নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

...

পুলহ

পুলহ › বিস্তারিত পোস্টঃ

হিমুর চলে যাওয়া..

০১ লা জুলাই, ২০১৫ রাত ৮:৩২

[আমার কথাঃ হুমায়ূন আহমেদ মারা যান নিউইয়র্কে, তারিখটা ছিলো এ মাসেরই ১৯ তারিখ, অর্থাৎ- ১৯ জুলাই ২০১২। খবরটা শোনার পর আমি অত্যন্ত অবাক (এবং কিছুটা লজ্জিত) হয়ে লক্ষ্য করলাম- অন্যতম প্রিয় লেখকের মৃত্যুতে যতটা না দুঃখ পাওয়া উচিত ছিলো, আমার আসলে ততটা খারাপ লাগছে না! বরং দুঃখ, শোক সব ছাপিয়ে অদ্ভূতভাবে সে সময়ে প্রবল হয়ে উঠেছিলো লেখালেখির একটা সুতীব্র বাসনা! কি লিখব জানি না, আদৌ লিখতে পারবো কি না- সেটাও জানি না! শুধু জানি- "লিখতে হবে ! স্যারের স্মৃতিতে কিছু একটা হলেও লিখে রাখতে হবে.."

সে কঠিন সময়কার লেখালেখিরই এক পূর্ণাংগ রূপ হোল নীচের এই গল্পটি!

আর কথা না বাড়িয়ে গল্পের ভুবনে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি..।]


