাদান। আর মূল্য-যে সাহিত্যের জন্য ক্ষতিকর এ বিষয়টি বিংশতকের অনেকআগেই আবিস্কার হয়ে গেছে, আর পূঁজিবাদের বিকাশ শুরুর দিনগুলোতেই এ ধারণাটি ব্যাপক প্রতিষ্ঠাও পেয়ে গেছে সাহিত্যিক মহলে। ফলে সাহিত্যের প্রান্তীয় অবস্থান পুঁজির বাজারে নির্ধারিত হয়ে যায়, স্নায়ুযুদ্ধেরও বহু আগে। মার্ক্সীয় উত্থানেরও বহু আগে। সাহিত্য যতো বিশুদ্ধ হতে লাগলো ততই তার গা থেকে ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, নৈতিকতা, ধর্ম, দর্শন, ইত্যাদি কেন্দ্রীয় দৃশ্যমানতা হারাতে থাকে। বড়জোড়, শব্দ ও বাক্যের আড়ালে সুপ্ত উপাদান হিসেবে, যেনো পাতার আড়ালে পাতাখোকো পোকার মতোই ঘুমিয়ে থাকে তা। সাহিত্যের এই সংকুচিত রূপ থেকে উপযোগবাদী পাঠকরাও সটকে পড়ে স্বাভাবিকভাবেই। সাহিত্যের বিদ্যাবাগীস রূপটি দুর্বল, ও অবলুপ্তপ্রায় হয়ে উঠে পুঁজিবাজারে।
বামরাজনীতির উত্থান বারবার বিদ্যাবাগীশরূপটিকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছে ভিন্ন চেহারায়। এর ফল হয়েছে ডানপন্থী জগতের তীব্র বিরোধীতার মুখে পড়া, চূড়া-বিরোধীতার। কখনো জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও, সাহিত্যের এ রূপটি সাধারণত পুজি-ভাবাদর্শের বিপরীতে ক্রিয়াশীল হয়ে থাকে বলে, জনসাধারণ একে গ্রহণ করলেও, পুজি-পুরোহিতরা এর শ্রদ্ধেয় চেহারাকে কেটেছেটেবেটেবিবর্ণপ্রান্তীয় করে তোলে বেশ ভালভাবেই। তবে বলা হয়ে থাকে, সাহিত্যের এমন রূপটিকেও নিজের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে আজকের এই বাজার সভ্যতা।
যদিও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যাবাগিশ সাহিত্যরূপটির চর্চা আজও করে, ধর্মীয় পরিমন্ডলের এ রূপটি নিয়ে পুঁজিবাদী বিশ্বের বলতে গেলে কোন মাথা ব্যথাই নেই। নেই আসলে, মানুষের মননও ইতিমধ্যেই অনেক নড়ে গেছে বলে। নেহায়েত নিষ্ক্রীয় বিশ্বাসের প্রতি অনুমোদনবশত এর দিকে হহঠাত্ হঠাত্ ফিরে তাকিয়েছে আজকের বেশকিছু মানুষ, যা বড়ো ধরনের আঁচড় কাটেনি কখনোই সমাজশরীরে। ফলে মাঠের মানুষের কাছে এ হিসেবের বাইরেই থেকে গেছে, এমনকি গতশতাব্দির পুরো সময়পরিধিতেও। যদিও তা একাডেমিতে ডিগ্রি অর্জনের হাতিয়ার হয়ে আছে বেশ ভালভাবেই।
এ অবস্থার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে কবিতার উপর, সাহিত্যের অন্য যেকোনো জঁরের তুলনায়। ফলে, গরিষ্ঠজনেরই মত হয়েছে যে, ব্যবহারকে নিশ্চিত করার ভেতর দিয়ে মূল্য সাহিত্যকে নিঃশেষ করে ফেলে, আর কবিতাকেতো খুন করেই।
বাংলাদেশে এ প্রভাব রবীন্দ্রনাথের হাত পার হয়ে বুদ্ধদেব বসুর অতি-সক্রিয়তায় আরো প্রবল হয়ে উঠে ত্রিশের দশকে। অস্কার ওয়াইল্ড আর গ্যাটের ওয়াইল্ড ইনফুয়েন্স আধুনিক সাহিত্যের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহযোগিতা যুগিয়েছে, একই সাথে পরবর্তী দশকের কবিদেরকে এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে বাধ্য করেছে। এর প্রভাব আজও বহন করছে বাংলা কবিতা। রবীন্দ্রনাথ একটা কথা বলেছিলেন যে, যে-জাতিতে সাহিত্যের সৃজনশীল কর্মকা- বেশি সে-জাতি বেশি এগিয়ে। তো তখন মনে হয়, রবীন্দ্রনাথকেও তাহলে, প্রত্যক্ষ না হোক, পরোক্ষে সাহিত্যের মূল্য খুঁজে নিতে হচ্ছিল।
চল্লিশে এই শুদ্ধতার ছুঁতমার্গের বাইরে যেতে চেয়েও কবিরা তেমন সফলতা পাননি। ওই যুগের জটিলতার তুলনায় সাদামাটা রূপটির উর্ধ্বে উঠতে পারে নি বলে কবিতা দুর্বল বলে প্রতিপন্ন হয়েছে। আবার এই সাদামাটা রূপটি গড়াতে গড়াতে বাংলার মাটিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রবল ছোঁয়া লেগে জমে উঠার বদলে আরো সরলসোজা হয়ে গেছে, যদিও অজস্ত্র কবির মাঝে সময়ের প্রভাব পড়েছে, আর এ ধরনের কবিতার বন্যায় যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশ ভেসে গিয়েছে। বুদ্ধদেব বসুর প্রতি তাদের ভক্তি থাকা সত্ত্বেও, এমনই ঘটেছে। তবে এখানে বলে রাখা ভালো, সত্তরের চেয়ে ষাটের পঞ্চাশের কবিদের হাতেই এই সময়ের অধিক শিল্প সফল রূপায়ন ঘটেছে।
আর প্রধানত এই পানসে অবস্থার বিপরীতে ক্রিয়া করে আশির দশকে আবার বাংলাদেশে শুদ্ধ সাহিত্য নিজের জায়গা করে নিতে চেয়েছে। কিন্তু এবার আর শুদ্ধ সাহিত্যে সেরকম দক্ষ হাত জুটেনি। কিছু ভালো ফসল যে ফলেনি তা নয়, তবে এও নিঃস্ব করেছে নিজের সাহিত্যকে সমকাল, দেশ, সংস্কৃতি, তার দৈশিক ও বৈশ্বিক রাজনীতির সাথে পূর্ণমাত্রায় নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার ভেতর দিয়ে। তো আশির হাত ধরে কিছু লেখকের কবিতায় জাদুগুণ-যে ফিরে এসেছে, সে মিথ্যে নয়। কিন্তু কবিতার যে বিষয়সৌষ্ঠবতা, আর জনমগ্নতা তাদের অভাবে হাড়মাংসহীন একটা লাবণ্যজর্জর চামড়াতেই পরিণত হয়েছে এ সময়ের অধিকাংশ কবিতা-- এখানো পর্যন্ত এটাই প্রবল চেহারা আশির কবিতার। সামষ্টিক পটভূমি থেকে তাকালে, উপহারশূন্য একটা অপূর্ব মোড়কের মতো। ভাললাগার জায়গা থেকে এরও শিশুমোহন একটা প্রয়োজনীয়তা আছেই বৈকি।
