নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নেই তো কোন পরিচয়

আহা রুবন

নেই তো কোন পরিচয়

আহা রুবন › বিস্তারিত পোস্টঃ

বড় গল্প: দাগ অথবা কাজল (কিস্তি — ১৪তম)

০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৩৮




৩৪

সকালের নাস্তা শেষে দিপু ড্রয়িংরুমে দৈনিক পত্রিকা নিয়ে। নীলা সুঁই-সুতাসহ দিপুর দুটি প্যান্ট মেরামতে ব্যস্ত। দিপুর পুরনো অভ্যেস, ডান পা-টা প্যান্টের মধ্যে একটু গলিয়েই, দেয় এক টান। বুড়ো আঙ্গুলের মাথায় লেগে সেলাইটা যায় খুলে। শুধু ডান পা-তেই এই সমস্যা। সেটা এতদিন ও নিজেই অনভ্যস্ত হাতে বড় বড় ফোর দিয়ে জুড়ে দিত। দর্জির কাছে এই সব ছোট কাজ নিয়ে তেমন একটা যেত না, ওরা আগ্রহ কম দেখায় বলে। সামঞ্জস্য আনতে প্রায়ই, বাঁ পায়ের সেলাইও খুলতে হত। সদ্য দাড়ি গজানো তরুণটির মতো— বাম জুলফি সমান করতে গিয়ে, ডানটাকে বদখদ করে কাটা... এই প্রথম নিপুণ হাতে সুতোটি ডুব দিয়ে উঠে, ডুব দিয়ে এগোতে লাগল।
মঙ্গল কিছু সময় হল বসেছে, বলল, ‘ভাই তাহলে আস্তে-ধীরে দোকানে এগোই।’
‘একটু, কথা আছে।’
পত্রিকা থেকে চোখ না তুলে দিপু বলল, ‘দেশটা যাচ্ছে কোথায়? যখন যে দল ক্ষমতায়, তাদের ছাত্রনেতাদের উৎপাতে টেকা দায়।’
‘নয়ত বিরোধীদল যে সহজে ক্ষমতায় আসতে পারত না। চন্দ্র শেখর-সীমা অতিক্রম করা সেই নক্ষত্রটির মতো— যে নিজেই নিজের ধ্বংস-খেলায় মেতে ওঠে।’ নীলা না তাকিয়ে সুঁই-সুতোর খেলায় মত্ত অবস্থায় থেকে বলল।
‘আমাদের চিড়েচ্যাপটা হওয়া ছাড়া আর উপায় কী?’ মঙ্গল মন্তব্য করল।
‘কিন্তু আর কত? জনগণ যেন ফুটবল— গোল হোক আর না হোক, কপালে লাথি আছেই।’
মঙ্গল এতক্ষণ সোফায় হেলান দিয়ে ছিল। পিঠ উঠিয়ে সোজা হয়ে বসল। বুঝতে পেরেছে, দিপু ভাই এ বিষয় নিয়ে বলতেই তাকে আটকিয়েছে। তার মেজাজ চেনা আছে মঙ্গলের, তার সাথে এ রকম আলোচনা হয়, সে-ও বেশ উপভোগ করে। অনেক কিছু জানা হয়, শেখা হয়, নিয়োগকর্তার সঙ্গে সম্পর্ক সহজ হয়। চোখে-মুখে গাম্ভীর্য আর আগ্রহ ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘কোনও রাস্তাও তো নেই, চেষ্টা তো আর কম করা হল না; এই দুই দলের বাইরে কাউকে সমর্থন দিয়ে গড়ে তোলার।’
‘প্রয়োজন হয়নি, তাই গড়ে ওঠেনি।’
‘এ কী, বললেন ভাই!? অনেকেই একটা পরিবর্তন চায়।’
‘কেউ কেউ হয়ত চায়, কিন্তু পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। উপযুক্ত পরিবেশ না থাকলে, কোনও কিছুই বিকশিত হয় না। আমরা তো সবাই নাতি-পুতি চাই, কিন্তু অবিবাহিত সন্তানের ঔরসে হলে? সব কিছুর সময় লাগে। সময়ের আগে যত চেষ্টাই হোক না কেন, ঐ অবৈধ সন্তানের মতোই তাদের অবস্থা হবে।’
‘ভাই দুঃখিত! যারা চেষ্টা করেছেন, দেশের মঙ্গল চিন্তা করেই করেছেন— সবাই, তা বলছি না।’
‘ম্যানেজার ভাই, তাদের উদ্দেশ্য খারাপ ছিল, বলিনি, কারও কারও তো নয়-ই। বলতে চেয়েছি— সময়, পরিবেশ, এসব একটা বিষয়। মানুষ না চাইলে; সে যত শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারীই হোন না কেন, কোনও পরিবর্তন, বিকল্প-শক্তি গড়ে তুলতে পারবেন না।’
‘আমি কিন্তু পরিবর্তন চাই, তবু হচ্ছে না। মানুষ চাইলেই কি সব হয়ে যায়, নেতৃত্ব বলে কিছু নেই? কাশ্মীর, বেলুচিস্তান... কী বলবে?’
