নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

...

পুলহ

পুলহ › বিস্তারিত পোস্টঃ

#গল্পঃ "হাওয়াই মিঠাই"

১৩ ই নভেম্বর, ২০২০ সকাল ১০:৩৭

আমি ততদিনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি আত্মহত্যা করবো, ঠিক সে সময়েই আলফাজউদ্দীনের সাথে আমার পরিচয় হলো......

আলফাজউদ্দীন শিশুপার্কের সামনে এসে বসে থাকতো। খুব দরদী গানের গলা ছিলো লোকটার। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম- হুইলচেয়ারে বসে বুঝি গান গেয়ে গেয়ে ভিক্ষা করে সে। কিন্তু পরে জানলাম ঘটনা ভিন্ন। আসলে প্রতি বৃহস্পতিবার আলফাজউদ্দীন ওখানে বসে থাকতো তাঁর প্রথম পক্ষের স্ত্রী- জাহানারাকে একনজর দেখার আশায়।

ওদিকে তখন এক সপ্তা'ও হয় নি লতা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এ দেশের অসংখ্য বেকার যুবকের গল্পের সাথে আমার গল্পটাও একাকার হয়ে গেছিলো ততদিনে। মাস্টার্স শেষ হবার পর দেড় বছরেও একটা চাকরি জোটাতে পারলাম না, অথচ লতার বাসাতে বিয়ের প্রস্তাব আসছিলো একের পর এক। বেকার যুবকেরা একটা পর্যায়ে গিয়ে সবকিছুর ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে বোধহয়, দু'জনের মধ্যে আমিও তাই হালটা ছেড়ে দিয়েছিলাম আগে। লতাকে ভুলে যেতে যেতে সিদ্ধান্ত নিলাম- আত্মহত্যা করবো !

এমনই এক উদ্ভ্রান্ত সন্ধ্যায় আলফাজউদ্দীনের সাথে পরিচয় হলো আমার। রাত দশটায় অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে শিশুপার্কের সামনে দিয়ে হাটছি, হঠাতই তখন একজনের গায়কী শুনে থমকে দাঁড়ালাম-

"আমার হাড় কালা করলাম রে
হায়রে আমার দেহ কালার লাইগা রে
আমার অন্তর কালা করলাম রে দুরন্ত পরবাসী......"


যেমনটা বলছিলাম- প্রতি বৃহস্পতিবার আলফাজউদ্দীন ওখানে বসে থাকতো জাহানারাকে একনজর দেখার আশায়। জাহানারা ততদিনে পতিতাপল্লীতে স্থায়ী হয়েছে। এমন মানুষদেরকে আমাদের সমাজ ভুলে যেতে পারলেই বাঁচে। কিন্তু আলফাজউদ্দীন ভুলতে পারছিলেন না। আমি উনার গল্প শুনে মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমার ঘটনা ভদ্রলোকের পুরো বিপরীত। একজন সপ্তাহে সপ্তাহে এসে বসে থাকছে প্রিয় মানুষটাকে একনজর দেখবে বলে, অন্যজন ভুলতে চাইছে চিরদিনের মত ... আহা মানুষ!

আলফাজউদ্দীনের সাথে কেমন করে আমার এতো ঘনিষ্ঠতা হলো- সেটা এ গল্পের সাথে প্রাসঙ্গিক নয়। শুধু এটুকু বলতে পারি- উনার জীবন কাহিনী শুনেই আমি আমার আত্মহত্যার সিদ্ধান্তটাকে পাল্টে ফেলেছিলাম। কার্তিকের এমনই এক হিম হিম রাতে উনি আমাকে উনার জীবনের গল্পটা শুনিয়েছিলেন, যার শুরু আজ থেকে ঠিক পাঁচ বছর আগে......

তখন কেবল উনাদের নতুন বিয়ে হয়েছে। আলফাজউদ্দীন সিএনজি চালাতেন। গ্যারেজে জমার টাকা দিয়েও মাসে পনেরো হাজারের মত বেঁচে যেতো তার। খুব নাকি ঘোরার শখ ছিলো জাহানারার। আলফাজউদ্দীন আদর্শ স্বামীর মত স্ত্রীর শখ পূরণ করতেন মাসে মাসে- থাকা-খাওয়ার বাইরে সত্যি বলতে এটাই ছিলো আলফাজউদ্দীনের অতিরিক্ত খরচ- কখনো আহসান মঞ্জিল, কখনো লালবাগের কেল্লা...... চিড়িয়াখানাও ঘুরতে যেতেন দু'জনে। তবে জাহানারার সব থেকে পছন্দের জায়গা নাকি ছিলো শিশুপার্ক! আলফাজউদ্দীন তাঁর ষোল বছর বয়েসী স্ত্রীর উপর বিরক্ত হতে গিয়েও সামলে নিতেন নিজেকে। কিছু কিছু মানুষ আছে কখনো বড় হয় না। বয়স বাড়লেও মনের একটা অংশ রয়ে যায় শিশুদের মত। আলফাজউদ্দীন তাঁর স্ত্রীর ভেতরকার সে শিশু সত্তাটিকে চিনতে পেরেছিলেন। তাই ঘন ঘন শিশুপার্ক আসার আবদারে অবাক হলেও বিরক্ত হতেন না কখনো।

