নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লেখার সর্বসত্ত্ব লেখক দ্বারা সংরক্ষিত।

রাবেয়া রব্বানি

মানুষের ভীড়ে মানুষ হয়ে গেছি বারবার।

রাবেয়া রব্বানি › বিস্তারিত পোস্টঃ

আলো অন্ধকারে যাই

১৫ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ১২:১৫







হ্যালো। স্লামালাইকুম।

-হ্যালো ওয়াদুদ। আমি সি ওয়ান থেকে বলছি।

-জ্বি স্যার বলুন।

-আমার এখানে সার্ভিসিং এর জন্য দুটো ছেলে আসে রোজ। ওদের নিশ্চয়ই চিনো ?

-জ্বি স্যার।

-ওরা ছাড়া অন্য কোন ভিজিটর আসলে বলবে আমি বাড়িতে নেই।

-জ্বি স্যার।

ইন্টারকমের রিসিভারটা ঝুলিয়েই রাখলাম। ইচ্ছে করছে উভচরের মতো চার পায়ে লাফিয়ে শীতনিদ্রার স্তব্ধ এক জগতে চলে যাই। শুধু চোখ বুজে নয় সমস্ত সত্তা নিয়ে যেখানে আমি দীর্ঘকাল ঘুমিয়ে থাকব।

আজ শুক্রবার, ছুটির দিন । তবু নানান জায়গা থেকে দু: সম্পর্কের আত্মীয়রা চলে আসবে। কারো চাকুরী দরকার তো কারো সাহায্য। কারো কারো নাকি আমার মৃত বাবার কাছে টাকা পাওনা ছিল, আবার কেউ আসবে আমার বিয়ের ব্যাপারে। ভাবতে ভাবতেই মুঠোফোনটা বেজে উঠল। ডিসপ্লেতে হীরার নাম। হীরা আমার অন্তর্জাল বন্ধু।

-মিঃ শান্ত। কী করছেন?

-কিছু না।

-আপনি না একটা খিচুরি টাইপ মানুষ। তাও স্পাইসি বা টেস্টি না একেবারে বেবি তরল খিচুরি। যখনি বলি কী করছেন ? আপনি বলেন, “কিছু না”।

-আচ্ছা ?

-ধুর আপনার সাথে কথা বলে মজা পাই না।

- খুব যে পাও না তা না। তুমি আমাকে বেশ টিজ করে কথা বল এবং তাতে মজা পাও। আরো বেশি মজা পেতে যদি আমি রাগতাম।

-হোয়াট! আমি আপনাকে কি টিজ করব? আপনি যথেষ্ট বয়স্ক ।

-আমি জানি। আর তুমি যথেষ্ট খুকি।

-হি হি!

-হা হা!

-আচ্ছা বিয়ের চেষ্টা কেমন চলছে?

-বেশ ভালো।

-বিয়ের পর আপনার সাথে দেখা করব। এখন দেখলে প্রেমে পড়ে যাবেন-তো তাই। তখন আবার ঝামেলা।

-হা হা!

-হাসছেন কেন ?

-তুমি কিন্তু নিজেই কচ্ছপের মতো একজন। অন্যকে উল্টো পালট করতে আসো কেন ? তোমাকে যদি উলটে দেই তুমি কিন্তু নড়তে পারবে না । হা হা !

-মানে!ধ্যাত!

চট করে লাইন কেটে দিয়েছে হীরা। অন্তর্জাল, মানুষের কিছু অসুখ উস্কে দিয়েছে। আমি বুঝতে পারি হীরার রহস্য রহস্য খেলায় আমি অনেকের মতো কেবল একটা চরিত্র। এইসব অসুখের অনুপ্রেরণাগুলোর একটা এই মুঠোফোন। মুঠোফোনটা আশেপাশে কোথাও ছুড়ে দেবার আগ মুহূর্তে আমি করুণ চোখে তাকালাম ল্যান ফোনের দিকে। এই যন্ত্রটার কথাতো আমার মনেই ছিল না।

-হ্যালো। স্লামালাইকুম স্যার।

-হুম।

-স্যার আমি শখ বাজার থেকে আখলাক বলছি।

-হ্যাঁ বলুন।

-স্যার আপনার আজকে ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের সাথে মিটিং ছিল। সবাই অপেক্ষা করছে ।

-আজ আমার শরীর ভালো না। মিটিং পোস্টপন্ড করুন। সন্ধ্যার পর আসবো ।

-স্যার শখা বাজারের গুলশান ব্রাঞ্চের ওপেনিং এর ব্যাপারে মিটিং টা ।

-আমি জানি। সন্ধ্যার পর।

-কোন সমস্যা নেই স্যার। গুড ডে স্যার।

প্রায়ই মনে হয় সভ্যতার সমস্ত যোগাযোগ যন্ত্রকে শরীরের শক্তি দিয়ে দূরে কোথাও ছুড়ে মারি। অসভ্য বর্বরতা নিয়ে আদিম গুহাবাসী হয়ে যাই। যেখানে এক টুকরা খাবারের জন্য যুদ্ধে লিপ্ত হব। প্রকৃতির প্রতিকূলতার দিকে ছুড়ে দিব বেঁচে থাকার চ্যালেঞ্জ। প্রতিকূলতা মোকাবেলা করার মতো হিংস্রতা নিয়েই আমি ল্যান ফোনের তারের সংযোগ খুলে ফেললাম। মুঠোফোনের সুইচ অফ করলাম। ভেবে নিতে চাইলাম আমি এক নিচ্ছিদ্র নিকষ আঁধার। আমাকে পুনরায় হতাশ করে কলিং বেলটা বেজে উঠল।

আমার নিজের প্রতিষ্ঠান শখবাজার থেকে প্রতিদিন যে দুটো লোক আসে তারাই এসেছে।তাদের রান্না আর কাজের অনুমতি দিয়ে শোবার রুমে চলে এলাম, একরকম জোড় করেই চেষ্টা করলাম ঘুমুতে। কিছুক্ষণের চেষ্টায় চোখে ঘুম লেগে গিয়ে আরামদায়ক একটা তন্দ্রায় আছন্ন হতেই ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের বিকট শব্দে ধুম করে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল । এবার প্রচণ্ড রাগ হলো । ইচ্ছে করলো ধমকে ছেলেদুটোকে তাড়িয়ে দেই । বার বার ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে মেজাজ মন দুটই খিঁচিয়ে আছে, ক্লান্তিটাও অসহ্য বোধ হচ্ছে । এই পাথর চোখ বুঝে লাভ নেই ভেবে আমি উঠে বসলাম। হঠাৎ খাটের পাশ লাগোয়া বারান্দায় ফিসফিস শব্দ হলো। মানুষের কণ্ঠের মতই শোনাল শব্দটা। একটু কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম। এবার বেশ স্পষ্ট শুনতে পেলাম,

-শান্তনু! শান্তনু!

যেন কোন বিপদ ঘণ্টা বাজছে ,যেন বিদ্যুৎ চলে গেছে আর আমি অন্ধকারে বড় চোখ করে তাকানো ভীতু বালক। আমি যান্ত্রিকভাবে উঠে দাঁড়ালাম । মস্তিষ্ক খোঁজ আর প্রশ্নের ছুটোছুটি চলছে । একটা রিনরিনে মেয়েলী কণ্ঠ আমার বারান্দায় আসবে কিভাবে ! আমি কান পেতে রইলাম ভুল ভাঙ্গার অপেক্ষায় । কিন্তু কণ্ঠটা হাল্কা থেকে আরও ঘাঢ় হল।

-শান্তনু !সুব্রত !শান্ত!

