নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি ভাল না খারাপ দূর থেকে নয়, কাছে এসে মিশে বন্ধু হয়ে দেখুন৷

খলিলুর রহমান ফয়সাল

ভাল আছি ভাল থেকো, আমার ঠিকানায় চিঠি লিখো

খলিলুর রহমান ফয়সাল › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমার উঠোন কোণে তুমি (বন্ধুত্বের গল্প-১)

১৫ ই অক্টোবর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৪০

সৌভিত ও রিফাতঃ কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটে বন্ধুত্ব

নেত্রকোণার ছেলে নাজমুল রিফাত সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর কোমড়ে ব্যাথা অনুভব করতো। মাঝে মাঝে এমন ব্যাথা হতো যে ক্লাসে যাওয়া যেতো না। এমন সময় এগিয়ে আসে তার বন্ধুরা, বিশেষ করে সৌভিত চাকমা। রাঙামাটির ছেলে সৌভিত প্রায় প্রতিদিন তাকে কাঁেধ করে ক্লাসে আনা-নেয়া করতো। বিপদের সময় যার কাঁধে হাতরাখা যায় সেই না বন্ধু। অবশ্য সৌভিত-নাজমুলের বন্ধুত্বের গল্পটা আরেকটু মজার। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনার প্রচন্ড চাপ। অথচ দুজনেরই ঘুরার নেশা। ঘুরতে ঘুরতে দুজনের বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে। আজ মৌলভীবাজারের হামহাম জলপ্রপাত তো কাল সিলেটের ইকোপার্ক। জালাল মিয়ার চায়ের টং থেকে জিন্দাবাজারের ব্যস্ত সড়ক, দুবন্ধু মিলে চুটিয়ে আড্ডা। ”সৌভিতের কাছে মনের কথা বলে খুব আরাম পাওয়া যায়, সে প্রচন্ড বিশ্বাসী একটা মানুষ” নিজের বন্ধু সম্পর্কে গর্বকরে বলেন রিফাত। হুট করে একবার রিফাতের গাজিপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হয়ে যায়। কিন্তু সৌভিত বলে, “তুই চলে গেলে আমি সিলেটে একলা হয়ে যাবো।” শুধুমাত্র বন্ধুত্বের জন্য রিফাত তার সিদ্ধান্ত বদলায়। এভাবেই সুখে দুখে পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ রেখে হাঁটছে দুই বন্ধু।

