নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নেই তো কোন পরিচয়

আহা রুবন

নেই তো কোন পরিচয়

আহা রুবন › বিস্তারিত পোস্টঃ

বড় গল্প: দাগ অথবা কাজল (কিস্তি— ১৭ম)

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ১০:২৮


৪৩

নীলা ঘুমিয়ে। দিপুর চোখে নেই। অনেক কষ্টে এপাশ ওপাশ করতে হয়। গত কাল থেকেই ব্যথাটা ফের বৃদ্ধি ধরেছে। সারাদিন গেছে একইভাবে। কষ্ট করে চেপে ছিল। নয়ত আরও সময় থাকত নতুন শ্বশুর বাড়িতে। তেমন তো কোনও কাজ নেই, সেই শুয়েই থাকা। নীলা তাতে খুশিই হত। কিন্তু অসুখ কারও সুখ দেখতে পারে না। দিপু কিছুটা চিন্তিত, ব্যথা আগে এত হয়নি আর। ভাবল শৈলেশকে ফোন করে। নীলার কথা ভেবে এসএমএস পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল। এই করে— কিছু সময় কেটে গেল। শৈলেশ সাহস দেবার চেষ্টা করল, সচরাচর যা করে। কিন্তু দিপুর মনে হল, কিছু একটা গণ্ডগোল আছে। কপালে ভাঁজ পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে নীলার দিকে তাকিয়ে রইল, এক দৃষ্টিতে, ডান হাত কপাল ছুঁয়ে।

রাত দুটো সতেরো, চোখে ঘুমের ছায়াটি নেই। বিরক্ত মনে আরও একটি ঘুমের ট্যাবলেট খেল। হাল্কা আলোয় নির্দিষ্ট একটা সময় পর পর, নীলার বুক ফুলে ফুলে উঠছে। শ্বাস-প্রশ্বাসের একেবারেই কোনও শব্দ নেই। এরই মধ্যে নীলার শরীরের ঘ্রাণ মুখস্থ হয়ে গেছে দিপুর। সেটাই কেবল জানান দিচ্ছে, তার অবস্থানকে। বুকের ওঠা–নামা দেখতে দেখতে এক সময় ঘুমে গড়িয়ে গেল দিপু।

৪৪

নীলা কপালে হাত রাখল, ‘বন্ধু-গো উঠবে?’ কোনও সাড়া নেই, গভীর ঘুমে। ভাবল ঘুমক, হয়ত নতুন জায়গায় ভাল ঘুম হয়নি। আমি বরং নাস্তা করে নেই। নাস্তা করে নীলা কলেজে যাবার জন্য তৈরি হল। দিপু তখনও ঘুমে। আর জাগাল না, চায়ের কাপটা হাতে করে খাটের কোণে বসে কিছুক্ষণ— চা শেষ হলে ঘর থেকে বেরিয়ে ডাক দিল, ‘মঙ্গল ভাই— আপনার ভাই তো ঘুমে, আপনি দোকান পরে খুলুন, ওর নাস্তা শেষে বেরোন।’
‘ঠিক আছে, তুমি যাও আমি আছি।’

৪৫

নীলা তিনবার ফোন করে জবাব না পেয়ে ভাবনায় পরে গেল। পরক্ষণেই খেয়াল হল, হয়ত রিংটোন অফ করে ঘুমিয়েছে। কিছুক্ষণ পরে মঙ্গল ভাইকে ফোন করে বলবে... হঠাৎ মঙ্গলের ফোন কল...
হ্যালো বলতেই প্রশ্ন ‘নীলা তুমি কোথায়? ভাইকে হসপিটালে এনেছিলাম।’
নীলার বুকটা ধক্ করে উঠল। নিজেকে একটু সামলে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন... কী...’ উত্তেজনায় গলা ভেঙ্গে গেছে।
মঙ্গল জানাল, তেমন কিছু নয়। রাতে ব্যথাটা খুব বেড়েছিল, তাই ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল বেশি মাত্রায়। বোধহয় শরীরটা তাই একটু খারাপ। চিন্তার কোনও কারণ নেই, এখন ভাল আছে। নীলাকে ঠিকানা দিয়ে ক্লাস শেষে আসতে বলল, একসঙ্গে বাড়িতে ফিরবে। ফোনে নীলা দিপুকে বলল, ‘তোমার ফোন কোথায়?’
‘তাড়াহুড়োয় ফেলে এসেছি, তুমি তাড়াতাড়ি এসো, তোমার জন্য চপ, সিঙ্গারা নিয়ে বসে আমরা।’
‘আসছি।’

