নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

...

পুলহ

পুলহ › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ "চেতনা-লিখন"

২৩ শে এপ্রিল, ২০১৫ রাত ৯:১৮

সকালের শিফট শেষ হয় রাত আটটায়। কর্মক্লান্ত দিনশেষে ব্যস্ততা থাকবার কথা নয় কিন্তু অনেক মানুষ একসাথে বেরিয়ে যায় দেখেই কি না জানি না, বেশ একটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় সে সময়টাতে। কিছুক্ষণ পরই আবার রাতের শিফটে যারা কাজ করে- দলে দলে তাদেরকে আসতে দেখা যায়। পায়ে রবারের স্যান্ডেল আর ওড়না মাথার সাধারণ সালোয়ার কামিজ পড়া মেয়েগুলোকে যতবারই দেখি- খুব মায়া লাগে। অলংকার বলতে শুধু ছোট একটা নাকফুল পড়ে থাকা মেয়েগুলোকে কেনো জানি বড় সহজ-সরল বলে মনে হয়।

আজ থেকে আট-দশ বছর আগেও এলাকাটা এতোখানি ঘিঞ্জি ছিলো না। খুব সম্ভবত নতুন গার্মেন্টসটা হবার পর থেকেই এই জায়গাটাতে কেমন একটা 'জটলা ভাব' চলে এসেছে। বিশেষ করে এক শিফট শেষ হয়ে অন্য শিফট শুরু হবার সময়গুলোতে চঞ্চলতা একেবারে তুঙ্গে ওঠে।

আমি এ জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে আছি গত প্রায় বিশ বছর যাবত। এখান থেকে বড় রাস্তা খুব কাছেই। মূল সড়ক থেকে মাঝারি আকৃতির একটা গলি ভেতরের দিকে চলে গিয়েছে। যখন চারা ছিলাম- তখন আশেপাশে তেমন কিছুই দেখতে পেতাম না। যে বাড়ির সীমানা ঘেষে আমি দাঁড়িয়ে- একপাশে সে বাড়ির উচু পাচিল আর অন্যপাশের ছোট টংটা আমার দৃষ্টি আটকে রেখেছিলো দীর্ঘ সময়। ছোটবেলার সে সময়টাতে আমি শুধু আকাশ দেখতাম। বহুরূপী সে আকাশকে আমার ভারী রহস্যময় বলে মনে হোত। কখনো তাকে দেখতাম ঘন নীল, কখনো ধূসর; ঝুম বৃষ্টি আসবার আগ দিয়ে একরকম, ঝলমলে রোদে আবার অন্যরকম। নক্ষত্রের হাল্কা নীল আলোয় যে কোমল, মমতাময়; ঝড়ের আগমুহূর্তেই আবার তাকে দেখে মনে হোত কেমন রুদ্র, নিষ্ঠুর।

যাই হোক, যেমনটা বলছিলাম- আমার ছেলেবেলাতেও এ এলাকাটাকে অতটা ঘিঞ্জি মনে হোত না। বেশ কিছু গাছও ছিলো একটা সময়ে, এখন যার খুব কমই অবশিষ্ট আছে। আমার অনেকটা কাছাকাছি (প্রায় বিশ ফুটের মত হবে) একজন বটগাছ ছিলেন। আমি জন্মের পর থেকে বাবা-মা কিংবা কাছের তেমন কোন আত্মীয় স্বজন ছাড়া একা একা বড় হচ্ছিলাম দেখেই কি না জানি না, আমার প্রতি উনার স্নেহটা ছিলো বাড়াবাড়ি পর্যায়ের। বয়সের দিকে থেকেও আমাদের এলাকার অন্য যে কোন গাছের তুলনায় উনি ছিলেন অনেক বেশি অভিজ্ঞ। কত কিছুই না জানতে পেরেছিলাম তার কাছ থেকে! সে হিসেবে একদিক থেকে নিজেকে কিছুটা সৌভাগ্যবান দাবী করাই যায়।

তবে উনার একটা জিনিসই শুধু আমার কাছে একটু বিরক্তিকর বলে মনে হোত। সেটা হোল- মানুষকে দু'চোখে দেখতে পারতেন না তিনি। মানুষের প্রসংগ উঠলেই শাখা ঝাকিয়ে রাগী রাগী গলায় বলতেন-

"সকাল বিকাল মানুষরে ধইরা লাইত্থানো দরকার...."

