নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

তোমরা মানুষ, আমরা মানুষ, তফাৎ শুধু শিরদাঁড়ায়

যাযাবর চিল

i agree to disagree...

যাযাবর চিল › বিস্তারিত পোস্টঃ

ক্রীতদাসের জবানবন্দী

০৮ ই অক্টোবর, ২০১৬ রাত ১০:০৩



আমার কথা আমি লিখব আগে কখনো ভাবিনি। ভেবেছিলাম অতীতকে মুছে ফেলে একজন জার্মান হিসেবে নতুন জীবন শুরু করবো। আমাদের হাজারো নিবেদিত মিশনারি মানুষ পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, সে সব দেশের মাটি ও মানুষের সাথে একাত্ন হয়ে গেছে। আমি তাদেরই একজন, যদিও একজন মিশনারির কোন দায়িত্বই আমি পালন করছি না। বরং নাম-পরিচয় পাল্টে আমি নিজের না থেকে অন্যের হয়ে গেছি। সিদ্ধান্তটা আমার ছিল সাময়িক। কিন্তু সে সাময়িক সিদ্ধান্তই পরে স্থায়ী হয়ে যায়। এর মাধ্যমে আমি আমার পিছুটান একেবারেই মুছে ফেলতে চেয়েছিলাম। আমার বিশ্বাস ও পরিচয়কে আমার ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে বাইরে আমি পুরোপুরি জার্মান হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ধীরে ধীরে আমার ভুল ভাঙতে শুরু করে। জীবনের একটা পর্যায়ে এসে পৌঁছলাম যখন আমার কাছে পরিস্কার হয়ে গেল যে, আমি বিরাট ভুলের মধ্যে রয়েছি। জার্মান দেশে বাস করলেই, জার্মান ভাষায় কথা বললেই জার্মান হওয়া যায় না। সরকার ও সরকারের আইন যাই বলুক, এখানকার সমাজের মূল স্রোতের যে চরিত্র কিংবা এই মূল স্রোত যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের নিয়ম-নীতি কখনো বদলায় না। এই নিয়ম-নীতি এখানে বহিরাগত আর দাস-বংশীয়দের কখনো জার্মান হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। তাতে বহিরাগতরা কোন কালেই জার্মান হয় না। তাদের বহিরাগত আর দাস-বংশীয় হবার অপবাদ বহন করেই চলতে হবে। এই চিন্তা করার পর আমি আমার নিজের কথা লেখার সিদ্ধান্ত নিলাম, যাতে আমার উত্তর পুরুষরা অন্তত একথা জানতে পারে যে, তারা ঐতিহ্যবাহী একটা জাতির অংশ। যারা ইউরোপকে সভ্যতা শিখিয়েছিল এবং যারা লন্ডন নগরী গড়ে ওঠার ৭শ’ বছর আগে গ্যাসবাতি ও পয়:প্রণালী সমৃদ্ধ নগর
সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল। দুর্ভাগ্য আমাদের অনৈক্যের অভিশাপেই বিশেষ করে আমাদের এই সভ্যতার পতন ঘটে। অন্ধকার ইউরোপের হিরক খণ্ড কর্ডোভা, গ্রনাডা, মালাডার মত শিক্ষা-সভ্যতা ও শক্তির কেন্দ্রগুলো নিজেই অন্ধকারে ডুবে যায়।
আমার নাম আবু ইউসুফ ইয়াকুব আল মানসুর। জন্ম আমার ১১৯৯ সালে। আমার জন্ম যে সময়, সে সময়টা গৌরবদীপ্ত মুসলিম সাম্রাজ্য স্পেনের পতন শুরুর কাল। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত, খণ্ড-বিখণ্ড স্পেনের একটা সালতানাতের রাজধানী, শিক্ষা-সভ্যতার জন্যে বিখ্যাত নগরী কর্ডোভায় আমার জন্ম। আমার জন্মের বছরই আল-মোহাইদ বাজবংশের খলিফা আবু ইউসুফ ইয়াকুব আল মানসুর ইন্তেকাল করেন। ঘনায়মান অন্ধকারের মধ্যে খলিফা আবু ইউসুফ ছিলেন ক্রমবর্ধমান ঔজ্জ্বল্যের এক প্রতীক। আমার আব্বা ছিলেন খলিফার দরবারের একজন কর্মকর্তা। খলিফার ইন্তেকালে শোকাহত আব্বা খলিফার নামানুসারে আমার নামকরণ করেন।
কর্ডোভার রাজকীয় স্কুলে আমার শিক্ষাজীবনের শুরু। আর আমার শিক্ষাজীবনের শেষ হয় কর্ডোভা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পঁচিশ বছর বয়সে। আমার শিক্ষাজীবনের গোটাটাই ছিল কৃতিত্বপূর্ণ। বরাবরের মত মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষাতেও আমি প্রথম স্থান অধিকার করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠীদের বিরাট অংশ ছিল ইউরোপের বিভিন্ন দেশের। গোটা ইউরোপে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় দূরে থাক, একটা মেডিকেল স্কুলও ছিল না। তখন ইউরোপে চিৎকিসাসহ সব ধরনের বিজ্ঞান চর্চা ছিল নিষিদ্ধ। কৃতিত্বের সাথে পাস করার পর মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অধ্যাপকের চাকরি পাকাপোক্ত হয়ে গেল। কর্ডোভার মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই শেষ পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিনটি যেমন ছিল আমার আনন্দের, তেমনি দিনটি ছিল বিষাদেরও। আমার রেজাল্ট নিয়ে বাসায় কি অপার আনন্দ হবে! আব্বা কি যে খুশি হবেন শীর্ষ কৃতিত্বসহ আমাকে ডাক্তার হতে দেখে! কিন্তু বাড়ির সীমানায় পা দিয়েই কান্নার রোলে আনন্দের শেষ রেশটুকুও আমার মন থেকে হারিয়ে গেল। আব্বাকে আর সুসংবাদ দেয়া হলো না, তাঁর ইন্তেকালের দু:সংবাদ নিয়ে আমি বাড়িতে প্রবেশ করলাম।
আমার পরিবারের যে দু:সময় তার চেয়ে বড় দু:সময় তখন চলছিল সুন্দর নগরী, শিক্ষার নগরী, সভ্যতার নগরী কর্ডোভার। ভয়ানক দু:সময় তখন গোটা মুসলিম স্পেনের। ১২২৭ সাথে আব্বা মারা যান। তখন একমাত্র গ্রানাডা ছাড়া কর্ডোভাসহ দক্ষিণ ও মধ্যস্পেনের বড় বড় শহরের কোনটিই আর মুসলমানদের অধিকারে ছিল না। কর্ডোভা তখন ছিল ক্যাস্টাই ও লিওনের খৃস্টান রাজার দখলে। এই অবস্থা অনেকের মত খলিফার দরবারের একজন কর্মকর্তা বাবাকেও দারুণভাবে আঘাত করেছিল। এই আঘাত ছিল বাবার মৃত্যুর অন্যতম কারণ। আমি পাস করার আগে থেকেই কর্ডোভার বিখ্যাত সরকারি হাসপাতালে ইন্টারনি ডাক্তার হিসেবে কাজ করছিলাম। নতুন খৃস্টান শাসক কর্ডোভা নগরীর বিখ্যাত ও নগরীর বিখ্যাত মসজিদের অনেক ক্ষতি করলেও নগরীর বিখ্যাত হাসপাতালে গায়ে তাদের স্বার্থেই হাত দেবার চেষ্টা তারা করেনি। হাসপাতাল থেকে তারা সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে, সেই কারণে হাসপাতালের কোন কার্যক্রমে তারা হস্তক্ষেপ করেনি। আমরা স্বাধীনভাবেই হাসপাতালের কাজ করেছি।
পাস করার পর ডাক্তার হিসেবে হাসপাতালে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেবার পর ১২২৮ সালে কর্ডোভার আঞ্চলিক এক মুসলিম সুলতান কর্ডোভাকে মুক্ত করেন। একটা আনন্দের প্রদীপ জ্বলে উঠল আমাদের মনে। কর্ডোভা-নগরী ও কর্ডোভা নগরীর কেন্দ্রবিন্দু কর্ডোভা মসজিদের ক্ষতস্থানগুলো সারিয়ে তোলার চেষ্টা চলল। আমাদের হাসপাতাল পূর্ণ প্রাণচাঞ্চল্য আবার ফিরে পেল।
কিন্তু ১০৩১ সালে শেষ উমাইয়া খলিফা তৃতীয় হিশাম চারদিকের ঘনায়মান অন্ধকারে ব্যর্থতার দায় নিয়ে নিখোঁজ হয়ে যাবার পর স্পেনে সীমাহীন বিরোধ-বিভক্তির যে যাত্রা শুরু হয়েছিল ইউসুফ ইবনে তাসফিনের আল-মুরাবাইদ বংশের শক্তিমান উত্থান তাকে রোধ করতে পারেনি, বরং ১১৩০ সালের দিকে আল-মোহাইদ বংশের উত্থান এই প্রচেষ্টার আরও ক্ষতিই করেছিল। পর্তুগাল, ইউরোপ ও উত্তর-স্পেন কেন্দ্রিক খৃস্টানদের সম্মিলিত উত্থানের মুখে ভেসে গিয়েছিল আল মোহাইদ, ইবনে হুদ ও নাসেরাইড ডাইনেস্টির মত শাসকরা।
কর্ডোভা আবার হাতছাড়া হলো। সেই কাস্টাইল বংশেরই রাজা তৃতীয় ফার্ডিন্যা্ন্ড তার বিশাল বাহিনী নিয়ে কর্ডোভা দখল করে নিল। এই দখলের হৃদয়হীন ঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিল কর্ডোভাকে। মুসলিম নামের ক্ষমতালিপ্সু, নির্লজ্জ শাসকদের বিভেদ-সংঘাতের কারণেই এই মহাবিপর্যয় ঘটেছিল। তবু তাদের বোধোদয় হয়নি। এদেরই একজন স্পেনে নাসেরাইড ডাইনেস্টির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আল হামার। কর্ডোভার পতনের পর কর্ডোভা বিজয়ী খৃস্টান রাজা ফার্ডিন্যান্ডকে মোহাম্মদ আল-হামার প্রস্তাব দিলেন যে, তিনি ফার্ডিন্যান্ডকে মুসলিম রাজ্য সেভিল জয়ে সাহায্য করবেন। বিনিময়ে ফার্ডিন্যান্ড মোহাম্মদ আল-হামারকে গ্রানাডার অনুগত স্বাধীন সুলতান হিসেবে মেনে নেবেন। এই চুক্তি অনুসারেই আল-হামার সেভিল জয়ে ফার্ডিন্যান্ডকে সাহায্য করেছিল। তারপর খৃস্টান রাজা ফার্ডিন্যান্ডের আনুগত্যের তকমা পরে আল-হামার গ্রানাডায় প্রবেশ করেছিল গ্রানাডার সুলতার হিসেবে। গ্রানাডায় প্রবেশের সময় বিবেকের দংশনে বিপর্যস্ত এই সুলতান স্লোগান তুলেছিল, ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোন বিজয়ী নেই’। ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোন বিজয়ী নেই’-এই কথাকে তিনি তাঁর রাষ্ট্রেরও মূল স্লোগান বানিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, বিখ্যাত আল-হামরা প্রাসাদের দেয়ালে আরবি ভাষার অপরূপ কারুকার্যময় লিপিতে শতবার শতভাবে এই কথা লিখে রাখেন। আমার ক্রীতদাস জীবনের শুরুতে আমি যখন উত্তর ফ্রান্সের এক দাস বাজারে, তখন আমি এই খবরটা শুনেছিলাম। এটা শোনার পর আমি অঝোর নয়নে কেঁদেছিলাম আল-হামরার মত মুসলিম শাসকদের চিন্তা ও কাজের বেদনাদায়ক বৈপরীত্য দেখে। কর্ডোভার ভাইদের প্রতি না তাকিয়ে, সেভিলের ভাইদের বুকে ছুরি মেরে তাদের উপর খৃস্টান রাজা ফার্ডিন্যান্ডকে বিজয়ী করে যিনি গ্রানাডাকে তার পুরস্কার হিসেবে নিয়েছেন, সেই সুলতার কি করে পারলেন এই স্লোগান তুলতে আর আল-হামরা প্রাসাদের গায়ে লিখতে যে, ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোন বিজয়ী নেই!’ দু’হাত তুলে সেদিন কেঁদে কেঁদে বলেছিলাম, এই সব শাসকের কথা ও কাজের এবং ঈমান ও আমলের এই বৈপরীত্যের মাশুল হিসেবে স্পেনের লক্ষ লক্ষ মুসলমান ধ্বংস হয়ে গেল, আমার মত হাজারো মানুষ ক্রীতদাসের শৃঙ্খল গলায় পরতে বাধ্য হলো। মা’বুদ আমার জীবদ্দশায় কর্ডোভা যদি মুক্ত হয়,
তাহলে আমাকে সেখানে যাবার সুযোগ দিও, যাতে গোয়াদেল কুইভারের ব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে আমি চিৎকার করে বলতে পারি, ‘আল্লাহ ছাড়া আর কেউ বিজয়ী নয়, এ কথা সত্য, কিন্তু যে শাসক নিজের স্বার্থে অন্যকে বিজয়ী করে, তাদের অধিকার নেই এই পবিত্র বাক্য উচ্চারণের। এরা এদের স্বার্থ হাসিলের জন্যে মুসলিম জনতাকে বিভ্রান্ত করছে। কিন্তু আমার ইচ্ছা পূরণ হয়নি। আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জানি কর্ডোভা মুক্ত হয়নি, বরং তার উপর রাতের অন্ধকার আরও গভীরতর হয়েছে।
কর্ডোভার পতন হওয়ার দুর্ভাগ্যের দিনটিও ছিল আমার জন্যে পরম সৌভাগ্যের। এদিন সকালেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে চিকিৎসা-বিজ্ঞানী হিসেবে অর্ধযুগের কাজের মূল্যায়নের স্বীকৃতি হিসেবে চিকিৎসা সেবায় সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসা-বিজ্ঞানীর পুরস্কার লাভ করি আমি। একটা স্বর্ণের মেডেল এবং তার সাথে পাই এক সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার হিসেবে। একই সাথে এই দিন বিশ্ববিদ্যালয়ও আমার শেষ পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার মেডেল দিয়ে দেয়। আমার পিতার মৃত্যু আমাকে এতটাই আপসেট করেছিল যে, মেডেলটি সংগ্রহ ও বাড়িতে নেয়ার ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু এদিন বিশ্ববিদ্যায়ের প্রক্টর আমার প্রিয় শিক্ষক বললেন, চারদিকের অবস্থা ভালো নয়। হাজারটা বিপদ শহরের উপকন্ঠে, মেডেলটা নিয়ে যাও। আমি সে মেডেলটা নিয়ে ব্যাগে পুরেছিলাম। তবে হাসপাতালে ফিরে দেখলাম একের পর এক আহত সৈনিক ও সাধারণ লোকদের নিয়ে আসা হচ্ছে হাসপাতালে। জানতে পারলাম ফার্ডিন্যান্ডের বাহিনী শহরে প্রবেশ করেছে। বিজয়ী হিসেবে তৃতীয় ফার্ডিন্যান্ডের কর্ডোভায় প্রবেশ এবার ধ্বংসের ঝড় নিয়ে এল। পালাতে পারেনি এমন কোন মুসলমান সেদিন এই ঝড়ের কবল থেকে বাঁচেনি। এই ঝড়ের কথা আমি আগে কল্পনাও করতে পারিনি। আমি একজন ডাক্তার হিসেবে সেদিন সারা দিন হাসপাতালেই ছিলাম। আহত খৃস্টান, মুসলমান সৈনিক ও সাধারণ মানুষ অবিরাম আসছিল হাসপাতালে। আমার যোগ্যতা ও শক্তির সবকিছু উজাড় করে তাদের বাঁচাবার চেষ্টা করেছি। আহার, বিশ্রাম সব কিছু ভুলে খৃস্টান, মুসলমান নির্বিশেষে সকলের সমান সেবা করেছি। আমার ধর্ম ইসলামে আহত মানুষের কোন জাত নেই। তারা মানুষ। মানুষ হিসেবেই তাদের সমান সেবা করতে হবে। আমি তাই করার চেষ্টা করেছি। একদিন একরাতের পর সেদিন ভোরে ফজরের নামাজের পর ঘুরে বসতেই মনে পড়ল বাড়ির কথা, একমাত্র সন্তান ও স্ত্রীর কথা। চমকে উঠলাম্। গত ২৪ ঘন্টা ওদের কথা মনে করিনি কেন? ওরা কেমন আছে? সঙ্গে সঙ্গে ক্লান্ত, অবসন্ন দেহ নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। রাজপথে রক্তের স্রোত মাড়িয়ে বাড়ি পৌঁছলাম। অল্প কিছু দূরে গোয়াদেল কুইভারের তীরেই আমার বাড়ি।
বাড়ির বাইরের প্রাঙ্গণে পৌঁছতেই দূর থেকে চোখে পড়ল আমার বাড়ির মূল গেট হা করে খোলা। আঁৎকে উঠলাম আমি। এমন তো হবার কথা নয়! এমন পরিস্থিতিতে বাড়ির গেটের দরজা খোলা থাকার প্রশ্নই আসে না। দৌড় দিলাম আমি। গেটে পৌঁছেই দেখলাম গেটের দরজা খোলা নয়, ভাঙা। এবার দেহের রক্তে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল। বুঝলাম কি ঘটেছে। বাড়ির ভেতরে পা বাড়াতে ভয় করছিল। কি দেখব সেখানে দিয়ে! কম্পিত পায়ে তবু এগোলাম। বৈঠকখানা ঘর খোলা, শূন্য। ভেতর বাড়িতে ঢুকলাম। সব ফাঁকা। পৌঁছলাম শোবার ঘরের সামনে। দরজা ভাঙা। আর এগোতে পারছিলাম না আমি। শরীরের সব শক্তি যেন নি:শেষ হয়ে গেছে। বুক কাঁপছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে মনটাকে শক্ত করে ঘরের ভেতরে পা বাড়ালাম। ঘরের ভেতরে চোখ পড়ল। আমার অজান্তেই বুক থেকে মুখ ভেদ করে একটা আর্তচিৎকার বের হয়ে এল। আমার তিন বছরের সন্তানের রক্তাক্ত দেহ মেঝেতে পড়ে আছে। তার মাথাটা গুঁড়ো হয়ে যাওয়া। দৃষ্টি ছুটে গেল পাশেই একটু দূরে। পড়ে আছে আমার স্ত্রীর দেহ। একবার তাকিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। এবার চিৎকারও বের হলো না মুখ থেকে। চিৎকারের ভাষা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। অবরুদ্ধ বোবা আবেগ দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে দিল হৃদয়টাকে। টলতে টলতে গিয়ে আমি বিছানা থেকে চাদর তুলে এনে ঢেকে দিলাম আমার স্ত্রীর দেহ। ধপ করে বসে পড়লাম স্ত্রীর চাদর-ঢাকা দেহের পাশে। আমার দৃষ্টি ঝাপসা। চারদিকের পৃথিবীটা আমার কাছে ছোট হয়ে গেছে। কতক্ষণ বসেছিলাম জানি না। ক্ষুধার্ত, অবসন্ন, বোবা হয়ে যাওয়া আমি তখন বোধ হয় তন্দ্রাচ্ছন্নও হয়ে পড়েছিলাম। অদ্ভুত একটা চিন্তা চলন্ত ছবির আকারে মাথায় এল। তা হয়তো স্বপ্ন ছিল। দু’টি লাশ কাপড়ে জড়িয়ে কাঁধে তুলে নিয়ে বাড়ির পাশের গোয়াদেল কুইভারের পানিতে নামিয়ে দিয়ে একটা পথ ধরে আমি এগিয়ে চলছি। পথটা নতুন। এর আগে কখনও দেখিনি। পথটা এগিয়ে আরও এগিয়ে দূর দিগন্তে আকাশের সাথে যেন মিশে গেছে।
তন্দ্র কেটে গেল আমার।
কিন্তু চিন্তাটা জীবন্ত দৃশ্যের মত সামনে রয়ে গেল আমার। ভাবলাম আমি, আমার প্রভুর নির্দেশ কি এটা আমার জন্যে! আমাকে কি কর্ডোভা ছাড়তে হবে? কোন নতুন পথ কি আমার জন্যে অপেক্ষা করছে? সে পথে একাই চলার ভাগ্য কি আমার?