‘নীলা তুমি একবার গভীরভাবে ভেবে দেখো— আসলেই তুমি পরিবর্তন চাও কি না, বা কতটুকু চাও, অথবা তুমি পরিবর্তন চাও, অথচ সেটা ঐ দল দুটির কাছ থেকেই। সমস্যাটা এখানেই। বাংলাদেশের মানুষ মূলত আওয়ামীপন্থী নয়ত আওয়ামী-বিরোধী। কাজেই আদর্শগত দিক থেকে এই বিপরীত-মেরুর মধ্য থেকে কী করে, ভিন্ন একটি শক্তি বের হবে; যা সহজে সমর্থন পেতে পারে? ক সাহেব যখন দলে থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেন, বিএনপি সমর্থন করে, তার খুব প্রশংসা করে, কিন্তু তাকে ভোট দেয় না। এ-ই- হল বাস্তবতা— তারা কখনই তার বিপরীত আদর্শকে গ্রহণ করবে না।’
‘সে না-হয় বুঝলাম ভাই, কিন্তু আওয়ামী লীগের বিরক্ত সমর্থক কেন ক সাহেবকে সমর্থন দিতে চায় না?’
‘চায় না, এই কারণে— এঁরা নতুন কিছু করতে গিয়ে, আওয়ামী লীগের চেয়ে আরও বিতর্কিত কিছু করে বসেন। এঁরা নতুন দল করতে যান, প্রায় ক্ষেত্রেই ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব থেকে, আদর্শের জন্য নয়।’
‘বন্ধু তুমি বলেছিলে, বিএনপির কোনও রাজনৈতিক দর্শন নেই। যদি না থাকে, তবে তাদের মধ্য থেকে কেন তৃতীয় বা ভিন্ন ভিন্ন দল বের হচ্ছে না, যেহেতু কোনও দর্শনই নেই, পুরনো কর্মীদের দর্শনযুক্তদলের প্রতি আকৃষ্ট করা কি সহজ নয়? তা হচ্ছে কি?’
‘শোনো, এরা ভাবে— ‘আওয়ামী লীগের বিরোধিতাই যদি করব, তবে ছোট বা নতুন কেন, আদিটার সাথেই থাকি। আর সত্যিই কি কেউ নতুন আদর্শ আনতে পেরেছেন...’
‘তাহলে কি ভাই, সামনে তৃতীয় কোনও পথ নেই?’
‘আপাতত নেই। আর তৃতীয় বা চতুর্থ শক্তি বের হলে, তা বেরোবে আওয়ামী বা বামধারা থেকেই। এবং, এবং এক সময় সেটিই দ্বিতীয় দলে পরিণত হবে। যে আদর্শের জন্য মুক্তিযুদ্ধ হল, তা-কে অবহেলা করে, কোনও রাজনৈতিক দর্শন নেই— কেবল কাউকে বিরোধিতা করে, যুগের পর যুগ, কেউ টিকে থাকতে পারে না। এমন কী, মুক্তিযুদ্ধে যে দলের সবচেয়ে বেশি অবদান, তারাও যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে লুকোচুরি খেলা খেলে, ইতিহাস তার বিচার করবেই, করবে।’
‘সে তো হতেই হবে, আপনার আগের কথার সাথে আমি কিছুটা সহমত পোষণ করি। বিএনপি থেকে কেউ ভিন্নমত প্রকাশ করলে, বা দল থেকে বের হলে, সে একেবারে হারিয়ে যায়। সে তুলনায় আওয়ামী লীগে কিছুটা হলেও অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র আছে।’
‘না নেই, আপনি যেটা দেখছেন, সেটা গণতন্ত্র নয়, অন্য জিনিস।’
মঙ্গল কিছুটা বিস্মিত হয়ে দিপুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর থুতনি একটু চুলকে মিনমিন করে বলল, ‘তাহলে সেটা কী?’ চোখ পিটপিট করতে লাগল।
‘হ্যাঁ ভাল কথা বলেছেন— শুনুন তাহলে— আওয়ামীরা একটু প্রগতিশীল। প্রগতিশীল মানুষের একটা বৈশিষ্ট্য হল, তারা একটু বেশি জানতে চায়। জানতে চাইলে, চিন্তা, ভিন্নমত, সমালোচনা আপনা থেকেই এসে পড়ে, আপনি ওটাকেই গণতন্ত্র ভাবছেন। দল হিসেবে দুটোই একই নায়ের... ওটা দলগত কোনও বিষয় নয়, একেবারেই ব্যক্তিগত।’
ঘাড় বাঁকা করল মঙ্গল, পটপট করে ফুটল। আয়েশের সঙ্গে প্রশ্ন করল, ‘মৌলবাদীদের সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?’
‘কোন ব্যাপারে?’
‘কীভাবে ওদের রোখা যায়?’