আমি হাসতে হাসতে বলতাম- "আপনার তো পা ই নাই, লাত্থাবেন কিভাবে?"

আমার এই কথা শুনে তিনি বিমর্ষ হয়ে যেতেন। তাকে দেখে মনে হোত- পা না দিয়ে প্রকৃতি তার প্রতি কি অবিচারটাই না করেছে!

মানুষের প্রতি তার এই ক্ষোভের কারণটা অবশ্য তিনি আমাকে কখনো স্পষ্ট করেন নি, তবে আমি কিছুটা অনুমান করেছি। আমার ধারণা- তার খুব কাছের কোন গাছকে মানুষেরা কেটে সরিয়ে ফেলেছিলো। আর সেই থেকেই মানুষের প্রতি তার চূড়ান্ত রাগ, যেটা সময়ের সাথে সাথে শুধু বেড়েছেই, কখনো কমে নি।

তাকে অবশ্য একবার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিলো এই মানুষেরাই! আমরা- এই অঞ্চলের গাছেরা যখন সবাই মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম যে তাকে আর দু'একদিনের মধ্যেই কেটে সরিয়ে নেবার কর্মযজ্ঞ শুরু হতে চলেছে- তখনি কোথা থেকে যেনো 'সম্মিলিত সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট' এর ব্যানারে একদল মানুষ এসে খুব হৈ চৈ শুরু করলো। জুম্মার নামাযের পর এলাকার মসজিদে মসজিদে লিফলেট বিতরণ করা হোল। এলাকাবাসীকে দলে দলে রোববার বিকেলের সভায় (সেই সভাও আবার ডাকা হয়েছিলো বটতলাতেই) যোগ দিয়ে- 'শত বছরের ঐতিহ্যবাহী' বটগাছটিকে রক্ষার আন্দোলন সফল করবার ডাক দেয়া হোল। বলা হোল- 'পরিবেশ ধ্বংসকারী পুজিবাদী চক্রের' কালো হাত গুড়িয়ে দেবার জন্য এলাকাবাসী যেনো দল-মত নির্বিশেষে, 'গোষ্ঠীস্বার্থ ভুলে' সবাই এক হয়ে যায়।

উনাকে এ ঘটনার কথা পরবর্তীতে মনে করিয়ে দিলে উনি আরো রেগে যেতেন। মেঘস্বরে বলতেন- 'চরম পরস্পরবিরোধী একটা জাত! কোন কথা না বইলা সকাল বিকাল শুধু এদের পাছায় লাইত্থানো দরকার...'

মানুষ ভালো না মন্দ সে তর্কে আমি কখনো উনার সাথে যাই নি, তবে কিছুকিছু মানুষের যে কান্ডজ্ঞান বলতে কিছু নেই- সে ব্যাপারে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত। আমার সব থেকে বিরক্ত লাগে যখন তারা গাছেদের গায়ে নির্বিকারভাবে আজব আজব নানা জিনিসের বিজ্ঞপ্তি ঝুলিয়ে দেয়। আমার ডান পাশের তিনটা বিল্ডিং পরেই যে কাঁঠালগাছটা, তার গায়েই নানা ধরণের মানবিক সমস্যা সংক্রান্ত প্রায় দুই-তিনটির মত বিজ্ঞাপন সব সময়ই লেগে থাকে। এর মধ্যে কিছু কিছু তো আছে রীতিমত ভয়ঙ্কর। যেমন- "আপনার লিঙ্গ কি ছোট এবং নিস্তেজ? সহবাসে দ্রুত বীর্যপাত হয়ে যাচ্ছে? অতিরিক্ত হস্থমৈথুন করে লিঙ্গ দূর্বল বানিয়ে ফেলেছেন? চিন্তা নেই, কোন রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া শতভাগ নিরাপদ চিকিতসাপদ্ধতি নিয়ে আমরা আপনার পাশেই আছি! ২৪ ঘন্টার মধ্যে হোম ডেলিভারী পেতে ডায়াল করুন..." কিংবা "আর নয় অপারেশান, এখন বিনা অপারেশানে অর্শ,গেজ,ভগন্দর/ফিষ্টুলা রোগের সু-চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে আমাদের এখানে! যোগাযোগের ঠিকানা..."