একটা আতংক আমার মেরুদণ্ড ছাপিয়ে নামলো ,গলা শুকিয়ে গেল ভয়ে । এক ছুটে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম । দিনের স্পষ্ট আলো চারিদিকে, কোমল রোদ ঝলমল করছে। হয়ত আলোর সাহসে ভয়টা পালালো তবে এক-বুক হতাশা সেই স্থান নিয়ে নিল। হ্যাঁ এবার বুঝি ষোল কলাই পূর্ণ হলো। হ্যালুসিনেশানের রুপালী ঝলক নয়তো! তৃষ্ণার্তের মতো ফিরে গিয়ে সিগারেটের প্যাকেটটা খুঁজতে লাগলাম। এবার বারান্দার কণ্ঠটা উত্তেজিত ভাবে বলতে লাগল,

-শান্তনু।শান্তনু।

আমি দিশেহারা মানুষের মতো ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রইং রুমে চলে এলাম । আমার ছুটে আসার ভঙ্গী দেখে সার্ভিসিং এর ছেলেদুটো জোর স্যালুট দিল,

-স্যার কোন সমস্যা ?

সীমাহীন ক্লান্তি নিয়ে কিছুক্ষণ ওদের কথার উত্তর হাতড়ালাম । নাহ পালানো তো আমার ধাত নয়। আমি সেই বারান্দাতেই ফিরে এলাম। সিগারেট ধরাতে ধরাতে নিজের বিশ্বাস অবিশ্বাসের মাঝামাঝি দাঁড়ালাম, কণ্ঠস্বরটা আবার শোনার অপেক্ষায় ।



২।

-ভাইয়া তুমি এমন মুখ করে আছো কেন ? আমরা মেয়ে দেখতে যাচ্ছি । চিয়ার আপ।

রাহুলের কথায় আমি বাক -বিতর্কে গেলাম না। মেকি হাসি হাসার চেষ্টা করলাম। আমার এই মাসতুতো ভাইটি যেন আমার বিপরীত ছবি। আবেগ নামক অদ্ভুত জিনিসটা তার শরীরে শিল্পের মত এঁটে গেছে। নিজের স্বার্থহীন শুভাকাঙ্ক্ষী বলতে এই একজনকেই মানি আমি তাই কোথায় কোন মেয়ে দেখতে যাচ্ছি সেটা জানতেও চাইনি । এক কথায় চলে এসেছি ।

আমার বিয়ের ইচ্ছেটা চট করে না ধুকতে ধুকতে মরে গেছে খেয়াল করি নি । তবে এ ব্যাপারে অনাগ্রহতাটা এখন চরম । ব্যাপারটা রাহুলের কাছে লুকোতেই প্রশ্ন করলাম,

-বাসাটা ঠিক কোথায় ?

-আমরা বাসায় যাব না তো আমরা যাব কে এফ সি তে। এন আন-অফিসিয়াল মিটিং ।

-ওহ। মেয়ে কি করে ?

-কিছু করে না আপাতত মাস্টার্স শেষ করেছে। লুকিং ফর আ হ্যান্ডসাম গ্রুম।

-ওহ !ওইথ আ হ্যান্ডসাম ইনকাম ওলসো। নাহলে এত এজড ছেলে বিয়ে করতে যাবে কেন?

-আশ্চর্য !এভাবে ভাবছো কেন! আমরাও তো কিছু চয়েজ রেখেছি । মোটামুটি গুড লুকিং হতে হবে । ভদ্র ফ্যামেলি ভদ্র হতে হবে আর এভারেজ শিক্ষিত। তুমিতো যাকে তাকে বিয়ে করবে না। মেয়েটা যদি কোন কারণে তার ফাইনান্সিয়াল সিকিউরিটির কথা ভাবে তাহলে ক্ষতি কি ?

-হ্যাঁ তাইতো। নিজের কথায় নিজেই লজ্জা পেলাম আমি । ছি! নিজে ব্যবসায়ী বলেই কি এভাবে ভাবতে পারি।

-সরি। মনটা ব্যবসায়ী হয়ে গেছে । সব কিছু ডেবিট আর ক্রেডিট করে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কেউ আমাকে দেখে একটা হাসি দিলেও মাঝে মাঝে মনে মনে একে পি এল এক্যাউন্টের ক্রেডিট সাইডে বসিয়ে দেই।

হেসে হেসে কথাটা বললেও মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল আমার। আবার শূন্য জগতটার মুখ হা হয়ে গেল আমাকে ভেতরে পুরার জন্য। আর আমিও যেন নিজেকে সেখানে সেঁধিয়ে দিলেই বাঁচি।

রাহুল যে আমাকে আড়চোখে দেখছে এটা আমি তার দিকে না তাকিয়েও বেশ বুঝতে পারছি। কারো মনোযোগে ইদানিং অতিরিক্ত অস্বস্তি হয়। আমি পকেট হাতড়ে সিগারেটের প্যাকেট ছুঁয়ে থাকলাম। গাড়ির ভেতর সিগারেট খেতে অভ্যস্ত কেন হতে পারলাম না এই ভেবে এখন আফসোস লাগছে। আমার এত সভ্য হওয়ার কোন প্রয়োজন ছিল না। রাহুল হঠাৎ একটু গলা নামিয়ে বলল,

-কয়দিন আগেই এই প্রোগ্রামটা হতো। আসলে আপু কে নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলাম! আমি বুঝতে পারছি এত বড় ফ্লাটে একা একা তোমার নিশ্চয়ই আরো দম বন্ধ লাগছে।

শামা! আমার বুক থেকে একটা খুব পুরনো একটা দীর্ঘশ্বাস বের হল। শ্যামলা রঙের অসাধারণ দেখতে মেয়েটি আজ আমার ঠিক পাশেই থাকতে পারতো । এই রাহুলের বোন শামার সাথে এক সময় আমার কি দূর্দান্ত প্রেমই না ছিল । নিয়ম অনুযায়ী এই রকম প্রেমগুলো সব বেকার অবস্থাতেই হয় । খুব সাধারণ প্রেমের গল্পের মত শামার বিয়ে হয়ে যায় । তবে কষ্টের যে কোন সাধারণ অসাধারণ শ্রেণীবিভাজন হয় না এটা হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলাম আমি । এখন যদিও শামার প্রতি প্রেম বোধ করি না ওভাবে এবং যদিও অনেকদিন আগের ব্যাপার তবু রাহুলের সাথে শামাকে নিয়ে কথা বলতে লজ্জাই হয় । আজ কেন জানি মুখ ফসকে বলে ফেললাম ।

কী নিয়ে ব্যস্ত ?

আমার প্রশ্নে যেন অনেকটা ই স্বচ্ছন্দ বোধ করে রাহুল। সে ব্যাপারটা বলার জন্য তৈ্রি ছিল,

-আপুর এডভান্স প্রেগন্যান্সি ছিল। ফাইভ মান্থ। এখনতো ফোর ডি আল্ট্রাসাউণ্ড করে।তো ওভাবে জানা গেল বাচ্চাটার মধ্যে কিছু জেনেটিক ডিফিক্যাল্টি রান করছে। মানে শারীরিক ভাবে এক হাত আর এক পা পঙ্গু।

এতটুকে বলে একটা টানা দীর্ঘশ্বাস নিল সে। আমি প্রকট চোখ তাকিয়ে রইলাম রাহুলের দিকে। যেন আমি বুঝতে পারছি পরের কথাগুলো কি হতে পারে। রাহুল যেন বাকি কথাটা বলার জন্য দম খুঁজছে।

-তো দুলাভাই আমরা সবাই ঠিক করলাম যে বাচ্চাটা রাখবো না। কারণ একটা সন্তান ভেজিটেবিল হয়ে পড়ে থাকলে প্রতি মুর্হূতে কষ্ট পেতে হবে তাছাড়া সে নিজেও কষ্ট পাবে। আপুর ম্যান্টল প্রেশার এড়াতে তাকে অনেকটা ধোঁকা দিয়েই এবোরশানটা করানো হয়। যখন থেকে আপু বুঝতে পেরেছে তার পেটে সন্তানটি নেই সে স্বাভাবিক আচরণ করছিল না। পাগলের মত চিৎকার চেঁচামেচি করে একদম চুপ হয়ে গেছে। দুইতিন দিন তার সাথেই ছিলাম তাকে নানান ভাবে বোঝাতে চেষ্টা করছি আমরা সবাই। এখন একটু ভালোর দিকে। আপুর মুখে শুধু একটাই কথা। আমার বুকটা খালি করে দিলে কেন?

