নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নেই তো কোন পরিচয়

আহা রুবন

নেই তো কোন পরিচয়

আহা রুবন › বিস্তারিত পোস্টঃ

অচেনা সময়

১২ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১:০২


গোরার পাড় থেকে গরু সামনের পালানে চরাতে নেয়ার সময় মধুকে বলল কথাটা। কাকা-কাকি বাড়িতে আসছেন। এতক্ষণ সে আমগাছ-তলায় ভেজা বালি পায়ের ওপর সাজিয়ে চেপে চেপে শক্ত করে, আস্তে করে পা-টা টেনে বের করছিল। সামনে বসে আছে তিন বছরের বোন সোহাগী, ঘাড় কাত করে হাসি মুখে দেখছে, ওর জন্য ভাইয়া কীভাবে মুরগির ঘর বানায়। মায়ের কথা শুনে মধু মাথা তুলে মাকে দ্খেতে থাকে।
‘কখন আসবে মা?’
‘আজই বিকেলের ট্রেনে।'

মধুর বয়স আট। ও যখন সোহাগীর বয়সী— মাত্র ক-দিনের রোগে ভুগে মারা যায় বাবা— বাঁধাই কারবার করত। রসুন, সর্ষে, মরিচ, কলাই, যখন যা সুবিধে। সংসার কোন মতে চলে যেত। সামান্য যা জমি ছিল, বৃদ্ধ বাবার সঙ্গে কিছু করার চেষ্টা করত। ছোট ভাইটা ভালছাত্র হওয়ায় তাকে নিয়ে ছিল অনেক আশা। ভাইটাও ছুটিতে এলে নিড়ানি হাতে ক্ষেতে চলে যেত, আর নানা গল্প করত বাবা-ভাইয়ের সাথে। তাদের চোখে স্বপ্ন নাচতে শুরু করত। পড়াশোনা চলা অবস্থায় এক বাড়িতে গৃহশিক্ষকতা শুরু করে। ভাইয়ের ওপর আর কত। এদিকে এমন আবস্হা হলে যা হয়— পাস করে চাকরি নিতে না নিতেই, সেই ছাত্রী বৌ হয়ে এল ঘরে। অবশ্য বৌ-টা যথেষ্ট লক্ষ্মী। আজকাল তো শহুরে মেয়েরা এমন হয়-ই না। ভাই মারা যাবার পর ভাবি তার কারবারের যতটুকু বুঝেছিল— চালিয়ে যেতে থাকে— কষ্টে সংসারের হাল ধরে। বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়ি আর দুটি ছেলে-মেয়ে— চলে যায়। ঢাকা থেকে কেউ এলেই তার কাছে মধু-সোহাগীর জন্য জামা-কাপড় ভাবির শাড়ি আর মা-বাবার জন্য টাকা-পয়সা প্রায়ই পাঠায়। বাড়িতে এসেছিল দুই বছর হয়ে এল। এবার আসার খবরে তাই আনন্দের ঢল যেন ফিরে এল।


ছোট ভাইটাকে পেয়ে ওরা দারুণ খুসি। ওর নাম তমাল। দুই ভাই-বোনের এথন কাজ ছোট ভাইকে গ্রামের পরিবেশ চেনানো। নিজেদের হঠাৎ ওরা বড় ভাবতে শুরু করল। এ-বাড়ি সে-বাড়ি ঘুরে বেড়ালেন কাকি— লাঠি হিসেবে রাখলেন মধুকে। পথ চলতে চলতে নানা গল্প চলে। শহরের আলোর ঝলকানি দেখায় লোভ জন্মাতে থাকে মনে। মধু এক সময় কাকির ভক্ত সেজে যায়। এক দিন দুপুরের খাবার শেষে কাকিই প্রথমে তুলেলন কথাটা। কাকা তাতে সায় দিলেন— মধুকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চান। দু-ভাই একত্রে থাকবে, কাছেই স্কুল— সেখানে ভর্তি করে দেবেন। মা শুনে প্রথমে একটা ধাক্কা খেল, পরে চিন্তা করে দেখল, ভালই হবে। ছেলে মানুষ হবে— তার জন্য তাকে যত কষ্টই হোক, সহ্য করতেই হবে। আর কাকা-কাকি ওদের খুব ভালবাসে। হযত ভালই হবে। এদিকে মধু পড়ে গেল মহাধন্ধে, মায়ের জন্য মন খারাপ হয়ে গেল— আবার নতুন শহুরে জীবনের তীব্র আকর্ষণ তাকে টানতে লাগল। অবশেষে সেই দিন এসে গেল। বিদায় কালে মা আঁচলে মুখ মুছল। কোলে নিতে ভীষণ কষ্ট হলেও রাস্তা পর্যন্ত নিয়ে এল। সোহাগী ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল, ভাইয়ের পা ধরে, মায়ের পিছু পিছু আসতে লাগল। ভ্যান ছাড়ল নতুন পথের সন্ধানে— আঁচলে ঢাকা মায়ের আধেক মুখ এক সময় বাঁশঝাড়ের আড়ালে হারিয়ে গেল।


