নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নেই তো কোন পরিচয়

আহা রুবন

নেই তো কোন পরিচয়

আহা রুবন › বিস্তারিত পোস্টঃ

তাড়নার গন্তব্যে (শেষ অংশ)

২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১১:৩০



বস্তাটা মাথায় নিল জগা। দুই কাঁধে দুটো ব্যাগ। একটি ওর আরেকটি মর্জিনার। আজেবাজে জিনিসে ঠাসা প্লাস্টিক বালতিটা মর্জিনার হাতে নিতে বলে পথ ধরল।
‘আমার পিছন পিছন আসো সখিনা।’
ধান ক্ষেতের আল দিয়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল মর্জিনার।
‘আঃ কত দিন পর! আমাদের বাড়ির সামনে এই রকম ধানের জমি ছিল। আমরা কত খেলতাম।’
‘তোমরা তো তাইলে ধনি মানুষ?’
‘না না আমাদের না তো... তাইলে কি আর চাকরানির কাজ করতে হয়!’
‘বাড়িতে তোমার কে কে আছে সখিনা?’
‘বাপ আছে, আর তার বউ আছে।’
‘তার বউ মানে!?’
‘মা মরণের পর বাপে বিয়ে করেছে।’
‘মা মরল কেমনে সখিনা?’
‘একটা ভাই হয়েছিল। ছয়দিন পর আগে ভাই মরল পরে মা...ধনুষ্টংকার...’
‘তোমার কথা বলো-না।’
‘আমরা দুই ভাই। আমি বড়, ছোট ভাই এইটে পড়ে। সবার বড় বোন। বাড়িতে বাবা-মা আছে। গরিব মানুষ আমরা সখিনা, বাবা কামলা বেচে।’
‘হ দুনিয়ায় গরিবে গরিবেই সাক্ষাৎ হয়—খোদায় ওইভাবেই মিলিয়ে দেয়। তোমার বাড়ি এখান থেকে কতদূর?’
‘বগুড়া থেকে এখানটা যতটুকু, এই তো এমন হবে।’
একটু দূরে গ্রামের কালো রেখা। গাছের মাথার ওপর দিয়ে চাঁদ উঁকি দিতে লাগল।


‘আর কতক্ষণ বসে থাকব? যদি না আসে?’
মনে হয় রাতের খাওয়া সাইরাই আসবে। গল্প করতে তো খুব ভাল লাগছে। তোমার না?’
মৃদু হেসে জগার কাঁধে মাথা রাখল। ওরা বসে ছিল সেচের একটা নালার ধারে। জগার দুলাভাইয়ের সেচের মেশিনটা চলছে একটু দূরে। দিনাজপুর পৌঁছে দিতে ফের বস্তা টানাটানি করা লাগবে তাই মেশিন ঘরে রাখবে। শুধু গয়নার ব্যাগটা বের করে পাশে নিয়ে বসে আছে—বস্তা, বালতি, ব্যাগ দুটো কুড়েটার দরজায়।


‘তুমি কি গান গাইতে পরো? শোনাও-না।’
‘হাসবে না, আগেই কইলাম কিন্তু।
আকাশ ছিঁড়া জ্যোৎস্না ঝরে
আমার প্রিয়ার গায়
তাই-না দেখে দুইটা তারা
লুকায়া লুকায়া চায়
আমার মন মানে না, প্রাণ যে বলে
জড়িয়ে ধরি তায়...’
সখিনাকে জড়িয়ে ধরল জগা। সখিনা খিল খিল করে হেসে বলল ‘এটা কি তোমার বানানো গান না কি? হি হি হি...’
‘এইটা একটা ধুয়া—ক্ষেতে কামলারা একসাথে গাইত আগে।’
‘দিনের বেলায় চাঁদের গান?’
‘কয় বছর আগে যখন ট্রাক্টর-পাওয়ার টিলার আসে নাই, তখন জ্যোৎস্না রাতে আমরা ক্ষেত কোপাইতাম আর জিরানোর সময় ধুয়া ধরতাম...
জরিনার মা নাই বাপ নাই
দাদির সাথে ঘোরে
হাতে ছিল পেলাস্টিকের চুড়ি...’
সখিনাকে টেনে নিল বুকে। আঁজলা ভরে সখিনার মুখ তুলে ধরল জ্যোৎস্নায়, চোখের সামনে—তৃষ্ণার্ত পথিক যেন গ্রাম্য নদীর ঘাটে।


