নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নেই তো কোন পরিচয়

আহা রুবন

নেই তো কোন পরিচয়

আহা রুবন › বিস্তারিত পোস্টঃ

বড় গল্প: দাগ অথবা কাজল (কিস্তি— ১৮ম)

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৪:৩৪


৫০

একে-একে আজান ভেসে আসছে। মোরগ ডাকল— একবার, দুবার, তিনবার। প্রজাপতি মুখ থুবরে পড়ে আছে দেয়াল ঘেঁষে। নীলা সন্তর্পণে দিপুর মাথাটা বালিশে নামিয়ে রাখল। ঠোঁটে একটা চুমু দিল— বরফেরে মতো ঠাণ্ডা, কোনও অনুভূতি হল না!

বিছানা ছেড়ে অলিন্দে এসে দাঁড়াল। গ্রিলে মুখ ঠেকিয়ে দুহাতে গ্রিল ধরে আকাশে হারিয়ে গেল নীলা— মুখ গ্রিলে চেপে থাকায় তা চারভাগ হয়ে গেল। যে অংশে নাক— কিছু উত্তাপ ছড়াল; আর সব ঠাণ্ডা— মৃত।
দূর আকাশে তারার সারি। দিপু বলেছিল, ‘ও যদি কখনও ছিটকে যায়, তবে তারা হয়ে নীলাকে আবর্তন করবে। কোন তারাটি হবে সে? আকাশে তো কত তারা, কার পাশে জেগে উঠবে? এই তারার রাজ্যের পরে কী আছে? লক্ষ-কোটি আলোকবর্ষ দূরে? মরে গেলে কি আমরা মহাবিশ্বের অংশ হয়ে যাব, না কি এখনও আছি? হাজার কোটি বছরে মহাবিশ্বের কতটুকু পরিবর্তন হয়— সেই তুলনায় আমাদের ক্ষুদ্র জীবনের পরিবর্তনগুলো তার ওপর কি কোনও প্রভাব ফেলতে পারে? একটা নক্ষত্রের মৃত্যুর ঘটনার কাছে, আমার আজকের এই ঘটনার কতটুকু মূল্য থাকতে পারে, কত তুচ্ছ এ-জীবন! কিছু সময় ধরে বুকের মধ্যে, যে-ব্যথাটা বহন করছি, সেটা কোথাও ছিল না; কোথা থেকে এল? এই সময়টুকুর আগে কোনও কষ্ট ছিল না, কষ্টের-সময়ের জন্ম হয়েছে। এভাবেই কি সময়ের জন্ম হয়! সব জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। মহাবিস্ফোরণের আগে সময় বলে কিছু ছিল না— এই সহজ কথাটাই কেন এতদিন বুঝতে পারিনি আশ্চর্য! নক্ষত্রগুলো নাকি অনবরত পরস্পর থেকে ত্বরণের সাথে দূরে চলে যাচ্ছে। এক সময় এত দূরে চলে যাবে যে, মহাকাশ হয়ে পড়বে ঘোর অন্ধকারে ঢাকা— শুধুই অন্ধকার, কেউ জীবিত থাকবে না। নীলা নামে একটি মেয়ে— যে একজনকে ভালবেসেছিল, স্বপ্ন দেখেছিল, কষ্ট পেয়েছিল। তখন কেই জানবে না, নীলা নামে পৃথিবীতে কেউ ছিল, তার সুন্দর দুটি চোখ ছিল। কী নিষ্ঠুর! কী নিষ্ঠুর!’

