নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

...

পুলহ

পুলহ › বিস্তারিত পোস্টঃ

"একজন পারুল অথবা কয়েকটি ঝরা ফুলের গল্প....."

০৪ ঠা জুন, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩০


=========================================
‘এই যে, একটু শুনেন। হ্যা, হ্যা আপ্নেরেই বলতেছি.. ‘
নারী কন্ঠের ডাক শুনে আমি চমকে তাকালাম। অথচ এতোটা চমকানোর মত কিছু ছিলো না। মেয়েটাকে অনেকক্ষণ ধরেই দেখছি আমার সামনে দিয়ে ঘুরঘুর করছে। হয়তো ভেবেছিলো- আমি নিজে থেকেই ডাকবো। কিন্তু পনেরো-বিশ মিনিট পার হয়ে যাওয়ার পরও যখন আমার দিক থেকে কোন সাড়া শব্দ পেলো না, নিজেই এগিয়ে এলো তখন।
‘আপ্নের কি কিছু লাগবে? অনেকক্ষণ ধইরাই দেখতেছি- এইখানে চুপচাপ দাঁড়ায় আছেন, তাই জিজ্ঞাস করলাম। অন্য কিছু না…’
সেই ‘অন্য কিছু না’- বলে মেয়েটা যে ভঙ্গিতে হাসলো, তাতে যে কারো স্পষ্ট বোঝার কথা এই মেয়েগুলো কারা। কি চায় এরা ‘অচেনা’ একজন পুরুষের কাছে !
আমি একটু ভালো করে এবারে মেয়েটার দিকে তাকালাম। হলুদ জমীনের উপর লাল-ফুলের-কাজ করা শাড়িটা খুব আটসাট করে পরেছে; ভেতরে মেরুন রঙের টাইট একটা ব্লাউজ। সস্তা প্রসাধন জাতীয় কিছু একটা গায়ে মাখানো বোধহয়, ভদ্র একটা দূরত্ব বজায় রাখার পরও সেই তীব্র গন্ধ নাকে এসে লাগছে।
সত্যি কথা বলতে- আমি আসলে এদের কাউকেই মনে মনে খুঁজছিলাম- মাগী; ভদ্রলোকেরা যাদের বলেন- দেহপসারিণী কিংবা পতিতা। একজনের কাছ থেকে শুনেছিলাম- পারুল নাকি জায়গা করে নিয়েছে এমনই কোন এক বেশ্যাপাড়ায়। সত্যি কথা বলতে- তার সন্ধানেই আমার এমন শহরে শহরে ঘোরা।
আসলে বুদ্ধি হবার পর থেকে যে মেয়েটাকে ভালোবেসে আসছি, তার এমন পরিণতি শুনে আমার বজ্রাহত হবার কথা ছিলো । কিন্তু অবাক করার মত বিষয়- পারুলের খবরটা যখন জানলাম, তখন মাথায় শুধু একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে মনে ভাবছিলাম- সারা দেশে এতো এতো পতিতাপাড়া, তার মধ্যে কোথায় খুঁজবো পারুলকে। আদৌ কি এটা কখনো সম্ভব !!
যাই হোক, এরপর সেলিমের কাছ থেকেই জানতে পারি- এক পতিতাপল্লীর সাথে নাকি আরেক পতিতাপল্লীর যোগাযোগ থাকে। অল্পবিস্তর। আবার ক্ষীণ আশা ফিরে আসে আমার মনে- যদি তেমনই কারো সহযোগিতায় হারিয়ে যাওয়া পারুলের খোঁজ পাই …..
‘কি হইল, কইলেন না !’
আবারো মেয়েটার কথায় চমকে উঠি আমি, অথচ চমকে ওঠার মত কিছু ছিলো না।
‘আমি… আমি আসলে একজন মানুষকে খুঁজছি।‘
‘যারে খুঁজতেছেন, সে কি এইখানে থাকে?’- বলে মেয়েটি গলির ভেতরে খারাপ পাড়ার দিকে ইঙ্গিত করলো।
‘জানি না আসলে। তবে শুনেছিলাম- এই শহরেরই কোন একটা জায়গায় ঠাঁই মিলেছে তার…’
আমার ভুলও হতে পারে, তবে মনে হলো মেয়েটি বুঝি আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না। তার হয়তো ধারণা হয়ে থাকবে- ‘নতুন মানুষ। বোধহয় একেবারে প্রথম প্রথম এমন একটা জায়গায় এসেছে; তাই সাহস করে আসল কথাটা বলে উঠতে পারছে না ! আরেকজনকে খোঁজার নাম করে ঘরে ঢুকে তবেই শুরু করবে শরীর নিয়ে খেলা….’