দু’চোখ থেকে অশ্রুর ধারা নেমে এল আমার। একা বেঁচে থাকাটা আমার জন্যে দু:সহ। তার চেয়ে ভালো হতো যদি ফার্ডিন্যান্ডদের লোকদের সাথে লড়াই করে জীবন দিতে পারতাম। তাহলে সকলের সাথে আমি কর্ডোভায় থাকতে পারতাম। কিন্তু তন্দ্রায় দৃশ্যগুলো আমার জীবনের জন্যে এক অমোঘ নির্দেশ বলে মনে হলো।
চোখের পানি মুছে বিমোহিতের মত উঠে দাঁড়ালাম। দু’টো লাশকে বিছানার চাদরে জড়িয়ে কাঁধে তুলে নিলাম। আমার প্রিয় বাড়িটির জন্যে একটুও মায়া মনে জাগল না। আমার দাদার তৈরি বাড়িটা বাবার অতিপ্রিয় ছিল, আর আমারও জীবনের সাথে অচ্ছেদ্য বাঁধনে জড়িয়ে ছিল বাড়িটা। কিন্তু এখন বাড়িটা ছাড়তে আমার কিছুই মনে হলো না। আমার বাড়ির সামনেই গোয়াদেল কুইভার নদী। বাড়ির পরে একটা পায়ে চলার রাস্তা। তার পর একটা ঘাট ধাপে ধাপে নেমে গেছে গোয়াদেল কুইভারের পানিতে। হাঁটু পরিমাণ পানিতে নেমে কাঁধ থেকে লাশ দু’টো নামিয়ে আদরের সাথে আস্তে আস্তে নামিয়ে দিলাম গোয়াদেল কুইভারের বুকে। তার নীরব স্রোতধারা যেন পরম স্নেহেই গ্রহণ করল লাশ দু’টোকে। মুহূর্তেই গোয়াদেল লাশ দু’টোকে আড়াল করল আমার চোখ থেকে। কিছুক্ষণ ওদিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। চোখের পানি দৃষ্টিকে ঝাপসা করে দিল। ধীরে ধীরে উঠে এলাম সিঁড়ি বেয়ে উপরের রাস্তায়। মুহূর্ত মাত্র দাঁড়ালাম। তাকালাম বাড়ির দিকে। চিরপরিচিত বাড়ি। রাস্তার দিকে মুখ ফেরালাম। হাঁটতে শুরু করলাম। গোয়াদেল কুইভারের তীর বেয়ে পায়ে চলার পথ। এগিয়ে গেছে সামনে, এগিয়ে গেছে সীমাহীন সীমান্তের দিকে। এ যেন গোয়াদেল কুইভারের সেই পরিচিত রাস্তা নয়। সব মানুষের সামনে চলার এ যেন সনাতন পথ। সেই পথ আজ আমারও পথ। চলছি বিরামহীন, লক্ষ্যহীন।
এই পথ আমাকে নিয়ে এল স্পেন পেরিয়ে দক্ষিণ ফ্রান্সে। সময় পার হয়েছে তিন মাস। আমার পিঠের ব্যাগটি অনেক বড় হয়েছে। এক কাপড়ে বেরিয়েছিলাম। আরেক প্রস্থ কাপড়, জ্যাকেট ইত্যাদি কিনতে হয়েছে। ব্যাগের পকেটের সহস্র স্বর্ণ মুদ্রা ছিল আমার সম্বল। এই টাকা ভেঙেই বেঁচে থাকার চেষ্টা করে এসেছি আর পথ চলেছি। কোথায় যাব, পথের এই যাত্রা কোথায় থামাব, মন সে ব্যাপারে আমাকে কিছুই বলেনি।
দক্ষিণ ফ্রান্সের পথের ধারের পান্থশালায় আমি সেদিন ঘুমিয়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি সম্বলমাত্র ব্যাগটি আমার নেই। ব্যাগটি মাথার নিচে দিয়ে ঘুমিয়েছিলাম। কখন কে আমার মাথার তল থেকে ব্যাগটি নিয়ে গেছে জানি না। এবার প্রকৃতই আমি পথের মানুষ হয়ে দাঁড়ালাম। তবু খুশি হলাম এই ভেবে যে, আমার দু’টি মেডেল রক্ষা পেয়েছে। ও দু’টি আমি রেখেছিলাম আমার পাজামার কোমরে এক গোপন পকেটে।
খাওয়া-দাওয়া-নাওয়া কিছু নেই, পথ চলছিলাম। জনবসতি কম। মাঝে মাঝে পথের পাশে গুচ্ছ বাড়ি দেখা যাচ্ছে কিন্তু ভিক্ষুক হতে মন সায় দেয়নি। বেওয়ারিশ সব গাছের পরিচিত অপরিচিত ফল-মূল খেয়ে আমার সময় কাটছিল।
একদিন ক্ষুধা-কাতর অবসন্ন দেহে পথের পাশে একটা গাছে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিদ্রাচ্ছন্নের মত বসেছিলাম। একটা গাড়ি আমি যেদিক থেকে এসেছি সে দিক থেকে এগিয়ে আসছে শব্দ পাচ্ছিলাম। কিন্ত চোখ খোলার প্রবৃত্তি হয়নি। গাড়িটি আমার বরাবর এসে দাঁড়াল। আমাকে দেখেই দাঁড়িয়েছে। আমি শুনতে পাচ্ছিলাম একজন বলছিল, ‘দেখতে মুরদের মত লাগছে। নিশ্চয় মুরদের কোন পলাতক সৈনিক। বয়স দেখা যাচ্ছে চল্লিশ এখনও হয়নি। ধরে নাও। স্লেভ মার্কেটে মুররা এখন হট কেক।’ এর কথা শেষ হলে আরেকজন বলে উঠল, ঠিক বলেছ জ্যাকি। মুর সৈনিক তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমাদের এ চালানে কিন্তু এখনও একজন মুর জোটেনি। একে পেলেই তো এবারের চালান পূর্ণ হয়ে যায়। চল ধরে ফেলি। ফাঁদটা বের কর।’
মনে হলো ওরা কয়েকজন গাড়ি থেকে নামল। ওদের মতলব বুঝতে পারলাম। পালাতে পারতাম কি না জানি না, কিন্তু পালাবার প্রবৃ্ত্তি হলো না। আমার চিন্তা শেষ হতে পারল না। কি যেন এসে আমার শরীরের চারদিকে অস্পষ্ট মোটা শব্দ তুলে পড়ল। চোখ মেলে দেখলাম, চারদিক থেকে দড়ির জালে আমি আবদ্ধ। জাল ওরা গুটিয়ে নিচ্ছে। আমি শুনেছি বন্য পশুকে এভাবেই ধরে থাকে। এখন ওরা পশুর মত করেই মানুষ শিকার করছে।
আমার পরিণতি কি হতে যাচ্ছে তা ওদের কথা থেকেই বুঝতে পেরেছি। ওদের ক্রীতদাস বাণিজ্যের চালানে এখনও একজন লোক কম আছে। আমাকে দিয়েই তারা ঐ শূন্যস্থান পূরণ করতে চায়। সব বুঝেও আমার কিছু করার ছিল না। চেষ্টা করেও ওদের হাত থেকে, ওদের ফাঁদ থেকে পালাতে পারতাম না। আর আমি আগেই নিজেকে পথের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিয়েছি। পথ আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেটাই দেখার বিষয়।
বিরাট বড় ওদের গাড়ি। একটা কাভার্ড ভ্যান আরও চারটি কাভার্ড ভ্যানকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
এখানে-সেখানে থেমে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে গাড়ি বহরটি গিয়ে পৌঁছল দক্ষিণ জার্মানীর সীমান্ত শহর স্ট্রাসবার্গে। এখানেই বসে মধ্য ইউরোপের সবচেয়ে বড় দাস বাজার। অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড, জার্মানী, সুইডেন, ডেনমার্ক অঞ্চল থেকে এখানে খদ্দের আসে।
স্ট্রাসবার্গে গিয়ে বুঝতে পারলাম কতজনকে দাস মার্কেটে বিক্রির জন্যে আনা হয়েছে। আমরা সংখ্যায় ছিলাম একশ জন। একেক কাভার্ড ভ্যানে পঁচিশজন করে। পশুর মত গাদাগাদি করে আমাদের আনা হয়েছে।
দাস বাজারে স্লেভ ট্রেডারদের এক বা একাধিক খোয়াড় ধরনের জায়গা আছে। এগলোর ছাদ আছে এবং গোলাকার চারদিকটা লোহার শিকের বেড়া দিয়ে ঘেরা। খোঁয়াড়ে প্রত্যেকের জন্যে একটা করে বেড আছে। খোঁয়াড় থেকে একেকজন করে বেরিয়ে খাবার নিয়ে আসতে হয়। খোঁয়াড়েই ঘুরে বেড়াতে হয়। রাত ছাড়া শোয়ার হুকুম নেই। পূর্ণ রাত্রি ঘুম ও পর্যাপ্ত খাবার আমাদের দেয়া হয়। দাসদের স্বাস্থ্য ভালো হওয়া বেশি দাম পাওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয়। খাওয়ার জন্যে বাইরে বের করে আনা হয় এটা দেখানোর জন্যে যে, সে শান্ত-শিষ্ট ও অনুগত। ভালো দাম পাবার জন্যে দাসকে শান্ত-শিষ্ট ও খুব অনুগত প্রমাণ করতে হয় ক্রেতার কাছে। যতদিন খদ্দের না পাওয়া যায়, তখন দাস বাজারের খোঁয়াড়েই থাকতে হয়। শীতের সময় রাতের বেলা খোঁয়াড়কে টিন শিট দিয়ে ঘেরা হয় এবং বাইরে চারদিকে আগুন জ্বালিয়ে আবহাওয়া গরম রাখা হয়। আমার সংগীদের মধ্যে জনাদশেক ছাড়া সবাই আফ্রিকার খৃস্টান। অবশিষ্ট দশজনের সবাই মুসলিম। তাদের কাউকে আমি চিনি না। ওরা সবাই সৈনিক। বিভিন্ন অঞ্চল খেকে ওদের ধরে আনা হয়েছে। এদের সবাইকেই আমি মনের দিক দিয়ে ভেঙে পড়া অবস্থায় পেয়েছি। আমি ওদের সাহস দিয়েছি, আল্লাহর ওপর ভরসা করতে বলেছি। সুস্থ থাকা, শান্ত থাকা এবং যেহেতু এর বিকল্প নেই, তাই যা ঘটে তা মেনে নেয়ার মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে বলেছি। সবাইকে হারালেও, সবকিছু হারালেও আল্লাহকে না হারাবার জন্যে ওদের উপদেশ দিয়েছি। আল্লাহ রাজি থাকলে কষ্টের এ দুনিয়ার পর অনন্ত সুখের সম্ভাবনা থাকে। কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকাংশই সোহেলী অঞ্চলের। সোহেলী ভাষা আমি মোটামুটি জানি। কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে প্রায় ৩০ জনের মত মুসলমান পেয়েছি। আমাদের নামাজ পড়া দেখে তারাই এসে তাদের পরিচয় দিয়েছে। এটা ঘটেছে দাস বাজারের খোঁয়াড়ে আসার পর। আমি তাদের উপদেশ দেবার সুযোগ পেয়েছি। তারা সবাই আমার ভক্তে পরিণত হয়েছিল। এখানে উল্লেখ্য, আমাদের এই নামাজ রাতের বেলা গোপনে পড়তাম। আমাকে তারা মুর জানত, কিন্তু সরাসরি জানত না আমি মুসলমান। আমি ইচ্ছা করেই আমার লেখা-পড়া, পেশা ও আমার ধর্ম গোপন করেছি শুরু থেকেই। খোঁয়াড়ের সবার সাথেই একটা হৃদ্যতার সৃষ্টি হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম কে কোথায় বিক্রি হয় তা জানার ও গোপনে লিখে রাখার চেষ্ট করব, যাতে ভবিষ্যতে ওদের সাথে যোগাযোগের সুযোগ হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো আমাদের একশজনের লটের মধ্যে আমিই প্রথম বিক্রি হয়ে যাই।
কয়েক দিন থেকেই আমি দেখছিলাম দীর্ঘ দেহী ‘নাইট’দের ইউনিফরম পরা বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিত একজন ঘোড়সওয়ার দাস বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের খোঁয়াড়ে কয়েক বার ঘুরে গেছে।
সেদিন দুপুরে আমাদের স্টল থেকে আমি খাবার আনছিলাম। হঠাৎ আমি সেই ঘোড়সওয়ারের সামনে পড়ে গেলাম। ঘোড়সওয়ারও থমকে দাঁড়াল। আমাকে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে বলল, ‘তোমার নাম কি?’ আমি বলল, জোসেফ জ্যাকব আলগার।’
নামটি আমি আগেই ঠিক করে আমার মালিককে বলে দিয়েছিলাম। নামটি আমার মূল নাম ‘ইউসুফ ইয়াকুব আল মানসুর’-এর খৃস্টীয়করণ। উভয় নামের অর্থ একই। ঘোড়সওয়ার লোকটি একটু ভ্রুকুঁচকে বলল, ‘দাসদের সবার নামই সংক্ষিপ্ত। তোমার এত বড় নাম? এ নামের অর্থ কি জান?’
আমি বললাম, ‘উত্তম যোদ্ধা জোসেফ জ্যাকব।’
গম্ভীর কন্ঠে বলল ঘোড়সওয়ার, ‘তুমি কি যোদ্ধা? যুদ্ধ করেছ?’
আমি বললাম, ‘যোদ্ধাও নই, যুদ্ধও করিনি। তবে যাদের নামে আমার নাম তারা সবাই এক ধরনের যোদ্ধা ছিলেন।’
‘কি ধরনের যোদ্ধা ছিলেন?’ বলল ঘোড়সওয়ার। সেই গম্ভীর কন্ঠেই।
‘শুনেছি তাঁরা মানুষ পরিবর্তনের যোদ্ধা ছিলেন।’ বললাম আমি। এবার আরও একবার ভ্রূকুঁচকে গেল ঘোড়সওয়ারের। বলল, ‘কোথায় শুনেছ তুমি?’
উত্তর আগেই চিন্তা করে রেখেছিলাম। বলল, ‘গির্জার সামনে শুনেছি।’
ঘোড়সওয়ারের চেহারায় প্রসন্নতা দেখা দিল। বলল, ‘তুমি গির্জায় যাও?’
‘যেতাম।’ আমি বললাম।
‘তুমি লেখাপড়া জান?’ জিজ্ঞেস করল ঘোড়সওয়ার।
‘কোন রকমে লেখা ও পড়ার মত অক্ষরজ্ঞান আমার আছে।’ বললাম আমি।
‘তুমি জার্মান ভাষার নাম শুনেছ?’ জিজ্ঞেস করল ঘোড়সওয়ার।
‘শুনেছি। কিছু বলতে ও বুঝতে পারি।’ আমি বললাম।
এবার বিস্ময় ঘোড়সওয়ারের চোখে-মুখে। বলল, ‘কেমন করে জান, কোথায় শিখেছ?’
‘আমার একজন জার্মান প্রতিবেশী ছিলেন। তার কাছ থেকেই দিনে দিনে কিছুটা শেখা হয়ে গেছে।’ বললাম আমি।
‘তোমাকে কোথেকে ধরেছে?’ জিজ্ঞেস করল ঘোড়সওয়ার।
‘পশ্চিম স্পেনের যুদ্ধ সংলগ্ন এক গ্রাম থেকে প্রতিপক্ষ যুদ্ধবন্দী হিসেবে ধরে নিয়ে যায় এবং বর্তমান মালিকের কাছে বিক্রী করে।’ আমি বললাম। এটাই মালিক বলতে বলেছিল।দক্ষিন ফ্রান্সের শান্ত এলাকা থেকে এরা আমাকে ধরেছে, এ কথা না বলতে শাসিয়ে দিয়েছিল মালিক। আমি সেটাই বললাম।
‘দাস হিসেবে বিক্রি হয়ে আমার খারাপ লাগেনি?’ জিজ্ঞেস করল মালিক।
‘এটাই মনে হয় আমার ভাগ্য।’ বললাম আমি।
‘এই ভাগ্যকে তুমি মেনে নিয়েছ?’ বলল ঘোড়সওয়ার।
‘ভাগ্য তো ভাগ্যই। একে মেনে নেয়া, না নেয়ার কোন অবকাশ নেই।’ আমি বললাম।
‘তুমি খুব বুদ্ধিমান। আমি খুশি হয়েছি।’ বলল ঘোড়সওয়ার।
‘ধন্যবাদ।’ বলে আমি চলে এলাম আমার খোঁয়াড়ে। আমার খাওয়া শেষ করে আমি হাত-মুখ পরিস্কার করতে গিয়ে দেখলাম, সেই ঘোড়সওয়ার ও আমার মালিক কথা বলছে। আমি হাত-মুখ ধুয়ে ফিরে এলাম।
আমি ফিরে আসার পরপরই ফিরে এল আমার মালিক। হাসিমুখে আমার কাছে এসে বলল, ‘আমার সৌভাগ্য, তোমারও সৌভাগ্য। ক্রুসেড ফেরত একজন বিখ্যাত নাইট তোমাকে কিনে নিয়েছে। সে একজন বীর ও জ্ঞানী মানুষ। এটা তোমার সৌভাগ্য। আর আমার সৌভাগ্য হলো যে রেট চলছে, তার দ্বিগুণ দাম সে আমাকে দিয়েছে। তুমি রেডি হও। সে আধা ঘন্টার মধ্যে এসে তোমাকে নিয়ে যাবে।
মনটা আমার খারাপ হয়ে গেল। আমার সাথী খোঁয়াড়ের সবাইকে আমি ভাইয়ের মত ভালোবেসে ফেলেছিলাম, বিশেষ করে মুসলিম ভাইদেরকে। আমার চলে যাওয়া মানে চিরতরে ওদের আমি হারিয়ে ফেলব।
মনটা আমার কেঁদে উঠলেও করার কিছু ছিল না। আধা ঘন্টার মধ্যেই ঘোড়সওয়ার আমার খোঁয়াড়ে গিয়ে হাজির হলেন একটা ঘোড়ায় টানা জার্মান গাড়ি নিয়ে। তার সাথে আরেকজন চব্বিশ-পঁচিশ বছরের যুবক।
মালিক স্বয়ং খোঁয়াড়ের মুখে ছিল। আমি বের হয়ে এলাম খোঁয়াড় থেকে। বের হবার সময় হাত দিয়ে একবার দেখলাম নতুন পাতলুনের পকেটে আমার সেই দু’টো মেডেল আছে কি না। নিশ্চিত হয়ে সামনে এগোলাম।
ঘোড়সওয়ার আমাকে স্বাগত জানাল। সাথের যুবকটিকে দেখিয়ে বলল, ‘এ হলো বেনেডিক্ট, আমার সেক্রেটারি। আর আমি ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক। রাইনের একজন নাইট। এখন রাইন ছেড়ে সালজওয়াডেলে চলে গেছি। তুমি সেখানেই যাবে। গাড়ির পেছনে উঠে বস।’
বলে ঘোড়সওয়ার নাইট ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক গিয়ে বসল ড্রাইভিং সিটে। তার পাশে বসল তার সেক্রেটারি বেনেডিক্ট।
গাড়ি চলতে শুরু করল।
আমি বললাম, ‘ঘোড়াটার কি হবে? ঘোড়া কে নিয়ে যাবে?’
‘ধন্যবাদ আলগার, তুমি ঘোড়াটার কথা মনে করেছ। ঘোড়াটা আমার ভাড়া করা ছিল। নাইটরা ঘোড়ায় চড়তেই বেশি গৌরব বোধ করে, ঘোড়ায় টানা গাড়িতে নয়। এখানে এসে ভাড়া করেছিলাম ঘোড়াটা।’ বলল নাইট ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক।’’
“তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় সালজওয়াডেলে পৌঁছলাম। মাঝখানে দু’রাত আমরা বিশ্রাম নিয়েছি দুই হোটেল বা পান্থশালায়। সব জায়গায় দেখেছি নাইট ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিকের ভীষণ খাতির। সবাইকে বলাবলি করতে শুনেছি, ইস্তাম্বুল অভিমুখের ষষ্ঠ ক্রুসেড পরিচালনায় তিনি বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার লোক হিসেবে আমরাও কম খাতির পাইনি।
সালজওয়াডেল নদীর ধারে বিশাল দুর্গসদৃশ বাড়ি নাইট ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিকের। পরে শুনেছি নাইট ফ্রেডারিক যখন রাইনের দুর্গ ছেড়ে সালজওয়াডেল চলে আসেন, তখন কিং চতুর্থ অটো তাকে স্বাগত জানিয়ে এই বাড়ি দান করেন এবং নদীর উপর পাহারাদারীর দায়িত্ব দেন।
বাড়িতে পৌঁছে আমার নতুন মালিক নাইট ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক তার সেক্রেটারি বেনেডিক্টকে বলল, আলগারকে আপতত বিশ্রামের একটা জায়গা দেখিয়ে দিয়ে নাস্তা করাও। তারপর তাকে সেলুনে নিয়ে গিয়ে চুল কাটাও।
দাসদের চুলকাটা মানে মাথা, মুখ সবকিছুকে নগ্ন করা। জীবনে এই প্রথম দাড়ি,গোঁফ ও চুল কেটে নেড়ে হলাম।
চুল কাটার পর মালিকের সেক্রেটারি বেনেডিক্ট আমাকে জানাল, ‘আগামীকাল সকালে তোমাকে নাইট ফ্রেডারিকের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। তাঁর সাথে পরিবারের অন্য কেউ থাকতে পারেন। সেই দেখা করার পর ঠিক হবে কোন কাজ তোমাকে দেয়া হবে।’ বুঝলাম সাক্ষাৎকারটা আসলে একটা ইন্টারভিউয়ের মত। মানে যে দাসকে কেনা হলো তাকে দিয়ে কোন কাজটা করানো হবে।
পরদিন নাস্তার পর আমাকে মালিকের সামনে হাজির করা হলো। মালিকের দুর্গসদৃশ বাড়ির প্রধান গেট দিয়ে ঢুকে বিরাট লন। লনের শেষ প্রান্তে বিরাট সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। বাড়িটা সত্যিই দুর্গের মত দশ বারো তলার সমান উঁচু। দোতলায় সিঁড়ির মুখে একপাশে একটা টেবিলের ওপাশে একটা চেয়ারে বসেছেন আমার নতুন মালিক। তার বামপাশে তার প্রায় সমবয়স্ক এক মহিলা, নিশ্চয় তার স্ত্রী হবেন। মহিলার পাশে পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের আরেকজন যুবতী, তার পাশে আট দশ বছরের একটি শিশু। তাদের পরিচয় ঠিক বুঝলাম না, তবে মনে হলো মেয়েটি মালিকের মেয়ে এবং শিশুটি মালিকের নাতি হলে মানায়। সবাইকে দেখলম প্রসন্ন, কিন্তু ডাক্তারের চোখ দিয়ে বুঝলাম, যুবতী মহিলাটি মানসিকভাবে ডিপ্রেসড। অন্য সবার মধ্যে একটা জীবন্ত আগ্রহ দেখলাম, শুধু সে ছাড়া।
তাদের টী টেবিল থেকে দশ ফুট দূরে হাতজোড় করে আমাকে দাঁড়াতে হলো। মনে কষ্ট লাগল এভাবে দাঁড়াতে, কিন্তু বেনেডিক্টের নির্দেশে এভাবে দাঁড়াতে হলো। আল্লাহ ছাড়া কারও কাছে কখনও হাতজোড় করিনি। কিন্তু আজ মানুষ মনিবের কাছে তা করতে হলো। আমার সামনে ছিল উঁচু ক্ষুদ্র একটা ডেস্ক। ডেস্কের উপরে ছিল এক শিট কাগজ ও একটা কলম।
আমি দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে আমার নতুন মালিক নাইট মি. ফ্রেডারিক বলে উঠলেন, ডেস্কের উপরের কাগজটায় তুমি তোমার নাম, দেশের নাম, অঞ্চলের নাম, স্ত্রী-সন্তান আছে কি নেই, তোমার ভাষা, তোমার জানা অন্য ভাষা, তোমার অতীত পেশা, কোন ক্রাইম তোমার দ্বারা হয়ে থাকলে তা লেখ। এসব বিষয় স্লেভ ট্রেডারের হুকুমেও লিখতে হয়েছিল, সে যেমন বলেছিল সেইভাবে। তার পুনরাবৃত্তি আমি লিখে ফেললাম। স্ত্রী-সন্তান নিহত হয়েছে লিখলাম আর পেশা আগের মতই কারখানায় চাকরি লিখলাম। আমার লেখা শেষ হলে পাশে দাঁড়ানো বেনেডিক্ট কাগজ কলম নিয়ে আমার দুই হাত এবং হাতের আঙুলগুলো পরীক্ষা করল। তারপর কাগজে কিছু লিখল এবং কাগজ কলমটি রেখে এল মালিকের টেবিলে। মালিক কাগজটি হাতে তুলে নিয়ে নজর বুলিয়ে স্ত্রীর হাতে দিল। তার স্ত্রী তা দেখে তার পাশের মেয়েটির হাতে দিল। মেয়েটি দেখে নিয়ে কাগজটি তার বাবার হাতে ফেরত দিল।
ফেরত পাওয়া কাগজটি হাতে নিয়ে মালিক একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। বলল, ‘ফ্যাক্টরিতে তুমি কি কাজ করেছ?’