বন্যা-সুমাইয়া: পানসে নয় মিষ্টি সম্পর্ক

দুজনের বাড়িই সিলেটের কানাইঘাটে। সুন্দরী সুমাইয়া রশীদের গলায় মোটা লকেটের অলংকার ছিলো। বন্যার এই কথাটা খুব মনে থাকে। এরপর ২০০৮ সাল। কানাইঘাট স্কুল ছুটি। ক্লাস টেনের ছাত্রী সুমাইয়া আর মৌমিতা স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলো। একটা বখাটে ওদের দিকে তাকিয়ে বাজে একটা ইঙ্গিত করলো। নিশাত তানজুম বন্যা দূর থেকে দেখে ঐ লোকের পেছনে হাঁটা শুরু করলো। দৌঁড়ে গিয়ে কলার টেনে ধরে শাসিয়ে আসলো। সেই থেকে শুরু। সুমাইয়ার মতে, “আমার জায়গায় যেকোন মেয়ে থাকলে বন্যা এ কাজটি করতো। তার সাহসিকতার ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম।”
বন্যা কথা কেড়ে নিয়ে বলে, “আসলে বন্ধুত্বটা হবার জন্য হোস্টেল দায়ী। কানাইঘাট ছেড়ে আমরা দুটি মেয়ে সিলেটের একটি হোস্টেলে উঠি। দৈনন্দিন কাজ শেষে রুমে এসে একজন আরেকজনের সাথে সব ঘটনা শেয়ার করতাম। এভাবেই বন্ধুত্বটা গাঢ় হয়। আমার জন্য একটা মানুষ কাঁদতে পারে সেটা কখনো মনে হয়নি। আর সুমাইয়ার মতো মেয়ে তো না ই। কারণ মেয়েটা এতই শক্ত যে তাকে আমি তিনবছরে মাত্র দুবার কাঁদতে দেখেছি। তাও একবার আমার জন্য। আমি তো কিছু হলেই কেঁদে কেটে ভাসিয়ে দিই। যদিও এটা বলা আমার উচিত না তবু বলি, তার বিয়েটা আমি এখনো মেনে নিতে পারি না। তাকে ছাড়া হোস্টেলে থাকতে হবে, এই আতঙ্কে আমি তার বিয়ের আগে খালার বাসায় গিয়ে উঠি। সুমাইয়া ছাড়া দম বন্ধ হয়ে আসছিলো।”
কম যায়না সুমাইয়াও, “বন্যা আসলে বড় বোনের মতো। সে বেশ হেল্পফুল। আরেকটা বড় বিষয় হলো বন্যা অনেক কিছু জানে। যে বেশি জানে, সে বেশি স্মার্ট। তার সাথে কথা বলতে বলতে আমি জ্ঞানী হয়ে গিয়েছি। স্কুলে থাকাকালীন সময়ে আমি প্রথম তার কাছ থেকে বই নিয়ে পড়েছি। এ উপকারটা আমি কখনো ভুলবো না।”
আমি প্রশ্ন করি, “তোমাদের কখনো ঝগড়া হয়নি?” দুজনেই বলে- এ বিষয়টা কমপ্লিকেটেড। আমাদের যখন কোন বিষয়ে মতের অমিল হয়, তখন পাঁচ মিনিট চুপ থাকি। তারপর বিষয়টা ভুলে যাই।” লোকে বলে ঝগড়া ছাড়া বন্ধুত্ব পানসে। তাদের এই পানসে বন্ধুত্বটা কত মিষ্টি তা শুধু বন্যা আর সুমাইয়াই জানে।

উর্মি- ইমরানঃ বন্ধুর পথে বহুদূর

আমি নিজেই যেহেতু একটা বান্দর টাইপের এজন্য মনে মনে চাইতাম দুষ্টু ছেলেপেলে আমার বন্ধু হোক -রুখসানা উর্মির সরল স্বীকারোক্তি। অবশ্য প্রথমে আবদুস শুকুর ইমরান উর্মিকে খুব জ্বালাতন করতো। তখন বন্ধুত্বটা ছিলো না, জাস্ট ক্লাসমেট। একদিন রাগ করে উর্মি ইমরানকে মার দিয়ে বসে। সেই ঝগড়া থেকে কখনযে বন্ধুত্বটা হয়ে গেলো তারা নিজেরাই টের পায় নি। অবশ্য এক্ষেত্রে ফেইসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপের অবদান খুব বেশি। উর্মি বলে, ”খুব শীতের সময় আমি একদিন মজা করে বলেছিলাম, তুই এখন গোসল করতে পারবি?” অবাক করে দিয়ে কনকনে ঠান্ডায় ইমরান জলে নেমে যায়। এরকম পাগল ছেলেকে বন্ধু হিসেবে রাখাই যায়। উর্মিকে নিয়ে ইমরানের সবচেয়ে ভাল লাগার কথাও শোনা হয়। “আসলে মেয়েটা আমার অভিবাবকের মতো। খুব কষ্ট পেয়ে যখন তাকে আমার ব্রেকআপের কথা বলি, সে বলে-সমস্যা নাই, তোর জন্য আমি পাত্রী খুঁজে দেবো। ২০১৫ সালের অসহায়ত্বের দিনগুলিতে তার উপর বেশ ভরসা রেখেছিলাম। সারাজীবন ঐ দিনগুলো আমার মনে থাকবে।”
এই ঘটনা দিয়ে বুঝতে পারলাম ,বন্ধুত্ব সম্পর্কটা কত বড়! ফাইনাল পরীক্ষার আগে উর্মি বইপত্র না নিয়েই বাড়ি চলে যায়। এখবর জানতে পেরে ইমরান প্রায় ২০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে উর্মির বাড়িতে হাজির। বন্ধুকে যে করেই হোক পাশ করাতে হবে।
বন্ধুত্বের প্রভাব দুজনের জীবনেই প্রচন্ড, বিশেষ করে ইমরানের। উর্মির সাথে পরিচয়ের আগের ইমরানকে বন্ধুরা আবেগী বা এংরি কিং বলে খেপাতো। হুটহাট রাগ উঠে গেলে কার ভালো লাগে বলেন? তবে উর্মি ইমরানকে ধৈর্য্যশীল বানিয়েছে। আমাদের ইমরান এখন বলতে গেলে মাটির মানুষ ।
একটা ছেলে ও একটা মেয়ে কখনো বন্ধু হতে পারে না, প্রেম হবেই হবে- এই সমাজে এরকমটাই প্রচলিত। কিন্তু সকলকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ইমরান-উর্মি হাটছে বন্ধুত্বের পথে। শুভ কামনা দুষ্টুরা।

