নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নেই তো কোন পরিচয়

আহা রুবন

নেই তো কোন পরিচয়

আহা রুবন › বিস্তারিত পোস্টঃ

বড় গল্প: দাগ অথবা কাজল (কিস্তি — ৫ম)

০৬ ই নভেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:৪৮




১০

ঘুম থেকে উঠল একটু দেরিতে। ব্রাশে টুথপেস্ট লাগানোর সময় স্বপ্নটা আবার ভেসে উঠল। আয়নায় নিজেকে দেখে হেসে ফেলল নীলা। অকারণেই যেন হাসতে ইচ্ছে করছে। আর যা দেখল, ঘুম ভেঙ্গে— সবই সুন্দর লাগছে।
কলেজে দু-একজন তো বলেই বসল, ‘তোকে খুব সুন্দর আর প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে।’ এর উত্তর দিয়েছিল নীলা সুন্দর একটা হাসি দিয়ে। দিনটা কেটে গেল হই হই করে। বাড়ি ফেরার পথে ইচ্ছে করল— দিপুর সঙ্গে দেখা করে যায়। কল্পনায় যতবার দিপুর সামনে দাঁড়িয়েছে, বুকে হাতুরির শব্দ পেয়েছে। শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। এ-অবস্থায় দিপুর সামনে নিজেকে কিছুতেই স্বাভাবিক রাখতে পারবে না, তাই ওখানে যাবার প্রচণ্ড ইচ্ছেটাকে ছাইচাপা দিতে হল।

সন্ধ্যেটা কাটাল নিজের ঘরেই, কিছু বই-পত্র পড়ে। সব ভনিতা— আসলে পড়া হল না কিছুই। নিজেকে প্রতারণা করতে গিয়ে, নিজের কাছে ধরা পড়ে লাল হল... রাতের খাবার খেয়ে দরজা বন্ধ করল তাড়াতাড়ি। কেবলই মনে হচ্ছিল সবাই বুঝি ওকে তাকিয়ে দেখছে— এই বুঝি ধরা পড়ে গেল। নীলার এমন আর কখনও হয়নি। একা থাকতে ভাল লাগছে। এপাশ ওপাশ করতে করতে বিছানার চাদরে ঝড় বয়ে গেল। মশা মারল ধুমধাম প্রচণ্ড শব্দে— লোকাল বাসের হেলপারের মতো। এক সময় নীলার হঠাৎ মনে হল— ও বড় হয়ে গেছে...

১১

তিনদিন কেটে গেল। নীলা দিপুর ওখানে গেল না। অথচ মনটা পড়ে রইল, ওখানেই। মনস্থ করেছে— আজ ফেরার পথে দেখা করে যাবে। দুপুরের খাবার ক্যান্টিনেই সারল। সারে পাঁচটার দিকে দিপুর গেটের সামনে— না আজ আর হাতুড়ির শব্দ নেই। গোলাপি রুমালে পুরো মুখ মুছে ভেতরে ঢোকে। সালাম পেয়ে দিপু ফিরে তাকাল।
‘কেমন ছিলে?’
‘ভাল।’
মোড়া টেনে বসল, কোলে ব্যাগ নিয়ে।
‘আপনি?’
‘দেখতেই পাচ্ছ?’
‘না, কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, শুনতে চাই।’
দিপুর চোখে চোখ রাখল নীলা। কিন্তু তা এক মুহূর্তের— লাল হয়ে উঠল— চোখ ঘুরিয়ে নিল। মনে মনে ভাবল, ‘দিপু ভাই কি আমার স্বপ্নটার কথা জানে? আমাকে অন্যরকম লাগছে না-তো? যদি সব জেনে যায়...’ ভয়ে কুঁকড়ে গেল।
‘আগের মতোই।’
দিপুর জবাবে হুঁশ ফিরে পায়।
‘ব্যথা কি কমেছে?’
‘কিছুই তো বুঝি না, মনে হয় একই...’
নাক কুঁচকে উত্তর দিল, মনে হল, হঠাৎ করেই বুঝি ডাস্টবিনের গন্ধের ঝটকা এসে লেগেছ। শেষে ঘার কাত করে নীলার দিকে তাকাল।
‘তোমার কথা বলো— এলে না যে?’
‘এই তো এলাম...’ হাসে নীলা, ব্যাগে একটা মৃদু চাপড় দিয়ে বলে। যেন নীলা নয়, ব্যাগটাই এসেছে।
দিপু আড়-চোখে ব্যাগের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘না মানে... এতদিন পরে?’
‘এতদিন?!’ নীলার চোখে কৌতুক খেলে যায়। দিপু ঠোঁট কামড়ায়।
‘চারদিন তো?’
মিনমিন করে বলে, ‘ঠিকই তো চারদিন, আর আমার মনে হল, দু-সপ্তাহ হয়ে গেছে। সারাদিন শুয়ে-বসে থাকি তো, সময়গুলোকে মনে হয় নাটাইয়ের সুতোর মতন...’
মনেমনে নীলা বলল, ‘ওই অবস্থা আমারও... মুখে বলল, ‘খেয়াল করে দেখেছেন, ঘুড়ি ওড়ার সময় সুতোয় অনবরত টান দেয়, ছিঁড়তে চায়— কিন্তু ছিঁড়ে গেলে, তার ওড়াটাই শেষ হয়ে যায়।’