কাঁঠালগাছ তার গায়ের নানা জায়গায় বিজ্ঞপ্তি নিয়ে প্রায় সময়েই লজ্জায় আশেপাশের গাছগুলোর কাছে ছোট হয়ে থাকে। সে দুঃখ করে আমাকে একবার বলেছিলো- 'বুঝলি, একরাতের নোটিশে কাঁঠাল ফলানোর ক্ষমতা থাকলে জায়গামত তিন চারটা কাঁঠাল ফলায়া এইসব বিজ্ঞাপন টিজ্ঞাপন সব ঢাইকা দিতাম।'

যাই হোক- কথা বলছিলাম মানুষের পরস্পরবিরোধী চরিত্র নিয়ে। আমার প্রশ্ন হোল- গাছেরাও কি সেটা থেকে মুক্ত? আমার তো মনে হয় না! আমার নিজের জীবন থেকেই একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে-

গত প্রায় একটা মাস ধরে আমি প্রতিদিন আমার সামনের গার্মেন্টসটার লাঞ্চ ব্রেক হবার জন্য গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে থাকি। সেখানে সকালের শিফটে কাজ করতে আসা একটা মেয়ের সাথে একই শিফটের আরেকজন ছেলের বেশ ভালো ভাব জমে গিয়েছে। লাঞ্চ আওয়ারে তারা প্রতিদিন দুপুরের খাওয়া শেষ করে আমার ছায়ার নীচে এসে দাঁড়ায়। মেয়েটি মাথা নীচু করে মিটি মিটি হাসে আর ছেলেটার কথা শোনে; মাঝে মাঝে মাটি থেকে মুখ তুলে সলজ্জ আগ্রহ আর গাঢ় আনন্দ নিয়ে ছেলেটার দিকে তাকায়।

কতক্ষণ গল্প করে তারা- দশ মিনিট? পনেরো মিনিট? সে পুরো সময়টা আমার গভীর ভালোলাগায় পার হয়ে যায়। অতিসাধারণ দুই মানব-মানবীর এই মুহূর্তের ভালোবাসাবাসিকে আমার মনে হতে থাকে স্বর্গীয় অনন্ত সময়ের স্নিগ্ধ কোন ছায়া। পৃথিবীতে বসে যে ছায়ার নাগাল পাওয়া যায় শুধু আলোকিত আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসার পবিত্র পথে হেটেই।

কিন্তু আসল সমস্যাটা অন্য জায়গায়, সেটা হোল- এদের দু'জনকে দেখলেই অবধারিতভাবে আমার আকাশমণির কথা মনে পড়া শুরু করে। দেখা যায়- ছেলেমেয়েদু'টি যার যার কাজে গার্মেন্টসে ফিরে যাবার পর থেকে বাকি সারাটা দিন আমার মন প্রচন্ড খারাপ হয়ে থাকে। আর মন খারাপ হবেই বা না কেন! কোনভাবেই যার কথা কখনো মনে করতে চাই না, যাকে রীতিমত জোর করে ভূলে থাকতে হয়- সেই তার স্মৃতিই যদি বারবার ফিরে ফিরে আসে, তাহলে....

আকাশমণি আর আমি- আমরা বয়সে ছিলাম প্রায় সমসাময়িক। এ এলাকায় আমাদের দু'জনের কাছাকাছি বয়েসের আর কোন গাছ ছিলো না, তাই আমাদের বন্ধুত্বটাও ছিলো একেবারে অন্য মাত্রার। আমি এমনিতে চুপচাপ স্বভাবের গাছ, আকাশমণির সাথে কথা বলবার সময় আরো চুপচাপ হয়ে যেতাম। আমার এই কম কথা বলা স্বভাবের কারণে- অনেক সময়েই দেখা যেত আকাশমণি আমার উপর রাগ করে বসে আছে। সে বিরক্ত গলায় বলতো- "তোর সাথে কথা বলা আর একটা ইটের সাথে কথা বলা একই...."