‘আসেন। আমার ঘরে আসেন।‘- বলে মেয়েটি সহজ ভঙ্গিতে হাটতে শুরু করে গলির ভেতরের দিকে।
আমিও চুপচাপ, ক্লান্ত ভঙ্গিতে এবেলা শুধু তার পিছু নিলাম।
-------------------------
যখন সত্যি সত্যিই মেয়েটা দেখলো যে- তার শরীরের ব্যাপারে আমার কোন আগ্রহ নেই- তখন বাস্তবিকই একটু অবাক হলো যেনো। কিছুটা বিরক্ত গলায়ই বললো- ‘আপনের ঐ মানুষরে খুইজা দিয়া আমার কি লাভ?’
আমি শান্ত গলায় তার জিজ্ঞাসার উত্তর করি- ‘দীর্ঘ বারো বছর আমি মিডল ইস্টে ছিলাম । যদিও তার মধ্যে বড় একটা সময় আমার কেটেছে পলাতক, কিন্তু তারপরো…. টাকা কম কামাই করি নি। রক্ত পানি করে দেশের ধারদেনা সব শোধ করা, বাড়িতে বছর বছর করে টাকা পাঠানো- এগুলোর পরও হাতে বেশ ভালো এমাউন্টের একটা টাকা রয়ে গিয়েছে আমার। আপনি যদি আমাকে পারুলের খোঁজ বের করার ব্যাপারে কোনরকম সহযোগিতা করতে পারেন, তাহলে ……’
‘আচ্ছা আচ্ছা, বুঝতে পারছি !’- কিছুক্ষণ চুপ থেকে মেয়েটা আনমনে কি যেন চিন্তা করে। তারপর গলা নীচু করে বললো- ‘তার সাথে আপনের সম্পর্কটা কি? খারাপ পাড়ার খারাপ একটা মেয়ে…ঐ মেয়েরে খোঁজার জন্য এইভাবে, এতো কষ্ট করতেছেন… মানুষ তো আসলে আমাগো ভুইলা যাইতে পারলেই বাঁচে!’
আমি শুনেছিলাম- এ জাতীয় মেয়েরা জীবনের কর্কশ রূপটাকে প্রতিনিয়ত দেখে যায় বলেই কঠিন সব কথাবার্তা অবলীলায় বলে ফেলতে পারে। ওর বেলাতেও দেখলাম তাই।
আমি অবশ্য মেয়েটার কথায় কিছু মনে করলাম না। নির্জীব গলায় শুধু বললাম- ‘আপা, আমি আজকে যাই। হঠাৎই শরীরটা খুব খারাপ লাগছে…’
…….এভাবেই জেসমিন নামের মেয়েটার সাথে আমার পরিচয়! শুনেছি এরা নাকি সমাজে এদের আসল নাম কখনো ব্যবহার করে না; তবে কেন যেনো আমার কাছে আজো মনে হয়- জেসমিন আপা আমাকে কখনো মিথ্যা কথা বলে নি তার নামের ব্যাপারে ! যে মানুষ পারুলের খোঁজ বের করে দেবার বিনিময় হিসেবে আমার কাছ থেকে একটা পয়সা পর্যন্ত নেয় নি, তাকে আমি অবিশ্বাসই বা করি কেমন করে !
সেদিন জেসমিন আপার ঘর থেকে তাড়াহুড়া করে চলে এলেও, ভাদ্র মাসের এক বিকেল বেলায় আমি তাকে আমার জীবনকাহিনী বলেছিলাম। পারুলের সাথে আমার সম্পর্ক, তারপর জীবিকার উদ্দেশ্যে বিদেশ চলে যাওয়া, দিনরাত অমানুষিক পরিশ্রম আর টাকা উপার্জন…. কিছুই বাদ দেই নি ! তখন চোখে স্বপ্ন ছিলো। শরীরে বল আর মনে সাহস। যাবার আগে আগে পারুলকে বলে গিয়েছিলাম- ‘তিন বৎসরের মধ্যে ফিরেই তোকে বিয়ে করব। পারবি না এই কয়টা দিন আমার জন্য অপেক্ষা করতে !’
পারুলের সেদিনের উত্তরটা আজো আমার কানে বাজে- ‘আপনার জন্য আমি এক জীবন অপেক্ষা কইরা কাটায় দিতে পারি…’
অবশ্য সেই তিন বৎসর ভালোয় ভালোয় পার হওয়ার আগেই একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলো ঐখানে। বিদেশে আমি যে রুমটায় থাকতাম, ওখান থেকে কিছু অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ। আমি তখন বাইরে। কাজে। আমার রুমমেট আমাকে ফোন দিয়ে জানালো- ‘পুলিশ তোরে আর আমারে খুঁজতেছে। আমি বর্ডার পার হয়া অন্য দেশে চইলা যাব আজই। বাঁচতে চাইলে আমার সাথে যাইতে পারস…’