পূর্বের আকাশে আলোর রেখা ফুটছে। উপুড় করা মুড়ির ঝাঁজরির মতো ফ্যাকাশে আকাশ। তারাগুলোকে মনে হয়, ঝাঁজরির ছিদ্র দিয়ে তাকিয়ে আছে, নীলাকে দেখছে একসঙ্গে সবাই— দিপুর সঙ্গে এখন যারা।
ভোরের আলো চোরা-চোখদের ভাগিয়ে দিতে লাগল একে একে।

নীলা আবার হারিয়ে গেল কৈশোরে। নদী শুকিয়ে যাবার বেলায় ভাই-বোনেরা বড়দের সাথে যেত মাছ ধরতে। জলের মধ্যে আদার মতো, খড়ি ধরণের কিছু উঠত— সবাই বলত, ওগুলো চিংড়িমাছের মল। ‘এরা কেনই যে একখানে দল বেঁধে মল ত্যাগ করতে যায়!’ বিকেলের চড়ুইভাতিগুলো কত মধুর ছিল! চিংড়ির মল শুকিয়ে আগুন জ্বালানোর কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল, পা-জামা পরানো ঘুড়িদের কথা। মাথায় পাতলা বেতের ফিতে বেঁধে দিত সাজু ভাইয়া। তখন ওরা মৌমাছির মতো ভোঁ ভোঁ করে সমানে ডাকতে থাকত। নীলার সব চিন্তার পর্দা সরে গেল ধীরে ধীরে, শুধু ঘুড়ির ভোঁ ভোঁ শব্দ কানে বাজতে থাকল।

৫১

মঙ্গল ঘুম জড়ানো চোখে দিপুর দরজায় টোকা দিল কয়েকবার, সাড়া না পেয়ে সামান্য ফাঁক করে উঁকি দিল খানিকটা সঙ্কোচ নিয়ে। দিপু চাদর জড়িয়ে শুয়ে আছে, মাথা ঢাকা, ঘরে নীলা নেই।
‘এত সকালে কী করে?’ আবার ভাবল, ‘বাথরুমে।’
হাই তুলতে তুলতে পূর্বের বারান্দায় গেল, নীলাকে পেয়ে গেল ওখানেই। নীলার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ‘সারারাত তো ঘুমোওনি, আবার এত সকালে উঠতে গেলে?’
গ্রিল-ধরা অবস্থায়ই মুখ ফেরাল মঙ্গলের দিকে।
‘এ-কী! নীলার এই চেহারা!’
কিছু বুঝে ওঠার আগেই নীলা দুহাতে মঙ্গলের গলা ধরে কপাল ঠেকাল বুকে। নীলা কেঁপে কেঁপে উঠছে, সে কম্পন মঙ্গলের শরীরে সঞ্চারিত হল।
‘পারলাম নাঃ কিছুই করতে পারলাম না!’ একটা গোঙ্গানির শব্দ শোনা গেল।
‘কী পারলে না!?...’
‘ও... ও... চলে গেছে!’
‘চলে গেছে মানে!?’
নীলা হু হু করে কেঁদে উঠল। বুক-পিঠ ফুলে ফুলে উঠল, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো।
‘অনেক কষ্ট করে কান্না চেপে ছিলাম, তুমি সারারাত ঘুমোওনি, তোমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে... প্রতিবেশিদের ...’
মঙ্গল যেন পাথর হয়ে গেল। নীলা কাঁদতে কাঁদতে মেঝেয় বসে পড়েছে। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘মানুষটাকে অনেক স্বপ্ন দেখিয়েছিলাম, সব মিথ্যা, সব মিথ্যা! আমি মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে প্রতারণা করেছি... আমার শাস্তি হওয়া উচিত!’
মঙ্গল কীভাবে সান্ত্বনা দেবে, বুঝে উঠতে পারল না। বোকার মত দাঁড়িয়ে বলল, ‘তুমি কি শুধু স্বপ্ন দেখিয়েইছিলে, নিজে দেখোনি?’
এবার যেন নীলার সমস্ত বাধ ভেঙ্গে গেল। কান্নার শব্দে প্রতিবেশীরা সব জেনে গেল।

