নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পরিচয় বলার মত কিছু এখনো করতে পারি নি। তাই ঘরটা ফাঁকাই। পরিচয় অর্জন করতে পারলে আমি যোগ করে দিব।

রক্তিম দিগন্ত

Life is all about a thrill.

রক্তিম দিগন্ত › বিস্তারিত পোস্টঃ

পূর্ণদৈর্ঘ্য আজগুবি কাহিনী

০১ লা নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১:২০

প্রচন্ড রাগ নিয়ে নিজের রুমে প্রবেশ করল রুমু! রাগে কিছু ভাঙতে ইচ্ছে করছিল তার! টেবিলের উপর দুটো গ্লাস পেয়ে তা ই ভেঙে রাগ কিছুটা কমানোর চেষ্টা করলো! কিন্তু রাগ কমছে না!
তার বাবার প্রচন্ড ক্ষেপে আছে সে! তাকে না বলেই তার বাবা তার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে! ছেলে দেখতে কেমন বা হাত-পা-নাক-মুখ এইসব ঠিকঠাক, এসব কিছু না জেনেই তাকে ঐ ছেলেকে বিয়ে করতে হবে! বাবার আদেশ শিরোধার্য! বাবার মুখের উপর সরাসরি নাও করতে পারছে না! বাবার সব আদেশ সে এতদিন বিনাবাক্য ব্যয়ে মেনে নিলেও এবার কোন ভাবেই মানতে পারছে না!
বিয়ে তো আর ছেলে খেলা নয় যে, বললেই যাকে খুশি তাকে করে ফেলবে! সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না, বাবা তাকে না বলেই কিভাবে তার বিয়ে ঠিক করে ফেলতে পারল!

রাগে গজ গজ করছে! হাতের কাচের জিনিসপত্র যা পেয়েছে সবই ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে! বাবার উপরের সব রাগ ঢালছে নিরীহ কাঁচের জিনিসগুলোর উপর দিয়ে! ঝনঝন করে একটা একটা আসবাব ভাঙার শব্দ হচ্ছে!
রুমুর বাবা বাসায় নেই, তাই সে ইচ্ছামত ঝনঝন করে সব ভাঙছে! তার বাবা বাসায় থাকলেও অবশ্য এই ঘটনার ব্যতিক্রম হত না! মাথায় রাগ চড়ে গেছে তার!

অনেকক্ষন ধরেই কাচ ভাঙার শব্দ শুনছিল রুমুর মা! মেয়ে যে কথাটা শুনলে রেগে যাবে সেটা তিনি রুমুর বাবাকে আগেই বলেছিলেন! কিন্তু এতটা রেগে যাবে সেটা তিনি ভাবতেও পারেন নি! মনে করেছিলেন, একটা দুইটা গ্লাস ভেঙে হয়ত ঠান্ডা হয়ে যাবে! কিন্তু রুমু অনবরত ভেঙেই চলেছে!
অগ্যতা, রুমুর মা কে উঠতেই হল! রুমুর রুমের দরজাটা চাপানো, কিন্তু আটকানো না! ঠেলা দিয়ে দরজাটা খুলতেই চক্ষু জোড়া কপালে উঠল উনার! ঘরের মেঝের পুরোটাতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাঁচ আর কাঁচ! রুমুর ঘরে কাঁচের যত জিনিসপত্র ছিল সবই ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে! বাদ যায় নি তার শখের ফুলদানী গুলোও!

‘মা! কি হল তোর? এমন পাগলামী করছিস কেন?’ অতি সন্তর্পনে হেটে হেটে রুমুর বিছানার কাছে পৌছলেন তিনি! গোটা মেঝেতেই কাঁচ ছড়িয়ে আছে! একটু অসতর্ক হলেই পায়ে গিঁথে যাবে!
রুমু মায়ের কথার কোন জবাব দিল না! রাগে ফুঁসছে! ভাঙার মত আর কিছুই তার হাতের কাছে নেই! মা কে আরো কিছু ভাঙার মত জিনিসপত্র চাইবে কি না চিন্তা করছে!
রুমুকে কোন কথা বলতে না দেখে রুমুর মা আবার জিজ্ঞেস করলেন একই কথাটা! এইবারও রুমু চুপ করে আছে! কোন কথাই বলছে না!

উনি বুঝতে পারছেন মেয়ে হঠাৎ করে এমন করার কারনটা! মেয়েকে শান্ত করার জন্য কি বলবেন বুঝতে পারছেন না!
‘মা রে! মন খারাপ করে, রাগারাগি করে কি লাভ আছে? মেয়েদের জীবনটাই তো এমন! একটা সময় তাকে মা-বাবা ছেড়ে যেতেই হয়!’
‘আমি ছেড়ে যাওয়ার জন্য রাগ করছি না!’ শান্ত কন্ঠে বলল রুমু!
‘তাহলে কেন রাগ করছিস?’
‘বাবার উপর রাগ লাগছে! বিয়ে দিবে ভাল কথা, ছেলে ভাল – সবই মেনে নিলাম! কিন্তু সম্পূর্ন একটা অচেনা মানুষকে কিভাবে বিয়ে করব? বাবা এসব বুঝে না?’
‘বুঝবে না কেন? অবশ্যই বুঝে!’
‘হুমম বুঝে! কচু বুঝে!’ রাগ করে বলল রুমু!

রুমুর মা মেয়ের কথা শুনে হাসলেন! মেয়ের বয়েসী থাকতে তিনিও কথায় কথায় ‘কচু’ শব্দটা বলতেন! রুমুও উনার মত করেই বলল! তবে বাবার উপরে রেগে এইধরনের কথা বলায় উনি একটু রাগও করলেন!
‘বাবার সম্পর্কে কেউ এইভাবে বলে?’
‘তাহলে কিভাবে বলব?’
‘তোর বিয়ে দেওয়াটা তো তোর বাবার দায়িত্ব! দায়িত্ব তো পালন করবেনই উনি!’
‘এটা কেমন দায়িত্ব যে, নিজের মেয়েকে সম্পূর্ন অচেনা ছেলের সাথে তুলে দিবে?’