ভয়ে দিশাহারা আমি তখন কোনমতে বলেছিলাম- ‘কিন্তু আমি তো কোন অপরাধ করি নি।‘
‘আরে তোর রুমে অস্ত্র পাওয়া গেছে- এইটাই তোর অপরাধ। শোন, এতো কথা বলতে পারবো না- এখন রাখি ! পালাইতে চাইলে আধাঘন্টার মধ্যে আমার সাথে দেখা কর…’
সেই থেকে শুরু হলো আমার পলাতক জীবন। অবৈধ অভিবাসী হিসেবে আজ এক দেশ, তো কাল আরেক - এভাবে যাযাবরের মত ঘুরলাম কত বছরের পর বছর ! কিছুদিন একটা দেশে থাকি, যখন দেখি অবস্থা বেগতিক- বেআইনী কর্মীদের ধরার জন্য পুলিশ অভিযান শুরু করেছে- তখন আবার পালাই ওখান থেকে। বারো বছরের বিদেশ জীবনে মোট পাঁচটার মত দেশে পালিয়ে থেকেছি; জেলও খাটতে হয়েছে কয়েকবার… এ দীর্ঘ সময়ে আমার দেশের সাথে তেমন যোগাযোগ ছিলো না। শুধু কোনরকম হুন্ডি করে বাড়িতে টাকা পাঠাতাম। পারুল নামের গ্রাম্য এক কিশোরী তখন আমার কাছে দূর এক কল্পনা জগতের নাম।
বারো বছর পর যখন বহু কষ্টে দেশে ফিরে এসেছি- ততদিনে পালটে গেছে অনেক কিছুই। শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর ব্রিজ হয়েছে। সন্ধ্যার পর থেকেই নদীর বুকে ঝলমল ঝলমল করে নেকলেস আকৃতির সে ব্রিজের আলো। বাড়ির পূর্বপাশে বাঁশঝাড় ছিলো বিরাট, সেখান থেকে জোনাকি ধরে ধরে হোমিওপ্যাথিক শিশিতে জমা করতাম আমি পারুলের জন্য। বাড়ি ফিরে আসার পর দেখি সে বাঁশঝাড়ও কেটে সাফ। বদলে গেছে গ্রামের ধুলো ওঠা মাটির রাস্তাটাও। কত খালি পায়ে হেটেছি আমি আর পারুল এসব রাস্তা দিয়ে। সে মাটিতে পায়ের ছাপ পড়তো আমাদের। বারো বছর পর এসে দেখি- সেই ধুলোমাটির রাস্তা পালটে গেছে পীচঢালা এক পথে। যার বুকের উপর আর মানুষের পায়ের চিহ্ন পড়ে থাকে না কখনো…..
সেলিমের কাছে শুনলাম- পারুল নাকি অনেক দিন অপেক্ষা করে ছিলো আমার জন্য। একটা চিঠি, একটা ফোন, অথবা ‘ভালো আছি, তুই কেমন’-হয়তো এটুকু একটা মেসেজই…. পারুলের বাবা একসময় জোর করে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিতে চাইলো। শুনলাম- সে বিয়ের আসর থেকেই পারুল নাকি পালিয়েছিলো….
এ বয়সের একটা মেয়ে, একা একা পরিবার পরিজন ছাড়া খুব বেশিদিন যে নিরাপদে জীবন চালিয়ে নিতে পারে না- এটা তো বাস্তব সত্য। পারুলের বেলাতেও ঠিক তা-ই হলো ! ঘটনার নানা পথ ঘুরে একটা সময় এসে তার জায়গা হয় পতিতাপল্লীতে। বদলে যাওয়া সে পারুলের গল্পই আমি শুনেছিলাম দেশে ফেরত আসার পর। যখন মিডল ইস্টে ছিলাম, তখন ভাবতাম - কি ঘটনাবহুল একটা জীবনই না কেটে গেছে আমার ! অথচ কল্পনারও বাইরে ছিলো আমারই ভালোবাসার মানুষটি আমার থেকেও কত নাটকীয় একটা জীবন পার করে ফেলেছে ততদিনে ! কি অদ্ভুত !
অবশ্য ঘটনা যে তখনো আরো দেখা বাকি আমাদের- সেটাই বা কে জানতো ! তারই খবর আনলেন একদিন জেসমিন আপা !