‘মার্ক্সবাদ ছাড়া মৌলবাদ রোখা সম্ভব নয়। শুধু মৌলবাদ কেন, পৃথিবীতে যেখানেই দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার হয়েছে, কমিউনিস্টরাই সবার আগে প্রতিবাদ করেছে। যেদেশে বামশক্তি দুর্বল সেখানেই সংখ্যালঘুরা তথা দুর্বলেরা নির্যাতনের শিকার হয় বেশি। পরমাণুর নিউট্রনের মতো (নীলার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল— তোমার টিটকারিটাই গ্রহণ করলাম।) তার কোনও চার্জ না থাকেলেও, পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে যেভাবে ধরে রাখে, তেমনি পৃথিবীতেও দুর্বল জাতি বা বিভিন্ন ক্ষুদ্র সম্প্রদায় টিকে থাকতে, কমিউনিস্টদের একটি পরোক্ষ ভূমিকা থাকে। একটু খেয়াল করলেই ভাল করে বোঝা যায়— মার্ক্সবাদ অনেককেই কমিউনিস্ট বানাতে না পারলেও, তাদের আচরণকে মার্জিত করতে পেরেছে। মৌলবাদ ধ্বংস করতে চাইলে, সশ্রদ্ধ-সন্দেহের চর্চা বাড়াতে হবে। যে সমাজে সন্দেহ নেই— সেখানে চিন্তা নেই, গবেষণা নেই, প্রমাণ নেই— তা কখনও বিকশিত হতে পারে না।’
নীলা অনেকক্ষণ ধরে সেলাই শেষ করে, দুজনের কথা শুনছিল মনোযোগ দিয়ে। একটু গম্ভীর হয়ে প্যান্ট ভাঁজ করে পাশের সোফায় রাখল। এতক্ষণ কোলের মধ্যে দলা-মোচরা করে রেখেছিল।
‘শ্রদ্ধা আবার সন্দেহ স্ব...বিরোধিতা... ?’
‘শ্রদ্ধা-বিহীন সন্দেহের পরিণতি হয়ে দাঁড়ায়, ভয়ংকর শত্রুতা অথবা কুৎসিত গালাগাল। কিছু সৃষ্টি আর হয় না। সন্দেহকে আমরা সবাই নেতিবাচকভাবে দেখতে অভ্যস্ত, সন্তানদেরও সন্দেহ করতে হয়, তবেই ওদের ভুল পথে যাওয়া থেকে ফেরানো সম্ভব। যে বাবা-মারা অতি বিশ্বাস করে নিশ্চিন্ত থাকে তারাই এক সময় পস্তায়।’
‘আচ্ছা কমিউনিস্টরা মৌলবাদী হয়ে গেলে? মৌলবাদী তো অনেক ধরণের হতে পারে, না কি?’
দিপু একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। মঙ্গল তাকাল নীলার মুখে, আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে মূহুর্তের অপেক্ষা কে কী বলে।
‘আমার মতে কমিউনিজম নয়, পৃথিবীর যত উগ্রতা আছে, তা ধ্বংস করতে পারে, কেবল শিল্প-চর্চা। মৌলবাদের বিপরীতই হল, শিল্প-সাহিত্য। শিল্প-সাহিত্যের চর্চা করতে গেলে, চিন্তাকে শৃঙ্খলমুক্ত হতেই হয়, অন্যথা অসম্ভব। এজন্যই এদের বড় শত্রু— মোমবাতি, ভাস্কর্য, সঙ্গীত... একটু থেমে বলতে লাগল, “প্রিয়, প্রিয় শিল্প-কলা! সে মানুষকে দেয় দুটি ডানা, মানুষকে নিয়ে যায় দূরে, বহু দূরে! মানুষ যখন নোংরামি, ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ স্বার্থের প্রতি বিরক্ত হয়ে ওঠে, অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, তখন শান্তি ও সন্তুষ্টি খুঁজে পায় একমাত্র সুন্দরের মধ্যে!” কথাগুলো চেখভের, তাঁর “আমার জীবন” গল্পে বলেছেন।
নীলা দিপুর চোখে চোখ রাখল, মুখে হাসি— ‘এবং শিল্পচর্চাকারীদের যেহেতু মৌলবাদীরা প্রশ্রয় দেয় না বা বিএনপি অপছন্দ করে , তাই এরা (শিল্পচর্চাকারী) আর কমিউনিস্টরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে।’ নীলা একটু খোঁচা মারল।
‘বিএনপির মতো প্রতিক্রিয়াশীল দল সহযোগী হিসেবে থাকলে, মৌলবাদের চাষ হবেই। যদিও এরা মুখে শিকার করে না।’
