নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম \'বোধ\'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবি

সাদাত হোসাইন

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম 'বোধ'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবিতে...

সাদাত হোসাইন › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্তুতা ফুস্তুতা

০৬ ই জুলাই, ২০১৪ সকাল ১০:৩২

আমরা তখন হাঁটি হাঁটি পা পা।

গ্রামগঞ্জে তখনও ক্রিকেট আসে নাই। খেলা বলতে বুঝি ডাংগুলি, লাটিম, মার্বেল আর ফুটবল। আমাদের আগ্রহ ফুটবলে। সমস্যা হচ্ছে একটা ফুটবল কেনার মতন অকাজে অর্থ অপচয়ের সামর্থ্য সেই গাঁয়ের বাবা মায়ের ছিল না। আমরা তাই বাড়ি বাড়ি জাম্বুরা গাছ খুঁজি। জাম্বুরা গাছ পেলেই সুযোগ বুঝে জাম্বুরা চুরি করি। পায়ে সুপারি গাছের খোল পেচিয়ে জাম্বুরার ফুটবল খেলি... প্রথম প্রথম কয়েকদিন পা ফুলে ঢোল হয়ে যায়, আমাদের খেলা থামে না।

গ্রামে ইলেক্ট্রিসিটি নাই, টেলিভিশন নাই, পেপার পত্রিকা নাই। যা আছে তার নাম রেডিও। সেই রেডিও চালাতে ব্যাটারি লাগে। ব্যাটারির নাম অলেম্পিক, ৮ টাকা দাম। ৬ টাকা দামের আরেক ব্যাটারি আছে, চান্দা ব্যাটারি। চার্জ বেশি থাকে না। চার্জ কম বেশি তে অবশ্য আমাদের কিছু আসে যায় না... অত টাকায় ব্যাটারি কিনে কেউ আমাদের রেডিও শোনাবে না। সুতরাং ফুটবল নামক খেলা যে এতো বিশাল মজাযজ্ঞের নাম, তাও আমাদের জানা হয় না। আমরা ফুটবল বলতে বুঝি 'জাম্বুরা'।

সেবার আব্বা ঢাকা থেকে বিভিন্ন জিনিষপত্রে মোড়ানো পুরনো পত্রিকার কাগজ নিয়ে আসলেন। সেই কাগজে দেখি লোকজনের ফুটবল খেলার ছবি। সেই ছবি দেখে আমরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি, 'দেখছস কাণ্ড! জোতা (জুতা) পায় দিয়া বল খেলায়!!'

সেই ভীষণ আচানক ব্যাপার দেখে আমরা ভাষাহত! মানুষ কোথাও বেড়াতে গেলে না জুতা পরে! জুতা পরে কেউ খেলে নাকি!! খেলাধুলায় জুতা পরা সাক্ষাৎ অপচয়! যে কোন সময় ছিঁড়ে যেতে পারে! এদের কি চিন্তা-ভাবনা নাই নাকি!

ছিঁড়ে গেলে কি হবে!

ছিঁড়ে গেলে কি হবে কে জানে! আমাদের অবশ্য জুতা ফুতা নিয়ে কোন ভাবনার বালাই নেই। আমরা দিন-মান খালি পায়ে মাঠ ঘাট চষে বেড়াই। আমাদের পায়ের তলা তাতে পাঁথরের মতন শক্ত হয়ে রয়। ইটের টুকরো, ছোটখাট কাটা-কুটা ফুটতে গিয়ে বিশেষ সুবিধা করতে পারে না।

কিন্তু অসুবিধা করে ফেললেন গ্রামের এক বড় ভাই। তিনি ঢাকা থেকে এসে সারাদিন গ্রামের এ মাথা থেকে ও মাথা হাঁটেন। তার হাত থাকে কানের কাছে। সেই হাতের মুঠোয় ছোট্ট রেডিও। তিনি সারাদিন রেডিওতে কি সব শোনেন! তা নিয়ে অবশ্য আমাদের মাথা ব্যথা নাই। আমাদের মাথা ব্যাথা অন্য। তিনি সবসময় আমাদের খেলার মাঠের পাশে বসে থাকেন। গভীর আগ্রহ নিয়ে খেলা দেখেন। কেউ জাম্বুরা বলটা জোরে মারলেই তিনি চেঁচিয়ে উঠেন 'স্তুতা ফুস্তুতা' টাইপের অদ্ভুত এক শব্দ করে। সেই শব্দের অর্থ আমরা বুঝি না। তার দিকে মহাবিরক্তি নিয়ে তাকাই। তিনি তুমুল উচ্ছ্বাস নিয়ে বলেন, ওই পোলা, তুই তো দেখি একদম স্তুতা ফুস্তুতা'র মতন করে খেলতেছস রে ব্যাটা! খেল খেল! এমনেই খেল! অনেক বড় খেলোয়াড় হবি।