মিথ্যাটা আগেই সাজিয়ে রেখেছিলাম। বললাম, ‘প্যাকিং-এর কাজ করেছি।’
আবার অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল মালিক আমার দিকে। বলল, ‘দেখ, আমি একজন মুসলিম ক্রীতদাস কিনতে চেয়েছিলাম। ইচ্ছা ছিল, একজন মুসলিমকে ক্রীতদাস বানিয়ে আমি প্রতিশোধ নেব। ক্রুসেডে আমি যা পারিনি এভাবে আমি তারই কিছুটা পূরণ করতে চেয়েছিলাম। আমি চতুর্থ ক্রুসেডে যোগদানকারী জার্মানের একজন শ্রেষ্ঠ নাইট। পোপ তৃতীয় ইননোসেন্টের অধীনে পশ্চিম ইউরোপের সাথে আমরা জার্মানরাও সে ক্রুসেডে যোগ দিয়েছিলাম। লক্ষ্য ছিল, মুসলমানদের হাত থেকে জেরুসালেমকে আবার উদ্ধার করা। প্রথম ক্রুসেডে আমাদের পূর্বসূরিরা মুসলমানদের হাত থেকে জেরুসালেম কেড়ে নিয়েছিলেন।
জেরুসালেম শহরের সত্তর হাজার মুসলমানকে যুদ্ধোত্তর অপারেশনে হত্যা করে আমরা চেয়েছিলাম জেরুসালেমকে আমাদের হাতেই রাখব। কিন্তু তা হয়নি। সালাহউদ্দিন আইয়ুবী যাকে মুসলমানরা গাজী সালা্হউদ্দিন বলে, জেরুসালেম আমাদের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে। ইউরোপের দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ক্রসেড পারেনি জেরুসালেমকে মুসলমানদের হাত থেকে কেড়ে নিতে। এই জেরুসালেম উদ্ধারই ছিল আমাদের চতুর্থ ক্রসেডের লক্ষ্য। কিন্তু আমাদের এই লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। হয়নি ঘরের শত্রু বিভীষণকে বধ করতে গিয়ে। পোপের অধীন ক্যাথলিক চার্চ বিশেষ করে আমাদের জার্মানদের ঘোরতর শত্রু ছিল বাইজান্টাইন অরথোডক্স চার্চ। ওরা রোমান ক্যাথলিকদের আইন-নীতি ভংগকারী, অধর্মচারী, লোভী, রক্তপায়ী, বিশৃঙ্খল বর্বর, নোংরা ইত্যাদি ধরনের গালাগালি করতো। কনস্টান্টিনোপলকে কেন্দ্র করে এই বাইজেন্টাইনরা ক্যাথলিক পোপ ও জার্মানীর তারা প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই ক্রসেড যাত্রার পর আমরা গতি পরিবর্তন করে জেরুসালেম জয়ের পরিবর্তে কনস্টান্টিনোপল জয়ের যাত্রা শুরু করেছিলাম। এই যাত্রা আমাদের সফল হয়েছিল। আমরা কনস্টান্টিনোপল জয় এবং তারপর তা বিধ্বস্ত করেছিলাম। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে বা্ইজেন্টাইন অর্থোডস্ক চার্চের সমাধি রচিত হলো বটে, কিন্তু মুসলমানদের গায়ে আমরা হাত দিতে পারলাম না। এই দু:খ আমাকে পুড়িয়ে মারছে। তাই চেয়েছিলাম একজন মুসলিম ক্রীতদাস এনে তার উপর মনের ঝাল মিটিয়ে দু:খ কিছু লাঘব করবো। তাও হলো না। তোমার সাথে কথা বলে তোমাকে আমার খুব পছন্দ হলো, তাই তোমাকে নিয়ে এলাম। সেই তুমি যাত্রা শুরু করলে মিথ্যা কথা বলে। তুমি ফ্যাক্টরিতে কাজ করনি। তোমার হাতের সবটুকু নরম হওয়া তারই প্রমাণ। আর তোমার কলমের আঁচড় প্রমাণ করে তুমি ভালো লেখায় অভ্যস্ত। ইচ্ছা করেই খারাপ করে লিখেছ। এই দুই মিথ্যার পর তোমার দেয়া তোমার পরিচয়ের উপরও এখন আমার আস্থা নেই। সুতরাং তুমি ভালো আচরণ পাওয়ার উপযুক্ত নও। তুমি আমার ফার্মল্যান্ডে কাজ করবে। ফার্মল্যান্ডের কঠোর পরিবেশ এবং কাজই মিথ্যাবাদীর জন্যে উপযুক্ত জায়গা।’
কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়াল আমার নতুন মনিব। তাঁর সাথের সবাই উঠল। আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো ফার্ম হাউজে। আমার মালিক ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিকের বাড়ির বিশাল এরিয়ার সীমা থেকেই তার ফার্মল্যান্ডের শুরু। সেখান থেকে প্রায় এক মাইল দূরে ফার্মল্যান্ডের মাঝখানে ফার্মহাউজ। এই ফার্মহাউজ থেকেই বিশাল ফার্মল্যান্ড পরিচালনা করা হয়।
হাসপাতালের একজন কৃতী ডাক্তার ছিলাম তা ভুলে গেলাম। ফার্মের শ্রমিক হিসেবে নতুন জীবন শুরু হলো। শ্রমিকরা বেতন পায়, কিন্তু ক্রীতদাসরা বাঁচার জন্যে শুধুই খাবার পায়। তাদের কাজের কোন সময়সীমা নেই। ক্রীতদাসদের সেই ভোরে কাজের শুরু হয়, আর ঘুমানো পর্যন্ত কাজ চলে। এভাবেই জীবন চলল।
একদিন মালিক-পরিবারের সবাইকে নিয়ে বেড়াতে এলেন ফার্মে। ফার্মটা দেখা ও তত্ত্বাবধান করার পর তারা ফার্মহাউজে এলেন। ফার্মহাউজে গোডাউন ছাড়াও রয়েছে শ্রমিক কর্মচারি ও দাসদের আবাস। এই সাথে ফার্মহাউজে রয়েছে দোতলা সুরম্য ভবন। ফার্মল্যান্ডে এলে মালিকরা এখানে থাকেন।
সেদিন বেলা পাঁচটায় মালিকরা এলেন সেই ভবনে। সেদিন সন্ধ্যার পর সে ভবনের দোতলায় প্রচণ্ড কান্নাকটি হৈ চৈ শুনতে পেলাম। সারাদিন পর আবাসস্থলে সবে এসে বসেছি। কান্না হৈ চৈ শুনে সবাই সেদিকে ছুটল। কৌতুহলের বলে আমিও সেদিকে গেলাম।
ফার্মহাউজের মাঝের এই বাড়িটি আসলে বাড়ির মধ্যে আর একটা বাড়ি। একট গেট পেরিয়ে প্রাচীর ঘেরা এই বাড়িতে ঢুকতে হয়। আমরা গেটের বাইরে একটা দূরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাদের লোকদের বলাবলিতে জানলাম, মালিকের মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। গতকাল বিকেলে হামবুর্গের রাজকীয় চিকিৎসালয়ে মাসখানেক চিকিৎসা নিয়ে ফিরেছে সে। আজই আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ভীষণ মাথাব্যথা। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। আগেই শুনেছিলাম, মালিকের এই মেয়ে ক্যাথারিনার স্বামী একজন নাইট, ১২২৮ সালে শুরু হওয়া ষষ্ঠ ক্রুসেডে যোগ দিয়ে তিনি নিহত হয়েছেন। এই সময় ঘোড়ার গাড়িতে একজন ডাক্তার আসতে দেখলাম। ডাক্তার ভেতরে চলে গেল। আমি চলে এলাম। আধাঘন্টার মত পার হয়ে গেল। আমি ফার্মহাউজের পাশে ফার্মের গরুগুলো সামলা্চ্ছিলাম। আবার হৈ চৈ কানে এল, দৌড়াদৌড়ি দেখতে পেলাম। সেই সাথে মালিকের উচ্চকন্ঠ। কৌতুহলবশেই আমরা ছুটে গেলাম সেই বাড়ির দিকে। শুনলাম, ডাক্তার অপারগতা প্রকাশ করে চলে গেছেন। বলে গেছেন, রাজকীয় চিকিৎসালয়ের ডাক্তার যে ওষুধ দিয়েছেন, তার বাইরে কোন ওষুধ নেই। সেই ওষুধে যখন কাজ করেনি, তখন আর করার কিছু নেই। রাজকীয় চিকিৎসালয়ের ডাক্তারের দেয়া ওষুধ খেতে হবে এবং ঈশ্বরকে ডাকতে হবে।
মালিক এ সময় বাইরে বেরিয়ে আসছিলেন। বিপর্যস্ত তার চেহারা। বেদনায় নীল তার চোখ মুখ। একমাত্র সন্তান মেয়েকে খুব ভালোবাসেন তিনি। মালিক গেটে এসে গেটের পাশে দাঁড়ানো তার সেক্রেটারিকে বললেন, তুমি গাড়ি তৈরি করতে বল। ক্যাথরিনাকে আবার রাজকীয় চিকিৎসালয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমার ভেতরে কি যেন হয়ে গেল। ডাক্তার ইউসুফ ইয়াকুব আল মানসুর আমার মধ্যে যেন তীব্রভাবে জেগে উঠল। হঠাৎ কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে মালিকের সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘মালিক, রোগটা কি আমি দেখতে পারি?’
মালিক বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত আমার দিকে ঘুরল। তার চোখ-মুখ অপমানে কালো হয়ে গেছে। দু’চোখ দিয়ে তার আগুন ঝরছে। তীব্রকন্ঠে বলে উঠল, ‘এতবড় স্পর্ধা..!’
কিন্তু হঠাৎ করেই তার কন্ঠ থেমে গেল। তার চোখ-মুখ সহজ হয়ে এল। নিভে গেল চোখের আগুন। মাথা নিচু করল। পরক্ষণেই মাথা তুলে বলল, আমার অন্য কোন শ্রমিক-কর্মচারি-ক্রীতদাস এমন কথা বললে তার আমি শিরচ্ছেদ করতাম। কিন্তু আমি দেখে আসছি তুমি সবার চেয়ে ভিন্ন। তুমি মিথ্যা কথা বল না, কাজে ফাঁকি দাও না, খাবার যা পাও, তার বেশি কোন দাবিও তোমার নেই। সবাইকে আমি চিনি, কিন্তু তোমাকে চিনতে পারিনি। তাই তুমি বেঁচে গেলে। কিন্তু বল, কেন তুমি এই কথা বললে? নিশ্চয় জান রাজকীয় চিকিৎসকের চিকিৎসাও ব্যর্থ হয়েছে।’
‘মালিক, কোন দুই ব্যক্তির বুদ্ধি, চিন্তা, দৃষ্টিকোণ সমান নয়। আর যে ঈশ্বর রোগ দিয়েছেন, তিনি তার ওষুধও দিয়েছেন।’ বললাম আমি।
মালিক কিছুক্ষণ আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলেন। তিনি কি যেন আমার মধ্যে খুঁজে পেলেন। তারপর বললেন, ‘এস।’ বলেই তিনি চলতে শুরু করলেন। আমিও তার পিছু পিছু চললাম। উঠলাম দোতলায়। তাঁর এই দোতলায় ওঠা তাঁর পরিবারের বাইরের কারো জন্যে এটাই বোধ হয় প্রথম।
দোতলার একটা ঘরে তিনি ঢুকলেন। মিনিট খানেক পরে বেরিয়ে এসে আমাকে ডাকলেন। ঢুকলাম সেই ঘরে বিরাট সুসজ্জিত ঘর। দেখে কোন শাহবেগম বা শাহজাদীর ঘর বলে মনে হলো। ভাবলাম ফার্মহাউজের ঘর যদি এমন হয়, তাহলে আসল বাড়ির ঘরটা কেমন? বিধবা মেয়েকে মালিক কত ভালোবাসেন, এটা বোধ হয় তারই প্রমাণ।
মালিকের মেয়ের গোটা শরীর চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। বালিশে মুখ গুঁজে সে চিৎকার করছে, ছটফট করছে। তার মাথার পাশে বসে আছেন মালিকের স্ত্রী। তিনি যখন আমার দিকে তাকালেন, মনে হলো ডুবন্ত মানুষের মত কোন সহায় যেন তিনি হাতড়াচ্ছেন। তিনি মেয়ের মাথার যে পাশে বসে আছেন, তার বিপরীত দিকে মালিকের মেয়ে ক্যাথারিনার মাথার পাশে গিয়ে আমি দাঁড়ালাম।
মেয়েটিকে মাথাগুঁজে ছটফট করতে দেখে আমি আশান্বিত হয়েছিলাম। যে সন্দেহটা আমার মনে উঁকি দিয়েছিল সেই সন্দেহটাই তাহলে ঠিক?
আমি মালিকের দিকে তাকালাম। বললাম, ‘মালিক ওকে চিৎ হয়ে শোয়াতে হবে।’
সঙ্গে সঙ্গেই মালিকের স্ত্রী তার মেয়েকে বলল মা একটু চিৎ হয়ে শুতে হবে।’ বলে নিজে তাকে চিৎ হতে সাহায্য করতে গেল।
মেয়ে ক্যাথারিনা চিৎকার করে বলল, ‘আমি আর ওষুধ খেতে পারবো না। আমার মাথার সাথে এখন পেটও জ্বলতে শুরু করেছে। আমি মরে যেতে চাই, আমাকে মরতে দাও।’
মালিক গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তাঁর স্ত্রীর পাশেই। সে এগিয়ে গেল। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, মা আমার, সোনা মা, আমরাও যে কষ্ট পাচ্ছি। একটু ঘুরে শোও। ঈশ্বরের প্রতি ভরসা রাখ মা।’
‘কত ভরসা রাখবো বাবা, যতই দিন যাচ্ছে, অসহ্য হয়ে উঠছে যন্ত্রণা। রাজবৈদ্যও তো চেষ্টার কম করলেন না। এই রোগে আমার মৃত্যুই বোধ হয় ঈশ্বরের ইচ্ছ। তার ইচ্ছাই পূরণ হোক। আমি মরতে চাই।’ বলল মালিকের মেয়ে ক্যাথারিনা। বলে বালিশে আবারও বেশি করে মুখ গুঁজল।
হঠাৎ করেই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, ‘মানুষ মরণশীল। সুস্থ ও অসুস্থ দুই অবস্থাতেই মানুষ মরতে পারে। মৃত্যুর জন্যে অসুস্থতা জিইয়ে রাখার প্রয়োজন হয় না। আর ঈশ্বরের বিধান হলো, রোগ হলে চিকিৎসা করাতেই হবে।’
এক ঝটকায় মেয়েটি ঘুরে উঠে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। তীব্র কন্ঠে বলল, ‘মৃত্যুর জন্যেই কি আমি অসুস্থতা জিইয়ে রাখছি?’ আমি একটা ছোট্ট বাউ করে বললাম, ‘স্যরি ম্যাডাম। আমি তা বলিনি, আমি একটা নীতিকথা বলেছি।’
সেই তীব্র কন্ঠেই মেয়েটি বলল, ‘রাজবৈদ্য যেখানে ব্যর্থ, এই মাত্র একজন বিখ্যাত ডাক্তারও যেখানে আর কিছু করণীয় নেই বলে চলে গেল, সেখানে একজন ক্রীতদাস চিকিৎসা করতে আসা একটা স্পর্ধা নয় কি!’
‘মাফ করবেন ম্যাডাম। প্রত্যেক মানব শিশু স্বাধীন হয়েই জন্মায়, পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব তাকে নানা রূপ দিয়ে গড়ে তোলে, ক্রীতদাসও বানায়। রোগটা কি তা দেখতে চেয়েছি, এটা আমার স্পর্ধা নয়, মানুষের প্রতি একটা দায়িত্ববোধ থেকে এটা করেছি। একটা পথের শিশু হলেও আমি এটাই করতাম।’ বললাম খুব নরম, কিন্তু অনড় কন্ঠে।
মালিকের মেয়ের চোখ দু’টি বিস্ফোরিত হয়ে উঠেছে। তার পলকহীন চোখ আমার দিকে নিবদ্ধ হলো। অবাক হয়ে কি যেন সন্ধান করছে সে আমার মধ্যে। ধীরে ধীরে তার পলকহীন চোখ বুজে গেল। নীরব হয়ে গেল সে। বুঝা যাচ্ছে, দাঁতে দাঁত চেপে সে তার অসহ্য যন্ত্রণা চাপা দেবার চেষ্টা করছে। আমি মেয়েটির মাথার আরও কাছে এগিয়ে গেলাম। আমি ঝুঁকে পড়ে তার দু’চোখ থেকে যে ধমনীগুচ্ছ মাথার দিকে চলে গেছে, তার ভেতর থেকে দুই প্রধান ধমনী খোঁজার চেষ্টা করতে লাগলাম। তার শ্বেত-শুভ্র কপাল বেদনায় আরক্ত হয়ে গেছে। দুই চোখের দুই কোণার দূরত্ব বিবেচনায় রেখে আনুমানিক হিসেব থেকে সে দুই ধমনীর অবস্থান ঠিক করলাম। তারপর মালিক-পত্নীর দিকে চেয়ে বললাম, ‘মা, আপনি আপনার দুই বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ঠিক এই দুই জায়গা মাঝারি শক্তিতে চেপে ধরে রাখুন।’
মালিক-পত্নী তাকাল মালিকের দিকে। বলল, ‘আমি বোধ হয় ঐভাবে ধরতে পারব না।’
আলগার, ব্যাপারটা তুমিই ভালো বুঝবে। কাজটা তুমিই করো।আমার দিকে তাকিয়ে বলল মালিক।
আমি তার মাথার পাশে ভালোভাবে বসে দুই হাতের দুই বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে বিসমিল্লাহ বলে সেই দুই ধমনী চেপে ধরলাম।
উপুড় হয়ে বালিশে তার মাথা গুঁজে থাকা, তার চোখ-মুখের রং ইত্যাদি দেখে আমার প্রাথমিক ধারণা হয়েছিল তার যন্ত্রণার উৎস মাথা নয়, চোখ। যদি তাই হয় তাহলে চোখ থেকে উপরে ওঠা প্রধান ধমনী দু’টি নির্দিষ্ট পরিমাণে চেপে ধরলে ব্যথার উপশম হবে। আল্লাহর রহমতে তাই হলো। অল্পক্ষণের মধ্যেই তার মুখের অবস্থা সহজ হয়ে গেল। ধমনী দু’টি চেপে রেখে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। আনন্দের সাথে দেখলাম, তার মুখে প্রশান্তি ও একটা শিথিলতার ভাব নেমে এসেছে। আমি তার কপাল থেকে হাত তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মালিকের দিকে চেয়ে বললাম, ‘এর সমস্যা মাথায় নয়, চোখে। চোখের সমস্যার কারণেই তাঁর মাথার যন্ত্রণা। চোখ থেকে মাথার দিকে উঠে যাওয়া প্রধান ধমনী দু’টোকে আমি যখন চেপে রেখেছিলাম, তখন দেখেছি তার মাথার যন্ত্রণা কমে গেছে। আমি ওর চোখ দু’টি একটু দেখতে চাই।
মালিক ও মালিক-পত্নী উভয়েরই চোখে-মুখে অপার বিস্ময়। মালিক এগিয়ে গেলেন মেয়ের দিকে। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘মা একটু চোখ খোল। এখন কেমন মনে করছ মা?’
চোখ খুলল মেয়ে ক্যাথারিনা। তাকাল বাবার দিকে। বলল, যন্ত্রণা প্রায় ছিলই না। আঙ্গুলের চাপ তুলে নেবার পর মনে হচ্ছে একটু একটু করে বাড়ছে যন্ত্রণা।’ খুশি হলেন ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক, আমার মালিক। বললেন, ‘তাহলে তো আলগার ঠিকই বলেছে। সে চোখ দেখতে চায়, চোখটা দেখাও মা।’ বলে একটু সরে দাঁড়ালেন মালিক।
আমি এগিয়ে গেলাম। বললাম, ‘প্লিজ ম্যাডাম, খাটের এ পাশে এসে পিঠের তলায় বালিশ দিয়ে খাটে হেলান দিয়ে একটু বসুন।’
কোন কথা না বলে খাটে হেলান দিয়ে বসল সে। আমি এগিয়ে গিয়ে একটু ঝুঁকে পড়ে তার চোখ দু’টি পরীক্ষা করলাম। দুই আঙ্গুলে চোখ ফাঁক করে চোখের আইবল বিভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে পরীক্ষা করলাম। কিন্তু আমি যেট দেখতে চাই বুঝতে চাই, সেটা তেমনটা হলো না।’
আমি দাঁড়িয়ে একটু সরে এসে মালিককে বললাম, ‘হাতখানেক লম্বা কিছুটা সরু একটা লোহার বা কাঠের কিংবা বাঁশের সোজা চোঙা দরকার।’
‘চোঙা দিয়ে কি হবে?’ বললেন মালিক।
‘চোখ পরীক্ষায় চোঙার ভেতর দিয়ে যাওয়া নিয়ন্ত্রিত আলোর শক্তিশালী ফোকাস ভালো কাজ দেয়।’ আমি বললাম।
‘হ্যাঁ আছে, আনছি এখনই।’
উনুনে বা স্বর্ণকারের কয়লার আগুন উস্কে দেয়ার জন্যে যে সরু চোঙা ব্যবহার হয়, সে চোঙাই তিনি নিয়ে এলেন। খুশি হলাম আমি।
চোঙার এক মাথা আমি ক্যাথারিনার খোলা চোখের উপর রেখে অন্য মাথায় পাওয়ার ফুল লন্ঠনের আলোর শিখা সেট করলাম, যাতে আলো অন্য দিকে বিচ্ছুরিত হবার সুযোগ না পেয়ে চোঙার সুড়ঙ্গপথে চোখের উপর গিয়ে কেন্দ্রীভূত হতে পারে।
সেই আলোতে ক্যাথারিনার দুই চোখ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ভালোভাবে পরীক্ষা করলম। দু’টো জিনিস পেলাম।এক, দুই চোখেরই সূক্ষ্ণ ধমনীর গুচ্ছ আহত হয়েছে এবং রক্তের সূক্ষ্ণ জমাট বিন্দুর সৃষ্টি হয়েছে। দুই চোখেরই আইবলের রেদপেনসিভ নয় যথেষ্ট পরিমানে। আইবলের কিছু টিস্যু শুকিয়ে গিয়ে চোখের জীবন্ত সত্তাকে বাধাগ্রস্ত করারই লক্ষণ এটা। চোখের এই পরীক্ষা শেষ করে আমি বললাম মালিককে উদ্দেশ্য করে, ‘দুই চোখের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ধমনী ড্যামেজড হয়েছে এবং দুই আইবলের কিছু টিস্যু শুকিয়ে গেছে।’
মালিক ও মালিক-পত্নী অপার বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে পড়েছেন। আমার কথায় তাদের চোখে-মুখে আতংকেরও সৃষ্টি হলো। বলল মালিক, ‘তাহলে এখন উপায় আলগার?’
‘মালিক, আমার দেয়া ওষুধ যদি খাওয়ানো বা ব্যবহার ঠিক মনে করেন, তাহলে চেষ্টা করে দেখতে পারি। এই রোগের চিকিৎসা আছে মালিক।’ আমি বললাম।
মালিক ও মালিক-পত্নী দু’জনরই মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মালিকের মেয়ে ক্যাথারিনা চোখ বন্ধ করে তার কপালের সেই বিশেষ স্থান দু’টো চেপে ধরে বসেছিল। মালিক বলল, ‘আলগার তুমি রোগ ধরতে পেরেছ এবং ঠিকভাবেই ধরেছ। তাই তোমার ওষুধই চলবে।’
‘ঠিক আছে মালিক, ওষুধ যেটা দরকার, তা তৈরি করতে সময় লাগবে। বনজ কিছু ওষুধের সাথে কিছু দুর্লভ অনুপান যোগাড় করতে হবে। সেটা পরে করব। আপাতত চোখে দেয়ার মত একটা ওষুধ পাঠাচ্ছি। সেটাতে চোখের ক্ষতিপূরণ না হলেও যন্ত্রণা কমে যাবে। আমাকে একটা পরিষ্কার শিশি দিন। ওষুধটা দিনে চার পাঁচ বার এক ফোঁটা করে চোখে দিতে হবে। চোখে কোন চাপ দেয়া যাবে না, শুয়ে থাকতে হবে। ঘরে তীব্র নয়, ঠাণ্ডা আলো থাকবে।’
‘আমি শিশি পাঠিয়ে দিচ্ছি। তোমার ওষুধ পাওয়ার পর আমরা ক্যাথারিনাকে বাড়িতে নিয়ে যাব। সকালে আমি ওষুধের অনুপান কি কি কিনতে হবে, তা তোমার কাছ থেকে জেনে নেব।’ বললেন মালিক।
‘ঠিক আছে মালিক, আমি চলি।’ বলে আমি চলে এলাম।
এসেই আমি ফার্মহাউজের বাগান থেকে ইউনানি ওষুধ বিজ্ঞানের জীবাণুনাশক, বেদনানাশক, স্নায়ু শীতলকারক এবং চক্ষুকোষের শক্তিবর্ধক একটা গাছের কিছু পাতা ও ফুল জোগাড় করে আনলাম। রস করে মালিকের পাঠানো শিশিতে করে পাঠিয়ে দিলাম। আমি তখন শুয়ে পড়েছি। আমার সাথী কয়েকজন শ্রমিক হুড়মুড় করে আমার ঘরে ঢুকে পড়ল। সমস্বরে বলে উঠল, ‘ওস্তাদ, তোমার ভাগ্য খুলেছে। তোমার প্রমোশন হয়েছে। তোমাকে আর এই ফার্মে কাজ করতে হবে না, এই ফার্মহাউজেও থাকতে হবে না। মালিকের বাড়িতে তোমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে।’
কথাগুলো আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলো না। তবু জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কোথায় শুনলে?’