-হুম।

-জানো ভাইয়া বাচ্চাটা হয়তো ফিজিক্যালী আনফিট ছিল ।কিন্তু তার জীবনীশক্তি ছিল। তার ডেভলাপে অন্য কোন সমস্যা ছিল না। আমরা একটি জীবন্ত বাচ্চাকে মেরে ফেলেছি ভাইয়া।

কথাটা শেষ না করতেই রাহুল আচমকা আমাকে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। আমি রাহুলের পিঠে হাত রাখতে চেয়েও পারলাম না। হঠাৎ আমার বাম হাত আর কাঁধে খিচুনি শুরু হয়ে গেল। যেন একটা অদৃশ্য জন্তু আমার উপরে চেপে বসেছে। আমি কিছু বলতে পারছি না নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না।নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে হাত কাঁপছে। প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়েই রাহুলের বুকে একরকম অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম। যখন জ্ঞান ফিরলো আমার মুখের সামনে রাহুলের উদ্বিগ্ন মুখ,

-এখন কেমন লাগছে ভাইয়া।

মস্তিষ্ক ছুটোছুটি পড়ে গেল স্মৃতি হাতড়ে আনতে। কিছুক্ষণের জন্য আমি মনে করতে পারলাম না একটু আগের ঘটে যাওয়া ঘটনা। আস্তে আস্তে ধাতস্থ হয়ে বুঝলাম গাড়ি ঘুরানো হয়েছে আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কাছের একটি হসপিটালে। বুঝে উঠতেই খুব কড়া গলায় বললাম,

-কিরে গাড়ি ঘুরিয়েছিস কেন ? আমি এখন কোন ডঃ এর কাছে যাবো না। যেখানে যাচ্ছিলাম সেখানে চল।

রাহুল কিছু বলতে চাচ্ছিল আমি আদেশের সুরে বললাম,

-ড্রাইভার আগে যেখানে যাচ্ছিলেন সেখানে চলেন। আমার ভালো লাগছে।ওটা কিছুনা।

খিচুনি কিসের লক্ষণ কে জানে । এখনই ঘাটাতে ইচ্ছে করছে না। এই মুহূর্তে হসপিটালে ঢুকে নানান রুটিন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার কোন মানে হয় না। প্রায় পনের মিনিটের মধ্যে কে এফ সি র কাছে পৌঁছে গেলাম আমরা। ভেতরে গিয়ে যে মেয়েটিকে দেখলাম তাকে দেখার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। ভেবেছিলাম খুব চালাক চতুর খুব আধুনিক একটি মেয়ে হবে। কিন্তু সেখানে একেবারে ভীতু আর নরম চেহারার সুন্দরমতো একটি মেয়ে বসে আছে । আশে পাশের কোন মেয়ের সাথে সাজ পোষাকে খাপ খাওয়ানো যাচ্ছে না একে। আমি রাহুলের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভাবে হাসলাম। রাহুল যেন প্রাণ ফিরে পেল।

টেবিলে বসতেই মেয়েটি ওড়নার প্রান্ত দিয়ে তার কপাল মুছতে লাগল।

রাহুল বলল, ভাইয়া তোমরা কথা বল। আমি খাবার নিয়ে আসি।

বসেই মেয়েটিকে বললাম,

- বেশি অস্বস্তি হলে আপনি চলে যেতে পারেন।

আমার কথা শুনে মেয়েটি প্রথমে বেশ চমকাল তারপর জ্বর সেরে উঠা রোগীর মতো সহজ, চমৎকার একটা হাসি দিল। মেয়েটির হাসিতে আমি কিছুটা ধাক্কা খেলাম। পুরনো পরজীবীটা কিছুদিনের ঘুমের পর তাহলে আজ আবার জেগে উঠেছে ।

এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে মেয়েটির এই হাসিটা খুব পুরনো। আমি আশে পাশে তাকালাম। কমলা রঙের এপ্রণ পড়া ওয়েটারের দিকে তাকাতে সেও এমন একটা পরিচিত হাসি দিল। সব যেন স্লো মোশনে চলতে থাকা কোন স্বপ্নদৃশ্য । মানুষের কথার টুকরো শব্দ ভেসে আসছে । সব আগেই দেখা আগেই শোনা। সামনে যা ঘটে চলছে তা সবই যেন গত জন্মের অস্পষ্ট ঘোলাটে একটা ছবি। এই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরেও নিশ্বাসের অভাব বোধ হল আমার। সিগারেটের জন্য মনটা পুড়তে লাগল।

একাকীত্বের কৃষ্ণগহ্বর আমাকে এর মধ্যে তার ভেতরে নিয়ে নিয়েছে। রাহুল চলে এসেছে খাবার নিয়ে। সে মেয়েটির সাথে কি যেন বলল। আমি শুনতে পেলাম না। মেয়েটি আগের ভঙ্গিতেই হাসছে । প্রচণ্ড ঘোর নিয়ে আমি উঠে দাঁড়ালাম। পুরনো এই রোগটা বহুদিন পর ফিরে এসে যেন আমার বুকটা খামচে ধরে আছে। রাহুল ব্যস্ত হয়ে গেল।

-কি হলো? উঠলে কেন? আবার খারাপ লাগছে? থাকতে পারবে এখানে না চলে যাবে?

আমার যাওয়া উচিত কিন্তু যেতে ইচ্ছে করছে না । পুরনো রোগটাকে জড়িয়ে ধরে এখানেই থাকতে ইচ্ছা করছে । আমি যাব বলতে চেয়েও পারলাম না ভেতর থেকে অন্য কেউ একজন ঠাণ্ডা স্বরে বলল,

-না। যাব না।

রাহুল মেয়েটার সাথে টুকটাক কথাতেও খুব হাসছে। কে বলবে একটু আগে এই ছেলেটাই হাউ মাউ করে কেঁদেছে। কি অদ্ভুত! আর আমি কিনা এখনো সেই রেশ মেখে বসে আছি। শ্যামার বাচ্চাটার কথা আমার মাথা থেকে সহজে নামবে বলে মনে হচ্ছে না ।

মাঝে মাঝে রাহুল আর মেয়েটির সাথে আমাকেও হু হা বলতে হচ্ছে। হাল্কা সুরে বাজছে টেরি জ্যাকস এর সিজন ইন দা সান। আমি দেখে চলছি মেয়েটির পরিচিত মুখ, চারপাশটা, প্লেয়িং সেকশানে ছুটন্ত বাচ্চাদের,কমলা এপ্রণ পড়া ওয়েটারদের, ঘন হয়ে বসা কপোত কপোতীদের। চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। কি অদ্ভুত! কী অদ্ভুত পুরনো বিষণ্ণ গানের মত অপূর্ব দৃশ্যগুলো!