ঐশ্বর্য- তানভীঃ বন্ধে মায়া লাগাইছে

বলিউডের নায়িকা ঐশ্বর্য রাই বচ্চনের নামে নাম। চোখও তার বেশ মায়াবী। এমন একটি মেয়ের ভাগ্যে একবার নেমে আসে হতাশার কালো ছায়া। বড় অসুখ টায়ফয়েড শরীরের যতটা না ক্ষতি করেছে, মনের তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। শিক্ষাজীবনে একবছর ক্ষতির খবরে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে ঐশ্বর্য মজুমদার সৃষ্টি। একে তো সমবয়সী বন্ধুরা আর সাথে নেই তার উপর কাছের মানুষের চলে যাওয়া কোনভাবেই মানতে পাওে না সে। এমনই এক বিপদের দিনে হাত বাড়িয়ে দেয় তানভী নামের আরেকটি মেয়ে। এসো নীপবনে ছায়াবীথি তলে।
সিকৃবি ক্যাম্পাসের প্রিয় মুখ তানজিলা জাফরিন তানভী। কী সুন্দর গায় গায়, নাচে, অভিনয় করে! অথচ এতটুকু অহংকার নেই। কঠিন পরীক্ষা হিস্টোলজি। বন্ধুহীনা ঐশ্বর্যকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসে তানভী। কৃতজ্ঞতায় ঐশ্বর্যের চোখে জল আসে।
তানভী কথা কেড়ে নিয়ে বলে,“দিদির চেহারায় কি যে মায়া! এমন মায়াবী চেহারায় মলিনতা একেবারেই ভালো লাগতো না। কাছে গিয়ে দেখি একেবারে আমার মনের মতো মানুষ।” দুজনের চ্যাট লিস্টেও ফার্স্ট নেম দুজনের। সারাক্ষণ ঘুটুর পুটুর। এমনকি স্যার যখন ক্লাসে থাকেন তখনো চিরকুট দিয়ে ভাবের আদান প্রদান। গ্রুপ স্টাডির নামে তানভীর বাসায় মাঝে মাঝে থাকে ঐশ্বর্য। কিসের পড়া, সারারাত শুধু খাওয়া দাওয়া আর গল্প।

তানভী বলেন আবেগী কথা, “আমার একটা বড় বোন নাই, একটা বোনের আফসোস আমার সারাজীবনের। দিদিকে পেয়ে আমার বান্ধবীর পাশাপাশি বোনের আফসোস মিটেছে। সকলে বলে মেয়েদের হৃদয় হিংসে ভরা। কিন্তু আমাদের ভেতরতো কোন হিংসে নেই”। তানভীর অবশ্য ইগোর সমস্যা আছে। রাগ করলে তাই ঐশ্বর্যই আগে এগিয়ে আসে। তবে হাইপারটেনশনে থাকা তানভী বন্ধু পেয়ে এখন অনেক চিল। সারাক্ষণ হাসিখুশি দুই বন্ধুর জীবনের সফলতা কামনা করি।