রুমুর মা কোন কথা খুঁজে পেলেন না! কি বলবেন? রুমু তো ঠিকই বলেছে! রুমুর আবার এখন যেন কথা বলার নেশায় পেয়ে বসল! কি বলছে কিছুই বুঝে বলছে না! রাগে অন্ধ হয়ে বলেই যাচ্ছে!
‘বাবা তো খালি সব সময়ই দায়িত্ব নিয়েই থাকে! সেই ছোট থেকেই দেখছি শুধু দায়িত্ব দায়িত্ব! আমি ভেবে পাই না, তুমি এতগুলো বছর যাবৎ এই দায়িত্ব দায়িত্ব শুনে কিভাবে পড়ে আছো!’
‘রুমু!’ বেশ জোরেই বলে উঠলেন রুমুর মা! রেগে গিয়েছেন রুমুর কথা শুনে! ‘অনেক কথা বলেছিস! এখন ঘুমা! আমি ঘর পরিষ্কার করা ব্যবস্থা করছি!’

মাকে রেগে যেতে দেখে ভয় পেয়ে গেল রুমু! নিজের কথার ভুলটা বুঝতে পারল! কিন্তু বলেই যখন ফেলেছে, সেটাকে আর কিভাবে ফিরিয়ে নিবে?
‘স্যরি আম্মু! রাগের মাথায় বলে ফেলেছি!’
‘হুমম!’
‘আম্মু! তোমাকেও কি নানু ভাই এইভাবেই বিয়ে দিয়েছিল?’
‘তোর নানু দিতে চেয়েছিল, কিন্তু একটা পাগলের জন্য তা আর সম্ভব হয় নি!’
‘পাগল? আসলেই পাগল?’
‘হ্যা! আসলেই পাগল!’
‘কি পাগলামী করেছিল?’
‘অনেক পাগলামী!’
‘বল না? একটু শুনি!’
‘অনেক বড় গল্প তো সেটা! তোকে তো পুরোটা বলাও যাবে না!’
‘অল্প একটুই বল?’
‘আচ্ছা শোন তাহলে!’

রুমু যে এতক্ষন রেগে ছিল তা মনে হয় সে ভুলেই গেছে! মায়ের রাগ ভাঙাতে গিয়ে নিজের রাগও ভেঙে গেছে! আর মায়ের কাছ থেকে গল্প শুনার কৌতুহলে এখন তার বিয়ের কথাও ভুলে গেছে!
রুমুর মা মেয়ের আকস্মিক রাগ ভাঙায় খুশি হলেন! যাক অন্তত মেয়ের মাথাটা ঠান্ডা করা গেছে! কিন্তু মেয়ে যে বায়না ধরে রয়েছে গল্প শুনবে বলে! গল্প বলায় উনার কোন সমস্যা নেই, তবে মেয়েটা যে গল্পটা শুনতে চাচ্ছে তাতে একটু একটু লজ্জাও লাগছে উনার! নিজের গল্প তো! হাত নেড়ে সংকোচ উড়িয়ে দিয়ে গল্প বলা শুরু করলেন!

*

তখন আমি হনার্স সেকেন্ড ইয়ারে! ক্লাসে যাই-আসি, ক্লাস করি, দুই-একটা টিউশনি করি! টিউশনি করাতাম শখে! পড়াতে ভাল লাগত! কিন্তু পড়তে একদমই ভাল লাগত না!
সেই সময় আরেকটা কাজ করতে আমার খুব ভাল লাগত! লিখতে! যাই মাথায় আসত তাই লিখে ফেলতাম! লিখলে তা প্রকাশ করার অনেক সহজ মাধ্যম ছিল তখন! ফেসবুক ছিল সেই সহজ মাধ্যম গুলোর মধ্যে সবচাইতে সহজ মাধ্যম!
লিখতাম, ফেসবুকে দিতাম! অনেকে পড়ে ভাল লেগেছে বলত, অনেকে পড়ে খারাপ লেগেছে বলত! ভাল-খারাপ যাই বলুক, তারা যে পড়তো তাতেই মন খুশিতে ভরে উঠতো! এইভাবে লিখতে লিখতে অনেক ভাল ভাল লেখকদের সাথেই পরিচয় হল! তাদের সাথে আড্ডা দিতাম, মনটা সবসময় আনন্দে ভরে থাকত!

এইভাবেই চলছিল হঠাৎই এক পাগল ছেলে আমাকে ফলো করলো! আমি অবাক! কারন, ছেলেটা পাগল হোক আর যাই হোক সহজে কাউকে ফলো করার মত ছেলে না! আর আমার মত নস্যি এক লেখিকাকে তো না ই!
মেসেজ দিলাম, ‘ভাইয়া! কি মানে এর?’
পাগলটার জবাব, ‘কোনটার মানে?’
‘এই যে যা করলেন?’
‘ও! এইটার তো কোন মানে নেই!’
‘মানে না থাকলে করলেন কেন?’
‘এমনি মন চাইলো!’

আরো টুকটাক বেশ কিছু কথা বল ছেলেটার সাথে! সত্যি বলতে ঐসময়টায় আমার খারাপও লাগছিল না, ভালও লাগছিল না! খারাপ লাগছিল না, কারন ছেলেটা কেমন কেমন করে ভালো লাগার কথাই বলছিল! আর ভাল লাগছিল না, ছেলেটার মতলব কি হতে পারে ওটা ভেবে!

একদিন পর আবারো মেসেজে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার এমন করার কারন কি? কারো সাথে বাজি-টাজি ধরেছেন নাকি?’
‘না! বাজি ধরবো কেন? আমি তো আপনাকে পটানোর জন্য এমন করছি!’
‘সেইটাই তো কার সাথে বাজি ধরে পটাতে চাচ্ছেন?’
‘বাজি ধরে পটাতে যাবো কেন? এমনিতেই পটাতে পারি না?’
‘এমনিতে পটিয়ে কি করবেন?’
‘তা তো জানি না! আগে পটিয়ে নিই, তারপর বলব?’