৩।

আমার ফ্লাটে ছোটখাটো পার্টি হচ্ছে। উদ্যোক্তা রাহুল, অতিথি আমার ও রাহুলের কিছু বন্ধু বান্ধব। আমি বসে আছি আমার চার পাঁচজন বন্ধুর মাঝে। যাদের সবাই বিবাহিত। আলোচনা হচ্ছে প্রেম নিয়ে,

-আমাকে অনেকে দোষ দেয় যে আমাকে নাকি পরকীয়া করতে দেখা যায়। আরে তোদের কি রে শালা! আসলে প্রেম প্রেম ই। সেটা স্বকীয়া হোক আর পরকীয়া। প্রেমের এসপেক্ট কিন্তু এক ই।

কাজল নামক এই বন্ধুর কথায় বাকি সবাই হই হই করে একমত হলো। কাজল তাতে উৎসাহিত হয়ে গলা উঁচিয়ে দিল,

-প্রেম শুধু জীবনীশক্তি আর ইন্সপ্রেরিয়েশান এর মাধ্যম নয়। সীমিত সময়ের জন্য হলেও অহং নামক বস্তুটিকে মেরে ফেলতে সক্ষম তাছাড়া চোখের আলোটাও বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুন। সেই আলোতে পৃথিবীই ধরা দেয় স্বর্গ রূপে। প্রেমের গুণ বলে শেষ করার নয়। সেটা স্বকীয়া হোক আর পরকীয়া। প্রেমের ক্লাসিফাই করা ক্লাস ওয়ান অপরাধ। এই অপরাধের ধারা বের করা উচিত।

আবার একটা ছোটখাটো শোরগোল উঠল,সবাই এক স্বরে বলে উঠল, সাধু! সাধু!

রঞ্জন বলল,

-দ্যাখ আজ আড্ডাটা কত জমেছে কেন জানিস!

সবাই একসাথে বলল,

-কেন কেন?

কারণ কোন প্রেমিকা বা স্ত্রী বা নারী নেই। এই বাড়িতে শান্তনু একা থাকে।

সবাই হা হা করে হাসতে লাগল। কাজল আবার টিপ্পনী কাটে,

“থাক বাবা শান্তনু তুই চল্লিশ পেড়ো । শুনছি তোর বিয়ে হয়ে যেতে পারে। কেন রে ? নিজের পায়ে কুড়াল মারবি!এভাবেই থাক। আমরা এখানে এসে হাফ ছেড়ে বাঁচবো আর পরনারী চর্চা করব।

এই সব রসিকতায় আমি নির্বিকার কিছু হাসি দিচ্ছি যার আদতে কোন অর্থ হয় না । টুকটাক হু হা করছি। আমি একটা বিয়ারের ক্যান নিতে আসার বাহানায় বন্ধুদের ভিড় থেকে উঠে এসে রাহুলের পাশে দাঁড়ালাম। রাহুল আমাকে খেয়াল করল না। সে খুব মনোযোগ সহকারে একটা ছেলের কথা শুনছে।ছেলেটি বলছে,

-What is life full of care

We have no time to stand and stare.

হয়তো এটা কবিতা বা অন্য কিছু। দু নম্বর লাইনটি খুব ভালো লাগল আমার। ঠিক তাই, আই হ্যাভ নো টাইম টু স্ট্যান্ড আন্ড স্টেয়ার। লাইনটা আমার ভেতর গুনগুন করতে করতে একটি বিয়ারের ক্যান নিয়ে চলে এলাম বারান্দায়।

আটটা বাজে, আমি ঘড়ি দেখলাম। ভরা শরীরের চাঁদটা এতক্ষণে উঠে আসার কথা। একটু খুঁজতেই দূরের একটা বিল্ডিং প্রান্তে পাওয়া গেল। আধ খানা হলুদ চাঁদ। কি একটা কবিতা মনে এসেও মনে আসছে না তার। রাহুল পাশে এসে দাঁড়ালে বললাম,

-কিরে পার্টি কেমন লাগছে?

-তোমার কেমন লাগছে? তোমার জন্যই তো আয়োজন করা। উফ ভাইয়া একটা ইম্পর্টেন্ট কথা।

-হুম

-আমরা কিন্তু মেয়ে পক্ষকে ওকে বলে দিয়েছি। আগামী সপ্তাহে ওদের এখানে অফিসিয়ালি আসার কথা তারপর আমরা গিয়ে এনগেজমেন্ট করব। আমি মহল্লায় খবর নিয়েছি মেয়েটি বেশ ভাল।

-হুম। বিয়ে কি ঠিক করে ফেলেছিস নাকি!

-আমি না তো ভাইয়া । কথা বলছে মা।

-আচ্ছা। রাহুল! আধখানা চাঁদ নিয়ে কি যেন একটা কবিতা আছে না রে?

-ওহ কবিতা ! রাহুলের কি যেন মনে পড়েছে ভঙ্গিতে বারান্দা ছেড়ে ঘরে চলে গেল,

সে উপস্থাপকের স্বরে একটা দুটো হাততালি দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইল,

-হ্যালো। প্রিয় সুধী। পার্টির শুরুতে কিন্তু শর্ত ছিল নো সিনিয়র-জুনিয়র। এখন দেখুন সবাই কিভাবে ভাগ হয়ে গেছি। আসুন মনের বয়সকে প্রাধান্য দেই। শরীরের নয়।

পেছন থেকে ব্যাড সাউন্ডের মত কাজল বলল,

-শান্ত তোর এই ভাইটা কিন্তু বিরাট জোশ আদমি।

রাহুল তা একেবারে অগ্রাহ্য করে আবার তার কথার লাগাম টানলো,

-এবার কিছু দুর্দান্ত কবিতা শোনা যাক। কবিতা আমাদের এক বোধে নিয়ে আসবে আশা করি। প্রথম কবিতা পড়বে আমার বন্ধু ওমর।

দেখতে দেখতে আলোগুলো সব নিভে গেল। হারিকেনের আলোর চেয়েও মৃদু কিছু স্পট লাইট জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। রাহুলের তৎপরতা দেখে এবার সত্যি মুগ্ধ বোধ করলাম। আমি জানালার পাশের একটি চেয়ারে এসে বসলাম। প্রকট আলো ণা থাকায় রাতের খুব সুন্দর একটা স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে। অসম্ভব সুন্দর আর পুরুষালী কণ্ঠে শুরু হলো আবৃত্তি।

নগ্ন নির্জন হাত

আবার আকাশে অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছেঃ

আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মত এই অন্ধকার।



যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে

অথচ যার মুখ আমি কোনদিন দেখিনি,

সেই নারীর মত

ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়ে উঠেছে।

মনে হয় কোন বিলুপ্ত নগরীর কথা

সেই নগরীর এক ধুসর প্রাসাদের রূপ জাগে হৃদয়ে।

ভারত-সমুদ্রের তীরে

কিংবা ভূমধ্যসাগরের কিনারে

অথবা টায়ার সিন্ধুর পারে

আজ নেই,কোন এক নগরী ছিল একদিন…………

মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলাম সবাই। হাল্কা পরিবেশটা হঠাৎ অন্ধকারের মতোই ঘন হয়ে উঠেছে। বহুদিন আগে কাব্য চর্চা ছেড়ে দেয়া কিছু মানুষের বুকে নস্টালজিয়ার তোলপাড় ঝড় থেকে স্লাইকোন। চলতে থাকলো আবৃত্তি। আমার চশমার গ্লাসে জানালার বাইরের শহরের জ্বলজ্বলে প্রতিচ্ছবি। আকাশে চাঁদের যুবতী শরীর। কবিতার উপুর্যপরি আঘাত।সব মিলিয়ে এক একজন যেন সেই পুরনো মানুষ হয়ে গেলাম।

