নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি ভাল না খারাপ দূর থেকে নয়, কাছে এসে মিশে বন্ধু হয়ে দেখুন৷

খলিলুর রহমান ফয়সাল

ভাল আছি ভাল থেকো, আমার ঠিকানায় চিঠি লিখো

খলিলুর রহমান ফয়সাল › বিস্তারিত পোস্টঃ

কালা বাইগুনের ধলা ফুল, রুমালে গাঁথিয়া তুল্...

২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:০২


ইনাকে আমরা ডাকতাম সুন্দরী দাদী। এ দাদী মূলত আমার দাদার বড় বোন। দাদার বাবা ছিলেন আমাদের উপজেলায় শিক্ষিতদের হাতে গুনা কয়েকজনের একজন..তাঁর নাম ছিল ইন্তেজ আলী মাস্টার। ইন্তেজ আলী সাহেব তার সুন্দরী এ মেয়ের নাম তৎকালীন নারী জাগরণের অগ্রদূত নবাব ফয়জুন্নেছার নামে নাম রেখেছিলেন। সেই সুন্দরী দাদী আজ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। সুন্দরী দাদীর সাথে আমার অনেক স্মৃতি। দাদা বেঁচে থাকতে দু ভাই বোন শুধু ঝগড়া করতো। সামান্য চা নিয়ে দুই বুড়ো ভাই বোনের ঝগড়া হতে পারে তা আমার পরিবারের মানুষ ছাড়া কেউ বিশ্বাস করবে না। দাদা মারা যাবার পরই দাদীও ভেংগে পড়েন। আম্মা যেদিন মারা গেলেন সেদিনও সুন্দরী দাদী গ্রাম ছেড়ে আমাদের বাসায় এসেছিলেন। আম্মার হঠাৎ চলে যাওয়াটা কেউ মানতে পারে না। দাদী আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন- "ভালা ব্যাডিডা হাইঞ্জালা আমারে কলা দিয়া দুদ বাত খাওয়াইলো, হাইঞ্জা শেষ অইতে অইতেই নাই।" প্রকৃতি কত নিষ্ঠুর। আজ তিনিও চলে গেলেন!

দাদীর কথা মনে হতেই আমার বিয়ের গানের কথা মনে পড়ে। আমার বাবা চাচারা এ দাদীকে ডাকেন- খাডুরার ঝি ( খাডুরা নামে একটি গ্রাম আছে, যেখানে দাদীর বিয়ে হয়)। তো সেই খাডুরার দাদি যখন মিহি সুরে গান ধরেন, আশে পাশের সবাই ছুটে আসতেন। ছোটবেলায় বিশেষ কোন কারণ ছাড়া আমরা গ্রামে যাওয়ার সুযোগ পেতাম না। ঈদ, বিয়ে, গায়ে হলুদ ইত্যাদি ছাড়া গ্রামে এক রাত কাটিয়েছি বলে মনে পড়ছে না। খুব মনে পড়ছে আমার ছোট চাচার বিয়ের কথা। ছোট চাচার বিয়ে হয় খালার সাথে... সে বিয়েতেও সুন্দরী দাদী গান ধরেছিলেন। এ ধরনের বিয়ের গান কে বলা হয়- গীত। আমার দাদী, ফুপু এমনকি বাবাও বিয়ের গীত জানেন।