৪৬

নীলাকে ডেকে শৈলেশ সতর্ক করে দিল। অসুখ নিয়ে দিপুর সঙ্গে যেন বেশি কথা না বলে। ‘ও একটু চিন্তা বেশি করছে, সাহস দেবেন।’ নীলা উৎকণ্ঠার সঙ্গে তাকালে জানাল, ‘ভয়ের কিছু নেই। ব্যথার জন্য রাতে ঘুম না হওয়ায় আবার ওষুধ খেয়েছিল, শরীর দুর্বল, ব্লাড প্রেশার ওঠা-নামা করছে। একটু খেয়াল রাখবেন।’ নীলা জানতে চাইল ব্যথার কারণ। জানাল— বাতের, হাড় ক্ষয়ে গেছে। কিন্তু জবাব দিল অন্যদিকে তাকিয়ে।
‘ঠিক হয়ে যাবে, ও তো ঠিক মতো, চিকিৎসা করায় না, নইলে সব নিয়ন্ত্রণেই থাকত। এখন আপনি আছেন, ভাল হল ওর জন্য।’
‘অবস্থা বেশি খারাপ নয় তো?’
‘না, তা নয়। অযথা কষ্ট পাচ্ছে। সমস্যা অনেক দিনের, নিজে নিজে ব্যথার ওষুধ খেয়েছে, এদিকে আবার কিডনির সমস্যাও বাঁধিয়েছে খানিকটা। খাবার বিষয়ে একটু খেয়াল রাখবেন।’
দিপু ডাক দিয়ে বলল, ‘দুই ডাক্তারে গুজ গুজ করছ, আমরা কি অপয়া হয়ে গেলাম? চলো ফেরা যাক, ঘুমব গা-টা ম্যাজম্যাজ করছে।’

৪৭

ঘরে ফিরে অসুখ নিয়ে, নতুন কিছু ভাবতে পেল না নীলা। ব্যস্ততায় বিকেল গড়িয়ে গেল। এদিকে দিপুর কোনও পরিবর্তন নেই, বরং কিছুটা নিষ্প্রভই লাগছে। মাঝে মাঝে অন্যমনস্কভাবে নীলার দিকে তাকিয়ে থাকছে, কথা খুব একটা বলছে না। চুপ করে থাকায় প্রায়ই ঠোঁট দুটো জোড়া লেগে যাচ্ছে, মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে। নীলা দিপুর মলিন চেহারা দেখে, কথা যতটা না বললেই নয়, বলছে। দিপু ছোট-মতো কথা ছুঁড়ে দিচ্ছে হঠাৎ হঠাৎ, তা যতটা কথার জন্য, তার চেয়ে ওর ঠোঁটের জোড়া ছাড়ানোটাই আসলে। ওর ভয় হচ্ছিল— যদি আর মুখ খুলতে না পারে— তাই এই করা। মানুষ যখন জ্ঞান হারাতে বসে, কিছু মানুষ হাল ছেড়ে দেয়, আর কেউ-বা চিন্তার ধারাটা যেন ছিন্ন না হয়, তার জন্য মরণপণ লড়ে যায়। অজ্ঞান হওয়া মানেই তো মৃত্যুর সঙ্গে মিতালি করা। দিপু এসব ভাবছিল আর প্রতিবার ঠোঁট খুলতে পেরে নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছিল— ‘না সব ঠিক আছে।’ মনে হল নীলাকে বলে— পানি দিতে। শারীরিক দুর্বলতা প্রকাশ পাবে বলে, চুপ করে রইল, ‘একটু পরে বলি।’
নিজেই নিজের পাছায় ঠেলা দিয়ে জামগাছটায় তুলতে লাগল। থোকা থোকা কালজাম— ক-টা মুখে পুরতেই মুখটা রসে ভরে গেল।
‘নীলা তোমার আঁচল দুহাতে ছড়িয়ে ধরো, আমি পটাপট ফেলছি। অমন করে কী দেখছ? দাগ লাগবে? লাগুক-না— মনে করো, আমি জাম হয়ে তোমার বুকে লাফিয়ে পড়ছি।’
‘ছাদের দিকে তাকিয়ে কী দেখছ? খারাপ লাগছে কি?’
দিপু বুঝতে পারল না, প্রশ্নটা কে করেছে, বা কোথা থেকেই ভেসে আসছে। দিপুর মনে হল— মাঝ-নদীতে নৌকোয় থাকলে, পাড় থেকে নাম ধরে, কেউ লম্বা করে ডাক দিলে যেমন। দ্বিতীয় ডাকে ঘার ঘুরিয়ে নীলার দিকে তাকাল।
‘এক-গ্লাস পানি...’
নীলা গ্লাস এগিয়ে দেয়ার সময় জিজ্ঞেস করল, ‘এত মনোযোগ দিয়ে কী ভাবছিলে?’
দিপু এমন করে নীলার মুখে দৃষ্টি রাখল, যেন প্রশ্নটা বুঝতে পারেনি। ডান হাতে গ্লাস ধরে, বাঁ হাতটা দিপুর পিঠের নিচ দিয়ে ঢুকিয়ে দিল। নীলার সাহায্যে হাতে ভর দিয়ে উঠে বসল। পানি খেয়ে, খাটে হেলান দেবে— ইশারায় পিঠের নিচে একটা বালিশ দিতে বলল।
‘একটু কাছে...’
বুকের মধ্যে টেনে নিল নীলাকে।

