নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

— জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে,বন্ধু হে আমার,রয়েছ দাঁড়ায়ে...

রুদ্র জাহেদ

অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়— আরো এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে

রুদ্র জাহেদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

না পাঠানো চিঠি❑সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

১৮ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১০:৩৭

[a woman, sold to a brothel for six thousand
rupees,writes to her mother]

মা, তুমি কেমন আছ?
আমার পোষা বেড়াল খুনচু সে কেমন আছে?
সে রাত্তিরে কার পাশে শোয়?
দুপুরে যেন আলি সাহেবদের বাগানে না যায়।
মা, ঝিঙে মাচায় ফুল এসেছে?
তুলিকে আমার ডুরে শাড়িটা পর়তে বোলো।
আঁচলের ফেঁসোটা যেন সেলাই করে নেয়।
তুলিকে কত মেরেছি! আর কোনদিন মারবো না।
আমি ভালো আছি। আমার জন্য চিন্তা কোরো না
মা, তোমাদের ঘরের চালে নতুন খর দিয়েছো?
এবারে বৃষ্টি হয়েছে খুব
তরফদার বাবুদের পুকুরটা কি ভেসে গেছে?
কালু-ভুলুরা মাছ পেয়েছে কিছু?
একবার মেঘের ডাক শুনে কৈ মাছ উঠে এসেছিল ডাঙায়
আমি আম গাছ তলায় দুটো কৈ মাছ ধরেছিলাম
তোমার মনে আছে, মা?
মনে আছে আলি সাহেবের বাগানের সেই নারকোল?
চুরি করে আনিনি,মাটিতে পড়েছিল, কেউ দেখেনি
নারকোল বড়ার সে স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।
আলি সাহেবের ভাই মিজান আমাকে খুব আদর করতো।
বাবা একদিন দেখতে পেয়ে চেলা কাঠ দিয়ে পিটিয়েছিল
আমাকে।
আমার কি দোষ,কেউ আদর করলে আমি না বলতে পারি?
আমার পিঠে এখনো সে দাগ আছে।
আলি সাহেবদের বাগানে আর কোনদিন যাইনি।
আমি আর কোনো বাগানেই যাই না
সেই দাগটায় হাত বুলিয়ে বাবার কথা মনে পড়ে।
বাবার জন্য আমার খুব কষ্ট হয়
আমি ভালো আছি, খুব ভালো আছি
বাবা যেনো আমার জন্য একটুও না ভাবে।
তুলি কি এখনো ভুতের ভয় পায়, মা?
তুলি আর আমি পুকুর ধারে কলা বউ দেখেছিলাম
সেই থেকে তুলির ফিটের ব্যারাম শুরু হলো
দাদা সেই কলা গাছটা কেটে ফেললো
আমি কিন্তু ভয় পাই নি, তুলি কে কত ক্ষেপিয়েছি
আমার আবার মাঝরাত্রে সেই কলা বউ দেখতে ইচ্ছে করে।
হ্যাঁ, ভালো কথা, দাদা কোনো কাজ পেয়েছে?
নকুলবাবু যে বলেছিল, বহরমপুরে নিয়ে যাবে
দাদাকে বোলো আমি ওর উপরে রাগ করিনি
রাগ পুষে রাখলে মানুষের বড় কষ্ট
আমার শরীরে আর রাগ নেই,আমি আর এক ফোঁটাও কাঁদি না
মা, আমি রোজ দোকানের খাবার খাই
হোটেল থেকে দু'বেলা আমার খাবার এনে দেয়
মাংস মুখে দিই আর তুলির কথা,কালু-ভুলুর কথা মনে পড়ে
তোমাদের গ্রামে পটল পাওয়া যায় না
আমি আলু পটলের তরকারি খাই,পটল ভাজাও খাই
হোটেলে কিন্তু কখনো শাক রান্না হয় না
পুকুর পাড় থেকে তুলি আর আমি তুলে আনতাম কলমি শাক
কী ভালো, কী ভালো, বিনা পয়সায়
কোনোদিন আর কলমি শাক আমার ভাগ্যে জুটবে না|
জোর হাওয়া দিলে তাল গাছের পাতা শরশর করে
ঠিক বৃষ্টির মত শব্দ হয়।
এই ভাদ্দর মাসে তাল পাকে ডিব ডিব করে তাল পড়ে।
বাড়ির তাল গাছ দুটো আছে তো?
কালু তালের বড়া বড় ভালবাসে, একদিন বানিয়ে দিও
তেলের খুব দাম জানি,তবু একদিন দিও
আমাকে বিক্রি করে দিয়ে ছ' হাজার টাকা পেয়েছিলে
তা দিয়ে একটা গরু কেনা হয়েছে তো?
সেই গরুটা ভালো দুধ দেয়?
আমার মতন মেয়ের চেয়ে গরুও অনেক ভালো
গরুর দুধ বিক্রি করে সংসারের সুসার হয়
গরুর বাছুর হয়, তাতেও কত আনন্দ হয়
বাড়িতে কন্যা সন্তান থাকলে কত জ্বালা
দু'বেলা ভাত দাও রে, শাড়ি দাও রে,বিয়ের জোগাড় করো রে