পায়ের সাথে ধাক্কা লেগে গয়নার ব্যাগ নালায় টইটম্বুর। সখিনার এক পা ক্ষেতের আলে অন্যটা নালার জলে। ওদের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে ঠাণ্ডা হাওয়া।
‘লক্ষ্মী সোনা, আমার সাথে সাথে বলো—আর কোনও দিন অনুরোধ করব না।’
‘আমি তোমাকে খুব ভালবাসি—গালি দেব কেন?’
‘এটা গাল না-তো ধরো এক ধরণের আদর—বলো বলো...
খা-কি মাগি মিনু, তোরে আমি...
খা-কি মাগি, জবেদা তোরে আমি...
খা-কি... মি...’
নামতা পড়ার মতো সুরে সুরে বলে গেল ওরা। জগা অবাক সখিনার এমন আবদারে।
‘তোমার এতগুলা নাম?’
‘আজকের পর থেকে খালি সখিনা বলবে।


জগা দু হাত পেছনে মাটিতে ভর দিয়ে আকাশ দেখছে। চাঁদ মেঘের লুকোচুরি খেলা। সখিনা হাঁটুর ফাঁকে মুখ রেখে নালার পানিতে আনমনে খেলতে লাগল। ভাবতে লাগল এই মাত্র যা ঘটল তা কি ঠিক হল—আমাদের ইচ্ছায় না কি আপনিই হয়ে গেল সব...
‘কী রে! বস্তা-মস্তা আবার কার?’
ওরা চমকে ওঠে ‘আমি জগা দুলাভাই।’
‘তুই!?’
সঙ্গে মেয়ে দেখে ভিরমি খায়।
‘বাড়ি চলেন আগে।’

বাড়ির সকলে খেয়ে উঠেছিল।
‘তোরা ডুব-সান করে নে। আর তুমি ভাত বাড়ো।’
‘ভাতে তো পানি দিয়া ফালাইছি—তুইলা দেই।’
‘বু এত রাতে ভাত রান্ধা লাগব না—পান্তাই দেও। নাকি বলো সখিনা?’
সখিনা মাথা কাত করে ‘ঠিক আছে বুবু পান্তাই খাই, কষ্ট করা লাগবে না।’
‘এহ কথার কী ছিরি! নতুন মানুষ আনছোস তারে খাওয়ামু পান্তা!’
‘তুমি যাও। তরকারি গরম করো আর দুইটা ডিম ভাজো, সখিনারে গোসলখানায় নিয়া যাও।’
‘হ্যাঁ যাই।’
‘কীসের তরকারি বু?’ ব্যাগের চেন খুলতে খুলতে বলে জগা।
‘পুঁটিমাছের আলু-বেগুন দিয়া। ’