‘শুনব আর কোথায়। খোদ মালিক যাবার সময় এ কথা তার শ্যালককে বলে গেছে, ‘কালকে সকালেই আলগারকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাবে। ব্যাবস্থা করেছি , ওখানেই সে থাকবে।’ শুনেই মালিকের শ্যালক সাহেব প্রতিবাদ করলেন, আলগার শুধু কাজই করতো না, কাজ করাতোও সে। সে সাথে থাকলে শ্রমিকদের কাছ থেকে অনেক বেশি কাজ পাওয়া যায়। সে গেলে ফার্মহাউজের ক্ষতি হবে।’ ‘ফার্মহাউজের কাজের জন্যে নয়, এখানে তাকে পাঠিয়েছিলাম একটা শাস্তি হিসেবে। সেটা তার প্রতি অবিচার হয়েছে। জান তোমার বোন কি বলছে, আজকেই এখন থেকে তাকে আমাদের বাড়িতে ট্রান্সফার করতে হবে।’ এরপর শ্যালক সাহেব আর কথা বলেননি।’
মালিকের বাসায় আমার আরেক জীবন শুরু হলো। সেখানে আমাকে কোন কায়িক পরিশ্রম করতে হলো না। আমাকে দায়িত্ব দেয়া হলো, বাড়ির স্টাফদের কাজ ঠিকমত হচ্ছে কি না দেখা এবং তা করিয়ে নেয়া। কোন কিছু ঘটলে তা মালিক বা মালিক-পত্নীকে অবহিত করা। আমার থাকার জায়গা দোতলায় সিঁড়িমুখের একটা ঘরে। বাড়ির স্টাফ কর্মচারিরা সবাই থাকে নিচলতায়। মালিকের সেক্রেটারি বেনেডিক্টের কাছে শুনেছি, মালিক আমার থাকার জায়গা এক তলারই একটা ভালো ঘরে করেছিলেন। কিন্তু মালিক-পত্নী রাজি হননি। তিনি বলেছেন, ‘ছেলেটা আমার মেয়ের চিকিৎসা করছে, এটাই শুধু নয়, ছেলেটির কথা-বার্তা, কয়েক মাসের আচার-ব্যবহার থেকে মনে হচ্ছে সে শুধু শিক্ষিত ও ভদ্রই নয়, মানুষ হিসেবেও অনেক বড়। দেখনা মাত্র কয়েক মাসেই ফার্ম হাউজের সবাইকে নিজের ভক্ত বানিয়ে ফেলেছে। শুনেছি, সবাইকে ভালোবেসে, সবার পাশে দাঁড়িয়ে, সবার জন্যে কাজ করেই সে সবার ভক্তি-ভালোবাসা অর্জন করেছে। ক্রীতদাস হয়েছে বলেই তার সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। তাকে সম্মান দিলে আমরা ছোট হয়ে যাব না!’ এসব কথা বলে মালিক-পত্নী দোতলার ঐ ঘরটায় আমার থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। এসব আমার শোনা কথা। মালিক কিংবা মালিক-পত্নী নিজ মুখে আমাকে কখনও কিছু বলেননি।
শিশিতে আমি যে তরল ভেষজ-রস সে রাতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, সেটা ব্যবহার শুরু করেই মালিক-তনয়া ক্যাথারিনা একমাসের মধ্যে প্রথম বারের মত শান্তিতে ঘুমাতে পেরেছে। মালিক দু’দিনের মধ্যেই দুর্লভ উপাদান ও অনুপানগুলো আমাকে এনে দিয়েছিলেন। সেসব উপাদানের সাথে কিছু বিস্ময়কর গাছ-গাছড়ার মূল, পাতা, ফুলের সমন্বয়ে ওষুধ তৈরি করে অনুপানগুলোর সাথে নির্দিষ্ট পরিমাণে মিশিয়ে সময়ে সময়ে তা খাওয়ানোর ব্যবস্থাপত্র দিয়েছিলাম। কিছু দিনের মধ্যেই সে সুস্থ হয়ে যায়। মালিক ও মালিক-পত্নী একদিন ডেকে আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন আমি কি চাই, তা তারা আমাকে দেবেন। আমি বলেছিলাম, ‘আমি কোন বিনিময় চাই না। আর বিনিময় চাওয়ার অধিকার ক্রীতদাসের থাকে না। আপনারা আমার জন্যে যথেষ্ট করেছেন। আমি তার জন্যে কৃতজ্ঞ।’
বলে আমি চলে আসছিলাম। দেখলাম সিঁড়ির মুখের এক পাশে একটা পিলারের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে মালিকের মেয়ে ক্যাথারিনা। তাকে দেখে আমি সেখান থেকে তাড়াতাড়ি চলে এলাম।
সেদিনই সন্ধ্যার পর আমি সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাচ্ছিলাম। পেছন থেকে নারীকন্ঠের আওয়াজ শুনলাম, ‘শুনুন।’
আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলাম সিঁড়ির মুখে মালিকের মেয়ে ক্যাথারিনা দাঁড়িয়ে। আমি এক ধাপ এগিয়ে মাথা নিচু করে বললাম, ‘আমাকে ডাকছেন?’
‘হ্যাঁ।’ বলল মালিকের মেয়ে ক্যাথারিনা।
‘কিছু আদেশ আছে, বলুন?’ আমি বললাম।
‘আদেশ নয়, অভিযোগ আছে।’ বলল ক্যাথারিনা।
‘অভিযোগ?’ আমি বললাম।
‘হ্যাঁ, অভিযোগ! আপনার বিরুদ্ধে!’ বলল ক্যাথারিনা।
‘তাহলে মালিককে বলুন। আমি কোন দোষ তো করতেই পারি।’ আমি বললাম।
‘কোন ক্রীতদাসের বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ নেই। আমার অভিযোগ আপনার বিরুদ্ধে। তাই মালিককে বলবার প্রয়োজন নেই।’ বলল ক্যাথারিনা।
‘ক্রীতদাস এবং আমি একই সত্তা। ঠিক আছে…।’
আমার কথার মাঝখানেই সে বলে উঠল, ‘কিন্তু সেদিন আপনি বলেছিলেন ক্রীতদাস পরিস্থিতির সৃষ্টি। পরিস্থিতি যা সৃষ্টি করে তা আসল নয় এবং স্থায়ীও নয়। সুতরাং তা মানব সত্তার অংশও নয়।’ বলল ক্যাথারিনা।
‘ঠিক আছে, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগটা বলতে পারেন।’ আমি বললাম।
‘সেদিন আপনাকে ক্রীতদাস বলেছিলাম। তাই আজ আপনি নিজেকে ক্রীতদাস বলে বিনিময় প্রত্যাখ্যান করে আমার উপর প্রতিশোধ নিলেন। কিন্তু আপনি জানেন না সেদিন থেকেই আমি মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করছি। মাফ চাইবার সুযোগ খুঁজছি। এর মধ্যেই আপনি…।’
কথা গলায় আটকে গেল ক্যাথারিনার। গলাটা হঠাৎ তার ভারি হয়ে উঠেছিল।
আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ‘আপনার ব্যাপারটাকে এভাবে দেখা ঠিক নয়। ক্রীতদাস পরিচয় আমার সত্তার অংশ হোক বা না হোক, পরিস্থিতিগত কারণে আমি ক্রীতদাস একথা তো ঠিক? এটা তো অনস্বীকার্য বাস্তবতা? সুতরাং ক্রীতদাস বলায় আমি কিছুই মনে করিনি, মনেও রাখিনি বিষয়টা। অতএব প্রতিশোধের বিষয় হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’
কিন্তু আমি তো অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করছি। আপনি আমাকে মাফ না করলে আমার এ যন্ত্রণা যাবে না।’ বলল ক্যাথারিনা।
‘না, আপনি আমার মনিব-কন্যা। আপনি এভাবে বলতে পারেন না।’ বললাম আমি।
‘আমি মনিব-কন্যা নই। আমি একজন মানুষের কন্যা ক্যাথারিনা।’ বলল ক্যাথারিনা।
‘ধন্যবাদ। কিন্তু সেদিন মানুষের কন্যা ক্যাথারিনা আমাকে ক্রীতদাস বলেননি, বলেছিলেন মনিব-কন্যা ক্যাথারিনা।’ আমি বললাম।
‘আপনি অনেক বিজ্ঞ, জ্ঞানী। কথায় কিংবা কোন দিক দিয়েই আমি আপনার সাথে পারব না।সেদিনের মনিব-কন্যাকেও আপনি মাফ করুন।’ বলল ক্যাথারিনা। কন্ঠ তার আবার ভারি হয়ে উঠেছিল।
মনিব-কন্যার সাথে এভাবে দাঁড়িয়ে কথা বলা আমার মানায় না। আর তার এই পরিবর্তন আমার মনে নতুন এক আশংকারও সৃষ্টি করল। বুকটা আমার কেঁপে উঠল। আমি আর কথা না বাড়াবার জন্যে বললাম, ‘ঠিক আছে ম্যাডাম। আপনার ইচ্ছা, অনুরোধ আমার কাছে আদেশ। আমি মাফ করলাম, যদিও সেদিন তা বলা আপনার জন্যে অন্যায় কিছু ছিল না। আপনার মহত্ত্বের জন্যে ধন্যবাদ।’
বলে আমি চলে যাবার জন্যে পা বাড়ালাম। পেছন থেকে মনিব-কন্যা ক্যাথারিনা বলে উঠল, ‘শুনুন, এটা আমার মহত্ত্ব নয়, একজনের মহত্ত্বের কাছে, বিরাটত্বের কাছে এক দুর্বিনীত হৃদয়ের আত্নসমর্পণ।’
মনিব-কন্যার কন্ঠ ছিল পরিষ্কার, স্থির, শান্ত কিন্তু শক্ত, তার কথাগুলো বিশ্বাসে দৃঢ়। কন্ঠের সেই ভারিভার এখানে ছিল না। এ যেন এক সিন্ধান্তের পরোয়াহীন প্রকাশ।
আমার হৃদয়টা আবার কেঁপে উঠল। পরিচিত সেই আশংকা আমার হৃদয়ে মাথা তুলল। আমি দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে মনিব-কন্যার কথার প্রতিবাদে কিছু বলার জন্যে ঘুরে দাঁড়ালাম। দেখলাম তিনি চলে যাচ্ছেন, আস্তে, শান্ত ও শক্ত পদক্ষেপে।
তাকে ডাকা আমার জন্যে অন্যায় মনে করলাম। আমি নেমে এলাম সিঁড়ি দিয়ে। দিন আমার এগিয়ে চলল ভিন্নতরভাবে। আমি মালিকের বাড়ির কর্মকর্তা-কর্মচারিদের দেখা-শোনার কাজ করি। কিন্তু মালিক আমাকে কোন আদেশ করেন না। কর্মকর্তা-কর্মচারিদের কোন বিষয় নিয়ে তাঁর কাছে গেলে তিনি আমার পরামর্শ চান অথবা বলেন তুমি যেটা ভালো মনে করো সেটাই করো। মনিব-কন্যা ক্যাথারিনার আট নয় বছরের ছেলে বেরুন বেকার প্রায়ই আমার কাছে আসে, নিষেধ সত্ত্বেও আংকেল বলে ডাকে।১৫ দিন ধরে নিয়মিত সে আমার কাছে পড়তে আসে সন্ধ্যার পর। মাসখানেক আগে সে একদিন বলে, ‘আংকেল, মা আমাকে আপনার কাছে পড়তে বলেছেন। মা বলেন, রাজার স্কুলে যা শেখানো হয় তা যথেষ্ট নয়। দেখুন, মা কি পড়াতে বলেছেন।’ বলেই সে আমার হাতে একখণ্ড কাগজ তুলে দেয়। কাগজে দেখলাম ‘যা পড়ানো হচ্ছে’ শিরোনামে তিনটি সাবজেক্টের নাম লেখা। সাবজেক্টগুলো হলো, জার্মান ও ল্যাটিন ভাষা, ক্যাথলিক থিওলজি ও চার্চের ইতিহাস। এরপর ‘যা পড়ানো দরকার’ শিরোনামেও তিনটি সাবজেক্টের নাম লেখা, সাবজেক্টগুলো হলো, অংক, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব ও পৃথিবীর ইতিহাস। আমি এই সাবজেক্টগলোর নাম দেখে বিস্মিত হলাম। সবগুলোই ইউরোপের জন্যে নিষিদ্ধ সাবজেক্ট। জার্মানসহ ইউরোপের কোন দেশেই অংক-বিজ্ঞান, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব ও দুনিয়ার ইতিহাস পড়ানো হয় না। আমি বেরুন বেকারকে জিজ্ঞাসা করলাম, এই বিষয়গুলোর নাম কি তোমার মা লিখেছেন?’
‘হ্যাঁ, মা তো লিখেছেন। তাছাড়া কে লিখবেন?’ বলল বেরুন বেকার।
‘তোমার মা এ বিষয়গুলো পড়েন, জানেন?’ আমি বললাম বেরুনকে।
‘মা এগুলো জানেন, পড়েন কি না জানি না। তবে মা’র অনেক বই আছে। মা তো পড়েই সময় কাটান।’ বলল বেরুন বেকার।
ডাক্তারের চেতনা থেকেই বোধ হয় আমার মুখ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে গেল, ‘চোখের অসুখ থেকে উঠেছেন, এখন তোমার মাকে কিছুদিন বই পড়া বন্ধ রাখতে হবে।’
‘তাই? তাহলে মাকে গিয়ে বলি।’ বলেই উঠে দাঁড়িয়ে ছুটল বেরুন বেকার। কিছুদূর গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমাকে পড়াবেন কবে থেকে, মা জিজ্ঞাসা করলে কি বলব আংকেল?’
‘ঐ কঠিন বিষয়গুলো কি আমি পড়াতে পারি?’ বললাম আমি।
‘ঠিক আছে বলব মাকে।’ বলে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেল বেরুন বেকার। এর কয়েকদিন পর মালিক আমাকে ডেকে বললেন, ‘আলগার, আমার নাতি বেরুনকে একটু কষ্ট হলেও পড়াও, ক্যাথারিনার অনুরোধ। তার বিশ্বাস, তুমি স্পেনের মানুষ। বেরুনকে খুব ভালভাবে তুমি পড়াতে পারবে। আমরা যাই বলি, মুসলিম স্পেন তো অংক বিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিজ্ঞানসহ সব বিজ্ঞান , ইতিহাস, ভূগোল, ধর্মতত্ত্ব শিক্ষার বিস্ময়কর কেন্দ্র। আমরা জানি, ইউরোপে আমরা অংক, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, চিকিৎসা ইত্যাদির চর্চা নিষিদ্ধ হলেও কিছু কিছু ইউরোপিয়ান ছেলে লুকিয়ে স্পেনে পড়তে গিয়েছে, যাচ্ছে। মুসলমানদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তাদের শিখিয়ে-পড়িয়ে ভর্তি করে নেবার মত উদারতা দেখিয়ে আসছে।’
পরদিন সন্ধ্যার পর বেরুন বেকারকে আমি পড়াচ্ছি। পড়াতে রাজি হয়ে নতুন বিপদে পড়ে গেলাম। ক্যাথারিনা মাঝে মাঝেই তার ছেলের হাতে বই পাঠায়। বইয়ের স্থানে স্থানে দাগ দিয়ে তার ব্যাখ্যা জানতে চায়। বইগুলোর প্রায় সবই ইতিহাস ও ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক। আমি প্রথম দিকে জানি না বলে এড়িয়ে যেতাম। ক্যাথারিনা একদিন লিখে পাঠায়, ‘জনাব, একজন তৃষ্ণার্তকে পানি পান করানো কি সবচেয়ে বড় কর্তব্য, সবচেয়ে বড় ধর্ম নয়?’ এরপর আমি আর না করিনি। বইয়ে দাগ দিয়ে পাঠানো তার সব জিজ্ঞাসার জবাবই লিখে পাঠাতাম। চোখের কথা বলে তাকে এত পড়াশোনা এখন না করার জন্যে বেরুন বেকারের মাধ্যমে আবার বলে পাঠিয়েছিলাম। সে লিখে পাঠিয়েছিল, ‘মান্যবর ডক্টর, লেখা-পড়াই তো আমার সাথী। লেখা-পড়া ছেড়ে দিলে রোগ থেকে হয়তো আমি বাঁচবো, কিন্তু আমি মরে যাব।’ আমি আর তাকে কিছু বলিনি। চিঠিটা আমার অবচেতন মনের কোথায় কি যেন বিদ্ধ করে, চিঠির সাথের অদৃশ্য একটা যন্ত্রণা যেন আমার হৃদয়েও সংক্রমিত হয়। দিন এভাবেই চলতে থাকে।
একদিন সকালে আমার ঘরে আমি নাস্তা খেতে বসতে যাচ্ছি, এ সময় মালিকের খাস পরিচারিকা এসে বলে, মালিক আপনাকে স্মরণ করেছেন। তিনি আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।’
নাস্তা না খেয়ে উঠতে হলো। পরিচারিকার সাথে সাথে চললাম।
পরিচারিকা যেখানে নিয়ে গিয়ে আমাকে পৌঁছালো সেটা তিন তলায় মালিকের পারিবারিক ডাইনিং কক্ষ। ডাইনিং টেবিলে বসে আছেন খোদ মালিক। তার বামপাশে তার স্ত্রী আর ডানপাশে নাতি বেরুন বেকার, বেরুনের পাশে বেরুনের মা ক্যাথারিনা এবং ক্যাথারিনার মামা মালিকের শ্যালক অসরিক রেডওয়ার্ল্ড। নাস্তা তাদের সামনে প্রস্তুত, কিন্তু নাস্তায় কেউ হাত দেয়নি।
এই অবস্থায় তাদের মধ্যে হাজির হয়ে আমি বিব্রত বোধ করলাম। বললাম, ‘মালিক আমি পরে আসছি।’ বলে চলে আসার উদ্যোগ নিলাম।
‘দাঁড়াও আলগার, আমরা তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছি। তুমি নাস্তার টেবিলে বসবে। কথা বলব এবং একসাথে বসেই নাস্তা করব। বস তুমি।’
মালিকের হুকুম শিরোধার্য। কিন্তু আমার দুই চোখ বিস্ময়ে বিস্ফোরিত। এ কি বলছেন উনি! মালিকের খানার টেবিলে বসবে তার ক্রীতদাস! ইসলাম এটা আটশ’ বছর আগে চালু করেছে, কিন্তু ইউরোপে এটা অবিশ্বাস্য। আমি দ্বিধা করছিলাম।
মালিক-পত্নী আমার দিকে তাকিয়ে বললেন। ‘এস বেটা, আমার পাশে বসবে।’
সবার দিকে তাকালাম। দেখলাম, ক্যাথারিনার মুখ নত। আর বেরুন বেকার আনন্দে চামচ দিয়ে প্লেট বাজাচ্ছে। মালিক ও মালিক-পত্নী আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
আমি ধীরে ধীরে মালিকের স্ত্রীর পাশে বসলাম। পরিচারিকা আমার সামনে প্লেট ও কাঁটাচামচ এগিয়ে দিল।’
নাস্তা আমাদের খাওয়া শেষ হয়ে গেল। সবাই নাস্তার সাথে পানীয় হিসেবে মদ পান করলেন। রীতি অনুসারে অন্তত আমারও মদ পান করা উচিত ছিল। কিন্তু আমি তা করলাম না। পরিচারিকা আমাকে লেমোনেড ওয়াটার দিল। আমি মদ পান করছি না দেখে সবাই অবাক হয়েছিল। বিস্ময়ে চোখ তুলে ক্যাথারিনা তাকিয়েছিল আমার দিকে। এই প্রথম সে আমার দিকে তাকাল চিকিৎসা শেষ হওয়ার পর। আমি দেখলাম নাস্তা শেষে সেও মদ পান করল না। তার গ্লাসের মদ গ্লাসেই থেকে গেল। আমি মদ পান করি না দেখে মালিক আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমার মদ পান না করার কারণ কি? আমি বলেছিলাম মালিক অনুমতি দিলে জবাবটা পরে দিতে চাই। তিনি তা মেনে নিলেন।
নাস্তার পর চা খাওয়া শুরু হলে মালিক বললেন, ‘আলগার, দু’টি কথা বলার জন্যে তোমাকে ডেকেছি। প্রথম কথা, তোমার একটা বড় ধরনের সাহায্য প্রয়োজন। গতকাল সকালে আমি সম্রাট চতুর্থ অটো’র দরবারে গিয়েছিলাম। দরবার বসেনি। গোটা রাজপ্রাসাদ বিষাদে ঢাকা। কথায় কথায় জানলাম, সম্রাট চতুর্থ অটোর একমাত্র ছেলে যুবরাজ তৃতীয় হেনরী থিয়োলজী যুদ্ধাবিদ্যা ইত্যাদি শেখার জন্যে রোমে ছিলেন গত দু’বছর। সেখানে এক বছর যেতেই তার দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। সেখানে অনেক চিকিৎসা হয়েছে। কিন্তু কোন ফল হয়নি। সম্পূর্ণ অন্ধ অবস্থায় তিনি গত পরশু বাড়ি ফিরেছেন। এখানকার রাজবৈদ্যরা গত দু’দিন ধরে দেখে অভিমত দিয়েছে, চোখ একেবারে শুকিয়ে গেছে। দৃষ্টিশক্তি ফেরানো আর সাধ্যের মধ্যে নেই। এই খবরে সম্রাটের প্রাসাদে কান্নার রোল পড়ে গেছে। আমি সম্রাটের সাথে কথা বলেছি। তোমার কথাও আমি বলেছি তাকে। রাজবৈদ্যরা ব্যর্থ হবার পর কিভাবে তুমি ক্যাথারিনার চোখ সারিয়ে তুলেছ, সেটাও বলেছি আমি তাকে। শুনেই সম্রাট অস্থির হয়ে উঠেছেন তোমাকে তাঁর ছেলে দেখাবার জন্যে। আজই আমি তোমাকে সম্রাটের প্রাসাদে নিয়ে যেতে চাই। তোমার সম্মতি প্রয়োজন।’ থামলেন মালিক।
আমি বললাম, ‘আপনার সম্মতিই আমার সম্মতি মালিক। আমার ভিন্ন সম্মতির প্রয়োজন নেই। তবে এত বড় বড় চিকিৎসক ব্যর্থ হবার পর আমি সম্রাটের ছেলের চিকিৎসার ব্যাপারে কতদূর কি করতে পারব বুঝতে পারছি না। আপনি কি যুবরাজ তৃতীয় হেনরিকে দেখেছেন?’