নব্বইয়ে এসে তরুণতর কবিরা অবিশুদ্ধ আর এই শুদ্ধ সাহিত্য দুটিতেই মজে থেকেছে, আর এর মিশ্র একটা রূপ জারিত হয়েছে তাদের হাতে, তবে সফলতা পরিমাণে আরো স্বল্প, আশির কবিদের মতোই। আশার কথা আশির বেশ কজনই কবিতার শুদ্ধতাসর্বস্বতা থেকে বেরিয়ে আসার নমুনাও উত্পাদন করতে শুরু করেছেন এরই মধ্যে।
কেউ যখন শুদ্ধ সাহিত্য পড়ে উচ্চারণ করে ওঠে-- বাহ, তখন এই ভাললাগাতো আমাদের অজ্ঞাতে ব্যবহার-মূল্যইকেই প্রকাশ করে যায়, কারণ তা অবিশুদ্ধ সাহিত্যের মতোই ব্যক্তিকে উজ্জীবিতই করেছে, আর তাতো কেবল কোন না কোন মূল্যের ভিত্তিতেই সম্ভবপর হতে পারে, হোক তা পাঠকের অজ্ঞাতেই। তো শুদ্ধ-সাহিত্য এভাবে চিরকালই ব্যর্থ হয়ে এসেছে, নিজের অজান্তে। বলছি তার লালিত সাহিত্য বিশ্বাসের ব্যর্থতার কথাই। অন্যভাবে বললে, এই ব্যর্থতা চিরপ্রার্থিতই তাদের কাছে।
অথচ যখনই কবিতায় রাজনৈতিক প্রসঙ্গ আসে, তারা এই ‘বাহ’-এর বিপরীত জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকেন। সে প্যারাডক্স তাদের রয়েছে। তবে তা পাঠকে নয়, শুদ্ধ সাহিত্যের উৎপাদকদের মাঝে। কেন বলছি, অশুদ্ধ কবিতা বরাবরই জনপ্রিয়তাকে একটা বা একাধিক প্রজন্মের ভেতর উপভোগ করে এসেছে। বিপুল ‘বাহ’-এ স্নানের সুযোগ পেয়েছে। কোন সাহিত্যিক যখন বলেন, কবিতায় আমার রাজনীতি ভাল লাগে না, তখন তা ব্যক্তিরুচির পরিচয় বহন করে। যখন বলেন, রাজনৈতিক কবিতা ভাল নয়, তখন ব্যাপক আপত্তি করার অবকাশ রয়েছে। কেননা এ হলো একেবারেই ভিন্ন কথা। তখন এর রাজনৈতিক তাত্পর্য বিবেচনায় না এনে পারা যায় না। তখন আসলে সমাজ দেহ থেকে একটা গোটা শিল্পরীতিকেই ঝেটিয়ে বিদায় করতে চাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ পায়। গোপনে রেসিস্ট হয়ে উঠছেন উচ্চারণকারী। মানে, রুচির-রেসিজমের চর্চা করছেন। ব্যক্তির সংবেদন-স্বাধীনতার পক্ষে দাড়িয়ে শুদ্ধ কবি যে আধিপত্যবাদিতাকে পায়ে ঠেলতে চান, তাকেই নিজের অজ্ঞাতে ফের আকড়ে ধরেন।
কবিতা যদি পাঠকরুচির উপরই দাঁড়িয়ে থাকে, ভাললাগার উপরে এর বেঁচে থাকা নিশ্চিত হয়, তাহলে রাজনৈতিক কবিতাই কেবল একমুহূর্তে সবচেয়ে বেশি পাঠক জয় করেছে, কয়েকটি মুহূর্ত সবচেয়ে প্রবলভাবে বেঁচেছে-- স্টেডিয়ামভরা পাঠকতালি রাজনৈতিক কবিতার কপালেই জুটেছে সবচেয়ে বেশি। এক্ষেত্রে সাম্প্রতিক অতীতের সুভাষ, সুকান্ত, এলেন গিন্সবার্গ, পাবলো নেরুদা, মায়াকোভস্কি, আন্দ্রে ভজনস্কি, ইয়েভতেশেংকো, এডোনিস, বা মাহমুদ দারবিশের নাম না বলে কি পারা যাবে! আর তার আগের অডেনের কথা কি ভোলা যাবে? এরও আগে নজরুলের কথা। আর শুদ্ধ কবিতার চর্চা করতে ব্যকুল অনেক কবির হাতে এইতো কয়েক বছর আগেও দেখেছি ফালগুনিকে হাতে হাতে চালান হতে!
তবে কথা হলো, কবিতার বিষয়টি গণ হাততালির চেয়েও গভীর। কেননা তাদের কতজন কবিতাকে হাততালি দিয়েছে, আর কতজন কবিতাকে তুচ্ছ করে নিজের পার্টিজান মানসকেই তালি যুগিয়েছে-- সে-খবর কিন্তু আমাদেরকেই নিতে হবে। কবিতার জন্যইতো হাততালিটুকু চায় কবি, শুধু মতাদর্শটির জন্য নয়, যা কবিতার বাইরেও সুলভ। মতাদর্শের প্রয়োজনকে অস্বীকার করেন না অশুদ্ধ কবি, বরং একে ধারণ করার পরও তার রচিত পংক্তিগুলো কবিতা হয়ে উঠুক তা-ই চান। সেক্ষেত্রে তিনি নিজেই সবচেয়ে বেশি জানেন, কোন মাপে তিনি তার কবিতাকে মাপছেন, পুরস্কৃত বা দ-িত করছেন-- কিংবা পাঠকের হাততালিতেই বা সে-হিসেব কতটা প্রতিফলিত হচ্ছে। তো এই ফাঁরাকগুলো মাথায় না রাখলে, কবিতার বাইরেই ছিটকে পড়তে হয় কবিকেÑ এ আশংকার কথা কবি কখনোই ভুলতে পারেন না। তবে যারা কবিতার নামে আদর্শকে উপভোগ করতে চান, তাদের হাত মুচড়ে দেওয়া কিন্তু কবির কাজ নয়। তাদের হাত তাদের ইচ্ছেতেই নাচবে সেটাই কবিজনোচিত চাওয়া।

অন্য কথাটি হলো, বিশুদ্ধ কবিতার এতো-যে পাঠক, তার অধিকাংশই মধ্যবিত্তের পলায়ন মনস্ক বিচ্ছিন্ন ও ব্যক্তি-কেন্দ্রিক ও দোটানায় তিক্ত ও অভ্যস্ত বিনোদনকেন্দ্রিক কিনা তাও খেয়াল করতে হবে-- এও কিন্তু নিজের শ্রেণীকেন্দ্রিক মানসকেই হাততালি যোগানো। কবিতাকে কতটা যোগায়, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। অধিকাংশ পাঠক কাব্যবোধের বদলে নিজের বিনোদন-সংস্কার বা নিখাদ জৈবিকসংবেদন বা যৌনজাদুকেই হাত তালি দিয়েছে কিনা সে কথাকেও বিবেচনায় আনতে হবে। কারণ এসবই কবিতার সর্বস্ব নয়।
