নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নেই তো কোন পরিচয়

আহা রুবন

নেই তো কোন পরিচয়

আহা রুবন › বিস্তারিত পোস্টঃ

মুখপুড়ি

৩১ শে মে, ২০১৬ সকাল ১০:৪২



কোমরের খাঁজে বস্তাটা লেপটে বসেছে জোঁকের মত। এমনিতে ভার বেশি হবার নয়— সচরাচর যেমনটা হয়। কিন্তু গত রাতভর বৃষ্টি, প্যাচপ্যাচে করে দিয়ে গেছে মাঠ-ঘাট। পিচ্ছিল মাঠে এগুতে হয় দু পায়ে খামচি কেটে।
‘বু দাঁড়াও একটু...’
ঝাঁকি মেরে বস্তাটা ইঞ্চি দুই ওপরে ওঠায়। থমকে ঘার বাঁকা করে তাকায় খানিক দূরে। দুটি মেয়ে থপথপ পায়ে দৌড়ে আসতে থাকে।
‘নূপুর বু আমরা কয়টা শাক আর লতা তুলছি—নাও-না?’
‘বাড়ি নিয়ে আয় বস্তায় জায়গা নাই...’
কিছু দিন হয়, এর ওর কাছ থেকে শাক-পাতা, কচুর লতি, দু চারটা সবজি সংগ্রহ করে করে শহরের ট্রেন ধরে।

বাবা ধানের বোঝা নিয়ে পা পিছলে পড়ে ঘাড় ভেঙ্গে সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেল। কামলা বেচাই ছিল যার একমাত্র কাজ। মাকে নিয়ে পড়ল সে অকূল সাগরে। জ্যাঠা যথেষ্ট সাহায্য করে, কিন্তু সেই-বা আর কতটুকু কী করতে পারে; যার নিজেরই ঠিক মত তিন বেলা চুলোয় হাঁড়ি চড়ে না।নূপুরকে তাই মাত্র চোদ্দ বৎসর বয়সে সংসারের হাল ধরতে হয়।



সারা মাঠ ঘুরে শাক-পাতা উঠিয়ে তিন কিলো মিটার পথ হেঁটে ট্রেন ধরতে হয়। বছর প্রায় হল, কিছু টাকা জমেছে আর তখন থেকে এ-বাড়ি সে-বাড়ি ঘুরে দুটো আনাজ কলা, মোচা, দেশি ডিম... কিনে শহরে ছোটে।কোনও কোনও দিন ভালই লাভ থাকে। দেশি মুরগির ডিম হলে বলে ‘আমার নিজের পোষা মুরগির গো।’ প্রথম প্রথম এমন মিথ্যে বলতে সঙ্কোচ হত—এখন বুঝে ফেলেছে এটা মিথ্যে নয়, একে বলে বিক্রয় কৌশল।


বুড়ো-বুড়ির কাছ থেকে জেনে নিয়েছে লতা-পাতার ভেষজগুণ সম্পর্কেও। শহরের লোকেরা বেশ স্বাস্থ্য সচেতন। উপকারী শাকপাতার কদর বোঝে। কায়দা করে দুষ্প্রাপ্য শাকগুলোই নূপুর সংগ্রহ করে। ইচা, কলমি, হেলেঞ্চা, ঢোল-কলস, ঢেঁকিশাক, নটে, কাঁটানটে, থানকুনি—ইদানীং তেলাকুচো পাতা বেশ চাচ্ছে। বহুমূত্র রোগীরা নেয়। কখনও কাঁটা-নটে গাছসহ নিয়ে যায়—বলে ‘যত কষা, পেশাবের জ্বালা-যন্ত্রণা আছে, এই শাক আর শেকড়ের রস খাইবেন সব শেষ।’ থানকুনি পাতা দেখিয়ে বলে ‘মুখের গন্ধ ভাইগা যাইব। ভাবিরে কইবেন চাটনি কইরা খাইতে—চেহারা খুলব।’ কচু শাক দেখিয়ে বলে ‘একেবারে কচকচা ইলিশ মাছের মাথা দিয়া, না পাইলে নোনা ইলিশ দিয়া ঘাটি করবেন—মুখ থেইকা থুইতে পারবেন না।’ অথবা হয়ত বলে ‘দুইটা তিতা আর একটা মিঠা পাট শাকের আঁটি নেন, রোজ রোজ তো ভাজি খান, আজ কুচা চিংড়ি দিয়ে ডালের মত ঝোল করতে কইবেন। তিতা তিতা আবার খানিক পিছলাও হইব। সম্ভার দিতে কইবেন ডালের মত। চেলচেলায়া এক গামলা ভাত পেটে ভইরা ফালাইবেন টেরই পাবেন না।’ নূপুরের এসব শুনে কেউ মজা পেয়ে হাসে, কারও বা হঠাৎ এসব খাওয়ার ইচ্ছে হয়। আবার কিছু লোক পাল্টা অশ্লীল মন্তব্য করে।