হাবলু, মিজান, শ্রীধর দের থাবা থেকে মেয়েকে বাঁচাও রে।
আমি কি বুঝি না? সব বুঝি
কেন আমায় বিক্রি করে দিলে তাও তো বুঝি
সে জন্যই তো আমার কোনো রাগ নেই, অভিমান নেই।
আমি তো ভালোই আছি, খেয়ে পরে আছি।
তোমরা ওই টাকায় বাড়ি ঘর সারিয়ে নিও ঠিকঠাক।
কালু-ভুলুকে ইস্কুলে পাঠিও
তুলিকে ব্রজেন ডাক্তারের ওষুধ খাইয়ো।
তুমি একটা শাড়ি কিনো, বাবার জন্য একটা ধুতি
দাদার একটা ঘড়ির সখ, তা কি ও টাকায় কুলোবে?
আমি কিছু টাকা জমিয়েছি, সোনার দুল গড়িয়েছি।
একদিন কি হলো জানো মা?
আকাশে খুব মেঘ জমে ছিল,দিনের বেলায় ঘুরঘুট্টি অন্ধকার।
মনটা হঠাৎ কেমন কেমন করে উঠলো|
দুপুরবেলা চুপি চুপি বের়িয়ে ট্রেনে চেপে বসলাম
স্টেশনে নেমে দেখি একটা মাত্র সাইকেল রিক্শা
খুব ইচ্ছে হলো,একবার বাড়িটা দেখে আসি।
রথতলার মোড়ে আসতেই কারা যেন চেঁচিয়ে উঠলো-
কে যায়? কে যায়?
দেখি যে হাবুল-শ্রীধরদের সঙ্গে তাস খেলছে দাদা
আমাকে বললো, হারামজাদী, কেন ফিরে এসেছিস?
আমি ভয় পেয়ে বললাম,ফিরে আসিনি গো, থাকতেও আসিনি
একবার শুধু দেখতে এসেছি
হাবুল বলল, এটা একটা বেবুশ্যে মাগী
কী করে জানলো বলো তো,তা কি আমার গায়ে লেখা আছে?
আর একটা ছেলে, চিনি না,বললো, ছি ছি ছি, গাঁয়ের বদনাম
হাবুল রিকশাওয়ালা কে চোখ রাঙিয়ে বললো, ফিরে যা
আমি বললাম, দাদা, আমি মায়ের জন্য ক’টা টাকা এনেছি
আর তুলির জন্য...
দাদা টেনে একটা চড় কষালো আমার গালে
আমাকে বিক্রির টাকা হকের টাকা
আর আমার রোজগারের টাকা নোংরা টাকা
দাদা সেই পাপের টাকা ছোঁবে না, ছিনিয়ে নিল শ্রীধর
আমাকে ওরা দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল।
আমি তবু দাদার ওপর রাগ করিনি
দাদা তো ঠিকই করেছে,আমি তো আর দাদার বোন নই,
তোমার মেয়ে নই, তুলির দিদি নই
আমার টাকা নিলে তোমাদের সংসারের অকল্যাণ হবে
না, না আমি চাই তোমরা সবাই ভালো থাকো
গরুটা ভালো থাকুক, তালগাছ দুটো ভালো থাকুক
পুকুরে মাছ হোক, ক্ষেতে ধান হোক,ঝিঙে মাচায় ফুল ফুটুক
আর কোনোদিন ঐ গ্রাম অপবিত্র করতে যাবো না
আমি খাট-বিছানায় শুই, নীল রঙের মশারি,
দোরগোড়ায় পাপোশ আছে, দেওয়ালে মা দুর্গার ছবি
আলমারি ভর্তি কাচের গেলাশ
বনবন করে পাখা ঘোরে। সাবান মেখে রোজ চান করি
এখানকার কুকুরগুলো সারা রাত ঘেউ ঘেউ করে
তাহলেই বুঝছো, কেমন আরামে আছি আমি?
আমি আর তোমার মেয়ে নই, তবু তুমি আমার মা
তোমার আরও ছেলেমেয়ে আছে,আমি আর মা পাবো কোথায়?
সেইজন্যই তোমাকে চিঠি লিখছি, মা
তোমার কাছে একটা খুব অনুরোধ আছে
তুলিকে একটু যত্ন করো, ও বেচারি বড় দুর্বল
যতই অভাব হোক, তবু তুলিকে তোমরা...
তোমার পায়ে পড়ি মা, তুমি বাবাকে বুঝিয়ে বলো,
তুলিকেও যেন আমার মতন আরামের জীবনে না পাঠায়
যেমন করে হোক, তুলির একটা বিয়ে দিও
ওর একটা নিজস্ব ঘর সংসার, একজন নিজের মানুষ।
আর যদি কোনোরকমই ওর বিয়ে দিতে না পারো?
ওকে বলো গলায় দড়ি দিয়ে মরতে
মরলে ও বেঁচে যাবে!
না,না,না,এ কী অলক্ষুণে কথা বলছি আমি
তুলি বেঁচে থাকুক,আর সবাই বেঁচে থাকুক
তুলির বিয়ে যদি না হয় হোক
হে ভগবান,গরিবের বাড়ির মেয়ে কি বিয়ে না হলে বাঁচতে পারে না?
বিয়ে না হলেই তাকে গ্রামের সবাই ঠোকরাবে?
দু'পায়ে জোর হলে তুলি কোথাও চলে যাক
মাঠ পেরিয়ে, জলা পেরিয়ে,জঙ্গল পেরিয়ে
আরও দূরে,আরও দূরে,যেদিকে দু'চোখ যায়
এমন জায়গা নিশ্চয়ই কোথাও আছে,কোথাও না কোথাও আছে
যেখানে মানুষরা সবাই মানুষের মতন
আঁচড়ে দেয় না,কামড়ে দেয় না,গায়ে ছ্যাঁকা দেয় না,লাথি মারে না
যেখানে একটা মেয়ে,শুধু মেয়ে নয়,মানুষের মত বাঁচতে পারে
মা,তুমি আমার মা,আমি হারিয়ে গেছি
তুলিকে তুমি...তুলি যেন...আমার মতন না হয়!