ভাললাগা যে কবিতা হয়ে উঠার সর্বজনীন মানদ- নয়, তার খবরটি তখন প্রকাশ হয়ে পড়ে। কারণ, তারও রয়েছে শ্রেনী-সীমা, শ্রেনীভেদে তারতম্য আর শ্রেণীর ক্ষমতা অনুযায়ী দৃশ্যমানতা অর্জনের রাজনীতি। নিন্মবিত্তের লোক যেহেতু নিজের ভাললাগার জানান দিতে মধ্যবিত্ত অধ্যুষিত সংবাদ ও সাহিত্য মাধ্যমগুলোতে স্থান পায় না, ফলে তার অভিমতের অস্তিত্বই সেখানে থাকে না যে, তুলনা করে বলা যাবে যে, মধ্যবিত্তরুচির বাইরে আরো একটি রুচির জগত রয়েছে। শুদ্ধ সাহিত্য সেখানে সমানই দুর্বোধ্য। বলতে চাচ্ছি, এতে সাহিত্যমান খর্ব না হলে সাহিত্যের দৃশ্যমানতা বেশ খর্ব হয়। নিন্মবিত্তের শ্রমজীবি মানুষদের কাছে উত্প্রেক্ষাপকট আর পরাবাস্তব কবিতা দিলে, হয়তো বলে উঠতো-- বুঝলাম না, ভাল লাগা শব্দটিরও স্থান সেখানে থাকবে না। কবিকে মনে হবে--কী পাগল, কী উদ্ভট কথা বলে তারা! বিপরীতে,শুদ্ধ কবিরা বলতে চাইবে-- কবিতা বুঝতে চায়, কবিতা কি বোঝার জিনিস! নিজের ভালোলাগার খবরটাও দেখো এরা রাখতে জানে না! তখন কী অবলীলায় শুদ্ধ করিবা বলে ফেলে-- ওরা অনেক পিছিয়ে আছে। এক্ষত্রে কিন্ত তারাও প্রগতির একটা স্তরকে নিজের বিরুদ্ধেই নিজের রণকৌশল হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। যদিও প্রগতিতে অবিশ্বাসী শুদ্ধ কবি ও কবিতা-পণ্ডিতরা।

অন্যদিকে, একটা উত্তাল সময়ের মানবগোষ্ঠীকে তার সময়ের ভাবনার সাথে যে চূড়ান্ত একাত্মতা, তাই তাকে সবার সাথে সাদৃশ্যময় করে তোলে, ও সরল উচচারণে হয়তো তাকে বাধ্য করে, অথচ যা অধিক কাব্যিক বলে মনে হয় সে সময়ের মানুষের কাছে। তাই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে বিচ্ছিন্ন করে শুধু আজকের এবং শুধু এই স্থানের (দেশ বা বিশ্ববিদ্যালয় বা মিডিয়া, বা প্রজন্মকেন্দ্রিক) কাব্যিক মানদণ্ডে বা অস্থির সময়ে কবিতাকে অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল সময়ের ব্যক্তিমানস দিয়ে বিচার করতে যাওয়া কতটা যৌক্তিক সে-কথা ভাবাও জরুরি। পরবর্তী সময়ের খাপে পূর্ববর্তী সময়ের কবিতাকে খাপ খাইয়ে নেয়ার মাঝেও একটা বাতিলকরণ, হ্রাসকরণ বিষয় চালু রয়েছে। সময়ের স্পন্দন থেকে কবিতাকে বঞ্চিত করার একটা প্রক্রিয়া চালু হয় এসবের ভেতর দিয়েও।

তাছাড়া সাহিত্যে ব্যক্তি রুচি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে একজন ব্যক্তির রুচি বা রুচিহীনতা অন্যদের রুচি বা রূচিহীনতাকে চূড়ান্ত অনুমোদন বা পুরোপুরি বাতিল করতে পারে না। কিন্তু সাহিত্যিকদের ক্ষমতা আর তার নির্দিষ্ট পাঠকদের উপর নিজের রুচিকে (সর্বজনীনতার ছদ্মবেশ পরিয়ে) জানান দেয়ার ভেতর দিয়ে কোন একটা পাঠক শ্রেণীকে আপাত নিরুত্সাহিত করা যায়। সে কাজটাই করে থাকে শুদ্ধ সাহিত্যের লোকজনেরা। সমপরিমাণে অবিশুদ্ধ সাহিত্যিকেরাও তা করে থাকে, পার্টিজান কবিরাতো তা করেই।
তবে মজার ব্যাপার আমার ভাষার বর্তমান শুদ্ধ কবিরাও (যদিও তারা নেহায়েত শুদ্ধ নয়) বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক কবিতা হাপুসহুপুস করে গিলে তৃপ্তি পেয়েছেন বলেই জানি, এ আমার ব্যক্তি অভিজ্ঞতা। আর সেটা আমার দেশের নতুন প্রজন্মের সাথেই বেশি মানানসই, যেহেতু আমিও এদের পাশাপাশি চলমান। ভিন্ন দেশ বা ভিন্ন ভাষার সাহিত্যিকদের কথা তেমনতো জানি না। আমার সমকালীন কবিদের অন্তরঙ্গ বা পারিবারিক বা বন্ধুমহলে এই অপ্রকাশিত রুচির প্রকাশ ঘটে। তবে সামাজিক বা রাজনৈতিক এলাকায় লেখকের রুচির ঘোষণা বিপরীত বা একমুখী হয়ে পড়ে। যদিও হতে পারতো পরিপূরক, একে অপরের। আবার বর্তমানের রাজনৈতিক কবিরাও শুদ্ধ কবিতার প্রতি তেমন পরান্মুখ বলে মনে হয়নি কখনো। তবে, অতি-উড়ুক্কু পাঠকের কথা বলছি না। অশুদ্ধ কবি যদি বিদেশী ভাষার কেউ হন, তখন তাদের অনেকের কলমই কৃপণ থাকেনি আর।
কবিতা রচনার ক্ষেত্রে একেক কবির সামর্থ বিবেচনায়ওতো কবিতার বিষয় পরিধি সংকুচিত বা প্রসারিত হয়ে থাকে-- সেকথা মাথায় রাখলে বিষয়টি কেবল কবির রুচির ব্যাপারেই সীমিত থাকে না, রুচির সাথে কলমের সংঘর্ষেও পরিণত হয়। তাই কবিতার ভেতরে নিজের সামর্থ্যরে পরিচয় ঢেকে রাখার সুপ্ত রাজনীতিও অনুমান করি এই রুচির জানান দেয়ার ভেতরে কবির অজ্ঞাতে জারি থাকে। তদুপরি, সৃজনের অনিশ্চিয়তাও, কবিকে প্রভাবিত করে, তিনি যেই ধরনের কবিতা রচনায়তেই ব্যপৃত থাকুন না কেন।

দ`A talk about trees is almost a crime
Because it implies silence about so many horrors...’
-বের্টোল্ট ব্রেখট

ইতিহাসে প্রতি ত্রিশচল্লিশ বছর পরপরই এমন এক সংকট আসে যখন কবিদের পক্ষে চোখ বুজে থাকা মুশকিল হয়ে পড়ে তার চারপাশ নিয়ে, শুদ্ধচোখ বুজে রাখার জন্য চেঁচামেচি শুরু হয়, তবু চোখের পাতা বোমার আঘাতে ছিঁড়ে গিয়ে রক্তাক্ত নির্ঘুম নিস্পলক চোখে পরিণত হয়। গটফ্রিড বেনের কথাও মনে পড়বে কারো কারো, এমনকি বরীন্দ্রনথের কথাও। সংকটের তেমন দিনগুলোতে প্রায় সমস্ত বড়ো কবিরাই এই নেহায়েত বিশুদ্ধতার হাত একটু সময়ের জন্য হলেও ছেড়ে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের পৃথিবী, আফ্রিকা, দুই বিঘা জমি, সাধারণ মেয়ে, সত্যকাম এসবই সেই সংকটপরিস্থিতির প্রতি কাব্যিক সাড়া দান। ইয়েটসের দ্য সেকেন্ড কামিং, ইস্টার ১৯১৬, টাওয়ার, মেডিটেশনস অন সিভিল ওয়ার, এন আইরিশ এয়ারম্যান ফরসিজ হিজ ডেথ-- এসবের প্রসঙ্গ কিভাবে বিবেচনা করবো আমরা? কিংবা তার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে ভীড়ে যাওয়া-- এ বিষয়টিকেই বা কীভাবে মূল্যায়ন করবো আমরা?