‘হ্যাঁ, দেখেছি আলগার।’ বললেন মালিক।
‘তার চোখের দিকে খেয়াল করেছেন? চোখ দু’টি কি গর্তে ঢুকে গেছে, না মোটামুটি স্বাভাবিক আছে?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম মালিককে।
‘আমি তার চোখ দু’টিকে ভালো করে দেখেছি। তুমি যেটা বললে তার চোখ মোটামুটি স্বাভাবিক কি না, হ্যাঁ আমি সে রকমই দেখেছি। চোখ গর্তে ঢুকে যায়নি।’ বললেন মালিক।
‘যদি তাই হয়, তাহলে চোখের টিস্যু ও ধমনীতে এখনও রস আছে, সেগুলো এখনও সজীব রয়েছে। এটাই আমার কথা।’ আমি বললাম।
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, তোমাকে ধন্যবাদ। ঈশ্বর তোমার কথা সত্য করুন। গতকাল থেকে তার সম্পর্কে শুধু হতাশার কথাই শুনছি। তুমিই প্রথম আশার কথা শোনালে।’ বললেন মালিক।
‘স্রষ্টার দয়া সম্পর্কে হতাশ হতে নিষেধ করা হয়েছে। তিনি জীবিতকে মৃত করেন এবং মৃতকে জীবিত করতে পারেন। তার সব দয়া মানুষের জন্যে।’ আমি বললাম।
‘আলগার তোমাকে যতই দেখছি, ততই বিস্মিত হচ্ছি। এত জ্ঞান তুমি কোথা থেকে পাও?’ বললেন মালিক।
‘মালিক, সব জ্ঞানের উৎস স্রষ্টা। মানুষের মগজ স্রষ্টার ইচ্ছা প্রকাশের একটা মাধ্যম। এই মাধ্যমের পথ ধরেই মানুষের সকল আবিষ্কার, সকল মহৎ সৃষ্টি।’ আমি বললাম।
ক্যাথারিনা আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল। বিস্ময়ভরা তার চোখে অনেক প্রশ্ন দেখলাম। মালিকই কথা বললেন, ‘সাংঘাতিক কথা বলেছ আলগার। কথাটা সাগরের চেয়েও গভীর। কারণ সাগরের তল আছে। ঈশ্বর তোমার জ্ঞান বাড়িয়ে দিন।’
কথা শেষ করে একটু থেমেই মালিক আবার বললেন, ‘তাহলে আজ বিকেলেই তুমি আর আমি রাজধানীতে যাত্রা করব।’ বলে থামলেন মালিক।
কেউ কোন কথা বলল না।
অস্বস্তিকর একটা নীরবতা।
নীরবতা ভাঙলেন আবার মালিক নিজেই। বললেন, ‘এবার আমার দ্বিতীয় কথা।‘
কথাটা সংগে সংগে শুরু করলেন না মালিক। আবার নীরব হলেন তিনি।
অন্য সবাই আনত দৃষ্টিতে বসে আছে। অস্বস্তিকর নীরবতায় আবার কাটল কিছুক্ষণ। পরিবেশকেও ভারি করে তুলেছে এই নীরবতা।
আবারও নীরবতা ভাঙলেন মালিকই। শান্ত, গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘আলগার, সেদিন তোমাকে কিছু চাইতে বলেছিলাম। তুমি চাওনি। বলেছ ক্রীতদাসদের কিছু বিনিময় চাইবার অধিকার নেই। চলমান ব্যবস্থায় এটা সত্য। কিন্তু আলগার, কোন ক্রীতদাস এতবড় কাজ করার পর কিছু চাইবে না তা একেবারেই স্বাভাবিক নয়, অবিশ্বাস্য। এই অবিশ্বাস্য কাজ করে তুমি প্রমাণ করেছ আমরা যা ভাবতে পারি তার চেয়েও তুমি মহৎ, বড়। এমন মহৎরা কিছু চায় না, দিতে হয় তাদের। চাইবে না বলে তাদের দিতে হবে না, এটা ঠিক নয়। আমরা সেদিন ভুল করেছিলাম। সেদিনও তোমাকে চিনতে ভুল করেছি। সে ভুল আমাদের ভেঙেছে আলগার। সেদিন যা আমাদের না চাইতেই দিয়ে দেয়া উচিত ছিল, সেটা আজ আমরা দিয়ে দিতে চাই। আজ থেকে তুমি মুক্ত আলগার। তুমি আর কারও ক্রীতদাস নও। তুমি এখন আমাদের ছেলে সন্তানের মত। আমাদের তো কোন ছেলে সন্তান নেই!’ থামলেন মালিক। শেষের দিকে তার কন্ঠ কান্নারুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
আশার চেয়ে বড় কিছু ঘটলে, মানুষ যেমন বাকরুদ্ধ, বিহ্বল হয়ে যায়-আমারও সেই অবস্থা হলো। মুক্ত মানুষ থাকার যে কি স্বাদ তা ভুলেই গিয়েছিলাম, চেষ্টাও করেছি অতীতকে ভুলতে। আজ মুক্তির সংবাদ পাওয়ার পর সেই অতীত বাঁধভাঙা জোয়ারের মত আমার হৃদয়ে এসে আছড়ে পড়ল। সেই আদরের কর্ডোভা, সেই প্রিয় আমার বাড়ি, প্রিয়তমা স্ত্রী, প্রাণাধিক সন্তান, তাদের ও আমার পরিণতি, সবই এক সঙ্গে এসে আমার মনের দুয়ারে আছড়ে পড়ল। দু’চোখ থেকে দরদর করে নেমে এল অশ্রুর ধারা। ভুলে গিয়েছিলাম পারিপার্শ্বিকতা। কতক্ষণ কেঁদেছিলাম জানি না। পিঠে একটা মমতা ভরা হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম। চমকে উঠে নিজেকে সামলে নিলাম। তাড়াতাড়ি চোখ মুছে মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম, মালিক-পত্নীর হাত আমার পিঠে। তার চোখে রাজ্যের মমতা।সবার উপর দিয়ে আমার চোখ ঘুরে এল। দেখলাম মালিকের চোখে প্রশান্তির উজ্জ্বলতা। আর ক্যাথারিনের দৃষ্টি আনত। তার দুই রক্তিম ঠোঁটে খেলা করছে স্বচ্ছ হাসি। তবে দু’চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুর দুটি ধারা। হাসছে ক্যাথারিনার মামা আমার দিকে চেয়ে। বেরুন বেকার একেবারেই নির্বাক।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। নতমুখে ধীর কন্ঠে বললাম, আমার মুরুব্বি, আমার গুরুজন, আমার মহৎহৃদয় মালিকের প্রতি আমার হৃদয়ের অশেষ কৃতজ্ঞতা। আমি যা করেছি তা খুবই সামান্য, তিনি যা করলেন তা অনেক বড় হৃদয়ের পরিচয়। স্রষ্টা তাঁর মঙ্গল করুন। এই জগৎ ও পরজগতে স্রষ্টা অনেক বড় বিনিময় তাকেঁ দান করুন। আমার পরিবার থাকলে তারা আজ ছুটে আসত তাঁকে স্বাগত জানাতে, তাঁকে মাথায় তুলে নিতে। আমার তো কেউ নেই, সবহারা মানুষ আমি। তাই আমার একার সামান্য কয়েকটা কথা ছাড়া দেয়ার বা করার আমার কিছু নেই। এই পরিবারের সবার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। তারা প্রকৃতিগতভাবেই ভালো মানুষ। তাদের কাছে আমি ভালো ব্যবহার পেয়েছি। অবস্থাগত কারণ আমিই বরং কিছু মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছি। আপনাদের সবাইকে অন্তরের অন্তরের অন্তস্থল থেকে ধন্যবাদ। বললাম আমি।
‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আলগার। তুমি মহৎ বড়, বিজ্ঞ বলেই সবাইকে মহৎ ভাবতে পারছ। আলগার এখন একটা অনুরোধ করতে পারি?’ বললো আমার সাবেক মালিক।
আমি বললাম, ‘আপনি গুরুজন, অনুরোধ নয়, আদেশ করুন।’
‘তুমি যে মিথ্যাচারের কথা বললে, সেটা বুঝলাম না। আর আমি যে কথাটা বলতে চাচ্ছি তা হলো, তোমার পরিচয় আমরা জানি না। তুমি যেটুকু পরিচয় দিয়েছিলে তা আমার কাছে তখনই বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। তোমার আচরণ, কথা-বার্তা কোন কিছুর সাথেই তোমার পরিচয় মেলে না। জানতে পারি কি সব কথা?’ বললেন মি. ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক, আমার অভিভাবক।
একটু ভাবলাম। লুকিয়ে তো আর লাভ নেই।তবে মুসলিম পরিচয় এখন বলতে চাই না।যুবরাজের চিকিৎসা তাতে বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
পরক্ষণেই আবার ভাবলাম, আবার মিথ্যাচারের আশ্রয় নেব কেন? সত্য আমাকে যেখানে নিয়ে যাবে, সেখানেই যাব।
আমার জবাব দিতে দেরি হচ্ছে দেখেই বোধ হয় আমার সাবেক মালিক ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক বলে উঠলেন, ‘থাক আলগার, অসুবিধা বা বলতে না চাইলে বলো না। এখন…।’
আমি তার কথার মাঝখানেই বললাম, ‘স্যরি। বলতে চাই না তা নয়, অসুবিধাও কিছু নেই।’
বলে একটু থেমে আমি শুরু করলাম, ‘আমার নাম ইউসুফ ইয়াকুব আল মানসুর। আমার জন্ম স্পেনের কর্ডোভা নগরীতে। আমার বাবা কর্ডোভার সুলতানের প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। কর্ডোভা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে ঐ হাসপাতালেই ডাক্তার হিসেবে ১২৩০ সালে চিকিৎসক জীবনের শুরু করি। আমি ছাত্র হিসেবে যেমন সেরা ছাত্রের গোল্ড মেডেল নিয়ে বেরিয়ে আসি তেমনি চিকিৎসক হিসেবেও সেরা চিকিৎসকের গোল্ড মেডেল পাই ১২৩৬ সালে।’ এই কথাগুলো বলে আমি সংক্ষেপে কিভাবে দেশে বিপর্যয় ঘটল, কিভাবে স্ত্রী ও একমাত্র সন্তান হারালাম, কি করে আমি পথে নামলাম, পথ কিভাবে আমাকে জার্মানীতে নিয়ে এল তার কাহিনী বললাম। থামলাম আমি।
সবাই নীরব। সবার চোখ আমার দিকে নিবদ্ধ। ক্যাথারিনারও। তাদের চোখে বিস্ময় ও বেদনা দু’টোই।
আমি চোখ নামিযে নীরব রইলাম।
কথা বলে উঠলেন আমার সাবেক মালিক ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক। বললেন, ‘তোমার ও তোমার স্ত্রী সন্তানদের এই মর্মান্তিক পরিণতির জন্যে আমি ও আমার পরিবারের পক্ষ থেকে গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি আলগার। তোমার এই দু:খের উপর এবং আজকের জগতের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার সর্বশ্রেষ্ট কেন্দ্র স্পেনের চিকিৎসা-বিজ্ঞানের রাজধানী কর্ডোভার সেরা ডাক্তারের উপর কষ্ট ও নির্যাতনের যে বোঝা চাপিয়েছিলাম, চিকিৎসকের সোনাফলা হতে শ্রমিকের যে বেলচা, কৃষকের যে কোদাল তুলে দিয়েছিলাম, তার জন্যে আমি ও আমরা গভীর দু:খ প্রকাশ করছি। তুমি তোমার মুসলিম পরিচয় ও কর্ডোভার চিকিৎসকের পরিচয় গোপন করে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ঠিকই করেছিলে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রসেডের যে উন্মত্ততা ইউরোপ ও জার্মানীতে চলেছিল তাতে তোমার মুসলিম পরিচয় নিরাপদ ছিল না। প্রথমে তোমার এই পরিচয় পেলে বড় শিকার পেয়েছি বলে আমিও হয়তো তোমাকে হত্যা করে ফেলতাম। কিন্তু অর্ধেক বছরের ছোট্ট সময়ে আমরা তোমাকে নানা অত্যাচার করলেও তুমি তোমার কাজ, কথা, ব্যবহার দ্বারা আমাদের মন জয় করে নিয়েছ। তা না হলে যাই পরিণতি হোক, আমার মেয়েকে দেখানো বা তার চিকিৎসার জন্যে তোমাকে অ্যালাও করতাম না। তোমার প্রতি আমার অনুরোধ আলগার, তোমাকে তোমার পরিচয় ও স্পেনের ডাক্তার হওয়ার পরিচয় এখনও গোপন রাখতে হবে। আলগার, এই মুহূর্তে আমি অনুভব করছি, যে ধর্ম তোমাকে এত সুন্দর, এত মহৎ বানিয়েছে, সেই ধর্ম আমাকে, আমাদেরকেও যেন জয় করে নিচ্ছে। কিন্তু বেটা, ক্রসেডের আবেগ-উন্মত্ততার সয়লাব এখনও ইউরোপ জুড়ে চলছে। তোমার আসল পরিচয় এখনো নিরাপদ নয়। আমার পরিবারের আমরা যারা এখানে উপস্থিত আছি তারা ছাড়া আর কেউ জানবে না তোমার এই পরিচয়।’
থামলেন আমার অভিভাবক। আমি খুশি হলাম তাঁর কথায়। তিনি ঠিক পরামর্শ আমাকে দিয়েছেন। শুধু দেশ জোড়া নয়, মহাদেশ জোড়া এমন বৈরী পরিবেশে ইসলাম মেনে চলা ও প্রচারের কাজ করতে হলে একটু ভিন্ন, একটু কৌশলী হতেই হবে। আমি বললাম আমার অভিভাবককে লক্ষ্য করে, আবারও আমি আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি সঠিক পরামর্শ দানের জন্য। আপনি যে পরামর্শ দিয়েছেন, সেটাই হবে। আমি থামলাম।
আমার পাশ থেকে আমার সাবেক মালিকের পত্নী, যাকে আমি মা বলে ডেকেছি, তিনি বলে উঠলেন, ‘আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ দিন আজ। আমি বেটা আলগারকে আমাদের পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে স্বাগত জানাচ্ছি। আমি আজকের দিনকে খানার এক বিশেষ আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদযাপন করতে চাই। আর ক্যাথারিনার বাবা নাইট ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিককে অনুরোধ করবো, আমাদের বাড়ি ও ফার্মল্যান্ডের সকল শ্রমিক, কর্মচারি, কর্মকর্তাকে একমাস বেতনের সমপরিমাণ অর্থ উপহার হিসেবে আজ দিয়ে দেয়ার জন্য।’
আমার সাবেক মালিকের স্ত্রী থামতেই আমার অভিভাবক মি. ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক বললেন, ‘ধন্যবাদ গ্রিটা, ক্যাথারিনার মা। তোমার দুই প্রস্তাবই আমি আনন্দের সাথে গ্রহণ করলাম এবং সম্রাটের ওখানে যাওয়ার সময় আমি রাত আটটা পর্যন্ত পিছিয়ে দিচ্ছি। বলে দিচ্ছি রাত ৮টায় সম্রাটের ওখান থেকে গাড়ি আসতে।’
‘বাবা, মা তোমাদের দু’জনকেই ধন্যবাদ। বিশেষ করে বাবাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি একজন মানুষকে তার মানবিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার মহৎ সিদ্ধান্তের জন্যে। এই সিদ্ধান্ত শুধু তাঁকে মুক্ত করেনি বাবা, আমাদেরকেও মুক্ত করেছে। যে দূর্বহ কালো পাথরটা বুকের উপর চেপে ছিল, তা আজ থেকে নেমে গেল বাবা।’ বলল ক্যাথারিনা আনত মুখে। শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে সে কেঁদে ফেলল।
‘ধন্যবাদ মা ক্যাথারিনা। ঈশ্বর আমাদের সকলকে সাহায্য করেছেন।’
কথা শেষ করে একটু থেমেই ক্যাথারিনার বাবা ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক বললেন, ‘আমরা এখন উঠছি। গ্রিটা, তুমি আলগারকে তিন তলায় তার থাকার নতুন জায়গায় নিয়ে যাও। আর…।’
কথা শেষ করতে পারলেন না তিনি। তার কথার মাঝখানেই কথা বলে উঠল ক্যাথারিনার মামা অসরিক রেডওয়ার্ল্ড। বলল, ‘বৈঠক শেষ হচ্ছে দেখছি? তৃতীয় একটা কথা ছিল আমার।’
‘তোমার আবার কি কথা? বল।’ বললেন আমারা সাবেক মালিক।
‘আপা ঠিকই বলেছেন, শ্রেষ্ঠ দিনগুলোর সর্বশ্রেষ্ঠ দিন আজ। এই মহান দিনের জন্যে উপযুক্ত আরেকটা বড় কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যাচ্ছে।’ বলে থামল অসরিক রেডওয়ার্ল্ড।
‘থামলে কেন, বল সে কাজটা কি? তোমার দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলবে না তো! তোমার বউ মরে যাবার পর থেকেই কিন্তু পাত্রী খুঁজছি। এখনও পাইনি। বল, কি বলবে।’ বললেন আমার সাবেক মালিক।
‘ঠিক ধরছেন দুলাভাই। বিয়ের কথাই, তবে আমার বিয়ে নয়। আমার স্নেহের একমাত্র ভাগ্নির বিয়ে।’ বলল অসরিক রেডওয়ার্ল্ড।
‘ভাগ্নি মানে? ক্যাথারিনার বিয়ে?’ জিজ্ঞাসা করলেন আমার সাবেক মালিক। তার চোখে-মুখে বিস্ময়।
‘হ্যাঁ দুলাভাই। আমাদের সকলের প্রিয়, আমাদের শ্রমিক কর্মচারিদের প্রিয় জোসেফ জ্যাকব আলগারের সব কাহিনী আমরা জানলাম। তার স্ত্রী-পুত্র পরিজন কেউ নেই। তিনি সব হারিয়েছেন। তিনি এখন একা। আমরা তাঁকে আমাদের পরিবারের একজন হিসেবে গ্রহণ করেছি। আমি তার সা্থে ক্যাথারিনার বিয়ের প্রস্তাব করছি। তারা দু’জনেই এখানে আছে। তারা একে অপরকে শুধু চেনেনই না, জানেনও। এখানে এই আলোচনা হতে পারে।’ থামল অসরিক রেডওয়ার্ল্ড।
সংগে সংগে কেউ কথা বলল না। সবাই নীরব।
আমি কোন কথা বলতে পারলাম না। গোটা দেহ মনে কেমন ভাবাবেশের সৃষ্টি হলো। ইদানীং ক্যাথারিনার সামনে পড়লে, তার সাথে যখন কথা বলেছি, সে সময় মনের দুয়ারে পরিচিত যে শংকা, অস্বস্তির উদয় ঘটত, তা এখন নগ্নভাবে সামনে এসেছে। আসলে সেটা অস্বস্তি ও শংকা ছিল না, সেটা ছিল একটা আশা-সম্ভাবনার প্রকাশ চাপা দেয়ার সলজ্জ প্রয়াস। ক্যাথারিনাকে আপন করে পাওয়া বা আপন করে নেওয়ারই আশা সেটা। অলক্ষ্যে অবচেতনায় কখন থেকে যেন আমি ক্যাথারিনাকে চাইতে শুরু করেছিলাম। অসরিক রেডওয়ার্ল্ডের প্রস্তাব মনের সে চাওয়াকেই নগ্নভাবে সামনে এনে দিল। আমার মুখে কোন কথা সরল না।
ক্যাথারিনাও কোন কথা বলল না। ক্যাথারিনা কি ভাবছে, সেটাও এই মুহূর্তে আমার মনে বড় হয়ে উঠল।
কথা বললেন আমার মনিব। বললেন, ‘হ্যাঁ, অসরিক রেডওয়ার্ল্ড, তুমি প্রস্তাব করতেই পার। কিন্তু ব্যাপারটা শুধু আমার পরিবারের সিদ্ধান্তের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। দু’জনের ব্যক্তিগত মতামতটাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। তাদেরকে কি আমি জিজ্ঞাসা করতে পারি, তারা এখন এখানে কিছু বলবে কি না?