আমাদের অবশ্য বড় খেলোয়াড় টেলোয়ার হবার আশা খুব একটা আছে বলে মনে হয় না। আমরা খেলি তুমুল আনন্দে। ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। সেই বৃষ্টি যে নিজ চোখে না দেখেছে, তাকে বোঝানো সম্ভব না। বিস্তীর্ণ প্রান্তর জুড়ে তুমুল বৃষ্টি। মাঠ ঘাট ভেসে যাচ্ছে। সেই বৃষ্টির হাঁটু পানিতে আমরা 'খলসে-পুঁটি' মাছের মতন লাফাচ্ছি। সেই লাফানো আসলে ফুটবল নামের জাম্বুরাটাকে ঘিরে...'

সেদিন হঠাৎ সেই বড় ভাই বৃষ্টির মধ্যে হাঁটু পানিতে এসে নামলেন, তিনি নাকি আমাদের সাথে খেলবেন'। কিছুক্ষণ গাইগুই করে আমরা রেডিও শোনার লোভে রাজি হয়ে গেলাম। আমাদের সোহাগের খেলা দেখে তিনি আবারো ঘোষণা করে দিলেন, সোহাগ হচ্ছে বাংলাদেশের 'স্তুতা ফুস্তুতা'। আমরা 'স্তুতা ফুস্তুতা'র মানে জানি না, কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই কিম্ভুত 'স্তুতা ফুস্তুতা' নামের মানুষটা বড় কোন ফুটবল খেলোয়াড়। সোহাগ তার মত খেলে। আমরা সোহাগের এই প্রাপ্তিতে যারপরনাই ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ি। প্রত্যেকেই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করতে থাকি, সোহাগের চেয়েও ভালো খেলোয়াড় হতে হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সেক্ষেত্রে আমরাতো স্তুতা ফুস্তুতার চেয়ে ভালো কোন খেলোয়াড়ের নাম জানি না।

তাহলে উপায়?

উপায় অবশ্য আবিস্কার করে দিলেন সেই বড় ভাই-ই। তিনি আমাদের ৬৫ টাকা দিয়ে একটা সত্যিকারের ফুটবল কিনে দিলেন। তারপর উত্তর কান্দি আর দক্ষিণ কান্দির মধ্যে খেলারও আয়োজন করে ফেললেন। সেই খেলার রেফারি তিনি নিজে। খেলার আগে তিনি ঘোষণা করলেন, আজকের খেলায় যে সবচেয়ে ভালো খেলবে, তাকে তিনি পুরস্কার দিবেন, আর পৃথিবীর সেরা খেলোয়াড়ের নামে নাম দিবেন তার।

'স্তুতা ফুস্তুতার' চেয়েও বড়!! আসন্ন সেরা খেলোয়াড় উপাধি পাবার প্রবল আকর্ষণে আমরা আটঘাট নেমে মাঠে খেলতে নেমেছি। কিন্তু খেলতে নেমে আমরা দুই দলই চূড়ান্ত বিরক্ত। নানান কায়দা কানুন সেই খেলায়। বড় ভাই হাফপ্যান্ট পরে মাঠের এপার ওপার দৌড়ান। খানিক পরপর বাঁশিতে ফুঁ দেন। এরে ল্যাং মারা যাবে না, ওরে টেনে ধরা যাবে না। তারপর এই কিক, সেই কিক, অফসাইড। আরও কত কিছু! ত্যাক্ত বিরক্ত আমরা সেই খেলায় কোন গোল করতে পারলাম না। আমাদের কারো আর পৃথিবীর সেরা খেলোয়াড় হওয়া হল না। কিন্তু খেলা শেষে বড় ভাই বললেন, একেক দল ৩ টা করে শট করবে (টাইব্রেকার আর কি)। যারা বেশি গোল করতে পারবে, তারাই হচ্ছে বিজয়ী। এই আইডিয়া আমাদের পছন্দ হল। আগ্রহ নিয়ে আমরা পেনাল্টি শট নিতে গেলাম। আমাদের গোল কিপারের নাম ছালেক। ছালেক সবাইকে অবাক করে দিয়ে ব্যাঙের মতন লম্ফঝম্প করে কেমন কেমন উপায়ে যেন প্রতিপক্ষের ৩ টা শটই ফিরিয়ে দিল! আমরা জিতে গেলাম ২-০ গোলে।