খুব আশ্চর্য হচ্ছিলাম ছেলেটার কথায়! এমন ভাবে কেউ কথা বলে নাকি – ভেবেই পাচ্ছিলাম না! তবে ছেলেটার সাথে কথা বলতে ভালই লাগছিল! অনেকক্ষন মেসেজিং চলল ওইদিন আমাদের! ছেলেটা আমাকে পটাতে চাচ্ছে, কিন্তু পটানোর মত কোন কথাই বলছে না। স্বাভাবিকভাবেই কথা বলে যাচ্ছিল! এতে আরো অবাক হচ্ছিলাম! বুঝতে পারছিলাম না – এটাই কি তার পটানোর ধরন কি না!
তারপর দিন কেন জানি ছেলেটা খুব ক্ষমা-টমা চাইলো! বুঝতে পারছিলাম না কিছুই কি ঘটছে!
‘স্যরি! আসলে আপনার সাথে যা করছি তা ঠিক হচ্ছে না!’
‘কি করছেন?’
‘এই যে পটাতে চাচ্ছি!’
‘হ্যা! তা তো ঠিক হচ্ছেই না! কিন্তু স্যরি বলছেন কেন?’
‘ঠিক হচ্ছে না দেখেই বলছি! এতদিন আসলে মজা করেছি! মনে করবেন না কিছু আশা করি!’

এরপর আমারই খারাপ লাগল! মনে হচ্ছিল এরপর থেকে হয়তো ছেলেটার সাথে আর কথা বলা হবে না! আটকানো দরকার ছেলেটাকে! কি বলে আটকাবো?
‘ক্ষমা করলাম! মজা করেছেন বুঝতে পেরেছি! কিন্তু এখন এভাবে চলে যাচ্ছেন কেন?’
‘চলে যাচ্ছি মানে?’
‘না কিছু না মনে হল আর কি!’

এরপর আরো কিছুক্ষন কথা হল! অগোছালো কথাবার্তা! এর মাঝে হুট করেই ছেলেটাকে বলে বসলাম, ‘বন্ধু হতে পারি কি?’ আমি জানি না কথাটা কেন বলেছিলাম, হঠাৎ করেই বলে ফেললাম কথাটা! ছেলেটা এই কথা শুনে চমকিয়েছিল কি না বলতে পারব না, কিন্তু যথেষ্টই চমকে গিয়েছিলাম! আর এটাও জানি না যে, ছেলেটা বন্ধু হতে চাইবেও কি না! যদি না করে দেয়, তাহলে তো আমারই মন খারাপ হবে! এখন বলে যখন ফেলেছি ছেলেটির জবাবের আশায় বসে রইলাম!
ছেলেটি জবাব দিল, ‘বন্ধু? হ্যা তা তো হওয়াই যায়! আপনার সাথে বন্ধুত্ব করলে খারাপ হবে না!’
‘বন্ধুর মাঝখানে আপনি আপনি শব্দটা কেমন না? আপনি আমাকে আপনি আপনি করে বলবেন না!’
‘আপনি না বলে যা বলতে হবে, তা বলতে যে কিছু অস্বস্তি লাগছে?’
‘আপনাকে তুমি তুমি করেই বা কে বলতে বলেছে? তুই করে বলবেন!’
‘আচ্ছা! তুই করেই বলব! কিন্তু বন্ধুত্ব কি আমার একারই হয়েছে যে, শুধু আমাকেই তুই করে বলতে হবে? আপনার হয় নি!’
‘ইয়ে কি বলব? আচ্ছা, আমিও তোকে তুই ডাকব, তুইও আমাকে তুই ডাকবি! হয়েছে?’
কথাটা বলে নিজেই হেসে ফেললাম! ঐ ছেলেটাও হয়তো হাসছিল! কিন্তু তা তো আর জানি না আমি! মেসেজে তো আর বুঝা যায় না হাসছে কি না!

তারপর এই বন্ধুত্ব চলতে লাগল! আমি ছেলেটার প্রেমে পড়লাম! ছেলেটাকে আমি তখনো দেখি নি, জানিও না ছেলেটার সম্পর্কে! কি কারনে প্রেমে পড়লাম জানি না! ছেলেটার সাথে কথা বলতে ভাল লাগত! কথা বলতে চাইতাম! ছেলেটার সময় থাকত না – এত বেশি কথা বলতে পারতো না! তারপরও আশায় রইলাম হয়তো বেশি বেশি কথা হবে কোনদিন!
আশায় আশায়ই রইলাম! আশা নিরাশায় পরিনত হতে থাকল! বুঝতে পারছিলাম না ছেলেটার সাথে কথা বলা চালিয়ে যাব নাকি বন্ধ করে দিব!

আমাদের ঐ সময়টায় ভার্চুয়াল রিলেশন বলে একটা রিলেশন ছিল! ঐ ভার্চুয়াল রিলেশনে একজন কষ্ট পেত, আরেকজন ধোকা দিত! মজা করার জন্য ছিল এই ধরনের রিলেশন! আমি ঘৃনা করতাম এসব! কিন্তু নিজেও জড়িয়ে পড়লাম এই ধরনের রিলেশনে! কষ্ট পেতে লাগলাম একটু একটু করে, কিন্তু ছেলেটা ধোঁকা দিচ্ছে এটা মেনে নিতে পারলাম না!
এইভাবে আর থাকতে না পেরে একটা সময় ছেলেটার সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিলাম! আর বলব না সিদ্ধান্ত নিলাম!

*

রুমুর মা এইটুক বলার পর থামলেন! অনেকক্ষন এক নাগাড়ে কথা বলে হাপিয়ে উঠেছেন!
ঐদিকে রুমু মনযোগী শ্রোতার মত শুনছে তার মায়ের এক না দেখা পাগলের প্রেমে পড়ার কাহিনী! শুনতে ভালই লাগছে তার! মা হুট করে থেমে যাওয়ায় বিরক্ত হল রুমু!
‘থামলে কেন? বল না?’
‘না আর শুনতে হবে না! অনেক বলে ফেলেছি! আর বলতে পারব না!’
‘আম্মু? প্লিজ?’

রুমুর মা কি যেন ভাবলেন এক মুহুর্ত! একটা নিশ্বাস নিয়ে আবার বলা শুরু করলেন!

*

দুইদিন কথা বলি নি! এরপর ছেলেটা নিজে থেকেই কথা বলা শুরু করল! আগে যেভাবে কথা বলত, তখন সেইভাবে বলছিল না! কেমন যেন অন্যরকম ছিল কথা বলার ধরনটা! বুঝতে পারলাম আমি যা চাচ্ছিলাম এতদিন, সেটাই পেতে যাচ্ছি!
পেলামও তা! কেমন জানি তখন নিজেকে অন্যগ্রহের কেউ মনে হচ্ছিল! প্রেমে পড়ব না কোনদিন এমন কোন কঠিন সিদ্ধান্ত নেই নি, কিন্ত কোনদিন প্রেম করব না এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম! কিন্তু প্রেমে পড়লামও, প্রেম করার সিদ্ধান্তও নিলাম!