৫২

হঠাৎ করেই নিচ তলায় জোরে জোরে কথার শব্দ, দরজা খোলা ছিল। ভাড়াটিয়া ছুটে এসেছে রাত-পোশাক পরেই। ‘কিন্তু এটা মনে হয় সুমির গলা— এত সকালে খবর পেল কার কাছে, নীলা তো জানানোর অবস্থায় নেই। তবে?’
মঙ্গল এগিয়ে গেল। মঙ্গলকে দেখে সুমি বলল, ‘লম্পটটা কোথায়?' কিন্তু উত্তর দিল না। খটখট করে দিপুর রুমে ঢোকে সুমি। পেছনে মঙ্গল এগিয়ে যায়। নীলাকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখতে থাকে— পারে তো ছিঁড়ে ফেলে।
'তা সাহেবের ঘুম ভাঙ্গবে কখন?'
‘ও আর কখনও উঠবে না। ভোর চারটার দিকে...’
সুমি এক মূহুর্তের জন্য লাল হল। তারপর বিছানায় বসল। মুখ থেকে চাদর সরিয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। ‘ডাইনি কোথাকার! আমার সংসার নষ্ট করে, তছনছ করে তোর খায়েস মিটল না... শেষ পর্যন্ত আমার স্বামীটাকেও মেরে ফেললি!’
তড়াক করে লাফিয়ে উঠে নীলার গলা চেপে ধরল। নীলা সামলাতে না পেরে পড়ে গেল। চুলের মুঠি ধরে মেঝের সাথে মাথা ঠুকতে লাগল। টানাটানিতে ব্লাউজ ছিঁড়ে, নীলার পিঠ বের হয়ে গেল। মঙ্গল চেষ্টা করল ছাড়ানোর; কিছুই করতে পারল না।
‘খানকি-মাগি তোকে আজ আমি মেরেই ফেলব। স্বামীটা অসুস্থ ছিল, খবরদারি তো তুই-ই করতি... তাতেও তোর হল না? খুন করলি?’
মঙ্গল ধাক্কা দিয়ে সুমিকে সরিয়ে দিল। নীলাকে ছেড়ে দিয়ে জামা-কাপড় ঠিক করতে করতে বলল, ‘কত্ত বড় সাহস!’
আজ এসেছে একটা কিছু ঘটাবে এমন পরিকল্পনা করে। সারা রাত চিন্তা করেছে কীভাবে নীলাকে জব্দ করবে সে। কিন্তু দিপুর মৃত্যু পরিবেশটাকে বদলে ফেলল। সুমি তার পরিকল্পিত কর্ম বাতিল করলেও বাদ দিতে পারল না।

সুমি ফোন নিয়ে বসে গেল। নাকের পানি, চোখের পানি এক করে, কখনও মুখ দিয়ে, কখনও নাক দিয়ে কথা বলতে লাগল। এবং গালাগাল চলতে থাকল নীলার উদ্দেশ্যে— সম্পত্তি দখলের অভিযোগে, দিপুর হত্যাকারী হিসেবে।

৫৩

দশটা পেরিয়ে গেছে। নানা রঙের পোশাক-পরা লোকে বাড়ি পরিপূর্ণ। আগরবাতি, আতর, কর্পূরের সাথে অতিথিদের দামি পারফিউম মিলেমিশে অদ্ভুত একটা পরিবেশ তৈরি করেছে। দিপুর বড় ভাইয়েরা চুপচাপ বসে আছেন। তাদের স্ত্রীরা এদিক সেদিক দাঁড়িয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ, এমন ভাব চেহারায় ফুটিয়ে পরামর্শ করছে। সঙ্গে আরও কয়েকজন— যারা মনে হয় কোনও বিয়ে বাড়িতে রওয়ানা হয়েছিলেন; খবর পেয়ে সরাসরি চলে এসেছেন। দিপুর বড় বোন নিজের কর্তৃত্ব আর গুরুত্ব বোঝাতে, অন্যদের মনে ভীতি জাগিয়ে জুতোর তলায় শব্দ তুলে অকারণে পায়চারি করছেন। আর এ-কে ও-কে ডেকে নানা প্রশ্ন করছেন, চাপা গলায় শাসাচ্ছেন। ‘তোমরা কোনও একটা কাজও ঠিক মতো করতে পারো না! তালুকদার সাহেবকে এখনও খবর দাওনি! সবার বসার ব্যবস্থা করো... আপ্যায়নটা যেন ঠিকঠাক হয়... পৃথিবীতে কোনও কিছুই আটকে থাকে না। কী ভাববে বলো তো! আর পারি না! একা কত দিক সামলাই...’ গজগজ করতে করতে ওপরে চলে গেলেন। নীলা আর মঙ্গল আজ ভাঙ্গাকুলো হয়ে বসে আছে।

