নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

তোমরা মানুষ, আমরা মানুষ, তফাৎ শুধু শিরদাঁড়ায়

যাযাবর চিল

i agree to disagree...

যাযাবর চিল › বিস্তারিত পোস্টঃ

একটি নন-গ্লামারস গনহত্যা

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:৪৫

#০১
"... ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক ঢাকা ও দেশের অন্যান্য স্থানে সূচিত 'ক্র্যাক ডাউনের' মাধ্যমে নির্বিচারে হাজার হাজার বাঙালিকে হত্যা, নারী ধর্ষণ ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের খবরে পাবনার পাকশী এলাকার মুক্তিকামী বাঙালিরা এমনিতেই ছিল ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত। তার ওপরে হানাদার বাহিনী ১০ এপ্রিল নগরবাড়ীর প্রতিরোধ চূর্ণ করে পাবনা শহরের দিকে এগিয়ে আসার সময় রাস্তার দু'পাশের বাড়িঘরগুলোতে অগ্নিসংযোগ এবং নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শত শত বাঙালিকে হত্যা করে। এ খবরও পাকশীতে পৌঁছায়। তাছাড়া ১০ এপ্রিল পাকশী ছাত্রলীগের সশস্ত্র কর্মীরা কিছু কিছু স্থানীয় বিহারির চালচলনে বুঝতে পারে যে, বিহারিদের মধ্যে অনেকে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর আগমন প্রতীক্ষায় সময় গুণছে। হানাদার বাহিনী আসার সাথে সাথেই তারা বাঙালিদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে।

এ রকম আশঙ্কা ও সন্দেহ থেকেই ১০ এপ্রিল রাতে ছাত্রলীগের একটি সশস্ত্র গ্রুপ বিহারি রেল-কর্মচারি জহির আনছারীর বাড়িতে তল্লাশি চালায়। এ সময়ে জহির আনছারীকে বাসায় না পাওয়া গেলেও, তার শোয়ার ঘরের বিছানার তলা থেকে একটি অবৈধ পিস্তল পাওয়া যায়। ফলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়। এরপর স্থানীয় নেতৃবৃন্দ সন্দেহজনক ও ক্ষতিকর প্রায় ২০-২৫ জন বিহারিকে চিহ্নিত করেন। ঐ রাতেই এদের মধ্যে ১৭-১৮ জন বিহারিকে ধৃত করে পদ্মা নদীর দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু পথিমধ্যে বিহারিরা একযোগে ছাত্রলীগের সশস্ত্র গ্রুপটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় গুলিতে কয়েকজন বিহারি নিহত হয়। অন্যরা পালিয়ে যায়।

পরদিন সকালেই পাকশীতে খবর আসে যে, আগের দিন পাবনা শহর পাকিস্তানি বাহিনী অধিকার করে নিয়েছে এবং আজ সকালে হানাদার বাহিনী ১০ এপ্রিলের মতোই রাস্তার দুঽপাশের বাড়িঘর পুড়িয়ে এবং নির্বিচারে বাঙালিদের হত্যা করতে করতে ঈশ্বরদীর দিকে আসছে। এই খবর পাওয়ার পর পাকশীর সশস্ত্র আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের কর্মীরা এবং তাদের সাথে এর মধ্যেই পাবনার দিক থেকে এসে যোগ দেয়া কিছু ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্য পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক পাকশী অধিকৃত হওয়ার আগেই পাকিস্তানপন্থি বিহারিদের হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। এরা তখনই আশঙ্কা করেছিলেন যে, পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক একবার অধিকৃত হওয়ার পর এসব বিহারি হানাদার বাহিনীর সহায়তায় বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১১ই এপ্রিল সকালেই পাকশীতে বসবাসরত সকল বিহারিকে পরিবার-পরিজনসহ পাকশীর একমাত্র উর্দু মিডিয়াম মুসলিম হাইস্কুলে সমবেত হওয়ার জন্য নির্দেশ জারি করা হয়। তাদেরকে আশ্বাস দেয়া হয় যে, সকল বিহারির নিরাপত্তার জন্যই এটা করা হচ্ছে এবং এখানে জমায়েত হলে তাদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা হবে। এই আশ্বাসের পর প্রায় চার-পাঁচশ বিহারি নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ এসে অল্পক্ষণের মধ্যেই জমায়েত হয়েছিল মুসলিম স্কুল প্রাঙ্গণে।