গল্পঃ হিমুর চলে যাওয়া....
[আমার কথাঃ হুমায়ূন আহমেদ মারা যান নিউইয়র্কে, তারিখটা ছিলো ১৯ জুলাই ২০১২। খবরটা শোনার পর আমি অত্যন্ত অবাক (এবং কিছুটা লজ্জিত) হয়ে লক্ষ্য করলাম- অন্যতম প্রিয় লেখকের মৃত্যুতে যতটা না দুঃখ পাওয়া উচিত ছিলো, আমার আসলে ততটা খারাপ লাগছে না! বরং দুঃখ, শোক সব ছাপিয়ে অদ্ভূতভাবে সে সময়ে প্রবল হয়ে উঠেছিলো লেখালেখির একটা সুতীব্র বাসনা! কি লিখব জানি না, আদৌ লিখতে পারবো কি না- সেটাও জানি না! শুধু জানি- "লিখতে হবে ! স্যারের স্মৃতিতে কিছু একটা হলেও লিখে রাখতে হবে.."
সে কঠিন সময়কার লেখালেখিরই এক পূর্ণাংগ রূপ হোল নীচের এই গল্পটি!
আর কথা না বাড়িয়ে গল্পের ভুবনে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি..।]
এখন বাজছে দশটা দশ।
হিমুর হাতে অবশ্য কোনো ঘড়ি নেই, তারপরো সে বুঝতে পারছে এখন ঠিক দশটা দশই বাজে- এর এক মিনিট বেশীও না, কমও না। সে চাইলেই কারো কাছ থেকে সত্যি সময়টা জেনে, তার অনুমানের সাথে সেটাকে মিলিয়ে নিতে পারে; কিন্তু হিমু সেটা করবে না। কারন যতক্ষন পর্যন্ত সে আসল সময়টা না জানছে, ততক্ষন একটা ফিফটি-ফিফটি চান্স থেকেই যায় অনুমানটুকু সত্যি হবার; অনেকটা শ্রোডিঞ্জারে সাহেবের বিড়ালের মত অবস্থা। যখনি সে সত্যি সময়টা দেখে ফেলবে- তখনি ওয়েভ ফাংশান কলাপস করবে। হিমুর কথা হোল- কি দরকার শুধু শুধু একটা নিরীহ বিড়াল বেচারার জীবনের ঝুকি নিয়ে!
হিমু হাটতে শুরু করেছে, তার অপারেশান আগামীকাল সকাল ১১ টায়। সুতরাং সব মিলিয়ে এখনো প্রায় ২৪ ঘন্টার মত সময় হাতে আছে। সে হাটতে হাটতে তার আজকের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। মানুষ যখন জানতে পারে যে সে আর মাত্র চব্বিশ ঘন্টা বেচে আছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই সে অস্থির হয়ে পড়ে। কিন্তু হিমুর কথা আলাদা- তার মধ্যে এই মুহূর্তে তেমন কোনো অস্থিরতা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না।
হিমুর আজকের দিনের কর্মপরিকল্পনা অবশ্য আশ্চর্য রকমের সহজ। সে প্রথমে হেটে হেটে তার মেসে চলে যাবে, সেখানে গিয়ে দু'বালতি পানি খরচ করে খুব ভালো মত একটা গোসল সারবে। তারপর আবার হাটতে বের হবে; সারা দিনে এই ঢাকা শহরে তার যত প্রিয় মুখগুলি আছে তাদের সাথে দেখা করবে, কিছুক্ষন সে মানুষগুলোর সাথে সময় কাটাবে। তারপর রাতে মেসে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়বে। তার অবশ্য ইচ্ছা ছিলো রাত জেগে জীবনে শেষ বারের মত জোছনা দেখার (আজ আবার পাকচক্রে পূর্নিমা), কিন্তু ডাক্তার হিমুকে খুব বুঝিয়ে শুনিয়ে সেটা করতে মানা করে দিয়েছেন। একজন মানুষ রুঢ় ভাবে একটা জিনিস বললে সেটার অবাধ্য হতে ইচ্ছা করে, কিন্তু কেউ যখন তার চেয়ার থেকে উঠে এসে কাধে হাত রেখে নরম গলায় একটা কথা বলে- সেটার অবাধ্য হতে ইচ্ছা করে না।
হিমু যখন ডাক্তার সাহেবকে তার রাত জেগে জীবনে শেষ বারের মত জোছনা দেখার কথাটা বলেছিলো, তখন নেফ্রোলোজির সার্জন অধ্যাপক ডঃ আসগর আলী তেমন একটা অবাক হন নি। তিনি দীর্ঘ দিন যাবত ডাক্তারী করছেন; আজ পর্যন্ত বহু রোগিকে দেখেছেন মৃত্যু নিশ্চিত জেনে কমবেশী সবাই এলোমেলো আচরন করে। তাই সামনে বসা হলুদ পাঞ্জাবীর এই যুবকটিকে তিনি শুধু কথার পিঠে কথা হিসেবেই ভদ্রতা করে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে- সে কেনো জোছনা দেখতে চাচ্ছে। তবে এর জবাবে হিমু নামের এই ছেলেটি যা বললো সেটি শুনে সামান্য একটু হলেও ভেতরে ভেতরে তিনি নাড়া খেয়েছেনঃ
'ডাক্তার সাহেব, আমি যাকে আমার এই কিডনী দুটো দিয়ে যাবো, সেই রুপার সাথে আমার জীবনে আর কোনদিন, কখনো দেখা হবে না। আর জোছনা এমন একটা ব্যাপার- যেটা সবার মধ্যেই কমবেশী ঘোর তৈরী করে। তাই আমি চাই সামান্য একটু সময়ের জন্য হলেও বিভ্রম আর বিভ্রান্তির জগতে গিয়ে শেষবারের মত রুপার পাশে বসে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে।'
ডঃ আসগর তার কথা শুনে কিছু বলেন নি, শুধু তার চোখ থেকে চশমাটা খুলে টেবিলের ওপর রেখেছিলেন।
হিমু হাটতে হাটতে তার মেসের কাছাকছি চলে এসেছে। মেসে ঢোকার সময় সে দেখে মেসের নতুন ম্যানেজার জয়নাল- পুরানো ঢাকার মানুষজনের ঢঙ্গে লুঙ্গিটাকে এক হাতে ধরে আট-দশ বছরের এক ছেলেকে আঙ্গুল নাড়িয়ে নাড়িয়ে শাসাচ্ছেন। জয়নাল সাহেব পুরান ঢাকার মানুষ নন বলেই খুব সম্ভবতঃ তার লুঙ্গীটাকে ঠিকমত ধরে তুলতে পারেন নি, সেটা একরকম বিপদজনকভাবে হাটুর উপর উঠে আছে। আর বাচ্চা ছেলেটা তার সাইজ ছোট হওয়ার দরুনই বোধহয় লুঙ্গীর নীচ দিয়ে বিশেষ কিছু দেখতে পাচ্ছে। সে জয়নাল মিয়ার মুখের দিকে না তাকিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সেদিকে।
হিমুকে দেখে জয়নাল লোকটি কেমন যেনো চুপসে গেলো; সে যে কোনো কারনেই হোক তাকে খুব ভয় পায়। হিমু গম্ভীর মুখে এগিয়ে গেলো তার দিকে।
"কি জয়নাল সাহেব, খবর টবর সব ভালো।"
"জ্বী হেমু ভাই, আপনে আছেন কেমন? একটু শুকায়া গেছেন মনে হইতেছে।'- হঠাত করেই তাকে হিমুর স্বাস্থ্য নিয়ে অতিরিক্ত রকমের ব্যাস্ত হয়ে পড়তে দেখা যায়।
হিমু তার কথার জবাব না দিয়ে বললোঃ "এতটুকু একটা বাচ্চাকে এভাবে ধমকাচ্ছেন কেনো?"
"আরে আর বইলেন না, হারামজাদা বিরাট বদ। হইছে কি......"
"কিছু মনে করবেন না, কি হয়েছে আমি সেটা শুনতে চাচ্ছি না। বাদ দিন না, বাচ্চা একটা ছেলে..."
এটা বলেই হিমু আর অপেক্ষা করলো না, সিড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে তার রুমে ঢুকে পড়লো। নষ্ট করার মত সময় তার হাতে একেবারেই নেই। জয়নাল কিছুক্ষন কটমট করে বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে থেকে সেও হিমুর পেছন পেছন মেস বিল্ডিঙ্গে ঢুকে পড়ে।
*
হিমু যখন মাজেদা খালার বাসায় পৌছুলো, তখন সূর্য প্রায় মাথার উপর উঠে এসেছে। মাজেদা খালার দারোয়ান তাকে দেখে বিরস মুখে গেট খুলে দিলো। হিমু ইট বিছানো রাস্তা ধরে এগিয়ে মাজেদা খালার কলিংবেলে যেই হাত রাখতে যাবে, এমন সময় শুনতে পায় ভেতর থেকে মাজেদা খালার উত্তেজিত কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে খালুর সাথে ঝগড়া করছেন। ঝগড়াটা খুব সম্ভব খালা একাই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, কারন খালু সাহেবের কোনো কথা বাইরে থেকে শোনা যাচ্ছে না। তাছাড়া মাজেদা খালা কিছু একটা বললে খালুর অবশ্য সামনাসামনি সেটার প্রতিবাদ করে কিছু বলার মত সাহসও নেই।