রাত বাড়তে থাকল, আমি ছাড়া সবার হাত হার্ড ড্রিংকসএ পড়তে লাগল এবার। অনেকেই একটু বেসামাল। অর্ধ রাত পর্যন্ত চলল কবিতা গান আর আড্ডা। এর মধ্যে কথা বলেছি খুব কম। একটার পর একটা সিগারেট টেনে গেছি। কিছুক্ষণের জন্য আবার ভর করেছে ডিজ্যাভু। এই ঘরে আমরা-একদল যুবক অনেক আগেই একসাথে হয়েছিলাম। তাদের ভারাক্রান্ত চেহারা ঠিক আগের কোন চলচ্ছবি। এই বোধটা আজকে অবশ্য একটুও ভালো লাগছে না। অপেক্ষা করতে লাগলাম দ্রুত এই বোধ থেকে বের হয়ে আসার।



রাত আরো বাড়ল। আস্তে আস্তে এক এক জনের ফোন কল আসতে থাকলো। একটু আগের তৈরি হওয়া অপার্থিব জগতটা বাস্তবতার আড়ালে ম্লান হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল ধীরে ধীরে। বর্তমানের চেহারাটা ঠিকঠাক এঁটে গেল সবার চেহারায়,বিদায় নিল একে একে। সবাইকে বিদায় দিয়ে রাহুল এসে আমাকে বলল,

-এত রাতে আমি আর যাব না ভাইয়া। তুমি ঘুমিয়ে পড়।

আমি মাথা নেড়ে শোবার রুমে চলে এলাম। চোখ বুজে পরে রইলাম তবু ঘুম আসছে না। কিছুক্ষণ রাহুলের খুটখুট শুনতে পেলাম। তারপর আস্তে আস্তে সব নীরব হয়ে গেল। হয়ত রাহুল ঘুমিয়ে পড়েছে। হাল্কা এলকোহলেও ঘুমের আসক্তি নেই আমার চোখে! অতিমাত্রায় সিগারেটের কারণেই হয়ত এই অবস্থা। কিংবা কবিতার আবেশ। একটু আগের শোনা সুন্দর কিছু লাইন ,

“ঘুমে চোখ চায় না জড়াতে

বসন্তের রাতে

বিছানায় শুয়ে আছি

-এখন সে কত রাত।ওই দিকে শুনা যায় সমুদ্রের স্বর

আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর”

ঘুম আসছেই না। আমি মোবাইলটা হাতে নিলাম। হীরা কে ফোন করে রহস্য রহস্য খেলা যায়। সে অনেক রাত জাগে। কিন্তু অপারেটর মেয়েটি হীরার ব্যস্ততা জানালো। খুব কৌতুক বোধ হলো। “আকাশে পাখিরা কথা কয় পরস্পর।

ক্লান্তিহীন এপাশ ওপাশের পরও ঘুম আসছে না। যা ভাবছিলাম তাই হলো, কণ্ঠটা আজ বেশ স্পষ্ট এবং জোরালো ।

-শান্ত । বাইরে এসো।শান্তনু বাইরে এসো ।

হৃদপিণ্ডের ধকধক দ্বিগুণ হল। সেই রিনরিনে কণ্ঠস্বর।

-বাইরে এসো শান্ত।এসো শান্ত!তোমার ঘুম পাচ্ছে না শান্ত।

নিজেকে সামলাতে চাইলাম। এটা অবশ্যই হ্যালুসিনেশান। বালিশে কান চেপে ধরলাম। তবু একঘেয়ে ভাবে কণ্ঠটা চিৎকার করে যাচ্ছে

-বাইরে এসো শান্তনু।বাইরে এসো শান্তনু

কখন যে যন্ত্রচালিতের মত দরজার হাতলে হাত রেখেছি চলে এসেছি বারান্দায় নিজেই জানিনা। শহরটা নিভে গেছে। নিকষ কালো আধার চারপাশে। কণ্ঠটা যখন ঠিক কানের পেছনে ফিসফিস করে উঠল,

-শান্তনু! শান্তনু!

অন্ধকার বারান্দায় অস্থির কণ্ঠটার সাথে নিজেকে আবিষ্কার করেই প্রচণ্ড প্রচণ্ড ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠলাম।

৪।

“জীবনে জেস্ট পাচ্ছেন না? মনস্তাত্ত্বিক দেখাতে দেখাতে ক্লান্ত? আজই চলে আসুন। আসুন সম্ভাবনার দরজাটা আর একবার খুলি”। -সুশীল গুপ্ত।

১৩ এ শংকর।ধানমন্ডি।

নামটা কেমন চেনা চেনা লাগছে।অবশ্য চেনা চেনা লাগাই আমার সমস্যা। লিফলেট টা আমাকে দিয়ে গেছে আমার কর্মচারী মিঃ জাহিদ। যাব ভাবছি। আমার সমস্যাটাতো তো বেড়েই চলছে। ব্যাপারটা মনে হতেই আমার অস্থির লাগতে লাগল।বারান্দায় সিগারেটে আগুন দিতেই পিওন এসে বলল,

-স্যার আপনার কাছে একজন ভদ্রলোক এসেছেন।

-ঠিক আছে বসতে বল আমি আসছি।

কারো সাথে দেখা করার কোন তাড়া বোধ হয় না। আমি সময় নিয়ে সিগারেট টা শেষ করলাম। কিছুই বুঝতে পারছি না এই ধরনের হ্যালুসিনেশান আমার হচ্ছে কেন? আর এত ঘন ঘন ডিজ্যাভু!আবার সাইক্রিয়াটিস্ট ।ডিজ্যাভু নিয়ে দিন কাটানো যায়।কিন্তু সাথে হ্যালুসিনেশান হলে তো কথাই নেই।

ঘরের ভেতরের লোকটা তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে গলা খাকড়ি দিল। লোকটি দাঁড়িয়ে আছে দেখেও বসতে বলতে ইচ্ছে হলো না।বিরক্তি চেপে বললাম,

-জী বলুন।

আমার আচরণে লোকটি নিজের মুখের বিস্ময় গোপন করতে পারল না।আমতা আমতা করে বলল,

মানে আমি উর্মির দুলাভাই।

-উর্মি কে?

-মানে আপনি গত সপ্তাহে একটা মেয়ে দেখেছিলেন না? আমি তার দুলা ভাই।

-ও আচ্ছা বসুন। অস্বস্তি কাটাতে প্রশ্ন করলাম,

-চা না কফি?

-সরি আমি লাঞ্চের পর কিছু খাই না। আমার অফিস কাছেই। আপনাকে আসলে বিরক্ত করতে হলো একটা কারণে।

-জ্বি বলুন।

-আপনার আপত্তি না থাকলে আমার কিছু প্রশ্ন ছিল।

-কাল সন্ধ্যায় আমাদের বাড়িতে অপরিচিত কিছু লোক আসে। তারা আমাদের শুভাকাংখী হিসাবে নিজের পরিচয় দেয় আর বলে

-কি?

-যে আপনি নাকি বিদেশে বিয়ে করেছিলেন একটা। আপনার নাকি জমজ সন্তান ও আছে। তারা সিঙ্গাপুর তাদের মায়ের সাথে থাকে।

-হা হা!