৪৮

রাত সাড়ে-আট। নীলাকে দিপু বলল, ‘শেলুকে আসতে বলো। একটু দেখে যাক।’
মঙ্গল তাতে সায় দিল। ওকে চিন্তামগ্ন দেখাচ্ছে। ইতঃপূর্বে অসুখ এ পর্যায়ে আসেনি কখনও। প্রেশার ঠিক নেই, বুক ধড়ফড় করছে, জ্বর-জ্বরও আছে শরীরে।
নীলা মঙ্গলকে জিজ্ঞেস করল, ‘আগেও কি এমন...’
তাকিয়ে থাকল মুখের দিকে। মঙ্গল একটু সময় নিয়ে ঢোক গিলে ভাঙ্গা-গলায় বলল, ‘না, এত বেশি কখনও হয়নি।’
দুজনেরই ভয় ভয় করছিল। দিপু উদ্‌ভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক চোখ ঘোরাচ্ছিল। আর মাঝে মাঝে নীলার দিকে, এক পলকে তাকিয়ে থাকছে— দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। নীলা ভাবল— কষ্ট হচ্ছে বলে কাঁদছে, কিন্তু মানুষ যে অন্য কারণেও কাঁদে... অবশ্য সেটাও একরকম কষ্টই।
‘খুব বেশি খারাপ লাগছে কি?’
দিপু কোনও জবাব না দিয়ে, নীলার হাত শক্ত করে ধরল, অথচ শক্ত করে ধরতে পারল না; স্বপ্নের মধ্যে যেমন হয়...

নীলার বাড়ির সবাই এসেছে। মুখগুলো টানটান— যেন নিখুঁত করে পালিশ করা সব; যেন মুখগুলো বলছে— ভয়ানক কিছু একটা ঘটতে চলেছে, আর তা তারা দেখতে মোটেই প্রস্তুত নয়। কিন্তু মুখের সারি দিপুর ওপর ঝুঁকে আছে।
নীলার বাবা ফিসফিস করে বললেন, ‘ডাক্তারকে খবর দিয়েছ?’ যেন খুব একটা গোপনীয় কথা বলছেন তিনি।
‘শুনেছিলাম বাতের ব্যথা— এখন মনে হচ্ছে— সাথে আরও কিছু...’
এর মধ্যে শৈলেশ এসে পড়ায়, তাকে পথ করে দিল সকলে। দিপুর হাত ধরে ওর মাথায় কাছে ডাক্তার বসল। চোখ কুঁচকে কিছু একটা চিন্তা করল মনে হয়।
‘ভাবি প্রেশার দেখেছেন...?’
‘হ্যাঁ, ওঠা-নামা করছে।’
‘জ্বরও আছে দেখছি, ব্যথা কেমন রে?’
‘বুঝতে পারছি না।’
কথাটা বলল— যেন ভাঙ্গা পায়ে বলে লাথি দিল। কপালে হাত রেখে নীলাকে উদ্দেশ করে বলল, ‘মাথা ধোয়ার ব্যবস্থা করুন, জ্বর আছে— জ্বরের ওষুধ দেয়া যাবে না। আর মঙ্গল ভাই, এই ওষুধগুলো...’
মঙ্গলের দিকে কাগজটা এগিয়ে দিল, ‘সমস্যা তেমন গুরুতর কিছু দেখছি না। কিন্তু এমন ঘাবড়ে গেল কেন, সেটাই তো বুঝতে পারছি না। ব্যথাও বলছে তেমন নয়।’ (আসলে কিন্তু বলেছে— বুঝতে পারছে না।) আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তি আরও বড় আঘাত পেলে, বা আঘাতের সম্মুখীন হলে, পূর্বের আঘাত ঠিকমত উপলব্ধি করতে পারে না।
‘কিছু খেয়েছে?’
‘একটু স্যুপ খেয়েছে।’
‘ঠিক আছে— মাছ-মাংস পরিমাণ মতো দিচ্ছেন তো? মঙ্গল ভাই...’
মঙ্গলের দিকে তাকাল ডাক্তার মঙ্গল মাথা ঝুঁকাল দুবার।
এর মধ্যে ঘড়ির কাঁটা এগারো পেরিয়ে গেছে। দিপু শৈলেশ কে বলল, ‘তুই এবার বাড়ি যা— ফোন মাথার কাছে রাখিস, প্রয়োজনে ফোন করতে পারি।’
‘না কি থাকব রে?’
দিপু ডান হাত নেড়ে নিষেধ করল, ‘যা তো।’
মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করল। এটা করতে দিপুর মোটেই সহজ ছিল না। শৈলেশ দিপুর কপালে হাত রেখে বলল, ‘ভালমতো ঘুমা সকালেই দেখবি গা-টা কেমন ফুরফুরে। উঠি তাহলে...’