রাজীব-সোহানঃ নির্ভরশীলতার অপর নাম বন্ধুত্ব

ঐক্যের গুরুত্ব বুঝাতে বাংলায় একটি জনপ্রিয় প্রবাদ আছে- দশের লাঠি একের বোঝা। ক্যাম্পাসে ভর্তি হয়ে রিয়াজুল ইসলাম রাজীব-সৈয়দ ইশতেমাম সোহান এক হয়েছিলো বিভিন্ন সমস্যা একসাথে মোকাবেলা করার জন্য। অন্যেরা যাতে প্রভাব খাটাতে না পাওে তাই দুজনে হাত মেলায়। সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকে মাস্টার্স, এখনো সেই একতা আছে।
সোহানের সাথে যাদের বন্ধুত্ব নেই, রাজীবও সেদিকে পা বাড়ায় না। বন্ধুর বন্ধু আমার বন্ধু, বন্ধুর শত্রু আমারো শত্রু। দুজনেরই ছাড় দেয়ার মানসিকতা প্রচন্ড। বাড়ি থেকে খরচের জন্য কত টাকা আসলে সেটা বিষয় না। অর্থ যেখানে অনর্থের মূল, সেখানে দুটো মানিব্যাগ দুজনের পাছায় থাকলেও দুজন মিলেই মালিক যেন। রাজীবের টাকা সোহানের, সোহানের টাকা রাজীবের। কখনো ধার নামে শব্দটি তাদের মাঝে আসেনি। কে কার জন্য কত টাকা খরচ করলো এরকম কোন হিশেব করেনি তারা।
সোহানের মতে, “আমি খুব অলস। অথচ রাজীব বেশ পরিশ্রমী। আমার বন্ধুটি সবসময় আমাকে রান্না করিয়ে খাওয়ায়। অনেক বন্ধুরা মিলে কাজ করলে সে নিজেরটার পাশাপাশি আসার কাজটাও করে দেয়। এই উপকারটা পরিবার ছাড়া কোথাও পাবেন?”
বন্ধুর কোন কাজে বিরক্ত জানতে চাইলে, রাজীব বলে- “সোহান খুব উদাস ও অলস।” সোহান বলে, “রাজীবের একটা আচরণে আমি কষ্ট পেয়েছিলাম। তার প্রেম হয়েছে এবং সে এটি আমাকে অনেক পরে বলেছে। অথচ সবার আগে আমি তা জানার কথা ছিলো।” অবশ্য রাজীব কথা টেনে নিয়ে বলে, “নিশ্চিন্তভাবে প্রেম হয়েছে জানার পর অফিসিয়ালি তাকেই আমি প্রথমে বলি।” খুনসুটির এক পর্যায়ে দু’ বন্ধুর কাছে মজার কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া হয়।

প্রশ্ন: দুজনের একই মেয়ে প্রেমিকা হিসেবে পছন্দ হলে কে ছাড় দিবে?
সোহান: আমি ছাড় দিবো।
রাজীব: ঐ মেয়ের সাথে কারোর প্রেমই হবে না।

প্রশ্ন: চাকুরীর অফার দেয়া হলো দুজনকে, কিন্তু একজনই পাবে, কে ছাড় দেবে?
সোহান: আমি ছাড় দিবো।
রাজীব: আমারো মনে হয় সোহানই ছাড় দিবে।

প্রশ্ন: বন্ধু মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী হলে কি করবে?
সোহান: মানুষে মানুষের সম্পর্ক নিয়ে নাটক বা সিনেমা বানাবো। জনগণকে দেখাতে বাধ্য করবো।
রাজীব: আমি সোহানকে আমার মন্ত্রীত্ব দিয়ে পদত্যাগ করতাম।

জীবনের সবচেয়ে খুশির মূহুর্তগুলো যেমন বন্ধুর সাথে শেয়ার করা যায়, অতি কষ্টের সময় বন্ধুর কাঁধে মাথা রেখে কাঁদাও যায়। রাজীব-সোহান খুব গভীর রাতে সারাদিনের গল্প নিয়ে একসাথে বসে। রাতের নিস্তব্ধতায় নরম মনে কথার চালাচালি হয়। এভাবেই বিভক্ত পৃথিবীতে একটা শক্ত বাঁধন তৈরি করেছে তারা।