আমরা যখন রুচির দোহাই পাড়ি-- ‘নাহ ভালো লেগেছে’-- তখনো আমাদের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক রুচি কতটাযে সময় প্রহৃত সে-কথার জানান দেই না। আর নিজের অজ্ঞাতেও এ রুচি কতযে পরিবর্তনপ্রত্যাশী-- জানান দেই না সেকথারও। আমরা একসময় কাউকে পড়ে মুগ্ধ হই, কয়েক বছর বা দশক শেষ হওয়ার পরই টের পাই সেই লেখককে ঘিরে আমাদের মাঝে পানসে অনুভূতির আগমন। তখন কি লেখক খারাপ হয়ে পড়ে? তখনওতো পরবর্তি প্রজন্ম তাকে আকড়ে থাকতে দেখা যায়! আর নেহাত ভাললাগা কোন লেখকের উত্কর্ষের মানদ- হিসেবে খুব একটা কাজে আসে না। তাহলে যে যতো বেশি আমাকে দখল করে রাখে সেই লেখকের লেখাই কি ভাল লেখা? তাহলে নিজের কালের বাজারী জনপ্রিয় লেখকই উত্কৃষ্ট হয়ে পড়ে না কি? আমাদের সমালোচকরা যে বলে থাকেন, বেশ জনপ্রিয় কয়েকজন কবির কবিতাও নাকি ভাল না-- এ বলার কারণ কি তার জাদুশূন্যতা, সমালোচককে ভাল লাগাতে ব্যর্থতাÑ--তাহলে এতো এতো পাঠকের ভাললাগার উত্সটি কোথায়! নাকি এখানে পাঠকের চেয়ে সমালোচকের উচ্চমন্যতা, অধিক প্রগতিশীলতা (/ব্যক্তিঅহংকেন্দ্রিক ভান?) কাজ করছে? (হাঁ, এখানে ঠিকই ঘাপটি মেরে আছে প্রগতির ধারণা, এমনকি শুদ্ধ সাহিত্যের সামলোচকদের মাঝেও!) নাকি আরো অধিক কিছু? নিশ্চয় অধিক কিছু। সে হলো রচনায় নতুনত্ব আর বিষয়গৌরবের অভাব (নিজ সমাজ ও সময়ের সাহিত্য এতিহ্যের প্রেক্ষাপটে, অন্য সংস্কৃতিতে একই রচনা নতুন মনে হতে পারে), বিষয়কে ঘিরে গভীর ও পরিপূর্ণ অনুসন্ধানের স্বল্পতা, সমাজনির্ধারিত চলন-সীমাকে সংরক্ষণশীল লোকের মতো মান্য করে চলা, দৃষ্টিভঙ্গির দারিদ্র, বিষয়ের নতুনত্ব উদঘাটনের আকাল, কিংবা নতুন বিষয়ের অভাব, এমন আরো অনেক কিছুই। অনেকে আবার নতুনত্বকে পলায়নপরতার সাথেও ঘুলিয়ে ফেলে। তবে আমি একে বাতিলের কথা বলছি না, সাহিত্যে বাতিল নয়, গ্রহিষ্ণুতাই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। অন্যদিকে, যে নিজের প্রজন্মকে মাতিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো, তাকে আর সেই প্রজন্মের ভাললাগাকেইবা আমরা বাতিল করবো কিভাবে! সামষ্টিক অনুমোদনের স্বার্থে, নাকি নিজের ব্যক্তিরুচির স্বার্থে? তো এই জটিলতাকেও মাথা রাখা দরকার। আবার শুদ্ধ সাহিত্যিকের এক প্রজন্মের সমালোচক জয় আর পাঠকের ভাললাগার পর আরেক প্রজন্মের সামনে মুখ থুবড়ে পড়াকেই বা কিভাবে ব্যাখ্যা করবো আমরা? পরবর্তী প্রজন্ম কি বলবে, পূর্বপ্রজন্মের পাঠক ও সমালোচক ও কবি আসলে কবিতা কী তা বুঝতো না? এর মানে কিন্তু বহু প্রজন্মের ভেতর দিয়ে চলার একটা অতিজীবী বিয়য় হিসেবে কবিতার বিবেচনাটি প্রাধান্য পাচ্ছে। আবার, যে নিজের প্রজন্ম ও সমকালীন সমালোচকদের জয় করতে ব্যর্থ হয়েছে ঠিক, তবে পরবর্তী প্রজন্মের সমালোচক ও পাঠক জয় করে নিয়েছে তার কথা কিভাবে ভাববো? ভাববো কি কবিতার পাঠক হিসেবে সমকালীন সমালোচক ও পাঠকই শেষ কথা নয়! এর ভেতরেও কিন্তু সমকালীন পাঠককে তুচ্ছ করার প্রবণতা, আর কবিতার অতিজীবীতার স্বীকৃতি প্রচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। অতিজীবীতা কী কেবলই কবিতার ধর্ম-- আরো কতকিছুরইতো অতিস্মরণীয়তার মাত্রা রয়েছে-- দার্শনিক, রাজনীতিক, আবিস্কর্তাদের কথাও তো এক্ষেত্রে সামনে আসে! তবে কবিতা চর্চা না করেও তা হওয়া যায়, তাই নয় কি?
শুদ্ধ সাহিত্যের মূল, কি কালে কি স্থানের দিক থেকে, দূর গ্রীসের গভীরে ছড়ানো। আর ইউরোপের মনোমতো সাজানোগোছানো যেনো, যদিও গ্রীস ইউরোপের একার সম্পদ নয়। তবে এই ইউরোপ-সম্মত নন্দনতত্ব আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা, এশিয়া, ও প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের অনেক কিছুই ঠিকঠাক ধরতে পারে না। ধরতে পারে না এসব মহাদেশ, উপমহাদেশের সাম্প্রতিক কবিতার বিশাল অংশটিও। সেকথা আমাদের ভুলে গেলে কি চলবে? এই বৈচিত্র্যই আমাদের অধিক অন্তরঙ্গ সম্পদ আর স্বাস্থ্যপ্রদ রোদ।
গ্রেট হতে হতে পুরাণিক গল্প হয়ে ওঠা লেখকরা তাদের নামই কেবল ভাসিয়ে রেখেছেন জনবলয়ে, তো তার লেখা নিয়ে সেই জাতিমানস ব্যাপৃত নয় আর ততটা, যদিও শ্রদ্ধাটুকু জানানো হয় তাকে। আর বহুদূরের লেখকের কাব্যকৃতিকে সবটা নেওয়া যদি সম্ভব না-ই হয় বর্তমানের প্রেক্ষাপটে, এই দীর্ঘস্থায়ীত্ব এক অর্থে লেখকের ব্যাপ্তিকেই কেমন হ্রাস করে থাকে বর্তমানের মানসপটে। এখানেও কিন্তু সাহিত্যের উপযোগিতাই মানদ- হিসেবে ফিরে আসছে! একই সাথে এ ধরনের প্রশ্নের পেছনে যে-প্রজন্ম প্রশ্নটি তুলছে তার নিজস্ব রুচির শাসনও থাকে। তো সেই রুচিও যেখানে আর অনন্য মাপকাঠি নয়, সেক্ষেত্রে কি জীবিতরাই শুধু মাপকাঠি হবে? আর জীবিতদের এই মাপকাঠিকে যতোটা দৃঢ়তা দেয় পূর্বজরা, ততটুকুই কি পূর্বজরা অনুমোদিত হবে? তো এই বেঁচেবর্তে থাকা, বা টিকে থাকাও লেখকের লেখার সাপেক্ষে যতোটুকু শ্রদ্ধার, আনন্দের, ভাবি, ঠিক ততটুকু গ্লাণীরও বটে। লেখকরুচির নাট্যে বলয়িত হয়ে বা পাঠকরুচির নাট্যে তরঙ্গিত থেকে ম্রিয়মানা শিখার মতো ধুকে ধুকে জাগা বিপুলতর অন্ধকারে-- এর বেশি কী আশা করা যায়, এতো আশংকা ও আকাঙ্খার এই জটিল অরণ্যে। কিন্তু কথা হলো, জীবিতদের মাঝে ছাড়া আর-কোথায়-বা বেঁচে থাকবে একজন কবি!
