নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম \'বোধ\'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবি

সাদাত হোসাইন

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম 'বোধ'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবিতে...

সাদাত হোসাইন › বিস্তারিত পোস্টঃ

কুকুরজনম

২৯ শে জুন, ২০১৪ সকাল ১১:৩১

"আমার সারারাত ঘুম হয় না। আমি জেগে থাকি। জেগে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে মাঝরাতে বারান্দায় গিয়ে দাড়াই। আমার অন্ধকারে ডুবে যেতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু এ শহরে অন্ধকার নেই। অন্ধকারের মানুষ আছে, অন্ধকারের টাকা আছে, অন্ধকারের থাবা আছে। কিন্তু ডুবে যাবার মতন বিষণ্ণ আলোর অন্ধকার নেই। আমার এক বিষণ্ণ অন্ধকারের স্তব্ধ নির্জনতায় ডুবে যেতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু এখানে নির্জনতা নেই। এখানে সন্ধ্যা নেই, রাত্রী নেই, নিশুতি নেই...

এখানে অন্ধকার মানেই মৃত্যু।"



রিমি প্রায়ই মাঝরাতে ঘুম ভেঙে ফেসবুকে ঢোকে। তার কেন যেন মনে হয় আসিফের আজ ঘুম হচ্ছে না। আসিফ তাকে ফেসবুকে চিঠি লিখেছে। সে ইনবক্সের নোটিফিকেশনটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আসিফের চিঠিটা পড়ে। তারপর চুপ করে বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় যায়। রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের নিচে কুকুরটা দাঁড়িয়ে। কেউ ইট মেরে পেছনের ডান পা'টা থেঁতলে দিয়েছে। কুকুরটা পা'টা টেনে নিয়ে খানিক হেঁটে যায়। আবার ফিরে আসে। দাঁড়িয়ে থাকে। আবার হেঁটে যায়। আবার ফিরে আসে। ল্যাম্পপোস্টটার ঠিক শরীর ঘেঁসে বসে কুকুরটা। তারপর সেও হয়তো আসিফের মতই অন্ধকার খোঁজে। মুখটা উঁচু করে মাথার উপরে তাকায়। তার মাথার ঠিক উপরে আলো। তারওপরে অন্ধকার। নিকষ অন্ধকার। কুকুরটা হঠাৎ তীব্র চিৎকারে যেন কাঁপিয়ে দেয় রাতের শহর। সেই চিৎকারের পুরোটা জুড়ে কি সীমাহীন কান্না। কি ভয়ংকর আর্তনাদ! ওই অন্ধকারে কার কাছে সে নালিশ করে! তার পা'টা কি অদ্ভুতভাবেই না পড়ে আছে। শরীরে সাথেই। আবার শরীর থেকে আলাদা! তাকে এই তীব্র যন্ত্রণার অংশটাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে! রিমির হঠাৎ কুকুরটার জন্য এত কষ্ট হয়! এতো কষ্ট! সে অবাক হয়ে আবিস্কার করে, তার চোখের কোল বেয়ে একটা তপ্ত জলের স্রোত।



রিমি ঘরে ফিরে এসে অবাক তাকিয়ে থাকে! তার ফেসবুক ইনবক্সে আসিফের আরেক চিঠি, "আমার প্রায়ই মনে হত, মানুষ না হয়ে জন্মালে কি হত? আজ এই মুহূর্তে হঠাৎ মনে হল, কুকুর হয়ে জন্মালে বেশ হত। তুমি আমার জন্য কাঁদতে। কোন এক মাঝরাতে। আচ্ছা, তুমি কি পোষা একটা প্রাণী চেয়েছিলে!"



রিমি ভেবে পায় না, আসিফ কিভাবে দেখল! কিভাবে? কোথায় আসিফ? সে বারান্দায় এসে তন্নতন্ন করে খুঁজল। দুচোখ যেদিক যায়। কিন্তু কোথায় আসিফ? নেই। রিমি বিছানায় ফিরে জড়সড় হয়ে বসল। তারপর পাশে শুয়ে থাকা তার চার বছরের কন্যা 'জিনা'র শরীর ঢেকে দিল কম্বল দিয়ে। তাকাল জিনার পাশে শুয়ে থাকা সুদর্শন মানুষটার দিকে। শাহেদ! তার স্বামী! সে তাকিয়ে রইল শাহেদের দিকে। মানুষটা ঘুমুচ্ছে! নিশ্চিন্ত ঘুম। এতো রাত করে অফিস থেকে ফেরে! আবার সেই কাঁক ডাকা ভরে অফিস। ক্লান্ত মুখ! রিমি তাকিয়েই রইল, তাহলে আসিফ? আসিফ কোথায়?'