বুঝতে পারছিলাম না ছেলেটার সাথে আসলে আমার সম্পর্কটা কি? বন্ধুত্ব নাকি প্রেম?

এখনো দেখিই নি ছেলেটিকে! না দেখেই প্রেম কিভাবে করা যায়? এটা বন্ধুত্বই! আবার ভাবলাম, সবাই যেভাবে ভাবে আমি হয়তো তার থেকে ব্যতিক্রম! অথবা আমার ভাগ্যটাই ব্যতিক্রমী! যা হওয়ার সবই হবে হয়তো ব্যতিক্রমী ভাবে!

এই ভেবেই সামনে এগুতে লাগলাম! ঐ সময়টায় ঐ ছেলেটার সাথে আমার তুমুল ঝগড়া হয়ত! ঝগড়ার কোন কারন নেই! সাধারন ছোটখাট কথা থেকেই ঝগড়ার সৃষ্টি! প্রথম প্রথম ভাল লাগত ঝগড়া করাটা!
ঝগড়া করলে মন খারাপ হত ঠিকই, তবে ঝগড়ার পর পরই ছেলেটা আবার মন ভালও করে দিত! কিন্তু একটা সময় আমার বিরক্ত লাগা শুরু করল এই ঝগড়ায়! আর কত! অযথাই ঝগড়া আর কতদিন করা যায়?

তোদের এই জেনারেশন আর আমাদের ঐ জেনারেশনের একটা মিল এখনো আছে! সেটা হল ব্রেক আপ করা! ব্রেক আপ করে ফেললাম ছেলেটার সাথে!

*

রুমুর মা আবারো থামলেন! হয়তো ঐ কথা স্মরন করে উনি স্মৃতিকাতর হয়ে গেছেন, নয়তো ঐ ঘটনা মনে পড়ায় নিজেই রেগে গেছেন! দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলছেন শুধু!
রুমু আগ্রহ নিয়েই শুনছিল! কিন্তু মায়ের হুট করে থেমে যাওয়ায় কিছুটা বিরক্তও হয়েছে! একটা গল্প একটানা না শুনে থেমে থেমে শুনতে হচ্ছে! ভাল লাগছে না এটা তার!

‘কি হলো আম্মু! থেমে গেলে কেন?’
‘গল্প শেষ তো!’
‘কিভাবে শেষ হল? এখনও তো শেষ হয় নি!’
‘নাহলে নেই! আর শুনতে হবে না!’
‘আম্মু! শুনব! তুমি বল না? পাগলটার সাথে তোমার দেখা হয়নি কখনো?’
‘হয়েছে!’
‘ঐ গল্পটা বলবে না?’

মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন রুমুর মা! গল্প বলতে তার খারাপ লাগছে না! ভালই লাগছে! নিজের জীবনের এই না বলা কাহিনীটা মেয়েকে বেশ মজাই লাগছে তার! আর গল্প বলতে গিয়ে সেই সময়ের কথা চিন্তা করতেও বেশ লাগছে উনার!
আবার বলা শুরু করলেন!

*

ছেলেটার সাথে প্রথম দেখা হলো অনেক আয়োজন করেই বলা যায়! প্রথম দেখা বলে কথা! এতদিন তো শুধু কথা বলেছি, দেখিনি কখনো! দেখতে কেমন হবে তা নিয়ে তেমন ভাবনা ছিল না, ছবিতে তো দেখেছিই আগে! কিন্তু তারপরও অন্যরকম লাগছিল!
দেখা করার আগের দিন কথা হচ্ছিল!
‘কয়টায় বের হবি?’ ছেলেটা জিজ্ঞেস করল আমাকে!
‘কয়টায়? সাড়ে দশটায়?’
‘আচ্ছা ঠিক আছে! এখন দিন এমনিতেই ছোট! সন্ধ্যার আগে তোকে ফিরতে হবে! তাই, দেরী করবি না! একদম সাড়ে দশটায় জায়গামত থাকবি!’
‘আচ্ছা বাবা থাকব!’

ভাবছিলাম, সাড়ে দশটা যে বললাম যেতে যেতে হয়তো এগারোটা বেজে যাবে! এমনিতেই প্রচুর ঝগড়া হতো আমাদের, দেরী করে গিয়ে যদি দেখে সে আগে থেকেই বসে আছে তাহলে তো আবারও ঝগড়া হবে! চিন্তা করলাম, যেভাবেই হোক দেরী করা যাবে না!

পরদিন সকালে তৈরি হয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম! দেরী করতে না চাইলেও কিছুটা দেরী হয়ে গেল! বেশিক্ষন না অবশ্য, দশ মিনিটের মত হবে! ভাবলাম, এইটুক দেরী করা নিয়ে হয়ত ঝগড়া হবে না! নির্দিষ্ট জায়গায় গেলাম! গিয়ে দেখি সে নাই!

দাঁড়িয়ে রইলাম! তার আসার নামও নেই! দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত লাগছিল! কতক্ষন ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, আবার নিজেই বলে দিয়েছে সময়মত আসতে! এখন তারই আসার নাম নেই! আসার পর ঝগড়া সে না করলেও আমি করব চিন্তা করে রাখলাম।
সে আসলো! আমি প্রায় বিশ মিনিটের রোদে দাঁড়িয়ে রইলাম! দূর থেকে তাকে দেখলাম বাস থেকে নামছে! এদিক-ওদিক আমাকে খুঁজছে! আমাকে দেখতে পেয়ে হাত নাড়ল! আমি ঝগড়ার চিন্তা করে রাখলেও, তাকে দেখে আর ঝগড়ার কথা মনে রইলো না! জবাবে হাসলাম!
আমি রাস্তার অন্যপাশে ছিলাম! সে রাস্তা পের হয়ে আমার কাছে আসল! ভেবে রেখেছিলাম, এসেই বলবে, ‘রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিল! তাই দেরী হয়ে গেছে!’
এইসব কিছুই বলল না! প্রথম কথা, ‘এরকম ভূতের মত সাইজা আসছিস কেন?’

আমি শুনে হেসে ফেললাম! এরপর সারাটা দিন ঘুরলাম! পরের কয়টা দিন ঘুরলাম দুজনে মিলে! প্রথমে ভালই লাগছিল, পরে আর ভাল লাগছিল না! কারন ঝগড়া হচ্ছিলই আমাদের! এত ঝগড়া বিরক্তিকর লাগত!