এরপর দুপুর নাগাদ নারী ও শিশুদের স্কুলের একটি বড় কক্ষে ঢোকানো হয় এবং অন্যদের তিন-চার লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। পরে ঘরের ভেতরে বন্দি নারী-শিশুদেরও জানালা দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।

এদিকে এ সময়ে ঈশ্বরদীর দিক থেকে মর্টার ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গোলাগুলির শব্দ পাকশীর দিকে ক্রমশ এগিয়ে আসতে শোনা যাচ্ছিল। এ অবস্থায় তড়িঘড়ি করে নিহত বিহারিদের লাশ ট্রাকে করে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে পদ্মা নদীতে ফেলার কাজ শুরু করা হয়। কিন্তু দুই ট্রাক লাশ এভাবে ফেলার পর পরই মর্টার শেল ও গুলি ছুড়তে ছুড়তে এবং রাস্তার দু'পাশে বাড়িঘর ও দোকানপাটে আগুন লাগাতে লাগাতে পাকিস্তানি বাহিনী পাকশীর কাছাকাছি চলে আসে। সন্ধ্যার আগেই হানাদার বাহিনী পাকশীতে অবস্থান নেয়॥"

- কামাল আহমেদ / '৭১ চেতনায় অম্লান ॥ [ র‍্যামন পাবলিশার্স - ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ । পৃ: ৯২-৯৪ ]

#০২
"... পাকশী। ১০ই এপ্রিল, ১৯৭১। রেলওয়ে কলোনীর অধিবাসীদের শান্তি কমিটি গঠন করার অজুহাত দেখিয়ে প্রতারিত করা হয়। তাদের একটা হাই স্কুল ভবনে আটকে রেখে জীবিত অবস্থায় পুড়িয়ে মারা হয়েছিলো। প্রায় ২ হাজার লোক নিহত হয়॥"

- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : পাকিস্তান সরকারের শ্বেতপত্র / সম্পা : বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর ॥ [ আগামী প্রকাশনী - ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৩ । পৃ: ১৪৭ ]

#০৩
"... ১০ এপ্রিল পাবনার তৎকালীন জেলা প্রশাসক জনাব নুরুল কাদের খানের নির্দেশে পাকশীতে সন্ধ্যে থেকে ভোর রাত পর্যন্ত কারফিউ জারি করা হয়। বিস্ময়কর ব্যাপার, করাচি রেডিও স্টেশন থেকে ঐ দিন রাতেই এখানে কারফিউ জারি করা সংক্রান্ত খবর প্রচার করা হ'ল। কী করে এ খবর এত তাড়াতাড়ি করাচিতে গিয়ে পৌঁছুল, এ ব্যাপারে সকল সন্দেহ গিয়ে পড়লো রেলওয়েতে কর্মরত অবাঙালি কর্মচারি জহির আনসারির ওপর। সে রাতেই আব্দুর রহিম চিনুর নেতৃত্বে একটি দল জহির আনসারির বাড়িতে তল্লাশী চালায়। কিন্তু জহির আনসারিকে সে রাতে বাসায় পাওয়া গেল না। তার বিছানা তল্লাশী করে পাওয়া গেল একটি পিস্তল। আর এ থেকেই পাকশীর সকল অবাঙালীকে সন্দেহের চোখে দেখার কাজটি শুরু হলো।

ঐ রাতেই আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নেন, ক্ষতিকর এবং সন্দেহভাজন অবাঙালিদের শাস্তির বাইরে রাখলে চলবে না। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রায় সতেরোজন সন্দেহভাজন ও ক্ষতিকর অবাঙালিকে বন্দী করে পদ্মা নদীর ধারে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে নিয়ে যাওয়ার সময় মেরিন পাড়ার কাছে আসতেই আকস্মিকভাবে তারা প্রতিরোধ বাহিনীর সদস্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে প্রতিরোধ বাহিনীর গুলিতে সে রাতেই তিনজন অবাঙালি মারা যায়।

পাকবাহিনী পাবনায় তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে - ১১ এপ্রিল এই মর্মে এক খবর পাকশীতে পৌঁছতেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব অবাঙালিদের বাঁচিয়ে রাখা আর নিরাপদ ভাবলেন না। তাই সমস্ত অবাঙালিকে পাকশীর অবাঙালিদের একমাত্র স্কুল, মুসলিম স্কুলে সমবেত হওয়ার নির্দেশ দেয়া হ'ল।