শামীম-ঋত্বিকঃ রাজনৈতিক সহযোদ্ধা

বিভিন্ন বক্তৃকায় একটা কথা প্রায়ই আসে - পলিটিক্যাল ফ্রেন্ড ইজ দ্যা বেস্ট ফ্রেন্ড। অথচ সারা বাংলাদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে শাখা-প্রশাখায় বিভক্তি স্পষ্ট। বন্ধু দিবসকে সামনে রেখে মুখোমুখি হয়েছিলাম সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ডাঃ শামীম মোল্লা ও সাধারণ সম্পাদক ডাঃ ঋত্বিক দেব অপুর সাথে। কথার শুরুতেই ক্যাম্পাসের ট্যাংকির তলায় বেঞ্চিতে বসে নিজেদের বন্ধুত্বের গল্প শোনালেন তারা।
দুজন প্রায় সমবয়সী। একজন ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সায়েন্স অনুষদের ১৩তম ব্যাচের, আরেকজন একই অনুষদের ১৪তম ব্যাচের। রাজনীতি করতে গিয়েই মূলত দুজনের পরিচয়। একই আদর্শের রাজনীতির করার সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম থেকেই দুজনের মধ্যে একটা সুসম্পর্ক তৈরি হয়। প্রথম দিকে ব্যাচ রাজনীতি এবং অনুষদীয় রাজনীতির নেতৃত্ব দিলেও ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষনা করার পরই তাদের বন্ধুত্বটা গাঢ় হয়।
ঋত্বিক বলেন, “সম্পর্কের পূর্ণতা লাভ করে যখন দুজন সাংগঠনিক দায়িত্ব পাই। সংগঠনকে গতিশীল করতে আমরা বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ সিন্ধান্ত নিয়েছি। অনেক সময় হয়তো একজনেরটা অন্যজনের ভালো লাগেনি কিন্তু ভালো সিন্ধান্তটি শেষ পর্যন্ত আমরা নির্বাচন করতে পেরেছি, দু’জনের ভালো সমঝোতা থাকার কারণেই। তবে মতের অমিল ছিলো আমাদের মধ্যে এমন ঘটনা খুব কম, আমাদের মতের মিল ছিলো বলেই সংগঠন শক্তিশালী হয়েছে।” ঋত্বিকের সাথে একমত পোষণ করেন শামীম। তিনি বলেন, “তাকে আমি পরিবারের ছোটভাইয়ের মতোই আদর করি। সে আমার সিদ্ধান্তগুলোকে শ্রদ্ধা করেছে আমিও তার সিদ্ধান্তগুলোকে অসম্মান করিনি।” নিজেদের বন্ধুত্বের ঘটনা বলার আগে একজন আরেকজনের প্রশংসাও করেন তারা। “ঋত্বিক খুব স্পষ্টভাষী। সে বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারে।” শামীমের মুখে এরকম কথা শুনার পর ঋত্বিক বলেন, “শামীম ভাই খুব দৃঢ়চেতা। নিজের মতামতকে শক্তভাবে লালন করেন তিনি।”
একগাল হেসে চা খেতে খেতে শুরু হয় মজার প্রশ্নোত্তর পর্ব।
প্রশ্ন: তোমাদের দুজনকে একটা দ্বীপে ফেলে আসা হলো। খাবার দাবার আছে, বাথরুম ফ্যসিলিটিও আছে। আর কি চাই?
শামীম: ইন্টারনেট সুবিধা থাকলে ভালো। মাঝে মাঝে সকলকে ফেইসবুকে আপডেট জানাতে পারবো। তাছাড়া ঋত্বিক যেহেতু আছে তার সাথে গল্পও করা যাবে। কিভাবে প্রেম করা যায় এরকম কিছু টিপস নেয়া যেত। হা হা হা।
ঋত্বিক: নির্জনতা আমার পছন্দ নয়, কোলাহলই বেশি ভালো লাগে। তবে একবার এমন পরিবেশে আমাকে পাঠিয়ে দিলে খুব একটা খারাপ লাগবে না। রাজনৈতিক সহকর্মী থাকলে তো আরো ভালো। তাছাড়া একটা নরম বিছানা, পড়ার চেয়ার- টেবিল এবং কিছু ভালো বই হলেতো কথাই নেই ।