শহরে নতুন জীবন— আলো, গাড়ির শব্দ, মানুষ, কোলাহল— এতদিন কোথায় ছিল! দিন চলে যায় নতুন নতুন অভিজ্ঞতার জাদুতে। কেবল রাতে যখন একা— বোন-মায়ের জন্য মনটা কেমন করে ওঠে। স্কুলে ভর্তি হয়েছে মধু— আস্তে আস্তে বন্ধু বাড়তে লাগল। নতুন বন্ধুদের সাথে আনান্দে দিন কেটে যায়। বাসায় কাকিকে দু-এক সময় আলু পেঁয়াজ ছিলে দেয়া, ঘর ঝাড়ু দেয়া আর ছোট ভাই এর সঙ্গে দিনভর খেলা। রাতে কাকি বসেন পড়াতে, তমাল তখন ব্যস্ত টিভিতে কার্টুন নিয়ে।

দুই এক দিন পর পর মা-বোনের সাথে কথা বলিয়ে দেন কাকি। সোহাগী কত কিছুর জন্য যে বায়না ধরে... মাত্র পাঁচ বছরের বড় ভাইয়া— তার কাছে যেন বিশাল কেউ, তার অনেক ক্ষমতা— যা চাইবে সব সে এনে দেবে। মধুও বোনের বায়না পূরণ করবে বলে আশ্বাস দেয়। ‘তোর জন্য সব নিয়ে আসব, দুষ্টুমি করবি না কিন্তু।’

এই কয় দিনে কত বড় হয়ে গেছে...
কাকির কাছ থেকে একটা কার্টন চেয়ে নিয়েছে মধু। বারান্দায় ভাঙ্গা টেবিলের নিচে এক কোণে রেখে দিয়েছে। এর মধ্যে তার নিজের জিনিসপত্র। ক-দিন না যেতেই সেটি প্রায় ভরে উঠতে লাগল। কাকা-কাকি চকলেট, চিপস্ যা-ই আনুক দু ভাইকে ভাগ করে দেন। দু-জনে সেসব খায় আর গল্প করে। খেলায় দিন কেটে যায় এক এক করে। মধু কিন্তু চকলেট, ক্যান্ডি সব খায় না, তার কিছু জমিয়ে রাখে ওর নিজস্ব স্থানে। গাড়ি নিয়ে দুভাই খেলা করে। তমালের মামা একটি সুন্দর দামি গাড়ি দিয়েছে কয়েকদিন আগে। সেটার ওপর খুব লোভ ওর, কিন্তু ওকে তা দিতেই চায় না তমাল। খেলা শেষে আবার কাকির হাত দিয়ে শোকেসে উঠিয়ে রেখে দেয়। মধু একদিন গাড়িটি দরজার আড়ালে লুকিয়ে রাখল। খেলার মধ্যে এক সুন্দর মহিলা বেড়াতে আসে, তমাল বলে ডাক দেয়ায় দৌড়ে চলে যায় সে। আর সেই ফাঁকে কাজটি করে তমাল— পরে আর খেয়াল থাকে না তমালের। সবাই যখন গভীর ঘুমে, মধু চুপি চুপি উঠল বিছানা থেকে। গাড়ি নিয়ে খেলতে লাগল সাবধানে। অনেকক্ষণ ধরে খেলল সে। খেলা শেষে শোকেসের পাশে রেখে বিছানায় শুয়ে পড়ল।


অনেক সময় কেউ কেউ বেড়াতে আসে, তারা শুধু একটি চিপস্ বা একটি চকলেট নিয়ে আসে। তমালের হাতে দেয়। তমাল দৌড়ে গিয়ে ভাইয়ার হাতে দেয়, খুলে দিতে। মধু সে-টা খুলে দেয় আর অন্য কোনও কাজে মন দেয়ার ভান করে— শুধু কান খাড়া করে রাখে, কখন বলবে, ‘আর খাব না।’ ওর হাতে দেয়া মাত্র খাওয়া শুরু করে দেয়।