সকাল থেকেই প্রায় চার-পাঁচ শত অবাঙালি সমবেত হ'ল মুসলিম স্কুলে (বর্তমানে পাকশী রেলওয়ে কলেজ)। তাদেরকে আশ্বাস দেয়া হয়েছিলো এই বলে যে, বাইরের গ্রাম থেকে আসা বাঙালিরা যাতে তাদের জান-মালের ক্ষতি করতে না পারে সে জন্য তাদেরকে মুসলিম স্কুলে রেখে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হবে। সেই মিথ্যে আশ্বাসে বিশ্বাস করে এরা দলে দলে এসেছিলো বাঁচার নিশ্চয়তার আশায়। এই অবাঙালিদের অধিকাংশই ছিলো খেটে খাওয়া ছাপোষা মানুষ। অসহযোগ আন্দোলনের ফলে তাদের অনেকেই কাজ না পেয়ে দু'তিনদিন অভুক্ত অবস্থায় ছিলো। দুপুর নাগাদ সকল অবাঙালিকে তিনটি লাইনে দাঁড় করিয়ে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করা হ'ল। একজন ইপিআর-এর নির্দেশে অবশিষ্ট নারী ও শিশুকে একটি কক্ষে বন্দী করে জানালা দিয়ে পেট্রোল ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এর পরই শুরু হয় মুসলিম স্কুলে সমবেত হয়নি, অথচ রেলওয়ে কলোনিতে প্রাণভয়ে আত্মগোপন করে আছে এমন অবশিষ্ট অবাঙালিকে খুঁজে খুঁজে মারার পালা। অবশ্য এ ব্যাপারে প্রতিরোধ বাহিনী বা ইপিআর-রা অংশ নেয়নি। কিছুসংখ্যক সুযোগ সন্ধানী গুন্ডাপান্ডা লুটপাটের আশায় কলোনিতে এ হত্যাকান্ড চালায়।

দুপুর একটার দিকে নঈম সাহেবের বাসায় এইসব দুর্বৃত্ত ঢুকে একে একে সবাইকে গুলি করে। তারা বেরিয়ে যাওয়ার পর ভেতরে গিয়ে দেখা গেল, সবাই মারা গেছে শুধু একটি শিশু তার রক্তাপ্লুত মায়ের বুকে মাথা রেখে কাঁদছে। এ সময় এমন কিছু অবাঙালিকেও হত্যা করা হয়েছিলো যারা একাত্ম হয়ে গিয়েছিলো বাঙালিদের সাথে। এজাজ নামে একজন অবাঙালি যুবক, যার প্রায় সকল বন্ধুই ছিলো বাঙালি, যে সুন্দর বাংলা বলতে পারত, নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয়ও দিত, মুসলিম স্কুল থেকে দৌড়ে বেরিয়ে এসেও শেষ পর্যন্ত সে বাঁচতে পারেনি। সে তার বন্ধুদের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলো। তাতেও কিছু হয়নি। তার সহপাঠী এক বন্ধুর বুলেটের আঘাতেই তাকে দিতে দিতে হয়েছিলো প্রাণ।

বোরহান খাঁ, উর্দু কবি, উত্তরবঙ্গের প্রতিটি 'মুশায়েরা'য় যিনি কবিতা পাঠ করতেন, সেই আত্মভোলা মানুষটিও সেদিন বাঁচতে পারেনি। মুজিব, যে পড়তো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, তাকে তার বন্ধুরাই জামে মসজিদের পাশে এনে হত্যা করে॥"

- আবুল কালাম আজাদ / মুক্তিযুদ্ধের কিছু কথা : পাবনা জেলা ॥ [ জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী - জুলাই, ১৯৯১ । পৃ: ২৩-২৫ ]

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১:৩২

জগতারন বলেছেন:
জাতি-র গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস "মহান বিজয় দিবস"-এর প্রাক্কালে,
আজ আবারো হৃদয়ে প্রশ্ন জাগে,
রক্তাক্ত মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে যে বিজয় আমরা পেয়েছি,
অর্জনের ৪৫ বছর পরেও,
আজো কেন তা সার্বজনীনতায় রূপান্তর হলো না.. ?
কেন আজো "স্বাধীনতা" সবার জন্য সমান নয়.. ??
স্বাধীনতা তুমি কার.. ???

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.