নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম \'বোধ\'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবি

সাদাত হোসাইন

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম 'বোধ'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবিতে...

সাদাত হোসাইন › বিস্তারিত পোস্টঃ

লাশেরা কথা বলছে

১৩ ই আগস্ট, ২০১৪ সকাল ১১:৩০

আমি কিছু মৃত মানুষ দেখলাম। লাশ!!

কোথায় দেখলাম, কিভাবে দেখলাম জানি না। আমি কেবল দেখলাম তারা একটা ছোট্ট কামরার ভেতর আটকে আছে। সেই কামরাভর্তি জল। তারা সেই জলে লাশ হয়ে ভাসছে। কিন্তু অদ্ভুত উপায়ে সেই লাশগুলো পরস্পরের সাথে কথা বলছে। কি উপায়ে কথা বলছে আমি জানি না। কোন টেলিপ্যাথিক উপায় কি না তা ও না। তবে তাদের কথপকথন আমি শুনতে পাচ্ছি। একজন স্বামী, একজন স্ত্রী, এক মেয়ে আর ছোট্ট এক ছেলে...

স্ত্রী লাশের একটা আঙুলের পচে প্রায় গলে যাওয়া অংশ ঠুকরে নিয়ে গেল একটা মাছ । স্ত্রী লাশ হঠাৎ ফিসফিস করে বলল, 'দেখেছ? আঙুলের সাথে তোমার দেয়া সেই প্রথম দিনের আংটিটাও গেল। মাছটা কেমন করে খুবলে নিল'।

স্বামী লাশ প্রবল বিষাদে বলল, 'মৃত মানুষদের কাছে জগতের সবকিছুই অর্থহীন'।

স্ত্রী লাশ বলল, 'কিন্তু ওই আংটিটার সাথে এমন কিছু ছিল, যা এখনও পৃথিবীতে রয়ে গেছ, অর্থহীন না।'

স্বামী লাশ অবাক গলায় বলল, 'কি!'

স্ত্রী লাশ বলল, 'ভালোবাসা, কষ্ট, কান্না'।

স্বামী লাশ বলল, 'তার সাথে আংটির কি সম্পর্ক?'

স্ত্রী লাশ বলল, 'আমাকে প্রথম দেখতে গিয়ে তুমি হকচকিয়ে গেলে। তারপর কাউকে কিছু না বলেই হঠাৎ তোমার হাতের আংটিটা খুলে আমার হাতে পরিয়ে দিলে। এরপর আমাদের বিয়ে হল, এতগুলো ছেলেমেয়ে হল। বড় ছেলেটা এখন কি করছে? বড় মেয়েটা? তুমি কি শুনতে পাও, কতগুলো মানুষ এখন কাঁদছে! কষ্টে, শোকে দিশেহারা হয়ে আছে। সবতো আমাদের ওই আংটিটার জন্যই, তাই না? জগতের সবকিছু শেষ হয়ে যায়, কেবল রক্তের এই বন্ধন ছাড়া, ভালোবাসা ছাড়া... থেকেই যায়। '

স্বামী লাশটা বলল, 'তাহলেতো আংটিটা গিয়েছে, ভালোই হয়েছে। মৃত লাশের স্মৃতি থাকতে নেই'।

স্ত্রী লাশটা চুপ করে রইল। তার পেটের দিকটাতে একটা মাছ খোটাচ্ছে। পচে যাচ্ছে ওই অংশটাও। তাদের মেয়ে লাশটা হঠাৎ বলল, 'বাবা, আমাদের লাশগুলোকি আর কখনোই তোলা হবে না? আমাদের কবর হবে না কখনোই?'

কেউ কোন জবাব দিল না। মেয়ে লাশটা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, 'কিন্তু ভাইয়া, আপু, নানু, দাদু সবাই রোজ আমাদের লাশের জন্য অপেক্ষা করে! আবার অলৌকিকভাবে বেঁচে ফিরবারও অপেক্ষা করে। কি কষ্ট ওদের, তাই না? আচ্ছা, আমাদেরতো কবর হবে না। কবরের পাশে বসে কেউ দোয়াও পড়বে না। ভাইয়া, আপু, দাদু, নানু, আমার বন্ধুরা কেউ আমাদের কবরের কাছে কখনোই আসতে পারবে না! তাই না?'