কখনও কখনও সজনে ফুল, বক ফুল, বেতফল, আতা, নিয়ে আসে।একবার জালে দেবার জন্য বাড়িতে কচি গাব ঢেঁকিতে থেঁতলে ভেজানো হল। একটু মজা করেই গাবের বিচিগুলো পরিষ্কার করে মাটির একটা ভাণ্ডতে করে বাজারে নিয়েছিল। এক ক্রেতা তাজ্জব হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখল, পরে সবগুলো বিচি নিয়ে নিল, বাচ্চাদের দেখানোর জন্য। কিছুদিন আগে ছেলে-মেয়েদের কাছে নুন মেখে কচি গাব-বিচি খাওয়ার ছোটবেলার গল্প করেছিল সে।

নূপুরের ক্রেতাদের বেশির ভাগই পরিচিতরা। নতুনরা যে যোগ হয় না তা নয়, তবে বেশির ভাগ পুরনো ক্রেতারাই প্রায় শেষ করে ফেলে। আগে অনেক কষ্ট করতে হত। একেক দিন একেক স্থানে বসতে হত। নানা জনে উৎপাত করত, টাকা কম দিত, মেরে দিত। একদিন স্টেশনের পাশে রোদের মধ্যে পসরা সাজিয়ে বসেছে। দুটো ছোকরা কিছুক্ষণ পরপর এসে এটা-সেটা দেখার ভান করে অশ্লীল ইঙ্গিত করতে লাগল। একটা কলার মোচা নিয়ে ঝাঁকিয়ে দাম জিজ্ঞেস করল। ত্রিশ টাকা দাম চাওয়ায় মুখ বিকৃত করে বলল ‘এই দামে আর বেচা লাগবে না, নিয়া বইসা থাক।’ শেষ কথাগুলো বলার সময় মোচাটা নূপুরের উরু সন্ধিতে চেপে ধরল। এতক্ষণ রোদের মধ্যে দরদর করে ঘামছিল নূপুর, এবার দু চোখ ফেটে জল বেরিয়ে ঘামের সঙ্গে মাখামাখি হয়ে গেল। দু হাতে অশ্রু-ঘাম মুছতে লাগল। আর ছেলে দুটো দাঁত বের করে হাসতে লাগল। কিছু দূর থেকে একটা লোক হনহন করে ছুটে এসে, দুই হাতে ছেলে দুটোর একজনের চুল, অন্যজনের সার্টের কলার চেপে ধরেন। ঠাস ঠাস করে কয়টা চড় লাগিয়ে দিলেন গালে। এতক্ষণে লোক জড়ো হয়ে উঠেছে। ঘটনা জেনে ওদের কান ধরে উঠবস করাল সবাই। লোকটি নূপুরের কাছ থেকে মাঝে মাঝে এটা সেটা কেনেন। হুঙ্কার দিয়ে বললেন ‘সব তোল বস্তায়—আমার সাথে আয়।’ ওর কান্না আরও বেড়ে গেল, সবার সহানুভূতি পেয়ে। ‘যা স্যারের সাথে যা...’ ভদ্রলোক ওকে তার বইয়ের দোকানের সামনে বসার জায়গা করে দিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি বইয়ের একটা দোকান দিয়েছেন তিনি। তারপর থেকে নূপুরের আর পেছনে তাকাতে হয়নি। রোজ বইয়ের দোকান খোলার আগেই ছালা বিছিয়ে বসে পড়ে। সব বিক্রি হয়ে যায় পটাপট।



কিছুদিন আগে থেকে কয়েকজন ছেলে রোজ অনেক পরিমাণে শাক-সবজি নিয়ে যায়। একদিন উৎসাহের সঙ্গে জানতে চেয়েছিল এত বাজার করে তারা কী করে। জানাল ওরা মেসের ছাত্র। ওখানে আঠারজন ছাত্র আছে, তাই এত বাজার। ছেলেগুলোকে নূপুরের বেশ লাগে। কী সুন্দর হাসিখুশি সব সময়। মাঝে মধ্যে বায়না করে বিশেষ কোনও শাক-সবজি এনে দেবার। ওদের দেখলে সুন্দর একটা হাসি দিয়ে নূপুর বলে ‘আপনাদের পছন্দের জিনিস আনছি। কয়জন চাইছিল, কইছি বেচা হয়া গেছে... এইযে নেন।’


