নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ফেবু লিংক https://www.facebook.com/tashfic007

ভবঘুরে যাত্রি

বিনা অনুমতিতে কিংবা লেখকের নাম বিহিন লেখা কপি করবেননা

ভবঘুরে যাত্রি › বিস্তারিত পোস্টঃ

মাঝ নদীর মাঝে | তাসফিক হোসাইন রেইযা |

০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৪৬




-কিরে কানাই মাছ ধরবার জাবিনা?
-আরে আর কইস না, পোলাডা জেদ ধরছে ওরে নিয়া যাইতে।
-তো নিয়া চল সমস্যা কি? জাইলার পোলা জাইলা হইবো জজ বেরিস্টার তো আর বানাইতে পারবিনা?
-না আমার পোলারে সাহেব বানামু। ওয় অনেক বড় হইবো।
-তা না হয়লে বানাইস কিন্তু এর লাইগা তো টেকা থাকতে হইবো তাইনা? টেকা না থাকলে কি আলাদিনের চেরাগ আইশা তোর পোলারে পড়ালেহা করাইবো? না তগোরে খাওয়াইবো? পেটে খাওন না থাকলে পড়ালেখা দিয়া কি হইবো?
-ঠিক কইছস। চল তাইলে। পটারেও লগে লইয়া যাই। ওয় ও দেখুক ওর বাপে কেমনে মাছ ধরে।
কানাই তার ছয় বছরের ছেলে পটা কে নিয়ে তার বন্ধুর সাথে মাঝ ধরার জন্য বের হয়ে গেল। বাসার কাছেই নদী। পদ্মা নদীর উপর কয়েক যুগ ধরে টিকে থাকা বাধবপুর চর এলাকার জেলে বস্তিতে ওদের কুঁড়ে ঘর। সরকারের দয়ায় কিছুদিন আগেই নতুন বাঁধ বানানো হয়েছে। এর জন্যই হয়তোবা চরটা তার বাশিন্দাদের নিয়ে জীবন যুদ্ধে টিকে আছে।
*
পটা, বাবা এবং বাবার বন্ধুর হাত ধরে ঝুলতে ঝুলতে যাচ্ছিল। অবশ্য কিছুক্ষণ আগেই ওর বাবা ঝাড়ি দিয়েছে কারণ কাঁধে মাছ ধরার জাল নিয়ে যাওয়া এমনই কষ্টকর। তার উপরে ছেলের এমন ফাজলামো তার পছন্দ হচ্ছিল না।
-বাপ আজকা আমরা কি মাছ ধরুম?
-দেখিরে আল্লায় যা কপালে রাখছে।
ওই হাশেম আকাশে দেখি মেঘ করতাছে। গাঙ্গের পানিরো দেখি ঢেউও বারছে মনে হয়।
-আরে রাখতো। মেঘ করতাছে তো কি হইছে হ্যা? মেঘ কড়ছে দেইখা মাছ ধরুমনা? মাছ না ধরলে কালকা মহাজনের কাছে কি কবি? আর মাছ ছাড়া উনি টেকা দিবো?
-বুঝস না? পটারে লইয়া আইছি। বাচ্চা মানুষ। তাই ভয় লাগে।
-কেন অয় সাঁতার জানেনা?
-জানেতো। কিন্তু পদ্মার রাক্ষসী ঢেও কি ও সহ্য করবার পারবো?
-হইছে জাইলা বাড়ির পোলা আর সহ্য করবার পারবোনা? আর একটা কথাও কবিনা। চল।
*
আকাশে মৃদু মেঘের গর্জন। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ এর ত্রিব্য ঝলকানিতে আশে পাশে আলো করে দিচ্ছে। কানাই এবং হাশেম এতখণ নৌকার পানি সেচে নৌকা ভাসিয়ে দিলো নদীর মাঝে। পটা ঠিক নৌকার মাঝখানে বশে আছে ওকে বলা হয়েছে হারিকেনের আলোতে মাছগুলো বড় পাতিলটার মধ্যে রাখতে। কিন্তু ওর মন বারবার টানছে নদীর ঢেউয়ে। আস্তে আস্তে এগিয়ে কাসেম এর কাছে গিয়ে বসলো দার টানা দেখার জন্য।
-কানাই! তোর মনে হয় কিছু পামু?
-কিছুতো বুঝতাছিনারে। আর মরার বৃষ্টি টাও শুরু হইছে। মনে হয়না আজ আর মাছ পামু। মনডা কেমন যেন আনচান করতাছে। এমনেই পোলাডারে লইয়া আইছি। চল বাড়িত ফিরা যাই।
-দেখ কানাই আমি মাছ না নিয়া বাড়িত জামুনা। ঘরে খাওনের কিছুই নাই। আরেকবার যদি মাছ পাওয়ার আগে বাড়িত যাওয়ার কথা কইছত। তাইলে কইল আমার নৌকা জীবনেও দিমুনা তোরে। তখন বউ পোলাপান লইয়া না খাইয়া মরিস। স্বর্গে গিয়া করাইস পোলারে লেখা পড়া।
-ঠিকাছে আর কমুনা। তুই মাঝ দরিয়ার ভিতরে নিয়া রাখ কিছুখন, আমি জাল বিছাইতে থাকি নতুন কইরা। তারপর একটু তামুক সাজা। ভিজা শরীরে কাম করা যায়না। তামুক দিয়া একটু গরম করি।
-হ তাই কর।
ওরা নদীর আর ভেতরে চলে গেল। পটা ওর ভেজা শরীর নিয়ে নৌকার ছাউনি ধরে দাড়িয়ে পাড় খোঁজার বৃথা চেষ্টা করছে। দূরে দূরে কিছু মাঝি নৌকার আলো বাদে দূর দূর পর্যন্ত কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে মেঘের ঝলকানি দুএকটা নৌকার আবরণ হালকা ভাবে বোঝা যায়। এদিকে হাশেম ভেজা শরীর নিয়ে দাঁর বাইছে এবং মনের মত গান গাচ্ছে।
পদ্মার পানি...... ওরে সোনার পানি..
নয়নের মনি....... ওরে সোনা মনি..
পেটের খুদা তোরে শুধাই একটু দয়া ধর্ম কর,
মনের মানুষ বইসা আছে ঘড়ে, যেথায় তোর বুকে তে চর
ও পদ্মার পানি....................................
*