কেউ একজন অন্ধকারের ভেতর থেকে বলল, 'আসিফেরা অন্ধকারে। আর এ শহরে অন্ধকার মানেই মৃত্যু'।



রিমি ঝট করে উঠে দাঁড়াল। তারপর জ্বেলে দিল ঘরের সবগুলো আলো। আলোয় ভেসে যাচ্ছে খাটের পয়া, আলমারির শরীর, ঘরের গলিঘুজি। কোথায় আসিফ? না আসিফ কোথাও নেই। তার থাকার কথাও না। হি ইজ অ্যা ফরগটেন চ্যাপ্টার। দুর্বল চিত্তের মানুষেরা সুইসাইড করে। আসিফ তার নিজের দুর্বলতার কারণে মরেছে। নাহ, রিমির কোন দায় নেই। কোন দায় নেই! সে আসিফের মত এতো দুর্বল চিত্তের মানুষ না। সে শেষ মুহূর্তে ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে। শাহেদ ওয়াজ দ্যা রাইট ডিসিশন! ইয়েস, ইনডিড।



কিন্তু রোজ রাতে যে অন্ধকার হলেই আসিফ এসে হাজির হয়! রোজ রাতে!! কি করবে রিমি! সে শাহেদের হাত ধরে টেনে তোলে। তারপর হড়বড় করে বলে, 'আমাকে কাল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। কাল ভোর হলেই। ভোর হলেই।'



কাঁচা ঘুম ভাঙা শাহেদ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে, 'কি হয়েছে তোমার?'

রিমি ফিসফিস করে বলে, 'কিছু হয় নি, কিচ্ছু না। কিচ্ছু না। তুমি ঘুমাও। কিচ্ছু না'।

- 'বলো আমাকে।' শাহেদ আলতো করে রিমির কাঁধ ছোঁয়।

রিমি ভয়ার্ত গলায় ফিসফিস করে বলে, 'আমার অন্ধকার খুব ভয় হয়। খুব ভয়, খুব'।

শাহেদ নরম গলায় বলে, 'কেন?'

রিমি হঠাৎ শাহেদের বুকে এলিয়ে পড়ে, তারপর বলে, 'জানি না, কিছু একটা আসে। কিছু একটা, বা কেউ একজন। অন্ধকার হলেই আসে।'

শাহেদ হাসে, 'ও কিছু না। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলে। স্বপ্ন দেখছিলে'।

রিমি জোর গলায় প্রতিবাদ করে, 'না', কেউ একজন আসে'।

শাহেদ আবারো হাসে, 'তুমি হয়তো ইদানীং খুব করে কিছু ভাবছ। কিছু খুব করে তোমাকে ভাবাচ্ছে'।

রিমি আবারো প্রতিবাদ করে, 'না, আমি কিছুই ভাবছি না, কিছুই না'।



শাহেদ রিমিকে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। রিমি হতভম্ব চোখে তাকিয়ে থাকে। ল্যাম্পপোস্টটার নিচে সেই কুকুরটা আর নেই। সেখানে গাড় অন্ধকার। সেই অন্ধকারে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। সে রিমির দিকে তাকিয়ে হাসছে। রিমি শক্ত করে শাহেদের হাতের কবজি চেপে ধরে বলল, 'আমার ভয় হচ্ছে, ভয়। আমার আজকাল অন্ধকারকে খুব ভয় হয়। খুব। আচ্ছা, অন্ধকারে কি থাকে?'



শাহেদ কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল, তারপর হঠাৎ রিমিকে বুকের সাথে চেপে ধরে হেয়ালির সুরে বলল, 'অন্ধকারে? উমমমম... অন্ধকারে থাকে অতীত। আমাদের অতীত। একা নির্জনতার অন্ধকারে আমাদের অতীত থাকে। আমরা অন্ধকারে অতীত খুঁজে ফিরি'।



রিমি কোন কথা বলল না, সে সম্মোহিতের মতন তাকিয়ে রইল সেই অন্ধকারে। আসিফ ক্রমশই কুকুর হয়ে যাচ্ছে। সেই কুকুরটার মতন। তার একটা পা কেমন অবশ পড়ে আছে। আসিফ তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে মুখ করে। আসিফ কি এখন চিৎকার করবে? সেই ভয়ংকর আর্তনাদ? সেই চিৎকার?



কিন্তু রিমি শুনল, আসিফ ফিসফিস করে বলছে, 'আমার কুকুর জনম বেশ ভালো লাগে, রিমি। আমি রোজ অন্ধকারে শহরের অলিগলি ঘুরে ঘুরে অন্ধকার দেখি। সেই অন্ধকারের ভেতর লেখা থাকে, মানুষের মুখোশ। সেই অন্ধকারের ভেতর লেখা থাকে মানুষের অতীত আর বর্তমান। আসলে অন্ধকারেই লেখা থাকে মানুষের কুকুর জনম।'



আসিফ খানিক থামে। তারপর ফিসফিস করেই আবার বলে, 'এখানে অন্ধকার মানেই মৃত্যু। মানুষের মানবজন্মের মৃত্যু'।

---------------------------------------------------------------------------------

কুকুরজনম/ সাদাত হোসাইন

২৭/০৬/২০১৪

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:২২

জল ঝড় বলেছেন: ভালো লাগলো

২| ৩০ শে জুন, ২০১৪ সকাল ১১:১১

বৃতি বলেছেন: বেশ ভালো লাগলো।

৩| ১৮ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১০:১১

আফসানা যাহিন চৌধুরী বলেছেন: “.........আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে থাকি তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখব বলে........”

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.