অন্য সময়ে হলে এরকম পরিস্থিতিতে হিমু বাসায় ঢোকার চিন্তা বাদ দিয়ে পালিয়ে যেতো, কিন্তু আজকের কথা আলাদা। হিমু কলিংবেলে হাত রাখলো, মুহূর্তে ভেতরের সব কোলাহল থেমে গেলো। মাজেদা খালা দরজা খুলে হিমুকে দেখে কিছুটা আশ্বস্ত হলেন। তার দিকে তাকিয়ে বললেনঃ 'ভালোই হয়েছে তুই এসেছিস, আজ এর একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বো। আয় আমার সাথে।'
খালা হিমুর হাত ধরে তাকে টেনে ভিতরে নিয়ে যাবার সময় হিমু বললোঃ "খালা, তুমি দরজা বন্ধ করতে ভূলে গেছো। দরজাটা আটকে দিয়ে আসি? তাহলে আবার নতুন উদ্যমে তোমরা তোমাদের ঝগড়া শুরু করতে পারবে, বাইরের কেউ শুনে ফেলার ভয়ও থাকবে না।'
"রসিকতা করবি না হিমু, মন মেজাজ ভালো না। সকালে নাস্তা করেছিস??"
"না"
"সোজা টেবিলে গিয়ে বস, আমি তোর জন্য নাস্তা নিয়ে আসছি; খবরদার ওই বুড়ো শয়তানটা তোকে ডাকলেও কিন্তু তুই যাবি না; মনে থাকবে??"
"অবশ্যই।"
হিমু নাস্তার টেবিলে গিয়ে বসে, মাজেদা খালা চলে যান রান্নাঘরের দিকে। খালার পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশের ঘর থেকে খালু সাহেব পর্দা সরিয়ে শুধু তার মাথাটা বের করে উকি দেন। হিমুর কাছে মনে হোল, পর্দা ফাক করে বুঝি একটা করোটি উকি দিয়েছে। খালু হিমুকে দেখে আকাশের চাদ হাতে পেলেন। তোতলাতে তোতলাতে বললেনঃ'আরে হিমু যে!! খুব ভালো সময়ে এসেছো। আমার উপর তোমার খালার মেজাজটা একটু ইয়ে হয়ে আছে। দেখোনা, একটু ম্যানেজ করতে পারো কি না। তোমাকে খুব স্নেহ করেন তো, তোমার কথা ফেলতে পারবেন না। তোমার খালার মেজাজটা ঠান্ডা করে দিয়ে যেতে পারলে আমি পরের পহেলা বৈশাখে তোমাকে পান্তা-ভাত আর ইলিশ খাওয়াবো, সে ইলিশ যত দামই হোক! আই কিপ মাই ওয়ার্ডস......'
খালুর বোধহয় আরো কিছু বলার ছিলো, কিন্তু মাজেদা খালার পায়ের শব্দ শুনে তিনি কচ্ছপের মত চুলুক করে মাথাটা পর্দার ভিতরে ঢুকিয়ে ফেললেন। কচ্ছপ যেমন বিপদ দেখলেই খোলসের ভেতর তার মাথাটা ঢুকিয়ে ফেলে, খালু সাহেবও খুব সম্ভবত এখন সেই স্টেজে আছেন। তার কাছে মাজেদা খালার চেয়ে বড় বিপদ এই মুহূর্তে বোধহয় আর কিছুই না।
খালা টেবিলে এসে হিমুর পাশে বসলেন, হিমু খালার দিকে তাকিয়ে বললো, "আমার নাস্তা কই?"
"আসছে, কাজের মেয়েটাকে পরটা ভাজতে বলে এসেছি। এখন শোন তোকে কি বলি, সব সমস্যা এই কাজের মেয়েটাকে নিয়ে। মেয়েটার বয়স সতের-আঠারো, চেহারা দেখতে ভালো না; কিন্তু শরীরটা ভালো। তোর খালুকে দেখি বাবু সাহেব সুযোগ পেলেই মেয়েটাকে দিয়ে কাজ করায়। আমি করলাম কি- একদিন খেতে বসে হাতে-নাতে ব্যাটাকে ধরলাম, দেখি কি জানিস!! বাবু সাহেব মেয়েটার বুকের দিকে তাকিয়ে বলছেন- ও সুরাইয়া, ডালের বাটিটা দাও তো! অথচ টেবিলে কোনো ডালের বাটিই নেই, চিন্তা কর অবস্থা। বুড়ো বয়সে ভীমরতি হলে যেটা হয় আর কি......"
''মেয়েটাকে বিদায় করে দাও না কেনো?'
'গাধার মত কথা বলিস না তো হিমু। ভরা বয়সের একটা মেয়ে- আমরা বের করে দিলে যাবে কোথায়? শেষে কি না কি বিপদে পড়ে।'
'সেটাও তো কথা'
খালা কিছু একটা বলতে গিয়ে হঠাত করে থেমে যান, কারন সেই মুহূর্তে কাজের মেয়েটিকে দেখলাম নাস্তা নিয়ে ডাইনিং রুমে ঢুকছে। হিমু খালাকে বললোঃ "খালা ডিমভাজি খেতে ইচ্ছা করছে। বেশী করে পেয়াজ-মরিচ দিয়ে কড়া করে ডিমভাজি।"
"তুই গরুর মাংস দিয়ে খেতে থাক, আমি ভেজে নিয়ে আসছি। আর কিছু??"
"না, আপাতত এতেই চলবে।"
খালার পায়ের শব্দ মিলিয়ে যেতেই খালু আবার পর্দার ফাক দিয়ে তার মাথাটা বের করলেন। খুব সম্ভব তিনি পর্দার আড়ালে থেকে আমাদের কথাবার্তা সব শুনছিলেন। খালু প্রায় কাদো কাদো হয়ে মেয়েদের মত চিকন গলায় বললেন,
"হিমুরে বিশ্বাস কর, আমি এগুলো কিছুই করি নি। সবার মত আমার ভেতরো অনেক খারাপ জিনিস আছে, কিন্তু আমি এতোটা নীচে কখনো নামবো না।( খালু সাধারনতঃ হিমুকে তুমি তুমি করে বলেন, এখন বোধহয় তিনি অতিরিক্ত ইমোশোনাল অবস্থায় আছেন দেখে তাকে তুই তুই করছেন ) একদিন শুধু খেতে বসে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে সে খেয়েছে কি না? সেই থেকেই তোর খালার ধারনা হয়েছে যে কাজের মেয়েটাকে নিয়ে আমার বোধহয় খারাপ কোনো মতলব আছে......'
খালুর কথা শেষ না হতেই আবারো মাজেদা খালার পায়ের শব্দ পাওয়া গেলো, খালু আবার যথারীতি দেখার মত দ্রুততায় তার মাথাটা পর্দার ভেতরে ঢুকিয়ে ফেললেন। হিমু মুখ ভর্তি খাবার নিয়ে মাজেদা খালার দিকে তাকিয়ে বললোঃ "হ্যা, তারপর বলো।"
"খাওয়ার সময় এসব ঝামেলার কথা শুনে লাভ নেই, আরাম করে খা তো! তোর খাওয়া শেষ হোক, তারপর কথা বলবো।'
হিমু পেট ভরে নাস্তা করলো, নাস্তার পর গরম এক কাপ চা খেলো। তারপর টেবিল থেকে উঠে দাড়াতে দাড়াতে খালাকে বললোঃ 'যাই খালা'
মাজেদা খালা চোখ বড় বড় করে বললেনঃ' যাই মানে, দুপুরে খেয়ে-টেয়ে তারপর যাবি'
'না খালা, আমার এখনি যেতে হবে; কাজ আছে।'
'বাজে কথা বলিস না হিমু। তোর আবার কিসের কাজ?'
'বেকারদের কাজই তো সব থেকে বেশী খালা, আসি।'
খালা হিমুর পেছন পেছন দরজা পর্যন্ত এলেন। হিমু দরজা দিয়ে বেরিয়ে আবার পেছন দিকে ঘুরলো।
'কি রে বাবা, কিছু বলবি?'
'খালা, আমি যদি তোমাকে একটা অনুরোধ করি তুমি রাখবে?'
মাজেদা খালা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে হিমুর দিকে তাকিয়ে থেকে বললেনঃ 'তোর কি হয়েছে রে হিমু?'
'আমার কিছুই হয় নি। আমি হিমু না!! হিমুদের কখনো কিছু হয় না।'
'থাপড়ায়ে তোর হিমুগিরি বের করবো ফাজিল ছেলে.....'
হিমু খালার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো; মাজেদা খালা চোখ নামিয়ে নিতে পারলেন না, এতো সুন্দর করে একজন মানুষ হাসে কেমন করে? খুব ব্যাস্ত হয়ে তিনি হিমুর বুকে একটু থুতু ছিটিয়ে দিলেন- এতে নজর লাগার দোষ কাটা যায়। ছেলে-মেয়েদের উপর মা-খালাদের নজরই বেশী লাগে।
'খালা, তুমি নিজেও জানো খালু তোমাকে কতটা ভালোবাসে, উনি মানুষ হিসেবে কেমন সেটাও তোমার খুব ভালো মত জানা। তারপরো তার সাথে এই রকম কেনো কর? আর এরকম করবা না, ঠিক আছে?'