বৃষ্টি অনেক বেড়ে গিয়েছে তার সাথে পাল্লা লেগেছে নদীর ঢেউ। নৌকা মৃদু দোল খাচ্ছে। কানাই এবং কাশেম তখন তামাক খেয়ে আবার বৃষ্টির মধ্যে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। শহরের উঁচু দেয়ালের মানুষগুলো যখন বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করে চাদর মুরি দিয়ে আরামের ঘুম দেওয়ার জন্য তখন এভাবেই হয়তো কোন নদীর মাঝে কিছু মানুষ পেটের দায়ে বৃষ্টির সাথে যুদ্ধ করে বাঁচে।
*
বৃষ্টি বারতে বারতে ঝড়ের উৎপন্ন হয়েছে। রেডিও কাছে থাকলে হয়তো এতক্ষণে কোন উঁচু মাত্রার বিপদ সংকেত শুনতে পেত। কাসেম এবং কানাই দাঁর বাইতে বাইতে এক মনে নিজেদের প্রভুর নাম জপে যাচ্ছে। সবার মনের মাঝে সাধের জীবনটাকে হারানোর ভয়। পটা তার বাবাকে শুধু বার বার প্রশ্ন করছে।
-বাবা বাড়িত যামু কখন?
-চুপ আরেকটা কথাও কবিনা। কইছিলাম আমি আইতে চুপচাপ ছাওনির ভেতর বইয়া থাক।
হারিকেনের মৃদু আলো তুমুল বৃষ্টির কাছে বেমানান। পটা চুপচাপ এসে বাবার একটা পা জড়িয়ে ধরে দাড়িয়ে আছে। কানাই এবং কাশেম এর আপ্রাণ চেষ্টা কোন মতে পারে ফেরার। কিন্তু মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছে অনন্তকাল দূরে চলে এসেছে তারা। হঠাৎ নদীর প্রবল স্রোতে উল্টিয়ে দিল তাদের নৌকা। হারিকেনের আলো ধুপ করে নিভে গেল। প্রবল স্রোতে নিমিষেই হারিয়ে গেল তাদের নৌকা, তাদের আওতা থেকে। কাশেমের খোঁজ ও পাওয়া যাচ্ছেনা। পটার সাথে করে তার বাবা আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছে নদীর ঢেউ এর সাথে বেঁচে থাকার। কিন্তু পদ্মার ঢেউয়ের সাথে পাল্লা লেগে কি পারা যায়?
*
পটা বুকে একটি বই জরিয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে তার বাবার সামনে।
-বাপ ৫ খান টেকা দেও হাওয়াই মিঠাই খামু। স্কুলের বন্ধুগোরে দেখছি কালকা খাইতে আমিও খামু।
-যা যা কালকা দিবানি আজকা টেকা নাই।
-বাবা আমি তাইলে স্কুলে যামুনা, আমি নদীতে ডুইব্বা মরুম। এটা বলে ওদের দরজার সাথে লাগানো নদীর ভিতর লাফ দিয়ে হারিয়ে গেল।
কানাইয়ের চোখ খুলে গেলো। কয়েকটা কাশি দিয়ে বুকে জমা কিছু পানি বের করে নিল। নদীর পারে অনেক মানুষ। ফরিদের কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ওর নৌকা হারিয়ে গেছে। কানাইয়ের বউ জিজ্ঞেস করলো পটার বাপ "আমাগো পোলা কই?" কানাই হুট করে দাঁড়িয়ে চারপাশে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। নদীর এই কুল থেকে অকুলে কিচ্ছুনাই। খুব শান্ত একটা নদী। শুধু আশে পাশে জেলে বাড়ির মহিলাদের আর্তনাদ এবং চিৎকার। সবাই অপেক্ষায় আছে যদি কোন নৌকা বা টলার অন্য পার বা চরে ভেসে যাওয়া প্রিয় মানুষকে নিয়ে আসে। এত মানুষ কিন্তু তাও কানাইয়ের ছেলে কোথাও নেই।
*
পড়ন্ত বিকেল সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে বলা চলে। পশ্চিম দিকে সূর্য আকাশটা লাল করে নদীর বুকে ঢলে পড়ছে। নদীর পারে দেখা যাচ্ছে পটার মা এবং কানাই। দুজন বালুর উপর বসে আছে। অবশ্য পটার বাবার চোখে পানি নেই এবং পটার মাও চুপ কিন্তু ওর মায়ের চোখের পানিতে পরনের হাতা ছেঁড়া খয়েরি রঙের ব্লাউজের সামনের অংশ পুরোপুরি ভিজে যাচ্ছে। কানাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল পটার মা কে "আমাগো পটা স্কুলে জাইবোনা? চলো বারিত চলো ওর লেইগা বই কিনতে হইব" এটা বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে দিল।
*
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেল। পটার মা মাথায় আচল টেনে কানাইয়ের হাত ধরে বাড়ির দিকে ফেরার জন্য উঠল। কয়েক মিনিট আগেই ওদের পিছনেই একটা ট্রলার এসে থেমেছিল। কিন্তু তাতে তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। কানাই আনমনে বলে যাচ্ছে বউ আমাগো পটারে আমি মাইরা ফেললাম বউ,মাইরা ফেললাম, পোলার খুব ইচ্ছা ছিল লেহাপড়া করুণের। কাশেম রে কত কইলাম হুনলোনা।
*
নদীর পাশে ছোট ধান খেত, তারপর ওদের বাড়ি। গত রাতের ঝড়ে ধান গাছ গুলোকে আহত করে দিয়েছে। বালুর কাদা মাটি পেরিয়ে, ধান খেতের সামনে দাড়িয়ে পটার মা একবার পিছন ফিরে তাকাল তার মনে হলো তাদের কেও ডাক দিয়েছে। কিছুএকটা দেখে পটার বাবার হাত ছেড়ে কিছু একটা বলতে বলতে দৌড়ে ছুটে গেল ওদিকে। আকাশে আবার বিদ্যুতের চমক দেখা গেলো। আবার হয়তো বৃষ্টি নামবে।
*
মাঝ নদীর মাঝে | তাসফিক হোসাইন রেইযা