হঠাৎ দেখি সেই বড় ভাই ছালেককে মাথায় তুলে পাগলা নাচন নাচছেন, আর ষাঁড়ের মতন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছেন, 'এইডা হইল, ম্যারাডোনা, আসল ম্যারাডোনা! দুইন্যার সেরা খেলোয়াড় ম্যারাডোনা, ম্যারাডোনা'।

আমরা দুনিয়ার সেরা খেলোয়াড়ের নাম জানলাম,- ম্যারাডোনা। দুইন্যার সেরা খেলোয়াড়। তবে কিঞ্চিত সমস্যা আছে, সমস্যা হচ্ছে আমাদের ম্যারাডোনা হচ্ছে 'গুলকি'। গুলকি ম্যরাডোনা... আমরা সে যুগে গোলকিপারকে বলতাম গুলকি...

আমাদের ঘুমে, জাগরনে স্বপ্নে তখন ম্যারাডোনা। এই লোককে আমরা দেখি নাই। কিন্তু কেউ দৌড়ে ফার্স্ট হলেও আমরা বলি 'এক্কেলে ম্যারাডোনার লাহান', কেউ ভালো মার্বেল খেললেও বলি, 'এক্কেলে ম্যারাডোনা', ডাংগুলিতেও ম্যারাডোনা, হাডুডু, গোল্লাছুট থেকে শুরু করে ক্লাশের ফার্স্ট বয়ের নামও তখন আমাদের কাছে ম্যারাডোনা...

আমাদের শৈশব শ্রেষ্ঠত্বের বিশেষণ মানেই ম্যারাডোনা'।

ম্যারাডোনাকে আমি প্রথম দেখলাম ক্লাস নাইনে। আব্বা তখন ঢাকা থেকে বহু পুরনো দিনের বিচিত্রা পত্রিকা নিয়ে এসেছে। সেই পত্রিকায় কোন এক বিশ্বকাপ সংখ্যা। পাতায় পাতায় ফুটবলের সংবাদ, ছবি। আমি মুগ্ধ হয়ে সেই ছবি দেখি, আর অজানা ফুটবল রোমাঞ্চে কেঁপে উঠি। দু হাত জড়ো করা কোঁকড়া চুলের একটা মানুষের ছবি দেখে আমি কি এক অদ্ভুত সম্মোহনে তাকিয়ে থাকি। মানুষটা মাঠের মাঝখানে হাঁটু গেঁড়ে দু'হাত জোড় করে কারো কাছে কিছু বলছেন, মিনতি করছেন। তার সেই চোখ দুখানাভর্তি জল। তার সারা শরীর জুড়ে কি বিস্ময়কর নিবেদন! আমি সম্মোহিতের মতন সেই ছবির দিকে তাকিয়ে থাকি, ছবির নিচে কালো অক্ষরে ঝকঝকে নাম, 'ম্যারাডোনা'। ম্যরাডোনা!!

আমার আর কিচ্ছু মনে নেই। ম্যারাডোনা নামের সেই মানুষটা আমার মননে মগজে মিশে গেল অদ্ভুত সম্মোহনে। অবর্ণনীয় ভালোবাসায়... আমার বেড়ে ওঠা সময়ের সবটা গভীরতম অনুভূতির নাম তখন ম্যারাডোনা! ম্যারাডোনা!! ম্যারাডোনা!!!