নীলার সঙ্গে একটু কথা সেরে, মঙ্গলের কাঁধে হাত রেখে, কানের কাছে মুখ নিয়ে কথা বলতে বলতে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল শৈলেশ। ডাক্তারের বিদায়ে নীলার বাবা আশ্বস্ত হলেন। ভাবলেন তেমন বড় কিছু হলে, হাসপাতালে নিতে বলত। অথবা এখানেই থাকত।
‘নীলা, আমি তোর কাছে থাকি?’
‘কী-যে বল-না মা, এখানে থাকা আর তোমার বাড়িতে থাকার মধ্যে কোনও পার্থক্য আছে? কোনও সমস্যা নেই, তোমরা যাও— মঙ্গল ভাই আছেন, দরকার হলে ডাকব।’
‘ঠিক আছে মা, তোকে স্যুপটুকুন গরম করে দিয়ে যাই।’
নীলা কিছু বলল না। মা রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।

নীলা দিপুর হাত ধরে রইল।
‘কী দেখছ অমন করে?’
‘আমার পরাণ-পাখিকে।’
এই বলে মাথা ঝুঁকল নীলা— যেন চোখ দিয়ে নয়, কপাল দিয়ে দিপুকে দেখছে।
দিপু শুকনো হাসি দিয়ে বলল, ‘ভাল করে দেখে রাখো— উড়ে যেন না যায়।’
‘কক্ষনও না, হতেই পারে না; বারবার ফিরে আসবে।’
দিপু সুখের নেশায় চোখ মুদল।