ওরা দুজন খেয়ে উঠলে নিজেরা বসল কীভাবে কী করা যায়।
‘তুমি বাড়িত ফোন করো-না?’
‘হ্যাঁ দেও তো মোবাইলটা।’
ফোন ধরলেন শ্বশুর, ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। খানিকটা কথা শুরু করার পরই ধাক্কা দিয়ে স্ত্রীকে উঠিয়ে হাতে ফোন ধরিয়ে বললেন ‘কথা কও জামাই... জগা হারামজাদা নাকি বিয়া কইরা বৌ নিয়া ওখানে গেছে।’
দুচোখ কচলাতে কচলাতে হ্যালো বলেই কান্না শুরু করে দিলেন।
‘কান্দা থামা! তোর ছাওয়াল এই রকম কাজ করব আমি আগেই জানি। যেমন মা... কান্দন তো কেবল শুরু!’
এ-কথা শোনার পর কান্না আরও বেড়ে গেল। ওদিকে জগাকে ফোন ধরিয়ে দিয়েছে। জগার কণ্ঠ শুনতে পেয়ে মরা কান্না শুরু করে দিল।
‘চুপ কর শয়তান বুড়ি! এখন কাইন্দা কী করবি? খালি ছাওয়ালরে লাই দেওয়া! হারামজাদা আসুক দুইটারে একসাথে পিটমু...’
‘তোমার মুখে কিড়া পড়ুক! কী কথা, ছেলে-বৌয়ের গায়ে হাত!...’
‘ছেলে-বৌ নারে বজ্জাত! তোরে আর তোর বেটার হাড্ডি গুঁড়া করমু...’
‘ওই মা, তুই কান্দস কেন? বিয়া-তো করি নাই এখনও...’
‘তোর বাপ যে কইল? কী সর্বনাশ করলি... হু হু হু...’
‘দে আমার কাছে দে। মা শোন চিন্তা করিস না, মেয়ে খুব ভাল, কইতাছি খুব ভাল, লক্ষ্মী একটা মাইয়া। জগার পছন্দ আছে...বাজানরে নিয়া সকালে রওনা হ...হ্যাঁ হ্যাঁ খুব ভাল, তোর জামাইয়ের কাছে শুইনা দেখ...’
জগার বাবা বলল ওদেরকে নিয়ে সবাই যেন বাড়িতে চলে আসে। তার ভাইদের সঙ্গে পরামর্শ করে কিছু করবেন। কিন্তু জগা বলল ‘বাড়িতে গেলে বুড়া শয়তান একটা প্যাঁচ লাগাইবোই। হের খালি চিন্তা টাকা দেও। ভাবতেছে বিয়া করলে আমি টাকা-পয়সা দিমু না।’
এই সব হাউকাউ শুনে পাশের ঘর থেকে মতির মা উঠে এসেছেন। তিনি ঘটনা জেনে বেয়াই-বেয়ানকে তার বাড়িতে আসতে বললেন। এবং তার কাছে সখিনা সম্পর্কে প্রশংসা শুনে অবশেষে তারা সকালে আসার সিদ্ধান্ত জানালেন। একাজে ছেলের বউ তাকে শিখিয়ে, পড়িয়ে দিয়েছিল। পরদিন দুপুরে বিয়ের কাজ সম্পন্ন হল। সিদ্ধান্ত হল— একদিন সেখানে থেকে দিনাজপুর জিনিসগুলো পৌঁছে নতুন বৌ নিয়ে সোজা জগাদের বাড়ি ফিরবে সবাই।