আজকে যারা রাজনৈতিক কবিতার বিরোধী, তাদেরকে বলা যেতে পারে আফ্রিকা, ক্যারিবীয়, ল্যাটিন আমেরিকা, আর পূর্ব-ইউরোপের যেসব কবি আমাদের দেশের গত কয়েক দশকের ও আজকের পাঠক ও কবিদের কিছুটা হলেও ছুঁয়ে গেছে, তারা সবাই কোন না কোনভাবে রাজনৈতিক বিশ্বাসের বীজ ছিটিয়েই কবিতাজগতে কৃষকতা করেছেন। এ প্রসঙ্গে সহজেই আফ্রিকার এমে সেজায়ার, সেদার সেংঘর, কফি অনোয়ার, ওকিববো, সোয়িঙ্কা, ডেসিন ব্রুটাস, কিংবা ইউরোপের নাজিম হিকমত, ভাসকো পোপা, হুলোব, এননেবার্গার, চেশোয়ার মিউশ, সিম্বোর্সকা, পল সেলানসহ আরো অনেকের নাম বলতে হয়। শেষোক্ত তিনজনের উপরেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপুল প্রভাব, মানে সময়ের ছাপ বিপুলভাবেই বহন করছে তারা। আর আমার জানামতে আমাদের দেশের আজকের রাজনৈতিক কবিতার বিরোধীদেরও রুচি এই কবিরা জয় করে নিয়েছিলেন। আর ইউরোপ-আমেরিকার ল্যাংস্টন হিউজেস, আমিরি বারাকা, রবার্ট লাউয়েল, সিলভিয়া প্লাথ, এলেন গিনসবার্গ, টেড হিউজেস, পেট্রিক কাভানাহ বা সিমাসহীনি কথাই বা অনুল্লেখ্য থাকবে কেন। কিংবা ক্যরিবীয় ওয়ালকট, এমে সেজেয়ার, ডেরেক ওয়ালকট ও লাতিন কার্ডেনাল, সেজার ভালেহো, পাবলো নেরুদা, নিকানোর পাররা, কথাও কি ভুলা যাবে। আরো কতজনের নামইতো বলা যায়। এশিয়া থেকে কাজী নজরুল ইসলাম, জোসেফ ব্রডস্কি, মায়াকোভস্কি, শামসুর রাহমান, আল মামুদ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নাজিম হিকমত, কিংবা ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, এডোনিস, মাহমুদ দারবীশ, আরো অনেকের নামই আসবে। তো রাজনৈতিক কবিতা ভাল্লাগে-না বলার ভেতর দিয়ে তাদের প্রতি আমাদের ভালোলাগাকে-- আমরা এক কোপে আমাদের অজ্ঞাতে আলাদা করে দেই না কি-- সেকথা কি ভুলে থাকা উচিত?
এদিকে, ব্যক্তি চেতনা যদি সমাজ নির্ধারিত হয়ে থাকে, তবে বলতে হয়, যত দূরেই যাও না কেন, আর নিজের যতো গভীরেই ডুব দাও না কেন, সবখানেই তার দেখা পাবে। তার আশ্লেষমগ্নই থাকবে, তা থেকে পালাতে পারবে না। তো রাজনীতি সমাজেরই অবিচ্ছেদ্য উপাদান। অবচেতনার ভেতরেও এর শক্ত ঘাঁটি থাকতে বাধ্য। রাজনীতিসিক্ত হয়ে উঠতে বাধ্য যেকোন বিষয়ই। তবে রাজনৈতিক বিষয়, আর কোন বিষয়ের রাজনৈতিক হয়ে উঠার মধ্যে একটা সামনেপেছনে, বা দৃশ্যমানতার মাঝে একটা কেন্দ্রপ্রান্ত, বা একটা প্রচ্ছন্ন-প্রকটতার দূরত্ব রয়েছে। আর সে কথাটাই বলে দেয়, শুদ্ধ কবিতায় রাজনীতি ভাষায় দৃশ্যমান থাকলেও সমাজসম্মত অর্থ উত্পাদন বা অভ্যস্ত-সংবেদনরীতির শিকার হয়ে তা প্রান্তীয় বা প্রচ্ছন্ন অবস্থাটিই কেবল আঁকড়ে থাকতে পারে, প্রধান উদ্ভাসনা লাভ করে না। তা অদৃশ্যমানতারই নামান্তর। বিশুদ্ধ কবিতা ধারায় যেকোন বিষয়ের প্রচ্ছন্ন-রাজনীতিটুকুই শিল্পের জন্য যথেষ্ট বলে বিবেচিত। না হলে তা ইঙ্গিতনাশ তথা কবিতা-নাশ-সম্ভবা হয়ে উঠে। আর এর বিপরীতে সমাজবলয়ে সিদ্ধ হয়ে রাজনৈতিকভাবে প্রধান ইস্যু হয়ে ওঠা একটি বিষয়কে কাব্যিক করে তোলার মাঝে বিষয়টির রাজনৈতিক উদ্ভাসনার প্রাধান্যকে তারা মেনে নিতে পারেন না। সত্য যে, বিষয়টির অতি-পরিচিতি নিজেরই কাব্যিক বাধা হয়ে উঠে। তবে তা অনেকটা ফর্মালিস্টিক সংস্কারও বটে। কারণ, কবিতা শুধু অজ্ঞাতেরই কারুভাষ ঘটায় না, অতিজ্ঞাতের মাঝেও আনে অপরিচয়ের আভা, মানে নবমাত্রায় উদ্ভাসনের জাদু। তো পরবর্তী অংশটি সমপরিমাণেই অস্তিত্বশীল কাব্যিক জগতে-- আর তা ইস্যুভিত্তিক ও রাজনৈতিক বা অশুদ্ধ কবিতাতেও কি সমভাবে প্রযোজ্য নয়?
আর কেউ যদি প্রেমের অপূর্ব কবিতা লিখতে পারে, তবে কেন সেই বা অন্যজন্য নারী-কে নিয়ে বা যুদ্ধকে নিয়ে, বা রাজনৈতিক ইস্যুকে নিয়ে একটা অপূর্ব কবিতা লিখতে পারবে না? প্রেমের ক্ষেত্রে উত্তর হ্যাঁ হলে, বাকিগুলোর ক্ষেত্রেও উত্তর কেন হা হবে না!
আবার বলা হয়ে থাকে, রাজনৈতিক কবিতার ভাষা কেমন নির্বল, আভা ছিটোয় না! কথা হলো রাজনৈতিক কবিতার রাজনৈতিক ইস্যু থেকে বিচ্ছিন্ন করার ভেতরেই নিহিত থাকে কবিতা সম্পর্কে এক পূর্ব সংস্কার থেকে অবলোকন, আর এ হলো সেই পর্যটকের মতো, কোন দেশে ঘুরতে গিয়ে যিনি নতুন কিছুই দেখতে পান না, তার গাইড বইয়ের লেখা কয়েকটা স্থান, স্থাপনা, পুরাকীর্তিই কেবল খুঁজে বেড়ান বলে, অন্যকোন দিকেই তার আর চোখ যায় না-- অন্য পর্যটক যা দেখেন তিনিও তাই দেখে থাকেন-- আর বলেন, দেশটাতে আর কিছুইতো নেই! তেমন দেখা আসলে আস্ত একটা দেশকেই কয়েকটা নির্বাচিত স্থান আর স্থাপনায় সীমিত করে ফেলা। এ হলো অশুদ্ধ কবিতার বিস্তারিত এক জগতের ভেতরে শুদ্ধ কবিদের চোখ ফেলার একটা প্রভাবশালী ধরন। এর বিপরীতটাও কিন্তু সত্য-- অশুদ্ধ কবিরাও শুদ্ধ কবিতার ভেতরে প্রধানত কারুদক্ষতা, সঙ্গীতময়তা, যৌনগ্রাফী আর মৌনগ্রাফী ছাড়া কিছু দেখতে পায় না। দেখতে পায় শুধু শ্বাশত সব বিষয়-- জন্ম, মৃত্যু, প্রেম, বিরহ ইত্যাদি ইত্যাদি।
আরেকটি কথা, অন্তর্জগতের কবিতা তো পাঠকের কাছে বহির্জগতের উপাদান-- তো পাঠক যখন পড়ে তখন কি তা কবির অন্তর্জগতকে আবিস্কার করে কবিতায়, নাকি পাঠক নিজের অন্তজর্গতকে বিনির্মাণ করে ওই কবিতার আশ্রয়ে? তো পাঠকের কাছে সবই বহির্জগতের বস্তু। আর সেক্ষেত্রে অন্তর্জগতের কবিতার ওইযে ভার্জিনিটির দাবী, তা ভাষা প্রথমত একটি বর্হিজাগতিক উপদান হওয়ায়, মন নিজেই বহির্জাগতিক বিন্যাসপ্রাপ্ত বলে, আর কবিতাটি পাঠকের কাছেও বহির্জগতের বস্তু হিসেবেই আবির্ভূত-- এভাবে বললে সমস্ত শুদ্ধ কবিতাই দ্বিগুন বর্হিজাগতিক!