৪৯

মাথায় বেশ-সময় ধরে জল ঢালল। টাওয়ালে মুছে বিছানায় বসাল দিপুকে। খানিকটা সতেজ লাগছে এখন। ক-ফোঁটা বৃষ্টি, রং-চটা ছাতায় পড়লে যেমন করে ছাতা তার হারানো যৌবনের কথা মনে করে। দিপুর অনেকটা তাই হল। মনে পড়ে গেল, বহুদিন আগের কথা। সেই ছোট্টটি যখন— মাঠের বৃষ্টি মাথায় করে জল-কাদায় বাতাবি দিয়ে বল-খেলা। হেঁসেলের ছাইয়ের ভেতরে আধঘণ্টা মতন রেখে, নরম করে নিত। এতে করে বাতাবিটা বেশ নরম হত, পায়ে ব্যথা লাগত না, আবার টেকসইও হত— কাঁচা হলে সহজেই ফেটে যেত। কাদা-জলে মাখা-মাখি হয়ে যখন খেলা শেষ হত, ততক্ষণে হয়ত শরীরে শিরশিরে ঠাণ্ডা এসে চেপেছে। সন্ধ্যা নামার আগেই খুসখুসে কাশি, মাথা ব্যথা, কোমর ব্যথা আর কিছু সময় পর ছল ছল চোখ নিয়ে জ্বরের ঘোর। সেই ছোট্টবেলায়— ছোটফুফুর তখনও বিয়ে হয়নি— জ্বর হবার সংবাদ বা ছোটমতো কোন আবদার, সব তার কাছেই করত। মার কাছে জানাতে গেলে, জুটত প্রথমেই একটা ধমক, আর বাবা তো থাকত, সেই দূর কোন শহরে। জ্বর বা কোনও অসুখ-বিসুখ হলে, দিপুর মাঝেমাঝে ভালই লাগত। হঠাৎ করে সে-ও গুরুত্ব পেতে শুরু করত, আদর-যত্ন বেড়ে যেত। ...ছোটফুফু চামচে ফুঁ দিয়ে দিয়ে সাগু মুখে তুলে দিচ্ছে... হঠাৎ দিপু নীলাকে বলল, ‘ক-টা বাজে?’
‘পৌনে একটা।’
‘ফুফুর সাথে কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে, ফোন করব?’
‘এত রাতে? আর ফুফার শরীরটাও তো বললে বেশি ভাল যাচ্ছে না। সকালে কোরো।’
দিপু চোখ ঘুরিয়ে ছাদের দিকে তাকাল। ভাবল— সময়ের সাথে সাথে আপন মানুষগুলো কীভাবে দূরে চলে যায়! একদিন মেলা থেকে কেনা মাটির রুইমাছ ভেঙ্গে যাওয়ায়, যে ফুফুর কোলের মধ্যে হেঁচকি উঠিয়ে কেঁদেছিল; আজ তার কাছে ফোন করতে দ্বিধা করছে! স্যুপটুকুন শেষ হলে ওষুধ খাইয়ে আস্তে করে শুইয়ে দিল। নীলা সংক্ষেপে টুকটাক সেরে শুয়ে পড়ল, কম পাওয়ারের বাল্ব জ্বালিয়ে রাখল আজ। দরজা ভেজিয়ে রেখেছে, মঙ্গল ভাইকে বলেছে— ডাকলে যেন চলে আসে। কান খাড়া রাখবে তাই ‘রামদয়ালের মতো।’

নীলা দু-পা লম্বা করে দিপুর মাথা কোলে নিয়ে, মাথায় হাত বোলাতে লাগল। কিছুক্ষণ পরপর দিপুর চোখে হাত দিয়ে দেখল— পাতা দুটো কাঁপছে। অর্থাৎ ঘুমোয়নি।
মঙ্গল আস্তে করে ডাক দিয়ে দরজা একটু ফাঁক করে গলা ঢুকাল— ‘সব গুছিয়ে রেখেছি। দরকার হলে ডেকো।’
‘ঠিক আছে ভাই, দরজা খোলা থাকল, পারলে একবার দেখে যাবেন। আমার কেমন যেন ভয় ভয় করছে।’
‘ভয়ের কী আছে? আমি কান খাড়া রাখব।’

দিপু অনেক চেষ্টা করেও চোখে ঘুম আনতে পারল না। নীলার মনে হয়, একটু তন্দ্রাভাব এসেছিল। কপালে হাত দিয়ে দেখে পুড়ে যাচ্ছে। ‘মঙ্গল ভাই’ বলে ডাক দিয়েই উঠে থার্মোমিটার মুখে দিল। মঙ্গল সাবধানে দরজা ঠেলে ঢুকল। বোঝা গেল এখনও ঘুমোয়নি।
‘জ্বর কত?!’ মঙ্গলের উৎকণ্ঠিত স্বর।
‘১০৬° (আসলে ছিল আরও বেশি।) তাড়াতাড়ি বালতি আনুন, বরফ... বরফ...’
‘আনছি...’
ওয়ার্ডরোবের ওপর থেকে আফটারশেভ লোশনটা নীলার হাতে দিয়ে বলল, ‘তুমি আপাতত এটা কপালে দিতে থাকো...’