ড্রইংরুমে হুজুর সুর করে কোরান পড়ছেন। ওদিকে ওপরে তখন নীলার মা-বাবাকে মোটা মতো এক মহিলা হাঁসের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে, চ্যাপ্টা-নাকে চশমা সেঁধিয়ে (বারবার চশমা ঝুলে আসছিল।) ভারিক্কি একটা ভাব এনে, কথা শোনাতে শুরু করল। পাশ থেকে একজন বলল, ‘বিয়ে না ছাই, মেয়ে তো ডাক্তার (পাশ থেকে কেউ একজন ঠিক করে দিল, ডাক্তারি পড়ছে।) সে কি জানে না যে, আমাদের দিপু আর ফিরবে না! আসলে কোথায়, কার সাথে বাঁধিয়ে বসেছে, সে-টা এখন দিপুর ঘাড়ে চাপাতে চাইছে; যাতে সম্পত্তিটুকু গ্রাস করা যায়।’
নীলার বাবা নিচের দিকে তাকিয়ে আছেন। মা এমনভাবে মহিলার দিকে তাকালেন, যেন বুঝতে পারেননি কথাগুলো।
‘ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? নিজের মেয়েকেই জিজ্ঞেস করুন-না?’
‘আমাকে জিজ্ঞেস করার কী আছে, আপনিই তো সবচেয়ে ভাল জানেন, বলছেন যখন...’ এই বলে নীলা ঘৃণার সাথে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
‘তুমি কী বলতে চাও!? সম্পত্তির জন্য এসব করোনি?’
সুমির দৃষ্টি নীলাকে পুড়িয়ে দিতে চাইল। নীলা শুধু মুখের দিকে তাকাল, কিছু বলল না।
‘তুমি দিপুকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চেয়েছিলে— কপালের লিখন না যায় খণ্ডন।’
মোটা স্ত্রীলোকটি নীলার মা-বাবাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আপনাদের মেয়েকে তো ভাল জায়গাতেই পড়াচ্ছিলেন। কেনই যে দিপুর পেছনে লেলিয়ে দিলেন! নয়ত সুমির জীবনটা এমন হত না।’
‘ঠিকই বলেছেন আন্টি, কোন মেয়েই-বা পারে তার স্বামীকে অন্যের সাথে ভাগ করে নিতে।’
নীলার বাবা বললেন, ‘যে মানুষটাকে নিয়ে আমাদের এত বিরোধ, সেই তো আর আমাদের মধ্যে নেই। তাহলে আর এত ক্ষোভ...’
কথাটা শেষ করলেন না, সবার মুখের দিকে তাকালেন ভয়ে ভয়ে, সমর্থন পাবার আশায়।
সুমি একটু কী যেন ভাবল, পরে বলল, ‘ঠিক কথা, যে নেই তাকে নিয়ে আর ঝগড়া করার কোনও মানে হয় না।’

ওদিকে স্যুট পরিহিত কেতা-দুরস্ত একজন, কুতকুতে চোখ। ভালমতো খেয়াল না করলে কেউ ভাববে ঘুমচ্ছে। পানের কৃপায় দাঁত সব ভাঙ্গা মনে হয়। হাসলে মনে হয়, কামড়াতে আসছে, সুতো-ওঠা স্যুট গায়ের রঙের সাথে প্রায় মিলে আছে। জুতোর গোড়ালি ক্ষয়ে কাত হয়ে আছে; হাঁটার সময় জুতোর ফিতে জোড়া লাফাতে থাকে, ছুটতে-থাকা কুকুর-ছানার ঝোলানো কানের মতো। ভাইদের নিয়ে আলোচনায় মশগুল। কিছুক্ষণ আগে যখন বড়ভাইকে বলেছিল প্রথমে কথাটা চটে উঠেছিলেন তিনি, ‘আপনার মাথা নষ্ট নাকি হে বাপু! আমাদের ভাই গত হয়েছে, আমরা সবাই শোতগ্রস্ত—আর আপনি কিনা?.. ব্যবসা করতে গিয়ে সময়-জ্ঞানটাও খুইয়েছেন?’
খানিক বাদে আবার তাকে ডেকে বড়ভাই ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘কী যেন বলতে চেয়েছিলেন—আসুন ওদিকটায়...’