চিরকালই বাঙালির বিয়ে মানে উৎসব, হৈ হৈ আর গান-বাজনা। তবে বর্তমানের যান্ত্রিক সময়ে বিয়েতে গান-বাজনার প্রচলন থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা চলে গেছে হয় সাউন্ড সিস্টেম নয়ত পেশাদার শিল্পীদের দখলে। ইতিহাস বলে, সেই প্রাচীনকাল থেকেই এই উপমহাদেশের বিয়েতে নাচ-গানের প্রচলন ছিল। আর এটা করত অন্তপুরের নারীরাই। আজ থেকে দশ-পনের বছর আগেও দেখেছি গ্রামের বিয়েতে বিশেষ করে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য দাদীর মতো ‘গীত গাওনি’ মহিলাদের ডাক পড়ত। এখন যদিও এই গীতের ধারাটি ক্ষীণ হয়ে এসেছে, তবুও প্রত্যন্ত গ্রামে কোথাও কোথাও এখনো বিয়েতে গীত গাওয়ার প্রচলন আছে। এসব গীত আঞ্চলিক ভাষায় রচিত এবং প্রজন্ম পরম্পরায় মুখে মুখে প্রচলিত, স্মৃতি ও স্বতঃস্ফূর্ততায় বিকশিত। বয়স্করা অর্থাৎ শিশুদের মা-চাচী-খালারা যখন বিয়ের অনুষ্ঠানে গান করেন তখন তাদের ঘিরে থাকে শিশুরা। শিশুরা এসব গান শোনে এবং মনের ভেতর গেঁথে নেয়। এরপর যখন তারা বড় হয় তখন নিজেরাই সেসব গান গাইতে শুরু করে। এতে মূল গানের সঙ্গে হয়ত সময় পরিক্রমায় আরো কিছু সংযোজন-বিয়োজন চলে, তবে তাতে মূল গানের রস আস্বাদনে কোনো অসুবিধা হয় না। বিয়ের গীতের রচয়িতা নারী, এই গীত পরিবেশনও করেন নারীরা। এর শ্রোতাও সাধারণত নারী। নারী মনের আবেগ-উৎকণ্ঠা-আনন্দ-বেদনা-হাসি-কান্না-সুখ-আনন্দের প্রকাশ ঘটে বিয়ের গীতে। সাধারণত একসঙ্গে কয়েকজন বিভিন্ন বয়সের নারী গোল হয়ে বসে খালি গলায় বিয়ের গীত পরিবেশন করেন। গায়ন রীতি হয় সরল ও অলংকারবিহীন। সংগীত বিষয়ে শিল্পীদের কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকায় এই গান গাওয়া হয় একটানা সুরে, অচর্চিত গলায়, স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিতে। যা শহুরে শিক্ষিত মানুষের কানে বিরক্তিকর ও ত্রুটিপূর্ণ মনে হতে পারে, মনে হতে পারে একঘেয়ে কিন্তু বিয়ের গীত শুনতে হবে এর স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করে। এর সব সীমাবদ্ধতাকে উপেক্ষা করেই ঢুকতে হবে গ্রামীণ নারী রচিত বিয়ের গীতের সরস ভুবনে। বিভিন্ন এলাকার বিয়ের গীতের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে গায়ে হলুদ ও কনের গোসলের গীত। অঞ্চল ভেদে এসব গীতের ভাষাগত পার্থক্য থাকলেও বিষয়বস্তু একই।

দাদীর গাওয়া সবচে জনপ্রিয় গীতটি হলো-

‘কালা বাইগুনের (বেগুনের) ধলা ফুল রুমালে গাঁথিয়া তুল্ কইনা লো তোর দয়াল বাবাজির মায়া তুল্ । বরির (বরইয়ের) গাছে কুমড়ার ফুল রুমালে গাঁথিয়া তুল্ কইনা লো তোর দয়া চাচাজির মায়া তুল্ ।’

আরেকটি গীত মনে পড়ছে- কন্যা ডাক দেও তোর জননী না মাইরে/মাও দিয়া যাওক সোনা মুখে হলদিরে/হলুদা, ডাক দেও তোর জনমদাতা বাপেরে/বাবা দিয়ে যাউক তোর সোনা মুখে হলদিরে।

সংস্কৃতির যে ছিটেফোটা শরীরে এখনো আছে তা আমি আমার পরিবারের কাছ থেকেই পেয়েছি। আমার দাদী এখনো বেঁচে আছেন। তিনি গ্রাম্য ভাষায় নজইরা (শিলক/প্রবাদ/ নীতিকথা) দেন। এগুলো যদি কোনভাবে লিখে রাখা যায়, লোক সাহিত্যের বড় সংগ্রহশালা হয়ে যাবে। আমার দুই ভাই সৈকত ও রাহিম একবার উদ্যোগ নিয়েছিলে দাদির এ নজইরা গুলো লিপিবদ্ধ করবে। ব্যাস্ততার কারণে হয়ে উঠে না আসলে। আজ চলে গেলেন বিয়ের গীতের অন্যতম শিল্পী সুন্দরী দাদি। এভাবে নিরবে নিভৃতে বাংলার পল্লী সমাজে যে রস লুকিয়ে রয়েছে তা কি দিন দিন হারিয়ে যাবে? ভাল থেকো সুন্দরী দাদী।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:১৩

প্রামানিক বলেছেন: আপনার কথা শুনে সেই ছোট কালের কথা মনে পড়ে গেল। ছোট বেলায় এরকম অনেক বিয়ের অনুষ্ঠানে যেতাম মেয়েদের দল বেঁধে গীত গাওয়ার একটা রেওয়াজ ছিল। এখন সে সসব নাই। সেই মানসিকতাও নাই। পোষ্টের জন্য ধন্যবাদ। আপনার দাদীর মাগফেরাত কামনা করি।

২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:১৬

খলিলুর রহমান ফয়সাল বলেছেন: আপনার বাড়ি কোথায় ভাই? এরকম কোন গীত কি আপনার সংগ্রহে আছে??

২| ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:৩৭

মামুন রশিদ বলেছেন: আপনার দাদীর জন্য বিনম্র শ্রদ্ধা । ছবি দেখে বুঝাই যায় খুব স্নেহপরায়ন আমুদে মানুষ ছিলেন ।

৩| ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:১৩

নির্বোধ পাঠক বলেছেন: ডিজিটাল এই যুগে আপনার লোক-সাহিত্যের প্রীতি বেশ ভাল লাগল।
সুন্দরী দাদীর জন্য অনেক শুভ কামনা। তাঁর পারলৌকিক শান্তি কামনা করি।
শুভেচ্ছা রইল। ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.