এরপর তো তোকে বললামই, ব্রেক আপের কথা!

এরপর অনেকদিন কথা হয়নি! কথা আবার শুরু হল! তবে খুবই অল্প অল্প কথা! বেশি কথা বলতাম না! ছেলেটাও বলত না! কিন্তু ছেলেটার অবস্থা তখন আমার প্রথমে যেমন ছিল ঐরকমই! আমার প্রেমে সে হাবুডুবু খাচ্ছে, কিন্তু আমি বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকি!
কষ্ট পেত, হয়তো আমারই মত আশা করত। আশা করতে করতে নিরাশও হত! কিন্তু হাল ছাড়ে নি! হাল না ছাড়ার ফল অনেকদিন পর আমাদের আবারও দেখা হল!
দেখা করার আগের দিন কথা হচ্ছিল!
‘কয়টায় বের হবি?’
‘কয়টায়? সাড়ে দশটায়?’
‘আচ্ছা! দেরী করিস না! দিন ছোট……’ শেষ করার আগেই আমি থামিয়ে দিলাম!
‘তুই দেরী করিস না! আগের বার তুই ই দেরী করেছিলি! আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম!’ বেশ মেজাজ গরম করেই কথাটা বলেছিলাম!
‘আচ্ছা! ঠিক আছে, আমিও করব না – তুইও করিস না!’

পরদিন আমি ইচ্ছা করেই দেরী করলাম! সাড়ে দশটার জায়গায় গেলাম সাড়ে এগারোটায়! গিয়ে দেখি সে দাঁড়িয়ে আছে! ঠিক আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেখানেই! অনেকক্ষন ধরেই রোদে দাড়িয়েছিল, চেহারা দেখেই বুঝা গেল!
রোদের আচে মুখ কালো হয়েছিল! আমি যেতেই অর্ধেক খাওয়া একটা চকলেট দিল হাতে!
‘পুরোটাই এনেছিলাম! খুদা লাগছিল আর তোর আসতে দেরী হচ্ছিল দেখে একটু খেয়ে ফেলেছি!’ কৈফিয়ত দেওয়ার মত করে বলল!

আমার শুনে বেশ হাসি আসছিল! কিন্তু ইচ্ছা করেই হাসছিলাম না! দেখি আগে তো দেখা হলেই ঝগড়া শুরু করে দিত! এইবারও কি আমি এরকম করছি দেখে ঝগড়া শুরু করে কি না!
‘তুই চাইলে নতুন একটা এনে দিতে পারি! এইটা আমাকে দিয়ে দে! খুদা লাগছে!’ আবার বলল!
এইবার হাসি চেপে রাখতে পারলাম না! হেসেই দিলাম! ‘আরেকটা লাগবে না! তুই ই খা! খুদা লাগল কেন? নাস্তা করিস নি?’
‘না!’
‘কেন?’
‘ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে গিয়েছিল! নাস্তা করতে গেলে আসতে দেরী হত! তাই না করেই চলে এসেছি!’
‘তাহলে এখানে এসে কিছু খেয়ে নিতি?’
‘দেখ তো এইখানে খাওয়ার মত কিছু আছে কি না?’

তাকিয়ে দেখলাম! জায়গাটায় আসলে খাওয়ার কোন দোকানই নেই! মনটা খারাপ হয়ে গেল! একটু ধমক দিয়ে বলেছি দেখেই না খেয়েই অপেক্ষা করতে হবে! আসলেই একটা পাগল ছিল ছেলেটা!
‘অবশ্য একটা খাওয়ার জিনিস আছে! তুই অনুমতি দিলে খেয়ে আসতে পারি!’ মিটমিট করে হাসতে হাসতে বলল!
সে কি বুঝিয়েছে বুঝতে দেরী হল না! আমাকে রাগানোর জন্যই বলেছে! আমিও রাগলাম! চোখ কটমট করে বললাম, ‘ওটা খেলে পেট ভরে না! খাওয়া লাগবে না ওটা!’
‘একটু খেয়ে আসি?’
‘একটু খেতে হবে না! পুরোটাই খা! আমি বাসায় গেলাম!’
‘আরে রাগ করিস কেন? আমি তো এমনি বললাম! এখন বল কোথায় যাবি?’
‘বাসায়!’

রাগ করে বলে একটা রিকশায় উঠলাম! ছেলেটা আমার কথায় মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইলো! সে ভেবেছে আমি সত্যি সত্যিই বাসায় চলে যাব! হেসে ডাক দিলাম! ‘উঠ! বাসায় তো যাবই! তবে এখন না, পরে!’

এরপর সারাটা দিন ঘুরলাম! বিকালের দিকে পার্কে গেলাম! আগেও পার্কটায় যেতাম দুজনে মিলে! একটা নির্দিষ্ট জায়গা ছিল আমাদের! ঐখানেই বসতাম!
ঐদিন ঐ জায়গাটায় আগে থেকেই দুইজন বসে ছিল! ঐ জায়গাটা ছাটা অন্য কোথাও বসতে ভাল লাগত না আমার! তবে ভাগ্যটা বেশ ভাল ছিল! আমরা যেতেই বেঞ্চটায় যারা বসেছিল তারা চলে গেল! গিয়ে বসলাম!
কিছুক্ষন চুপ করে রইলাম দুইজনেই! সারাদিন ঘুরাঘুরি ক্লান্ত দুইজনেই! কিছুক্ষনের বিশ্রামের জন্যই কথা বলা বন্ধ ছিল! নীরব অবস্থাটা প্রথমে কাটালো ছেলেটাই!
‘অই! আগে না আমরা গেম খেলতাম কিছু! অনেকদিন খেলা হয় না, চল আজকে খেলি!’
‘কি গেম?’
‘আছে একটা গেম!’
‘এখন ক্লান্ত আমি! পরে খেলব!’
‘গেমটা একজনে খেললেই হবে! তোর খেলতে হবে না, আমিই খেলব!’
‘আচ্ছা খেল তাহলে শুরু কর!’