প্রশ্ন: তোমাদের শত্রু পক্ষের দুটি ছেলে রামদা নিয়ে ছুটে আসছে। শুধুমাত্র তোমরা দুজন ভার্সিটির মেইনগেটে দাঁড়িয়ে আছো। কি করবা?
ঋত্বিক: ঋত্বিক রোশনের মতো না হতে পারি তবে আমরা ভিতু নই। (মাসল দেখিয়ে) আঘাত আসলে পাল্টা আঘাত হবে। রামদা, চাপাতি ইত্যাদিকে ভয় পাই না আমরা।
শামীম: সেটাই। আর যাই হোক একজন আরেকজনকে ছেড়ে পালাবো না। সিকৃবির ছাত্ররাজনীতি করি আমরা। বিশ্ববিদ্যালয় রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। মেইনগেটে আসার আগেই রামদাওয়ালা স্টুডিপদের থাপ্পর দিয়ে বিদায় করবো।
সারা বাংলাদেশে ছাত্রলীগের অনেক শাখা আছে। তাদের ভেতর অন্তর্কোন্দল ও দ্বন্দের খবর দুদিন পরপর পত্রিকায় পাতায় পাওয়া যায়। এই দুজন একই রাজনৈতিক দলের বড় পদধারী, আবার বন্ধুত্বও আছে; এর রহস্য কী? শামীম এবার আগ বাড়িয়ে উত্তর দেন,“ অনেক মাস ধরে কিন্তু বর্তমান কমিটি চলছে। কোনদিন কি শুনেছেন আমরা মারামারি করে হাসপাতালে ভর্তি আছি? পরষ্পরের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো বলেই আজও আমরা একতাবদ্ধ আছি। যা বাংলাদেশের আর কোন শাখায় পাবেন না। দূর থেকে হয়তো দেখা যায় দূরত্ব আছে। কিন্তু খুব কাছ থেকে আমাদের সাথে মিশলে দেখবেন সিকৃবি ছাত্রলীগের প্রতিটি নেতাকর্মী ভাই-বন্ধু। জয়বাংলা শ্লোগান সব বিভেদ ভুলিয়ে দেয়। একই পরিবারের দুভাইয়ের মধ্যে মাঝে মাঝে ভুল বোঝাবুঝি হতেই পারে। কিন্তু দিনশেষে আমরা সবাই এক আছি।” ঋত্বিক এ কথার সাথে একমত হয়ে যোগ করেন, “ভিতরে-বাইরে অনেকেই সিকৃবি ছাত্রলীগের ঐক্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমাদের দুজনের লক্ষ্য অভিন্ন, ঐক্য শক্তিশালী। চমৎকার বোঝাপড়ার কারণে বারবার বিপদের সামনে থেকে আমরা উঠে এসেছি।” এ প্রসঙ্গে ঋত্বিক একটি ঘটনা জানান, “একবার আমি মটরসাইকেল একসিডেন্ট করে আহত হলাম। শামীম ভাই দৌঁড়ে চলে আসলেন। এই যে একজনের প্রতি আরেকজনের যে অদৃশ্য টান, একেই তো বন্ধুত্ব বলে।”
বন্ধুত্ব বয়স মানে না। মানেনা কে কোন এলাকা থেকে আসলো। যেমন, শামীমের বাড়ি নরসিংদী, হৃত্বিকের বাড়ি সুনামগঞ্জ। মনের মিল থাকলে যে কারো সাথে বন্ধুত্ব হতে পারে বলে মনে করেন এই দুই ছাত্র রাজনীতিবিদ।