‘আপনি কি বিএনপিকে তাই মনে করেন? এর প্রতিষ্ঠাতা কিন্তু একজন প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা...’
‘অনেকেই অনেক কিছু শুরু করেন, কিন্তু শুরুর স্পিরিট ধরে রাখতে পারেন কতজন? গল্প-কবিতা দিয়ে যারা শুরু করেন, দুদিন না যেতেই, পত্রিকা অফিসের সম্পাদকের চেয়ার গরম করা ধরেন। সাহিত্য চর্চা চালিয়ে না গেলে, তাকে কি আর সাহিত্যিক বলা যায়। শেষ পর্যন্ত তারা আর সাহিত্যিক থাকেন না, পুরোদস্তুর সম্পাদকে রূপান্তরিত হন। কে কী করেছেন, তার চেয়ে বড় কথা, বতর্মানে তার অবস্থান... এই মুক্তিযোদ্ধা কি বিতর্কিত কাজ কম করেছেন? আর একটি কথা, উত্তরাধিকারেরা কি সব সময় আদর্শ ধরে রাখে? আপনার বোন কি আমার আদর্শ ধরে রাখত? বরং সেটা ধ্বংস করাটাই হত, তার প্রথম কাজ। আওয়ামী লীগও সেই চেতনা পুরোপুরি ধরে রাখতে পারেনি, তবে মূল স্রোতাটা নষ্ট হয়নি।’
‘কিন্তু আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরতে সরতে কোথায় গিয়ে যে পৌঁছব! ... আজও যাঁরা বেঁচে আছেন, কয়েকদিন পরে তো এঁরা আর থাকবেন না। তখন যে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াব! আমাদের সেই চেতনা লুপ্ত হয়ে না যায়। যা করার এখনই করতে হবে...’
‘তোমার ধারণা ঠিক নয় নীলা— যতদিন যাবে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধীরা কমতে থাকবে। পরাজিত পক্ষের অংশ কে হতে চায় বলো? বিশ্বকাপ খেলার সময় দেখো না? পছন্দের দল হারলে, ডিগবাজি খেয়ে বিজয়ী দলের সমর্থক বনে যায়। সময়ের সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধাও কমবে, রাজাকারও কমবে। রাজাকারটি স্বাধীনতাকে মেনে নেয়নি ঠিকই, কিন্তু তার সন্তান, তার সন্তানেরা, আর পাকিস্তানের জন্য হা-হুতাশ করবে না। এক সময় তারা ভুলে যাবে, তাদের পূর্বপুরুষ রাজাকার ছিল। তখন সবাই হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক, বাহক। হয়ত আমি তখন থাকব না।’ দিপু হাসল।
‘কিন্তু ততদিনে যদি আমাদের চেতনাটাই ভুলে বসি?... হয়ত ততদিনে ইতিহাসের উপাদানগুলো বিবর্ণ হয়ে যাবে। এমনিতেই তো পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস বা তেমন কোনও বৃহৎ উপন্যাস রচিত হয়নি এখনও। যা পড়লে বলতে পারি হ্যাঁ এটাই হল বাংলাদেশ।’
‘বাঙ্গালীর এতবড় ঘটনাকে তুমি কী মনে করো! এত সহজে ভুল যাব আমরা!’
দিপুর কণ্ঠে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ল। দুহাত নাড়াতে নাড়াতে ঘাড় ডানে বামে হেলিয়ে দুলিয়ে বলল, ‘তোমাদের এমন মানসিকতার জন্যই ওদের সাহস বেড়েছে। ওরা বিলুপ্ত হবে, বিলুপ্ত! বুঝেছ!’
হাত দিয়ে মুখ মুছে হাঁপাতে লাগল, কপাল ভিজে উঠল।
‘তুমি কি খারাপ বোধ করছ?’
হাত নেড়ে জানাল ঠিক আছে। একটু দম নিয়ে হেসে বলল, ‘প্রিয়-মানুষটির সামনে বসে, তাকে নিয়ে কবিতা লেখা যায় বটে, উৎকর্ষ থাকে না। একটু আড়াল চাই— দূরে গেলেই উপলব্ধিটা তীব্র হয়ে ওঠে। হতাশ হবার কোনও কারণ নেই। সামনেই সেই দিন— মুক্তিযুদ্ধের ওপর বিশাল উপন্যাস লেখা হবে, ইতিহাস লেখা শেষ হবে।
‘বাঙ্গালীরা মনে হয়, লম্বা কোনও বিষয়ে মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। ছোট কাজে যেমন— কবিতা বা ছোট গল্পে, যতটা মুন্সিয়ানা দেখাতে পারে, বড় কোনও উপন্যাস বা গবেষণামূলক বিষয়ে তা পারে না। তবে বিশ্বাস হারাতে নেই। “মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ”।’