‘যত শীঘ্র করতে পারবেন, তত ঝামেলা কম হবে। কাছেই একজন আছেন, বাড়ি কেনার জন্য মুখিয়ে আছেন। আর এটা দেখলে তো হাতছাড়া করতেই চাইবেন না। ভাল দাম পাবেন, শালা টাকার কুমির একটা।’ সোফায় একটা চাপড় মেরে বললেন।
‘আর কথা হল, তার কিনা হাতে সময় খুব কম, দিন কয়েকের মধ্যে একটা রফা করে ফেলতে চাচ্ছেন। তাই বলছিলাম কী, হাত-ছাড়া যাতে না হয়... আপনাদের ভালর জন্যই কথাগুলো বললাম। আপনাদের ভাইকে আমি খুব স্নেহ করতাম, এর হাতে বাড়িটা পড়লে অবিকল এমনই থাকবে। বুঝতে পারছি ভাইয়ের স্মৃতি... আমি কথা দিচ্ছি, আপনাদের ভাইয়ের স্মৃতি যেন রক্ষা করা হয়, সে নিশ্চয়তা আদায় করে দেব। আর দেবই না কেন, এ-টা আমার নৈতিক দায়িত্বের মধ্যেই তো পরে।’
বড় ভাই বললেন, ‘আচ্ছা সম্পত্তি কতটুকু আছে? কীভাবেই বা ভাগ... ছোট বউ কি কোন অংশ পাবে? এ-বিয়ের কথা তো আমরা জানিও না, কাজেই তাকে আমরা স্বীকৃতি নাও দিতে পারি?’
লোকটি চালাকির হাসি দিয়ে বলল, ‘সেই কিন্তু এখন সব— তার গর্ভে যদি আপনার ভাইয়ের সন্তান থেকে থাকে, তবে আপনারা কিছুই পাবেন না।’
ছোট ভাইটি কপালে মৃদু চাপড় দিয়ে, যেন দারুণ একটা সমাধান পেয়েছেন, বললেন, ‘আমরা তাকে বলব, সন্তান নষ্ট করে ফেলতে। বিনিময়ে যা চায় আমরা না হয় তাকে দিলাম...’ সবাইকে একবার চোখ বুলিয়ে যোগ করলেন, ‘আর বোঝাব, সন্তান থাকলে, ওর ফের বিয়ে করতে অসুবিধা হবে। ও নিশ্চয়ই ব্যাপারটা গুরুত্ব সহকারে নেবে।’
দিপুর বোন অনেক সময় হল সোফার পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। ভাইয়েরা ইশারায় বসতে বললেও হাত নেড়ে জানালেন, ‘ঠিক আছে।’
এবার বোন কোনও ভণিতা না করে বললেন, ‘আমরা সরাসরি তার সন্তানকে অস্বীকার করব, বলব— আগে থেকেই, সে পেটে করে বয়ে এনেছে। সুমিরও এ বিষয়ে মত আছে, আমার কথা হয়েছে।’
‘কিন্তু আপনাদের ভ্রাতৃবধূর সন্তান যদি আপনার ভাইয়ের ঔরসের নাও হয়ে থাকে, আইন মতে সে-ই সম্পত্তির মালিক হবে।’
একথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সবাই চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বোন বললেন, ‘মেয়েটাকে কড়া করে বললে, নিশ্চয়ই সন্তান নষ্ট করতে রাজি হবে, আত্ম-সম্মান বলে তো কিছু আছে, নাকি?’