আর অশুদ্ধ কবিতা অনেক সময়েই জনপ্রিয় কবিতার শৈলীকে অনুসরণ করে, সূচী করণ এসব শৈলীর একটা, বা একই কথার পুনরাবুত্তি চালিয়ে একটা তীব্র প্রতিক্রিয়ার উত্সারণ ঘটাতে চায়, কিন্তু মুহুর্তের উজ্জল্য পেতে গিয়ে, ঐতিহাসিকতা আর গভীরতা অর্জনেও তখন ব্যর্থ হয়, বিনোদনপ্রবণতা বাড়ার সাথে সাথে দায়িত্বশীলতার প্রতি একটু খামতি ঘটায় যেনো।
আবার উত্তপ্ত সময়, বা সংকটের কাল তার গা থেকে অসহনীয়তার মাত্রাকে হ্রাস করে আনলে, তখন জনমনে যে কান্তি আর ভিন্নকিছুর পিপাসা, তাকে উত্তপ্ত ও তুমুল সময়ের চাহিদা দিয়ে পূরণ করা যায় না-- করতে গেলে অত্যাচার হয়ে দাঁড়ায়, সেইসময়ে পাঠকের রুচি ভিন্ন ধরণের কবিতাকেই বেছে নেয়-- সেই স্বাভাবিকতাকে ক্ষুণœ করাও কবিতার জগতকে সীমিত করে দেখারই নামান্তর। পাঠকের রুচিই শেষাবধি সময়ের শাসক-- যেকোন কবির জন্য, আর কবির রুচি-- সেই সময়ের ভিন্ন-নির্মাণ। আর সেই সময়ের পূর্ববর্তী কবিরাই সময়টাকে শাসন করে থাকে-- পূর্ববর্তী করির সাথে লড়াইটা থাকে বিষয়ে, রুচিতে, আর ভাষাভিন্নতা নির্মাণে-- তো পূর্বের কবিরা সামাজিক-রাজনৈতিক জায়গায় প্রাধান্য বিস্তার করে গেলে, পরবর্তী প্রজন্মের কবিরা আসে নির্জন, ব্যাক্তিগত, মানসিক জগতের প্রাধান্য নিয়ে-- এভাবে সময়ের একটা সমাজবাস্তবতার সমান্তরালে-যেনো একটা ছদ্ম-ছন্দও ধরে রাখে। কবিদের অজ্ঞাতে, দুই রুচির কবিদেরই পাঠকের চোখের নিচে ঠেলে দেয়-- একেক দলকে একেক সময়ে প্রবল করে তোলে-- স্বীকার ও অস্বীকারের ভেতর দিয়ে।
তো আবার কাব্বানিতে ফিরে আসি। তাকে পড়তে পড়তে আরো কত জানেরই না নাম মনে আসে।

ভালবাসি যখন
সমস্ত গাছপালাই
আমার দিকে ছুটে আসে খালি-পায়ে...
-নিজার কাব্বানি

এই পংক্তি তিনটি পড়তেই চট করে মনে এলো রণজিতের উদ্ভিদ কবিতাটি যেখানে তিনি ভালবাসার সাথে সংশয়কে মিশিয়ে নিজের করে নিয়েছেন, আত্মসাত কী চমত্কারভাবেই না আত্মীকরণ হয়ে উঠেছে! সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কেউ কথা রাখেনি’র কথাও মনে আসবে অনেকের, পরোক্ষভাবে, রাষ্ট্রীয় সীমানা নিয়ে কাব্বানির কবিতার প্রসঙ্গে জয় গোস্বামীর নামও মনে আসবে। কিংবা ফরহাদ মজহারের আমার কতৃত্ব গ্রহণ করো নারী’র কথাও মনে আসবে অনেকের। নারী ইস্যুতে তসলিমা নাসরিনের কথাতো যেকোরোই মনে আসবে।
কাব্বানির কবিতা পড়তে গিয়ে আমাদের কবিতা জগত নিয়ে একটা সংস্কার চোখে পড়লো, তা হলো কাব্বানিকে দ্রোহী হতে গিয়ে, প্রগতিশীল হতে গিয়ে, নিজের ধর্মীয় সংস্কৃতিকে এড়িয়ে যেতে হয়নি, তার ধর্মীয় সাংস্কৃতিক উপাদান ও শব্দগুলো তার কবিতাকে সুঠাম করেছে, অথচ আমাদের দেশে তিনটি ধর্মের সাংকৃতিক উপাদানে সমৃদ্ধ-- যদিও আমাদের শুদ্ধ ও অশুদ্ধ কবি নির্বিশেষে প্রায় সবাই সনাতন সংস্কৃতির উপাদান নিয়ে কোন ছুঁতকারতায় ভোগেন না, আর বুদ্ধ সংস্কৃতির নানা উপাদান ব্যবহার করে নিজেদের প্রগতিশীলতাকেই দৃঢ়তা দেন, আর মুসলিম সংস্কৃতিক উপাদান এড়িয়ে চলার ভেতর দিয়ে নিজেকে যেনো প্রতিক্রিয়াশলতার হাত থেকেই রক্ষা করেন-- অথচ তিনটি গ্রহনে বর্জনে এর মুখোমুখি হয়েই আমাদের প্রকাশ দৃঢ় হতে পারে। কাব্বানি যেনো মুখোমুখি হয়েছেন এসবের, এড়িয়ে যাননি। তাতে যেমন প্রতিক্রিয়াশীল হননি তিনি, তেমনি প্রগতিতেও টান পড়েনি তার। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে কিছুটা ব্যাতিক্রম বলা যায় আলমাহমুদ, শামসুর রাহমান আর ফরহাদ মজহারকে। এক্ষেত্রে একক কবিতা হিসেবে আলমাহমুদের সোনালি কাবিন কবিতাটি নিঃসন্দেহে একটা মাইলফলক, যাতে এই তিন সংস্কৃতিগত উপাদানের সাথে মিশেছে প্রগতিশীল ভাবনা, আর ব্যক্তির তীব্র দ্রোহ।
কাব্বানির ছুঁতোয় এত কথা শেষ করার আগে, বলতে হয়, সব কবির মতো তারও আছে স্ববিরোধ। তার সব কতিবা পড়ার যেহেতু সুযোগ হয়নি, তাই এর মাত্রা কতটা তীব্র তা আমার পক্ষে ধারণা করা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক প্রতিরোধে যে বিষয়কে তিনি অবলম্বন করেন, নারীবাদী ইস্যুতে তাকেই আবার খারিজ করে দেন। কিংবা এর অন্য অর্থও হতে পারে, আসলে কোন বিষয় বা বিশ্বাসকে পুরো খারিজ করেন না, বরং একই উপাদানের ইস্যু অনুসারে এর সুবিধা ও সীমাই হয়তো পরোক্ষে জানিয়ে দিয়ে যান একাধিক কবিতার ভেতর দিয়ে আমাদের।
এমন ভাবনা পেয়ে বসলে, মাঝে মাঝে মনে হয়, স্ববিরোধ ছাড়া সৃজনই অসম্ভব। তবু তা গোচরীভূত হওয়া ভাল, আজকের দিনে। যেমন বিশুদ্ধতা ভাল বলার সাথে সাথে, হিটলারের নাশকতার কথাও আমাদের জানতে হবে। গুণের ভজনা ভাল, কিন্তু একইসাথে আমাদের জানতে হবে, হাজার বছর ধরে চতুবর্ণাশ্রমের ভেতর বৈশ্যদের জীবনের অসম্ভব অবমাননা। শুভ্রতা ভাল, কিন্তু মনে রাখতে হবে এর ভেতর দিয়ে কালো জাতিগুলোর প্রতি চালানো অমানবিক নির্যাতন ও লুণ্ঠন। সৌন্দর্য ভাল, তবে মনে রাখতে হবে সত্যকে চাপা দেয়ার ক্ষেত্রে এর পারঙ্গমতা। সঙ্গীত ভাল, মনে রাখতে হবে, এর বিষয়মুক্ততা, চূড়াবিমূর্ততা। বাস্তব ভাল, মনে রাখতে হবে এর রুক্ষতা, স্থবিরতা ও অসহনীয়তা। প্রগতি ভাল, মনে রাখতে হবে এর বৈচিত্রবিনাশী চেহারা! কী--আর থাকে তবে, বিশুদ্ধতা, অবিশুদ্ধতা, রাজনীতি, কিংবা রাজনীতিহীনতা-- কোন একটির প্রতি বিশুদ্ধ মোহবিস্তারের পেছনে! তবু এ সবই যেনো মৃত্যুর মতো এক মহৎ প্রয়োজনে অবলীন হয়ে আছে আমাদের সাথে, আমাদের চারপাশে!