খালা বললেনঃ 'এই তোর অনুরোধ, আমি তো ভেবেছিলাম কি না কি! আচ্ছা যা, ঠিক আছে......'
হিমু নরম গলায় বললোঃ 'তুমি এতো ভালো কেনো খালা?'
মাজেদা খালা কিছুক্ষন হিমুর দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর হঠাত করেই গভীর মমতায় হিমুকে জড়িয়ে ধরলেন। হিমু আজ পর্যন্ত কখনো তার বাবার কথার অবাধ্য হয়নি; এই প্রথম সে সেটা অমান্য করলো। হিমুর বাবা বলে গিয়েছিলেনঃ
'বাবা হিমালয়- সর্বাবস্থায় মানুষের ভালোবাসার আলিঙ্গন এড়াইয়া চলিবে। ইহা একাই নিশ্চিতভাবে তোমাকে মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ করিবার জন্য যথেষ্ট। সবসময় মনে রাখিবে যে, মহাপুরুষ মাত্রই জাগতিক সকল কিছুর মায়া হইতে মুক্ত। একজন মহাপুরুষের ভেতর প্রবল মায়া থাকিবে, কিন্তু সে কখনোই, কোনো অবস্থাতেই মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ হইবে না। তাই কারো ভালোবাসার আলিঙ্গন যেনো কখনই বেশী সময় ধরিয়া তোমার চিন্তা-চেতনাকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিতে না পারে......'
হিমু তার খালার মাথায় আলতো করে চুমু খেলো, তারপর বললোঃ 'যাই তাহলে খালা।'
'আবার কবে আসবি?'
হিমু সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। সে স্পষ্ট বুঝতে পারে মাজেদা খালা এখনো দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন; যতক্ষন না হিমু মেইন গেট দিয়ে বেরুবে, ততক্ষন তিনি একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন। খালা কি কিছু অনুমান করতে পেরেছেন? মাতৃস্থানীয় মানুষেরা আগে আগে অনেক কিছু টের পায়।
হিমু গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।
*
হিমুর পরবর্তী গন্তব্যস্থল ধানমন্ডি থানা। ওসি কামরুলের সাথে বহুদিন ধরে তার কোনো দেখা সাক্ষাত নেই, বদলি হয়ে গেছেন কি না কে জানে! বদলি হয়ে থাকলে ভালো সমস্যা, তাহলে মৃত্যুর আগে আগে শেষ বারে মত একজন প্রিয় মানুষের সাথে দেখা হয়তো নাও হতে পারে।
হিমু থানার গেট দিয়ে ঢুকে ওসির রুমে উকি দিলো। ওসি সাহেব হিমুকে দেখে শুকনো গলায় বললেনঃ'ভেতরে আসুন'
হিমু চেয়ারে বসতে বসতে বললোঃ 'যাক আপনি আছেন তাহলে, আমি তো ভেবেছিলাম বদলি হয়ে গেলেন কি না।'
'এখনো হই নি, তবে বদলির কথাবার্তা চলছে। চা খাবেন?'
'খেতে পারি।'
ওসি সাহেব চায়ের কথা বলে হিমুর দিকে তাকিয়ে বললেনঃ 'এখন বলুন, কি জন্য এসেছেন? থানাওয়ালা মানুষদের কাছে সমস্যা ছাড়া কেউ আসে না।'
'তা ঠিক, তবে আমি কিন্তু গল্প করতেই এসেছি।'
ওসি কামরুল হিমুর দিকে কিছুক্ষন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতেই বললেনঃ 'ঠিক আছে, গল্প করুন। আমি শুনছি।'
'কিসের গল্প শুনবেন, একটা হাসির গল্প বলি?'
'বলুন।'
অনেকদিন ধরে লস খাওয়ার পর এক বাংলাদেশী পোল্ট্রি ব্যবসায়ী একবার ক্ষেপে গিয়ে তার মুরগীগুলোকে বললেন,
“কালকে থেকে যদি প্রতিদিন যদি ২টা করে ডিম না দেস তাইলে ধইরা জবাই কইরা খায়া ফালামু!!”তো এরপর থেকে প্রত্যেকটা মুরগীই প্রতিদিন ২টা করে ডিম পাড়তে লাগলো, শুধু একটা বাদে। ঐটা অন্যগুলোর মত প্রতিদিন দুইটা করে ডিম না পেড়ে একটা করে ডিম দিতে লাগলো!!সেটা দেখে ওই ব্যবসায়ী ক্ষেপে গিয়ে বললেন, “কিরে!! তোর তো সাহস কম না!! এতো বড় হুমকি দিলাম, এরপরও তুই প্রতিদিন একটা কইরাই ডিম পারতেছস!!”
তিনি উত্তর পেলেন, 'জনাব!! আপনার ভয়ে তাও তো বহু কষ্টে একটা কইরা ডিম পারতেছি!! আমি তো আসলে মোরগ!!'
ওসি সাহেব গল্প শুনে কিছুক্ষন চুপ করে রইলেন, তারপর ঘর কাপিয়ে হাসতে লাগলেন। হিমু চা শেষ করে চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে ওসি সাহেবকে বললোঃ 'আপনি বোধহয় জানেন না, আপনার হাসি খুব সুন্দর। সব সময় হাসি খুশি থাকতে চেষ্টা করবেন। অপরাধীদের পেছনে ছুটতে হলেই যে সব সময় মুখ গোমড়া করে থাকতে হবে, এমন তো কোনো কথা নেই।'
ওসি সাহেব বললেনঃ 'আপনার কথাটা আমি মনে রাখবো হিমু। তবে কি জানেন, মানুষ কিন্তু পুলিশের মুখে হাসি দেখলে আরো ভড়কে যায়।'
হিমু দৃঢ় গলায় বললোঃ 'ভড়কাবে না। ভবিষ্যতে পুলিশ হবে মানুষের সত্যিকারের সেবক; বাংলাদেশের মানুষ তখন শুধু কথায় না, কাজেও পুলিশকে জানবে তাদের পরম বন্ধু হিসেবে।'
ওসি কামরুল হিমুর কথা শুনে হকচকিয়ে গেলেন। কিছুক্ষন চুপ থেকে মৃদু গলায় বললেনঃ 'সত্যি, আপনি মাঝে মাঝে এমনভাবে কথা বলেন যে বুকে ধাক্কার মত লাগে। শুনে মনে হয় আপনি বুঝি সবকিছু চোখের সামনে পরিষ্কার দেখতে পারছেন।'
হিমু হাসতে হাসতে বলেঃ “ মানুষকে ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতা দেওয়া হয় নি। তবে তার থেকেও বড় ক্ষমতা মানুষের আছে!”
ওসি সাহেব অবাক গলায় বলেন- “সেটা কি?”
“স্বপ্ন আর আশা” – বলেই হিমু উঠে দাঁড়ালো। তারপর ওসি কামরুলের সাথে জীবনে প্রথমবারের মত হ্যান্ডশেক করে মনে মনে বললোঃ 'ভালো থাকবেন ওসি সাহেব। আপনার মত সৎ পুলিশ অফিসারদের এ দুঃখী দেশটার খুব বেশী প্রয়োজন।'
ওসি কামরুল হিমুর সাথে হাত মেলাতে গিয়ে চমকে উঠলেন, তার কেনো জানি স্পষ্ট মনে হোল হিমু নামের হলুদ পাঞ্জাবীর মানুষটি এই মাত্র তাকে কিছু একটা বললো।
*
হিমু যখন বাদলদের বাসার সামনে এসে দাড়ালো, সময়টা তখন বিকেল। কি কারনে যেনো বাদলদের বাসার সদর দরজা হাট করে খোলা। হিমু খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে সোজা বাদলের রুমে হাজির হল। বাদল শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলো, হিমুকে দেখে তড়াক করে শোয়া থেকে বিছানায় উঠে বসলোঃ
'আরে, হিমুদা। কখন এলে?'
'এসেছি মাত্রই, তোদের বাসার দরজা এরকম খোলা কেনো? বাসায় কেউ নেই?'
'আগে তোমার সেকেন্ড কোশ্চেনটার এনসার দেই। না বাসায় কেউ নেই। সবাই মিলে সেন্ট মার্টিন বেড়াতে গেছে।'
'তুই গেলি না কেনো?'
'আমার এগুলো ভালো লাগে না হিমুদা।'
'ভালো না লাগলে তো না যাওয়াই উচিত। তা দরজা খোলা রেখেছিস কেনো, এমনিতেই বাসায় কেউ নেই......'
'একটা এক্সপেরিমেন্ট করছি হিমুদা। বাসায় কেউ নেই দেখেই তো এক্সপেরিমেন্টটা করার সুযোগ পাচ্ছি। আব্বু- আম্মু থাকলে তো ইয়ে......'
'কি এক্সপেরিমেন্ট?'