আলোচনার বিষয় আর গোপনীয় নেই। সবাই যার যার মতো হিসেব কষছে— কে কতটুকু পাবে, তার মূল্য কত হতে পারে। সেই টাকা দিয়ে কীই-বা করা হবে। বড় ভাগ্নে মার কাছ থেকে সুন্দর হাসিসহ আশ্বাস পেয়েছে। ক-মাস হল বিয়ে করেছে, মধু-চন্দ্রিমা হয়ে ওঠেনি। স্ত্রীকে আনন্দের খবরটা দিয়ে বলল, ‘এখন আর আমাকে হাড়কিপটে বলতে পারবে না, হে হে হে।’ পর মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল, মুখ গম্ভীর করে ভাবল—‘হাসি দেয়া ঠিক হয়নি, সবাই কী ভাববে।’ চারদিক তাকিয়ে দেখে খুশি হল— ‘যাক কেউ খেয়াল করেনি।’ খুশিভাব লুকোনোর জন্য, জিবে জোরে কামড় বসাল, তবু চোখ দুটো বারবার চকচক করে উঠল।
স্যুট পড়া লোকটি বলল, ‘ক্রেতা রেডিই আছে, তার আগে আপনাদের সবার একত্রে বসা দরকার।’
মঙ্গল বলল, ‘আমি বলি কী মাটি হয়ে গেলে বিকেলে আপনারা না হয় বসুন।’
কেউ বলল— সেই বরং ভাল। কিন্তু নানাজন নানা অসুবিধার কথা তুলে ধরল। একজন সন্ধ্যায় মার্কেটে যাবার ইচ্ছে আছে জানাল। অন্যজন বলল, ‘আকাশ মেঘলা, বৃষ্টির কথা বলা যায় না। আর এ-তে ধর্মীয় দিক থেকে কোনও সমস্যা নেই, আমি এই মাত্র হুজুরকে জিজ্ঞেস করে এলাম।’
শৈলেশ রাগ দমন করে অতি বিরক্ত মুখে বলল, ‘মামারা সবাই মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলুন, আগে-পরে যখন করতেই হবে।’
ভদ্রলোকটি শক্ত করে হাত মুঠো করলেন, ’সবাই যেখানে একমত, তবে সেরে ফেলাই ভাল।’

ডাইনিং-রুমে বসেছে সবাই। নীলা একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল, কেউ একজন ধরে নিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল। চুপ সবাই। শুধু নিচ থেকে হুজুরের কোরান পাঠের মিহি সুর ভেসে আসছে। বড় বোন শুরু করলেন— ‘কথা হল, নীলা তুমি যে আমাদের ভাইকে বিয়ে করেছ তা আমরা মানি না।’
নীলা কোনও সাড়া দিল না। ‘তোমার গর্ভের যে সন্তান— তাকেও আমরা স্বীকৃতি দেব না। কাজেই তুমি যদি বুদ্ধিমতী হয়ে থাকো; আশা করি, তুমি বুদ্ধিমতী— তবে ওকে নষ্ট করে ফেলো। তাতে তোমার বিয়েতে কোনও সমস্যা থাকল না।’
নীলা তখন ভাবছিল— বৃষ্টি এলে কবরস্থানে যাবার লোক পাওয়া যাবে কি না।
পেছন থেকে একজন মহিলা মন্তব্য করল— ‘ও-টা তোমার ভাইয়ের, তা তোমায় কে বলল। আগেই কোথা থেকে বয়ে এনেছে, এখন সুযোগ বুঝে তোমার ভাইয়ের গলায় ঝুলে পড়েছে। জারজটার বৈধতাও পাওয়া গেল, সাথে বিশাল সম্পত্তি।’
এই সব মেয়েলি কুটচালে বিরক্ত হয়ে উকিল অথবা দালাল লোকটি অধৈর্য হয়ে বলল, ‘উনি যদি তার সন্তান নষ্ট না করেন, তবে আপনাদের কিছুদিন অপেক্ষা করতেই হবে, হ্যাঁ তা ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই।’
এবার নীরবতা ভেঙ্গে মুখ খুলল নীলা, ‘আপনাদের চিন্তার কোনও কারণ নেই। আমার গর্ভে... কোনও সন্তান... নেই... সে-টা হবার... পরিস্থিতি ছিল... না... আমার... স্বামীর সাথে কোনও... প্রকার... আপনারা নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আমি কিছু দাবিও করছি না। যা পেয়েছি। তা আমারই। কিছু সুন্দর স্মৃতি পেয়েছি। ওই আমার অনেক। আর কিছু চাই না। যা খুশি আপনারা করতে পারেন।’
ভাঙ্গা-ভাঙ্গা কথা শেষ করে হাঁপাতে লাগল।