কয়দিন পর মেসের ছেলেদের দুজন এসে প্রস্তাব করল, বাজারে বসার আগেই যদি ওদের মেসে কিছু দিয়ে আসে, তবে ওরা নিয়মিত নেবে। আর মাস শেষে টাকা দিয়ে দেবে। নূপুর রাজি হয়নি, তার ওপরেই সংসার চলে, কাজেই এক মাস অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। শেষমেশ সপ্তাহ শেষে বিল পরিশোধের চুক্তিতে আবদ্ধ হল। এতে নূপুর দারুণ খুশি। বাড়তি আয় করার জন্য আরও সকাল সকাল মাঠে, এ-বাড়ি সে-বাড়ি ছোটে। পাশের গ্রামে পর্যন্ত ঢুঁ মারা শুরু করল। রাতে মায়ের সঙ্গে শুয়ে শুয়ে গল্প করে ‘এই রকম যদি হয়, তাইলে সামনের বছরই গমের ডাঁটি ফালায়া দিয়া, ঘরে টিনের চাল লাগাতে পারব।’ মা কপট রাগ মিশ্রিত কণ্ঠে বলে ‘ নে এখন ঘুমা খালি টাকার হিসাব... নিজের চেহারাটার দিকে একটু নজর দিস...’

কয়দিন ধরে অবিরাম বৃষ্টি, শহরে যাওয়া বন্ধ। ঘরে যে টুকু চাল ছিল গত কালই শেষ হয়ে গিয়েছিল। সকালে উঠেই মাকে বলল ‘ঘর থেকে না বের হলে তো আর চলছে না মা... কিছু একটা নিয়ে যেতে চাই। তাড়াতাড়ি কিছু দাও খাই।’
‘এই ঢলের মধ্যে কোন দরকার শুনি? কিছু না জুটলে রোজা থাকমু, বাইরে যাওয়ার কোনও কাম নাই।’
‘না মা, মেসটা যদি হাত ছাড়া হয়—কতজন ধান্দায় আছে, ধরার জন্য।’
‘এর মধ্যে কী নিয়া যাবি?’
‘তোমার আচারের বয়ম কয়টা দাও। বৃষ্টির দিন তো আশা করি বেচা হইব। সাথে কাদের ভাইয়ের ভাঙ্গা কলাগাছের কলা কয়টা নিমুনে।’
‘থো তোর ঘ্যানঘ্যানানি, মাইনষের আর কাম নাই, এর মধ্যে তোর আচার খাইতে ভিজতে বাইর হইব! আর ঐ বিচাকলা শহরের মানুষ খাইব নাকি? আমরাই খাই ঠেলায় পইড়া... কোনও দরকার নাই যাওনের।’
‘মা তুমি বুঝতেছ না, বাজারে এই কয়দিন কিছুই যায় নাই, বিচাকলাই আনাজকলার আদর পাইব। যা পাই তাই তো আগাইল...’
‘যা বোঝোস কর...’ একটা ঝামটা দিয়ে মাথায় ছেঁড়া কাপড়ের একটা টুকরো ফেলে রান্নাঘরের দিকে দৌড় দিল মা।



থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। শহরটা একেবারে ফাঁকা। নূপুর যেখানটায় দোকান সাজিয়ে বসে, আজ তিনটে কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। দুই একটি দোকান বাদে সবই বন্ধ, যেগুলো খোলা আছে তাও আবার অর্ধেকটা বন্ধ করে রেখেছে। যেন কারফিউ চলছে শহরে। এই পরিবেশটা খানিক ভীতি জাগিয়ে তুলল নূপুরের মনে।
ছাতি থাকা সত্ত্বেও বাতাসের ঝাপটায় পুরো শরীর জবজবে হয়ে আছে। আজ ছেঁড়া একটা ট্রাভেল ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়েছে। জামার নিচের অংশ ঝাঁকি মেরে ছাড়িয়ে নেয় লেপটে থাকা শরীর থেকে। গেটে ঠকঠক শব্দ করে। কিন্তু ভেজা গেট সব শব্দ শুষে নেয়। ধুমধাম থাপ্পড় দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। অনেক সময় পর বারান্দায় একজন এসে চিৎকার করে ‘কে?’
‘ভাই আমি নূপুর, শাক দেই যে...’
প্রায় পাঁচ মিনিট কেটে যায়, কোনও সাড়া পাওয়া যায় না। ফেরত চলে আসবে কি না ভাবল— তাহলে তো যাতায়াত ভাড়াই উঠবে না। আর শহরের যা অবস্থা অন্য কোথাও কিছু বিক্রি করতে পারবে বলে মনে হয় না। মার কথা না শুনে শহরে আসা ঠিক হয়নি। না কি ফ্যামিলি বাসায় ঢুকবে? এই সব ভাবতে ভাবতে লক্ষ করল ছাতা মাথায় একজন এসে গেট খুলে দিল।
‘বৃষ্টির জন্য তিন দিন আসি নাই, ভাবলাম আপনাদের সমস্যা হইতেছে,তাই...’
ছেলেটি গেট বন্ধ করে বারান্দায় দৌড় দেয়। বারান্দায় গিয়ে কাঁধ থেকে ব্যাগ নামায় নূপুর।
‘বৃষ্টির দিন তাই আচার আনলাম। খিচুরির সাথে জমে ভাল।’
‘ভাল করেছ।’
‘লোকজন কম নাকি ফাঁকা ফাঁকা লাগে যে?’
‘বৃষ্টির জন্য সবাই বাড়ি গেছে।’
‘এ হে! তাইলে তো খামাখা আইলাম।’
‘না না কয়জন তো আছি। তোমার আচার দিয়ে যাও, ঘরে আসো।’



বৃষ্টির মধ্যেই কাক ভেজা হয়ে ফুলি মানে নূপুরের বড় ফুফু বাবার বাড়ি এসেছে। সঙ্গে বাদশা আর অপরিচিত একটি ছেলে। নূপুরের দাদি মেয়েকে এই বিরূপ পরিবেশের মধ্যে হঠাৎ দেখতে পেয়ে বিস্মিত। তবে ওর হাসি মুখ দেখে নিশ্চিন্ত হল—খারাপ কিছু নয়।

নূপুরের বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে। বাদশা নামের ছেলেটার সঙ্গে। বাবা- মা কেউ নেই। ফুলি ফুফুর বড় জা এর ভাই এর ছেলে সে। ছয় বৎসর থেকেই নূপুরের ফুফুর বাড়িতে আছে। পাশের গ্রামে ছোট একটি দোকান করেছে। দর্জিগিরি করে আর টুকটাক কিছু কাপড়ও বিক্রি করে।
‘মা আমরা সবাই বাদশাকে খুব ভালবাসি। ছোট বেলা থেকেই ও খুব শান্ত স্বভাবের। বাপ-মা নাই বলে কেউ কখনও অনাদর করি নাই। তোমার জামাই পরিষ্কার বলে দিছে—নূপুর আর বাদশার যদি বিয়া হয়, আমরা যেটুক অংশ পাই ওগো দিয়া দেব। ছোট বউ তুমি কথা দিয়া দাও, আমরা জানি নূপুর বাদশাকে পছন্দ করে। তোমার ছেলে নাই, ছেলে পাইবা, বাদশা মা পাইব। এইখানেই একটা ঘর উঠায়া নিব। কি রে বাদশা ঘর তোলার খরচ দিবার পারবি তো?’
বাদশা লাজুক মুখে ঘার কাত করে।



বছর খানেক আগে নূপুর ফুফুর বাড়ি গিয়েছিল মেলা উপলক্ষে। দিন পনের ছিল সেবার। নূপুরের ফুফুরা এখনও যৌথ পরিবারেই আছে। কাজেই রাতে মাঝে-মধ্যে বাদশাকে খাবার পরিবেশন করতে হয়েছে। বড় ফুফু হঠাৎ খেয়াল করল, বাদশা বাড়ি ফিরলে নূপুর রান্নাঘরে ঘুরঘুর করে। ফুফু কিছুটা আঁচ করল, হিসাব-নিকাশ করে মনে মনে বলল ‘খারাপ হয় না।’
মেলার দিন বাদশাকে বলল ‘নূপুরকে মেলায় নিয়া যা।’
বাদশা কিছু বলল না, কিন্তু নূপুরের মুখ লাল হয়ে গেল। অথচ কয় বছর আগেই বাদশা, নূপুর, শেফালি, মিঠু, ময়না দল বেধে নদীতে কত ঝাঁপাঝাঁপি করত।