'তুমি যেমন সবসময় তোমার মেসের দরজা খোলা রেখে ঘুমাও, কিন্তু তোমার ঘর থেকে কখনোই কিছু চুরি হয় না; তেমনি আমিও পরীক্ষা করে দেখতে চাচ্ছি, আমরা, মানে সাধারন মানুষেরা দরজা খোলা রেখে দিলে আমাদের ঘর থেকে কিছু চুরি যায় কি না।'
'তা এখন পর্যন্ত এক্সপেরিমেন্টের রেজাল্ট কি?'
বাদল আনন্দিত গলায় বললোঃ 'কালকে রাতে টিভিটা চোরে নিয়ে গেছে হিমুদা। আমি অবশ্য জানতাম এমনটাই হবে। তোমার রুম থেকে কিছু চুরি হয় না কারন তুমি একজন মহাপুরুষ। সেই হিসেবে কমনসেন্স বলে- এভাবে দরজা খোলা রেখে দিলে আমরা যারা সাধারন মানুষ, তাদের সবার ঘর থেকেই কিছু না কিছু অবশ্যই চুরি হবে।'
'দরজা-জানালা খোলা থাকুক বা না থাকুক, ভুটানে কখনো কিছু চুরি হয় না, তার মানে কি এই যে সে দেশের সব মানুষই মহাপুরুষ।'
বাদল হিমুর কথা শুনে হকচকিয়ে গেলো; হিমু বললোঃ 'বাদল তুই একজন বুদ্ধিমান ছেলে; এপ্লাইড ফিজিক্সের মত একটা সাবজেক্ট থেকে তুই যথেষ্ট ভালো রেজাল্ট নিয়ে তোর অনার্স শেষ করেছিস। তারপরো তুই এতো বোকা কেনো?'
বাদল চুপ করে হিমুর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো, কিছু বললো না। হিমু নরম গলায় আবার বললোঃ 'তবে কি জানিস, আমি চাই সবসময় তুই এমন বোকাই থাক। কারন সৃষ্টিকর্তার অলিখিত একটা নিয়ম আছে বোধহয়, আর সেটা হোল- যে যত সরল, তাকে তিনি তত ভালো একজন মানুষ করে পৃথিবীতে পাঠান। আমাদের আশেপাশে যত আলোকিত মানুষেরা ঘুরে বেড়ান, খেয়াল করলে দেখবি-তাদের সবার ভেতরই অসম্ভব সরল একজন সত্তাকে সবসময় খুজে পাওয়া যায়।'
বাদল কিছু বললো না। হিমু বাদলের মাথায় হাত রেখে তার চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিয়ে বললোঃ 'আজ যাই রে বাদল। উঠে এসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে যা; ঘরের দরজা খোলা রাখার কোনো প্রয়োজন নেই, শুধু খেয়াল রাখবি মনের দরজাটা যেনো কখনো বন্ধ না হয়। সেটা যেনো সব অবস্থায়, সব সময়ের জন্য খোলা থাকে।'
বাদল হিমুর পেছন পেছন এসে ঘরের দরজা বন্ধ করে বারান্দায় গিয়ে দাড়ালো। সে হিমুদাকে দেখছে, হলুদ পাঞ্জাবীর অসাধারন একজন মানুষ শিষ দিতে দিতে হাল্কা পায়ে হেটে চলে যাচ্ছে দূরে। একটিবারের জন্যও পেছন ফিরে তাকাতে দেখলো না সে তার অসম্ভব প্রিয় এই মানুষটিকে।
*
হিমু বেল টিপে প্রায় দশ মিনিটের মত হল দাঁড়িয়ে আছে। ভেতর থেকে মিসির আলী একবার শুধু 'কে' বলেই চুপ করে গেছেন, তার আর কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
দরজা খুলে মিসির আলী হিমুর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন, মনে হোল যেনো ঠিক চিনতে পারছেন না। হিমু বললোঃ 'স্যার আমাকে চিনেছেন? ওই যে একবার আপনার কাছে এলাম......'
'ভেতরে আসো হিমু। সরি, দরজা খুলতে দেরী হল। খুব ইন্টারেস্টিং একটা বইয়ের শেষটুকু পড়ছিলাম, শেষ না করে কিছুতেই উঠে আসতে পারলাম না।'
মিসির আলী হিমুকে নিয়ে সরাসরি তার শোবার ঘরে ঢুকে পড়লেন। খাটে বসতে বসতে তার রিভলভিং চেয়ারটি দেখিয়ে হিমুকে বললেনঃ 'বস; একটু দেখো, সাবধান, চেয়ারের একটা পায়ার চাকা খুলে যেনো কোথায় হারিয়ে গেছে, খুজে পাচ্ছি না...'
'স্যার, আপনি ভালো আছেন?'
'হ্যা ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?'
'আমিও ভালো। আপনার জন্য একটা রহস্য নিয়ে এসেছি স্যার'
'বলো।'
'এখন না, চলে যাওয়ার আগে বলবো।'
'ঠিক আছে, চা খাবে?'
'তা খাওয়া যায় এক কাপ।'
'একটু অপেক্ষা করতে হবে যে তাহলে। বাসায় কেউ নেই তো, তাই সব কাজ আমাকেই করতে হয়...'
'কোনো সমস্যা নেই স্যার, আমি বসছি'
হিমু বসে বসে চায়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। মিসির আলীর সাথে কথা বলে সে একটু অবাক হয়েছে। স্যার একটা বারের জন্যও তার সেই অন্ধগলির সমস্যাটার শেষমেষ কি হল, সেটা সম্পর্কে জানতে চান নি। অথচ জানতে চাওয়াটাই ছিলো স্বাভাবিক......
'এই নাও চা, তোমার ভাগ্যটা ভালো। বাসায় দুধ, চিনি, চা-পাতা সবই ছিলো।'
হিমু চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললোঃ 'একটা প্রশ্ন ছিলো স্যার। আমি যে একসময় আপনার কাছে একটা সমস্যা নিয়ে এসেছিলাম সেটার শেষ পর্যন্ত কি হোল- আপনি এখন পর্যন্ত একবারো সেটা জিজ্ঞেস করলেন না। স্বাভাবিক কৌতূহল থেকেই কি সেটা সম্পর্কে জানতে চাওয়া আপনার উচিত ছিলো না?'
মিসির আলী শান্ত গলায় বললেনঃ 'ব্যাক্তিগতভাবে আমি যথেষ্টই কৌতূহলী একজন মানুষ। আমার মধ্যে কৌতূহল যদি না ই থাকতো তাহলে আমি কখনোই এ জাতীয় সমস্যা নিয়ে নাড়াচাড়া করতাম না। তবে একটা ব্যাপার ভূলে গেলে চলবে না, সেটা হোল পৃথিবীতে লজিকের বাইরে কিছু ঘটে না। সুতরাং, আমি খুব ভালো মত জানি যে তোমার সেই সমস্যাটা ছিলো পুরোপুরি মানসিক। তাই তোমাকে যখন আরেকবার আমি সেই গলিটাতে গিয়ে দাড়াতে বলেছিলাম, তুমি যেটা দেখেছিলে-সেটাকে বলেছিলাম আবারো ফেইস করতে, তুমি নিশ্চই সেদিন গিয়ে সেখানে কিছুই দেখো নি; যদি দেখতে তাহলে নিশ্চই আবার আসতে আমার কাছে...'
হিমু কিছুক্ষন চুপ করে থেকে হাসতে হাসতে বললোঃ 'আপনি মানুষটা খুব অদ্ভূত স্যার।'
'মানুষ মাত্রই অদ্ভূত, কারন আমরা সবাই মস্তিষ্কের মত অত্যন্ত জটিল একটা 'স্ট্রাকচার' সঙ্গে করে নিয়ে এ পৃথিবীতে এসেছি।'
হিমু চা শেষ করে উঠে দাঁড়ায়, মিসির আলী বলেনঃ 'কোথায় যাচ্ছ, বস। রাতে আমার সাথে খেয়ে যাও। আয়োজন অবশ্য খুব বেশী কিছু না- ভাত, ডিমভাজি আর ডাল।'
হিমু বললোঃ 'আজ না স্যার। আচ্ছা, আপনাকে যে রহস্যটা দিতে চেয়েছিলাম......'
হিমু বড় করে শ্বাস নিল, মিসির আলী ঝকঝকে চোখে তাকিয়ে আছেন হিমুর দিকে।
'স্যার, ভালোবাসা ব্যাপারটা আসলে কি?'
মিসির আলী চুপ করে আছেন। হিমু তাকে গভীর চিন্তায় রেখে বাইরে বেরিয়ে এলো।
*
বিসমিল্লাহ হোটেল থেকে খেয়ে হিমু মেসে তার নিজের ঘরে ঢুকে জীবনে প্রথমবারের মত দরজা বন্ধ করে দিলো। সারাদিনের হাটাহাটিতে ক্লান্ত লাগছে খুব, ঘুমে চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু ঘুমিয়ে যাওয়ার আগে একটা কাজ এখনো বাকি, রুপার কাছে একটা চিঠি লিখে যাওয়া। হিমু খাতা কলম নিয়ে বসলো।
রুপা,
তোমার কাছে লেখা প্রথম এবং শেষ চিঠিটা আবেগে টইটুম্বুর হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু সে ধরনের কিছুই আমি লিখবো না। আমাকে মহাপুরুষ বানানোর কারিগর আমার বাবা বলে গিয়েছিলেন যে একজন মহাপুরুষকে বিদায় বেলাতেও তার চিন্তা ঠিক রাখতে হয়, আবেগাপ্লুত হলে চলে না। আমার মৃত্যুর আগে এটাই খুব সম্ভবত বাবার বলে যাওয়া শেষ উপদেশ যেটা পুরোপুরি মনে রেখেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেবো আমি।