দু-জনই কেমন সঙ্কোচ বোধ করতে লাগল। দ্রুত প্রসঙ্গ পালটাল নীলা।
‘ভাবির সাথে যোগাযোগ হয়েছে?’
‘না:।’
‘কেমন হল?’
‘উঁ- কী?’ভ্রু কুঁচকে দিপু জিজ্ঞেস করল।
‘ভাবির কথা বলছিলাম। মানুষ একসাথে থাকলে তো একজন আরেকজন দ্বারা প্রভাবিত হয়, আপনাদের বেলায় হল না? এতগুলো বছর, কম সময় তো নয়!’
‘হ্যাঁ এগারো বৎসর।’
এক মুহূর্ত চুপচাপ— পরস্পরকে খেয়াল করে উভয়েই হাসতে লাগল।
‘ভাবিকে প্রভাবিত করতে পারলেন না?’
‘তুমি কি জাদু-টোনার কথা বলছ?’
‘তা হবে কেন? দু-জন একত্রে বেশিদিন থাকলে, পরস্পরকে অনুকরণ করায়, নিজেদের চেহারার মধ্যে একটা মিল পর্যন্ত চলে আসে। আর আপনাদের মতের মিলই হল না?’
‘ওই যে বললে মিল... অনুকরণ, তার কিছুটা তো থাকতে হয়। একজনের আদর্শ যদি অন্যের একেবারে বিপরীতে থাকে; তবে তো বিন্দুমাত্র তার প্রতি আকৃষ্ট হবে না, প্রভাবিতও হবে না। যেমন ধরো— আওয়ামী লীগ আর বিএনপির কথা— আওয়ামী লীগ যে আদর্শ ধারণ করে, বিএনপি তার বিপরীতে অবস্থান করে, সহজ করে বললে— আওয়ামী লীগের বিরোধিতাই হল বিএনপির আদর্শ। জামাতের অবস্থানও আওয়ামী লীগের বিপরীতে, ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক দর্শনগত কারণেই। তাই এদের দ্বারা আওয়ামী লীগ কখনই প্রভাবিত হবে না। বিএনপির যেহেতু কোনও রাজনৈতিক দর্শন নেই...’
‘আপনি কি তাই মনে করেন?’
‘হ্যাঁ তাই?’
একটু থেমে বলতে লাগল, ‘জামাতের সাথে ওঠা-বসা করলে তারা সহজেই প্রভাবিত হবে; যেহেতু উভয়েই আওয়ামী লীগ বিরোধী। কিন্তু আওয়ামী লীগ জামাত যতই ওঠা-বসা করুক, কেউ কাউকে প্রভাবিত করতে পারবে না। দেখতে পাচ্ছ তো বিএনপির ঘাড়ে জামাত কীভাবে চেপে বসেছে... আর আওয়ামী লীগ ও জামাত, একে অন্যের প্রতি চোখ ওলটাতে সময় নেবে না। আসলে এদের মধ্যকার মতৈক্যের স্থায়িত্ব খুব কম সময়ের জন্যই সম্ভব— ক্ষমতা আর শুল্কমুক্ত গাড়ি ... হাসল দিপু।
‘সাবান তৈরিতে কস্টিক-সোডার বদলে তুমি কস্টিক-পটাশ দিতে পারো, কেননা ওরা সমধর্মী; চিনি দিলে তো আর মিশ খাবে না।’
‘এক হল কীভাবে? সোডিয়ামে ব্লাড-প্রেশার বাড়ে, পটাসিয়ামে কমে ...’
‘নীলা তুমি না ...’ হা হা করে দুজন হেসে উঠল।