বাদশা মিষ্টি আর বড় দুটো ইলিশ মাছ এনেছে। ঘরে কোনও তরকারি নেই। ফুলি বলল ‘কয়টা ভাজো আর কয়টা ডাঁটাফাঁটা কিছু দিয়ে ঝোল তরকারি করো।’ বুড়ি ছুটল, কার বাড়ি ডাঁটা আছে।



নূপুরের যখন জ্ঞান ফিরল সমস্ত শরীর ব্যথায় ভেঙ্গে যাচ্ছে। ওরা চার হাত-পা বেঁধে ফেলেছিল চৌকিতে—মাকড়সা জালে যেভাবে হাত-পা ছড়িয়ে থাকে। তিন জন পর্যন্ত মনে আছে। তার পর নিশ্বাস যখন বন্ধ হয়ে আসছিল, পানি চেয়েছিল। ওরা কি ওকে পানি দিয়েছিল? হয়ত দিয়েছিল, হয়ত না। আবার পিপাসা লাগছে। ‘একটু পানি...’ কোনও সারা পাওয়া গেল না। এখন আর হাত-পা বাঁধা নেই। বারান্দায় শুয়ে আছে নূপুর। সব রুম তালা দেয়া।


সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, জবুথবু শহর গুটিসুটি মেরে আছে আশি বছরের বৃদ্ধার মত। কিছুক্ষণ উদভ্রান্তের মত হাঁটল নূপুর। সব রাস্তাই চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু ভাল ভাবে চিনতে পারছে না। মাঝে মাঝে ঠাণ্ডা বাতাস কাঁপুনি ধরিয়ে দিতে চাইছে। গলায় হাত দিয়ে দেখল জ্বর এসে গেছে। হঠাৎ মনে হল গলায় যেন আঁচর... হাত দিতেই জ্বলা শুরু করল। সমস্ত শরীর হাতড়াতে লাগল আর কোথায় কিছু হয়েছে কি না।


‘ভাই সন্ধ্যার ট্রেনটা কি আছে?’
‘চলে গেল মাত্র।’


বাস-স্ট্যান্ডে বসেছিল আনমনা হয়ে। একটা বাস দাঁড়িয়েছিল অনেকক্ষণ, ডেকে ডেকে যাত্রী তুলছিল।
‘আপা বাস ছাইড়া দেব ওঠেন।’
যেন কথাগুলো বুঝতে পারেনি সেভাবে হেল্পারের দিকে তাকাল নূপুর।
‘আপা গেলে ওঠেন আজ আর বাস নাই কিন্তু।’
নূপুর দাঁড়াতে চেষ্টা করে আবার বসে পড়ল। বাসের হেল্পার এগিয়ে গিয়ে বলল ‘অসুস্থ না কি? তাইতো মনে হয়। হাত দেন...’
অস্ফুট স্বরে বলল ‘আমার কাছে ভাড়া নেই।’
‘ওস্তাদ ভাড়া নাই, ফহিন্নি।’
‘থাক তাইলে, আয়া পর।’
‘হয়ত বিপদে পড়েছে বেচারি। একজনের ভাড়া না নিলে তোমাদের চলে না?’ ক্ষোভ ঝাড়ল এক যাত্রী।
‘আমাগো কন কেন, আপনেও তো দিতে পারেন?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ আমিই দেব, ওঠাও তুমি...’




অন্যদিন হলে দেরি করার জন্য কৈফিয়ত দিতে হত। আজ বাড়ির উঠোনে ঢুকতে দেখেই জেঠিমা বলল ‘ঐ যে আইসা গেছে!’
‘তাড়াতাড়ি আয় মুখপুড়ি।’ দাদি তাকে এই বলেই বেশিরভাগ সময় ডাকে।
নূপুর কারও কথায় কান না দিয়ে পগারের দিকে নেমে গেল।