ও আচ্ছা! ভালো কথা, তুমি সুস্থ হয়ে ওঠার পর নিজে দায়িত্ব নিয়ে আমার মৃত্যুর খবরটা মিসির আলী স্যারকে জানিয়ে দেবে, কেমন?
ভালো থেকো।
হিমু
পুনশ্চঃ
".....প্রেম বলে যে 'যুগে যুগে, তোমার লাগি আছি জেগে'
মরণ বলে- 'আমি তোমার জীবনতরী বাই'।।"
চিঠি শেষ করে বিছানায় শুয়ে বালিশে মাথা ছোয়ানো মাত্র হিমু ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে খুব অদ্ভূত একটা স্বপ্ন দেখলো সেঃ
যেনো সে শূন্যের উপর দাঁড়িয়ে আছে, চারপাশে ঘন কুয়াশা- কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝেই প্রচন্ড শীতে হিমুর গা কাটা দিয়ে দিয়ে উঠছে। কখনো কখনও সমুদ্র গর্জনের মত শব্দ উঠে আবার সেটা মিলিয়ে যাচ্ছে নিমিষে। এরকম অবস্থায় হঠাত করেই কে যেনো একজন কথা বলে উঠলোঃ'তোমার কি মন খারাপ ছেলে?'
হিমু চমকে উঠলোঃ 'কে! কে কথা বলে?'
'আমি! তুমি কিন্তু এখনো আমার প্রশ্নের জবাব দাও নি। তোমার কি মন খারাপ?''
জ্বি'
'কেনো?'
'কারন আমার খুব ইচ্ছা ছিলো জীবনে একটিবারের জন্য হলেও প্রবল জোছনায় রুপার পাশে বসে আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি, রুপার কন্ঠে একটা গান শুনি। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হোল না বলেই বোধহয়.....'
হিমু তার কথা শেষ করবার সাথে সাথেই হাসির শব্দ শুনতে পায়। হাসি থেমে যাওয়ার পর আবার সেই কন্ঠস্বর কথা বলে ওঠেঃ 'বোকা ছেলে, কেনো সম্ভব না? তুমি না একজন মহাপুরুষ, তুমি চাইলেই তো সেটা সম্ভব...'
'কেমন করে?'
'তুমি চাইলেই হবে। একবার শুধু মনে প্রানে তুমি সেটা চাও, দেখো না কি হয়!!'
'কিন্তু আপনি কে?'
'এসব প্রশ্ন কি এখন অপ্রাসঙ্গিক নয়? তোমার হাতে সময় খুব কম। তাড়াতাড়ি কর, তাড়াতাড়ি...'
'বেশ আমি চাইছি......'
হিমুর কথা শেষ হবার আগেই তার চারপাশের কুয়াশা নিমেশে ফিনিক ফোটা জোছনায় পালটে গেলো। হিমু অবাক হয়ে সামনে তাকিয়ে তার প্রিয় ময়ুরাক্ষী নদীটাকে দেখতে পায়। ওই তো নদীর পাড়েই রুপা কেমন বিষন্ন ভঙ্গীতে বসে আছে। বাতাসে তার চুল উড়ছে। রুপার পরনে একটা হলুদ রঙের শাড়ি। রুপালী জোছনা সে হলুদ শাড়িতে পড়া মাত্র সেটা সোনালী হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে।
হিমু রুপার দিকে হেটে যায়, কাছে গিয়ে কোমল গলায় রুপাকে ডাকে। সেই ডাক শুনে চমকে ওঠে রুপা। একদৃষ্টিতে খানিকক্ষন হিমুর দিকে তাকিয়ে থেকে কাপা কাপা গলায় বলে ওঠেঃ 'এটা তুমি কি করলে হিমু? তুমি কিভাবে ভাবতে পারলে যে তোমাকে ছাড়া আমি বেচে থাকতে পারবো? এই শাস্তিটা তুমি আমাকে কেনো দিলে? কেনো কেনো...??'
রুপা ডুকরে কেদে ওঠে। হিমু রুপার মাথায় হাত রেখে কোমল গলায় বলেঃ 'রুপা শোন! পৃথিবীতে শুধুমাত্র ভালোবাসার জায়গাটিতে এসেই আমার মত মহাপুরুষ আর সাধারন মানুষেরা সব এক হয়ে যায়। তাই আজ আমার জায়গায় তুমি হলেও ঠিক একই কাজটাই করতে......'
রুপা ফুলে ফুলে কাদতে থাকে। হিমু বলেঃ "ছিঃ রুপা। এতো সুন্দর একটা রাত এভাবে কান্নাকাটি করে নষ্ট করো না। দেখো, প্রকৃতি কি সুন্দর করে নিজেকে সাজিয়েছে! তুমি কি বুঝতে পারছো না, আজকের রাত, জোছনাকে ভালোবাসায় পাল্টে ফেলার রাত; আজ আমরা দু’জন জোছনার বদলে ভালোবাসা গায়ে মাখবো...'
রুপা কাদতে কাদতেই গভীর আবেগে হিমুকে জড়িয়ে ধরে। হিমু নীচু গলায় রুপাকে বলেঃ 'তোমার মনে আছে- তুমি যে আমাকে একদিন গান শোনাতে চেয়েছিলে; সেদিন তোমার গান আমার শোনা হয়নি। এক কাজ কর- আজই একটা গান গেয়ে শোনাও।'
রুপা- হিমুর বুক থেকে মাথা তুলে অনেক কষ্টে কান্না সংবরন করে চোখ মুছে নেয়। তারপর কিন্নরী কন্ঠে গান শুরু করে।
আকাশে পূর্নচন্দ্র, জোছনা অপরুপা এক তরুনী হয়ে পরম আদরে যেনো আকশের বুকে বিছিয়ে দিয়েছে তার গাঢ় বেগুনী-রঙ্গা শাড়ির আচল। চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে ময়ূরাক্ষী নদীর পাড়ের ধবধবে সাদা বালি; আর তার পাশেই ভরা পূর্নিমায় চন্দ্রস্নান করতে করতে মনের আনন্দে বয়ে চলেছে স্বচ্ছ জলের মায়াময় এক নদী। রুপা গাইছে- "দু:খ বলে 'রইনু চুপে, তাঁহার পায়ের চিহ্নরূপে'......"
রুপার সেই গান প্রিয় মানুষটিকে কাছে পেয়েও তাকে ধরে রাখতে না পারার হাহাকার হয়ে ভেসে বেড়াতে থাকে নদীর এপার থেকে ওপারে; বহেমিয়ান বাতাসে ভর করে চলে যায় দূরে।
হিমু রুপার দিকে পূর্নদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। রুপার চোখ থেকে ফোটা ফোটা পানি তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে। হিমু সেই চোখের পানি নিজ হাতে মুছিয়ে দেয়, মুগ্ধ হয়ে দেখে কোমল জোছনা কি অপূর্ব সব নকশাই না তৈরী করছে মেয়েটির অশ্রুভেজা গালে!
শেষ কথাঃ
মিসির আলী হিমুর মৃত্যুর খবরটা পান আজই। রুপা নামের মায়া মায়া চেহারার এক তরুনী বিকেলের দিকে তার বাসায় এসে নিজে থেকে তাকে খবরটা জানিয়ে দিয়ে গেলো।
হিমুর সাথে মিসির আলীর তেমন কোনো পরিচয় ছিলো না; জীবনে মাত্র দু'বারই ছেলেটির সাথে দেখা হয়েছিলো তার, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হোল খবরটা শোনার পর থেকেই মিসির আলী হলুদ পাঞ্জাবীর সেই যুবকের জন্য একেবারে মনের গভীর থেকে তীব্র এক ধরনের বেদনা অনুভব করছেন। এর পেছনে কি কারন থাকতে পারে? মিসির আলী জীবনে কখনো যেটা বিশ্বাস করেন নি, আজ বিড়বিড় করে তিনি সেটাই বললেনঃ 'পৃথিবী বড়ই রহস্যময়...'
পর্বতের মত দৃঢ় যুক্তি এবং কঠিন মানসিক ক্ষমতার অধিকারী একজন মানুষ এলোমেলো পায়ে হেটে তার টেবিলটার কাছে গিয়ে দাড়ান। তারপর নিজের 'unsolved' ডাইরীটা তুলে নিয়ে সেটার ৪৩ পৃষ্ঠায় টুকে রাখা হিমুর দেয়া রহস্যটার নীচে বড় বড় করে লেখেনঃ
'প্রিয় মানুষটি আর কখনো ফিরে আসবে না জেনেও, সে তারই জন্য হৃদয়-ঘরের দরজাটি সারাজীবন ধরে খুলে রাখার নামই বোধহয় ভালোবাসা !!'
কথাটা লিখতে লিখতে নিজের অজান্তেই দ্যা গ্রেট মিসির আলীর দু'চোখ ভর্তি হয়ে যায় পানিতে। 'unsolved' ডাইরীর ৪৩ পৃষ্ঠাটিতে ঝরে পড়ে কয়েক ফোটা পবিত্র অশ্রু।