আমি হাসতাম, বলতাম- "খুব দ্রুতই তোর পাশে মাটিতে একটা ইটের চারা এনে পুতে দেবো। সেখান থেকে ইটগাছ বের হওয়ার পর তার সাথে যত খুশি গল্প করিস"

আমার রসিকতা শুনে আকাশমণি আরো রেগে যেতো। তীব্র গলায় বলতো- "তোর সাথে আর কথাই বলবো না..."

তার সে কঠিন প্রতিজ্ঞা একদিনও পুরোপুরি টিকতো না; রাত গভীর হলেই সে যেনো 'কিছুই হয় নি' এমন ভঙ্গিতে আবার আমার সাথে কথা বলা শুরু করতো- 'এই, ঘুমিয়ে পড়েছিস নাকি? শোন না, সামনের বাসার বাচ্চা মেয়েটা জানিস- আজকে একটা পুতুলের জন্য খুব কাদছিলো! শেষমেষ কাদতে কাদতেই একসময় বেচারি ঘুমিয়ে গিয়েছে। প্রথম প্রথম মেয়েটার বাবা- মার উপর আমার খুব রাগ হচ্ছিলো, সামান্য একটা পুতুলই তো। পরে বুঝতে পারলাম- সমস্যাটা আসলে আর্থিক। আমার এমন মন খারাপ হোল!"- বলে আকাশমণি সত্যি সত্যি খুব মন খারাপ করতো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতো- " মানুষের কত রকম সমস্যা থাকে, না?"

আকাশমণির যে গল্পগুলো আমাদের এই এলাকার অন্য কোন গাছেরা জানতো না, সেটা আমি জানতাম। যে কথাগুলো সে কাউকে কখনো বলে নি, সে কথাগুলো গোপনে সে আমাকে বলেছিলো।
"তোকে একটা কথা বলি, কাউকে বলিস না!"
তার কথা বলার এমন ভঙ্গি দেখে আমি অবাক হতাম না, কারণ আমি জানতাম আকাশমণির মাথায় সামান্য 'ছিট' আছে!
আকাশমণি ফিসফিস করে বলতো- "আমার না মাঝে মাঝে মানুষ হয়ে যেতে ইচ্ছা করে! মানুষেরা কি সুন্দর চাইলেই জায়গা বদল করতে পারে। মন চাইলো- আর পায়ে হেটে, কিংবা গাড়িতে করে এখান থেকে ঐখানে চলে গেলাম। এক জায়গায় থাকতে থাকতে বিরক্তি চলে আসছে, চলে গেলাম নদীর ধারে কিংবা সমুদ্র দেখতে। আর আমাদেরকে দেখ!" বলেই লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তো সে।
আমি খুব সহজে অবাক হই না, তারপরো আকাশমণির এ কথা শুনে অবাক হতাম খুব। লোভ, ঘৃণা, হিংসা আর নৃশংসতা দিয়ে পুরো সৃষ্টিজগতটাকে মানুষ যেভাবে কলুষিত আর অপবিত্র করে রেখেছে, তাতে গাছেরা যে কখনো মানুষ হতে চাইতে পারে- সেটা আমার ধারণায় ছিলো না। আমি আকাশমণিকে বলতাম- "এই কথা আমাকে বলেছিস, বলেছিস। আর কেউ যেনো তোর এই ধরণের উদ্ভট ইচ্ছার কথা না জানে।" বিশেষ করে বটগাছের কানে যদি এটা যায়- তাহলে কি হবে ভেবেই সে রাতে আমার ঘুম হোল না।