আমার উন্মাদের মতো হাসি পেল।হাসি না চেপেই বললাম,

-ও বুঝেছি। হা হা! তাহলে ঘটনা সত্য? শুনুন কিছুদিন আগে আমার বাবা আমার বিয়ে প্রায় ঠিক করে ফেলেছিলেন।

-তারপর।

-তারপর সেখানে কিছুদিন পর পাত্রী পক্ষের থেকে জানানো হয় যে তারা রাজী না। আমার নাকি সিঙ্গাপুরে বউ আছে।আমার বাবা হাজার চেষ্টা করেও তাদের বিশ্বাস করাতে পারেন নি।

-আচ্ছা। আমরা কিন্তু চাচ্ছি বিয়েটা হোক। আমাদের রিকোয়ারমেন্টস এ আপনি খুব পছন্দসই একজন। তাই আমরাও চাচ্ছি না বিয়েটা খামোকা ভেঙ্গে যাক। এখন আপনি যে ওখানে বিয়ে করেন নি, এই সপক্ষে যদি কোন প্রমাণ দেখাতে পারেন …

-ভাই সন্দেহের সাথে বিনয় যোগ করবেন না। আমি কোন প্রমাণ দিতে পারবো না। বিয়ে করেছি এই মর্মে প্রমাণ রেডি করা যায় কিন্তু করি নি এটার কোন প্রমাণ দেয়া যায় না।

লোকটা যেন ঢোক গেলার মত উত্তরটা গিলল।

-আর একটা প্রশ্ন ছিল।

-বলুন।

- আচ্ছা শুনেছি ওখানে আপনার খুব সেটেলড বিজনেস ছিল।হঠাৎ সব ছেড়ে চলে এলেন কেন?ভাই সত্যটা বললে উপকার হয়। সত্য আগে পরে জানাজানি হবেই আগে থেকে জানা থাকলেই দু পক্ষের জন্য ভালো।

-আমি আপনাকে সত্যটাই বলব কেন জানেন ?

-কেন ?

-আমি সিঙ্গাপুরে ছিলাম প্রায় বারো বছর। অনেকটা টাকার উপর রাগ করেই। টাকার পেছনে আমি আলোর বেগে ছুটে চলেছি। পাঁচবছরে আমি ওখানে প্রায় চারটা শাখার ওয়ান স্টপ মলের মালিক হই। আমার ব্যাবসায়িক পজিশন ও আনুষঙ্গিক সব কিছু বৈধ ছিল। তবে এর জন্য আমাকে প্রচুর দুর্নীতি করতে হয়েছে। প্রতিদিন হাজার লোকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে মালের হেরফের করেতে হয়েছে।ঘুষ দিতে হয়েছে। কথায় কথায় স্বল্প-জীবী মানুষের চাকুরী খেতে হয়েছে। সব চেয়ে বেশি যেটা করতে হয়েছে সেটা হলো মিথ্যা বলা।একজন দোকানী সে আদার ব্যাপারী হোক আর জাহাজের,তার প্রধান কাজ হল মিথ্যা বলা। দমে দমে মিথ্যাতো আপনি নামদার। এর ফলাফল কি হলো জানেন?

-কি?

-আমার ভেতর প্রচণ্ড অপরাধ বোধ তৈরী হলো। তা থেকে বিষণ্ণতা। এবং আমার একরকম মানসিক ডিজঅর্ডার ও ডিপ্রেশন বেশ ভালো ভেবেই দেখা দিল। সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে রেগুলার যেতে লাগলাম। কিছুতেই তেমন উন্নতি হলো না। কিছুদিন যেতেই আগের মত। তারপর একদিন মনে হলো আসলে এত টাকার কোন কাজ নেই জীবনে। সব চুকিয়ে দেশে চলে এলাম।এখন দুর্নীতি টুকটাক যাই করি না কেন মিথ্যা আর বলতে পারি না।

-ভাই আপনার মানসিক সমস্যাটা কি রকম? ভয়াবহ কিছু।

-বুঝতে পারছি না এখনো।

-ঠিক আছে আজ আসি ।

-ঠিক আছে।

আমি লোকটার দিকে তাকিয়ে আবার হাসতে লাগলাম। নিজের মুখভঙ্গিতে কৌতুকের পাশাপাশি কেমন জানি হিংস্রতা নিজেই টের পেলাম। আয়নায় চেহারাটা দেখার জন্য বোধ করলাম একটা অস্থির তাড়না।



৫।

সুশীল গুপ্তর চেম্বারে উপচে পড়া ভিড়। নেমপ্লেটে নামের নিচে কোন বিশেষায়ণ লেখা নেই। লোকটা ভণ্ড কিনা কে বলবে ! একজন কর্মচারীর কথায় এমন একজনের কাছে হুট করে কেন চলে এলাম এখন বুঝতে পারছি না। এক্ষেত্রে হয়ত পরিচিত লাগতে থাকা নামটা আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে।

বেশ কিছুক্ষণ পর আমার ডাক পরল। ঢুকতেই সুশীল গুপ্ত নামক বেঁটেখাটো লোকটা, তেল চকচকে টাক নিয়ে একগাল হাসলেন।

-আপনি কেমন আছেন?

লোকটার এমন সুহৃদ সম্ভাষণে আমি চমকালাম না । মনোরোগের চিকিৎসা কিভাবে শুরু করতে হয় সে বিষয়ে আমার বেশ ভালো ধারনা আছে। আমি তাকে হাসিটা ফেরত দিয়ে বললাম,

-ভালো থাকলে আপনার কাছে আসা কেন ?

-বাহ!বেশ স্মার্ট!

-হুম।একটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে। মানে আপনি আসলে কি ?

-আমি একজন এডভাইজার। প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী জেনে কাজ নেই। আপনি আপনার যেকোনো সমস্যার কথা বলতে পারেন।

-হুম।

-এবার বলুন আপনার একচুয়াল সমস্যাটা কোথায়। একেবারে মেইন পয়েন্টটা বলবেন।

-আমার ইদানিং হ্যালুসিনেশান হচ্ছে।

-কিভাবে বুঝলেন।

-না বুঝার কি আছে?

-আচ্ছা। মানে আপনি একজন নিওরোসিস। কয়দিন হয়?

-এক দু সপ্তাহ। পাশাপাশি আমার আর একটা সমস্যা আছে।

-কি?

-আমার নতুন কোথাও গেলে প্রায়ই একটা ফিলিংস হয় যে এটা আগেই ঘটেছে।

-আচ্ছা বুঝতে পেরেছি ডিজ্যাভু তো। এটা কয় দিন ধরে?

-এটা প্রায় চার পাঁচ বছর আগে থেকে।

-আপনার কি এপিলেপ্সি আছে?

-না। তবে কিছুদিন আগে একবার খিচুনি হয়।

-আর হয় নি?

-না।

-তাহলে তো শুধু সিজার বলা যাচ্ছে। এপিলেপ্সিতে টার্ন নিতে নাও পারে। আপনার বংশের কারো এপিলেপ্সি ছিল?

-না।

খেয়াল করলাম সাইক্রিয়াটিস্টের মত লোকটা সমস্যা টুকে রাখছেন না।শুধু শুনে যাচ্ছ। লোকটা এবার প্রশ্ন করল না বিশ্বাস নিয়েই বলল,

-আপনি নিশ্চয়ই ব্যবসায়ী আর আনমেরেড।

ভদ্রলোকের সঠিক অনুমানেও আমি চমকালাম না। ছোট্ট করে বললাম,

-হুম।

-লিগ্যাল ব্যবসা? কি ধরনের ব্যবসা?

-ওয়ান স্টপ মলের বিজনেস।শখ বাজার।

-আই সী নাম শুনেছি। আপনার বাবা মা ভাই বোন তারাও নিসশ্চয়ই কাছাকাছি নেই?