মন্তব্য ১৮ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১৮) মন্তব্য লিখুন

১| ১৮ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১০:৪৯

সাহসী সন্তান বলেছেন: অনেক ভাল লাগলো! হৃদয় ছোয়ানো চিঠি বলতে হবে!

১৮ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১১:০১

রুদ্র জাহেদ বলেছেন: চিঠিটা সুনীলের কবিতা পড়তে গেলে যখন পুনরায় পড়ি তখন শেয়ার করতে ইচ্ছে হলো।চিঠিটা একদম মনুষ্যত্বের ভিতরটাতে নাড়া দেয়।কান্না চলে আসে...
সামাজিক বাস্তবতা যে কী বীভৎস!

২| ১৯ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১:১২

নষ্ট অতীত বলেছেন: চোখে জল চলে এলো!

১৯ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১:২১

রুদ্র জাহেদ বলেছেন: আসারই কথা।সত্যি পড়তে পড়তে নিজের অজান্তেই চোখের পানি চলে আসে।এরকম বীভৎস কর্মকান্ড সমাজ থেকে কখন যে দূরীভূত হবে

৩| ২০ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১০:১৯

জুন বলেছেন: হৃদয়স্পর্শী চিঠি যদিও পাঠায়নি সুনীল তারপর ও লিখেছেতো বটে।
শেয়ারের জন্য ধন্যবাদ রুদ্র জাহেদ।

২১ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১২:১১

রুদ্র জাহেদ বলেছেন: ধন্যবাদ আপুনি

৪| ২০ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১০:৩২

আহমেদ জী এস বলেছেন: রুদ্র জাহেদ




প্রান্তজনের পথ সঙ্গীত ।
যেখানে মানুষরা সবাই মানুষের মতন , সেখানেই এর সুর ধ্বনিত - প্রতিধ্বনিত হয় ।
ইট-পাথরের দেয়ালে সে সুর শুধু মাথা কূটে মরে ।

২১ শে অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ৯:২৯

রুদ্র জাহেদ বলেছেন: যেখানে মানুষরা সবাই মানুষের মতন ,
সেখানেই এর সুর ধ্বনিত - প্রতিধ্বনিত হয় ।ঠিক তাই
ধন্যবাদ প্রিয় ব্লগার।নিরন্তর ভালো থাকুন

৫| ২১ শে অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ৮:২৩

লালপরী বলেছেন: এখন কেউ চিঠি লিখেনা :(

২১ শে অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ৯:২৮

রুদ্র জাহেদ বলেছেন: কে বলেছে?এটা যদিও চিঠি,এটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্হে অন্তর্ভুক্ত। ধন্যবাদ ভালো থাকবেন

৬| ২১ শে অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ১২:৪৫

রেজওয়ানা আলী তনিমা বলেছেন: মন ছুঁয়ে গেল...।

২১ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ৮:৩১

রুদ্র জাহেদ বলেছেন: ধন্যবাদ প্রিয় ব্লগার

৭| ২১ শে অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৫:৫৮

স্পর্শিয়া বলেছেন: হৃদয়স্পর্শী

২১ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ৮:৩২

রুদ্র জাহেদ বলেছেন: হুম, একদম মনুষ্যত্বের ভিতরটাকে নাড়া দেয়।ধন্যবাদ।অনেক ভালো থাকবেন

৮| ২৩ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১:২৮

মোঃ খুরশীদ আলম বলেছেন: পুরোটা পড়তে পারনি, ধৈর্যে কুলায়নি তাই। তবে, যেটুকু পড়েছি শুধু আভিভূত হয়েছি। আরো সুন্দর লেখা চাই।

২৩ শে অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ৯:২১

রুদ্র জাহেদ বলেছেন: এটা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা।ধন্যবাদ

৯| ২৩ শে অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ৯:৫০

মোঃ খুরশীদ আলম বলেছেন: জ্বি, আচ্ছা।

২৩ শে অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৪:৫৪

রুদ্র জাহেদ বলেছেন: ধন্যবাদ।ভালো থাকবেন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.