দুজন মিলে সমানে ঠাণ্ডা পানি ঢালছে, কিন্তু জ্বর কমার কোনও লক্ষণ নেই। দিপু চোখ বড়বড় করে এদিক ওদিক করছে, আবোল তাবোল বকছে, যার কোনও অর্থ করা যায় না। একবার বলল, ‘এত কপি দিয়ে কী হবে, আপনাকে তো নারকেল আনতে বলেছিলাম। বিড়ালটার জন্য লাটিম আনতে বললাম, পেলেন না, এখন আমি মেলায় যাই কোন মুখে?...’
নীলার মুখে আর তাকানো যায় না, ওর চোখ থেকে টপটপ করে জল পরছে, প্যাঁচ-কাটা ট্যাপের মতো। মঙ্গল নীলার মাথায় হাত রেখে বলল, ‘তুমি এভাবে ভেঙ্গে পড়লে কেমনে হবে?’
জলভরা চোখ তুলে যখন মঙ্গলের দিকে চাইল, মঙ্গলের চোখও ছলছল করত লাগল।
‘মঙ্গল ভাই আমার খুব ভয় করছে।’
নীলা মুখ থেকে থার্মোমিটার বের করল। একটু যেন হাঁপ ছাড়ল, ১০২°।
‘এই তো কমতে শুরু করেছে!’
দিপু চোখ বন্ধ করে আছে, ঘুমোয়নি। রাত তিনটে নাগাদ জ্বর একদম নেমে গেল। নীলা নিশ্চিন্ত-মনে বলল, ‘মঙ্গল ভাই রাত তো প্রায় শেষ, এবার একটু ঘুমিয়ে নিন।’
মঙ্গল কোনও কথা না বলে, জগে পানি ভরে দরজা ভেজিয়ে চলে গেল।
নীলা পিঠে বালিশ দিয়ে, দিপুর মাথা কোলের মধ্যে নিল। কপালের পাশটা টিপে দিচ্ছিল।
‘একটু ভাল লাগছে?’
‘হু।’
ঘুম জড়ানো কণ্ঠে দিপু জবাব দিল। নীলা আর কোনও প্রশ্ন করল না। ওর মনে হল— কেউ বোধ হয় বাড়িটাকে উঠিয়ে দূর কোনও নির্জন দ্বীপের মধ্যে বসিয়ে দিয়েছে। কোনও সারা-শব্দ নেই, সেই সন্ধ্যায় একটা প্রজাপতি যে, ঘরের মধ্যে ঢুকেছে, আর বের হতে পারেনি; অনবরত উড়ছে আর বাল্বের সাথে আঘাত পেয়ে বা গরম লেগে সরে যাচ্ছে, আবার স্থির হয়ে কিছু ভাবছে— সেইটুকু শব্দ ছাড়া। মাঝে মাঝে মনে হল, প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর শব্দে, আবার দিপুর ঘুম-না ভেঙ্গে যায়। সন্ধ্যায় প্রজাপতিটি যে সৌন্দর্য নিয়ে ঘরে এসেছিল, বারবার আঘাত লেগে, আছার খেয়ে, ডানার রঙগুলো কেমন লেপটে মলিন হয়ে গেছে। নীলা দিপুর নাকের কাছে আঙ্গুল রাখল, না, গভীর ঘুমে— জ্বরও নেই আর। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দিপুর মাথা কোলে নিয়েই চোখ বন্ধ করল।
কিন্তু ভুলে গেল, সারাদিন যে ব্লাডপ্রেশার ওঠা-নামা করেছে, সেই কথা।

হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল নীলার। ঘুমের ঘোরে হাতটা দিপুর কপালে গিয়ে পড়েছিল। দিপু ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, শরীরে জ্বরের লেশমাত্র নেই। নীলা দুহাতে দিপুর মাথা বুকের মধ্যে শক্ত করে ধরে রইল, যেন কোনও মতেই ছুটে যেতে না পারে, অথবা বুকের উত্তাপে গরম করতে চাইল দিপুকে।

প্রজাপতিটি তখনও ঝাপটা-ঝাপটি করেই চলেছে। ডানার কিছু অংশ ভেঙ্গে মেঝেয় পড়ে আছে। নীলার মনে হল, ওকে সঙ্গ দেবার জন্যই প্রজাপতিটি জেগে আছে। সূর্য ওঠার পূর্ব পর্যন্ত, প্রজাপতিটি নীলাকে সঙ্গ দিয়ে গেল। নীলার মনে হল, সেও ওরই মতো নিঃসঙ্গ, বিবর্ণ... কোনও এক অজানা রহস্যে দুটি প্রাণী, একজন আরেকজনকে জাগিয়ে রাখল, সারারাত ধরে।

কিস্তি - ১৬তম

কিস্তি - ১৮তম

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:২৩

শাহরিয়ার কবীর বলেছেন:
গল্প সুন্দর হয়েছে ভাই।

আর বাকি দুই পর্ব, অপেক্ষা।

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ৯:৩৮

আহা রুবন বলেছেন: হ্যাঁ ভাই, শেষ হয়ে গেল। এতক্ষণ গান, কবিতা আবৃত্তি শুনে এলাম। বিজয়ের শুভেচ্ছা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.