তিনি কিভাবে কিভাবে ঠিকই পারুলের খোঁজ বের করে একদিন আমাকে তথ্য দিলেন। আমি জানতে পারলাম- পারুল, আমার পারুল, নাকি ক্যান্সার হাসপাতালে ভর্তি। খারাপ ধরণের জরায়ু ক্যান্সার নাকি ধরা পড়েছে মেয়েটার। উন্নত চিকিৎসার সামর্থ্য নেই দেখে দেশে থেকেই ট্রিটমেন্ট চালিয়ে যাচ্ছে কোনরকম। মনে আছে- বুকটা কেমন চিনচিন ব্যথা করে উঠেছিলো সেদিন পারুলের এমন দুরবস্থার কথা শুনে !
আমিও আর দেরি না করে ঐদিন বিকালেই হাসপাতালে পারুলকে দেখতে গেলাম। ঠিক এক যুগ পর ! নাকি তারও বেশি….
কি জানি! সময়ের আর হিসাব থাকে না ইদানিং।
-------------------------------
আধময়লা সাদা বেডের এক বিছানায় পারুল আধশোয়া হয়ে আছে। আমাকে দেখা মাত্র ঝরঝর করে কাঁদতে আরম্ভ করলো !
আমি কাঁদলাম না মোটেও, অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে রইলাম শুধু। টের পাচ্ছিলাম বুকের ভেতরটা তীব্র ঘূর্ণিঝড়ের ঝাপ্টায় শুধু আলোড়িত হচ্ছে বারবার, কিন্তু প্রকাশ করতে পারছিলাম না কিছুই। জড় পদার্থের মত অবশ তাকিয়ে থেকে অনেকখানি সময় পার হয়ে গেলো আমার।
আহ ! কতদিন পর দেখা ! সেই কিশোরী পারুলের স্নিগ্ধতার কিছুই অবশিষ্ট নেই আর। হালকা-পাতলা গড়নের সেই মাটির মেয়েটার শরীরে বোধহয় পানি এসেছে; কেমন বেঢপ মোটা লাগছে দেখতে। গায়ের রঙ কি মায়াময় শ্যামলা ছিলো একসময় ! আর এখন…. নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে আমার।
বহু কষ্টে খানিক বাদে পারুল নিজেকে সামলালো। আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর একসময় কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো সে- ‘আমার মত একটা খারাপ মেয়ের কাছে কি চাইতে আসছেন ?! আপনাকে দেওয়ার মত আর কিছুই অবশিষ্ট নাই আমার’
আমি জানি- এগুলো রাগের কথা, অভিমানের কথা, তাই কিছু না বলে চুপচাপ বসেই রইলাম। আরো একটু পর পারুল ফিসফিস করে বললো- ‘আপনার সাথে আর দেখা না হইলেই ভালো হতো, শেষ সময়ে আইসা আবার মায়া বাড়াইলেন ! কোন দরকার ছিলো না এইগুলার….’
‘পারুল, আমি তোকে বিয়ে করতে এসেছি…..’
এ কথা শুনে সে কিছুক্ষণ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। তারপর হাসতে আরম্ভ করে। মানসিক রোগীদের মত হাসি- হাসতে হাসতেই কান্না, আবার কাঁদতে কাঁদতে হাসা…. চরম বিব্রতকর একটা পরিস্থিতি।
আমি নিজে থেকেই পারুলকে স্বাভাবিক হয়ে আসার জন্য কিছুটা সময় দিলাম! কিন্তু অবস্থার উন্নতি হলো না তাতে খুব একটা, পারুল একই রকম আচরণ করে যেতে থাকলো। হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীদের মত। শেষমেষ নার্স এসে একটা ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে যাওয়ার পর- তবে শান্তি ।
মেয়েটাকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখেই সেদিনকার মত আমি বাইরে বেরিয়ে আসি দ্রুত। অনেক কাজ আমার সামনে। নষ্ট করার মত সময় হাতে নেই এখন আর। একেবারেই না !
------------------------------------