‘বাবা, তোমাকে ধন্যবাদ মতামত জিজ্ঞাসা করার জন্যে। কিন্তু বিয়ে পিতা-মাতারাই দেন। কোন কোন ক্ষেত্রে, ছেলে-মেয়েরা তাদের মতামত জানায় মাত্র। অতএব তোমাদের সিদ্ধান্তই এখনও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ বলল ক্যাথারিনা। নরম, সলজ্জ কন্ঠ তার।
‘ধন্যবাদ ক্যাথারিনা। অসরিক বলেছে আমরা জানি, আলগার একা, তার পরিবার নেই, পিতা মাতা নেই। আলগার তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, আমি ও গ্রিটা কি তোমার পিতা-মাতা হতে পারি না?’ বললেন আমার অভিভাবক নরম ও স্নেহের সুরে।
কথাটার মধ্যে কি জাদু ছিল জানি না। অথবা আমার হৃদয়টাই স্নেহ বুভুক্ষু হয়েছিল কি না তাও জানি না। কথাটা শোনার সাথে সাথে আমার দুই গণ্ড অশ্রুতে ভরে গেল। সংগে সংগেই আমি বললাম, ‘অবশ্যই পারেন জনাব, যদি আপনারা সবহারা একজনের পিতা মাতা হতে চান। তাহলে আমি বলছি, ক্যাথারিনার উপর আপনাদের যে অধিকার, আমার উপরও আপনাদের সেই অধিকার থাকবে।’
‘ধন্যবাদ আলগার। তুমি ও ক্যাথারিনা একই কথা বলেছ। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। তোমাদেরকে বলছি, তোমরা যদি একে-অপরের হয়ে যেতে সম্মত হও তাহলে তোমাদের বাবা-মা আমরাই সবচেয়ে খুশি হবো এবং খুশি হয়েছি তোমাদের মত পেয়ে। এটাই আমরা সিদ্ধান্ত করলাম যে, আমরা সম্রাটের ওখান থেকে এসেই বিয়ের কাজটা সারব। ইতোমধ্যে গ্রিটা ও তার ভাই বিয়ের প্রস্তাবক অসরিক রেডওয়ার্ল্ড বিয়ের আয়োজনে কাজ করতে থাকবেন। আলগার ও ক্যাথারিনা তোমাদের আর কোন কথা আছে?’ বললেন ক্যাথারিনার বাবা আমার সাবেক মালিক।
একটা কথা কিছু আগে থেকে আমার মনে খোঁচা দিয়ে যাচ্ছে, সেটা হলো, আমার মুসলিম পরিচয় সম্পর্কে ক্যাথারিনার মত কি? এ বিষয়ে তার মন বা মতামত জানা হলো না। তাই মনিবের কথা শেষ হতেই আমি বললাম, ‘একটা কথা বাবা, ক্যাথারিনা জোসেফ জ্যাকব আলগার সম্পর্কে জানেন কিন্তু তার মুসলিম পরিচয় সম্পর্কে ক্যাথারিনার মত জানা হয়নি।’
ক্যাথারিনার বাবা কিছু বলার আগেই ক্যাথারিনা বলে উঠল, ‘বাবা, ওকে বল, উনি যে মুসলিম এ বিষয়টা আজ উনি বলার আগেই আমি জানতাম।’
‘তুমি কিভাবে জানলে মা, আমরা তো জানতে পারিনি।’ বললেন ক্যাথারিনার বাবা।
‘বাবা, আমি বেরুন বেকারের মাধ্যমে আমার বিভিন্ন বইয়ের কিছু কিছু অংশের ব্যাপারে ওর ব্যাখ্যা জানতে চাইতাম। উনি তা লিখে পাঠাতেন। তার এসব লেখার মধ্য দিয়ে আমার বিশ্বাস নিশ্চিত হয় যে উনি মুসলিম। তার আগে আমার চিকিৎসার সময় তিনি হাতের একটা বই ফেলে রেখে এসেছিলেন আমার ঘরে।
তার মধ্যে একখণ্ড কাগজ ছিল, তাতে ওর হাতের কিছু লেখা ছিল। সেটা পড়েই আমি প্রথমে বুঝতে পারি, উনি মুসলিম হতে পারেন।’ বলল ক্যাথারিনা।
ক্যাথারিনার কথায় আমারও মনে পড়ে গেল, এ রকম ঘটেছে। খুশি হলাম এই ভেবে যে, আমি মুসলিম জেনেই সে আমার ঘনিষ্ঠ হয়েছে।
ক্যাথারিনার বাবা বললেন, ‘এক সময় মুসলমানদের প্রতি আমার দারুণ বৈরীভাব ছিল। সেটা এখন আর নেই। মুসলমানরা খৃষ্টানদের মতই একত্ববাদী এবং তারা ক্যাথলিক খৃস্টানদের চেয়েও ধর্ম পালনে বেশি নিষ্ঠাবান। ক্যাথারিনা এখন কিংবা কখনো ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও আমাদের আপত্তি নেই।’ ‘আমি ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা করছি বাবা। জীবন্ত ধর্ম ইসলাম আমার ভালো লেগেছে।’ এ নিয়ে তোমার সাথে আলোচনা করব বাবা। বলল ক্যাথারিনা।
‘ধন্যবাদ ক্যাথারিনা।’
বলে সবার দিকে তাকিয়ে ক্যাথারিকার বাবা ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক বলল, তাহলে এবার সব কাজ আমাদের শেষ হলো। সত্যি আজ সর্বশ্রেষ্ট দিন আমারও জীবনে। উঠবো এবার আমরা। অসরিক রেডওয়ার্ল্ড ধন্যবাদ তোমাকে, একটা ভালো কাজ তুমি করলে।
না দুলাভাই, প্রতিদিনই আমি ভালো কাজ করি। তুমি দেখ না। শালা হওয়াই আমার অপরাধ।
ক্যাথারিনা ও ক্যাথারিনার মা মুখ টিপে হাসছিল।
শালার চেয়ে মধুর সম্পর্ক আর আছে নাকি, অপরাধ হবে কেন? বলে উঠে দাঁড়ালেন ক্যাথারিনার বাবা ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক। সবাই উঠল। আমিও উঠে দাঁড়ালাম।’’
‘সন্ধ্যার পর সম্রাট চতুর্থ অটোর পাঠানো রাজকীয় ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে আমরা যাত্রা করলাম।
আমরা নিজেদের ঘোড়ার গাড়িতে চড়েই যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সম্রাট নাকি বলেছেন, সম্রাটের ছেলেকে যিনি চিকিৎসা করবেন তিনি রাজকীয় সম্মান নিয়েই আসবেন।
দুইঘোড়ার গাড়ি। ৪টি সিট।
পেছনের দুই সিট প্রহরীদের জন্যে। দু’জন প্রহরী আগে থেকেই বসা ছিল সেখানে। সামনের দুটি ভিআইপি সিট। আমি ও আমার মালিক ক্যাথারিনার বাবা বাকি দু’টি আসনে বসলাম।
গেটে দাঁড়িয়ে আমাদের বিদায় জানাচ্ছিল বাড়ির সবাই। ক্যাথারিনাও হাজির ছিল।সকালের পর এই প্রথম দেখলাম ক্যাথারিনাকে। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে সে। বেরুন বেকার তার মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়েছিল। সে তার নানাকে টাটা দেখালো, পরে আমাকেও। আমিও বেরুন বেকারকে হাত নেড়ে টাটা দিলাম।
গাড়ি নড়ে উঠে চলতে শুরু করেছে। আমরা তখনও গেটে দাঁড়ানো সবার দিকে তাকিয়ে আছি। সবশেষে দেখলাম ক্যাথারিনার হাত উঠল আমার উদ্দেশ্যে। হাত নাড়ল আমাকে লক্ষ্য করে। আমিও জবাব দিলাম হাত নেড়ে। মনট আমার খুব প্রসন্ন হয়ে উঠল। মনে হলো, ক্যাথারিনার এমন একটা সাড়া পাবার জন্যে আমার অবচেতন মনের একটা আকাঙ্খা যেন উন্মুখ হয়েছিল।
ঘোড়ার গাড়ি চলছিল বেশ দ্রুত। রাস্তাটাও সম্রাটেরই তৈরি।
ক্যাথারিনার বাবা ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক ও আমি দু’জনেই নীরব ছিলাম। আর কারও কথা বলার কথাও নয়। ঘোড়ার গাড়ি চলার শব্দ ছাড়া কোন শব্দ নেই চারদিকে। নীরবতা ভেঙে ক্যাথারিনার বাবা এক সময় বলে উঠল, ‘সম্রাট খুব আস্থা ও আশা নিয়ে তোমাকে ডেকেছেন, তাই ভয় হচ্ছে আমরা তার আস্থা রাখতে পারবো কি না।’
আমি বললাম আমি সাধ্যমত চেষ্টা করব, এটুকুই আমরা বলতে পারি।’
‘তা ঠিক। তোমার উপর আমার আস্থা আছে। তোমার আসল পরিচয় পেয়ে আমার আস্থা বহুগুণ বেড়েছে। আমার মনে হচ্ছে তুমি পারবে, এই আশাই আমি করব।’ বলল ক্যাথারিনার বাবা ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক।
‘দোয়া করুন। মানুষ চেষ্টার মালিক। ফল আল্লাহ দেন।’ বললাম আমি।
‘হ্যাঁ আরগার। ঈশ্বরই সব কিছুর মালিক, সব কিছু তাঁরই নিয়ন্ত্রণাধীন।’ বলল ক্যাথারিনার বাবা।
একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘আমরা প্রায় এসে গেছি আলগার। সম্রাটের সাথে দেখা হলে তো সম্মান দেখাতে হয়। তা খেয়াল রেখো।’ বলল ক্যাথারিনার বাবা।
আমি বললাম, ‘এই সম্রাটকে সম্মান দেখানোর কি কোন বিশেষ নিয়ম আছে? আমি কিন্তু সেজদা করে বা মাথা নুইয়ে সম্মান দেখাতে পারি না।’
‘না, না আলগার। অন্য রাজা ও সম্রাটদের এই রীতি চালু আছে, কিন্তু স্যাক্সন সম্রাটরা, এমনকি স্যাক্সনরাও এটা করে না। তবে সম্রাটের শাসন ও শক্তির প্রতীক তার হাতের রাজদণ্ডকে চুমু খেতে হয়, এর বেশি কিছু নয়।’ বলল ক্যাথারিনার বাবা।
‘রাজদণ্ড মানে অলংকারখচিত সিংহ বা হাতি কিংবা ক্রস-এর মত কোন কিছুর প্রতীকসংবলিত সুশোভন লাঠি, এই তো?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
‘ঠিক বলেছ আলগার। তবে অলংকারখচিত সুশোভন লাঠি বা রাজদণ্ডটি হাতি বা সিংহমুখো নয়, কিংবা ‘ক্রস’ মাথাও নয়, বরং লাঠির মাথাটা মিনার আকৃতির। তবে মিরারের সূচালো মাথায় ক্রস নেই, আছে পাঁচ মাথ তারকা।’ বলল ক্যাথারিনার বাবা।
আমি বিস্মিত হলাম। বললাম, ‘রাজদণ্ডের মাথায় বাঘ, সিংহ, হাতি না থাক, ক্রস থাকারই কথা, যেমন পোপের আছে। তার বদলে তারকা কেন?’
‘ও তুমি জান না। স্যাক্সনরা বিশেষ করে স্যাক্সন রাজারা খৃস্টান নয়। স্যাক্সনদের রাজা রোমানদের দখলে যাবার পর বাধ্য হয়ে অনেকেই খৃস্টধর্ম গ্রহণ করে, অনেকেই আত্নপরিচয় গোপন করে ফেলে, আবার কেউ কেউ দেশ ত্যাগ করে। রোমান সম্রাট শার্লেম্যানের সময় খৃস্টানদের এই অত্যাচার ভয়াবহ আকারে শুরু হয় এবং চলতে থাকে। আমাদের সম্রাট চতুর্থ অটো রাজ্যহারা এক রাজকুমার। পরে নতুন এই স্যাক্সন ল্যান্ডে এসে তিনি রাজ্য স্থাপন করেন। আমরা নাইটরা খৃস্টান হয়েও তাঁকে সমর্থন করি। কারণ তিনি অত্যাচারী নন, স্বৈরাচারীও নন। সম্রাট হয়েও তিনি জনগণের একজন। দু’বছর পর পর তিনি নাগরিক সম্মেলন ডেকে তাদের কথা শোনেন এবং তার শাসনের ব্যাপারে তাদের রায় নেন। তার ছেলে যুবরাজ হয়েছে, তাও নাগরিক সম্মেলনের রায় অনুসারে। সম্রাট যুদ্ধের মত বড় কোন সিন্ধান্ত নিজে নেন না, নাগরিক সম্মেলন ডেকে নাগরিকদের রায় নিয়ে তা করেন।’
একটু হেসেছিলেন ক্যাথারিনার বাবা ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক। সেই সুযোগে আমি বলে উঠলাম, ‘স্যাক্সন সম্রাটরা তো দেখছি গণতান্ত্রিক, রোমান সম্রাটদের মত অত্যাচারী ও অটোক্র্যাট নয়।’
‘এই ঐতিহ্য স্যাক্সন সম্রাটদের নয়, এই ঐতিহ্য স্যাক্সনদের। আদি স্যাক্সন সমাজ ছিল গণতান্ত্রিক সমাজ। খৃস্টান রোমানরা স্যাক্সন রাজ্য লণ্ডভণ্ড করার পরও সেই ঐতিহ্যের কিছু এখনও অবশিষ্ট আছে।’ বলল ক্যাথারিনার বাবা।
‘ধন্যবাদ স্যাক্সন ও স্যাক্সন সম্রাটদের। আমাদের ইসলামী সমাজও গণতান্ত্রিক সমাজ।’
‘হ্যাঁ, আমরা এসে গেছি। ঐ তো সম্রাটের প্রাসাদের উঁচু গেট দেখা যাচ্ছে।’ বলল ক্যাথারিনার বাবা।
আমরা এসে গেলাম সম্রাটের প্রাসাদে। প্রাসাদের গেটে ছোট একটা ঘোড়সওয়ার দল ছিল আমাদের স্বাগত জানাবার জন্যে। তারা আমাদের স্বাগত জানাল। আমরা গেটে পৌঁছার সাথে সাথেই একজন ঘোড়সওয়ার ছুটল প্রাসাদে সম্রাটকে খবর দেয়ার জন্যে। কিছুক্ষণ পরেই প্রাসাদের একজন অফিসার এলেন আমাদের নেবার জন্যে। তার সাথে রাজপ্রাসাদের ভেতরে চললাম। অফিসারটি জানাল, সম্রাট আজ দরবারের কাজ মুলতবি করেছেন এবং প্রাসাদের রাজকীয় চিকিৎসা ও সেবা বিভাগে যুবরাজকে নিয়ে অপেক্ষ করছেন।
আমাদের সরাসরি রাজপ্রাসাদের চিকিৎসা ও সেবা বিভাগে নিয়ে যাওয়া হলো।
সেখানে পৌঁছলে সম্রাট চতুর্থ অটো’র প্রধান স্টাফ অফিসার আমাদেরকে একটা বিশ্রাম কক্ষে নিয়ে গেলেন। একটু বিশ্রাম নিয়ে হাত-পা ধুয়ে ফ্রেশ হবার পর আমাদেরকে ডিনারের টেবিলে নিয়ে যাওয়া হলো। ডিনারের টেবিলে খোদ সম্রাট এলেন। বিস্ময়ে হতবাক আমরা উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শনের জন্যে তার দিকে এগোচ্ছিলাম। সম্রাট হাত দিয়ে এগোতে নিষেধ করে আমাদের স্বাগত জানিয়ে বললেন, খাবার টেবিলে বসে উঠতে নেই। আসুন আমরা ডিনার সেরে নেই।
রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে সম্রাটের সাথে বসে ডিনার করলাম। মনে পড়ে গেল আমার দীন-দুনিয়ার বাদশাহ আমার রাসূলের (স.) কথা, সোনালি যুগের সোনার মানুষ খলিফা আবু বকর (রা.), খলিফা ওমর (রা.)-দের কথা। তাঁরা শাসক হয়েও মানুষের সেবক ছিলেন। তাঁদের স্থান ছিল মানুষের কাতারে, ক্লান্ত হলে শয্যা হতো খেজুর গাছের নিচে বালির উপর, নাগরিকরা যখন ঘুমিয়ে, তখন তাঁরা মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াতো তাদের অবস্থা জানার জন্যে, চাকরের সাথে পালা করে উটের পিঠে চড়েছেন, আবার রশি ধরে উটকে টেনে নিয়েছেন, তাঁদের সিংহাসন ছিল খেজুরের চাটাই। কিন্তু তাঁদের ব্যক্তিত্ব, প্রজ্ঞা কম্পন জাগাতো রোম সম্রাট, গ্রীক সম্রাট ও পারস্য সম্রাটদের হৃদয়ে। তাঁদের সে আদর্শেরই কিঞ্চিত একটা রূপ দেখলাম স্যাক্সন সম্রাট চতুর্থ অটো’র মধ্যে। আমার চোখের কোণ ভিজে উঠছে। আমি বললাম সম্রাটকে লক্ষ্য করে, ‘এক্সিলেন্সি, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে, আপনার সাথে বসে খাওয়ার সৌভাগ্য হলো।’
সম্রাট চতুর্থ অটো’র চোখে-মুখে একটা সূক্ষ্ণ প্রসন্নতা ফুটে উঠল। বলল, ‘ধন্যবাদ ডক্টর যে আপনি একে সৌভাগ্য বলছেন।
আসলে আমাদের স্যাক্সনদের জন্যে এটা স্বাভাবিক বিষয়। আমি সম্রাট, সেটা সামাজিক সিস্টেম হিসেবে। জনগণের সামষ্টিক ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা। স্বতন্ত্র কোন ইচ্ছা আমার নেই।’
‘ধন্যবাদ, এক্সিলেন্সি। এভাবে মানুষের মনের সম্রাট হওয়া যায়।
শাসক সম্রাটের চাইতে মনের সম্রাট অনেক বেশি শক্তিশালী। ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি।’ আমি বললাম সম্রাটকে লক্ষ্য করে।
সম্রাট চোখ তুলে আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। বললেন, ‘ডক্টর আপনি সাংঘাতিক কথা বলেছেন। সম্পূর্ণ নতুন পরিভাষা, সম্পূর্ণ নতুন প্রকাশ। আপনি কোথায় লেখাপড়া করেছেন?’
হঠাৎ আমার মুখ ফসকেই বেরিয়ে গেল, ‘স্পেনে লেখাপড়া করেছি।’
‘স্পেনে?’ বলে সম্রাট উঠে দাঁড়ালেন। তার চোখে-মুখে বিস্ময়ের বিস্ফোরণ। তার দুই চোখের স্থির দৃষ্টি আমার উপর নিবদ্ধ। আমার জন্যে আশার কথা যে, তার সে দৃষ্টিতে বিদ্বেষ, ঘৃণা বা হিংসার প্রকাশ নেই। আছে সবিস্ময় অনুসন্ধান।
সম্রাটের সাথে সাথে আমরাও উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। সম্রাট ধীরে ধীরে বসলেন। আমরাও বসলাম।
বসার সাথে সম্রাট তাঁর দুই চোখ বন্ধ করেছেন। আত্নস্থ হওয়ার প্রকাশ তার চোখে-মুখে। অনেক মুহূর্ত পার হলো।
সম্রাট চোখ খুললেন। বললেন, ‘ডক্টর, আপনার সাথে কি ওখানকার শাসকদের কারও কখনও দেখা হয়েছে? নিজ মুখে ওদের কথা-বার্তা শুনেছেন কখনও?’ বললেন সম্রাট।
‘হ্যাঁ, এক্সিলেন্সি। আমি তাঁদের দেখেছি, কথাও শুনেছি তাঁদের। বললাম আমি।
‘ওরা মানুষ কেমন? শুনেছি, শাসন নাকি ওদের আগের মত নেই!’ বললেন সম্রাট।
‘এক্সিলেন্সি ঠিকই শুনেছেন। ওরা মানুষ হিসেবে এখনও ভালো। তবে শাসক হলে তাদের মধ্যে ধীরে ধীরে যে দোষ-ক্রটি ঢোকে তা তারা মুক্ত থাকতে পারেনি। এ কারণেই তাদের শাসনও আগের মত নেই। বিভেদ-বিতর্ক ও হানাহানি তাদের নিজেদের মধ্যে বেড়েছে। সে কারণে তারা দুর্বলও হয়ে পড়েছে। দুর্বলতার কারণে তাদের রাজ্যও সংকুচিত হয়ে পড়েছে।’ বললাম আমি।
সম্রাট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বললেন, ‘আমরা এক সময় ওদের উপর অনেক নির্ভর করেছিলাম, অনেক আশা করেছিলাম। আমাদের পূর্বপুরুষরা আশা করেছিলেন, তারা ও আমরা মিলে ইউরোপে একটা উদার ও মানবিক রাজ্যের প্রতিষ্টা করব। কিন্তু তা হয়নি।’
বিস্ময়ে আমার অবাক হয়ে যাবার পালা। সম্রাট এ কি বলছেন। স্পেনের মুসলিম সুলতানদের সাথে মিলে স্যাক্সন সম্রাটরা কিছু করতে চেয়েছিলেন? বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে আমি বললাম, ‘এক্সিলেন্সি, দয়া করে কি বলবেন, স্পেনের মুসলিম সুলতানদের সাথে মিলে আপনাদের কিছু করার ব্যাপারটা কিভাবে ঘটেছিল, মাঝখানের বিশাল দূরত্ব ডিঙিয়ে?’
‘ডক্টর, প্রয়োজনের তাকিদে আমার পূর্বপুরুষ প্রথম অটো, তারপর দ্বিতীয় অটো এই বিশাল দূরত্ব ডিঙিয়ে তাদের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। বলেছি, আমাদের প্রয়োজনেই আমরা এটা করেছিলাম। আমাদের স্যাক্সনদের প্রথম সম্রাট অটো ‘দি গ্রেট স্পেনের মুসলিম সুলতান তৃতীয় আবদুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। যোগাযোগ ছিল একটা ঘটনা উপলক্ষ্যে। স্পেনের সুলতানের সৈন্যরা আলপস-এর অনেকগুলো আলপাইন গিরিপথ দখল করে নিয়েছিল। তার ফলে সওদাগরী কাফেলার যাতায়াত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সুলতানের সৈন্যরা আলপাইনের গিরিপথগুলো ছেড়ে দেয় অথবা সওদাগরী কাফেলাকে নিরাপদে যাতায়াত করতে দেয়, এই অনুরোধ নিয়েই স্যাক্সন সম্রাট প্রথম অটো ৯৫৩ খৃস্টাব্দে সুলতান আবদুর রহমানের রাজধানী কর্ডোভায় একটা প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিলেন। প্রতিনিধিদল এক মাস কর্ডোভায় ছিলেন। সুলতান তৃতীয় আব্দুর রহমান সম্রাট প্রথম অটো’র সম্মান রেখেছিলেন। একমাস পর প্রতিনিধিদলটি জার্মানীতে ফিরে এলে তাদের কাছে স্পেনের সুলতানদের কাহিনী শুনেছিলেন। এটা সম্রাট প্রথম অটোকে যারপরনাই আনন্দিত ও প্রভাবিত করেছিল। তিনি দেখেছিলেন মুসলমানদের সাথে স্যাক্সনদের অনেক মিল। স্যাক্সনদের মতই মুসলমানরা সরল জীবন যাপন করে। কোন আশরাফ-আতরাফের ব্যবধান তাদের মধ্যে নেই স্যাক্সদের মতই। সুলতান বা সম্রাটকে মুসলমানরা মনিব বা ঈশ্বরের মত করে ভাবে না, শাসককে সাথী বা ভাই মনে করে। স্যাক্সনদের রাজা-সম্রাটরাও তাই। স্যাক্সনদের মতই
মুসলমানরা কোন মূর্তি বা প্রতিকৃতিকে দেবতা মানে না।মুসলমানদের প্রার্থনা গৃহের মিনারগুলো স্যাক্সনদের মিনারের মতই আকাশচুম্বী উঁচু। আরও শুনেছিলেন প্রতিনিধিদলের কাছে যে, রোমান ও গ্রীক সম্রাটরা মুসলমানদের ভয় করে। মুসলিম সুলতানদের এই শক্তির কথা শুনে সম্রাট অটোর হৃদয়ে একটা পুরানো কথা মাথাচড়া দিয়ে উঠেছিল, সেটা হলো স্যাক্সনদের উপর রোমক খৃস্টানদের নৃশংস হামলা, আক্রমণ ও অবর্ণনীয় অত্যাচার। ৭৮২ সালে শার্লেম্যানের খৃস্টান বাহিনী একদিনে ৪ হাজার ৫শ’ স্যাক্সনকে পশুর মত হত্যা করেছিল। শার্লেম্যানের এই বাহিনীর কাছে স্যাক্সনদের মৃত্যুর বিকল্প ছিল খৃস্টধর্ম গ্রহণ করা। রাজনৈতিক সম্রাটের পরিবারও সেই খৃস্টধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। সেই সূত্রে এখন তারা খৃস্টান। কিন্তু এই বীভৎস অতীতকে স্যাক্সনরা ভোলেনি। শার্লেম্যানের বাহিনী তাদের হত্যা ও খৃস্টীয়করণই শুধু নয়, স্যাক্সনদের সমাজ, সংস্কৃতি সবই ধ্বংস করেছে। আইন করে মিনার তৈরি নিষিদ্ধ করেছে। অতীতের এই দু:সহ বেদনা-তাড়িত স্মৃতি আমার পূর্বপুরুষ সম্রাট প্রথম অটোকে এক প্রতিকার চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। তিনি ভেবেছিলেন, রোমানদের অত্যাচার-আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্যে স্পেনের সুলতানদের সাথে ঐক্য গড়া যায়। এই ঐক্য একটা বিরাট শক্তি হিসেবে দেখা দেবে। যেই ভাবা সেই কাজ। তিনি স্পেনের সুলতান তৃতীয় আবদুর রহমানের কাছে আরও একটা প্রতিনিধিদল পাঠালেন। একটা চিঠি পাঠালেন তিনি সুলতান তৃতীয় আবদুর রহমানের উদ্দেশ্যে। এবারও মাসখানেক পর প্রতিনিধিদল ফিরে এল সুলতান আবদুর রহমানের একটা চিঠি নিয়। চিঠিতে সুলতান আবদুর রহমান সম্রাট প্রথম অটোকে যা লিখেছিলেন তার সারকথা হলো, ‘সম্রাটের বক্তব্য ও মতামতকে স্পেনের খিলাফত সাদরে গ্রহণ করেছে। আল্লাহর রাসূল (সঃ)-এর উত্তরসূরি এই খিলাফত জাতিগতসহ সকল অত্যাচার-অবিচারের বিরোধী। যে ঐক্য-সহযোগিতা মানুষের শান্তি, মর্যাদা ও সমৃদ্ধির স্বার্থে, আমরা তার পক্ষে। এ নীতির ভিত্তিতে সম্রাটের সাথে আমাদের ঐক্য ও সহযোগিতা হতে পারে। এই লক্ষ্যে সম্রাটের সাথে আমাদের আরও আলোচনা চলবে। ইতিমধ্যে আমরা একে-অপরের শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি লক্ষ্য রাখব।’ এই চিঠি পেয়ে সম্রাট খুব খুশি হয়েছিলেন।
আলোচনা শুরু হয়েছিল এবং অনেক দূর এগিয়েছিল। কিন্তু ৯৬১ সালে সুলতান তৃতীয় আবদুর রহমানের মৃত্যু হলে আলোচনায় ছেদ পড়ে। অন্য দিকে একটা দুর্ঘটনা ঘটে। সুলতান তৃতীয় আবদুর রহমানের উত্তরসূরি দ্বিতীয় হাকামের কাছে লেখা কনডোলেন্স ও আবার আলোচনা শুরু সংক্রান্ত প্রথম অটোর একটা চিঠি পথে সম্রাটের প্রতিনিধিদলের কাছ থেকে চুরি হয়ে যায় এবং তা পোপের হাতে পড়ে। তারপর তা পোপের হাত থেকে ক্রসেডারদের হাতে চলে যায়। সম্রাট অটো স্পেনের মুর সুলতানদের সাথে মিলে পোপ ও ক্রসেডারদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। হৈ চৈ শুরু করা হলো ইউরোপ জুড়ে। জার্মানীদের না্ইটদের খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করা হলো। এই অবস্থায় সম্রাট অটো পরিস্থিতিকে শান্ত করার জন্যে চুপ হয়ে যান এবং স্পেনের সাথে যোগাযোগ আপাতত বন্ধ করে দেন। ক’বছর পর আবার যখন যোগাযোগ শুরু করতে যাবেন, তখন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সে অসুখেই ৯৭৩ সালে তিনি মারা গেলেন। এভাবে সম্রাট প্রথম অটোর একটা স্বপ্ন একের পর এক ধাক্কা খেয়ে পেছনে পড়ে গেল, যা আর সামনে আনা যায়নি।’
থামলেন সম্রাট চতুর্থ অটো। উঠে দাঁড়ালো। পায়চারি করতে করতে বলল, ‘আমার উত্তরসূরিদের সে স্বপ্ন সফল হয়নি, কিন্তু স্বপ্নটির কথা আমরা ভুলে যাইনি। আপনার ডাক্তারী শিক্ষা এবং বাড়ির ঠিকানা কর্ডোভায় শুনে সেই অতৃপ্ত স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেছে। যাক, আমি খুশি হয়েছি।’
‘এক্সিলেন্সি, আমি খুশি হয়েছি আপনার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হওয়ায়। আমি আরও খুশি হয়েছি কর্ডোভা ও স্পেনের সুলতানদের সাথে আপনাদের পুরানো সম্পর্কের ইতিহাস শুনে। দুই পক্ষের এই স্বপ্ন সফল হলে আমার মনে হয় দুই পক্ষই উপকৃত হতো।’ আমি বললাম।
‘উপকৃত মানে? ইতিহাস অন্যভাবে লিখিত হতে পারতো। অটো’দের সাম্রাজ্য তাহলে অত তাড়াতাড়ি ধ্বংস হতো না এবং প্রায় দু’শ বছর অটো পরিবারকে রাজ্যহারা অবস্থায় ঘুরে বেড়াতে হতো না।
অন্য দিকে স্পেনের সুলতানরাও খৃস্টান রাজাদের অনেক জ্বালাতন থেকে বাঁচতেন।’ বলল সম্রাট চতুর্থ অটো।
থামলেন সম্রাট। ঘুরে তাকালেন ক্যাথারিনার বাবা ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিকের দিকে। বললেন, ‘আসুন, যুবরাজ অপেক্ষা করছেন।’ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আসুন ডক্টর।’
বলে চলতে লাগলেন তিনি। আমরা তার পিছু পিছু চললাম। বড় একটা সুসজ্জিত ঘর। দুগ্ধফেনা সদৃশ শয্যায় শুয়ে আছে এক সুদর্শন যুবক। চোখ বুজে শুয়ে আছে সে।
তার মাথার পেছনে একজন নার্স দাঁড়িয়ে আছে এ্যাটেনশন অবস্থায়। দরজায় ছিল দু’জন পরিচারিকা। সম্রাট ও আমাদেরকে দেখেই কুর্নিশ করে দু’পাশে সরে দাঁড়িয়েছিল তারা।
সম্রাটের পেছনে আমরাও ঘরের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালাম।
‘সম্রাট যুবকটিকে দেখিয়ে আমাকে বললেন, ‘ডক্টর এই আমার একমাত্র ছেলে, যুবরাজ পঞ্চম অটো।’
আমি এগিয়ে গেলাম বিছানার দিকে।
যুবরাজ উঠতে যাচ্ছিলেন। দু’জন নার্স ছুটে এসে যুবরাজকে ধরে বসিয়ে দিতে গেল।
আমি দ্রুত কন্ঠে বললাম ‘প্লিজ এক্সিলেন্সি, যুবরাজ। প্লিজ, আপনি উঠবেন না।’ বলে আমি ধরে তাকে আস্তে আস্তে করে শুইয়ে দিলাম।
.আমি উঠে দাঁড়িয়ে সম্রাটের দিকে চেয়ে বললাম, ‘এক্সিলেন্সি, আমি কি যুবরাজকে দেখতে পারি?’