কাপড় পাল্টে যখন চৌকির কোণাটায় বসল—সবাই এসে গোল করে ঘিরে ধরল। তারা বিয়ে ঠিক করেছে শুনে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাল না, কেবল দাঁতে নখ কাটতে লাগল নূপুর।
‘বউ আগে ওরে ভাত দাও, মুখটা ছোট হয়ে গেছে ক্ষিধায়।’
অন্যমনস্কভাবে ধীরে ধীরে উঠে ভাত খেতে বসে সে। ডাঁটার টুকরোগুলোর ওপর বড় একটা ইলিশ মাছের টুকরো, টুকরোটার মাঝে সামান্য একটু ডিম। নূপুরের মনে হল ওকে কেটে টুকরো করে বাটির মধ্যে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। দু চোখ ভরে জল আসতে লাগল, ফুঁপিয়ে উঠল নূপুর। নিজের বাম বাহুতে ঘাড় গুঁজে চোখ বন্ধ করল। মনে হতে থাকল বারবার, মা-র বাধা সত্ত্বেও কেন যে শহরে যেতে গেল!
‘কি রে ভাত খা।’
মেয়ের কোনও প্রতিক্রিয়া না দেখে মা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। তবে কি মেয়ে এই বিয়েতে রাজি নয়! এদিকে তো সব পাকা হয়ে গেছে, আগামী মাসের চার তারিখ।
‘মা তুই কি রাজি না?’
কোনও উত্তর নেই। জেঠিমা বলল ‘তোমরা খালি ফুলির কথায় সব ঠিক কইরা ফালাইলা...’
‘আমি দেখতেছি। ওই মাগি, ফুলি যে কইল...? তুই রাজি না? ক?’
নূপুর সারা দেয় না কোনও, ফুঁপিয়ে উঠে মাথা নিচু করে চোখ ঢাকে কনুইয়ের ভাঁজে।
‘কোনও সমস্যা নাই বাদশারে পছন্দ না করলে বিয়া ভাইঙ্গা দেই?’
ক্ষীণ স্বরে নূপুর বলে ‘না।’
‘ফুলির কথা কি ঠিক, তুই বাদশারে পছন্দ করস?’
নূপুর ঘার কাত করল। ‘ওরে মুখপুড়ি! তলে তলে এই সব!’ গাল টিপে দিল দাদি।
‘মুখপুড়ির মনের আশা পূরণ হইতেছে, আর মাগি কান্দে! হাস... হাস মাগি। হাসবি না? খাড়া কাতুকুতু দিতেছি, হাস...’ আরও জোরে হাসানোর চেষ্টা করে দাদি।

কিছুক্ষণ জড় বস্তু হয়ে থাকে যেন। তারপর মনে হল নূপুর সবাইকে ভেংচি কাটছে... ‘দাদি... আমি তো হাসার চেষ্টাই করতেছি, তা খালি ভেতর থেইকা কান্না বারাইতেছে... দাদি আমি যে বাদশা ভাইকে খুব ভালবাসি...’ শেষ কথাগুলো বলে নূপুর দাদিকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।

মন্তব্য ৭ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ৩১ শে মে, ২০১৬ দুপুর ১২:০৩

কল্লোল পথিক বলেছেন:




সুন্দর গল্প।
ভালো লেগেছে।

৩১ শে মে, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:০৩

আহা রুবন বলেছেন: প্রিয় কল্লোল দা আপনাকে আমার ব্লগে পেলেই মনট আনন্দে ভরে ওঠে।

২| ৩১ শে মে, ২০১৬ বিকাল ৩:৫৬

বিজন রয় বলেছেন: অনেক ভাল লাগল।
+++++

৩১ শে মে, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:১১

আহা রুবন বলেছেন: আপনার মত বড় লেখকেরা সব সময়ই উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আমার মানের যারা তারা তো মন্তব্য করছে না। তাই মাঝে মাঝে সংশয় জাগে, আসলে কি লেখা হচ্ছে?

৩| ৩১ শে মে, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৪১

বিজন রয় বলেছেন: ভাল হোক আর খারাপ হোক লিখতে থাকুন, লেখা থামাবেন না।
কে কি বলল না নিয়ে ভাববেন না।

শুভকামনা।

৪| ৩০ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ১২:২৩

ফেরদৌস প্রামানিক বলেছেন: ওয়াও ! আমি তো আপনার এই গল্প পড়ে পুরাই থ মেরে গেলাম। গল্পকবিতা ডটকমে এরকম ভালো লেখা দেন না কেন? আপনার লেখার হাত তো অসাধারণ !

৩০ শে আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ১:২৫

আহা রুবন বলেছেন: আমার কেন জানি মনে হল মনে যা অনুভূতি তৈরি হয়েছিল ঠিক মতো প্রকাশ করতে পারিনি। একটা খচখচানি ছিল। কিন্তু বড় সমস্যা হল, কোথায় পরিবর্তন করা উচিত সেটাও বুঝতে পারছি না। অবশ্য একথাও সত্য লেখকের নিজের বিচার সব সময় ঠিক নাও হতে পারে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.