একদিন বাড়িতে হঠাৎ হৈচৈ মধু কিছু বুঝতে পারল না। তমালের মাথায় লম্বা টুপি— আগে কখনও এমন লম্বা টুপি কারও মাথায় দেখেনি। মধু দরজার পর্দার ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে লাগল সবাইকে, যদিও ওকে কেউ খেয়াল করছিল না। তমালই তখন সবার কেন্দ্রবিন্দু। তমাল ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিবিয়ে দিল— আর হাত তালি দিল সবাই। বড় গোল মতো কিছু একটা চাকু দিয়ে কাটল তমাল...
কাকা-কাকি খুঁজতে লাগলেন।
‘মধু তুই কোথায় গেলি রে? সবাই এখানে, কোথায় গেলি...’
ওকে এক টুকরো কেক দেয়া হল। অর্ধেকটা খেয়ে বাকি অর্ধেক রেখে দিল ওর নিজের জায়গায়...

রাতে সবাই ঘুমে, চুপচাপ চারিদিক। মধু বিছানা থেকে উঠল। রান্নাঘরের বাতি জ্বালাল। দরজায় দেখে এল কেউ উঠল কি না। ফিরে, একটা কাগজে মোড়া কেকটি বের করল— রাখল শেল্ফের ওপর। তিনটি ম্যাচের কাঠি গাঁথল মোমবাতির মতো করে। আবার দৌড়ে গেল, উঁকি দিল, কেউ এল না তো? ম্যাচ জ্বালিয়ে কাঠিগুলোয় আগুন ধরাল। তারপর ফুঁ দিয়ে নেবাল। হাততালি দিল— ভয় পেয়ে গেল সে, জোরে শব্দ হয়েছে। খুব সাবধানে ছুরি দিয়ে কেটে খেতে লাগল।


মেঘেঢাকা আকাশ, বিকেল থেকেই। পুরো শহর ঘুমিয়ে আজ আগেভাগে। দানবের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে আকাশ জুড়ে। দাঁত কিড়মিড় করে ভেংচি কাটে— কেঁপে ওঠে সমস্ত শহর। বিজলির পিছু পিছু নেমে আসে কান-ফাটানো ভয়ঙ্কর গুড়ুম গুড়ুম... কাকা-কাকি দরজা বন্ধ করে। একাকি মধু ডাইনিং-রুমে কেঁপে ওঠে। চোখে ঘুম নেই— এক সময় বিছানা টেনে দরজার সঙ্গে জুড়ে দেয়। গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকে। মনে পড়ে মায়ের কথা, বোনের কথা। আতঙ্ক আর ঘুমের লড়াই চলতে থাকে— বিজয়ী হয় ঘুম।

মাঝরাতে কাকির ঘুম ভেঙ্গে যায়। পিপাসায় উঠতে হয় বিছানা থেকে, অনিচ্ছা নিয়েই। আজ পানি আনা হয়নি ঘরে। চোখ পুরোটা না খুলেই দরজা দিয়ে বেরুতে যান। চিৎকার করে ওঠেন— পায়ের নিচে কী!? ঘুমের ঘোরেই কেঁদে উঠে কাঁপতে থাকে মধু— ঊরুতে পায়ের... কাকি দরজা ভেজিয়ে দেন। কুসুম আলোয় দেখতে পান, মধু বিছানায় বসে ঊরু চেপে ধরে উঁ উঁ করছে। কোলে করে টেবিলে বসিয়ে আলো জ্বালেন। মধুর সারা মুখে আতঙ্কের ছায়া। বিস্ময় কাটিয়ে কাকি প্রশ্ন করেন, ‘তুই এখানে কেন?’ মালিশ করে দিতে থাকেন ব্যথার স্থানে।
‘ভয় করছিল...’
‘কাঁদিস না আমার বাপ, আমি তো দেখিনি— কাকা জেগে গেলে আমাকে বকবে— কাঁদিস না।’
মধুর মাথায় নিজের গাল চেপে ধরে, হাত বোলাতে থাকেন আর বলতে থাকেন, ‘আমি দেখিনি রে, দেখিনি...’