এমনই এক সময়ে আলফাজউদ্দীনের স্নায়ুর অসুখটা ধরা পড়লো। প্রথম দিকে উনি নাকি পায়ে জোর পেতেন না। গরীব মানুষ একেবারে বাধ্য না হলে ডাক্তারের কাছে যায় না। আলফাজউদ্দীনের পায়ের জড়তা একদিন গিয়ে এমন পর্যায়ে ঠেকলো যে তিনি আরেকটু হলেই নাকি বড়সড় একটা এক্সিডেন্ট করে বসতেন। একরকম মালিকের জোরাজুরিতেই সিএনজি জমা দিয়ে পরদিন ডাক্তারের কাছে গেলেন তিনি।

বেশ কিছু টেস্ট দিলো ডাক্তার। সেগুলো করিয়ে টেস্টের রিপোর্ট পেতে পেতে আলফাজউদ্দীনের হাটুর নীচের অংশ অবশ হয়ে গেছে ততদিনে। জানা গেলো- নার্ভের কি এক জটিল রোগ হয়েছে উনার। ধীরে ধীরে নাকি গোটা শরীরটাই এরকম অবশ হয়ে যাবে। হতাশার কথা হলো- এ রোগের চিকিৎসাও আসলে বড় একটা নেই। দ্রুত মরণ এড়াতে চাইলে বড়জোড় অপারেশন করানো যায়। যদি ভাগ্য ভালো থাকে তাহলে নাকি কোমরের ওপর অংশটুকু প্যারালাইজ হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যাবে, জীবন দীর্ঘায়িত হবে- এটুকুই যা সান্ত্বনা ......

প্রায় বারো লক্ষ টাকার প্রয়োজন ছিলো আলফাজউদ্দীনের অপারেশন করানোর জন্য। এদেশের অনেক মানুষের কাছে বারো লাখ টাকা কোন টাকাই না, আবার অনেকের কাছে এই পরিমাণটুকুই জীবন-মরণ! আলফাজউদ্দীনেরা দ্বিতীয় দলের। ডাক্তার সাহেব সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন- যত দেরি হবে অপারেশন করাতে, সেই অপারেশন সাকসেসফুল হবার সম্ভাবনাও কমবে তত।

আত্মীয়-স্বজন খুব একটা ছিলো না, নিজের সারা জীবনের সঞ্চয় ভেঙ্গে দেখা গেলো চার লাখ টাকার মত জমেছে। ধার কর্জ করে উঠলো আরো দুই, বাকি ৬ লাখ টাকার ব্যবস্থা করতে গিয়েই সংসারটা বরবাদ হয়ে গেলো। শেষমেষ উনারা যে বস্তিতে থাকতেন, সেখানকার মাজেদা খালা টাকার একটা সন্ধান আনলেন। মোট পাঁচ বছরের চুক্তি। এ পুরো সময়টা জাহানারাকে শহরতলীর একটা পাড়ায় থাকতে হবে। নিজের শরীরটাকে পতিতাপল্লীতে বন্ধক রেখে এককালীন যে টাকাটা জাহানারা পেয়েছিলো, সেটা সে স্বামীর চিকিৎসার জন্য দিয়ে দিলো......

আলফাজউদ্দীন এ সবের কিছুই জানতেন না। জানলেন দেনা-পাওনা সব মিটে যাওয়ার পর। কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ সব ফুলিয়ে ফেলেছিলো জাহানারা। এতো ভালো একটা অপারেশন হবার পরও আদরের বৌটা এভাবে কেন কাঁদছে, সেটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেন নি আলফাজউদ্দীন। একটু সুস্থ হবার পর মাজেদা খালার কাছ থেকে সব শুনলেন।

এই ঘটনার তিন বছরের মাথায় আলফাজউদ্দীন দ্বিতীয় বিয়ে করেন। আরো আগেই করতে পারতেন, কিন্তু উনি শর্ত দিয়ে রেখেছিলেন- জাহানারা আলফাজউদ্দীনের স্ত্রী হিসেবেই থাকবেন আজীবন, এবং সে যদি কখনো ফিরে আসে- তবে আলফাজউদ্দীন তাকে গ্রহণ করে নেবেন ঠিক স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েই। বলা বাহুল্য- এমন শর্তের পর মেয়ে খুঁজে পাওয়াটা একটু কঠিনই বৈ কি। তার উপর আবার লোকটা যেখানে পঙ্গু! অবশ্য অর্থনৈতিকভাবে আলফাজউদ্দীন ঘুরে দাঁড়িয়েছেন ততদিনে। একটা এনজিওর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে মুদি দোকান দিয়েছিলেন। অপারেশনের পর স্রেফ ছয় মাস বসে থাকলেন। এরপর দিনরাত পরিশ্রম আর ভাগ্যের উদার স্পর্শে আলফাজউদ্দীনের বিনিয়োগ উঠে এলো অল্প সময়েই। আগে সিএনজি চালিয়ে যা উপার্জন করতেন, তার প্রায় কাছাকাছিই আয় হতে লাগলো দ্রুত। সব মিলে বেশ একটা রমরমা অবস্থা।