সম্রাট চতুর্থ অটো সুশোভিত একটা চেয়ারে গিয়ে বসেছেন। বললেন, ‘হ্যাঁ ডক্টর, প্লিজ শুরু করুন।’
ক্যাথারিনার বাবাও সম্রাটের পেছনে আরেকটা চেয়ারে গিয়ে বসেছেন সম্রাটের নির্দেশে।
আমি যুবরাজের পাশে গিয়ে বসলাম। বললাম নরম স্নেহের সুরে, ‘এক্সিলেন্সি যুবরাজ, আমি একজন ডাক্তার। আপনার প্রতি অসীম শুভেচ্ছা নিয়ে আল্লাহর নামে আমি আমার কাজ শুরু করতে চাই। প্লিজ যুবরাজ আমাকে অনুমতি দিন, আপনার সহযোগিতা আমি চাই।’
যুবরাজ ম্লান হাসলেন। বললেন, ‘আপনাকে ওয়েলকাম, যদিও চিকিৎসার প্রতি আমার আগের সেই আস্থা নেই। তবু সব সহযোগিতা আমি করব। আমার জন্যে কষ্ট করার জন্যে আপনাকে আগাম ধন্যবাদ।’
‘ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি। আমি প্রথমে দুই চোখ ভালো করে দেখবো। তারপর দরকার হলে কিছু জিজ্ঞাসা করব। তারপর সব অবস্থা দেখে সামনে এগোবো।’
পরীক্ষা শুরু করলাম আমি। আমি যুবরাজের দুই চোখের ভেতরের অবস্থা দেখলাম। আমি বিস্মিত হলাম দেখে যে, যুবরাজের দুই চোখের দুই আইবলসহ চোখের সব অবস্থা স্বাভাবিক। একটাই অস্বাভাবিকতা দেখলাম। সেটা হলো, দুই চোখেরই আইবলসহ ভেতরটা শুকনো এবং চোখের আইবলে কোন রিফ্লেকশন নেই। আমি নার্সকে একটা সুচ আনতে বললাম। নার্স দৌড়ে গিয়ে সুচ এনে আমাকে দিল। আমি সুচটা দেখে নার্সকে সেটা আগুনে জীবাণুমুক্ত করে দিতে বললাম। নার্স সুচটা পুড়িয়ে নিয়ে এল। আমি যুবরাজকে বললাম, প্লিজ যুবরাজ, চোখে যতবার আঘাত পাবেন, কথা বলবেন প্লিজ। চোখের আইলিডসহ চোখের ভেতরটায় প্রযোজনীয় অনুভুতিপ্রবণ অংশগুলোতে সুচের আগা দিয়ে আঘাত করে দেখলাম যুবরাজ প্রতিটাতেই রেসপন্স করছেন। আমি বিস্মিত হলাম চোখের স্নায়ুগুলো সব জীবিত আছে! তাহলে দুই চোখ শুষ্ক কেন? চোখের আইবলে রেসপন্স নেই কেন? তাহলে চোখের কালেকটিভ টিস্যু এবং দৃশ্য প্রবাহ মণিকে বহন ও বিতরণকারী গ্রন্থিগুলোতেই কি সমস্যা? কিন্তু পরীক্ষাটা একটু কঠিন ও কষ্টকর। আমি নার্সদের দিকে চাইলাম। বললাম এর চেয়েও সূক্ষ্ণ সুচ কি পাওয়া যাবে? নার্স বলল, স্যার, এ ধরনের সুচ নেই, তবে আকুপাংচারের সুচ আছে। আকুপাংচারের কতকগুলো সুচ অনেক লম্বা, খু্বই সূক্ষ্ণ।
আমি খুশি হয়ে বললাম , ‘ধন্যবাদ নার্স। ওগুলো আরও ভালো, বেশি কাজের। নিয়ে এস, দ্রুত।’ নার্স নিয়ে এল সুচ। সুচগুলোকে আগুনে সেঁকে জীবাণুমুক্ত করে নিয়ে এসেছে নার্স। আমি ধন্যবাদ দিয়ে সুচ হাতে নিলাম। যুবরাজের দুই চোখের উপরের দিকটায় মাপজোখ করে দুই চোখের তিনটি করে জায়গা ঠিক করলাম পরীক্ষার জন্যে। চোখের আইবলের গোড়ার দিক থেকে যে সূক্ষ্ণ সেলের অংশ মস্তিষ্কের সাথে সংযুক্ত, সেগুলো চোখে প্রতিবিম্বিত হওয়া ইনফরমেশনকে
মস্তিষ্কে পৌঁছায় এবং মস্তিষ্ক সে ইনফরমেশনকে দৃশ্যে পরিণত করে চোখে পাঠায়। সুতরাং এই সেলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে চোখ ও মস্তিষ্কের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থায় চোখ ও আইবল ভালো থাকলেও চোখ কিছুই দেখতে পায় না। আমি এই সেলগুলো পরীক্ষারই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্রস্তুত হয়ে আমি যুবরাজকে বললাম, ‘এক্সিলেন্সি, যুবরাজ, আপনি রোমে সামরিক ট্রেনিং নিয়েছেন। ট্রেনিং-এ শারীরিক ও মানসিক সহ্য-শক্তিরও পরীক্ষা নেয়া হয়। দেহে সুচ ফোটানোর কোন ট্রেনিং কি আপনার হয়েছে?’ যুবরাজ হাসলেন। বললেন, ‘ডক্টর নিশ্চয় কোথাও সুচ ফোটাতে চাচ্ছেন। যাই করুন ডক্টর আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।’
‘ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি।’ বললাম আমি। কাজ শুরুর আগে আবার আমি বললাম, ‘এক্সলেন্সি, এবার আপনার আরও ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা চাই। সুচ চামড়া ভেদ করার সময় ব্যথা লাগবে, অবশ্যই, কিন্তু তারপর সুচের আগা যে দিক দিয়ে এবং যেখানে গিয়ে থামছে সে স্থানগুলোতে ব্যথা লাগছে কি না সেটা আমি জানতে চাই। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।’
যুবরাজ বললেন, ‘ইয়েস ডক্টর, গড ব্লেস আস।’
প্রত্যেক চোখের আইবলের পেছনে নির্দিষ্ট স্থান বরাবর উপরে তিনটি ডট ঠিক করে নিলাম। প্রথমে দুই চোখের মাঝের দুই ডটে সুচ প্রবেশ করালাম। যুবরাজ বললেন, ‘চামড়ার অংশ ফুটো হবার সময় সামান্য কিছু অংশে ব্যথা বোধ করেছি, তারপর আর কোন ব্যথা লাগেনি।‘ আমি যুবরাজকে ধন্যবাদ দেবার পর ভেতরে ঢুকে যাওয়া সুচের দৈর্ঘ্য পরখ করে বুঝলাম চোখ ও মুস্তষ্কের সংযোগবিধানকারী সেলগুলোতে কোন অনুভূতি নেই। যুবরাজের অন্ধত্বের কারণ আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। নিশ্চিত হবার পরও অবশিষ্ট চার পয়েন্টে আমি সুচ প্রবেশ করালাম। রেজাল্ট একই হলো। তবে একটা সুখবরও মিলল।সেটা হলো, ডান চোখের ডানের ডটে এবং বাম চোখের বামের ডটে সুচ ঢোকানোর সময় সুচের আগা সামান্য গেলেও যুবরাজ কিছু ব্যথা অনুভব করেছেন।এর অর্থ চোখ ও মস্তিষ্কের যোগাযোগ মাধ্যম সেল সবটাই সম্পূর্ণ মরে যায়নি। এটা আমার জন্যে বিরাট সুখবর। স্নায়ু ও সূক্ষ্ণ সেল শীতলকারী সেই সাথে এ্যান্টিসেপটিক একটা ভেষজ নির্যাস যুবরাজের চোখের উপরের অংশের আহত স্থানগুলোতে মালিশ করে দিয়ে আমি বললাম, ‘এক্সিলেন্সি, আমি শুনেছিলাম আপনি কিছুই দেখতে পান না, কিন্তু মনে হচ্ছে আপনি সামান্য কিছু দেখতে পান। বিশেষ করে বাম চোখের বাম দিক এবং ডান চোখের ডান দিক দিয়ে কিছুটা দেখতে পান আপনি।’
‘হ্যাঁ ডক্টর, খুব সামান্য দেখতে পাই। কোন কিছুর ধোঁয়াটে একাংশ। কিন্তু ডক্টর আপনি এটা জানলেন কি করে? খুব উল্লেখযোগ্য নয় বলে কাউকে আমি জানানোর প্রয়োজন বোধ করিনি।’ বলল যুবরাজ।
‘এক্সিলেন্সি যুবরাজ, আমি যে পরীক্ষা করলাম তাতে আমি এটা বুঝতে পেরেছি।’
বলে উঠে দাঁড়িয়ে আমি সম্রাটের দিকে ফিরলাম। দেখলাম চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে তিনি তাকিয়ে আছেন। আমি তার দিকে ফিরতেই তিনি বললেন, ‘ডক্টর আপনি সুচ দিয়ে ফুঁড়েই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন। কিভাবে?’
আমি বললাম, ‘এক্সেলেন্সি সম্রাট, এটা আমি পরে বলছি। তার আগে একটা কথা বলি, এক্সিলেন্সি যুবরাজের চোখের আঙ্গিকে কোন ক্ষত আমি দেখতে পাচ্ছি না। চোখের দৃশ্যমান সব অঙ্গই সেনসেটিভ। চোখ দু’টি শুকনো এবং আইবলে রিফ্লেকশান নেই এটাই শুধুমাত্র ব্যতিক্রম। এক্সিলেন্সি, আসল সমস্যা, চোখের পেছন থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত সংযোগকারী সেলগুলোতে। এই সেলগুলো রেসপন্স করছে না, সাড়া দিচ্ছে না। এক্সিলেন্সি, আপনার প্রশ্নের উত্তর হলো, সাড়া না দেয়া এই সেলগুলোর মধ্যে বাঁ চোখের বাঁ দিকের এবং ডান চোখের ডান দিকের সেলের একটা অংশ সাড়া দিচ্ছে। সুচ দিয়ে যখন এ সেলগুলোতে আঘাত করা হয়েছে, তখন যুবরাজ কিছুটা ব্যথা অনুভব করেছেন।’
সম্রাট অটো দাঁড়িয়ে গেছেন। বললেন, ‘এর দ্বারা কি বুঝা যাচ্ছে ডক্টর? যুবরাজের চোখ ভালো হবে কি না?’
‘এক্সিলেন্সি আমি চোখের অবস্থা জানার চেষ্টা করছি। চোখের অসুবিধাটা কোথায়, কি কারণে চোখ কিছু দেখতে পায় না, সেটা আমার কাছে বোধ হয় পরিষ্কার। চোখ ও মস্তিষ্কের সংযোগকারী সূক্ষ্ণ সেলের কণিকাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটাই চোখে না দেখার কারণ।
একটা আশার কথা হলো যে, সেলগুলোর কিছুটা এখনও সক্রিয় রয়েছে।’ আমি বললাম।
‘ধন্যবাদ ডক্টর। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। যুবরাজের অনেক চিকিৎসা আমি করিয়েছি, কিন্তু কেউ চোখের এমন পরীক্ষা করেনি এবং চোখে কেন দেখতে পায় না তার কারণ কি তা কেউ বলেনি। আপনিই প্রথম একটা কারণের কথা বললেন। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ডক্টর। আমি হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। আপনার কথা আমাকে আনন্দিত ও আশান্বিত করেছে।’ বলল সম্রাট অটো।
‘এক্সিলেন্সি যুবরাজকে আমার আরও কতকগুলো প্রশ্ন আছে। আমার খুব অবাক লাগছে চোখ ও মাথার সংযোগকারী মাঝের সেলগুলো এই ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো কি করে?’ আমি বললাম।
‘হ্যাঁ ডক্টর, কি জানতে চান আপনি জিজ্ঞাসা করুন। আমাদের উপস্থিতিতে তো সমস্যা নেই?’ বললেন সম্রাট চতুর্থ অটো।
‘না, না এক্সিলেন্সি, আপনাকেও দরকার। আমি যা জানতে চাই তা আপনি জানতে পারেন।’
বলে একটু থেমেই আবার বললাম, ‘এক্সিলেন্সি সম্রাট এবং যুবরাজ, আমার মনে হয় প্রচণ্ড একটা শক-এর কারণে চোখ ও মস্তিষ্কের মাঝের সেলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যুবরাজ চোখে এ ধরনের কোন শক পেয়েছিলেন কি না?’
যুবরাজই দ্রুত বললেন, ‘ডক্টর, চোখে কিসের শক, কি ধরনের শক?’
আমি বললাম, ‘তীব্র আলোর শকেই এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে।’
‘আলোর শক? এ ধরনের বড় কোন ঘটনা তো ঘটেনি। যুবরাজ দু’বছর রোমে ছিলেন। এ সময় কি এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটেছে যুবরাজ?’ বললেন সম্রাট চতুর্থ অটো।
যুবরাজ বললেন, ‘এমন কোন ঘটনার কথা তো মনে পড়ছে না।’
আমি বললাম, ‘যুবরাজ আপনি কি বিদ্যুৎ চমকের দিকে কখনও পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন?’
‘না ডক্টর, এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটেনি।‘
‘কখন থেকে আপনি চোখের অসুবিধা অনুভব করে আসছেন যুবরাজ?’ বললাম আমি।
‘গত বছরের নভেম্বরের দিক মানে প্রায় এক বছর আগে থেকে চোখের অসুবিধা অনুভব করছি ডক্টর।’ বলল যুবরাজ।
‘গত বছরের নভেম্বর থেকে।’ কথা শুনেই আমার মনে পড়ে গেল অক্টোবর মাসের সূর্যগ্রহণের ঘটনার কথা। আমি দ্রুত কন্ঠে বললাম, ‘যুবরাজ, গত বছর অক্টোবর মাসে সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। আপনি কি ঐ সূর্যগ্রহণ দেখেছিলেন?’