পারুল মারা গেলো আমাদের বিয়ে হবার ঠিক সাতদিনের মাথায়।
শেষের দিকে সে শুধু আগের জীবনের গল্প করতো। বলতো- ‘মনে আছে, আপনি যে একবার আমারে মেলায় নিয়া গেছিলেন ! আমি জিদ ধরলাম নাগরদোলায় চড়াইতে হবে আমারে। হাওয়াই মিঠাই কিন্না দিতে হবে….. মনে আছে- গোলাপি রঙের হাওয়াই মিঠাই একটা নিয়ে দিছিলেন আমার জন্য !’
আমি পারুলের হাত ধরে বসে থাকতাম, আর বলতাম- ‘হু। মনে আছে ! খুব মনে আছে !’
পারুল আবার বলতো- ‘মনে আছে না ছাই! বলেন তো- একবার যে আমরা নৌকা কইরা ভাটির দিকে গেলাম, ঐদিন আমার পরনে কি ছিলো?! বলতে পারলেন না তো- আমি ঐদিন কলাপাতা রঙ একটা শাড়ি পরছিলাম আপনেরে দেখানোর জন্য !‘
‘কথা বইলো না পারুল। একটু রেস্ট নাও।‘
‘আপনে আমার হাত ধইরা বইসা আছেন- এইটাই আমার রেস্ট।‘ হয়তো সত্যি সত্যিই কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠতো সে, তাই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলতো- ‘আমি এতোদিন ভাবতাম- আল্লাহ বুঝি খালি কষ্ট দেওয়ার জন্যই এ পৃথিবীতে পাঠাইছে আমারে। কিন্তু আপনে যখন সত্যি সত্যি আমারে বিয়া করলেন- তখন মনে হইলো আসলে আমার ধারণা ভুল ! পরিবার বলেন, সমাজ বলেন- এরা যে মেয়েদেরকে ছুইড়া ফেলায়া দেয়- তাদেরই একজনের জন্য আপনে সত্যিকারের ভালোবাসা নিয়া আগায়া আসছেন। একসময়ের প্রিয় মানুষটা এখন নষ্ট হয়া গেছে দেইখা পরিত্যাগ করেন নাই তারে- আমার জন্য এর থেকে বড় পাওয়া আর কি হইতে পারে !!’
আমি কাঁদতে কাঁদতেই বলি- ‘চুপ কর তো পারুল ! কেন শুধু শুধু আমাকে এইভাবে ……’-কান্নার দমকে কথা শেষ করে উঠতে পারি না।
‘কাইন্দেন না। এই জীবনে অনেক কষ্ট করছি আমরা দুইজন। পরের জীবনে আল্লাহ আমাদেরকে সুখ দিবেন নিশ্চয় ……’
এটাই ছিলো পারুলের সাথে আমার শেষ কথা। এরপর শরতের এক অপূর্ব বিকেলে পারুল আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নেয়। চিরদিনের মতই। একবার হারিয়ে ফেলার পরও আবার আমি তাকে খুঁজে বের করেছিলাম, কিন্তু এবার আর সে উপায় নেই আমার ! থাকলে আবারো ঠিকই খুঁজে বের করতাম আমার ভালোবাসার সে অপূর্ব মানুষটিকে !
পারুলের কবর যিয়ারত করতে গেলেই তার ওই শেষ কথাগুলো বারবার শুধু মনে হয় আমার। মনে হয়- পারুল ঠিকই বলে গিয়েছিলো আসলে ! ওপারে তাকে আমি আবারো জীবনসঙ্গিনী রূপে পাবো- এ-ই কি কম সুখের কথা ! নিজের অজান্তেই আমার দু’চোখ তখন ভর্তি হয়ে ওঠে পানিতে, আবেগ-আনন্দে পূর্ন হয় মন !
গভীর প্রশান্ত এক হৃদয় নিয়ে আমি তখন চুপচাপ বাড়ি ফেরার পথ ধরি। শীতলক্ষ্যার পার ধরে হাঁটতে হাঁটতে নিজের মনেই চিঠি লিখতে থাকি পারুলের চিরন্তন ঠিকানায়। যে ঠিকানা আমরা কেউই জানি না, আবার সবাই জানিও !
“ভালো আছি, ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো,
দিও তোমার মালা খানি
বাউলের এই মনটারে।
আমার ভিতরে বাহিরে আন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে…..”
***
(সমাপ্ত)