প্রফেসর জামাল-প্রফেসর নাজমুলঃ আস্থায় অবিচল বন্ধুত্ব

দুজন দুমেরুর লোক অথচ কী গভীর বন্ধুত্ব! পনের ষোল বছর ধরে এই সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছেন প্যারাসাইটোলজি বিভাগের প্রফেসর ডাঃ মোঃ জামাল উদ্দিন ভূঞা এবং কৌলিবিজ্ঞান ও প্রাণি প্রজনন বিভাগের প্রফেসর ড. মোঃ নাজমুল হক। শুরুর গল্পটা বেশ সাদামাটা হলেও শেষটা বেশ রঙিন। প্রাথমিক অবস্থায় দুতলা বাসায় মেস করে থাকতেন সিকৃবির শিক্ষকবৃন্দ। প্রফেসর জামাল উপরতলায়, প্রফেসর নাজমুল নিচতলায়। ক্লাস করিয়ে অবসর সময়ে তাশ খেলা হতো, আর হতো ব্যাডমিন্টন। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি কলেজে শিক্ষক থাকাকলীন সময়েই প্রফেসর জামালের বিয়ে হয়ে যায়। ২০০২ সালে মেস করে থাকা অবিবাহিত শিক্ষকদের মধ্যে প্রথম প্রফেসর নাজমুলের উইকেটের পতন হয়। বন্ধুবাৎসল ও সহকর্মীর গায়ে হলুদ জমকালো করে আয়োজন করেন প্রফেসর জামাল ও অন্যান্যরা। বন্ধু তোর বরাত নিয়ে তারা না গেলেও বিয়ের পর নতুন বউকে অভ্যর্থনা জানাতে প্রফেসর জামাল সোজা চলে যান রেলস্টেশনে। সেদিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে বেশ আবেগী হয়ে উঠেন প্রফেসর নাজমুল, “জামাল ভাই বন্ধুর চেয়েও বেশি এবং ভাইয়ের চেয়ে কোন অংশেই কম না। সিলেটে আসার পর আমার সব বিপদ আপদের সাথী তিনি। আমার যখন প্রথম বাচ্চাটা যখন হয়, হসিপাতাল থেকে কোলে করে ঘরে নিয়ে আসেন তিনি।” প্রফেসর জামাল এবার হাল ধরেন, “আমি চলে যেতাম ক্লাসে, আমার স্ত্রী ব্যাংকে চাকুরী করতেন। বড় ছেলে শিখন তখন খুব ছোট। আমাদের বাচ্চাটা নাজমুল সাহেবের ঘরে রেখে যেতাম। ভাবী আর ভাই নিজ সন্তানের মতো আমার ছেলেকে আদর করতেন।”
প্রফেসর জামাল ও প্রফেসর নাজমুল প্রায় একযুগ ধরে প্রতিবেশি। একসাথে বাগান করেন। অথচ কোনদিন তাদের মনোমালিন্য বা ভুল বোঝাবুঝি হয়নি। কোন কারণে কেউ উত্তেজিত হয়ে গেলে অন্যজন নিরব থাকেন। পারিবারিক যেকোন বড় সিদ্ধান্ত তারা একসাথে নেন। বড় বড় অর্থনৈতিক পরামর্শগুলো শেয়ার হয়। প্রফেসর জামাল বলেন, “এটা আসলে একটা অলিখিত সম্পর্ক। আমি আমার বাচ্চাকে কোন স্কুলে ভর্তি করাবো, তিনি তার পরিবারের কারো অসুখের সময় কোন হাসপাতালে চিকিৎসা নিবেন, এবারের ইদ-পরিকল্পনা কী- এরকম হাজারো পরামর্শ দুজনে মিলে নিয়েছি। কারণ আমাদের পরষ্পরের প্রতি আস্থা আছে”। প্রফেসর জামাল, সম্পর্ক উন্নতকরণে প্রফেসর নাজমুলের ভূমিকাই বেশি বলে মনে করেন। তাঁর মতে প্রফেসর নাজমুল বেশ ধৈর্য্যশীল। তিনি বিভিন্ন কারণে ব্যস্ত থাকলেও প্রফেসর নাজমুল সবসময় খোঁজখবর রাখেন। শোনা যায়, সেই পনের ষোল বছর থেকে বাসায় একটা ভাল খাবার রান্না হলে কেউ কাউকে না দিয়ে খান না তাঁরা।