এভাবেই আমাদের দিন কেটে যাচ্ছিলো। কত রৌদ্রজ্জ্বল সকাল আর জোছনা বিধৌত রাত্রিরা এসে পরম আশীর্বাদে আমাদের দু'জনের জীবনকে এক সুতোয় গেঁথে দিয়ে যেতো! কত সহস্র চঞ্চল পাখি আকাশমণির ডালের স্পর্শ পায়ে মেখে উড়ে এসে বসতো আমার শাখায় ! বৃষ্টি এলেই আকাশমণিকে দেখতাম আনন্দে পাগলের মত হয়ে যেতো। শুধু আমি না, আমাদের এলাকার প্রতিটি গাছ তার এই বৃষ্টি-প্রিয়তার কথা জানতো। বৃক্ষ মাত্রই বৃষ্টি পছন্দ করে, তারপরো আকাশমণির বাড়াবাড়ি ধরণের বৃষ্টি- উচ্ছ্বাসের কারণেই হয়তো অন্যরাও বৃষ্টির সময় স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই আদিখ্যেতা দেখাতো।

গাছেরা এমনিতেই বেশিরভাগ সময় আনন্দে থাকে, তার উপর আকাশমণির মত একজনকে সঙ্গিনী হিসেবে পেয়ে যাওয়াতে আমার সুখ রীতিমত 'আকাশ' ছুয়েছিলো। আকাশমণি যখন তার গা ভর্তি করে ঝলমলে হলুদ ফুল ফুটিয়ে আমাকে লজ্জা লজ্জা গলায় বলতো- "এই দ্যাখ তো! আমাকে দেখে কেমন লাগছে?" তখন আমি মনে মনে কবিতা আবৃত্তি করতাম-

"...তবু এই পৃথিবীর সব আলো একদিন নিভে গেলে পরে,
পৃথিবীর সব গল্প একদিন ফুরাবে যখন,
মানুষ র'বে না আর, র'বে শুধু মানুষের স্বপ্ন তখনঃ
সেই মুখ আর আমি র'বো সেই স্বপ্নের ভিতরে। "

সে আকাশমণি মারা যায় বৈশাখের দ্বিতীয় দিন। সময়টা ছিলো দুপুরের ঠিক পর পর। সারাদিনের আবহাওয়া বেশ স্বাভাবিকই ছিলো। হঠাতই দুপুর সাড়ে তিনটা নাগাদ দিনের আলো নিভে চারদিক অশুভ এক ছায়ায় ঢেকে গেলো, সাথে হাল্কা বাতাস। দূর্বল সে সাধারণ বাতাসই ধীরে ধীরে ধ্বংস আর প্রলয়ের দেবতা হয়ে পাতাল থেকে জেগে উঠলো। তীব্র ঝড়টুকুর অস্তিত্ব ছিলো ঠিক পনেরো মিনিট। এ সামান্য সময়েই আমার চোখের সামনে আকাশমণির ডালগুলো দুমড়ে- মুচড়ে যেতে লাগলো আর আমি অসহায়ের মত সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে আছে- সে সময়টাতে আমি ঝড় বন্ধ হয়ে যাবার জন্য প্রার্থনা করি নি। প্রার্থনা করেছিলাম যেনো আমার দৃষ্টিশক্তিটাকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও কেড়ে নেয়া হয়!

আকাশমণির মৃত্যুতে সবাই কেদেছিলো- পূর্বের নিম, দক্ষিণের হিজল, তমাল আর করচ; মুরুব্বী বট, কাঠাল, আর আকাশমণির পাশের আমগাছগুলো, প্রফেসর সাহেবের বাড়ির সামনের ডালিম গাছটা- সবাই। কোন একটা বিচিত্র কারণে কাদতে পারি নি শুধু আমি। আমার কাছে পুরো ঘটনাটাকেই মনে হোত ভয়ঙ্কর কোন দুঃস্বপ্ন। শুধু মনে হোত- যে কোন মুহূর্তে আমার দুঃস্বপ্ন দেখা শেষ হয়ে যাবে। আমি জেগে উঠে শুনতে পাবো আকাশমণি বলছে- "এভাবে বেহুশের মত কেউ ঘুমায়! আমি কতোক্ষণ থেকে তোকে ডাকছি সে খেয়াল আছে!"