মা লাশ বলল, 'কবরতো হতেও পারে। এখনও সবাই লঞ্চটাকে খুঁজে বেরাচ্ছে। পেয়ে গেলে তার ভেতরে আমাদের লাশগুলোও পাবে। তখন দাফন হবে'।



বাবা লাশ বলল, 'হবে না। যারা খুঁজে পাবে, তারা লাশগুলোকে লঞ্চের এই ঘর থেকে বের করে নদীর তলায় ডুবিয়ে দিবে। তারা কাউকে লাশ দেখাতে চায় না। আর খুঁজে পেলেও কি! আমাদের কে কি আর চেনার উপায় আছে?'



ছোট্ট সেই ছেলে লাশটা এতক্ষণ চুপ করে ছিল। একটাও কথা বলে নি। এই তিন জনের সাথে তার কোন সম্পর্কও নেই। সে কেমন কেমন করে ভেসে চলে এসেছে এই তিন জনের কাছে। সে হঠাৎ বলল, 'জানো, লঞ্চটা যখন ডুবে যাচ্ছিল, তখন আমার বাবা মা দু'জন মিলেই আমাকে বুকের সাথে চেপে ধরে রেখেছিল। কিন্তু এখন দেখি তারা কোথাও নেই। তোমরা কেউ জানো?'



মেয়ে লাশটা বলল, 'মানুষেরা লঞ্চ খুঁজতে আসে, তারপর কিছু লাশ তুলে নিয়ে যায়। পেট চিরে ডুবিয়ে দেয়, যাতে লাশগুলো আর ভেসে উঠতে না পারে... তোমার বাবা মাও হয়তো...'

- 'মানুষেরা এখনও এই লঞ্চ খুঁজছে?'

- 'হ্যা, খুব আয়োজন করে খুঁজছে। রেডিও, টিভি, পত্রিকাতে রোজ দেখাচ্ছে। খুঁজতে খুঁজতে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে'।

ছেলে লাশটা খানিক চুপ করে থাকে। তারপর হঠাৎ বড়দের মতন গম্ভীর গলায় বলল, 'এই পচা গলা লাশে ভরা তলিয়ে যাওয়া লঞ্চ খুঁজে আর কি হবে? ওদেরকে একটু বল, ওদের পচে গলে তলিয়ে যাওয়া দায়িত্ব, অনুভূতি আর মনুষ্যত্বদের খুঁজে বের করতে। ওগুলো খুঁজে বের করতে পারলে আর রোজ রোজ ডুবে যাওয়া লাশ খুঁজে বের করতে হবে না'।



কেউ আর কোন কথা বলল না। একটা ঠাণ্ডা চুপচাপ নৈশব্দ!

হঠাৎ জলে কম্পন উঠলো। একটা বড় মাছ এসে লেজে তরঙ্গ তুলল জলে। মেয়ে লাশটা ভয় পেয়ে বলল, ' বাবা, এই মাছটাই আমাদের চোখ ঠুকরে খেয়েছে, জানো? মা'রটা আর তোমারটাও... '

বাবা লাশ বলল, 'আমাদেরতো চোখ কখনও ছিলই না'।

মেয়ে লাশটা অবাক গলায় বলল, 'চোখ ছিল না মানে?'

বাবা হেসে বলল, 'যদি সত্যি সত্যি মানুষদের চোখ থাকত, তাহলে রোজ রোজ এভাবে কারো ডুবে মরতে হত না, কাউকে না'।



লাশগুলো তারপর চুপ হয়ে গেল। কোন কথা শুনতে পাই নি আর। তবে জলে ঢেউ তুলে বিশাল সেই মাছটা ঠুকরে খাচ্ছিল পচা লাশের মাংস।



আর আমরা মানুষেরা (!) পদ্মার সেই সুস্বাদু মাছ খাবার অপেক্ষায়।

আহা, মাংস!

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.