‘বন্ধু কথার পেছনে একটু ফিরে যাই। বলতে চেয়েছি অনেকবার কিন্তু তোমায় বাধা দিতে চাইনি, তাই অপেক্ষায় ছিলাম। বামপন্থি আর মৌলবাদীদের মধ্যে কিন্তু একটা মিল আছে। এরা সব সময় নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে অমিলগুলো খুঁজে বেড়ায়, প্রমাণ করতে চায় কে কত খাঁটি। নিজেরা বিভক্ত হয়ে হাউকাউ তৈরি করতে পারে, কিন্তু কখনও শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে না। যদিও মৌলবাদীরা মাঝে মাঝে প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়, তবে ওটা শক্তি নয়— আতঙ্ক। ভারতের মতো এত বৈচিত্র্য নিয়ে, এই বিশাল দেশটি টিকে আছে, তারা তাদের অমিলগুলোকে এড়িয়ে, মিলগুলো খুঁজেছে বলে। নিজের উন্নত-অবস্থান তুলে ধরতে কমিউনিস্টরা সব সময় চেষ্টা করেছে, নিজেরা বিভক্ত হয়েছে। আর আমার দৃষ্টিতে তারা খুব অহঙ্কারী, তা অহঙ্কার তাদের থাকতেই পারে। গরিবদের কথা ভাবে, প্রচুর পড়া-লেখা করে, অপকর্মও করে না— দুর্জনেরা অবশ্য বলে সুযোগ পায়নি তাই। কিন্তু কথা হল— অহঙ্কার নিয়ে কি জনগণের খুব কাছে যাওয়া সম্ভব?’
নীলা একবার মঙ্গলভাইয়ের দিকে তাকাল, সমর্থনের আসায়। মঙ্গল মাথা ঝোঁকাল। একটু থেমে দিপুকে উদ্দেশ করে আবার বলতে লাগল।
‘এদের সফল না হবার আরও কারণ আছে— মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থিদের একটা অংশের বিতর্কিত ভূমিকা তাদের দুর্বল করেছে। অন্য অনেক গণ-আগ্রহের বিষয়কে তারা অবহেলা করে, নানা তাত্ত্বিক-কথা বলে দূরে থেকেছে। ভোটের সময় মানুষ কীভাবে উৎসব হিসেবে ফুর্তি করে। এসব ক্ষেত্রেও তারা বলে থাকে জনগণের ভাগ্যের কোনও পরিবর্তন হবে না, নির্বাচনকে তাচ্ছিল্য করে। কিছু যে হবে না, তা তো জানা আছে সকলেরই, আবার হয়ও নইলে এগোই কেমনে? সে যাক... কিন্তু যারা সারা বছর কাটায় নিরানন্দভাবে, তারা যদি কয়েকদিনের ভিআইপি হতে পারে, ওতেই ওরা খুশি। সেই খুশির মধ্যে আবার চাঁচাছোলা কথা কেন। আর একটি ব্যাপার বলি— এ দেশের মানুষ কৃষি কাজ করতে করতে প্রকৃতির ওপর এতটাই আস্থা-প্রবণ হয়ে গিয়েছে যে, পরিবার চালানোর ক্ষেত্রে, সাংসারিক জীবনের সফলতা ব্যর্থতায় সে কৃষক মনোভাবাপন্ন বলে ঝড়, বৃষ্টি, কুয়াশা এমন কি দালালরা সব লাভ নিয়ে গেলেও, তারা প্রকৃতিকে তথা ভাগ্যকেই দায়ী করে। বঞ্চিত যে মানুষদের নিয়ে কাজ, তাদের শত্রু যদি হয় ভাগ্য, কী করবে? আরও কারণ আছে— অনেকের ধারণা— এরা ক্ষমতায় এলে ধর্মচর্চা বন্ধ হয়ে যাবে। তোমরা এমন সব শব্দ বলো, যা বুঝতে অনেকেরই কষ্ট হয়; আর শ্রমিক-কৃষকদের কথা চিন্তা করো... কথায় কথায় বিদেশি শক্তির ষড়যন্ত্র খোঁজো, নিজেদের অথর্ব প্রমাণিত করো। কেননা ওদের তো রুখতে ব্যর্থ হয়েছ। বড় যে কোনও কাজ করতে গেলেই, তোমরা সরকারের সমালোচনা শুরু করে দাও। এতে করে আমরা মনে করি, তোমাদের কাজই কেবল হই চই করা। তাই তোমরা যৌক্তিক কিছু বললেও, আমরা সেসব কানে তুলি না। সেই যে বাঘ এল বাঘ এল, রাখালের মতো আর কি... আমি নিজেই বামদের সম্পর্কে পরিষ্কার নই আর অসচেতন যারা এদের কথা একবার ভাবো তো...'