এরপর বেড়ে উঠেছি, বড় হয়েছি, সময় কেমন কেমন ভেসে গেছে... কিন্তু সেই মানুষটা ঠিক তেমন করেই মিশে আছেন বিমুগ্ধ বিস্ময়ের ভালোবাসায়। এই ভালোবাসায় আর কোন যুক্তির দরকার নেই, ভালো মন্দের হিসেব নিকেশের ধার নেই, এই ভালোবাসার সবটা জুড়েই কেবল সীমাহীন ভালোবাসা... সবটা জুড়ে। দিনের পর দিন আর্জেন্টিনা নামের দেশটাকে হারতে দেখেছি, সুনীলের 'কেউ কথা রাখেনি' কবিতার মত করে,- 'একটাও বিশ্বকাপ জিততে দেখি নি কখনও, কেউ আমার কাঁধে হাত রেখে বলেও নি, দেখিস, একদিন আমরাও...'

তারপরও...

ম্যারাডোনা নামের সেই সম্মোহনে বিদ্যুচ্চমকের মত করে উড়ে এসে জুড়ে বসলেন আরেকজন, মেসি, দ্যা লিওনেল মেসি... এই দুজন মানুষ সব হিসেব নিকেশ, যুক্তি তর্ক সব ফেলে দিয়ে বহাল তবিয়তে জুড়ে রইলেন ভালোবাসার সবটুকু। সেখানে হার-জিত বড় হয়ে ওঠে, সাধ্য কই তার?

শুভ কামনা প্রিয় আর্জেন্টিনা, আজ অবশ্যই আমরা জিতব। কিন্তু যদি হেরে যাই? বেলজিয়ামের সাথে কেন, যদি প্রথম রাউনড থেকেও বাদ পরে যেতে, কিছুই যেত আসতো না। ভালোবাসা এমনি থাকতো।। এমনি থাকবে... ভালোবাসার জন্য কারণ লাগে না, ভালোবাসার জন্য শ্রেষ্ঠ হতে হয় না... তাহলে জগতের সকল মানুষ একজনকেই ভালোবাসতো, যে শ্রেষ্ঠ, শুধু তাকেই...

ভালোবাসা হতে হয় যুক্তিহীন, সব হিসেব নিকেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শিশুর মতন অনুভূতির সবটুকু দিয়ে ডুবে যাওয়া যায়... ডুবেইতো আছি, সেই শৈশবের স্বপ্নময় দিন আর বেড়ে ওঠার প্রতিটি মুহূর্তে... ডুবে আছি, ডুবেই আছি। ভালোবাসা প্রিয় নীল-সাদা...

ভালোবাসা, নীল-সাদা আকাশের সমান...

উল্লেখ্যঃ 'স্তুতা ফুস্তুতা' বলতে আসলে কিছু নেই। সেই বড় ভাই আসলে বলেছিলেন 'বাতিস্তুতা'। গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা। কোন এক অদ্ভুত কারণে বাতিস্তুতা শব্দটাকে আমরা শুনেছিলাম স্তুতা ফুস্তুতা...

মন্তব্য ২ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১২:২২

আদম_ বলেছেন: হিজলের, তাল, বুনোঘাস, গুল্মলতার ঝোপে,
কাশবন, বাশঝাড়, ভরা ভাদরের নদীকূলে।
ফেলে এসেছি শৈশব আনমনে কোনো এক কালে
হারিয়ে ফেলেছি গোধুলি লগ্ন মঙ্গল ধুপে।
রাতজাগা চোখে, জোনাকির আলো, কদমের ঘ্রাণ
সবকিছু পলাতক সময়ের স্রোতে।

২| ০৬ ই জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১:০৪

ডি মুন বলেছেন: ভালোবাসা হতে হয় যুক্তিহীন, সব হিসেব নিকেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শিশুর মতন অনুভূতির সবটুকু দিয়ে ডুবে যাওয়া যায়... ডুবেইতো আছি, সেই শৈশবের স্বপ্নময় দিন আর বেড়ে ওঠার প্রতিটি মুহূর্তে... ডুবে আছি, ডুবেই আছি। ভালোবাসা প্রিয় নীল-সাদা...

খুব মনোমুগ্ধকর স্মৃতিচারণ। ভালো লেগেছে।

আর এবার প্রিয় নীল-সাদা'র জয় হোক এই প্রত্যাশা।

ভালো থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.