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা জুন, ২০২০ রাত ৮:০৯

ওমেরা বলেছেন: অনেক করুন গল্প তবু সুন্দর !!

০৫ ই জুন, ২০২০ বিকাল ৩:২০

পুলহ বলেছেন: মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ

২| ০৪ ঠা জুন, ২০২০ রাত ৯:৩৭

রাজীব নুর বলেছেন: পারুলের মৃত্যু আসলেই দুঃখজনক।

০৫ ই জুন, ২০২০ বিকাল ৩:২০

পুলহ বলেছেন: মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ

৩| ০৫ ই জুন, ২০২০ ভোর ৬:৫৪

নেওয়াজ আলি বলেছেন: দুঃখজনক । পড়ে মন খারাপ হলো

০৫ ই জুন, ২০২০ বিকাল ৩:২০

পুলহ বলেছেন: মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

৪| ০৬ ই জুন, ২০২০ রাত ৮:৩২

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: কত মিষ্টি বিষাদময় একটা গল্প! তবুও হয়তো ভেতরে একটু খুশি - অন্ততঃ অল্প সময়ের জন্যেও তো মিলেছিলো দু'জন।

ভাল লেগেছে। প্রথম প্লাস।

০৭ ই জুন, ২০২০ রাত ৮:০৫

পুলহ বলেছেন: অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। পাঠ ও মন্তব্যে কৃতজ্ঞতা জানবেন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.