কিস্তি - ১৩তম

কিস্তি - ১৫তম

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:৪০

চাঁদগাজী বলেছেন:


আপনার রাজনৈতিক ভাবনা দেখলাম; আমি অনয়ভাবে দেখি: নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সময় মুক্তিযু্দ্ধ হয়েছে; আওয়ামী লীগ এই যু্দ্ধকে্ দেখেছে, পাকীরা তাদেরকে ক্ষমতা না দেয়ায় এ যুদ্ধ হয়েছে; অন্যদিকে, জনতা যুদ্ধ করেছে অর্থনৈতিক মুক্তি ও গণতন্ত্রের জন্য; ২টি সম্পুর্ণভাবে আলাদা অবস্হান।

০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ৯:০৩

আহা রুবন বলেছেন: গল্পের চরিত্রের মতামতের সাথে লেখকের মতের শতভাগ মিল নেই। আমি চারপাশে যাদের দেখি তাদেরকে গল্পে আনার চেষ্টা করি।

২| ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ৯:৫৫

চাঁদগাজী বলেছেন:


তাই? আমি ভাবছিলাম আপনি গল্পের ছলে নিজকে প্রকাশ করছেন!

০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ১০:০১

আহা রুবন বলেছেন: ভাল মত আপনাকে বুঝে নেই, সম্ভব হলে আপনাকেও কোনও গল্পে আনতে পারি। মাথায় কি টাক থাকবে?

৩| ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৪:২১

শাহরিয়ার কবীর বলেছেন:
পড়ে ভালো লেগেছে ।

০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:৩৯

আহা রুবন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.