নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম \'বোধ\'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবি

সাদাত হোসাইন

লিখি, ফিল্ম বানাই, ছবি তুলি। বই প্রকাশিত হয়েছে ৫ টি। উপন্যাস, ছোট গল্প আর (অ)কবিতার বই। প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম 'বোধ'। ২০১৩ তে জিতেছে জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড। স্বপ্নের সবটা জুড়ে গল্প। সেই গল্প বলতে চাই লেখায়, চলচ্চিত্রে, ছবিতে...

সাদাত হোসাইন › বিস্তারিত পোস্টঃ

জলের পাটাতন

২৭ শে আগস্ট, ২০১৪ রাত ১০:৫৬

মশারী তুলতেই চমকে গেলাম, 'মাছ! মশারীর মধ্যে মাছ!!'

দুই হাতে পাঁজাকোলা করে সেই মাছ ধরলাম। লেজের তীব্র ছটফটানিতে পেটের নিচটায় জ্বলছিল। কিন্তু এতো বড় মৃগেল মাছ! ছেড়ে দেয়ার প্রশ্নই আসে না! ঘরের ভেতর কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে আম্মা ক্লান্ত মুখে দেখছিলেন, বললেন, 'মাছ কি কাঁচা খাবি? তারচে ছাইড়া দে'।

আমি মাছ ছাড়লাম না। দুই হাতে মশারীতে পেঁচিয়ে ঘরের দরজায় বাঁধা নৌকায় উঠলাম। তারপর রেখে দিলাম পাটাতনের নিচে। মাছটা পাটাতনের তক্তায় শব্দ তুলে লাফাচ্ছে, 'ঠকাত, ঠকাঁত!!' কিন্তু মুক্তির উপায় কি? প্রতি লাফে জারি হচ্ছে নিশ্চিত মৃত্যু'।



বন্যার পানি বাড়ছে। গতকাল বিকেল অবধি পানি ছিল পুকুর উপচে উঠান ছুঁই ছুঁই। সন্ধ্যা না গড়াতেই সেই পানি ধেয়ে এলো ঘরের দোর অবধি। রাত নামতেই ঘরের মেঝে থৈ থৈ। দাদী আম্মাকে ডেকে বললেন, 'ও বউ, গাঙ্গের অবস্থা ভালো না। পানি বাড়তেছে বেশুমার। রাইতের মধ্যে ঘরডাই না তলাই যায়! যা যেমনে আছে থাউক। কাপুর চুপুর লইয়া লও ইশকুলের দালান ঘরে যাই'।



আম্মা দ্বিরুক্তি করলেন না। সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে কাদাজল হয়ে যাওয়া আমাদের দুই ভাইকে টেনে তুললেন। আমরা চলে এলাম ইশকুল ঘরের বারন্দায়। শতশত মানুষ। বন্যার জল বাড়ছে। ঘরহারা মানুষ বাড়ছে। কিন্তু খাবার? খাবার কই পাব!



সকাল হতেই নৌকা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। চাল ডাল যা ছিল, নিয়ে যাব ইশকুল ঘরে। ঘরে ঢুকতেই দেখি জলে ডুবে আছে চৌকি। গতরাতে টানিয়ে রাখা মশারিতে পেঁচিয়ে আছে বিশাল মৃগেল। আমি সেই মাছ জাপটে ধরে নৌকায় তুললাম। কিন্তু আগুন নাই, কাঠ নেই, চুলা নেই! কি করে খাব?



আম্মা ম্লান চোখে তাকিয়ে আছেন ঘরের উত্তর দিকের ছনের বেড়ার দিকে। তীব্র স্রোতে সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে বানের জল। চালের ড্রাম? ডালের বস্তা? নেই, কোথাও নেই। আম্মা আমার দিকে তাকালেন, শূন্য দৃষ্টি, বললেন, 'মাছতো নিছস, এখন দেখ আগুন ধরানির ব্যবস্থা করা যায় কি না?'



নৌকায় উঠে আমরা দুজন ফিরে চললাম ইশকুল ঘরে, আম্মা চুপচাপ বসে আছেন। চারপাশে কেবল জলের গন্ধ, জলের শব্দ, বৈঠার শব্দ ছলাৎ ছলাৎ...



বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত, রাত গড়িয়ে সকাল। সেই মৃগেল মাছটা পরে থাকে পাটাতনের নিচেই। রক্তাক্ত শরীরের মৃত মৃগেল। আর বন্যার জল বাড়ে, বাড়তেই থাকে। যতটা বানের জল তার চেয়ে ঢের বেশি চোখের... আটানব্বুইর সেই বন্যা শুধুই জলের গল্প, চোখের, শোকের, বুকের, সকল জল একাকার।



কালাম সরদার ভ্যান চালাত। এই জলে কি করবে সে? কোথায় ভ্যান চালাবে? বউটাও পোয়াতি। সেই এক ভেসে যাওয়া জলের রাতে ফুটফুটে এক মেয়ে জন্মাল, কালাম সর্দার সারা দিন তাকিয়ে থাকে নিস্পলক। তার চোখভর্তি জল। মেয়েটা মারা গেল দু'দিন বাদে। তখনও কালাম সর্দার তাকিয়ে ছিল। তার চোখে তখনও জল। সে আর তার বউ দুই দিন বয়সের সেই বুকের ধন সোনা মানিককে ভাসিয়ে দিল বানের জলে... আর তারা ভেসে গেল চোখের জলে। জলেরা মিশে গেল জলে...



লালমনিরহাট গিয়েছি ২০১০ সালে।

জমিতে জল নেই। ধুধু চর। মরুভুমির মতন। জল নেই, ফসল নেই, ফুল নেই। তিস্তায় বাঁধ। জলের অভাবে মানুষ মরে। জলের অভাবে। আবার বাঁধ সরে, জলে ভেসে যায় তিস্তা। ভাসে লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম... জলের স্ব-ভাবে। এই জলের অভাব, আর জলের স্ব-ভাবে জল থৈ থৈ মানুষগুলো ডুবে মরছে। এইতো আজ, আজ বুধবার তিস্তার পানি বেড়েছে ৯ সেন্টিমিটার। সেই সঙ্গে তিস্তার পানি বিপদসীমার ৩৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।



সেখানে কতজন কালাম সরদার আছেন কে জানে? তবে পাটাতনের নিচের সেই মৃগেল মাছটার মত অনেকেই আছে নিশ্চিত। দুর্ভাগ্য তারা মাছ নয়, মানুষ। জলের পাটাতনে বন্দি। মুক্তির জন্য ছটফট করছেন, চিৎকার করছেন, কেউ কি শুনতে পাচ্ছে? না কি জলের পাটাতনে সেই ছটফটানি শুধুই শব্দ তুলছে, ছলাৎ... ছলাৎ...

-------------------------------------

জলের পাটাতন/ সাদাত হোসাইন

২৭/০৮/২০১৪

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে আগস্ট, ২০১৪ রাত ১১:৪৫

মৃদুল শ্রাবন বলেছেন: চমৎকার লেখা আপনার।

ভালোলাগা নিবেন।

২| ২৮ শে আগস্ট, ২০১৪ সকাল ৯:০৮

অতনু অর্ঘ বলেছেন: অসাধারণ... সত্যিই অসাধারণ... আর কিছু বলার মতো শব্দ খুঁজে পাচ্ছিনা... ভালো থাকুন... আর এরকম অসাধারণ লিখতে থাকুন...

৩| ২৮ শে আগস্ট, ২০১৪ সকাল ১১:০২

সুরাজ হাসান বলেছেন: সুন্দর লিখেছেন......ধন্যবাদ

৪| ২৮ শে আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ১:২৬

লাইলী আরজুমান খানম লায়লা বলেছেন: চারপাশে কেবল জলের গন্ধ, জলের শব্দ, বৈঠার শব্দ ছলাৎ ছলাৎ...''---------অসম্ভব সুন্দর ---

৫| ২৮ শে আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ১:২৮

লাইলী আরজুমান খানম লায়লা বলেছেন: চারপাশে কেবল জলের গন্ধ, জলের শব্দ, বৈঠার শব্দ ছলাৎ ছলাৎ...''----------অসম্ভব সুন্দর

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.