ছেলেটাও আমার মত টুকটাক লিখত! তবে খুব কম লিখত! লিখাগুলো ভালই লাগত, কিন্তু ছেলেটা ভাবত তার লিখা একদম খারাপ! তাই লিখতই না বলা চলে! সে গল্প বলার মত করে বলা শুরু করল! এটাই তার গেম!
‘বিকেল বেলা! সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে ঘুরাঘুরি করার ফলে ক্লান্ত হয়ে একজোড়া পাগল-পাগলী পার্কের বেঞ্চে এসে বসল বিশ্রাম নেওয়ার জন্য!’
‘অক্লান্ত পরিশ্রম করে ক্লান্ত কিভাবে হয়?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম!
‘এখন কোন প্রশ্ন না! প্রশ্ন সব পরে!’
‘আচ্ছা!’
‘কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থাকার পর পাগল ছেলেটি তার হাতের দু আঙুল দিয়ে হাতকে পার্কের বেঞ্চির উপর হাটাতে শুরু করল!’ সত্যিই সে তখন এই কাজটা করছিল! ‘হাতটা আঙুল দুটোর উপর ভর করে হাটতে হাটতে একটা সময় পৌছে গেল পাগলী মেয়েটার হাতের কাছাকাছি! বালকের হাতটার মনে হয় মেয়েটির হাতে চেপে বসার খুব শখ হচ্ছে! তবে হাতের গতিপথ বদলে দিল তার চালক আঙুল দুটো! মেয়েটির হাতের কাছাকাছি গিয়ে উড়োজাহাজের মত উপরে উঠে পড়ল! যেন পার্কের বেঞ্চিটা একটা রানওয়ে, আঙুল দুটো উড়োজাহাজের চাকা, হাতটা একটা উড়োজাহাজ! হাতটা উড়োজাহাজের মত সাই করে উড়ে মেয়েটির চোখের সমান্তরালে চলে আসল! যেন মেঘের সমান্তরালে থেকে উড়ছে কোন উড়োজাহাজ!’ আসলেই আমার চোখের সামনে তখন তার হাতটি ছিল! অবাক হচ্ছিলাম খুব! এটা আবার কি ধরনের গেম বুঝতে পারছিলাম না! আমার চোখের অবাক হওয়া দৃষ্টিটা দেখে ছেলেটি হাসল!

আবার বলা শুরু করল! ‘কিন্তু বজ্রপাতে উড়োজাহাজটি ফুটে উঠল! ছিটকে উড়ে বের হয়ে আসল ভিতরের যাত্রী!’ এই কথাটা বলার সময় তার হাতে মুঠো হুট করেই খুলে ফেলে আর হাত থেকে কি যেন একটা উপরের দিকে ছুড়ে দেয়! একটা আংটি! ‘উড়োজাহাজের মতই ছেলেটার হাতও খুলে যায়, উড়ে বের হয়ে আসে কিছু একটা! ছেলেটি ক্রিকেট খেলতে ভালবাসত! ক্রিকেট খেলায় যেভাবে ক্যাচ ধরতে হয় সেই ভাবেই ক্যাচ করে ধরল হাতের বস্তুটি! ছেলেটির অপর হাতটি, মেয়েটির হাত ধরল! হাতের একটা একটা আঙুল ছুয়ে ছুয়ে চলে আসল চার নম্বর আঙুলটায়! অপর হাত দিয়ে ক্যাচ করা বস্তুটিকে আলতো করে পড়িয়ে দিল আঙুলটায়! তারপর পাগল ছেলেটি পাগল মেয়েটিকে বলল, ‘ভালবাসার সাথী হবি?’’

আমি হুট করে এমন কিছু ঘটে যাওয়ায় খুব অবাক হয়েছিলাম! কি বলব বুঝতে পারছিলাম না! তাড়াতাড়ি করে হাত থেকে আংটিটি খুলে ফেললাম! ছেলেটাকে আংটিটি ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘এসবের মানে কি?’

ছেলেটি মনে হয় একটু হতাশ হয়েছিল আংটিটি খোলায়! তারপর আবার হেসে শুরু করল, ‘মেয়েটি হাত থেকে আংটিটি খুলে ফেলল! ফিরিয়ে দিল ছেলেটির হাতে! ছেলেটি বুঝে ফেলল মেয়েটি তার ভালবাসার সাথী হবে না! অতঃপর ছেলেটি আংটিটি ছুড়ে ফেলল! আর গেম কমেন্ট্রেটর তখন বলে উঠল, ‘গেম ওভার!’’ সে আসলেই আংটিটি ছুড়ে ফেলে দিল!
‘আংটিটা ফেলে দিলি কেন তুই?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম!
‘ওটা তো গেমের জন্য ছিল! গেমের স্ক্রিপ্টে আংটিটি ফেলে দেওয়ার কথাই লেখা আছে!’
‘কচু লেখা আছে! আংটিটা নিয়ে আয়! ঐযে দেখা যাচ্ছে! বেশি দূর ফেলিস নাই!’
‘থাক! ওটা আর লাগবে না এখন!’ মাগরিবের আজান দিচ্ছিল তখন! ‘চল, সন্ধ্যা হয়ে গেছে! তোকে পৌছে দিয়ে আসি!’

বলে সে নিজে থেকেই উঠে পড়ল! আমি হতভম্বের মত বসে রইলাম! কি ঘটল বিকালে কিছু বুঝে উঠতে পারছি না! তার রাগ সম্পর্কে জানি! ফেলে দিয়ে যখন উঠে চলে গেছে, তাহলে আর তাকে হাজার অনুরোধ করলেও আংটিটি তুলবে না! আমিও কি করব বুঝতে পারছিলাম না! সন্ধ্যাও হয়ে গিয়েছে! সেও হাটতে হাটতে বেশ দূর এগিয়ে গেছে! আংটিটি তুলে নিয়ে আমিও হাটা শুরু করলাম!