এন্থনি লাভ পিককের লেখা এক চিঠিতে ১৮১৯ সালের পিটারলোর গণহত্যা সম্পর্কে বর্ণনা পড়ে পার্সি বিসি শেলি লিখেছিলেন ‘দ্য মস্ক অব এনার্কি’ কবিতাটি, তারই তিনটি লাইন:

"Shake your chains to earth like dew
Which in sleep had fallen on you-
Ye are many — they are few".

তবু শক্তি, ক্ষমতা, ভোগ, উপভোগ আর সচেতনতার ক্ষেত্রে হাজার বছরেও গরিষ্ঠরাই লঘিষ্ট রয়ে গেলো, বিপরীতে অতি লঘুরাই হয়ে রইলো গরিষ্ঠ। এই দুঃখজনক অবস্থাটি, এই অসহ পরিস্থিতি কবিদের দিয়ে সবসময়েই কি রাজনৈতিক কবিতাগুলো লিখিয়ে নেবে না? আর সবার মতো আমিও চাই রাজনৈতিক কবিতার অবসান, কিন্তু হতাশার কথা হলো চলমান ব্যবস্থার ভেতরে এও সম্ভবত অসম্ভব, দূর ভবিষ্যত অবধি!Ñ তা আসলে অপ্রতিরোধ্য ডিস্টোপিয় বাস্তবতা। আর ব্যক্তির অর্জিত যে সৌন্দর্য্যবোধ তা তাকে দিয়ে চিরকাল শুদ্ধ কবিতাও লিখিয়ে নেবেইÑ কেননা আপন সৌন্দর্যবোধের স্থিতিশীলতা তথা দীর্ঘায়ু মুখ কে না দেখতে চায়? এ আসলে এক পরবর্তনশীল প্রিয়-ইউটোপিয়ার দিকে যাত্রা, আর এ অভিগমন অপ্রতিরোধ্য।
তবে মননহীন সৌন্দর্য আর সৌন্দর্য্যহীন মননÑদুটোই আংশিক। এদেও প্রয়োজনীয়তা অস্বীকারের নয়। কিন্তু প্রথমটিতে রয়েছে বিশ্বাযোগ্যতার অভাব ও প্রতারণা আর নির্ভারতা। দ্বিতীয়টিতে রয়েছে দুর্বহ ভার। কিন্তু মননশীল সৌন্দয্যই বোধ হয় আমরা চাই। যা প্রতারাণা ও বোঝা বহনের হাত থেকে আমাদেও মুক্ত রাখতে পারে। এ দায়িত্বটুকু পালন করাই সম্ভবত সাহিত্যিকের প্রকৃত কাজ। এবং সবেচেয়ে কঠিন। তাই হয়তো মহত্ সাহিত্যিক এতো দুর্লভ, আদরনীয় ও দামী!



২.
এতোক্ষণতো কাব্বানির ছুঁতোয় রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক, শুদ্ধ-অশুদ্ধ, ব্যক্তিক আর জন-কবিতা- এই সব নিয়ে, এদের সীমা ও সম্ভাবনা নিয়ে, এদের পরিপূরকতা নিয়েই কথা হলো। এবার কাব্বানি জীবন ও পরিবার সম্পর্কে কিছু কথা বলা যাক। তিনি জন্মেছিলেন ১৯২৩-এর ২১ মার্চে। আর ১৯৯৮ সালের ৩০ এপ্রিল তার এই পার্থিব ভাষা-অতিরিক্ত জীবন থেমে যায়।
সিরিয়ার কূটনীতিক ছিলেন তিনি। তিনি কবিতা লেখার পাশাপাশি প্রকাশনা ব্যাবসার সাথেও নিজেকে জড়িয়েছিলেন। সারল্য ও সৌন্দর্যের মিশেল ঘটেছে তার কবিতায়। বিষয় হিসেবে প্রেম, যৌনতা, নারীবাদ, ধর্ম, আর আরব জাতীয়তাবাদ তার কবিতায় প্রাধান্য পেয়েছে।
সিরিয়ার রাজধানী শহর দামেস্কাসে জন্মেছিলেন তিনি, এক মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান, মভা বড়ো হন মিত-নাহ আল-শাহম-এ, পুরোনো দামেস্কাসের কাছেরই এক জায়গা। বাবার বন্ধু আহমদ মনিফ আল-আইদি’র শিক্ষালয় ন্যশনাল সায়েন্টিফিক কলেজ স্কুলে ১৯৩০ ও ১৯৪১ এর মাঝখানে পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে দামেস্কাস বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে পড়াশোনা করেন এবং ১৯৪৫-এ তার এই ডিগ্রি অর্জন করেন। প্রেমের কবিতার বই অপরূপা আমাকে বলেছিলো তার প্রথম কাব্য গ্রন্থ, বিশ্ববিদ্যলয়ে অধ্যয়নরত অবস্থাতেই বেরিয়েছিলো। দামেস্কাসের সংরক্ষণশীল সমাজে বেশ আলোড়ন তুলেছিলো বইটি, কারণ এর ভেতর নারী-শরীর নিয়ে অনেক চমকে দেয়া কথা ছিলো, যা সিরীয় মানসকে আঘাত করে। আর এই আলোড়নে নিজেকে অধিক গ্রহণযোগ্য করে নিতে তিনি শিক্ষামন্ত্রী মুনির আল-আজলানিকে কবিতার বইটি পাঠান। এই মন্ত্রী তার বাবার বন্ধু ছিলেন, ছিলেন নেতৃস্থানীয় এক সিরীয় নেতা। তিনি কাব্বানির কবিতার প্রশংসা করে বইয়ের জন্য একটি ভূমিকাও লিখে দিয়েছিলেন।
আইনের পড়াশোনা শেষে সিরিয়ার পররাষ্ট্রীয় মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন, এবং কনসাল বা কালচারাল এটাসে হিসেবে বইরুত, কায়রো, ইস্তাম্বুল, মাদ্রিদ ও লন্ডনে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৯ সালে, ইউনাইটেড আরব রিপাবলিক গঠিত হলে চীনা এম্বাসিতে কাব্বানি এর ভাইস-সেক্রেটারী নিয়োজিত হলেন। চীনে অবস্থানকালেই তিনি তার অধিকাংশ কবিতা রচনা করেছিলেন, বেশকিছু ভাল কবিতা এ সময়েরই লেখা। ১৯৬৬ সালে আগ-পর্যন্ত তিনি তার কুটনীতির চাকরি চালিয়ে যান। এরপর নিজেই এ চাকরিতে ইস্তফা দেন। এসময়েই তিনি বইরুতে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান খুলেন।
কাব্বানির বয়স যখন ১৫, তখন তার ২৫ বছর বয়েসী বোন আত্মহত্যা করে। ভালবাসে না এমন একলোককে বিয়ে করতে অস্বীকার কওে তার বোন, আর এ ইচ্ছে জলাঞ্জলি না-দিতেই আত্মহত্যা করে বসে। বোনের অন্ত্যেষ্টির সময়েই কাব্বানি সামাজিক এই দুরবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নেন। আপনি কি বিপ্লবী? এমন প্রশ্ন তাকে করা হলে উত্তর দিতেন, “প্রেম আরব বিশ্বে একজন মানুষকে অপরাধী বানিয়ে ফেলে, আর আমি চাই এই অবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি। আমি আমার কবিতার ভেতর দিয়ে আরব লোকজনের মন, সংবেদন, আর শরীরকে স্বাধীন করে তুলতে চাই। নারী ও পুরুষের সম্পর্ক আমাদের সমাজে স্বাস্থ্যকর নয়।” তিনি তার সমকালে সবচেয়ে তুখোর নারীবাদী ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী হিসেবে খ্যাত ছিলেন।