তার এ কথা শুনে হয়তো বটগাছ আকাশমণিকে ধমকে দেবে, রাগী গলায় বলবে- "বেচারা ঘুমাইতেছিলো তারে খালি খালি ডাকতে গেলি ক্যান! এতো অস্থিরতা কই থেইকা শিখছস? মানুষের কাছ থেইকা? শিখার জন্য যাইতে হয় প্রকৃতির কাছে, বুঝছস! মানুষ হইলো গিয়া শিক্ষক হিসাবে অতি নিম্নশ্রেণির...."

যাই হোক- আকাশমণির মৃত্যু শোক আমি অবশ্য বেশ অনেকটাই সামলে উঠেছিলাম। গাছেরা মানুষের মত এতো দীর্ঘ সময় 'নেগেটিভিটির' মধ্যে বাস করতে পারে না, সেটা যত বড় বিপর্যয় কিংবা ঝামেলাই হোক না কেন। কিন্তু আবার সমস্যা শুরু হোল গার্মেন্টসের এই ছেলেমেয়েদু'টির কারণে! তাদেরকে যতবার দেখি, ততবারই আমার আকাশমণির কথা মনে পড়ে; এবং আগে যেমনটা বলেছিলাম- তারা চলে যাবার পর থেকে পুরো সময়টা আমার ভয়ঙ্কর রকম মন খারাপ হয়ে থাকে। রাত গভীর হলে যখন একে একে নক্ষত্রেরা আকাশ-সমুদ্রে স্নানে নামে- তখন মন এতোটাই খারাপ হয় যে চিতকার করে বলতে ইচ্ছা করে - "পৃথিবীর মানুষেরা! তোমরা তোমাদের প্রিয় মানুষগুলিকে মন প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসো, আমার কোন আপত্তি নেই। আমি দূর থেকে তোমাদের সকলকে আশীর্বাদ করে যাবো। শুধু দোহাই- তোমরা কেউ আর আমার ছায়ায় দাঁড়িয়ে সে ভালোবাসার প্রকাশটুকু দেখিও না। আমার খুব কষ্ট হয়...."

অবাক ব্যাপারটা হোল- আমার সে মন খারাপ ভাবটুকু সকাল হতে না হতেই কেমন এক বিচিত্র অস্থিরতায় পালটে যেতো। শুধু দুশ্চিন্তা হোত; মনে হতে থাকতো- "আজ ছেলেমেয়েদু'টো আসবে তো? দেখতে পাবো তো আবার তাদের?".... হায়রে! কি চূড়ান্ত পরস্পরবিরোধীতাই না গাছেদেরকেও গ্রাস করে ফেলতে পারে! বটগাছ, মানুষের যে পরস্পরবিরোধী স্বভাবের কথা বলে প্রায়ই মেজাজ খারাপ করতেন- ভাগ্যিস তিনি আমার এ অধঃপতন দেখে যেতে পারেন নি! বেচে থাকলে নিশ্চই তিনি মহা বিরক্ত হতেন...

এই বেলা বলে রাখি- বটের জীবনের শেষ সময়টাও আসলে খুব একটা ভালো কাটে নি। মৃত্যুর কয়েকমাস আগ দিয়ে উনার মাথায় কিছুটা সমস্যা দেখা দিয়েছিলো। প্রায়ই শোনা যেতো বিড়বিড় করতেন। গভীর রাতে আমরা- গাছেরা যখন নিজেদের শরীরটাকে স্নিগ্ধ অন্ধকারে মিশিয়ে ফেলবার সাধণায় ডুবে যেতাম, তখন মাঝে মাঝেই তার উচু গলার প্রলাপ আমাদেরকে সে সমাহিত অবস্থা থেকে বাস্তবে ফিরিয়ে নিয়ে আসতো। আমরা শুনতাম তিনি অস্থির গলায় বলছেন- "সবাই শোন! ইট-পাথরের শহর আগায়া আসতেছে, তোমাদের সবাইকে গ্রাস করবে। কেউ তার হাত থেকে মুক্তি পাবা না। সাবধান, খুব সাবধান..."