রিকশায় উঠলাম! ছেলেটা রিকশায় উঠলে প্রচুর কথা বলত! আমি চুপ করে থাকতাম! আজ সেও চুপ, আমিও চুপ! একদম নীরবতা বিরাজ করছিল! অন্ধকার নেমে এসেছে তাই দেখতে পারছিলাম না তার মুখটা! নিয়ন আলোয় আবছা আবছা দেখে বুঝা গেল ছেলেটা অনেক মন খারাপ করেছে!
নিশ্চয় অনেক আশা করে, অনেক পরিকল্পনা করে আমাকে আংটি পড়াতে এসেছিল! আর আমি কি না তা পড়ানোর সাথে সাথেই খুলে ফেললাম? নিজের উপরেই রাগ লাগছিল! ছেলেটার মন খারাপ দেখে আমার মনটাও খারাপ হয়ে গেল!
‘অ্যাই! পাগল!’ ডাক দিলাম!
‘বল পাগলী!’ সেও জবাব দিল!
‘আমার হাতটা ধর!’
‘না!’
‘কেন?’
‘এমনি!’
‘বুঝছি! এখন ধরতে বলছি ধর!’
‘আচ্ছা ধরলাম!’
‘আঙুলে হাত বুলা!’
‘হুমম!’
‘বিশেষ কিছু পেলেই বুলিয়ে!’
‘হুমম!’
‘কি সেটা?’
‘একটা আঙুলে লোহা জাতীয় কিছু একটা পড়ে রেখেছিস!’
‘ঐটা লোহার ছিল?’ রাগ করে বললাম!
‘কোনটা?’
‘তুই যেটা বিকালে পড়িয়ে দিলি?’
‘না!’
‘তাহলে এখন লোহা বলছিস কেন?’
‘তুই ঐটা পড়ে আছিস?’
‘হুমম! কিন্তু একটা সমস্যা হচ্ছে!’
‘কি সমস্যা?’
‘আংটিটা না বেশি বড়! মনে হচ্ছে, খুলে পড়ে যাবে!’

এরপর আর কথা হয় নি! দুজনে মিলেই হাসা শুরু করলাম! এতদিনের সব ঝগড়া, কষ্ট পাওয়া শেষে দুজনে মিলিত হলাম!

সমস্যা ছিল, সেও তখনও স্টুডেন্ট ছিল আমিও স্টুডেন্ট! বাবা আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল! কোন রকমে আটকিয়ে রাখলাম! সে পাশ করল! চাকরী নিল! বাবার কাছে প্রস্তাব পাঠালো! বাবা নাকচ করে দিল! তারপর………

*

রুমুর মা থেমে গেলেন এরপর! নীচে গাড়ির হর্নের আওয়াজ শুনলেন! রুমুর বাবা এসে পড়েছেন! এখন আর গল্প বলা যাবে না মেয়েকে!
ঐদিকে রুমু অস্থির হয়ে উঠেছে শেষটা জানার জন্য! ‘তারপর কি আম্মু?’
‘তারপর আমার বিয়ে হয়ে গেল তোর বাবার সাথে!’
‘আর ঐ পাগল ছেলেটা? যে তোমাকে আংটি পড়িয়ে দিয়েছিল?’
‘সেও আছে।’
‘কোথায়?’
‘দেখবি?’
‘কিভাবে দেখব? সেই পাগলটা কি আশেপাশেই থাকে নাকি?’
‘হুমম!’
‘কোথায়?’
‘আয় দেখাচ্ছি!’

রুমুর মা মেয়েকে নিয়ে বেলকনিতে গেলেন! আঙুল দিয়ে নীচে রুমুর বাবার দিকে তাক করলেন! বললেন, ‘ঐ যে ঐ পাগলটা!’
রুমু অবাক হয়ে গেল! ‘বাবা?’
‘তোর বাবাই ঐ পাগল!’

তার বাবা তার মাকে এতটা ভালবাসে সেটা রুমু জানত না! এটাও জানত না যে তার মাও তার বাবাকে কতটা ভালবাসে! সে না জেনেই বাবা সম্পর্কে ঐ কথাটা বলেছিল! এখন নিজেরই খারাপ লাগছে!
‘স্যরি আম্মু! আমি না বুঝে ঐসব বলে ফেলেছি!’
‘আরে পাগলী! না বুঝে মানুষ কত কি ই তো করে, আমরাও করেছি! এরজন্য কি নিজের মাকে স্যরি বলা লাগে?’
‘তোমরা বিয়ে করেছো প্রেম করে, তাহলে আমাকে জোর করে অপরিচিত ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছো কেন?’
‘তোর অপরিচিত হতে যাবে কেন? পরিচিত তো তোর!’

কথাটা শুনে রুমু বেশ অবাক হল! তার পরিচিত ছেলে! তার পরিচিত ছেলেকে তার বাবা-মা চিনলো কি করে? সেই কথাটা চাপা রেখে জিজ্ঞেস করল, ‘মানে?’
‘এই ছবিটা দেখ তো ছেলেটাকে চিনিস কিনা? না চিনলে বলে দে! বিয়ে ক্যান্সেল করে দেওয়া যাবে!’ বলে রুমুর মা রুমুকে ছেলেটার ছবি দিলেন! ছবি দেখে রুমুর চোখ কপালে উঠলো! বড়সড় একটা ধাক্কা খেল সে!
‘কি চিনিস না ছেলেটাকে?’ রুমুর মা আবারও জিজ্ঞেস করলেন!
‘জানি না!’ রুমু না হাসছে না মন খারাপ করছে এমন একটা ভাব নিয়ে বলল! তার মা সব বুঝে গেছেন!
‘আচ্ছা তাহলে বিয়ে ক্যান্সেল করে দিই!’
‘না!’ চটে গিয়ে বলল রুমু!
‘কেন?’
‘জানি না! তোমরা দুইটা আসলেই পাগল-পাগলী!’ বলে দৌড়ে চলে গেল রুমু!

*

রাতের বেলা রুমুর বাবা রুমুর মা কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিরে দেখলি? তোর মেয়েকে কেমন চমকে দিলাম!’
‘দেখলাম তো! ঠান্ডা করার জন্য তো আমার একগাদা গল্প বলতে হল!’
‘গল্প বললি? হাহাহা! কিসের গল্প?’
‘কিসের আর! আমাদের প্রেম কাহিনী!’
‘কি?’ থতমত খেলেন তিনি! ‘সব বলে দিয়েছিস?’
‘হ্যা সব! তোর অসুবিধা হবে তাতে?’
‘মেয়ের সামনে এখন মুখ দেখাবো কিভাবে সেটাই ভাবছি!’
‘মুখ কিভাবে দেখাবি আর? ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে দেখাইস!’