প্রথম লাইনে আবার চলে আসি- দুজন দুমেরুর লোক অথচ কী গভীর বন্ধুত্ব! মূলত দুজনের রাজনৈতিক আদর্শ ভিন্ন। প্রফেসর ডাঃ মোঃ জামাল উদ্দিন ভূঞা আওয়ামী পন্থি শিক্ষকদের সংগঠন গণতান্ত্রিক শিক্ষক পরিষদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এবং প্রফেসর ড. মোঃ নাজমুল হক বিএনপিপন্থী সংগঠন সাদা দলের সদস্য। এ বিষয়ে প্রফেসর নাজমুল বলেন, “রাজনৈতিক আদর্শ ভিন্ন থাকতেই পারে। কিন্তু সবার আগে আমরা মানুষ। হানাহানি বা বর্বরতার যুগটি শেষ। এখন আমরা নিজেদের সভ্য বলে দাবী করি সুতরাং আমাদের আচরণও তেমনি হওয়া উচিত। পারষ্পারিক শ্রদ্ধাবোধ, মানবতাবোধ খুব জরুরী।”
কথা হয় সম্পর্কে তৃতীয় ব্যক্তি নিয়ে। ঘায়েল করতে একটু মজা করে প্রশ্ন করি, “ধরা যাক হঠাৎ আপনাদের বয়স ২৫ বছর কমে গেলো। এখনো অবিবাহিত। বিয়ের বয়স চলছে, কার বিয়ে আগে হবে?” প্রশ্ন শুনে দুজনই একগাল হাসেন । একটু সচেতন ভাবে উত্তর দিলেন প্রফেসর নাজমুল, “যিনি আগে প্রতিষ্ঠিত হবেন তিনিই আগে বিয়ে করবেন।” প্রফেসর জামাল অবশ্য আরো গুছিয়ে উত্তর দিলেন, “যে-ই আগে বিয়ে করুক আমাদের সম্পর্কে কোন সমস্যা হবে না। স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক আর বন্ধুত্ব, দুটো ভিন্ন সম্পর্ক। একটি আরেকটির সমস্যা করে না। এমনকি আমার স্ত্রী ও নাজমুল সাহেবের স্ত্রীও ভাল বন্ধু।” সম্পর্কে তৃতীয় ব্যক্তির প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রফেসর জামাল বলেন, “পারষ্পারিক আস্থা মজবুত হলে কারো সাধ্য নেই যে সম্পর্ক ভেঙে দিবে। তবে কোন কারণে যদি কোন সম্পর্ক ভেঙেও যায় তবে বুঝতে হবে দুজনের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি ছিলো।”
প্রফেসর জামাল আর প্রফেসর নাজমুলের মধ্যে আরো অনেক ভিন্নতা রয়েছে। শোনাযায় ময়মনসিংহস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল হাজবেন্ড্রি অনুষদের মধ্যে বেশ বৈরিতা বিদ্যমান। দুদিন পরপর মারামারি। অথচ ভেটেরিনারির লোক প্রফেসর জামাল ও এনিম্যাল হাজবেন্ড্রির লোক প্রফেসর নাজমুলের মধ্যে এ নিয়ে কোন শত্রুতা নেই। দুজনই খেলা পছন্দ করেন। তবে প্রফেসর জামাল দেশে আবাহনী এবং বিদেশে আর্জেন্টিনা ও বার্সেলোনা দলের সাপোর্টার, তাঁর প্রিয় খেলোয়াড় লিওনেল মেসি। অন্যদিকে প্রফেসর নাজমুল দেশে মোহামেডান এবং বিদেশে ব্রাজিল ও রিয়াল মাদ্রিদের সাপোর্টার, তাঁর প্রিয় খেলোয়াড় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। এতো অমিলেও দুজনের চমৎকার বন্ধুত্ব অনেকেরই ঈর্ষার কারণ। বেঁচে থাকুক বন্ধুত্ব।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.