কিস্তি - ১৭তম

কিস্তি - ১৯তম

মন্তব্য ১২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৪:৫৫

চাঁদগাজী বলেছেন:



ঘটনাকে ভয়ংকর বেশী নাটকীয় করে ফেলেছেন, দীপুর মৃত্যুর সকালে পুলিশের আগমন; এটাকে আরেকটু ভেবেচিন্তে সাজানো যেতো হয়তো। প্রসংগক্রমে, আমি জীবনে গল্প ইত্যাদি লিখিনি

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৫:১৪

আহা রুবন বলেছেন: সেটি আমি নিজেও ভেবেছি। অন্যভাবে উপস্থাপন করা যায় কি না। কিন্তু যা বলতে চেয়েছি আভাসে-ইঙ্গিতে সেটা যেন ঠিক মত প্রকাশ করতে পারছি না। আপনার মতামত গুরুত্বসহ নিলাম। চেষ্টা করব গল্পটি আগা-গোড়া যেমন সাবলিল শেষাংশেও তেমন করা যায় কি না।

২| ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৫:৫৮

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: রুদ্ধশ্বাসে পড়ে গেলাম।

দারুন লাগল জীবন বোধের অণুভবের অংশেতা অসাম!!!!

ক্লাইমেক্সে জটিলতা এক্কেবারে যেন চোখেই দেখছি!!! সম্পত্তির লোভ আসলেই ভয়াবহ নিদেন যারা বস্তুবাদী!

+++++++

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:১২

আহা রুবন বলেছেন: অনুপ্রাণিত করলেন! প্রিয় লেখককে অনেক ধন্যবাদ।

৩| ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:০১

মোঃ ফিরোজ খান বলেছেন: খুব ভালো লাগলো

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:১৪

আহা রুবন বলেছেন: ধন্যবাদ।

৪| ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ১০:২০

শাহরিয়ার কবীর বলেছেন: ভাই
আগামী পর্বে কি গল্প শেষ হয়ে যাচ্ছে?

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ১০:৫৪

আহা রুবন বলেছেন: হ্যাঁ ভাই। শেষ হলে একটা মতামত দেবেন আশা করি। আজকের পর্বের পুলিশ আনার অংশে ভাবছি পাণ্ডা গোছের কাউকে নিয়ে আসবে সুমি। এমন করে একটু বদল করতে চাই। এই অংশটুকু নিজের কাজেই স্বাভাবিক লাগেনি, মনে হয়েছে জোর করে ঘটানো হচ্ছে।

৫| ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ১০:৫৯

শাহরিয়ার কবীর বলেছেন: কিছু দিন ধরে ভীষণ ব্যস্ত আছি এবং থাকবো ।
পুরো গল্প পড়ে .......
পাঠক হিসাবে এক কলম আর দু কলম যা লিখি তা মন্তব্য করবো।

ভালো থাকুন ভাই।

১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:১৬

আহা রুবন বলেছেন: ব্যস্ততা কেটে যাক এবং তা সফলভাবে। শুভ কামনায়।

৬| ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ৩:৪৬

ডঃ এম এ আলী বলেছেন: একদিন হাতে লম্বা সময় নিয়ে সবগুলি পর্ব পড়তে হবে । সবগুলি পর্ব পাঠের পর এক সময় আবার আসার ইচ্ছে আছে । আপাতত এই পর্বের জন্য ভাল লাগা জানিয়ে গেলাম ।
শুভেচ্ছা রইল ।

১৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:১৯

আহা রুবন বলেছেন: আপনাকে ব্লগে দেখে ভাল লাগছে। অপেক্ষায় থাকলাম।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.