বলে দুইজনে মিলে হাসতে লাগলেন! তাদের দুইজনের মাঝখানের পাগলামী গুলো আজো জীবিত আছে! কেউ ই দেখে না তাদের পাগলামী গুলো! সদা গম্ভীর ভাব নিয়ে থাকেন দুই জনে! আসলে দুইজনের মাঝের সেই বন্ধুত্বটাই তাদের পাগলামীকে বাঁচিয়ে রেখেছে! সেই সাথে বাঁচিয়ে রেখেছে তাদেরকেও।

স্মৃতিকাতর সেই পার্কের বেঞ্চটায় বসার জন্য প্রায়ই যান দুইজনে মিলে! কিন্তু ফিরে আসতে হয় ব্যর্থ হয়েই! ঐ বেঞ্চটায় আগে থেকেই কেউ বসে থাকে! বসে থাকা মেয়েটা তাদেরই মেয়ে রুমু! জেনে হোক না জেনে হোক, সেও বাবা-মায়ের সেই বসে থাকা বেঞ্চটাতে বসে পাগলামী করে যায়! তার সাথেও থাকে একটা পাগল ছেলে! সেও পাগলামী করে! এই দৃশ্য রুমুর বাবা প্রথমে চটে গেলেও রুমুর মা আটকিয়ে রেখেছিলেন! ‘রাগছিস কেন? আমরাও তো আগে এমনই করতাম! করতে দে না ওদেরকে পাগলামী! জীবনটাকে উপভোগ করুক!’
প্রায়ই দেখতেন এই দৃশ্য! ছেলেটার পরিচয় খুঁজে বের করে অভিভাবক পর্যায়ের আলাপ-আলোচনাও সেড়েছেন! সবই ঠিকঠাক! শুধু যাদের জন্য এত কিছু হচ্ছে তারাই জানে না! তারা আছে এক অজানা শঙ্কায়! তারা তো আর জানে না ভবিষ্যৎ-এ তারা একজন আরেকজনকে পাবে কি পাবে না!

সব ঠিক হয়ে যাওয়ার পর রুমুর বাবা চিন্তা করলেন, এত সহজে ছেলেমেয়ে দুটোকে খুশির কথাটা বলা ঠিক হবে না! একটু ট্র্যাজেডী আসুক তাদের জীবনে! ট্র্যাজেডি ছাড়া কি কোন মজা আছে জীবনের?
ব্যাস! সব প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে রুমুর মাকে জানালেন! রুমুর মা রুমুর বাবার পাগলামী প্ল্যান শুনে হাসলো কিছুক্ষন! তারপর সেই অনুযায়ী কাজ!

সেইসব চিন্তা করে আবারও হাসলেন রুমুর মা! ‘তুই তো পাগল কেন?’
‘তুই পাগলী তাই!’
‘বুড়ো হয়েছিস! এখনও বৌকে তুই তুই করে ডাকিস কেন?’
‘তুই তুই করে ডাকতে কে বলেছিল প্রথমে?’
‘সেটা তো বলেছিলাম, তখনের জন্য! এখনও ডাকা থামাতে পারলি না?’
‘তুইও তো ডাকিস! তুইও তো বুড়ি কম হইলি না।’
‘হইছে এখন এই মধ্যরাতে আর পাগলামী করা লাগবে না! ঘুমা!’
‘তুইও ঘুমা!’

অতঃপর! পাগলামী চলতেই থাকল, চলতেই থাকল, চলতেই থাক……

(The End)

[এই গল্পটা প্রায় একবছর আগে মানে এই নভেম্বরের ১ তারিখেই লিখেছিলাম। কাকতালীয় ভাবে এইটা আজ আবার চোখের সামনে পড়লো। গল্পটা আসলে একটা চ্যালেঞ্জের মত ছিল আমার জন্য। আমি নাকি কাঁটাছেড়া ছাড়া কিছুই লিখতে পারবো না কোনদিনও। তাই এইটা লিখেছিলাম। এবং এটাও প্রমাণ করেছিলাম যে,
আমাকে দিয়ে আসলেই কাঁটাছেড়া টাইপ লেখা ছাড়া আর কিছুই আসবে না।

আজগুবি গল্প পড়ে চটবেন অনেকেই। তাদের কাছে আগেই দুঃখ প্রকাশ করছি।]

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:৫৮

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: আজগুবিই বটে! খারাপ লাগেনি

০১ লা নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:২৯

রক্তিম দিগন্ত বলেছেন: লেখার এক ব্যর্থ প্রয়াস আর কী!

ধন্যবাদ। :)

২| ০১ লা নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:৫৯

হাসান মাহবুব বলেছেন: এই নিকটা কি আপনার?

আজগুবী গল্প বটে। তবে পড়তে ভালোই লাগলো।

০১ লা নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৩১

রক্তিম দিগন্ত বলেছেন: হ্যা! ঐটা আমারই। হুট করে ব্লক করেছে ঐটা। তাই এটার সৃষ্টি। ওটাকে আর উদ্ধার করতে পারিনি। :(

আপনি খুঁজে পেলেন কী করে? চোখ বটে ভাই আপনার!! :)

৩| ০১ লা নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:৫৩

শতদ্রু একটি নদী... বলেছেন: ভালোই লাগছিলো পড়তে। লেখার ভঙ্গী খারাপ না, বেশ ভালোই। শুভকামনা রইলো। :)

০১ লা নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৩৪

রক্তিম দিগন্ত বলেছেন: ব্যর্থ চেষ্টা ভাই সবই।
লেখালেখির ব্যর্থ চেষ্টা। এই গল্পটা আমি খুব ভালোভাবে লিখতে পারিনি। আড়াই-তিনঘন্টা সময়ে শেষ করতে হয়েছিল। খুব একটা রিচেক করার সময়ও পাইনি। :(

ধন্যবাদ, পড়ার জন্য। :)

৪| ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ৮:২৩

নীল-দর্পণ বলেছেন: সবাই আজগুবি-ফাজগুবি-টাজগুবি-মাজগুবি কই সব বলছে। আমার ত ভালি লেগেছে বেশ! হ্যাপ্পী এন্ডিং কি না তাই :P
আমার আবার ট্রাজেডি ভাল লাগেনা :(
+

০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:৫৩

রক্তিম দিগন্ত বলেছেন: আমার আবার ট্র্যাজেডিক এন্ডিং না দিলে ভাল্লাগে না।

তবে এইটাকে সব কিছু থেকে বদলিয়েই লিখেছি। লাভ স্টোরি তো অনেকেই লিখে, সবার থেকে আলাদা বানানোর এক ব্যর্থ চেষ্টা। :-B

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.