আমি হাসলাম।

-না। আমি আপনাকে আমার সম্পর্কে এক কথায় বলি। আমার নাম সুব্রত সেন ডাক নাম শান্তনু, বয়স উনচল্লিশ। প্রায় বারো বছর সিঙ্গাপুরে থাকার পর সব কিছু গুছিয়ে কয়েক মাস হয় বাংলাদেশে চলে এসেছি। দেশে আসার কিছুদিন পরই আমার বাবা মারা গেছেন আর মাকে হারিয়েছে আরো পাঁচ বছর আগে। বাবা মারা যাওয়ার পর পর বড়দার সাথে কিছু ব্যাপার নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তারপর আমি শ্যামলীর পৈত্রিক বাড়ী ছেড়ে উঠে এসেছি উত্তরার একটি এপার্টমেন্টে। বিয়ের ব্যাপারে মত অমত বর্তমানে আর কিছুই নেই।অবশ্য বিয়ে হচ্ছে না।হা হা।

-মামা , চাচা আর অন্য আত্মীয়রা?

-মামা খালাদের দিকে যাতায়াত আছে আপাতত। আগে সত্য মিথ্যা মিলিয়ে বলতাম সবাই ভাল জানতো।এখন সত্য বলা শুরু করেছি কিন্তু মানুষ ভুল বুঝছে। কাছের মানুষরা দূরে সরে যাচ্ছে।

-সব সময় সত্য বলতে হবে এমন কেন?

-আমার ভালো লাগে।

-একটা ফিলোসফি জাতীয় লাইন হলো, সত্য মিথ্যা বলে কিছু নেই সবি আংশিক সত্য আর আংশিক মিথ্যা। সত্য মিথ্যা নিয়ে মাথা না ঘামানোই ভালো। আমি আপনাকে যে এডভাইস গুলো দিব সেটা মানতে হবে।

-বলুন।

-মানুষের মন খুব অদ্ভুত একটা জিনিস। মনকে যতো প্রাধান্য দিবেন সে আপনাকে তত পেয়ে বসবে। মনকে কনট্রোল করার একটাই উপায় আর সেটা হলো তাকে আকাশে উড়তে দেয়া কিন্তু সাথে তার সুতোটা আপনার হাতেই রাখা । আবার ঠিক উল্টোটাও ঘটে আপনি মনকে যদি একেবারেই প্রাধান্য না দেন তাহলেও একি ব্যাপার ঘটে। আমার ধারনা আপনার বেলায় দ্বিতীয়টাই ঠিক।

-হুম।

-কিছু এলিমেন্ট আছে যা মনকে স্বাভাবিক আর সচল রাখে তা হলো রাগ, অনুরাগ, ভালোবাসা আর কষ্ট। কষ্ট এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।সবচেয়ে হতভাগ্য তারা যাদের তাও তেমন নেই। আমার ধারণা আপনার জীবনে একটা বড় অধ্যায় শূন্য বোধে কেটেছে।

-হ্যাঁ ঠিক।

-আমি ডঃ নই আর মেডিসিন সম্পর্কে ধারনা কিছুই নেই।আর মনোরোগ ঔষধে সারে এমন বিশ্বাস রাখি না। আমি আপনাকে কিছু ফ্রেশ সাজেশান দিব।যদি মানতে পারেন তাহলে কষ্ট কিছুটা কমবে।

এক,আপনি যদি এই মুহূর্তে একটা বিয়ে করতে পারেন কিংবা যেকোনো ধরনের প্রেম তা নৈতিক বা অনৈতিক তাহলে আপনার চিকিৎসা অটোমেটিক হাফ ডান।

দুই,আপনি যদি আপনার ব্যবসা আপাতত এক্সপান্ড না করেন তাহলেও ভালো। মনের শান্তির আর একটা বড় উপায় হলো দান এই জন্যই আগের যুগের অনেক ধনশালী বলশালী রাজা হঠাৎ করে সব দান করে ছেড়েছুড়ে পথে নেমে পড়তেন। পেটে ভাত জুটানোর চিন্তা মনের চিন্তাকে আচ্ছন্ন আর বোধহীন করে রাখে।

-আচ্ছা।আমি অলরেডি আমার পৈত্রিক বাড়ির অংশী স্বেচ্ছায় আমার বড় ভাইকে লিখে দিয়েছি। আমার হ্যালুসিনেশানটা কিন্তু এর পর হয়েছে।

-আই সি।কিন্তু তার পরও আপনার অগাধ সম্পত্তি।

-হুম।

- আপনি বুঝতে পারছেন যে আপনার হ্যালুশিনেসান হচ্ছে। তাহলে আপনার চিন্তাশক্তি এখনো সচল। আপনার এই ইনসাইট কাজে লাগিয়ে আপনি মেডিটেশান করতে পারেন। আপনি সৌভাগ্যবান ।আপনার জন্য সম্ভাবনার দ্বার এখনো উন্মুক্ত।এর কিছু কারিকুলাম আছে। আপনি যদি আগ্রহী হন তাহলে আমি আপনাকে সেশান দিব। আপনি বাইরে এর চার্জ জেনে নিতে পারেন।

এতক্ষণ লোকটার সোজাসাপটা কথা শুনতে ভালো লাগছিল বেশ। দোকানী মুখোশটা একরকম হুট করে খুলে যাবে এটা আশা করিনি। মেডিটেশান একটা পন্থা তবে এটা এখন একটা উঠতি ব্যবসা। হায় রে ব্যবসা !আত্মিক শক্তি নামক বিষয়ের চর্চাও ও এখন একটা বাজার। আমি উঠে দাঁড়ালাম। সুশীল গুপ্তের উপদেশ অমান্য করে সত্যটাই বললাম,

-মেডিটেশন কারিকুলাম আছে জানলে আমি এখানে আসতাম না। ঠিক আছে ধন্যবাদ। আসি।

লোকটা ঠিক আগের মত হাসি দিল। রুম থেকে বেরোতেই পরিচিত লাগতে থাকলো সব কিছু। চেম্বার ভর্তি সমস্যাক্রাত মানুষ।মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হতে লাগল আমরা যেন সবাই সহোদর। একি সমস্যার উদরে আমাদের অবস্থান।

আমার যাওয়া উচিত। কিন্তু পায়ে যেন একটা অদৃশ্য শেকল এঁটে গেছে । ইচ্ছে করছে এখান থেকে এক চুল না নড়ি। নাহ! আমার তো দাঁড়িয়ে থাকার কথা না । আই হ্যাভ নো টাইম টু স্ট্যান্ড আন্ড স্টেয়ার।



৬।

আলোর অস্তিত্ব বুঝতে চোখ খুলতে হয় না। যেমন চোখ বুজেই বুঝতে পারছি এখনো বেলা উঠেনি। সারা রাত নির্ঘুম কেটে ভোরের দিকে যা একটু বা চোখ লাগে আজ তাও হলো না। একঘেয়ে কর্কশ সুরে ল্যান ফোনটার জন্য। লাইনটা খুলে রাখা হয় নি বলে এখন বেশ আফসোস হচ্ছে।

-হ্যালো।শান্তনু!

-ও ছোট মাসী।

-হ্যা। তুই কি শুরু করেছিস?

-মানে?

-এতকিছু বলে বড়দি আর রাহুল তোর বিয়েটা ঠিক করল তুই নাকি তাদের বলেছিস তুই পাগল।

-আমি এরকম কিছু বলিনি। আর বিয়েটা এমনিতেও ভেঙ্গে যেত।

-রাম ছাগল তোকে কে বলেছে!তুই তাদের ভুল ভাঙ্গাতি।তোর দাদারা তো চায়ই না তোর বিয়ে হোক। ওয়ারিশ হোক। তুই এটা বুঝিস না ? তুই চুপ করে তোর বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া দেখছিস কেন ? আমি বাংলাদেশে থাকলে দেখিয়ে দিতাম ওদের। আর তুই যদি বিয়ে করতে নাই চাস আমাদের সরাসরি বলে দে।

-আমি চাই না কে বলল ?