‘দিপু ভাই কি সাবান বানাতে পারেন?’
‘সোজাই তো, পারো না?’
‘না, শেখাবেন?’
‘তেল, পানি আর কস্টিক-সোডা লাগবে।’
‘পরিমাণ?’
‘একেক তেল বা চর্বির জন্য একেক রকম— তবে মোটামুটি তেল আর পানি সমান, কস্টিক-সোডা পাঁচ ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ ১ কেজি তেল বা চর্বিতে ২০০ গ্রাম কস্টিক-সোডা, আগের রাতে ১ লিটার পানিতে গুলে রাখতে হবে। গন্ধযুক্ত তেল ব্যবহার করলে সাবানও গন্ধ হয়, এক্ষেত্রে নারকেল তেল খুবই ভাল সাবান তৈরি করতে পারে। সাবান তৈরি শুরু হলে একটু লবণ দিতে পারো— না দিলেও হয়, লবণ দিলে অতিরিক্ত ক্ষার ও গ্লিসারিন পানিসহ আলাদা হয়ে যায়। ওটা তোমার রান্না ঘরের আঠালো তেল সাফ করতে ব্যবহার করতে পারো। সব যোগাড়? তবে কড়াইতে তেল নিয়ে গরম করো, অতঃপর কস্টিক-সোডা মিশ্রিত পানি ধীরে ধীরে ঢালো, আর দাও— ঘুঁ-উ-টা, ঘুঁ-উ-টা-...’ হাত নাড়িয়ে দেখাল, হাসতে লাগল দিপু। হঠাৎ নীলার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
‘দিপু ভাই, আপনার ঘুঁটা শুনে আমার একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। ছোট বেলায় ফুফুর বাসায় বেড়াতে গিয়েছি— আমরা টিভিতে চেখভের একটা নাটক দেখছি, নাটকটা খুবই হাসির। আমার ফুফাতো বোন তন্দ্রার ছোট কাকার মেয়ে ঝুমুও নাটক দেখায় মত্ত। অথচ অনেকক্ষণ ধরে ও বাথরুম আটকে আছে। নাটকের দম ফাটানো হাসি, শেষ না হতেই শুরু হল, সাদেক আলির সেই বিখ্যাত বিজ্ঞাপন। সেদিনই প্রথম দেখি ওটা। ঝুমু তখনও বসে— মিস করতে চায়নি। তো সাদেক আলি মাটির হাঁড়িতে, রসগোল্লার মতো করে খাবার স্যালাইন আনে। (দিপু কৌতূহলের সঙ্গে নীলার দিকে তাকিয়ে আছে হাসি হাসি মুখে।) বিজ্ঞাপনের শেষ অংশে যখন অভিনয় করে দেখায়, কীভাবে স্যালাইন তৈরি করতে হয়। আর তিনি কীভাবে ঘুঁটা দিয়েছেন, এবং নুর যখন গ্লাসে করে খাচ্ছেন, সুজা খন্দকার বলতে থাকেন— আ-হা আ-হা–য়া। ওটা দেখে আমাদের পেটে খিল ধরে যায়, হাসতে হাসতে। এদিকে হয়েছে কী, হাসির দমকে ঝুমু আর ধরে রাখতে পারেনি; পাজামা ভিজিয়ে একাকার...’
নীলা হো হো করে হাসতে লাগল। দিপুও হাসিতে যোগ দিল, তবে মুচকি হেসে। হাসি শেষ হলে গম্ভীর হয়ে গেল নীলা। মুখ হয়ে উঠল, পাকা টম্যাটোর মতো। মনেমনে বলল, ‘এ কী করলাম!... হায়, কী ভাববে দিপু ভাই... একটা বেকুবের মতো কথা বলে ফেললাম!’
দিপু মুখে হাত দিয়ে, নীলার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল। নীলা বোকাটে লাজুক হাসতে লাগল, আর শরীর মোচড়াতে লাগল। দিপু সহজ করার জন্য বলল, ‘মাঝে-মধ্যে আমরা আগ-পিছ না ভেবে, সরল-মনে অনেক কিছুই করে ফেলি। তাতে কখনও সখনও বিব্রত হলেও, ও-তে করে কিন্তু আমরা পরস্পরের কাছে আসতে, টনিক হিসেবেই কাজ করে ওটা।’