তবে অপূর্ণতা ছিলো শুধু একদিকেই- জাহানারার অনুপস্থিতি! শুরুর দিকে মেয়েটা আসতো মাঝে মাঝে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শিশুপার্কের সামনে এসে দেখা করতো। সেই থেকেই আলফাজউদ্দীনের এখানে আসাটা অভ্যাস হয়ে গেলো। প্রতি বৃহস্পতিবার তিনি শিশুপার্ক গেটের সামনে এসে বসে থাকেন। মাঝে মাঝে খুব বেশি মন খারাপ থাকলে গানে টান দেন-

"তুই যদি আমার হইতি রে
ও বন্ধু, আমি হইতাম তোর
কোলেতে বসাইয়া তোরে,
করিতাম আদর......"


বেশিরভাগ সময়েই তাকে হতাশ হতে হয় অবশ্য। কাগজে কলমের হিসাবে পাঁচ বছর পর জাহানারার সাথে পল্লির চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিলো। হয়তো চাইলেই সে পারতো আবার আলফাজউদ্দীনের কাছে ফেরত আসতে। কিন্তু জাহানারার মত মেয়েরা নিজেরাই নিজেদেরকে গুটিয়ে নেয় একসময়। হয়তো ভাবে- একবার যে অভিশপ্ত যে জীবনে তাদের পা পড়েছে- এ থেকে তাদের আর কোন মুক্তি নেই ! আশপাশের অভিজ্ঞতা থেকেই উপলব্ধি করে এরা- সমাজ কিভাবে, কত দ্রুত এসব মেয়েদেরকে ভুলে যায় ! তাই তো নতুন নাম, নতুন পরিচয়ে ভিন্ন এক জীবন শুরু হয় এদের, অবশ্য সেটাকে যদি কোনো জীবন বলা যায় আদৌ !

এরপর আরো কত বছর পার হয়ে গেছে ! আমি সে-ই কবে ঢাকা থেকে চলে এসেছি সিলেট ! বিয়েও করেছি। লতার কথা এখনো মনে হয় মাঝে-সাঝে। মানুষের চিন্তা আসলে চেইন-রিএকশনের মত। এক সুতো ধরে টানলে আরেক সুতোয় টান পড়ে। তাই লতাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন যে দুঃখিনী জাহানারার মনগড়া, আবছা মুখ ভেসে ওঠে কল্পনায়- সেটা টের পাই না ! আমি সেই আলফাজউদ্দীন কিংবা জাহানারার বৈবাহিক জীবন কিংবা ভালোবাসাবাসির কিছুই দেখি নি কখনো- তারপরো চোখের সামনে দিয়ে যেনো তাদের টুকরো জীবন- শিশুপার্কে ঘোরাঘুরি, জাহানারার শ্যামল হাতে শক্ত-করে-ধরে-থাকা হাওয়াই মিঠাই, আর দু'জনের মমতাপূর্ণ হাসিমাখা আলিঙ্গন ভেসে যায় বায়োস্কপের মত! জীবনটাকে আমার তখন হাওয়াই মিঠাই এর মতই রঙিন, অথচ ঠুনকো লাগে। কেন জানি না- গভীর আবেগে দু'চোখ হঠাৎ ভর্তি হয়ে যায় পানিতে।

আমি দূর চা-বাগানের মাথায়, কুয়াশায় ভর করে নেমে আসা গোধূলির নিভু নিভু আলোর দিকে তাকিয়ে আবৃত্তি করি-

"কড়ির মতন শাদা মুখ তার,
দুইখানা হাত তার হিম;
চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম
চিতা জ্বলে: দখিন শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়
সে-আগুনে হায়।

চোখে তার
যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার;
স্তন তার
করুণ শঙ্খের মতো— দুধে আৰ্দ্ৰ— কবেকার শঙ্খিনীমালার;

এ-পৃথিবী একবার পায় তারে, পায়নাকো আর।"


***
(সমাপ্ত)

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৩ ই নভেম্বর, ২০২০ দুপুর ১:৫৯

ওমেরা বলেছেন: মানুষের জীবনে কত জটিলতায় ভরা ।

১৬ ই নভেম্বর, ২০২০ রাত ৮:৫৯

পুলহ বলেছেন: জ্বি, আসলেই। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ !

২| ১৪ ই নভেম্বর, ২০২০ দুপুর ১:৫৫

রাজীব নুর বলেছেন: লেখাটা খুবই ভালো লাগলো।

১৬ ই নভেম্বর, ২০২০ রাত ৮:৫৯

পুলহ বলেছেন: ধন্যবাদ !

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.