©©

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ৮:২২

চাঁদগাজী বলেছেন:


দু:খী মানুষের জীবনকে ভয়ংকর দু:খে ভরে দিয়েছেন, এত কস্টের প্লট ভালো না।

০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ৮:৩৪

ভবঘুরে যাত্রি বলেছেন: বাই বাস্তবতাটাই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি
কমেন্ট এর জন্য ধন্যবাদ
ভালোবাসা রইলো :)

২| ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ৮:২৮

কানিজ রিনা বলেছেন: ওদের নিয়ে আর কে লিখে, ওদের বেঁচে থাকা অন্ধকারে, ওরা কেউনা এসমাজের ওরা শুধুই মাছ ধরা জেলে,লেখা পড়া জানলে হয়ত বই লিখত কবিতা লিখত ব্লগে আসত।

০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ৮:৩৭

ভবঘুরে যাত্রি বলেছেন: লিখে আপু অনেকেই লিখে, আমার শেষের দিকের বেশীর ভাগ লেখা গুলোতেই গ্রাম বাংলার চিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা চালিয়েছি কিন্তু অনেকেই হয়তো প্রকাশ করেনা কারন এসব লেখা খুব কম লোকে পড়ে। কারন এসব লেখায় কাল্পনিক প্রেম থাকেনা। থাকে কঠিন বাস্তবতা।
কমেন্ট এর জন্য ধন্যবাদ
ভালোবাসা রইলো :D

৩| ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২:০৬

কালীদাস বলেছেন: লেখাটা ভাল হয়েছে :( অনেকদিন পর গ্রামবাংলার জেলে সমাজের দুঃখকষ্টের কোন গল্প পড়লাম :|

২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২:২৯

ভবঘুরে যাত্রি বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই আপনার মন্তব্যের জন্য

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.