পাগল-ছাগলের কথা ধরতে নেই, কিন্তু আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম- যাকে আমরা সবাই ভেবে নিয়েছিলাম মাথা-খারাপ বৃক্ষের অর্থহীন প্রলাপ, বটগাছ মারা যাবার মোটামুটি ছয়-সাত বছর পর থেকেই একে একে সে ভয়ঙ্কর কথাগুলো সত্য হতে শুরু করলো। প্রথমে গেলো আকাশমণির চারপাশের আমগাছগুলো। তারো বছরখানিক পর আমার সামনের কাঠালগাছটা আর তার পেছনের নারিকেল গাছেরা যে জায়গাটাতে ছিলো, সেটা ডেভেলপাররা নিয়ে নিলো। সারাক্ষণ ইটভাঙ্গার মেশিনের শব্দে কান মোটামুটি ঝালাপালা।

কিছুদিন আগ পর্যন্তও সামনের রাস্তাটা মোটামুটি ভালোই ছিলো। ফ্লাইওভারের কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে দিন দিন রাস্তাটার অবস্থা খারাপ থেকে আরো খারাপ হচ্ছে। ছাল চামড়া উঠে যাওয়া বাসগুলো এখনি ধুলার কুয়াশা তৈরি করে দুলতে দুলতে এবড়ো থেবড়ো রাস্তাটা কোনরকমে পার হয়ে যায়। সিএনজিতে বসে ঝাকি খেতে খেতে চলা মানুষগুলোকে দেখলে মনে হয়- এরা মানুষ নয়, সবুজ খাচায় আটকে থাকা বুদ্ধিহীন কোন প্রাণী।

এই শহরটাতে ইদানীং তো মানুষেরই জায়গা হয় না, সেখানে গাছেদের জায়গা হওয়াটাতো আরো অনেক দূরের ব্যাপার। এখনই যেমন আমার চারপাশে বিশ-পচিশ হাতের মধ্যে গাছের সংখ্যা কমতে কমতে মোটে চারটিতে এসে ঠেকেছে। ওরাও সবাই খুব ভয়ে ভয়েই প্রতিটা দিন পার করে। এদের মধ্যে বয়েসে সব থেকে ছোট একটা বেলগাছ- সে প্রায়ই আমাকে দুঃখী গলায় বলে- 'ভাই, খুব ভয় লাগতেছে। কবে জানি কাইটা সরায়া ফেলে...'

আমি তাকে ভরসা দেই, বলি- "তুমি যে জায়গাটাতে আছ, সেটার কোন মূল্য নাই; জায়গাটা এতোটাই চিপা যে সেখানে এপার্টমেন্ট তো দূরের কথা, একটা টং-এরও জায়গা হবে না। সুতরাং, তোমাকে শুধুশুধু কেটে ফেলার সম্ভাবনাও খুব কম, ভয়ের কিছু নাই রে ভাই।"

বোকা ছেলেটা আমার কথা শুনে খুব খুশি হয়, বড় মায়া লাগে আমার! আমি মনে মনে প্রার্থনা করি- 'আমার আয়ু থেকে খানিকটা হলে নিয়েও যেন বেলগাছটাকে দিয়ে দেয়া হয়। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে বাঁচুক আরো কয়েকটা দিন। ভরা পূর্ণিমায় মনের আনন্দে আরো কিছুটা সময় সাঁতরে বেড়াক জোছনার মহাসমুদ্র।'

আমার নিজের অবশ্য ভয়-টয় খুব একটা লাগে না, কারণ একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর গাছদেরকে অজানা অনেক কিছুই জানিয়ে দেয়া হয়। বিশেষ সে জ্ঞানের কারণেই আমি জানি- মৃত্যুতেই সব কিছুর শেষ নয়! বরং আরেক রহস্যময় জীবনের শুরু মাত্র। সমাপ্তির শূণ্যতাটা ভয়ের, রূপান্তরকে তো ভয় পাবার কিছু নেই।