মধু বারবার কেঁপে উঠতে থাকে— কান্না রূপ নেয় কাঁপুনিতে। কাকি আরও নিবিড় করে আঁকড়ে ধরেন। মধুর বারবার মনে হতে থাকে মায়ের কথা। ইচ্ছে করে কাকির গলা জড়িয়ে ধরে— সাহস হয় না— কাকির শাড়ি মায়ের চেয়ে অনেক সুন্দর... কিছু শিক্ষা মানুষ নিজ থেকেই পেয়ে যায়— ছোট্ট শিশুটি পর্যন্ত বাদ থাকে না। মধুর নিজের ভেতরকার সেই শিক্ষকটির নাম দারিদ্র। দারিদ্র মানুষের সাহসকে কেড়ে নেয়, বুদ্ধিমানকে সাজায় গর্ধপ, কথাপ্রিয় তাকিয়ে থাকে নির্বাক হয়ে, অধিকারিকে শেখায় নত হতে।


‘তাড়াতাড়ি বাজার নিয়ে এসো— দু-দিন ছুটি আছে, ঘরবাড়ি একটু গুছিয়ে ফেলি, একদম জঘন্য হয়ে আছে। আজ তোমাকেও হাত লাগাতে হবে।’

মধুকে নিয়ে কালিঝুলি ঝাড়-পোছ শুরু করে দিলেন। টেনে বার করলেন মধুর বাক্সটাও— উল্টো করে ঢালেলন। বেরিয়ে এল যত রাজ্যের জিনিস— ক্যান্ডি, কোটের বোতাম, পাখি-পাহাড়ের ছবি, গিফট-বক্স বাঁধার পাতলা রিবন, অর্ধেক আপেল, ওষুধের খালি বাক্স, আরও হাবিজাবি সব। হঠাৎ একটা গোলাপি রঙের চুলের ক্লিপ বেরোনোয় কাকি সেটা তুলে নিয়ে বলেলন, ‘এটা এখানে কেন? কেন নিয়েছিস?’ মধুর গালে একটা চড় বসিয়ে দিলেন। ক্লিপটি মধুর খুব পছন্দের— পাথর বসানো, চকচক করে। কী মনে করে কাকির ড্রেসিং-টেবিল থেকে লুকিয়ে এনেছিল।

কাকা বাজার নিয়ে ফিরলে বলেলন, ‘তোমার ভাতিজার কাণ্ড দেখো! সব ক্যান্ডি, চকলেট না খেয়ে এই ময়লার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। খেতে বললাম খাচেছ না...’
‘কি রে, ফেলে দিয়েছিস কেন? খা...’

দুই ভাইকে ওগুলো ভাগ করে দেয়া হয়েছে— তমাল খাচ্ছে আর তাকিয়ে ভাইয়াকে দেখছে। কাকা ধমক দিলেন— একটা ক্যান্ডি ছিঁড়ে হাতে দিয়ে বলেলন, ‘আমার সামনে খাবি। ভাল জিনিস পছন্দ হয় না, না?’

মধুর কান্নার কোনও শব্দ হয় না, চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াতে থাকে, মুখটা বিকৃত হয়ে ওঠে। কামড় দিতে চায়, কিন্তু কান্নার তোড়ে জোর পায় না, মুখ হাঁ হয়ে যায়।

‘হয়ত তমালকে দিয়েছ বলে খাচ্ছে না। ভাইয়াকে ওগুলো দিয়ে দাও।’
তমাল ভাইয়াকে দেখতে দেখতে হাতে দিয়ে বলে, ‘তুমি খাও এগুলো, আমি পরে খাব। হাত ধরে ঝাঁকাতে থাকে আর বলে, ‘ভাইয়া কাঁদে না, কাদেঁ না।’

জঞ্জাল যত, এনে জমা করা হয়েছে গেটের সামনে। নোংরা কাগজ-পত্রের সঙ্গে মধুর বাক্স স্তুপ করে আগুন দিতে দিতে কাকা বলেলন, ‘তোকে একটা ভাল দেখে ব্যাগ কিনে দেব।’

এক ফাঁকে মধু তমালকে ক্যান্ডিগুলো দিয়ে দিয়েছে— সে খাচ্ছে আর তাকিয়ে ভাইয়ার সঙ্গে আগুন জ্বালানো দেখছে। পেয়ারা গাছটা জড়িয়ে ধরে মধু দেখতে লাগল— ওর জমানো সব কিছু জাদুর মতো ফুরিয়ে যাচ্ছে। আগুন খেয়ে ফেলছে সব, একে একে। কিন্তু চোখ ধাঁধানো প্রখর রোদের কারণে সে আগুন চোখে পড়তে চায় না।

আহা রুবন

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১:২৪

শাহরিয়ার কবীর বলেছেন: ভালো লিখেছেন ।
শুভ ব্লগিং

২| ১২ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১:৩২

আহা রুবন বলেছেন: ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.