নীলা নিরুত্তর রইল। একটু কেশে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কোন দলকে সমর্থন করেন?’
‘কাউকেই না’
পিঠ এলিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমার নিজস্ব একটা অবস্থান আছে, তার কিছুটা বাম এবং আওয়ামী লীগের সাথে মেলে।’
‘বিএনপির সাথে কিছু মেলে না?’
‘ওদের গলাবাজির সাথে মেলে, কাজের সাথে মেলে না।’
‘আপনি গলাবাজি করেন!’
‘আরে না, বোঝাতে চেয়েছি ওদের কথাগুলো তো খুব সুন্দর...’
‘কিন্তু বামদের খুঁজতে গেলে তো, কোথাও পাওয়া ভার। ... প্রকৃতি অসম্পূর্ণতা হ্রাস করতে চায়— হয়ত তারা প্রকৃতির কাছে অপরিহার্য নয়, তাই তাদের এই অবস্থা ...’
‘না না তুমি পৃথিবীর দিকে তাকাও— দুর্বলের পক্ষে প্রথমে দাঁড়ায় কিন্তু বামেরাই। যতদিন অন্যায়-অবিচার থাকবে, এদের প্রয়োজন ফুরোবে না। তোমার ধারণা ঠিক নয় ...’
‘পরমাণুর নিউট্রনের মতো— নিজস্ব চার্জ নেই, অথচ সে-ই নিউক্লিয়াসকে ধরে রাখে, নয়ত পরমাণুটি ভেঙ্গে পড়ত ... আপনারাও তাই ...’ নীলা হাসল।
‘যতই টিটকারি দাও— আমাদের শক্তি সম্পর্কে উপহাস করো, আমরা না থাকলে বুঝতে ...’
‘তা করছি না, শুধু আপনাদের কাজের ধরনটা মনঃপূত নয়। অন্যদিন বলব সেসব— আগে মতামতগুলো গুছিয়ে নেই।’
নীলার দু-চোখে একটা ঝিলিক বয়ে গেল। দিপু একটু গম্ভীর হয়ে বলল, ‘পাকা ঝগড়া করতে চাও? তা বেশ, হবে— এখন বলো তুমি কাকে সমর্থন করো?’
‘যারা বুদ্ধিমান, পড়ালেখা করে, আত্মসমালোচনা করে— এদের প্রতি দুর্বল।’
‘তেমন কি কাউকে উল্লেখ করতে পারবে?’
‘পারব, তবে তারা যে রাজনীতি করে না।’ দু-জনই হা হা করে হাসতে লাগল।
‘এক কাজ করো— তুমি রাজনীতিতে নেমে যাও, আমি সমর্থন দেব।’
‘ছেলে হলে চেষ্টা করে দেখতাম।’
‘সমস্যা কী? মেয়েরা কি রাজনীতি করছে না?’
‘তা করছে, তবু মেয়েরা এখনও বাঁধা ...’
‘কিসে বাঁধা বলো, কেটে দিয়ে আসি। তোমার এই কথাটা মানতে পারলাম না। একটা সময় হয়ত ছিল, এখন তা নেই।’
‘বাধা দূর হয়েছে ঠিক, তবু স্বআরোপিত কিছু বাধা-বাঁধন রয়েই গেছে। আর প্রকৃতিও হয়ত অনুকূল নয় মেয়েদের প্রতি ততটা।’
‘ভুল, সবই ভুল ... প্রকৃতি মানুষকে এক-চোখেই দেখে, সন্দেহ করা পাপ, মস্ত বড় পাপ।’ দিপু মাথা দোলাতে লাগল।
‘আপনারা তো বুড়ো আঙ্গুলে কুড়ুলের কোপ দিয়ে, কুমারত্ব রক্ষা করতে পারেন— একজন নারী? (‘ফাদার সিয়ের্গি’ গল্পের প্রতি ইঙ্গিত করল।) ভুলে যাবেন না— শাজনীন মৃত্যুর পরেও ধর্ষকাক্রান্ত হয়েছিল।’
দিপু কিছু না বলে হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইল, নীলার মুখের দিকে এবং পরিষ্কার বোঝা গেল না তলস্তয়ের গল্পটি তার পড়া কি না।

কিস্তি -৪র্থ

কিস্তি - ৩য়

কিস্তি - ৬ষ্ঠ

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.