আমার প্রশ্ন শুনেই যুবরাজ উঠে বসলেন। বললেন, ‘ঠিক ডক্টর, আমি সূর্যগ্রহণ দেখেছিলাম। তখন চোখে সামান্য অসুবিধা হয়েছিল। পরে তা ঠিক হয়ে যায়।’
‘কি ঘটেছিল?’ বললাম আমি।
‘একটা মাটির বড় প্লেটে পানি নিয়ে সবার মত আমিও সূর্যগ্রহণ দেখছিলাম। দেখার পর আমার চোখটা ঝাপসা হয়ে যায়। তবে সন্ধ্যার মধ্যেই আবার চোখ ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যায়।’ বললেন যুবরাজ।
‘ঠিক হয়ে যায়নি যুবরাজ। প্রাথমিক আঘাতের পর যে ঝাপসা ভাবটা ছিল, তা অল্প সময়ে কেটে যায়। কিন্তু আলোর যে প্রচণ্ড আঘাত চোখের উপর পড়েছিল, সেটাই ক্ষতি করেছে চোখের পেছনের সেলগুলোর। সেলগুলোকে আপাতত প্রাণহীন করে ফেলেছে।’ আমি বললাম।
‘ডক্টর, আপনি বললেন, চোখের সামনের সেল মোটামুটি ভালো আছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চোখের পেছনের সেলগুলো। প্রচণ্ড আলোর কারণে ক্ষতি হয়ে থাকলে চোখের সামনের সেল ক্ষতি হলো না, পেছনের সেল হলো কেন?’ সম্রাট চতুর্থ অটো বললেন।
আমি বললাম, ‘এক্সিলেন্সি, চোখ অনেক অনেক প্রশস্ত। কিন্তু তার পেছনে মস্তিষ্কের সাথে সংযোগকারী সেল-এর চ্যানেলটা অনেক ন্যারো। যে পরিমাণ আলো যে তীব্রতা নিয়ে চোখের উপর এসে পড়েছিল, সেই আলো সেই তীব্রতা নিয়ে যখন চোখের পেছনের সেল-এর ন্যারো চ্যানেলে প্রবেশ করে, তখন স্বল্প পরিসরের চাপে আলোর আঘাতের প্রচণ্ডতা বহুগুণ তীব্রতর হয়ে উঠে। সেই আঘাতে টিস্যুগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে।’
সম্রাট চতুর্থ অটো’র মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আমাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘ডক্টর, আমি যেমনটা ভাবছিলাম তার চেয়ে আপনি অনেক বড় ডাক্তার। আপনি যে পরীক্ষা করলেন, সে ধরনের পরীক্ষার কথা অন্য কোন ডাক্তার বোধ হয় চিন্তাই করতে পারেনি। আপনি রোগের যে কারণ ধরেছেন, সে কারণও কেউ ধরতে পারেনি। সত্যি আমি দারুণ বিস্মিত হয়েছি, আপনি এইমাত্র চোখের পেছনের সেল নিষ্ক্রিয় হওয়ার যে কারণ বললেন, তা শুধু বড় ডাক্তার হওয়া নয়, শারীরিকবিজ্ঞান সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের পরিচায়ক। ঈশ্বরকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে আপনার দেখা এভাবে আমরা পেয়েছি। এখন বলুন ডক্টর, রোগের কারণ তো জেনেছেন, এখন চিকিৎসা সম্পর্কে বলুন। যে কোন কিছুর বিনিময়ে আমার একমাত্র ছেলে যুবরাজ তার চোখের আলো ফিরে পাক।’
সম্রাটের শেষের কথা ভারি হয়ে উঠেছিল।
‘মানুষের কাজ মাত্র চেষ্টা করা ফল দেন স্রষ্টা। ডাক্তাররা সবসময় আশাবাদী হয়। আমিও আশাবাদী সম্রাট। আজ যুবরাজকে আমার দেখা হয়ে গেছে। কাল আমি চিকিৎসা শুরু করব।’ আমি বললাম।
পরদিন চিকিৎসা আমি শুরু করলাম। রাতভর আমি ভেবেছি। চোখের পেছনের সেলগুলোকে যদি তাজা না করা যায়, তাহলে যুবরাজের চোখ ভালো হবে না। আর মনে মনে ভাবলাম মরে যাওয়া সেল ভালো করার ট্রেডিশনাল কোন ওষুধ বর্তমান ওষুধ বিজ্ঞানে নেই। ভরসা যে কিছু সেল এখনও জীবন্ত আছে। সেলগুলোতে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী স্টিমুলেটিং কিছু ওষুধ প্রয়োগ করলে জীবন্ত সেল থেকে একটা চাঞ্চল্য মৃত টিস্যুগুলোর উপর ছড়িয়ে পড়তে পারে। তার সাথে সেলগুলোকে ভিজিয়ে রাখার ব্যবস্থা ভালো ফল দিতে পারে। এজন্যে যুবরাজের মাথায় সর্দি সৃষ্টি করতে হবে যাতে নাকের সাথে চোখ দিয়েও প্রচুর পানি গড়ায়। এই চিন্তা মাথায় আসায় আমি খুব খুশি হলাম। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম।
সকালেই আমি প্রথমেই সম্রাটের বাগান ঘুরে প্রয়োজনীয় ওষুধের গাছ ও সম্রাটের ভাণ্ডার থেকে কিছু অনুপান যোগাড় করলাম। দুই ধরনের ওষুধ তৈরি করলাম। এক, খাবার ওষুধ ও চোখে ফোঁটা আকারে প্রয়োগের জন্যে টিস্যুর উপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী স্টিমুলেটিং ওষুধ এবং দুই, মাথায় সর্দি সৃষ্টির জন্যে কপালে লাগানোর জন্যে প্রলেপ। ক্যাথারিনার বাবা সব সময় আমার সাথে থেকে আমাকে সাহায্য করলেন। সেই সাথে সম্রাটের লোক ও চিকিৎসকরাও চাহিদা মোতাবেক সব কিছু সরবরাহ করলেন।
সেদিন বেলা দশটায় সম্রাটের উপস্থিতিতে যুবরাজের চিকিসা শুরু হলো। আল্লাহর কাছে যুবরাজের শেফা প্রার্থনা করে যুবরাজকে ওষুধ খাওয়ালাম এবং চোখেও কয়েক ফোঁটা ওষুধ ফেললাম। পরদিন দুপুরের পর ভাটি বেলা শুরু হলে যুবরাজের কপালে প্রলেপ লাগালাম। এর পরদিন দুপুর থেকেই যুবরাজের ভীষণ সর্দি এল। নাক ও চোখ দিয়ে প্রচুর পানি পড়তে লাগল। সেই সাথে শুরু হলো হাঁচি। ওষুধ খাইয়ে চললাম নিয়ম মত। সর্দিতে বাধা দিলাম না।
উত্তেজনার মধ্যে কাটল সাত দিন। আমি আল্লাহর উপর ভরসা হারাইনি। সাত দিন পর সর্দি কমতে শুরু করল। হাঁচি থাকল না। নাক ও চোখ দিয়ে পানি পড়া বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু অপার আনন্দের মধ্যে দেখলাম চোখ দু’টি আর আগের মত শুকনো নয়। চোখে সজীব-সজলতা ফিরে এসেছে। চোখের পেছনের সেই টিস্যুগুলো জীবন্ত হওয়ার লক্ষণ নিশ্চয় এটা। আমি সম্রাটকে বললাম, এক্সিলেন্সি, আগামী তিন দিন কালো কাপড় দিয়ে যুবরাজের চোখ ঢেকে রাখতে হবে এবং পরবর্তী সাত দিনে সরাসরি আলো প্রবেশ করে না এমন একটা আলো-আঁধারী ঘরে যুবরাজকে রাখতে হবে।
এই ব্যবস্থা করা হলো। দশ দিনের তিন দিন যাবার পর কালো কাপড় চোখ থেকে সরাবার সময় দেখা গেল আলো-আঁধারী ঘরের সব কিছু দেখতে পাচ্ছে, তবে ঝাপসা। সম্রাট আনন্দে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘তুমি অসম্ভব একটা বাঁধনে আমাকে বেঁধে ফেললে। তুমি…।’
আমি সম্রাটকে বাধা দিয়ে বললাম, ‘এক্সিলেন্সি, যুবরাজের সামনে এসব কথা আর নয়। তাকে একেবারে শান্ত হতে হবে।’ এরপর যুবরাজের কাছে গিয়ে বললাম, ‘যুবরাজ আনন্দের কিংবা দু:খের কোন চিন্তাই মনে আনবেন না। মনকে আত্নস্থ করে শুধু ঈশ্বরের কথা ভাবুন।’
‘স্যরি ডক্টর। আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। আপনি ঠিকই বলেছেন। যুবরাজের স্নায়ুতে কোন প্রকার প্রেসার আনা যাবে না। আমি এবং ওর মা-সহ আমরা বরং কেউ এখানে আর না আসি। মি. ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক কোন খবর আপনার তরফ থেকে থাকলে আমাদের জানাবেন।’ বলল সম্রাট চতুর্থ অটো।
‘হ্যাঁ, সেটাই ভালো সম্রাট। আমি ঠিক ১১তম দিনে যুবরাজকে আধো অন্ধকার ঘর থেকে বাইরে নিয়ে যাব। ঐ দিন আপনারা সকলে আসুন।’ বললাম আমি।
এগারতম দিনে সম্রাট এলেন, সম্রাজ্ঞীও এলেন। রাজপরিবারের সবাই এলেন। আগে থেকেই আমি ও ক্যাথারিনার বাবা ছিলাম। আগের দিন আমরা যুবরাজকে ট্রায়াল দিয়েছিলাম তার চোখের ইনডিউর্যা্ন্স লেভেল দেখার জন্যে। ঘরের সব জানালা-দরজা খুলে দেয়া হয়েছিল। আলোতে ঘর ভরে গিয়েছিল। যুবরাজের চোখ সবকিছুই ভালোভাবে দেখেছিল। চোখে তার অসুবিধা হয়নি। যুবরাজকে শোয়া থেকে বসাচ্ছিলাম, তখন সে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। বলেছিল, ‘স্যার, আমাকে এক্সিলেন্সি বলবেন না। আপনি আমার কাছে ঈশ্বরের মত। আমার নতুন জন্ম হয়েছে আপনার হাতে।’
আমি যুবরাজকে সান্ত্বনা দিয়ে তার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, যুবরাজ, এসব কথা এখন নয়। আপনাকে আবেগ থেকে মুক্ত ও সম্পূর্ণ শান্ত থাকতে হবে। আমি সামান্য ডাক্তার মাত্র। আমি চেষ্টা করেছি, স্রষ্টা ফল দিয়েছেন, সব সময় তাঁর কথা স্মরণ করুন এবং তাকে ধন্যবাদ দিন।’
এগারতম দিন সকাল ১০টা। সম্রাট, সম্রাজ্ঞীসহ পরিবারের সকল সদস্য ঘরের বাইরে দাঁড়িয়েছিল উদগ্রীবভাবে।
আমি যুবরাজকে নিয়ে ঘর থেকে বেরুলাম। আমার পাশে ক্যাথারিনার বাবা ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক।
ঘর থেকে বেরিয়ে দরজায় আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম। ঘরের বাইরে বিশাল একটা লাউঞ্জ, কার্পেটে মোড়া, সোফায় সাজানো। সম্রাট-সম্রাজ্ঞীসহ সকলে লাউঞ্জের মাঝখানে ঘরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
আমরা দরজায় এসে যুবরাজকে বললাম, আপনি গিয়ে পিতা-মাতা ও সবার সাথে মিলুন। যুবরাজ ওদিকে ওগোলেন।
সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর যুবরাজ একে-একে পরিবারের সবার সাথে মিশলেন।
এরপর সকলে মিলে হাঁটু গেড়ে বসে হাত উপরে তুলে প্রার্থনা করতে লাগল। আনন্দে স্রষ্টার অসীম শ্রদ্ধায় সবাই শিশুর মত কাঁদল।
প্রার্থনা শেষে সম্রাট আমাদের ডাকলেন। আমি ও ক্যাথারিনার বাবা সেখানে গেলাম। সম্রাট আমাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং আবেগে কেঁদে ফেলে বললেন, ‘ঈশ্বর আপনাকে পাঠিয়েছেন আমার এ সন্তানের জন্যেই। তা না হলে আমাদের স্বপ্নের দেশ কর্ডোভার ডাক্তার আমাদের ঘরে আসবেন কি করে! ডক্টর আপনাকে ধন্যবাদ দেবার কোন ভাষা আমার জানা নেই। বিস্ময়কর আপনার রোগের কারণ অনুসন্ধান, আরও বিস্ময়কর আপনার চিকিৎসা!’ বলে সম্রাট আমাকে ছেড়ে দিয়ে হাততালি দিলেন।
সুশোভিত এক বড় ট্রে নিয়ে প্রবেশ করল একজন খাস পরিচারিকা এসে বাউ করে সম্রাটের পেছনে দাঁড়াল। সম্রাটের পিএস এসে ট্রের উপরের কাপড় তুলে নিল। ট্রে’তে সোনার উপর হীরকখচিত একটা মুকুট। তার পাশে সম্রাটের ফরমান দণ্ডে লাল কাপড়ে জড়ানো কিছু।
সম্মানজনক দূরত্ব বজায় রেখে আমরা গিয়ে সম্রাটের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম।
সম্রাট ট্রে থেকে প্রথমে ফরমান আকারের বান্ডেলটা খুললেন। তারপর সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যে ঘোষণা দিচ্ছি এখানে, তা আমি দরবারেও দিতে পারতাম। কিন্তু বিষয়টা আমার পারিবারিক। তাই পারিবারিকভাবেই ঘোষণা দেবার সিন্ধান্ত নিয়েছি।’
একটু থামলেন সম্রাট। তারপর আবার শুরু করলেন, ‘ঈশ্বরকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে তিনি দয়া করে আমার যুবরাজকে নতুন চক্ষু দান করেছেন। আমি ঈশ্বরকে আরও ধন্যবাদ দিচ্ছি এই কারণে যে, যার উপলক্ষে আমি আমার সন্তানের চোখ ফিরে পেলাম, সেই মহান ডক্টর কর্ডোভার মানুষ। কর্ডোভার সুলতানরা ছিলেন আমাদের স্যাক্সন রাজবংশের ঐতিহাসিক মিত্র, যদিও সে সময়ের অবস্থা ও ষড়যন্ত্রের কারণে আমরা দুই মিত্র মিলে বড় কিছু করতে পারিনি। কর্ডোভার এই মহান ডাক্তার যে ঋণে আমাকে এবং স্যাক্সন রাজবংশকে আবদ্ধ করেছেন তা শোধ করার সাধ্য আমার নেই। তবে তাঁর এই অবদানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে কিছু একটা করার সিন্ধান্ত আমি নিয়েছি।’
বলে তিনি হাতের ফরমান মোড়কটা খুললেন। পড়লেন ফরমানটা। সম্রাটের সে ফরমানের সারাংশ হলো, ‘সালজওয়াডেল অঞ্চলে আমার বিশেষ অমাত্য ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিকের জমিদারির পাশে ৪১ মৌজার মনোরম ভূখণ্ডটি আমি ডাক্তারকে লাখেরাজ হিসেবে দান করলাম। বংশ পরম্পরায় তিনি স্থায়ীভাবে তা ভোগ-দখল করবেন। দু’একদিনের মধ্যে আমি সেখানে নিজে গিয়ে তাকে দখল বুঝিয়ে দেব।’
বলে তিনি এগিয়ে এসে আমার হাতে ফরমানটি গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘প্লিজ ডক্টর গ্রহণ করুন। আমি ও আমার পরিবার খুশি হবো।’
এরপর সম্রাট ট্রে থেকে মুকুটটি তুলে নিলেন। তিনি সবার উদ্দেশ্যে বললেন, আমি মুকুটটি তৈরি করেছিলাম যুবরাজের জন্যে। কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছা অনেক মাপজোখ করে তৈরি করা সত্ত্বেও মুকুটটি বড় হয়েছে যুবরাজের মাথায়। হয়তো ঈশ্বর সম্মানিত ডক্টরের মাথার জন্যেই এটা তৈরি করিয়েছিলেন। আমি যুবরাজের রোগমুক্তির মহাস্মৃতি হিসেবে মুকটটি ডাক্তারের মাথায় পরিয়ে দিতে চাই।’
সম্রাট এটা বলে-আমি সব কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুকুটটি আমার মাথায় পরিয়ে দিয়ে আমার দু’টি হাত ধরে বললেন, ‘ডক্টর আপনাকে সম্মানিত করার জন্যে এ মুকুট নয়, আমরা সম্মানিত বোধ করব যদি দয়া করে এটা নেন। এ মুকুট যতদিন থাকবে, ততদিন মানুষের ভয়াবহ এক অন্ধত্ব ও বিস্ময়কর এক নিরাময়ের কথা মানুষ স্মরণ করবে। কর্ডোভার মহান জাতি এবং জার্মানীর স্যাক্সনদের সম্পর্কেরও ঐতিহ্যবাহী এক স্মারক হবে এটা।’
এভাবেই আমি একটা জমিদারি ও স্যাক্সন সম্রাটের অকল্পনীয় মূল্যের একটা মুকুটের মালিক হয়ে গেলাম।
যুবরাজের জন্যে সাত দিনের ওষুধের ব্যবস্থা করে সাত দিন পর আবার আসব বলে আমি ক্যাথারিনার বাবার সাথে সালজওয়াডেলে চলে এলাম সম্রাটের দেয়া ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে।
আমি ও ক্যাথারিনার বাবা পাশাপাশি বসেছিলাম। বিভিন্ন কথার ফাঁকে এক সময় বললেন, ‘তোমার অনুমতি ছাড়াই একটা আয়োজন করে ফেলেছি। তুমি কিছু মনে করবে না তো?’
‘কি আয়োজন জনাব?’ আমি বললাম।
‘সেদিন বিয়ের কথা হয়েছিল। আগামী কাল তারই আয়োজন করা হয়েছে। তুমি চিকিৎসার চিন্তা নিয়ে ব্যস্ত ছিলে তাই তোমাকে কিছু বলিনি।’
বিয়ে হবে এবং খুব শীঘ্রই হবে, সেটা সেদিনের আলোচনায় আমি বুঝেছিলাম। সুতরাং বিষয়টা আমার কাছে বিস্ময়ের ছিল না। তবু আমি বললাম, ‘ক্যাথারিনার সুস্পষ্ট মত নেয়া দরকার ছিল, সেটা হয়েছে কি না?’
‘আমি ক্যাথারিনাকে জানি বেটা। আমার শ্যালক অসওয়ার্ল্ড তার ভাগ্নিকে না জানিয়ে এ প্রস্তাব পেশ করেনি। তুমি ভেবো না। ক্যাথারিনার মা তার সাথে আলোচনা করেই দিন ঠিক করেছে।’
আমি আর কোন কথা বললাম না। একটা অস্বস্তির ভাব আমার মনকে আচ্ছন্ন করে তুলল। প্রেমময়ী স্ত্রীর স্মৃতি ডিঙিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্যেই কি এই অস্বস্তি? না, মন তা বলছে না। নতুন স্ত্রী যে নেই তার স্মৃতির প্রতিদ্বন্ধী হতে পারে না।
আমার চিন্তায় ছেদ টেনে ক্যাথারিনার বাবা বলে উঠলেন, ‘একটা সমস্যা হয়েছে আলগার। ক্যাথারিনা বলেছে, ‘বিয়ে ইসলাম ধর্মের বিধান মতে হবে। কিন্তু…।’
তাঁর কথার মাঝখানেই আমি বলে উঠলাম, ক্যাথারিনা বলেছেন একথা?’
‘হ্যাঁ আলগার, তার মায়ের কাছে শুনেছি সে ইসলাম ধর্ম মোতাবেক চলার চেষ্টা করছে।’ বললেন ক্যাথারিনার বাবা।
বিস্ময়ের ব্যাপার এই কথা শোনার সাথে সাথেই আমার মনের অস্বস্তি কোথায় যেন চলে গেল। মনটা আমার স্বচ্ছ হাসিতে হেসে উঠল।
ক্যাথারিনার বাবা একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘কিন্তু সমস্যা হয়েছে বিয়ের ব্যাপারে ইসলাম ধর্মের বিধান তো আমরা কেউ জানি না। শেষে এটাই আলোচনা হয়েছে। তুমি যেভাবে বলবে সেভাবেই বিয়ে হবে। আচ্ছা বলত, ইসলাম ধর্মের বিয়েতে আনুষ্ঠানিক জটিলতা কিছু আছে?
‘জটিলতার কিছু নেই। তবে বর ও কনেকে তাদের স্বীকৃতি জিজ্ঞাসা করার জন্যে বিয়ের পরিচালক একজন লোকের দরকার হয়। বর-কনের স্বীকৃতি জানার জন্যে উভয় পক্ষের তিনজন করে মোট ছয়জন সাক্ষী উপস্থিত থাকতে হয়। প্রথমে কনের স্বীকৃতি আসার পর তা সবার সামনে ঘোষণা করে তারপরে সবার সামনে বরের স্বীকৃতি নেয় হয়। এরপর বিয়ের পরিচালক ব্যক্তি বর-কনের শুভ কামনা করে সবাইকে নিয়ে দোয়া করেন। বিয়ের মূল অনুষ্ঠান এতটুকুই।’ আমি বললাম।
‘দুই পক্ষের সাক্ষীর তো অভাব হবে না, কিন্তু পরিচালক ব্যক্তিটি কে হবেন, কে স্বীকৃতি নেবেন, কে দোয়া করবেন। এটা সমস্যা হবে না?’ বললেন ক্যাথারিনার বাবা।
‘এ সমস্যাগুলো মৌলিক নয়। বর-কনের স্বীকৃতি নেয়ার কাজ আপনিও করতে পারবেন। স্বীকৃতি নেয়ার কথাগুলোও খুব সাধারণ। আমি বলে দেব। দোয়া নিজেরা করলেও চলে, আর সকলের শুভেচ্ছা কামনাটাই তো দোয়া।’ আমি বললাম।
‘তাহলে আর কোন সমস্যা নেই। ধন্যবাদ আলগার। আমি চিন্তায় পড়েছিলাম এসব নিয়ে।’
আমরা বাড়ি পৌঁছে গেলাম। পরদিন বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের দিন সকালে ক্যাথারিনা আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। অজু করার নিয়ম শিখিয়ে দিয়েছিলাম আমি আগেই। মাথায় রুমাল বেঁধে ও হাতাওয়ালা পবিত্র পোশাক পরে পরিবারের সবার উপস্থিতিতে ঘোষণা দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল ক্যাথারিনা। হঠাৎ কি হয়ে গেল। পরিবারের কর্তা ক্যাথারিনার বাবা ফ্রেনজিস্ক ফ্রেডারিক ঘোষণা দিলেন তিনিও ইসলাম গ্রহণ করবেন। তারপর পরিবারের সবাই ঘোষণা দিল তারাও সবাই ইসলাম গ্রহণ করবে। আমার সামনে ঘোষণা দিয়ে সবাই ইসলাম গ্রহণ করল ক্যাথারিনার মতই। সবাই ইসলাম গ্রহণ করার পর আমি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম, ‘ইহুদি, খৃস্টানসহ অতীতের সব একত্ববাদী ধর্মকে ইসলাম স্বীকার করে, অতীতের সব নবী-রাসূলকে ইসলাম সম্মান করে। অতীতের এই ধর্মগুলোকে যারা পালন করে চলতে চায়, তাদের সাথে ইসলামের কোন বিরোধ নেই। তবে ইসলাম নীতিগত ও স্বাভাবিক কারণেই মনে করে, অতীতের ধর্মগুলোর কার্যকারিতা শেষ হয়ে গেছে। সর্বকনিষ্ঠ ও সামনের সর্বযুগের জন্যে পরিকল্পিত ধর্ম হিসেবে ইসলাম মানুষের আধ্যাত্নিক ও ব্যবহারিক দুই জীবনের জন্যেই অপরিহার্য একটা ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা ইসলাম আল্লাহর কোন কল্যাণ করে না, এই ব্যবস্থা ইসলাম গ্রহণকারী ও সব মানুষের কল্যাণের জন্যেই। এই কল্যাণ মানুষের ইহকাল ও পরকাল দুই কালের জন্যেই। এই মূল বিষয়টা বুঝে নিলে ইসলাম ও মানুষ, ইহজীবন ও পরজীবন সবকিছুকেই ভালোবাসা যাবে, জীবন সুন্দর হবে, সহজ হবে।’
আমার কথা শেষ হলে ক্যাথারিনার বাবা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘নানা কারণে আমাদের ইসলাম গ্রহণের এই কথা এখন গোপন রাখতে হবে। সবাই যেন আমরা এ ব্যাপারে সতর্ক থাকি।’
বিয়ের পর যখন আমার ঘরে এসে বসলাম, তখন মাথাটা নুয়ে এল আল্লাহর প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতায়। স্বাধীন মানুষ ছিলাম, খ্যাতিমান ডাক্তার ছিলাম। সেখান থেকে পেশা, পরিবার, দেশ সব হারিয়ে হলাম ক্রীতদাস। আবার ক্রীতদাস থেকে হলাম এক জমিদার এবং একজন জমিদার কন্যার স্বামী। মহান আল্লাহর বাণী, ‘ফাইন্নামা’আল উসরে ইউসরা, ইন্নামা’আল উসরে ইউসরা’ অর্থাৎ ‘দু:খের পর সুখ আসে’।
বিয়ের পর স্ত্রী ক্যাথারিনার সাথে প্রথম সাক্ষাতের সময় নানা কথার ফাঁকে তাকে বললাম, ‘ক্রীতদাসের সাথে বিয়ের পর মালিক-কন্যার প্রতিক্রিয়া কি?’
ক্যাথারিনা বলল, ‘যে ক্রীতদাস তার মালিকদের দাস বানিয়ে ফেলেছে, তার সাথে বিয়ে তো সৌভাগ্যের ব্যাপার।’
‘মালিকদের কিভাবে সে দাস বানাল?’ আমি বললাম।
‘আল্লাহ বলেছেন, যে মুমিন হয়, আল্লাহ তার জান, মাল সব কিনে নেন। আপনি সবাইকে মুমিন বানিয়ে তাদেরকে আল্লাহর ক্রীতদাস করে ফেলেছেন।’ বলল ক্যাথারিনা।
আমি হাসলাম। বললাম, ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কথার অর্থ ঠিক এতটুকু নয়। যাক তুমি ভালো বলেছ।’
ক্যাথারিনা বলল, ‘আমার কথা শেষ নয়। আমার উত্তরের মাত্র একাংশ বলেছি।’
‘আচ্ছা। বল বাকি অংশ কি?’ জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
‘ক্রীতদাসকে আমি বিয়ে করিনি। ক্রীতদাসের সাথে আমার বিয়ে হয়নি। একজন স্বাধীন মানুষ এবং একজন জমিদারের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে।’ বলল ক্যাথারিনা।
সেদিন আমার স্ত্রী ক্যাথারিনার কাছ থেকে শোনা কথা দিয়েই আমার এই ছোট্ট আত্নকথা শেষ করব। আমি দাস হিসেবে বিয়ে করিনি, দাস হিসেবে আমার পরিবার-জীবনের যাত্রা শুরু হয়নি, হয়েছে স্বাধীন মানুষের স্বাধীন পরিবার হিসেবে। এই কথাগুলো এভাবে বলার প্রয়োজন ছিল না। বলতে হলো এই কারণে যে, অন্ধকার ইউরোপের অন্ধ-কূপমণ্ডুকতা কাটতে আরও অনেক শতাব্দীর প্রয়োজন হবে। সেই অন্ধকারে আমার পরিবারও নিজেদের হারিয়ে ফেলতে পারে। তারাও কূপমণ্ডুকতার শিকার হয়ে হীনমন্ন্যতায় ভুগতে পারে। এমন সব দিনের কথা ভেবেই আমি আমার জীবনের কথা লিখে গেলাম যাতে তাদের আবার আলোকিত হয়ে ওঠার পথ তৈরি হয়, নিজের পরিচয় নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবার তারা সুযোগ পায়।’
[ এটি আমার লেখা না। রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজ সাইমুম-৫২ থেকে নেওয়া ]

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০৯ ই অক্টোবর, ২০১৬ ভোর ৫:২০

রক্তিম দিগন্ত বলেছেন:
এটা পড়েছিলাম।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.