(হিমুকে চেনেন না- এমন বাংলাদেশি খুজে পাওয়াটা দুঃসাধ্য। হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট এই চরিত্রটি বাংলাদেশের অসংখ্য যুবকের মত আমাকেও প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিলো এবং হয়তো করে যাবে আমরণ। এ লেখাটা কোন ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে লেখা হয় নি, হিমু এবং তার লেখক হুমায়ূন আহমেদের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা থেকেই লেখা হয়েছে। ইন কেইস- যদি প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ কর্তৃক দায়িত্ব ও ক্ষমতাপ্রাপ্ত কারো এ ধরণের লেখা নিয়ে কোন আপত্তি থাকে, তবে আমাকে জানালেই আমি পত্রপাঠ গল্প এডিট করে দেবো....

অন্য কারো সৃষ্ট চরিত্রদেরকে নিয়ে কিছু লেখবার আগে নিঃসন্দেহে তাদের অনুমতি নেয়াটা আবশ্যক, যেহেতু আমার সেই সুযোগ নেই- তাই পাবলিকলি এই অংশটুক লিখে জানালাম, দায়িত্ব মনে করেই!

হ্যাপি রিডিং)

মন্তব্য ১২ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (১২) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা জুলাই, ২০১৫ রাত ৯:১৮