তবে ভয় না লাগলেও- আমার ক্লান্ত লাগে খুব। আমার পাতায় পাতায় জমে থাকা ধুলোর আবরণটাকে বয়ে বেড়ানোর ক্লান্তি, এ শহরের বঞ্চনা আর দুঃখগুলোকে চেয়ে চেয়ে দেখবার ক্লান্তি, গড়ে ওঠা সভ্যতার মাঝখানে নিজেকে বিসদৃশ আর অনাহূত মনে হতে থাকবার ক্লান্তি... বেশিরভাগ সময়েই কল্পনা করতে চেষ্টা করি- ইট-পাথর আর আবেগ-অনুভূতিহীন যন্ত্র- যে শহরটাকে ক্রমাগত গ্রাস করে চলেছে- আমি আসলে সেখানকার কেউ নই। হয়তো দূরের কোন শান্ত- সমাহিত গ্রামে, কোন বিস্তৃত, বিশাল ধানখেতের মাঝখানে আমি দাঁড়িয়ে আছি! চারপাশে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ ধানের খেত আর দূরে হালকা নীল পাহাড়ের স্বপ্নময় আভাস...

ধীরে ধীরে আমার কাছে কল্পনার সে জগতটাকেই সত্য বলে মনে হতে থাকে, বাস্তবতাকে মনে হয় হয় বিভ্রম। মনে হয়, এইতো- আমি তো আসলেই ধানখেতে দাঁড়িয়ে আছি। আশেপাশে কোথাও কেউ নেই, শুধু আমার খুব কাছেই একটা আকাশমণি গাছ, আমার ডালপালাগুলো যে গাছের শরীর স্পর্শ করে! মাঝে মাঝেই সেখানকার আকাশে কাজল-কালো মেঘেরা ঘন হয়ে জমা হয়। সেখানকার বজ্র কানে তালা লাগানো শব্দ তুলে মাটিকে আঘাত করে না, শুধু তার চোখ ধাধানো অথচ কোমল আলো এঁকেবেঁকে আকাশের গায়ে অপূর্ব সব কারুকাজ তৈরি করে দেয়। সে জগতের বাতাস কখনো ঝড়ে রূপ নেয় না, শুধু ধানের মাথায় আদর বুলিয়ে দূর পাহাড়ের গায়ে মিশে যায়।

সেখানে চারপাশ অন্ধকার করে বৃষ্টি নামে। বৃষ্টিতে নিজের ডালগুলোকে আকাশের দিকে বিছিয়ে দিয়ে মনের আনন্দে ভিজতে দেখা যায় এক মায়াবতী আকাশমণিকে। তার পাতায় পাতায় বৃষ্টির ফোটা পড়ে তৈরি হয় মনে হাহাকার জাগিয়ে তোলা অদ্ভূত কোন সঙ্গীত, যার ছন্দে হৃদয়ের গহীন থেকে উঠে আসে প্রিয় কাউকে ধরে রাখতে না পারার বেদনা; তাকে কাছে পেয়েও হারিয়ে ফেলবার তীব্র দুঃখবোধ।

কল্পনা বাস্তবের মত নিষ্ঠুর নয় বলেই আমার সে দুঃখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। গভীর ভালোলাগার এক স্বর্গীয় অনুভূতি নিয়ে আমি আকাশমণির দিকে তাকিয়ে থাকি। বৃষ্টি থেমে যাবার পর ভেজা হাওয়ায় তার গা থেকে একটি দু'টি পাতা উড়ে এসে আমার গায়ে পড়ে। আমি যত্ন করে সে পাতাগুলোকে আমার পাতার সাথে মিলিয়ে দেই; আকাশমণি আমার কান্ড দেখে হাসে।

কল্পনার সে মায়াপুরীতে আমি রংধনুর জন্য অপেক্ষা করি না। আমি শুধু অপেক্ষা করে থাকি আরেক পশলা বৃষ্টির!

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৩ রা মে, ২০১৫ রাত ৮:৫৯

~~অপরিচিত অধ্যায়~~ বলেছেন: অনেক সুন্দর হয়েছে :)

০৭ ই মার্চ, ২০১৬ রাত ১১:৩০

পুলহ বলেছেন: সময় নিয়ে পড়বার জন্য ধন্যবাদ !

২| ১০ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:১৫

এহসান সাবির বলেছেন: গাছের আত্মকথন ভালো লাগল।

শুভেচ্ছা।

১০ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:১৮

পুলহ বলেছেন: ধন্যবাদ! অনেক অনেক ধন্যবাদ! :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.