-কে আর বলবে ? কিছু বুঝি না ভেবেছিস। বুড়ো হয়ে যাচ্ছিস আর কোন জনমের কোন কাহিনী মনে রেখে বসে আছিস।সে কি বসে আছে দিব্যি সংসার করে…………।

দিনের শুরুতেই এসব জটিল কথায় মন বসছে না। আমি ফোনের স্পিকারটা কান থেকে নামিয়ে ফোনের পাশে রাখলাম। জানালার খুলে বাইরে তাকালাম। শীতের সকাল এখনো সূর্যের তেজ জাগেনি। এখনো খানিকটা আধার। কেন জানি খুব ভালো লাগছে।

ঘড়িতে ছয়টা বেজে ত্রিশ মিনিট। শীত পোষাকে দ্রুত তৈরী হয়ে নিচে নেমে এলাম। রাস্তায় নেমে ভালো লাগা আরো বেড়ে গেল । আমি লেকের উদ্দেশ্যে হাটতে লাগলাম।

এত সকালেও রাস্তার পাশের পিঠার দোকান বসে গেছে।পাশে দাঁড়িয়ে একটা বাচ্চা ছেলে এই শীতেও হাল্কা পোষাকে, আগ্রহ নিয়ে পিঠা বানানো দেখছে। এত বিলাসবহুল এলাকায় দরিদ্রতা নিয়ে খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে ঠিক বেমানান লাগে আমার কাছে। মনে হয় দুটো বিপরীত রঙ একসাথে বসানো হয়েছে । মিশছে না । মনে মনে রঙ দুটোর মিলনাত্মক জায়গাটা চোখে ভাসলো । আরে এটাতো মধ্যবিত্ত!সে যাক।আমি কিছুক্ষণ ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইলাম তারপর চোখ ফেরালাম। চট করে আবার তাকালাম। হ্যাঁ সেই তো খুব পুরাতন। খুব চেনা। এই ঘটনা, ছেলেটা ,এই আগুন এবং এই সকাল। আমি আনমনে আগুনের কাছে গেলাম। সম্মোহিতের মত চেয়ে রইলাম বেশ কিছুক্ষণ। তারপর ছেলেটার দিকে। ছেলেটাও আমার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে হেসে বললাম,

-কেমন আছ তুমি?

-আফনেরে কমু কে?চিন পরিচিত ছাড়া মায় কতা কইতে না করছে।

-আমি তো তোমাক অনেক আগে থেকেই চিনি।

আমার কথায় ছেলেটা কিছুক্ষণ তাকিয়ে উলটোদিকে হাটা দিল। পিঠাওয়ালী মধ্যবয়সী মহিলা শাড়ির আচল টেনে আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

-পিডা কিনবেন?

-না।

নাহ! আই হ্যাভ নো টাইম টু স্ট্যান্ড আন্ড স্টেয়ার। আমি হাটতে লাগলাম লেক বরাবর। লেকের কাছে এসে মনে হল শীত অনুভূত হলো । পরনের পোশাকে মানছে না। আমি শরীর গরম করতে দ্রুত চলতে লাগলাম। এখনো লেকের ধারের চারপাশ কুয়াশায় ঢাকা। তিন চার হাত দূরের জিনিস স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না এমন। জোরে জোরে হাটায় পরনের ট্রাওজারে ঘষা লেগে খস খস শব্দ হচ্ছে। তবু তা ছাপিয়ে আমার কানে এল,

শান্তনু! শান্ত।

আমি থেমে গিয়ে শব্দের উৎসকে খুঁজতে লাগলাম। বেশ অবাক হয়ে দেখলাম উর্মি নামের মেয়েটি যার সাথে তার বিয়ের কথা হচ্ছিল সে আমার কাছ থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে। সে পেছন দিকে মুখ ঘুরিয়ে আমাকে দেখছে আর মিটিমিটি হাসছে। উর্মির বাসাতো শুনেছি শান্তিনগর, তাহলে এত সকালে সে উত্তরা কি করছে ? আর এভাবে হাসছেই বা কেন? বুকে হাল্কা চাপ দিল। শব্দের আত্মা কি তাহলে এবার শরীর নিয়ে নিয়েছে! বুঝে উঠতেই আর দাঁড়ালাম না । আমি চলা শুরু করলাম । আমার সাথে সামনে চলা মানবীটিও। মাঝে মাঝে সে ফিরে তাকাচ্ছে পেছনে। তার হাস্যরত মুখ কুয়াশার মতোই মায়াবী।

(সমাপ্ত)

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ১:২৯

শ্যামল জাহির বলেছেন: বিয়ের পর আপনার সাথে দেখা করব। এখন দেখলে প্রেমে পড়ে যাবেন-তো তাই। তখন আবার ঝামেলা।
-হা হা!
-হাসছেন কেন ?
-তুমি কিন্তু নিজেই কচ্ছপের মতো একজন। অন্যকে উল্টো পালট করতে আসো কেন ? তোমাকে যদি উলটে দেই তুমি কিন্তু নড়তে পারবে না । হা হা ! ;)
-------------------------------------------
পড়ছি, ভাল লাগছে কিন্তু গল্পের শেষটা... :( :((

১৮ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ১২:১৪

রাবেয়া রব্বানি বলেছেন: ধন্যবাদ ।http://cdn1.somewhereinblog.net/smileys/emot-slices_15.gif

২| ১৫ ই আগস্ট, ২০১৩ সকাল ১১:৩৮

অপর্ণা মম্ময় বলেছেন: অন্যের পোস্টে কমেন্ট করতে না পারার দুঃখ আশা করি অচিরেই তোর শেষ হবে। জেনারেল হবার আগ পর্যন্ত নিজের লেখা পোষ্ট দিতে থাক। গল্প নিয়ে পরে কমেন্ট করছি। তোর লেখাটা শেয়ার দিলাম ফেবুতে

১৮ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ১২:১৬

রাবেয়া রব্বানি বলেছেন: ওকে। গল্পে অনেক টাঈপো ভুল আছে ঠিক করতে হবে। এখনো ওয়াচিং এ আছি,:(

৩| ১৫ ই আগস্ট, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:১০

জুলিয়ান সিদ্দিকী বলেছেন: বুজি, ট্যাগে গল্প অথবা উপন্যাস কেন? আমি তো মনে করি উপন্যাসই। এতে ছোটগল্পের বা বড় গল্পের আমেজের চাইতে উপন্যাসের আমেজটাই খুব বেশি করে পেয়েছি। ছোট আকারের উপন্যাসের নাম হয় উপন্যাসিকা বা নভেলা। আমার কাছে এটিকে নভেলা ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না। সেই সঙ্গে আপনার এই লেখাই প্রমাণ করে যে, আপনি ইচ্ছে করলেই উপন্যাস লিখে ফেলতে পারবেন।

আগাম অভিনন্দন জানিয়ে রাখলাম।

১৮ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ১২:১৭

রাবেয়া রব্বানি বলেছেন: উপন্যাসই করে দিমু এইটা।উপন্যাস লেখা দরকার কিন্তু মাথায় আসতাছেনা কিছু।কি করি :(

৪| ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১০:৩৬

সপন সআথই বলেছেন: + valo laga janai

২৮ শে অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১০:৩৮

রাবেয়া রব্বানি বলেছেন: ধন্যবাদ সপন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.