জগার ফোন থেকে কল করে শাহেদের নতুন বাসার ঠিকানা জেনে নিয়েছে। নাম্বার তো মর্জিনার মুখস্থ। পৌঁছে দেখে পুলিশকেও ডেকে আনা হয়েছে। এতক্ষণ মর্জিনার বাবাকে প্রশ্নবাণে নাস্তানাবুদ করে ফেলেছে। সবাই ধরে নিয়েছে গয়না চুরির কাজে সে-ও জড়িত, পাছায় দুচার ঘা বসান দিলে হির হির করে সব বলে দেবে—কার গোয়ালে মর্জিনাকে লুকিয়ে রেখেছ। তাকে গোল হয়ে সবাই ঘিরে আছে। সে ঘেমে, নেয়ে একাকার। আতঙ্কে তার গলা শুকিয়ে গিয়েছে কেননা সিদ্ধান্ত হয়েছে তাকে হাজতে ঢোকানো হবে। এমন সময় মর্জিনা ঘরে ঢোকে। মর্জিনার বাবা ওকে দেখেই তেড়ে এল।
‘আস্তে... তোমার বাহাদুরি অনেক দেখা আছে। আমি এখন একজনের বৌ... হাত নামাও...’
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চড় দিতে তোলা হাত নামিয়ে মুঠি করল।
‘এই যে আপনাদের গয়নাগাটি—বস্তা, বালতি নিচে। বুঝে নেন ঠিক মত।’
মিনু ধরিপড়িমরি করে গয়নাগুলো দেখতে লাগল। কোনটা কয়টি কাগজটা তার কাছেই ছিল, তাই সেটা পড়তে পড়তে সব মুখস্থ হয়ে আছে।
‘হ্যাঁ সব ঠিক আছে। কিন্তু তুই কোথায় ছিলি?’
‘ব্যাংকক—হানিমুনে...’
‘ম্যাডাম দেখে নিন ভাল করে, পরে আবার...’
‘হ্যাঁ মিনু গুণে দেখো।’
‘সব ঠিক আছে।’
‘ও, আপনার চশমা আছে... ভিজে গিয়েছিল ধুয়েছি। গয়নার সাথে ছিল তাই মনে করলাম দামি হবে।’
‘চশমা!?’
‘হ্যাঁ দিচ্ছি।’
মর্জিনা ওর হাত ব্যাগ থেকে একটা অন্তর্বাস বের করে সবার সামনে মেলে ধরল ‘এই যে আপনার চশমা... রাখতে চাইলাম, পরে চিন্তা করে দেখলাম—পুরানো চোখে পুরানো চশমা মানায় ভাল...’
ঘটনার আকস্মিকতায় সকলে বিমূঢ় হয়ে গেল। মিনুর মুখ চুন—শাহেদ দাঁত ক্ষয় করতে লাগল। পুলিশ জিভে কামড় দিল। ধমক দিতেও পারছিল না কেউ।


সখিনা বেরিয়ে এল যেন নাচতে নাচতে। হা হা করে হাসতে লাগল। পেছনে জগা।
একটা ট্রেন ছুটে আসছে ‘চলো আমরা নিচে ঝাঁপ দেই।’
এক টানে উড়িয়ে আনে লাইনের বাইরে।
‘একটুর জন্য তো গেছিলা! তুমি কি পাগল হয়ে গেলে!’
‘হা হা হা... আমি পাগল... হা হা...’
‘আচ্ছা তুমি যে বলছিলা মিনু তোমার নাম? কিন্তু... আর জবেদা কার নাম?’
সখিনা অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ল—ছুটতে লাগল ট্রেনের পিছু পিছু—শাড়ির আঁচল জগার সামনে উড়ছে। হাত ধরে ফেলল জগা—হাত ধরে দুজন দৌড়তে লাগল। সখিনার সাথে জগা হা হা করে হাসছে...

প্রথম অংশ

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২:১৮

কালীদাস বলেছেন: সিম্পল, সাবলীল। খারাপ লাগেনি লেখাটা :)

২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২:২৮

আহা রুবন বলেছেন: বুঝলাম কিছু ভাল কিছু খারাপ। খারাপ লাগাটাও জানালে খুশি হতাম। কাজে দিত। যা হোক পড়ে মন্তব্য করেছেন কৃতজ্ঞ। ভাল থাকবেন।

২| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২:৪৯

কালীদাস বলেছেন: ওকে। আমার কাছে দুর্বল মনে হয়েছে যেটা সেটা হল কাহিনীটা খুব আনকমন না, আপনি নতুনত্ব আনতে যেয়ে রোমান্টিক করেছেন এবং এই পার্টটার এক্সপানশনটা কোন কোন ক্ষেত্রে একটু বেশিই হয়ে গেছে। সেকেন্ড, কেন জানি জগা আর মর্জিনার এফেয়ারটা আমার কাছে খাপ খায়নি; প্লিজ এটার ব্যাখ্যা চাইবেন না, কারণ ব্যাখ্যা আমি নিজেই জানিনা :(

এনিওয়ে, চালিয়ে যান এক্সপেরিমেন্ট :)

২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২:৫৯

আহা রুবন বলেছেন: ধন্যবাদ। মূল্যবান মতামত দেয়ার জন্য। ভেবে দেখব।

৩| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১১:২৮

রোকসানা লেইস বলেছেন: নিটোল একটি গল্প

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১২:৩৭

আহা রুবন বলেছেন: ধন্যবাদ, ভাল থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.