এরপর ১৯৬৭ সালে আরবের পরাজয় তাকে ব্যাপক প্রভাবিত করে। এই আরব ইস্যুটি তার কবিতায় শোকের ছায়া ফেলে। এই পরাজয় কবিতায় শরীরি প্রেমের বিষয়ের সাথে প্রত্যাখান ও প্রতিরোধের বিষয়কে মিশিয়ে দেয়। পরাজয়ের কিতাবে’র পাদটিকা নামের কবিতাটি এর একটি ভাল উদাহরণ। কবিতাটি আরব হীনমন্যতা নিয়ে আত্মসমালোচায় উপচে উঠেছে। আরবের কি ডান কি বাম রাজনৈতিক বিতন্ডাতে এ বিষয়টি ঘৃতাহুতি দেয়।
নিজার কাব্বানির দুইবোন উইজাল ও হাইফা, আর তিন ভাইÑ মো-তাজ, রশিদ, ও সাবাহ। নিজারের পরবর্তীতে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি অর্জন করেন এই সাবাহ কাব্বানি। সিরীয় রেডিওর পরিচালক ছিলেন তিনি, আর ১৯৬০-এ সিরীয় টিভির পরিচলকও হয়েছিলেন। পরবর্তিতে, ১৯৮০ দশকে যুক্তরাষ্টে নিয়োজিত সিরীয় এম্বাসেডরও হয়েছিলেন সাবাহ।
নিজার কাব্বানির বাবা তোফিক কাব্বানি সিরীয় হলেও, তার মা ছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভুত। তার বাবার একটা চকলেট কারখানা ছিলো। তিনি সিরীয়ায় ফরাসি ম্যান্ডেটের বিরোধীদের সহযোগিতা করতেন। তার এই মতাদর্শিক অবস্থানের জন্য বহুবার জেল খেটেছেন। আর এসবই নিজার কাব্বানির বেড়ে উঠাকে ব্যাপক প্রভাবিত করেছে, যার পরিণাম একজন নিজস্ব-ধরনে এক বিপ্লবী কবিতে পরিবর্তিত হওয়া। কাব্বানির পিতামহ আবু খলিল কাব্বানি আরবের নাটকের একজন বড়ো সৃজনশীল ব্যাক্তিত্ব ছিলেন।
নিজার কাব্বানি দুইবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রথমবার তারই চাচাতবোন জাহরা আকবিকের সাথে, এ সময় আদবা নামে এক মেয়ে আর তওফিক নামে এক ছেলের জন্ম হয়। দ্বিতীয়বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন বিলকিস আল-রাউয়ি নামের এক ইরাকি নারীর সাথে। এক কবিতা পাঠের উত্সবে বিলকিসের সাথে কাব্বানির দেখা হয়েছিলো। লেবাননের গৃহযুদ্ধ চলাকালে বইরুতের সিরীয় এম্বাসিতে গেরিলাদের বোমা হামলায় নিহত হন এই নারী। তার মৃত্যু কাব্বানির উপর গভীর শোকের ছায়া ফেলে। বিলকিস নামের বিখ্যাত কবিতায় তিনি তাকে নিয়ে নিজের শোক প্রকাশ করেছিলেন, পুরো আরব বিশ্বকেই তিনি বিলকিসের মৃত্যুর জন্য দায়ী করেন ওই কবিতায়। বিলকিসের সাথে দাম্পত্যকালে ওমর নামের এক ছেলে আর জয়নাব নামে এক মেয়ের পিতা হন তিনি।
বিলকিসের মৃত্যুর পর কাব্বানি বইরুত ছেড়ে যান। একবার জেনেভা আরেকবার প্যারিস এভাবেই কাটতে থাকে সময়। একসময় লন্ডনে স্থায়ী হন। জীবনের শেষ ১৫টি বছর লন্ডনেই কাটিয়ে দেন তিনি। ৭৫ বছর বয়সে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে চিরনিদ্রায় চলে যান তিনি।
অর্ধ-শতাব্দির কবিতা চর্চার ভেতর দিয়ে কাব্বানি ৩৪টি কবিতার বইয়ের এক বিশাল ভাঁড়ার গড়ে তোলেন। স্তনের শৈশব, সাম্বা, তুমি আমার, কবিতা, প্রিয় আমার, শব্দে আঁকা, গা-না-করা এক নারী, দস্যু কবিতা, প্রেমের কিতাব, প্রেমের শত চিঠি, আইনের বিরুদ্ধে কবিতা, আমি বলছি তুমি ছাড়া আর কোনো রমনী নেই, মিশরীয় বেহায়ার ডায়েরি, বিলকিসের জন্য কবিতা, প্রেমকে থামাতে পারে না কোন রক্তিম আলো, উন্মাদ কবিতা, রাগ-উত্সারী কবিতা, প্রেমই আমার প্রভু হয়ে থাকবে, পাথর শিশুদের নিয়ে ট্রিয়লজি, কার্মাথিয় প্রেমিকদের গোপন নথি, এক আরব জল্লাদের জীবনী, তোমাকে বিয়ে করেছিলাম- হে স্বাধীনতা, তুমি আমার দুঃখের কান্না কি শুনতে পাচ্ছো?, পরাজয়ের বইয়ের পাদটিকা, নারীর প্রশংসায় পঞ্চাশ বছর, জুঁইফুলের বর্ণমালা ইত্যাদি।
কবিতার বাইরেও অনেক গদ্য লিখেছিলেন তিনি। আমার কবিতার গল্প, কবিতা কী, শব্দরা জানে রাগের পরিচয়, কবিতা নিয়ে, যৌনতা ও বিপ্লব, কবিতাতো সবুজ এক প্রদীপ, পাখিদের ভিসা লাগে না, আমার কবিতায় নারী ও আমার জীবন-- এমনই কয়েকটি বই। আরবের বহু বিখ্যাত গায়ক তার বহু গীতিকবিতাই কণ্ঠে তুলেছেন-- মোহাম্মদ আব্দেল ওয়াহাব, আব্দেল হালিম হাফেজ, ফাইরোজ, কাথেম আল-শাহের, খালিদ আল-শাইখ, উম্ম কুলথাম, লাতিফা, মজিদা আল রুমি, আসালাহ তেমনি কজন। এসব গান আরব বিশ্বে খুব জনপ্রিয়ও বটে। তার অনেক কবিতাতেও সুর দিয়েছেন কণ্ঠ শিল্পীরা।

দ্বিতীয় অংশটি অর্থাত্ কাব্বানির জীবন ও রচনাকর্মের সমস্ত তথ্যাদি উইকিপিডিয়া থেকে প্রায় হুবুহু আহৃত।



মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.