রাজীব নুর বলেছেন: হুম.।.।।

০১ লা জুলাই, ২০১৫ রাত ১১:০৬

পুলহ বলেছেন: আপনার "হুম" টার অনুবাদ করে নিলাম "মোটামুটি ভালো লেগেছে" :)
ভালো থাকবেন ।

২| ০১ লা জুলাই, ২০১৫ রাত ৯:৫২

মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেছেন: +++

০১ লা জুলাই, ২০১৫ রাত ১১:০৫

পুলহ বলেছেন: ধন্যবাদ সময় করে পড়বার জন্য :)

৩| ০১ লা জুলাই, ২০১৫ রাত ১০:৩০

শিরোনামহীনভক্ত দিহান বলেছেন: অনেক বড়, পরে পুরোটা পড়বো।

০১ লা জুলাই, ২০১৫ রাত ১১:০৪

পুলহ বলেছেন: মূল্যবান ফিডব্যাক এর অপেক্ষায় রইলাম :)

৪| ০২ রা জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৫:২১

শতদ্রু একটি নদী... বলেছেন: ভালোই লাগছিলো পড়তে।

০২ রা জুলাই, ২০১৫ রাত ৮:১৭

পুলহ বলেছেন: সময় করে পড়বার জন্য ধন্যবাদ ! ভালো থাকবেন :)

৫| ০২ রা জুলাই, ২০১৫ রাত ১১:৫৮

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: সুন্দর লিখেছেন| হিমু পর্ব খতম| এবার নিজের গল্প লিখুন| আপনার হাতে বাংলা সাহিত্যের ধারা প্রশস্ত হোক, তবে সেটা কাউকে ধরে নয়

০৩ রা জুলাই, ২০১৫ রাত ১২:২০

পুলহ বলেছেন: সময় করে পড়বার জন্য ধন্যবাদ ! আপনার সাজেশন মনে রাখবো :)
ভালো থাকবেন !

৬| ০৪ ঠা জুলাই, ২০১৫ দুপুর ১২:১১

বোকা মানুষ বলতে চায় বলেছেন: হিমু সিরিজের গুরুত্বপূর্ণ কিছু চরিত্রের মিশেলে হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুকে পশ্চাতে রেখে হিমুর মৃত্যুটা সিম্বলিক। ভালো লেগেছে। +++

০৪ ঠা জুলাই, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:১৮

পুলহ বলেছেন: অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে সময় করে পড়বার জন্য ! ভালো থাকবেন :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.